#পিঞ্জিরা
#পর্ব_১৪
#জান্নাত_সুলতানা
-“বিয়ে করবো আমি। এক্ষুণি।”
সবাই বিস্ফোরিত নয়নে তাকলো রিহান এর দিকে।ছেলে টা পাগল হয়েছে? এই অবস্থায় বিয়ে কিভাবে সম্ভব?মাথায় শুভ্র রাঙা বেন্ডেজ মোড়ানো। শরীরে বিভিন্ন অংশ ক্ষত-বিক্ষত।তখন দুপুর ছিলো।আর গ্রামের ওই সাইডে তেমন মানুষ না থাকায় কেউ এদের দেখে নি।রিহান এর যখন জ্ঞান ফিরে তখন শরীর দুর্বল আর মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা হচ্ছিল। তবে সেদিকে ছেলে টার খেয়াল ছিলো না। ঘাড় এদিক ওদিক ঘুরিয়েও যখন মিরা কে পায় নি তখন অস্থির হলো।গাড়ি থেকে নেমে মাথা চেপে ধরে কোনো রকম গাড়ি থেকে অনেক টা দূরে গিয়ে মিরা কে পেয়েছিল।জ্ঞান নেই মেয়ে টার।রিহান নিশ্চিত মিরা ব্যথা পায় নি।তবে মেয়ে টা ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলো।রিহান নিজেও হয়তো গাড়ি থেকে নেমে গেলে তার নিজের ও কোনো ক্ষতি হতো না। তবে তার শখের গাড়ি টা হয়তো আর ঠিক থাকতো না।রিহান ঝুঁকে বসে মিরা কে বারকয়েক ডেকেও যখন কোনো লাভ হয় না তখন রিহান এই অবস্থাতেই মিরা কে কোলে তুলে গাড়িতে বসায় অনেক কষ্ট। গাড়ি ঘুরিয়ে উপজেলা হসপিটাল আসতে দশ কি পনেরো মিনিট লাগে।সেখানে ব্যথায় জর্জরিত রিহান আধঘন্টায় এসে হসপিটাল পৌঁছায়। আর সেখানে গাড়ি থামাতেই অনেকে ওকে দেখে এগিয়ে যায়।আর ততক্ষণে রিহান নিজেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।কপালের ডান পাশে ভালোই জখম হয়েছে। তাই মাথা যন্ত্রণায় জ্ঞান হারায় আবারও। আর চোখ যখন খুলে তখন শেখ বাড়ির সবাই ওর সামনে উপস্থিত ছিলো।আর একে একে সবার মুখে যখন একই প্রশ্ন এসব কি করে হলো রিহান তখন নির্বিকার ভঙ্গিতে উপরোক্ত ইচ্ছে টা সবাই কে জানালো।
রিহান এর বাবা স্ত্রী রেহনুমা বেগমের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো।রেহনুমা বেগম স্বামীর চাহনি দেখে ঘাবড়ে গেলেন।শাশুড়ির আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। রমজান শেখ গম্ভীর। তিনি আগেই আন্দাজ করেছিলো কিছু একটা গড়বড় আছে। যে নাতি তার আগে মাস ছয় মাস পর গ্রামে আসতো সেই নাতি এখন সপ্তাহ, পনেরো, তিন দিন কিংবা রোজ আসতো।শুধু মাঝে সুইজারল্যান্ড ছিলো বলেই ব্যাপার উনার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তবে রিহান যে কোমন সেটা আর কেউ জানে আর না জানে বড়রা তো জানে।সবাই রমজান শেখ কি বলবে সেই অপেক্ষা করছে। বেশ কিছু সময় নীরবতা চলে।অতঃপর রমজান শেখ শান্ত স্বরে বললো,
-“তুমি সুস্থ হউ আগে দাদু ভাই। আমরা মেয়ে দেখে রাখবো।তুমি সুস্থ হলেই তোমার বি,,
-“আমি সুস্থ।”
-“কিন্তু এতো দ্রুত মেয়ে কোত্থেকে পাবো?তাছাড়া তোমার হঠাৎ এমন অবস্থায় বিয়ে কেনো করতে ইচ্ছে হলো?”
ইফাদ এর বাবা ইব্রাহীম শেখ এর প্রশ্ন টা হয়তো লজ্জাজনক। সবার চোখে-মুখে চঞ্চলতা ফুটে উঠলো। অপ্রস্তুত হলো সবাই। এমন প্রশ্ন কাকা হয়ে ভাইয়ের ছেলে কে করা টা নির্লজ্জ এর পরিচয় বহন করে। কিন্তু এখন সেটা করলো না। তার কারণ টা রিহান নিজেই।
সবাই কে বিষয় টা ভাবালো।ছেলে টা হঠাৎ এক্সিডেন্ট করে কি মাথায় আঘাত লেগে স্মৃতি শক্তি হারিয়ে গেলো।কিন্তু ডক্টর যে বললো ক্ষত তেমন গভীর নয় তাই দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই!
