নিভৃত দহনে পর্ব-৩৪+৩৫

0
43
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩৪)
নুসরাত জাহান লিজা

আজই বিয়ে, অথচ বিয়ের কেনাকাটা কিছুই করা হয়নি। অন্তত একটা শাড়ি তো কেনা উচিত। চিন্তায় রাফিদের প্রায় মাথা খারপ অবস্থা। ভেবেচিন্তে সোমাকে কল দিল। সোমা জানালো, চিন্তা নেই, ওর এক ফ্রেন্ডের নিজস্ব বুটিক হাউজ আছে, তারা বিয়ের পোশাক নিয়েও কাজ করে। ওদের কালেকশনও বেশ ভালো। সে-ই ওকে নিয়ে নিয়ে যাবে সকাল দশটার পরে।

কিনতে যাবার আগে মনে পড়ল, ওর কাছে খুব বেশি টাকা নেই। বাজেট কেমন হতে পারে! বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার করবে! পরক্ষণেই সেই ভাবনা বাতিল করে দিল৷ এত চমৎকার একটা জার্নির শুরুটা ধার দেনা করে করতে ইচ্ছে করল না।

এক পর্যায়ে সে সোমাকে বলেই ফেলল, “বিয়ের শাড়ির দাম কেমন হয়?”

সোমা হেসে বলল, “রাফিদ, বিয়ে হলো দু’জন মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া। দু’জন আলাদা মানুষ, যারা ভিন্ন পথে চলে এসেছে, তাদের পথ একসাথে জুড়ে যাওয়া। কত দামের শাড়ি, সেটা খুব একটা মুখ্য বিষয় নয়। তোমার সামর্থ্যের মধ্যে যেটা ভালো সেটাই নেবে, আমার বিশ্বাস তাতেই তপা আপু খুব খুশি হবে। এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

“কিন্তু মেয়েরা বিয়ের পোশাক নিয়ে কতরকম প্ল্যান করে রাখে…”

“হ্যাঁ করে। আমি নিজেও করেছি। প্রত্যেকটা মানুষের জন্য বিয়ে অত্যন্ত স্পেশাল। মেয়েরা চায় তাদেরকে সেদিন ভীষণ সুন্দর লাগুক। সবার দৃষ্টি তার দিকে থাকুক, সে সবার মধ্যমনি হয়ে থাকুক। একটা কথা জানো রাফিদ, তপা আপুরও একসময় এরকম স্বপ্ন ছিল। জমকালো আয়োজনে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু…..

“যাকে বিয়ে করছে, সে তাকে কীভাবে ট্রিট করছে, সেটাই আসল। তুমি যদি তোমার ভালোবাসা দিয়ে তাকে স্পেশাল ফিল করাও, পোশাকের দাম তখন অত্যন্ত গৌণ হয়ে যাবে। দামী উপহার দিতে পারছ না বলে মন খারাপ কোরো না, বরং তুমি নিজে তার জন্য উপহার হয়ে উঠো। তপা আপুর হাসিমুখ সবসময় দেখতে পাবে।”

রাফিদের ভেতরের সমস্ত দ্বিধা, সংকোচ কেটে গেল। একটা লাল শাড়ি কিনল, তপাকে ভীষণ মানাবে এটা। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল রাফিদের। দর্পণের জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনল, সোমা আর সায়েদা আন্টির জন্য কিনে দিল৷ সোমা রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু রাফিদ মন খারাপ করছিল বলে নিতে হলো।

মলিনা আর নীলার জন্যও কেনা হলো। রাফিদ ভাবছিল কেনাকাটা শেষ, উঠছিল, সোমা বলল,

“ব্লাউজ আর পেটিকোট নিতে হবে না?”

রাফিদ মাথা চুলকে বলল, “ও, আসলে মেয়েদের জন্য কখনো কেনাকাটা করিনি তো, তাই মাথায় ছিল না।”

“ব্লাউজের মাপটা জিজ্ঞেস করো তো, আমি..”

