নিভৃত দহনে পর্ব-২৬+২৭

0
38
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৬.১)
নুসরাত জাহান লিজা

শোভন তপার কল পেয়ে সাথে সাথে রওনা দিয়েছিল। ওর পরিচিত একজন সাংবাদিক আছে, যে একটা নামী পত্রিকার স্থানীয় রিপোর্টার। তার মাধ্যমে আরও কয়েকজনকে নিয়ে তাদের মাধ্যমে তপার এলাকার লোকাল থানায় ইনফর্ম করে দিয়েছিল।

তপা মোটরসাইকেলকে ফলো করতে দেখে সাথে সাথে আরেকবার শোভনকে কল করে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেছিল।

পুলিশ ফোর্স নিয়ে এসে তপাকে অচেতন অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। ইঞ্জিনের শব্দ বলে দেয় তারা সদ্য পালিয়েছে। তপাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নীলাকেও পাওয়া গেছে ঝোঁপের মধ্যে, ঠকঠক করে কাঁপছিল আতঙ্কে। সে তপাকে পড়ে যেতে দেখে আবার ফিরে এসেছিল। কিন্তু ওদের আক্রমণাত্মক দেখে বের হতে সাহস পায়নি। ওকে বাঁচাতে গিয়ে একজন মরে যাচ্ছে, এই গ্লানি তার ছোট্ট হৃদয়ে পাষাণভার চাপিয়ে দিচ্ছিল।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফজলু, তার দলের কয়েকজন স্যাঙ্গাৎ, সাথে নীলার বাবাকেও পুলিশ নিজের হেফাজতে নিয়ে আসে। তারও কিছুক্ষণ আগে সাংবাদিকসহ শোভন চলে আসে৷

সাংবাদিক ছিল বলে ফজলু পুলিশের সাথে মিটমাট করার পথ পায়নি।

স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তার জানিয়েছে, তপার মাথার আঘাত কতটা সেটা পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব নয়। তবে হাঁটু মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। সিলেটে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে সিটি স্ক্যান করালে জানা যাবে, ভেতরের আঘাত কতটা গুরুতর।

***
বিকেল থেকেই সোস্যাল মিডিয়ায় একটা খবর বেশ ভাইরাল হয়ে গেছে৷

“একজন এনজিও কর্মকর্তা’’র সাহসিকতায় বন্ধ হলো বাল্যবিবাহ, ধরা পড়ল মাদক চক্র, তরুণী গুরুতর আহত”

রাফিদ এখন ফেসবুকে খুব একটা আসে না। ওর একটা পেইজ আছে, যেখানে ওর তোলা ছবি পোস্ট করে। এখন যেহেতু ছবি তোলা হয় না, তাই সে-ও খুব একটা আগ্রহ পায় না।

সন্ধ্যার আগে আগে রাফিদ ওর ডেস্কের ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখছিল, বেরিয়ে পড়বে বলে, তখনই সোমার কলটা এলো,

“রাফিদ, তুমি ফেসবুকে কিছু দেখেছ?”

“কী দেখব?”

“ও, দেখোনি তাহলে। আসলে তপা আপু…”

রাফিদের মন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল, ভোর হবার মুহূর্তে দেখা দুঃস্বপ্নের কথাটা মনে পড়ল, চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে সে প্রশ্ন করল,

“তপার কী হয়েছে?”

“আগে তুমি শান্ত হও, বলছি।”

“সোমা, প্লিজ, বলো। খারাপ কিছু?”

সোমা সংক্ষেপে সমস্তটা বলল। সব শুনে মুহূর্তেই যেন রাফিদের পৃথিবীটা নিমিষেই শূন্য হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

কোনোমতে বলল, “দর্পণ?”

