#কুহকিনী
#হুমায়রা_শাম্মী
পর্ব সংখ্যা—৫ (সমাপ্তি)
নয়িম ভেজা শার্ট গায়ে জড়িয়ে নেয়।জাবিনের দিকে ফিরে বলল, “চলো বাসায় যাই।”
জাবিন উঠে দাঁড়ায়।নয়িমের পিছনে ধীরে গতিতে চলছে।ব্রিজের নিচের থেকে বের হতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়া শুরু করে।নয়িম আকাশের দিকে তাকায়।বৃষ্টির সাথে বাতাস বইছে।বড় ঝড় উঠার পূর্বাভাস। জাবিন নয়িমের কাছে আসে।নয়িম বলল, “এক জায়গায় দু’জনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর উঠবে।”
“আচ্ছা চলেন তাহলে।”
নয়িম তাকে নিয়ে আবারো ব্রিজের নিচে আসে।আশপাশে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো জায়গা নেয়।তাই তারা আবারো ব্রিজের নিচে আসে।নদীর পানিতে ঢেউ উঠেছে।জাবিন হাঁচি দেয়।নয়িম তা দেখে বলল, “ভিজা কাপড় বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লাগবে।”
“এখন কি করা যাবে?”
“চলো বাসায় এভাবে যাই।আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি থামবে না।”
দুজনে আবারো ব্রিজ থেকে বের হয়।আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।জাবিন নয়িমের একদম নিকটে আসে।নয়িম রাস্তায় কিণারায় দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে।কিন্তু ফলাফল শূন্য হচ্ছে।একটা সিএনজি থামে।নয়িম সামনের সিটে বসে।জাবিন পিছনে বসে।জাবিনের পাশে একজন মধ্য বয়সের লোক বসা ছিল।নয়িম পিছনে ফিরে।তার সুবিধে লাগছে না।পরে সেও পিছনে এসে জাবিনকে কিনারার সিটে বসতে দিয়ে সে মাঝে বসে।সিএনজি দ্রুত চলছে।জাবিন পরপর হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে।নয়িম কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বলল, “বেশি ঠান্ডা লাগছে?”
জাবিন মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ।নয়িম বলল,” তোমারই দোষ।পাগলের মতো ছুটে এখানে আসছ।নিজেও নদীতে পড়েছ সাথে আমাকেও ফেলে দিয়েছ।এখন বুঝো মজা।”
জাবিন একপলক নয়িমের দিকে ফিরে।জাবিনের চোখে,মুখে কি আকর্ষণ ছিলো নয়িম তা পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।তবে তার মনে সেটা তোলপাড় সৃষ্টি করে।জাবিন নিচের দিকে ঝুঁকে যায়।নয়িম বলল,” কি হয়েছে? ”
“আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।”
নয়িম তার মাথা তুলে নিজ কাঁধে রাখে।নয়িমের কাজে জাবিন হতবিহ্বল হয়।তবে সে আরামসে তার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে।নয়িম জাবিনের পিছন থেকে তাকে ধরে।কিছুক্ষণের মধ্যে সিএনজি তাদের গন্তব্যে আসে।তারা নেমে যায়।জাবিন সিএনজি থেকে নেমে নয়িমকে ফেলে দ্রুত নিজ ফ্ল্যাটে চলে যায়।নয়িম ভাড়া দিয়ে সেও নিজ রুমে চলে আসে।
_______________________
রাত তখন দশটা বাজে।ইমতিয়াজের ফোন এসেছে।নয়িম রিসিভ করে বলল,” কেমন আছিস?”
“এই তো কোনো রকম।গায়ে জ্বর এসেছে। আজ বাড়িতে যাচ্ছি। ”
“ঢাকা আসবি না?”
“আসব কয়েকদিন বাড়িতে থাকি।সুস্থ হয়ে উঠি আগে।”
“সাইমার কাছে আর নিজেকে দাঁড় করাবি না?”