“তুমি করো, প্লিজ..,”

খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বলতে গিয়ে থেমে বলল,

“না, থাক। আমি যে কেনাকাটা করতে এসেছি ও জানে না। এখন না বলি, একেবারে গিয়ে ওর হাতে দেব, তুমি আন্দাজ মতো নিয়ে নাও।”

***
জহুরা, সায়েদা আর মলিনাকে নিয়ে রান্নাঘরে আছেন৷ মাগরিবের পরেই বিয়ে হবে। কাজী আসবেন, রাফিদের দুজন বন্ধু, একজন ক্যাম্পাসের বড় ভাই আসবে৷ তপার অফিসের কলিগরা আসবে।

জহুরা তুহিনকে কল দিয়েছিল, সে শুনেই বেশ রেগে গেল,

“ওই ছেলেটা? আমি সেদিনই বুঝেছি কিছু একটা চক্কর আছে। একটা ম্যাচিওর ছেলে বিয়ে করতে পারত না?”

“তুই আসবি না বোনের বিয়েতে?”

“কেন আসব? বোন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার পরামর্শ নিয়েছে? বলা নেই কওয়া নেই, একবারে শুনি বিয়ে। ফাজলামো নাকি? তুমি ওখানে থেকে এটা হতে দিলে?”

“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? রাফিদ খুব ভালো ছেলে।”

“তপার বিয়ের পরে তুমি আমার কাছে চলে আসবে মা। অনেকদিন তো ওইখানে থাকলে। তোমার মেয়ে এখন সুস্থ, আবার বিয়েও করছে। ওখানে তোমার আর কী দরকার।”

“যাব। তুই এসে নিয়ে যাস।”

তুহিন তপাকেও কল করেছিল, দুই একটা কথা বলে আরও বলতে যাচ্ছিল, তপা পাত্তা দেয়নি।

***
তপা রাফিদের আনা লাল শাড়িটা হাতে ধরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে। ওর মনে আছে একবার সে ভীষণ উৎসাহ, উদ্দীপনা নিয়ে বউ সেজেছিল কারো জন্য। কত খুশি ছিল সেদিন। দুই হাত ভর্তি মেহেদি ছিল, গা ভর্তি অলংকার। চারপাশে আলোর রোশনাই, কত মানুষের ভীড় ছিল ওকে ঘিরে। কবীরের সাথে ওকে একসাথে যখন বসানো হলো, কেউ কেউ বলছিল, ‘’রাজযোটক।”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল তপা। সেদিনের সমস্ত আয়োজন বৃথা গেছে। সেদিনের খুশি ওকে ব্যঙ্গ করে এসেছে কতগুলো দিন ধরে।

আজ আরেকবার সে বউ সাজতে বসেছে। এবার আহামরি আয়োজন নেই, অনাড়ম্বর বিয়ে হবে। ওর কোল আলো করে দর্পণ আছে। আরেকবার সে ভালোবেসেছে। কিছু মানুষ আছে, যারা এতটা ভালোবাসা দেয়, যে ঋণের বোঝা মাথায় চেপে বসে ফিরতি ভালোবাসা না দেয়া পর্যন্ত। রাফিদের ভালোবাসাও তেমন।

দ্বিতীয়বার এই সিদ্ধান্ত নেয়া তপার জন্য অনেক কঠিন ছিল। মন এমন কেন! বারবার আশার পাল তুলে ভবিতব্য নামক অতল সমুদ্রে নৌকা ভাসায়! এবার যেন সব ঠিকঠাক হয়!

শাড়ি পরে নিজেকে আয়নায় কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল তপা। আজ অনেকদিন পরে মনের মতো করে সাজল। কতদিন পরে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নায় দেখল তপা।

জীবন থেকে সমস্ত রঙ হারিয়ে গিয়েছিল। আজ আবারও নিজেকে রাঙাল রাফিদের জন্য, ওর দেয়া শাড়িতে। জীবন এখনো কেমন রঙিন মনে হলো সহসা।

পেছনের যত জঞ্জাল, পেছনে পড়ে থাকুক, সামনে হাঁটতে দোষ কী! সেই পথে যোগ্য সঙ্গী যদি কাউকে মনে হয়, তার হাত ধরায় অন্যায় নেই নিশ্চয়ই।

যারা পেছনে কথা বলে তাদের পরোয়া সে করে না৷ করলে কবীরের নাগপাশ থেকে মুক্তি মিলত না। এখনো পরোয়া করছে না সেসবের। যারা বলার তারা বলবেই। পরশ্রীকাতর মানুষের কথা বলার জন্য ছুতোর অভাব হয় না।