“ও কাঁদছে, মাকে খুঁজছে। ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে হচ্ছে।”

রাফিদ দ্রুত পায়ে উঠে দাঁড়াল। এরপর একছুটে বেরিয়ে এলো নিজের কেবিন থেকে।

মুখোমুখি জয়নুলের সাথে দেখা হয়ে গেল,

“কোথায় যাচ্ছ?”

রাফিদের জন্য এখন প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান, সে এক মুহূর্ত নষ্ট করতে নারাজ।

“সিলেটে।”

“তুমি শর্তের কথা ভুলে গেছ?”

রাফিদ দাঁতে দাঁত চেপে, হাত মুঠো করে, বড় করে শ্বাস টেনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

“জীবন মানুষকে কখনো কখনো এমন মুহূর্তের সামনে দাঁড় করায়, যেখানে ঠুনকো শর্তের কোনো মূল্য থাকে না। আসি।”

“রাফিদ, রাফিদ… রাফিদ……”

বাবার উচ্চকিত গলার রাগান্বিত স্বরকে উপেক্ষা করে রাফিদ আলোর বেগে বেড়িয়ে গেল।

যাবার সময় সে পায়ে দলে গেল শর্তের বেড়াজাল, ক্লাসিজমের দম্ভ, অদৃশ্য শেকলে বাঁধা সমস্ত পিছুটান। ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে কেউ, রাফিদের ভালোবাসা ভালো নেই।

সে এখনো এসব বিধিনিষেধ মেনে বসে থাকবে, এতটা আহাম্মক তো সে নয়। এমন সময়ে যদি পাশেই না দাঁড়াতে পারে, তবে মুখে ভালোবাসি বলারও কোনো অধিকার নেই।
………..
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৬.২)
নুসরাত জাহান লিজা

রাফিদ পোঁছেই হাসপাতালে এসেছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলছে এখন,

“পেশেন্টের মাথার পেছনে বেশ শক্ত আঘাত লেগেছে, ফেটে গেছে অনেকটা। তবে ভাগ্য ভালো যে ব্রেইন ইনজ্যুরড হয়নি। তাহলে বেশ বড় বিপদ হতো। তবে এখনো রিস্ক আছে৷ সেকেন্ডারি স্টেজে গেলে পুরোপুরি রিকভার করা কঠিন হয়ে যেত। নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে অনেকটা সময় লাগবে। আমরা দেখছি।”

একজন নিওরোলজিস্ট এবং একজন অর্থোপেডিক দেখছেন তপাকে।

রাফিদ আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বিস্তারিত জেনে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো। দর্পণকে হাসপাতালে আনা হয়নি। এই পরিবেশে মাকে এভাবে দেখলে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে সেটা কেউ জানে না।

তপার মা এসেছেন, সাথে তুহিন। বোনের জ্ঞান ফিরলেই সে চলে যাবে। কে বলেছিল যেচে পড়ে ঝামেলা গায়ে মাখতে! এই মেয়ে সোজা পথে চলতেই পারে না। ছোটবেলা থেকে সব কিছুতেই নিজের নাক গলাতে যায়। সবসময় তো পার পাওয়া যায় না। বড় কোনো বিপদে যে তপা পড়তে পারে এই আশঙ্কা তুহিনের আগে থেকেই ছিল, যখন ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে একা একা এতদূর চলে এলো তখন থেকেই। বাবা যদি একটু শাসন করতেন মেয়েকে, তাহলে এমব বেয়াড়া হতো না। কবীরের সাথে সংসারটাও টিকত, এমন বিপদেও পড়ত না। বাবার সব শাসন ছিল কেবল তুহিনের জন্য।

রাফিদ চলে গেল সোমাদের বাড়িতে। তপার সাথে ওর মা আছে, ভাই আছে, সায়েদা আন্টিও, রমা ছিলেন, কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন। বাড়িতে মলিনা আর সোমা আছে কেবল। এখন দর্পণকে সামলানো বেশি দরকার।

বাসায় ঢুকেই দর্পণের কান্নার শব্দ কানে এলো। রাফিদ ভেতরে এসে সোমার সাথে কথা বলল,

“কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, একটু আগে ঘুম ভাঙতেই আবার কাঁদছে। সামলানো যাচ্ছে না। মা ছাড়া এত লম্বা সময় কখনো থাকেনি তো।”

বিধ্বস্ত রাফিদ নিজেকে সামলে নিয়ে মলিনার কাছ থেকে দর্পণকে নিল, “দর্পণ সোনা, কাঁদে না।”

“মা.. মা…..”