“সেটা তো করব।আমি এত সহজে পরাজয় মেনে নিবো না।তবে এখন না।নিজেকে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করে দাঁড় করাব।আচ্ছা রাখি।”
ইমতিয়াজ ফোনের লাইন কেটে দেয়।বাসের সিটে গিয়ে বসে।বাহিরের দিকে তাকায়।মনে মনে সে সংকল্প করে নিজেকে যেদিন প্রতিষ্ঠিত করবে তখন সাইমার সামনে দাঁড় করাবে।তার কিড*ন্যাপে সাইমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছে।এখন সে পড়াশোনা নিয়ে আছে।সে শুনেছে সাইমা তিন বছরের মধ্যে বিয়ে বসবে না।ইমতিয়াজ এই সুযোগকে কাজে লাগাবে।এর মধ্যে নিজেকে নতুন করে সাজাবে।যাতে সাইমা নিজ থেকে তার কাছে আসে।
নয়িম ফোন রেখে শোয়ে যায়।বৃষ্টির পানিতে ভিজার ফলে শরীর খারাপ লাগছে।সাথে মাথা ব্যথা করছে।নয়িমের ফোন বাজে।জাবিন করেছে।নয়িম রিসিভ করে বলল, “হ্যালে।”
“কি করছেন?”
জাবিনের কণ্ঠে অসুস্থতা বুঝা যায়।ঠান্ডা লেগেছে,সাথে গায়ে জ্বর এসেছে।নয়িম বলল,” তুমি অসুস্থ? ”
“হ্যাঁ,খুব খারাপ লাগছে।”
“ঔষধ খেয়েছ?”
–হ্যাঁ,
“ঘুমিয়ে যাও।দেখবে সকালে সুস্থ হয়ে গিয়েছ।”
“একটু বাহিরে আসবেন?”
–কেনো?
“আসেন, আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
নয়িম না করতে পারেনি।সে আচ্ছা বলে উঠে দাঁড়ায়।গায়ে চাদর জড়িয়ে নেয়।বাহিরে বৃষ্টি না থাকলেও শীতল বাতাস বইছে।নয়িম ফ্ল্যাটের বাহিরে আসে।জাবিন দাঁড়িয়ে আছে।জাবিন উপরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল,” চলেন ছাদে যাই।”
নয়িম তার পিছনে আসে।দু’জনে ছাদের আসে।শীতল বাতাস একটু বেশিই ছিল।দূরে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখা গেলো।আবার বৃষ্টি হবে হয়তো।নয়িম বলল,” কি বলবে বলো।একটু পরে মনে হয় বৃষ্টি হবে।”
জাবিন তার দুই বাহু চেপে ধরে।ঠান্ডায় তার শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।শীতে ঠোঁট নড়ছে।সে নয়িমের দিকে ফিরে বলল, “আমি আপনার চাদরের নিচে আসতে পারি?”
নয়িম আশ্চর্য হয়।ভ্রু কুটি করে তার দিকে ফিরে।জাবিন মৃদু হেসে বলল, “আমি সেভাবে বুঝাই নি।মানে আপনার চাদরের এক মাথা আমার গায়ে দিবেন।”
নয়িম চাদরের এক মাথা জাবিনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।জাবিন তার গায়ে জড়িয়ে নেয়।এতে দু’জনের উপকার হলেও তেমন হয়নি।দু’জন শীতল হয়ে যাচ্ছে। নয়িম বলল,” কি বলবে বলো।এই শীতল বাতাসে বাহিরে থাকা যাচ্ছে না।এমন আবহাওয়াতে একটা ঘুম দিলে ভালো লাগবে।”
জাবিন নয়িমের কাছে আসে।তার গায়ের সাথে নিজের শরীর আলতো করে লাগায়।নয়িম কিছু বলল না।সে সেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল।
“জাবিন তোমার কিছু বলার নেয়?”
“আমি তো বলেনি আপনাকে কিছু বলব। আমি বলেছি আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“তাহলে দেখা হয়েছে।যাই তাহলে।”
“চলে যাবেন?”
“জাবিন তোমার শরীর ভালো নেয়।আমারও শরীর দূর্বল। দু’জনে গিয়ে শোয়ে পড়লে ভালো হবে।”
–আচ্ছা।
__________________________
আজ শনিবার। জাবিনের পরীক্ষা। সে তৈরি হয়ে পরীক্ষায় চলে যায়।নিজের মনের মতো পরীক্ষা দেয়।পরীক্ষা হল থেকে বের হতেই গেইটে নয়িমকে দেখতে পায়।ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চুলগুলো উসকোখুসকো।জাবিন তার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি এখানে?”