তপার একমাত্র চাওয়া, ওর সামনের জীবনটা যেন খুব সুন্দর হয়। দর্পণ যেন একটা সুস্থ জীবন পায় যোগ্য সাহচর্যে।

***
মলিনা নীলাকে সাজিয়ে দিচ্ছে।
“এই তো, এহন কী সুন্দর দ্যাহা যাইতাছে। চুল বাইন্ধা গুছাইয়া রাখবা। আমি সন্ধ্যা হইলে কইরে দিমুনি।”

“আচ্ছা।”

“তপা আপা কইছে, তোমারে ইশকুলে ভর্তি কইরা দিব। খোঁজ খবর নিব।”

“আমারও পড়তে ভালো লাগে।”

“তাই? আইজকা খাওনের সময় আমার সাথে বসবা। মেহমান থাকব, তুমি যে শরম পাও। খাইতে পারবা না। তাই আমি সাথে থাকমু।”

“আচ্ছা।”

মলিনার ভীষণ মায়া পড়ে গেছে এই মাতৃহীন কিশোরীর জন্য। মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে, একবার যদি মা ডাক শোনা যেত! বিয়ে মিটলে সে তপাকে নিশ্চয়ই বলবে বিষয়টা নিয়ে।”

***
রাফিদ সময় গুণছে। তপা ওর জন্য পাঞ্জাবি কিনেছিল উপহার হিসেবে দেবে বলে। সেটাই পরেছে।

দর্পণ কোলে বসে ওর চুল ধরে টানাটানি করছে। মা’য়ের কথা খুব মনে পড়ছে। বাবার কথাও। এত উত্তেজনার মধ্যেও কোথাও গিয়ে একটা শূন্যতা বিরাজ করছে ওর মন জুড়ে।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে রাফিদের মনে হচ্ছিল, যা হলো, এটা কি সত্যি নাকি স্বপ্ন! কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল ওর। পুরো সময়টা যেন ঘোরের মধ্যে ছিল সে।

দুজনকে যখন একসাথে বসানো হলো, রাফিদ এক পলক তপার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেল। কী ভীষণ সুন্দর যে লাগছে লাল শাড়িতে!

অলংকার বলতে কেবল শিরীনের দেয়া হার, জহুরার দেয়া সোনার বালা, তপার পুরোনো একজোড়া কানের দুল। এভাবে কখনো সে তপাকে দেখেনি। সবসময় হালকা রঙের কাপড় পরতে দেখেছে। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না ওর।

কবুল বলা, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন ফরমে সিগনেচার করার পুরো সময়টায় শিরীন ভিডিওকলে ছিলেন। রবিনের কাছে ওর ফোন দিয়েছিল কাজটা করে দিতে।

অতিথিরা বিদায় নিলে তপা আর রাফিদ যখন একা হলো, তপা এগিয়ে এসো বলল, “কেমন লাগছে?”

“বলে বোঝাতে পারব না। কিছু অনুভূতি প্রকাশের জন্য ভাষা থাকে না।”

“তাহলে তোমার মন খারাপ কেন? বাসার কথা মনে পড়ছে?”

“আজ আমার জীবনের সবচাইতে খুশির দিন। কিন্তু আমার কাছের মানুষরা পাশে নেই। যদি বলি কষ্ট হচ্ছে না, তাহলে মিথ্যে বলা হবে। আমি মিথ্যে বলতে পারি না।”

“কিছুক্ষণ কাঁদো রাফিদ। দেখবে হালকা লাগবে।”

রাফিদ সারাদিন ধরে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল কান্নাটা চেপে রাখতে। এখন আর সম্ভব হলো না। কেঁদে ফেলল ফুঁপিয়ে। তপা এগিয়ে এসে রাফিদের মাথা নিজের কাঁধে রাখল, রাফিদ জড়িয়ে ধরল।

“আজ আমি ভীষণ খুশি, তোমাকে আমার জীবনে পেলাম বলে। এত বড় প্রাপ্তি আমার জীবনে আর একটিও নেই। তবুও কষ্ট হচ্ছে মা’র জন্য। বাবা-র জন্যও। উনি কেন আমাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করলেন না?”

