পিঞ্জিরা পর্ব-২৩

0
271

#পিঞ্জিরা
#পর্ব_২৩
#জান্নাত_সুলতানা

ইফাদ অনেক চেষ্টা করেও আজ এতোদিনে শিশির এর সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি।
সবরকম চেষ্টা করেছে। আজ আবার কাজল এর কাছে কল করেছে। কাজল কে তিন চার বার কল দেওয়ার পর রিসিভ করলো। বাংলাদেশে অনেক বেলা হলেও সুইজারল্যান্ড একদম ভোর। কাজল কল রিসিভ করে বেশ রেগে বলে,

-“শ্লা। কাল রাত তিন টা বাজে কাজ শেষ করে ঘুমিয়েছি। আর তুই এতো সকাল সকাল কল করে আমার ঘুমের বারো টা বাজিয়ে দিলি!”

-“শিশির কে একটু বল না কথা বলতে প্লিজ। সারারাত ঘুমুতে পারি নি।”

ইফাদ মিনতি করে বললো। কাজল এর একটু মায়া হয়। তবে ইফাদ যা করেছে। সে-সব মনে পরে নিজে কে সামলে নেয়। শোয়া থেকে উঠে বসলো। গম্ভীর স্বরে বললো,

-“আমার বোন কে কখনো আমি কোনো ব্যাপার ফোর্স কি নি। আর করবো ও না। ওর যা ভালো মনে হবে তাই করবে। ওর ভাই হিসেবে আমি ওকে অলওয়েজ সাপোর্ট করে যাবে ওর পাশে থেকে। আর তোর বন্ধু হয়ে আমি তোকে উপদেশ দিচ্ছি চেষ্টা করতে থাক।”

ইফাদ বুঝতে পারে কাজল তাকে কোনো সাহায্য করবে না। তার নিজের কিছু করতে হবে। আর কিছুক্ষণ কথা বলে কল রাখলো ইফাদ। এরপর বেরিয়ে এলো রুম থেকে। করিডোরে এসে দেখলো রিহান মিরা নিচে যাচ্ছে। মিরা ইফাদ কে দেখে মিষ্টি করে হাসে। বিনিময়ে ইফাদ মলিন মুখে নিজেও হাসে। এরপর সে চলে এলো। ইফাদ রিহান এর কাছে এগিয়ে এসে বললো,

-“কথা ছিলো!”

রিহান কিছু বলে না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। মিরা পেছনে ফিরে শুধু এটুকু দেখলো তাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে কিছু শুনতে পেলো না। তবে ইফাদ কে যে রিহান ভালোই শাসাচ্ছে মিরা কিছু টা আন্দাজ করতে পারে। আর ভেবেও নিলো হয়তো শিশির কে নিয়ে কথা হচ্ছে দু’জন এর মাঝে। এরপর মিরা নিচে চলে এলো।

এদিকে রিহান অনেক রেগে আছে। চোখ মুখ শক্ত করে কঠিন স্বরে বললো,

-“দেখ বেশি বাড়াবাড়ি করবি না। আমার বোন শিশির। তুই তোর লিমিট এর মধ্যে থাক। নিজের মতো থাক। যা বলবি তাতে সাহায্য করবো আমি তোকে। কিন্তু শিশির এর থেকে তো দূরে ই থাক তুই।”

রিহান প্যান্ট এর পকেটে এক হাত গুঁজে আরেক হাতের তর্জনী আঙ্গুল উঁচিয়ে কথা গুলো বলে চলে গেলো সেখান থেকে। ইফাদ পেছনে মলিন মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রিহান এর কথা গুলো তার একটু খারাপ লাগে নি। বরং এসব এর জন্য নিজে কে দায়ী করলো।