–হ্যাঁ,
নয়িম নিজ কপালে হাত রেখে বলল,” আমার গায়ে জ্বর উঠেছে।দেখো তুমি।’
জাবিন নয়িমের কাজে অবাক হয়।নয়িম তার সাথে এমন আচরণ কখনো করেনি।নয়িম তার হাত চেপে ধরে সিএনজিতে তুলে।জাবিন বলল,” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
সিএনজিতে কেউ ছিলো না।সামনে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। নয়িম তার মাথা জাবিনের কাঁধে রেখে দেয়।জাবিনের হাত এখনো তার হাতে মুষ্টিবদ্ধ।জাবিনের কাঁধে নয়িমের শরীরের জ্বর অনুভব হচ্ছে। আজ পরীক্ষা থাকায় সেই রাতের পর সে নয়িমের সামনে আসেনি।একদিন ধরে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ছিল।জাবিন বলল ,”আপনি ঠিক আছেন?”
–না,
“শরীর বেশি খারাপ লাগছে?”
–হ্যাঁ,
সিএনজি সেই ব্রিজের সামনে থামে।নয়িম ভাড়া দিয়ে নেমে যায়।জাবিনের হাত এখন সে ধরে আছে।তাকে নিয়ে ব্রিজের উপর আসে।আশপাশে তেমন মানুষ নেয়।অদূরে কয়েকজন দেখা যাচ্ছে।জাবিন রেলিংয়ে গিয়ে দাঁড়ায়।নয়িম তার হাত আরো একটু চেপে ধরে বলল, “আমার জাবিন এই দু’রাত তেমন ঘুম হয় নি।”
–কেনো?
“তোমার কথা মাথায় ঘুরছিল।”
“সেটা কেনো?”
“এটা তুমি ভালো ভাবে জানো।জাবিন আমার খুব জ্বর উঠেছে।”
জাবিন তার হাত কপালে রেখে বলল,” এত জ্বর নেয়।”
“কি জ্বর নেয়!তোমার জন্য জ্বর এসেছে।”
“আমি কি করলাম?”
নয়িম নদীতে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল,” এখানে তুমি আমাকে ফেলে দিয়েছিলে।জাবিন আমি তোমার প্রতি ভিষণ ভাবে দূর্বল হচ্ছি।সোজাসাপ্টা বলি আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”
জাবিন তার হাত নয়িমের থেকে ছাড়িয়ে বলল,” আপনারো কথা।”
“সত্যি ভালোবাসি।”
জাবিন মনে মনে খুশি হয়।তবে সে প্রকাশ করতে দেয় নি।মুখের অভিব্যক্তি এমন করেছে যেনো সে তাকে অপছন্দ করে।নয়িম বলল, “আমি জানি তুমিও আমাকে পছন্দ করো।”
“মুটেও না।”
“জাবিন তুমি তোমার মুখের অভিব্যক্তি ভালো ভাবে প্রকাশ করতে পারছ না।তোমার মনের ভিতরের অবস্থা বুঝা যাচ্ছে। তুমি আমাকে পছন্দ করো এটা বুঝা যাচ্ছে।”
“আপনি বললেই হলো।আমার মনের ভিতর এইসব চলছে না।”
“আচ্ছা তাহলে চলে যাই।”
নয়িম চলে যাচ্ছে। জাবিন পিছন থেকে বলল,” আমাকে নিয়ে যান।”
“নিয়ে গেলে কি হবে!তুমি আমাকে পছন্দ যেহেতু করো না তাই একা যাও।”
জাবিন পিছন থেকে নয়িমের শার্ট টেনে ধরে বলল, “আপনি আমাকে এখানে এনেছেন।তাই আপনি নিয়ে যাবে।”
“নিয়ে যাবো না।”
জাবিন দাঁড়িয়ে যায়।নয়িম হেঁটে অনেক দূরে আসে।পিছন ফিরে দেখে জাবিন এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।নয়িম জাবিনকে ডাক দেয়।জাবিন উত্তর দেয় না।নয়িম আবারো তার কাছে আসে।জাবিনের হাত চেপে ধরে বলল, “এত অভিমান! ”
জাবিন এটাই চেয়েছিল।নয়িম যেনো আগের মতো তার হাত ধরে নিয়ে যায়।জাবিন নয়িমের দিকে তাকায়।ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলল,” আমি আপনাকে সারাজীবনের জন্য চাই।”
নয়িমও মৃদু হাসল।সে জাবিনকে নিয়ে যায় সামনের দিকে।তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো নতুন জীবনের দিকে।এমন জীবন সেখানে তারা দু’জন দু’জনকে মন উজাড় করে ভালোবাসবে।
সমাপ্তি