তপার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে, ওর চোখেও জল। রাফিদের পরিস্থিতি সে বুঝতে পেরেছিল ভোরবেলায় যখন দেখেছিল তখনই।

রাফিদের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তপা বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কান্না জমিয়ে রাখলে একসময় তা জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে বুকের পাঁজরে। শ্বাস আটকে দেয়। কান্নাকে বয়ে যেতে দিতে হয়, চোখের জলে কষ্টের মাত্রা সহনীয় হয়ে আসে একসময়।

***
দর্পণ ঘুম থেকে উঠে রাফিদকে নিজের বিছানায় ঘুমুতে দেখে যতটা অবাক হয়েছে তার চাইতে বেশি ভীষণ খুশি হয়েছে। সে সকাল সকাল উঠে পড়ে, তপার সাথেই প্রায় ঘুম ভাঙে। অপরদিকে রাফিদের একটু দেরিতে ঘুম ভাঙে।

দর্পণ কতক্ষণ রাফিদের চুল ধরে টানাটানি করে ডেকে সাড়া না পেয়ে বুকের উপরে চড়ে বসল। ওর লাফালাফিতে রাফিদের ঘুম ভেঙে গেল।

ঘুম ভেঙে নিষ্কলুষ হাসিমুখ দেখে কী যে ভালো লাগল রাফিদের।

“গুড মর্নিং, দর্পণ বাবা।”

দর্পণ অনুকরণ করার চেষ্টা করল। রাফিদ বসে ওর গালে চুমু খেল, সে-ও একই কাজ করল।

তপা ভেতরে ঢুকছিল, এই দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল দরজার বাইরে। কী চমৎকার মন ভালো করা একটা দৃশ্য! সারাদিন পৃথিবী ভুলে গিয়ে তাকিয়ে দেখা যায়।
……..
ক্রমশ

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩৫)
নুসরাত জাহান লিজা

রাফিদের অভ্যাস ঘুম ভাঙার পরেও খানিকক্ষণ শুয়ে থাকা, তখন কেমন অলসতা মেখে থাকে গায়ে। মায়ের কাছে টুকিটাকি অনেক বকুনিও খেয়েছে সে এর জন্য। সে হেসে বলত,

“ঘুম থেকে উঠলাম, এখন একটু রেস্ট নিচ্ছি। তারপর উঠি মা।”

এখন ওর সেই অলসতা উদযাপন পিরিয়ড চলছে। তপাকে ভেতরে আসতে দেখে রাফিদ প্রশ্ন করল,

“দর্পণ কোথায়?”

“রুমা আপুর মেয়ে নিয়ে গেল। তুমি কখন উঠবে? খাবার কিন্তু হয়ে গেছে।”

হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে রাফিদ বলল,

“এই তো উঠছি।”

তপা ঘরের জিনিসপত্র গুছাচ্ছে, এখানে-ওখানে হাঁটছে, কাঁচের চুড়ির রিনঝিন শব্দ হচ্ছে। রাফিদের শুনতে ভীষণ ভালো লাগছে। সে নতুন করে জেনেছে, তপা কাচের চুড়ি পরতে ভীষণ ভালোবাসে৷

কিছুক্ষণ পরে তপা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে বসল, রাফিদ তখনো নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে সেদিকে। তপা আধভেজা চুল আঁচড়াচ্ছে, আয়নায় ফুটে উঠা প্রতিবিম্বতে ওকে কী যে সুন্দর লাগছে দেখতে। রাফিদের মোহাবিষ্ট দৃষ্টি আয়নায় দেখল তপা, প্রতিবিম্বে প্রতিবিম্বে চোখাচোখি হলো। তপা জিজ্ঞেস করল,

“কী দেখছ?”