“মা’র কাছে যাবে? আমি নিয়ে যাব তো মা’র কাছে।”

“তোমার মনে হয় খাওয়া হয়নি। রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। আমি খাবার দিচ্ছি। আগে খেয়ে নাও ভাই।”

সোমার কথায় মনে পড়ল দুপুরে খেয়েছিল রাফিদ, এরপর আর খাওয়া হয়নি কিছু,

“এক গ্লাস পানি দাও শুধু। এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।”

রাফিদ দর্পণকে কোলে নিয়ে ছাদে উঠে এলো। আজও আকাশে চমৎকার জোৎস্না, তবুও কেমন ম্লান সবকিছু। দর্পণের কান্নার শব্দ কমে এসেছে, তবে এখনো ফুঁপিয়ে উঠছে, ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছে।

রাফিদের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। দর্পণকে খুব কম কাঁদতে দেখেছে সে। আজ সে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছে। তপার কিছু হয়ে গেলে এই অবোধ্য শিশুর কী হবে! ভাবনাটা মনে আসার সাথে সাথে ঝট করে লাগাম টানল রাফিদ। এসব অলুক্ষুণে ভাবনাকে সে কিছুতেই মনে ঠাঁয় দেবে না।

দর্পণকে সামলাতে গিয়ে নিজেকে শক্ত রাখার যত চেষ্টাই রাফিদ করছে, তা বিফলে গিয়ে ওর চোখও বারবার ভিজে আসছে। সে মনে মনে সে আওড়াল,

“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো, তপা। দর্পণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, আমিও।”

আল্লাহর কাছে নিজের সর্বস্ব দিয়ে দোয়া চাইল রাফিদ।

একসময় ক্লান্ত দর্পণ রাফিদের কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল, ঘরে এসে ওকে শুইয়ে দিয়ে সে পাশে শুয়ে পড়ল৷ কিন্তু একফোঁটা ঘুম হলো না। সায়েদা আন্টির কাছে কিছুক্ষণ পরপর তপার আপডেট নিতে থাকল। ভোর হতেই সে সোমা আর মলিনাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এলো।

এসে শুনল তপার একবার জ্ঞান ফিরেছিল, এখন ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কথা বললে মস্তিষ্কে চাপ পড়বে।

সায়েদা আর জহুরা বাসায় চলে গেলেন। তারা বয়স্ক মানুষ, বিশ্রাম প্রয়োজন।

ডাক্তার জানিয়েছে আশঙ্কা কেটে গেছে, তবে আঘাত যেহেতু বেশ গুরুতর, তাই অবজারভেশনে রাখতে হবে আরও বেশ কিছুদিন।

তুহিন এসে সরাসরি রাফিদকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”

সে রাতেও তপার জন্য এই ছেলেকে অস্থির হতে দেখেছে। লক্ষণ সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না।

“আমি রাফিদ। তপার বন্ধু।”

রাফিদ সোমার কাছ থেকে তুহিনের পরিচয় জেনেছে এসেই।

“কেমন বন্ধু?”