ইব্রাহিম স্ত্রী কে ইশারা করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।রেহনুমা বেগম আতংকিত। শাশুড়ী কে সাথে নিয়ে বাহিরে এলো।নিনা বেগম এসেই বললো,
-“বড়বউ কিছু জানে না।ওরে কিছু কইয়া লাভ নাই।”
-“আম্মা ওর কি হয়েছে? হঠাৎ এসব কথা? আমরা চাই রিহান বিয়ে করে। বয়স হয়েছে। তাই বলে এমন পরিস্থিতিতে?”
রিয়াজ শেখ হতবিহ্বল। নিনা বেগম কোমড় ব্যথায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না।তিনি গিয়ে একটা চেয়ারে বসেন।রেহনুমা বেগম শাশুড়ী পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নিনা বেগম ছেলে বউয়ের হাতের উপর হাত রেখে ভরসা দেন।এবার যা হবে ভালো হবে। ভালো করতে হবে। নয়তো দুই পরিবার এর অভিমান কোনো দিন মিটার নয়।তবে এটা তক্ষুণি সম্ভব হবে যখন তাহার একমাত্র মেয়ে শেখ বাড়ির প্রথম মেয়ে রমজান শেখ এর এক মাত্র কন্যা রোকেয়া শেখ চাইবে।
তবে তিনি আশায় বাঁচে। রোকেয়া নিশ্চয়ই নিজের কষ্ট টা মেয়ে কে পেতে দিবে না। এটা ভেবেই চিন্তামুক্ত থাকেন।ছেলে কে ইশারা করে পাশে বসতে বলে।রিয়াজ শেখ স্বাভাবিক ভাবে এসে মায়ের পাশে বসে।নিনা বেগম বললো,
-“জানি বোন কে তোমরা দুই ভাই নিজেদের চেয়েও বেশি ভালোবাসো।বোন স্বামী ছাড়া একা একটা বাড়িতে রয়েছে। বৃদ্ধা শাশুড়ী আর ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে কে নিয়ে সেটা আবার খুব সচ্ছলতার সাথে। এটা যে তোমার কিংবা তোমার বাপ ভাইয়ের কাজ সেটা সম্পর্কে শেখ বাড়ির সবাই অবগত। বোন কে আড়াল থেকে ও তোমরা সাহায্য করেছো।হয়তো এটা তোমাদের কর্তব্য, দায়িত্ব। কিন্তু ভালোবেসে তো করেছে।বোন কে একটা সময় তোমরা অনেক অত্যাচার করেছো।আর ভুল কিংবা ভবিষ্যতে খারাপ হবে এটা ভেবে অনেকে বোন বা নিজের মেয়ের জন্য সবাই ভালো টা চেয়ে এমন করে।ভালো সবাই চায়।কিন্তু মাঝেমধ্যে আমরা ভালো চাইতে গিয়ে নিজের অজান্তেই হয়তো তাদের মনে অনেক টা আঘাত দিয়ে ফেলি।কাছের মানুষের দেওয়া আঘাতে কষ্ট বেশি হয়।হঠাৎ যখন চোখের সামনে আপন মানুষ গুলো বদলে যায়। অন্য একটা রূপ চোখে ধরা পরে তখন হয়তো এরচেয়ে বিষাদময় অনুভূতি আর কিছু হতে পারে না। তখন আমার মেয়ে পালিয়ে গিয়ে ঠিক করে নি।তবে পালাতে কিন্তু তোমাদের জন্যেই বাধ্য হয়েছিল আমার মেয়ে। প্রথমে কিন্তু আমাদের মানাতে চেয়েছিলো।আফসোস আমরা মেনে নেই নি।
আমি চাইবো দ্বিতীয় বার তোমাদের দ্বারা যেন এমন ভুল টা আর না হয়।”
রিয়াজ শেখ মায়ের কথা শুনে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছাড়ে।সত্যি বাড়াবাড়ি টা তখন তারাই করেছিলো।বোনের ভালো চাইতে গিয়ে বোনের ভালোবাসা ভুলে গিয়েছিল। সুখ-শান্তি শুধু টাকা পয়সা অর্থসম্পদে থাকে না।ভালোবাসা থাকা টা জরুরি। আফসোস শুধু একটাই তারা ভালো চাইলেও আল্লাহ তো ভিন্ন রকম পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছিলো।যেটা কেউ জানতো না।
রিয়াজ শেখ মায়ের কথা ঠিক বুঝতে পেরেছে। তবে ব্যাপার টা পুরো টা খোলাসা করতে বলেন,
-“আম্মা আমি যদি খুব বেশি ভুল না হই তুমি মিরা’র কথা বলছো।কিন্তু মিরা অনেক ছোট। রোকু মানবে না।”
ছেলের মুখে এতো বছর পর বোনের সেই ছোট বেলার আদর করে ডাকা নাম শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে নিনা বেগম।তবে কিছু ভেবে বলে উঠলেন,
-“আর যদি তোমার বোনের মতো একই কাজ মিরা করে। তাহলে তোমরা মেনে নিবে তো?”
