এক আকাশ রুদ্ধশ্বাস পর্ব-০২

0
227
এক আকাশ রুদ্ধশ্বাস" পর্ব- ১ (নূর নাফিসা)

#এক_আকাশ_রুদ্ধশ্বাস
#পর্ব- ২
(নূর নাফিসা)
.
.
পালিয়ে বিয়ে করলে পরিবার মানবে না, জানতো নওরিন। কিন্তু কোপাকোপির মতো মারাত্মক আক্রমণ করবে শাবাবের উপর, তা জানা ছিলো না। এর আগে শাবাবের ব্যাপারটা জেনে তাকে ব্যাপক শাসিয়েছিলো পরিজন। জানিয়েছিলো, পড়াশোনা শেষ করলেই বড়ো ফুপুর ছেলের সাথে বিয়ে দিবে আব্বা। বড়ো দুই ভাই আর ওই ফুপাতো ভাই এক হাতের মানুষ। আব্বার হুকুমে ব্যবসায়, জমিজমা আর ফসলাদির সকল খবরদারি করে তিনজন। ছোট ভাইয়ের কড়া শাসানোতে শাবাবের ব্যাপারটা পরিবারে আবার উঠলে এবার পড়াশোনা শেষ হওয়ার কোনো অপেক্ষা আর রাখে না। বিশাল আয়োজনে বিয়ের বন্দোবস্ত শুরু করে দিচ্ছিলোই বলে। নওরিন জানে, জোরপূর্বকই বিয়ে দিয়ে ছাড়বে। তাই ছোট ফুপুর মেয়ের বাড়ি গিয়ে হঠাৎ বিয়ের লুকোচুরি আয়োজন। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার ঘন্টাখানেক সময় মাত্র এই আয়োজনে মাতামাতি ছিলো ফুপাতো বোনের সেই ঘরটা। এরপরই জানতে পারে, ভাইয়েরা খবর পেয়ে গেছে। হুলুস্থুল করে আসছে এদিকে। সেই থেকে এই দৌড়াদৌড়ির উপরই আছে। বাড়ির আশপাশটা তাদের হুলস্থুলে উত্তপ্ত হয়ে আছে৷ বোনের বাড়িতে আরও উত্তাল সৃষ্টি করেছে কি না, কে জানে! তবে ভাবনা আপুকে কড়া জবাবদিহিতায় যে পড়তে হবে, তা ভালোই জানা আছে। যত দুশ্চিন্তা এখন তার, একমাত্র শাবাবকে নিয়ে। তাকে পেলে রেহাই দিবে না। যদি এতোটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে জানতো, তবে আগে পালাতো। তারপর দূরে কোথাও গিয়ে বন্ধন গড়ার সিদ্ধান্ত নিতো। দুর্ভাগ্যক্রমে নিজ গন্ডিতে বিয়ে করে এখন মহা ফাঁদে পড়েছে, একেকটা নিশ্বাসে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা বিরাজ করছে। একটু আড়াল হওয়ার মতো পথের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অথচ, এতো দুরূহ একটা সময়েও লোকটা মজা করে চলেছে। জিজ্ঞেস করলো শরীরের অবস্থা, উত্তর করলো তার সাজসজ্জা! প্রেম যেন তার অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে বাবলা গাছের আঠার মতো। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় বাবলা গাছের ভুত হয়ে তার ঘাড়ে চেপে বসুক। এতো কড়া প্রেম করতে আছে?

এই প্রেমের জন্য গতবছর মালয়েশিয়ার ফ্লাইট মিস করেছে শাবাব। একটু বাউন্ডুলে ছেলে হওয়ায় পিতামাতা চেয়েছিলো বিদেশ পাঠিয়ে দিবে। উপার্জনে জীবনের একটা গতি ঠিক করে নিবে। সকল বন্দোবস্তোও হয়ে এসেছিলো। এরইমধ্যে বিদেশ যাবে শুনে নওরিনের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। এমনিতেই ঘরের পীড়াপীড়ি তার ভালো লাগছিলো না। শাবাব বিদেশ গেলে প্রেমের বিচ্ছেদ বুঝি সুনিশ্চিতভাবেই ঘটে যাবে। ফলশ্রুতিতে বিদেশ যাওয়াটাই ক্যান্সেল করে দিয়েছিলো শাবাব, দেশেই একটা কিছু নিশ্চিত করার অঙ্গিকার দিয়ে। মায়ের কাছে দেওয়া সেই অঙ্গিকারের কোনো সুফল আজও ফলাতে পারলো না। তাতে মায়ের দুঃখ ততোটাও ছিলো না। একমাত্র ছেলেকে দূরে পাঠাতে তারও ভালো লাগছিলো না। তবে বাবা রাগ করেছিলেন ভীষণ। আজও হয়তো বাবা রাগ করবেন। সামনে পড়লে দুই গালে দুইটা চড়ও লাগাতে পারেন। মা বলবেন, “থাক না। ছেলে তো আমার চলে যায়নি৷ ঘরের ঘরণী এনেছে। আল্লাহর বরকত এনেছে।” তারপর যখন পুত্রের দায়িত্বশীলতা আর পুত্রবধূর গোছানো সংসার তিনি দেখবেন, তখন প্রাণভরে হাসবেন; নিশ্চিত।