“তোমাকে।” ঘোরগ্রস্ত গলায় বলেই সাথে যোগ করল, “তোমাকে শীতের সকালের ঘাসের উপরে জমা শিশিরের মতো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।”

স্তুতিবাণী শুনে তপা ঘুরে তাকালো, রাফিদ উঠে এসে তপার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

“তোমাকে প্রথমবার এত কাছ থেকে দেখছি। তোমার এই মুহূর্তের অভিব্যক্তি সাথে মুহূর্তটাকে হৃদয়ের ফ্রেমে চিরস্থায়ী করে নিচ্ছি, যাতে সারাজীবন তোমার এখনকার মুখটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে পারি, স্মৃতিটাকে রোমন্থন করতে পারি।”

“প্রথম বলেই এত মুগ্ধতা। পরে…”

“কিছু মুগ্ধতা কখনো কমে না তপা, বরং বাড়ে। তুমি তো কবিতা ভালোবাসো, রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন আছে না?
‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি. শত রূপে শত বার,
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।’ তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাও তেমনই।”

তপা রাফিদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “আমারও তাহলে মুহূর্তটাকে হৃদয়ের ফ্রেমে চিরস্থায়ী করা উচিৎ, তাই না?”

রাফিদ হাসল, সরলতা মাখা সোম্য হাসি৷ তপার গলাতেও মুগ্ধতা,

“তোমার হাসি ভীষণ সুন্দর রাফিদ। শিশুর মতো সরল, মন ভালো করে দেয়।”

রাফিদের মনে হলো পৃথিবীটা ভীষণ সুন্দর।

“কমপ্লিমেন্ট কেবল তোমরা ছেলেরাই কেন দেবে? আমিও দিতে পারি।”

সত্যি বলতে তপার মুখ থেকে নিজের জন্য প্রশংসা শুনতে উন্মুখ হয়ে ছিল রাফিদ। ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজের প্রতি মুগ্ধতার বুলি শুনতে কার না ভালো লাগে।

“মিথ্যে করে হলেও এভাবে সবসময় বোলো তপা৷ আমার খুব ভালো লেগেছে শুনতে।”

“মিথ্যে করে কেন বলতে হবে? যার ভেতরে এমন চমৎকার একটা মন আছে, সে নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষের মধ্যে একজন। এই সৌন্দর্যকে ইগনোর করা সম্ভব?”

সকালটা এত সুন্দর হবে তা রাফিদ ভাবতে পারেনি। এমন আরাধ্য প্রাপ্তির সুখ যে এত বিস্তৃত তা আগে কখনো জানা হয়নি ওর।

***
শিরীনের সাথে জয়নালের একটা টানাপোড়েন চলছে। রাফিদের বিয়ে নিয়ে তার কত স্বপ্ন ছিল, অথচ সেই ছেলের বিয়েতেই কি-না তিনি থাকতে পারলেন না। তাকে বিয়ে দেখতে হলো ভিডিওকলে। একজন মায়ের জন্য এরচেয়ে কষ্টকর আর কী হতে পারে!

অপরদিকে জয়নুল, চেষ্টা করেছেন কয়েকবার, পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলার জন্য। কিন্তু তিনি শুনতেই চাননি।

বাড়িতে এখন দুটো মাত্র প্রাণী। কেমন নির্জীব মনে হয়। অথচ রাফিদ সেদিনই গেল। ছেলে যেখানেই যাক, ঘুরে বেড়াক, দিন শেষে তার কোলেই ফিরবে ভেবে তিনি মানিয়ে নিতেন। কিন্তু এখন যখন নিশ্চয়তা নেই কবে ফিরবে কিংবা আদৌ ফিরবে কি-না , তখন তার মাতৃ হৃদয় সন্তানের জন্য বারবার আকুল হয়ে উঠছে।

“শিরীন..”

শিরীন একবার তাকিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। উত্তর দিলেন না।

“ইদানিং তুমি সবসময় বলো, তুমি আমাকে পড়তে পারছ না। যদি আমি পাল্টা অভিযোগ করি যে তুমি আমাকে আগের মতো করে বুঝতেই চেষ্টা করো না!” বলেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ছেলেকে নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনার কথা শিরীনকে আর জানাতে চেষ্টা করবেন না। এখন তিনি পুত্রশোকে কাতর, তার কথা শুনতে চাইবার পরিস্থিতি নেই।

***
দর্পণকে কোলে নিয়ে রাফিদ ফেসবুকে ওর পোস্ট করা ছবির কমেন্ট চেক করছিল। ওদের বিয়ের দিনের ছবিটা পোস্ট করেছে। ছবিতে ওর কোলে হাস্যোজ্জ্বল দর্পণ, পাশে তপা। ক্যাপশনে লিখেছে,