রাফিদ উত্তরে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, সোমা এসে বলল, “ও আমার ভাই। তপা আপুকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি।”

সোমার বলার ভঙ্গিতে তুহিন আর কিছু জিজ্ঞেস করা থেকে নিজেকে বিরত রাখল। কেমন ভালোবাসা কে জানে! তবে এই পরিস্থিতিতে এসব কথা তোলা সমীচীন নয় বলে চুপ করে রইল, সরে যাবার আগে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে রাফিদকে পর্যবেক্ষণ করতে ভুলল না।

***
নীলার বাবা আর ফজলু জেলে আছে। ফজলুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্যাংয়ের আরও কিছু লোককে ধরা হয়েছে। এই বিষয়টা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার নজরে আসায় প্রশাসন বেশ তৎপর ভূমিকা পালন করছে।

নীলা এখন আছে সায়েদা আন্টির বাসায়, সে আপাতত অভিভাবকহীন। ওর মামা নিতে এসেছিল, সোমা সাথে যেতে দেয়নি। আসলে নীলা যেতে চায়নি, কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছিল না।

তুহিন একদিন পরেই ঢাকায় ফিরে গেছে। জহুরা মেয়ের এই অবস্থায় যেতে চাননি। দর্পণের সাথে তার সখ্যতা তৈরি হয়নি আগে, সেজন্য নাতি তার সাথে ঠিক স্বচ্ছন্দ নয়, থাকতে চায় না।

সায়েদা আন্টির শরীরটাও ভালো নেই। সোমার অফিস, মলিনাকে তপার সেবায় বেশি সময় দিতে হচ্ছে, ফলে গত তিনদিন ধরে দর্পণের প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে উঠেছে রাফিদ। এখন তার কান্না অনেকটা কমে এসেছে।

তপার কাছে নিয়ে গেলে ওর কোলে যেতে চায়, কিন্তু এখনো তার অনুমতি পাওয়া যায়নি। কাছ থেকে কিছুক্ষণ দেখিয়ে নিয়ে আসে।

কখনো দর্পণকে মলিনার কাছে দিয়ে সে তপার বেডের কাছে বসে থাকে। তপা মাঝেমধ্যে তাকিয়ে ওকে দেখে, ছেলেকে দেখে। আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

তপা যখন গভীর ঘুমে থাকে, তখন রাফিদ একমনে কথা বলে, নিজের মনের কথাগুলো অকপটে বলে। জানে, যার উদ্দেশে বলছে সে শুনবে না কিছুই। সেজন্যই সে আগল খুলতে পারে।

তপার হাঁটুতেও ছোট্ট একটা সার্জারি করতে হয়েছে।

রাফিদের খুব ইচ্ছে করে, একবার অন্তত তপার হাতটা ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে, তপা এখন ঘুমিয়ে আছে, সে জেগে থাকতে ওকে হাত ধরার অনুমতি দেয়নি। ঘুমন্ত তপার হাত ধরে সে সুযোগ নিতে চায় না। যদি কখনো অনুমতি পায়, তবেই সে চির আরাধ্য হাতদুটো মুঠোবন্দি করে নেবে ভালোবাসায়।

এত কাছে তপা, তবুও যেন আলোকবর্ষ দূরত্বে, কাছে থেকেও স্পর্শের অনেক বাইরে।

এভাবে তপাকে পড়ে থাকতে দেখে রাফিদের হৃদয়ের কোনো এক নিভৃত কোণে কী ভীষণ দহন ওকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে, সে তার কোনো থৈ পায় না।

তপার সুস্থতা ওর এখন একমাত্র আরাধ্য, সুস্থ হয়ে যদি রাফিদকে কটু কথা বলে, দূরে সরিয়ে দেয়, দিক। তবুও সে সুস্থ হোক। তার জন্য রাফিদকে আরও পুড়তে হলেও পুড়তে আপত্তি নেই।
………..
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৭)
নুসরাত জাহান লিজা

দর্পণকে গোসল করিয়ে গা মুছিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল রাফিদ। নিজেও অনেকটা ভিজে গেছে। এখন গোসল করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সময় নেই, হাসপাতালে যেতে হবে।

দর্পণের সামনে খেলনা দিয়ে সে টি-শার্ট বদলে নিল। আগে কখনো ছোট বাচ্চাকে গোসল করানো হয়নি, প্রথম দুই তিনদিন বেশ ভয় লেগেছে। মনে হয়েছে যদি পড়ে গিয়ে ব্যথা পায় কিংবা কানের মধ্যে পানি ঢুকে যায়!