——

রিহান মিরা আজ রোকেয়া বেগম এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। সকালে নাস্তা করে ওরা বেরিয়ে এলো। রিহান সেই নিজের জিপগাড়ি চালাচ্ছে। মিরা পাশে কালো একটা শাড়ী পড়ে বসে আছে তার কোলে টম। আর রিহান কালো শার্ট চোখে রোদ চশমা। হাতে কালো রঙের দামী একটা ঘড়ি শার্ট এর হাতা ফোল্ড করা। মিরা আঁড়চোখে একটু পর পর দেখে যাচ্ছে রিহান কে আর টম এর শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রিহান গম্ভীর মুখে বসে আছে।
সে যে মিরা কে দেখছে না তেমন নয়। দেখছে একটু পরপরই তবে মুগ্ধতা নিয়ে নয়। গম্ভীর মুখশ্রী পুরুষ টার। মিরা ভেবে পায় না। কিসের জন্য এমন হুতোম প্যাঁচার মতো মুখ করে রেখেছে এই রিহান ভাই। সে কারণ খুঁজতে লাগলো। তবে পাচ্ছে না। সকালেও ভালোই হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। মিরা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত রিহান তখন গম্ভীর স্বরে শুধালো,

-“বলেছিলাম বাড়ির বাইরে শাড়ী না পড়তে। তাও পড়তে হলো!”

মিরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রিহান এর দিকে। সে শাড়ী পড়তে চায় নি। কারিরা বেগম রেহনুমা বেগম এবং রিহান এর দাদি নিনা বেগম শাড়ী পড়তে বলেছে। যেহেতু নতুন বউ কিছু দিন শাড়ী পড়লে ভালো হয়। মানুষজন আসা যাওয়া করে। মিরা কিছু বলতে যাচ্ছিল এব্যাপারে। রিহান তার কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজে আগে বলে উঠলো,

-“কিছু দিন মায়ের কাছে থাক। প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা গুলো শেষ কর। আমি ঢাকা থেকে ফিরে এসে তোকে নিয়ে যাব।”

মিরা ফিরতে কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ বসে শুনে গেলো।

——

দুপুরে খাবার টা খেয়ে রিহান চলে গিয়েছে। মিরা আর তারমধ্যে এই সময়ের মাঝে একবার ও কথা হয় নি। মিরা’র অভিমান হয়। তাকে সবাই যখন শাড়ী পড়তে বলছিল তখন তো রিহান নিজেও সেখানে ছিলো। তাহলে তখন কেনো কিছু বলে নি? আর এখন এটা নিয়ে তারউপর ই বা কেনো রাগ দেখাচ্ছে! সে তো সবার মুখের উপর না বলতে পারে নি। কিন্তু রিহান তো বলতে পারতো। এতে করে মিরা’র অভিমান হলো। আজ রোকেয়া স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে। মেয়ে জামাই যাওয়ার পর সারা টা বিকেল আর কোনো কাজের ঝামেলা নেই। কমলা বেগম উঠানে গাছের পরিচর্যা করছেন। রোকেয়া তেল নিয়ে এসে দরজার সিঁড়িতে বসলেন। মিরা কে ডাকলো। মিরা আসতে রোকেয়া মেয়ে কে টেনে নিজের সামনে বসিয়ে দিলো। লম্বা কোমড়ের নিচের সমান চুল গুলোর মাঝে সিঁথি কাটলেন। মিরা টম কে কোলে নিয়ে চুপচাপ মন মরা হয়ে উঠানে কাজ করতে থাকা দাদির দিকে তাকিয়ে রইলো।