-“প্রয়োজনে তাই।তার আগে রোকুর সাথে এব্যাপারে কথা বলা উচিৎ।”
নিনা বেগম আড়ালে হাসে।রেহনুমা বেগম স্বস্তি পান।এটা নিয়ে অন্তত স্বামী আর তাকে কিছু বলতে পারবে না।যা রাগী মানুষ। রেহনুমা বেগম এতো যুগ সংসার করে এসছে এই মানুষ টার সাথে। অথচ আজ পর্যন্ত উনার মুখের ওপর কথা বলার সাহস হয় নি।যদিও রিয়াজ শেখ স্ত্রীর সাথে খুব নরমাল বিহেভিয়ার করেন।ভালোবাসে।আদর যত্ন সবই করে।কিন্তু তিনি নিজেই একটু চুপচাপ আর ভীতু স্বভাব এর।আর বয়সে ও খুব ছোট ছিলো বিধায় এতো বছর সংসার করে সহজ হতে গিয়েও যেন পারে না। কিংবা মানুষ টার অসম্মান হয় কোনো কথায় সেই থেকে কিছু বলে না।
—–
রিহান এর পাশের রুমের মিরা ভর্তি আছে। জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। ভয়ে পেয়েছে প্রচুর। স্বাভাবিক হতে কিছু টা সময় লাগবে। তবে তারচেয়েও বড় কথা মিরা এই মূহুর্তে ভীষণ পাগলামি করছে রিহান এর জন্য। দু’জন নার্স একজন আয়া কত বার করে বললো রিহান ঠিক আছে কিন্তু মিরা’র বিশ্বাস হচ্ছে না।বরং আরো কান্না করছে আর কি সব বিড়বিড় করছে।
রোকেয়া গিয়েছিল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। রিহান নিজের কথায় অনড়। আজই বিয়ে করবে সে।তাই রোকেয়া বেগম এর সাথে এব্যাপারে কথা বলেছে রিয়াজ।রোকেয়া শুধু বলেছে তার মেয়ে যায় চাইবে সে তাই মেনে নিবে।
তাই সবাই এসেছিল মিরা’র কাছে। কিন্তু কেবিনে এসে মিরা’র পাগলামি দেখে কেউ আর বুঝতে বাকি থাকে না। তবুও কথা ক্লিয়ার করে নেওয়া ভালো। রিয়াজ শেখ মিরা’র কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে জানালো,
-“আম্মাজান রিহান ঠিক আছে।
বিশ্বাস হয়েছে?”
মিরা মায়ের দিকে তাকায়।মা এতো নিশ্চুপ মিরা’র ভয় হতে গিয়েও হয় না।সেদিন বলা মায়ের কথা টা মনে পরে।ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে আবদার করলো,
-“আমি একটু উনাকে দেখবো মামা।”
-“অবশ্যই দেখবে।তার আগে বলো আমার মেয়ে হবে? বিয়ে করবে রিহান কে?”
মিরা’র কথা টা বুঝতে কিঞ্চিৎ সময় লাগে। কি বলেছে মস্তিষ্ক বুঝতে পেরে চোখ বড় বড় হয়।স্বপ্ন মনে হয় সব।তৎক্ষনাৎ মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারে না।শুধু ফ্যালফ্যাল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।নীরবতা যেন সম্মতির লক্ষ্মণ। রোকেয়া মেয়ের চোখের ভাষা পড়তে পারে। মেয়ে তার উত্তর না পেয়ে যে কিছু বলবে না তিনি তা ভালো করেই জানে।চোখের ইশারায় হ্যাঁ বোঝাতেই মিরাও আচমকাই বলে উঠলো,
-“আমি রাজি মামা।”
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]