সায়েদা আন্টির কাছ থেকে শিখে নিয়েছে, এখন আর সমস্যা হয় না। পানিতে বসিয়ে দিলে দর্পণ ভীষণ আনন্দ পায়, পানির মধ্যে হাত দিয়ে পানি ছিটাছিটি করে হাত পা নেড়ে খেলে। এই করে রাফিদকে ভিজিয়ে দেয়।

মলিনা দর্পণের খাবার দিয়ে গেল, রাফিদ একটু একটু করে মুখে তুলে দিচ্ছিল, দেখাদেখি দর্পণও ওর ছোট্ট হাতে খাবার ছুঁইয়ে রাফিদের মুখে তুলে দিতে চেষ্টা করল। এটা সে তপার সাথে করে, শিশুরা ভীষণ অনুকরণপ্রিয় হয় বলে সে-ও একই কাজ করতে চাইত। এখন রাফিদের সাথে করছে৷

দর্পণকে জামা বদলে দিতে এলে সে হাত দিয়ে নিজের পাশে বসতে কয়েকবার ইঙ্গিত করল, মুখে ডাকল কয়েকবার,

“দাফেত, দাফেত…”

রাফিদ বসতেই সে ওর কাঁধ ধরে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল, এরপর কোলে উঠতে চেষ্টা করল, মুখে বলছে,

“মা, মা, মা…..”

এই সময় প্রতিদিন মায়ের কাছে যায় এটা মনে রেখেছে, রাফিদ কোলে তুলে নেবার আগে জামা পড়িয়ে চুল আঁচড়ে দিল।

রাফিদের হাত থেকে চিরুনি নিয়ে সে-ও রাফিদের চুলে চিরুনি চালাবার চেষ্টা করল। রাফিদ মাথা নিচু করে দর্পণ বরাবর এগিয়ে দিল।

শিরীন কল দিলেন এরমধ্যে একবার, “কেমন আছিস খোকা?”

“ভালো আছি মা। তোমার শরীর কেমন এখন?”

“আছি। তপার কী অবস্থা?”

“আগের থেকে একটু উন্নতি হয়েছে। ডাক্তার বলছে সময় লাগবে।”

“মেয়েটা বড় ভালো। সাহসীও। আমি ওর জন্য প্রতিদিন দোয়া করি নামাজের পরে।”

“ওর জন্য এখন দোয়াটা অনেক জরুরী মা।”

“তুই কী করিস? তোর বাবা বলল ওর কল নাকি তুই ধরিস না।”

“আমি খুব ব্যস্ত থাকি মা। সেজন্য।”

বাবার শর্তের কথাগুলো মাকে বলতে ইচ্ছে করল খুব, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামলে নিল। সেটা বাবার হুমকির জন্য নয়, এখন যে পরিস্থিতি, তাছাড়া সে শর্ত উপেক্ষা করেই চলে এসেছে। বলতে পারল না, মা কষ্ট পাবেন বলে। তার ভরসার জায়গাটা কোথাও গিয়ে ধাক্কা খাবে। এটা রাফিদ চায় না। এই প্রথম একটা কথা সে মায়েত সাথে শেয়ার করল না।

“হ্যাঁ রে, তোর উপর খুব ধকল যাচ্ছে, তাই না?”