——-

বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে ভ্রমণের সবচেয়ে সহজ ও দ্রুত মাধ্যম হলো বিমান। সরাসরি ফ্লাইট না থাকলেও, বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে এক বা একাধিক ট্রানজিট নিয়ে সুইজারল্যান্ডে পৌঁছানো সম্ভব। আর ইফাদ ও সেইভাবেই যাবে।
রিহান ঢাকা এসে জানতে পারলো ইফাদ খুব শীগ্রই সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। যেহেতু তার-ও পূর্বে রিহানদের সাথে যাওয়ার কথা ছিলো সেক্ষেত্রে তার তেমন অপেক্ষা করতে হবে না। কিন্তু সে কাউ কে এব্যাপারে কিছু জানায়নি। রিহান একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে ইফাদ এবিষয়ে শেয়ার করেছে।
ইফাদ আপাতত চৌধুরী বাড়িতে রয়েছে। রিহান তাকে ম্যাসেজ করে নিজের রুমে ডাকলো। ইফাদ এলো দুই তিন মিনিট এর মাথায়।
রিহান নিজের গিটার নিয়ে ব্যালকনিতে বসে আছে। আজ সে গ্রামে ফিরবে না। ইচ্ছে করে যাবে না। এদিকে নিজে কে স্থির রাখাও অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে তাই গিটার নিয়ে বসেছে।
ইফাদ আসা মাত্র রিহান এর পাশে ফ্লোরে বসলো। রিহান গিটার এর টুংটাং শব্দ করে যাচ্ছে। ইফাদ এর ভালো লাগে রিহান এর গিটার বাজানো। সে মুগ্ধ হয়। চুপ করে বসে রইলো। প্রায় অনেক টা সময় রিহান গিটার বাজায়। ইফাদ তো কিছু সময়ের জন্য ভুলেই গিয়েছিল তাকে এখানে কেনো ডাকা হয়েছে। তবে গিটার এর শব্দ বন্ধ হওয়ার পরপরই তার মনে পড়লো রিহান তাকে ডেকেছে। কিন্তু কেনো ডেকেছে সে জানে না।
রিহান গিটার টা দেয়ালের সাথে হেলিয়ে ঠেশ দিয়ে রাখে। ইফাদ রিহান কি বলবে সেই অপেক্ষায়।
তাদের মধ্যে পিনপতন নীরবতা চলছে। রিহান কিছু সময় চুপ থেকে বলে উঠলো,

-“এক মাস এর মধ্যে যদি আমার বোন কে মানাতে না পাড়িস তাহলে ওর পিছু ছেড়ে দিবি। অন্যথায় যদি মেনে ও যায় তারপর আগের মতো কোনো কষ্ট যদি তুই আমার বোন কে দেওয়ার চিন্তাও করিসি তাহলে সেটা তোর জন্য ভালো হবে না।”

ইফাদ জানে রিহান নিজের বোন কে যতোটা ভালোবাসে ঠিক তেমন শিশির এবং রিহান এর দুই বোন ঈশিতা, ইরা কেও একই রকম ভালোবাসে। শেখ বাড়ির তিন মেয়ে কে যেমন চোখে দেখে ঠিক শিশির কে তেমন।

-“ছেড়ে দেবো।”

রিহান ইফাদ এর কথায় গম্ভীর মুখখানা মৃদু হাসি টেনে বললো,

-“ছাড়তে যেনো না হয় সেটা প্রার্থনা করি।”