“পথ আমাকে ভীষণভাবে টানত, পথ ধরে অক্লান্ত হেঁটে আমি আবিষ্কার করতাম প্রকৃতিকে। পথের কোনো এক বাঁকে তার সাথে দৈবক্রমে দেখা হলো। প্রকৃতির চাইতে তার টান প্রবল হয়ে উঠল, আর তাতেই পথিকের পায়ে হাঁটা থেমে গেল। হঠাৎ করে ঘর আমাকে ডাকল। এত সম্মোহনী শক্তি যে টানে, আমি উপলব্ধি করলাম, তার নাম ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষের সাথে ঘর গড়া শুরু করলাম। সবাই দোয়া করবেন।”

অসংখ্য কমেন্টে চলছে শুভকামনা আর টীকা টিপ্পনীর ঝড়।

“অবশেষে তুইও…”

“দ্য মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর, তরুণীর হৃদয় ভেঙে দিল” একজন বন্ধু মজা করে লিখেছে।।

কেউ কেউ দর্পণের কথা জিজ্ঞেস করেছে, “বাবুটা কে?”

বন্ধুদের জন্য বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাই তারা বিস্ময় প্রকাশ করতে ভুলছে না।

রাফিদের এই মুঠোফোন দর্পণের সহ্য হচ্ছিল না, টানাটানি শুরু করেছিল বলে সেটা রেখে দিয়ে শুয়ে বুকের উপর দর্পণকে রাখল।

এরপর বলল, “আমি তোর বাবা। বলতো সোনা, বাবা।”

বেশ কয়েকবার চেষ্টায় খানিকটা সফল হলো, দর্পণ বলল,

“দাফেত বাবা।”

রাফিদের খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছিল। এত চমৎকার কেন এই অনুভূতি!

তপা দেখছিল ওদের খুঁনসুটি। সে ভেবেছিল, দর্পণের জন্য বাবা-মা দুটোই সে। এখন মনে হচ্ছে, দর্পণ ওর বাবাকে পেয়ে গেছে।

রাফিদের পোস্টটা সে দেখেছে। কমেন্টে প্রশ্নের উত্তরে দর্পণকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ‘আমার ছেলে’ বলে।

তপা জিজ্ঞেস করল, “তুমি বিয়ের ছবি পোস্ট করেছ, তোমার অস্বস্তি হয়নি?”

রাফিদ দর্পণকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অস্বস্তি কেন হবে? আমার এই খুশিটা এতটা চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, যতটা চিৎকারে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ধূলিকণা অব্দি জেনে যায়। দর্পণকে দেখে আমাকে নিয়ে মানুষ কী ভাববে বা বলবে সেটা ভাবছ তো? আমার ভালোবাসা এতটাও ঠুনকো নয় তপা। একসাথে চলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি আমরা। সেটা জানাতে পারব না?”

তপা ইদানীং রাফিদে মুগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মুগ্ধতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে।

***
মাস তিনেক আগেই তপার সাহসিকতার প্রশংসা মানুষের টাইমলাইনে জায়গা পেয়েছিল। তাই সে কিছু মানুষের কাছে পরিচিত। তার বিয়ের খবরও তেমনই কীভাবে যেন অনেকে বের করে ফেলেছে।

কবীরের বন্ধুর ওয়াইফ ফোন করে তপার বিয়ের খবরটা ওকে দিল। খবরটা ওকে তাতিয়ে দিয়েছে৷

যে মেয়েকে কদিন আগেও সে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিল, সে-ই মেয়ের এত তেজ ওর অসহ্য লাগছে।

ভেবেছিল তপা কদিনেই ডিভোর্সের জন্য অনুশোচনাবোধ করবে। একটা দুর্বিষহ জীবন কাটাবে। তখন কবীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে মেয়েদের কতটা নমনীয় হতে হয়! সব ভেস্তে দিয়ে বিয়ে করে বসে আছে। এটা ওর কেন সহ্য হবে।

সে হারতে জানে না। একটা সামান্য নারীর কাছে হার স্বীকার করার মতো মানুষ অন্তত কবীর নয়। এতে তার পৌরুষ আঘাতপ্রাপ্ত হবে। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে তো।

ওর ব্যবসায়িক কনসালট্যান্টকে কল দিল সে।
……….
(ক্রমশ)