“ধকল আর কই, ওইটুকু একটা বাচ্চাকে সামলে রাখতে হচ্ছে এইটুকুই তো। খাবারের জন্য এখনও সে তপার উপরে নির্ভরশীল, যেহেতু সেটা এখন পাচ্ছে না, কেবল বাইরের খাবারগুলোই ভরসা। তখন একটু সামলানো কষ্ট হয়ে যায়।”

সায়েদার কাছ থেকে শিরীন রাফিদের গত সাতদিনের সমস্ত কার্যক্রম শুনেছেন। সে যতই বলুক ওইটুকু বাচ্চা, এক বছর তিন মাস বয়সী শিশুকে সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। বরং ভীষণ কঠিন।

শিশুদের পছন্দ করে তাদের কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে ভালিয়ে কোলে নেয়া এক জিনিস, তাদের সারাক্ষণ সামলে রাখা অন্য জিনিস। তার ছেলেটা অনেকটা উড়নচণ্ডী ধরনের, ঘর তেমন টানে না।

অনেকদিনের সম্পর্ক বিয়ে হতে হতে ভেঙে গেছে ‘ইরেসপন্সিবল’ এই অজুহাতে। জয়নুল সারাক্ষণ বলেন এই কথাটা। তার মনেও কখনো ক্ষীণ আশঙ্কা উঁকি দিত, যে সত্যিই হয়তো দায়িত্ব নেবার জন্য তার ছেলে প্রস্তুত নয়।

আজ তার সমস্ত আশঙ্কা বালির বাঁধের মতো ভেঙে গেল। তার সন্তান চোখের সামনে দেখতে দেখতে কী করে এতটা দায়িত্বশীল হতে শিখে গেল!

দর্পণের দেখভালের পাশাপাশি যেভাবে তপার জন্য ভাবছে, হাসপাতালে ছোটাছুটি করছে, রাফিদ ছাড়া তেমন কর্মঠ কেউ আপাতত তপার ওখানে নেই, সোমা পারত, কিন্তু ওর অফিস থাকে। মলিনা আর জহুরা হাসপাতালেই থাকে। মলিনা সকালে একবার এসে দর্পণের খাবার রান্না করে দিয়ে যায়। রাফিদ এখন গেলে মলিনা জহুরাকে নিয়ে নিয়ে বাসায় চলে আসবে। সন্ধ্যার পরে আবার তার দুজন যাবে। ততক্ষণ রাফিদ থাকবে। রাতে এগারোটার পরে সে বাসায় চলে আসে, রাতেও থাকত, কিন্তু দর্পণকে নিয়ে সেখানে থাকা যায় না।

আরও এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হবে, যেহেতু মস্তিষ্কের বিষয়, তাই এই সতর্কতা।

টাকার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, এটা নিয়েই ভাবছিল, জহুরা এসে রাফিদকে বললেন,

“বাবা, তুমি আমার মেয়ে আর নাতির জন্য যা করছ, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আরেকটা সাহায্য করবে?”

“বলুন না আন্টি।”

তিনি এক জোড়া স্বর্ণের বালা রাফিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? এখন বয়স হয়েছে, এদিকের পথঘাট, চিনি না। তুমি না থাকলে ওদের নিয়ে যে কী করতাম।”

রাফিদ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল, সে বলল, “আন্টি প্লিজ, আমি চেষ্টা করছি ম্যানেজ করতে।”

“তুমি এমনিতেই অনেক করছ, টাকার বিষয়টা মাফ করো বাবা। আমি এখনো বেঁচে আছি। তপার একাউন্টে কিছু টাকা আছে। কিন্তু এখন সেটা তুলতে পারছি না…”

রাফিদ বুঝল, সাহায্য নিতে তার বড্ড অনীহা, কারোর আত্মসম্মানবোধকে সে ছোট করতে চায় না। রাফিদ গত তিন মাসের স্যালারি হিসেবে বেশ ভালো অঙ্কের টাকাই পেয়েছিল, খরচ তেমন হয়নি। সেটা এখানে যথেষ্ট নয়। অনেক খরচ হচ্ছে। অগত্যা সে নিল বালা জোড়া।