——

দিন রাত মিলিয়ে আজ আট দিন হলো রিহান এলো না গ্রামে। মিরা’র প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা ও শেষ হয়েছে।তবে কথা হয় রোজ। আজ আসবে রিহান। রোকেয়া মেয়ে জামাই এর জন্য যা পারছে বিকাল থেকে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। মিরা ঘরদোর গোছাচ্ছে। শাহনাজ সন্ধ্যায় এলো। মিরা কতক্ষণ আড্ডা দিলো শাহনাজ এর সাথে। কাজল আসবে মাস দুই এক এর মধ্যে তখন বিয়ের প্রস্তাব দিবে শাহনাজ এর মায়ের কাছে। শাহনাজ সব বলে মিরা কে। এসবও বলললো। মিরা খুশি হলো। শাহনাজ মানুষ টা ভীষণ ভালো। এতো ভালোবাসে মিরা কে। কখনো প্রতিবেশী কিংবা দূরের কেউ ভাবে নি। সব সময় বড় বোন এর মতো আগলে রাখে। শাহনাজ কে রাতের খাবার খাইয়ে তবেই ছাড়লো রোকেয়া। এরপর রাত আটটা বাজতে বাজতে সব গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। গ্রামে রাত আটটা বাঝে মানে অনেক রাত। চারদিকে নিস্তব্ধতা। কমল বেগম ও আজ জেগে বসে আছে নাতজামাই এর জন্য। সাড়ে আটটা বাজার পর গেইটে কেউ নক করে। রোকেয়া কমলা বেগম দুই বউ শাশুড়ী দু’জনে গেলো।
বেশ শোরগোল হলে বাহিরে। মিরা উঁকি দিয়ে বরাবর এর মতো রিহান এর পাগলামি দেখলো।
অনেক বাজার ফল মিষ্টি আরো কত কি এনেছে।
রিহান কিছু সময় পর মিরা’র রুমে এলো। মিরা তখন রিহান এর জন্য একটা গামছা আর ট্রাউজার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো শেখ বাড়ি থেকে আসার সময় মিরা সাথে নিয়ে এসছে। মিরা দাঁড়িয়ে ছিলো তখন রিহান হুট করে মেয়ে টার দেহখানা আগলে ধরে নিজের সাথে। এলোমেলো হলো মিরা তার হাতের গামছা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। রিহান মেয়ে টাকে পুরো এলোমেলো করে দিয়ে ছাড়লো। নিজের অধর মুছে বাঁকা চোখে তাকিয়ে নিজের গা থেকে শার্ট খুলে। এরপর সেটা আলনায় রেখে বাহিরের ওয়াশ রুমে গেলো। মিরা নিজে কে স্বাভাবিক করে। তারপর ওয়াশ রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

রাত সাড়ে ন’টা বাজতে বাজতে খাওয়াদাওয়া আড্ডা সব শেষ হলো। কমলা বেগম চলে গেলো নিজের রুমে। রোকেয়া সব কিছু গুছিয়ে রেখে রুমে যেতে একটু লেইট হলো। তার ঠিক এক মিনিট পর রিহান মিরা চুপিচুপি দাদির রুমে গেলো। মিরা খুব সাবধানে জানালা টা খুললো। এরপর আগে রিহান বাহিরে নামলো। এরপর মিরা কে কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের উপর নিয়ে নামিয়ে নিলো।

কুয়াশাচ্ছন্ন রাত। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক। অন্ধকারে জোনাকিপোকা মিরা’র খুশি আর দেখে কে। গ্রামে থাকলেও এইরকম মূহুর্তের সাথে সে আগে কখনো সাক্ষাৎ করে নি। রাতে বাড়ির বাহিরে যাওয়া কখনো হতো না। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে। সেখানে এসব ভাবা অসম্ভব। মিরা খুশিতে রিহান এর একটা হাত শক্ত চেপে ধরে আছে। রিহান মিরা’র স্পর্শে অনুভব করতে পারছে মেয়ে টা এই সামন্য কিছুতে কতোটা না খুশি। রিহান মেয়ে টাকে লাখ টাকার গহনা যখন দিয়েছিলো মেয়ে তখন ও বোধহয় এতো টা খুশি হয় নি। রিহান মিরা’র মাথায় চুমু খেলো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

-“অনুভূতি বলো? কেমন লাগলো?”

মিরা নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে কয়েকটা জোনাকি ধরার ট্রাই করে। সফল ও হয়। মেয়ে টা বেশ খুশি ই আছে। আর এখন জোনাকিপোকা ধরতে পেরে আরো খুশি। তার কণ্ঠে তার প্রমাণ পেলো। মিরা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

-“অনুভূতি বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।”

-“তাহলে প্র্যাক্টিক্যালি বুঝিয়ে দাও।”

মিরা কিছু বোঝার আগে অন্ধকারে নিজের অধর রিহান এর দখলে অনুভব করলো। পুরুষ টার মাতাল করা স্পর্শ মিরা’র হাতে যে মুঠো করে জোনাকিপোকা গুলো বন্দি করে রেখেছিলো সেগুলো ছাড়া পেয়ে আবার উড়ে গেলো।
রিহান ভাই এর স্পর্শ পেয়ে যেমন করে উড়তে লাগলো তার অনুভূতি গুলো।

#চলবে….

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]