অফিস থেকে কিছু পাওয়া গেছে মেডিকেল কস্ট হিসেবে, এছাড়া কলিগরা তাৎক্ষণিকভাবে কিছু দিয়েছিল। সোমা তার হিসেব রেখে দিয়েছে। তপাকে সে চেনে, সুস্থ হলে এই ঋণ শোধ করতেই অতিরিক্ত মাথা ঘামানো শুরু করবে। তাই হিসেব থাকুক, চাইলে দেয়া যাবে।

সেদিন মনিরুল আলম দেখতে এসেছিলেন তপাকে, অফিস নাখোশ ছিল প্রথম দিকে, মনিরুল আলম চেষ্টা করে শোকজ নোটিশ আটকেছে। পরে তারা যখন দেখল তাদের বেশ ভালো একটা পাবলিসিটি হয়েছে এই ঘটনায়, তখন তারাও নতুনভাবে ভাবল। তাছাড়া তপার সাহসিকতার প্রশংসা করতেই হয়।

***
মলিনা নীলাকে খেতে দিয়েছে, “রান্দন ভালা হইসে?”

“হুম।”

“খাও। যা খাইতে মন চাইব আমারে কইবা, আমি কইরা দিমু।”

নীলা খাচ্ছে, মলিনা একদৃষ্টে ওকে দেখছে। এইটুকু মেয়ের কপালে কত দুঃখ! আহারে! মায়ায় হৃদয় আর্দ্র হয়ে আসে নিঃসন্তান মলিনার। তার যখন বিয়ে হয়েছিল, কোলে যদি একটা সন্তান আসত, এইরকম বয়সেরই হতো হয়তো।

“ম্যাডাম কেমন আছে?”

“দেখতে যাবা?”

“হুম, তারে দেখতে ইচ্ছা করে। কী সুন্দর মানুষ, এত ভালো মানুষ।”

“আপার মনডা খুব ভালা।”

নীলা একবার গিয়েছিল তপাকে দেখতে, এরপর আর যায়নি। খুব কষ্ট হয় ওর, ওর মতো একজন যার নিজের বলতে কেউ নেই, ভেসে যাওয়া শ্যাওলা, তার জন্য কত বড় ঝুঁকি নিয়ে এখন ধুঁকছে। সব তো ওর জন্য।

সে ডুকরে কেঁদে ফেলল আচমকা, মলিনা উঠে দাঁড়িয়ে নীলার মাথা বুকে চেপে সান্ত্বনা দিল, “সব ঠিক হয়ে যাব।”

এই স্নেহ-ছায়াহীন মেয়েটার মধ্যে সে নিজেকে দেখতে পায়, নিজের কৈশোরকে দেখতে পায় বলেই কিনা মলিনা জানে না, বড্ড আপন মনে হয়। সুপ্ত মাতৃস্নেহ জাগ্রত হয় ভেতরে।

***
নীলা আর তপার খবরটা ভাইরাল হয়েছিল বলে সারাদেশের সিম্প্যাথি পেয়েছে, সাথে বীরোচিত সাহসের জন্য প্রশংসা। যদিও তপা এসবের জন্য কিছু করেনি, সে জানেও না এতকিছু।

তবে একজন মানুষ খুব খুশি হয়েছে, সে কবীর। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার ফল এভাবেই ভোগ করতে হয়। পিপীলিকার পাখা মরিবার তরেই তো গজায়। এটা তো ওর জানাই ছিল।

এবার সে দর্পণকে আনার জন্য আরেকটা মামলা তো করতেই পারে। ছেলের ঠিকঠাক দেখাশোনা হচ্ছে না। অসুস্থ তপা কীভাবে এর দেখাশোনা করবে। আইন এবার ওর দিকেই থাকার কথা, তাদের কাছে শিশুর জন্য একটা সহায়ক পরিবেশের নিশ্চয়তাই তো সবার আগে।
……..
(ক্রমশ)