নওরিনের পায়ের অনেক জায়গায় কেটে গেছে ভাঙা শামুক আর পথের ইট কণায়। ঝোপঝাড়েও তো দৌড়েছে। গাছগাছালির কাটাও বিঁধে থাকতে পারে। আপাতত আঙুলের চিপা থেকে শামুকের ভাঙা কণা চিমটে তুলে আনছে সদ্য ভোরের ম্রিয় আলোতে। শাবাব তার পা তুলে কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করে আরও কণা আছে কি না। নুপূরে চোখ ফেলে বলে,

“নূপুর কোথায়?”

নওরিনের মুখখানা হঠাৎই আরও বিষাদময় হয়ে উঠে। তার পায়ের এক জোড়া নূপুর গায়েব! মায়ের গড়ে দেওয়া নূপুর জোড়াই নেই! বছর কয়েক আগের হওয়ায় একটু আঁটসাঁট হয়ে গিয়েছিলো পায়ে। দৌড়ঝাঁপে ছোটাছুটি করায় হয়তো পায়ের চাপে ছিঁড়ে গেছে সহজেই। এখন যেগুলো আছে, এগুলো ঢিলে হওয়ায় টিকে আছে। পুরো এক জোড়া নূপুর হারিয়ে মনটা হতাশায় ঢেকে গেলো। শাবাব থুতনি ছুঁয়ে বললো,

“মন খারাপ করো না। আমি আবার গড়ে দিবো ওই নকশায়।”

গড়লেই কী? মায়ের স্মৃতি ফিরবে? তবুও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না সে। ভাগ্যের পরিহাস মন্দ বলেই হয়তো একের পর এক ঘটে যাচ্ছে। তবুও অগ্রযাত্রা সফল হলেই হয়। হতাশাটুকু মনের ভেতর চেপে রাখলো। সবকিছু নিয়ে কাঁদলে তো চলবে না। কাল থেকে কাঁদছে, আর কত কাঁদবে? এখন উপায় খুঁজতে হবে। বাঁচার উপায়। নওরিন পা নামিয়ে নিয়ে ধীর নিশ্বাস ফেলে। ভেজা চোখে শাবাবের পানে তাকিয়ে অনুনয়ের গলায় বলে,

“আপনি দূরে কোথাও চলে যান। দূর কোনো বন্ধুবান্ধব নাহয় আত্মীয়ের বাড়ি। তবুও এই এলাকা ছাড়ুন। নয়তো আপনাকে তারা ছাড়বে না।”

“আর তুমি?”

“আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমার কিছু হবে না।”
“আমারও হবে না।”

“পাগলামো করবেন না। আপনাকে তারা বাঁচতে দিবে না। একটু তো ভয় করুন।”

“তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারলে তো আগেই বেঁচে যেতাম।”

নওরিনের অশ্রুধারা আবার বাঁধ ভাঙে। তবে কান্নার কোনো শব্দ হয় না। যেমন বাঁধাহীন অশ্রু গড়াচ্ছে, তেমনই বাঁধাহীন কথা ঝরাচ্ছে।

“আপনার শরীরটা ভালো না। এসব ঢংয়ের কথা একদম বলবেন না। আগে নিজে বাঁচুন। নিজে বেঁচে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচুন।”

“চলো, সঙ্গে নিয়েই বাঁচি তবে।”

শাবাব উঠতে যায় তার হাত টেনে। নওরিন উঠে না তার টানে। তাকেও উঠতে দেয় না। কথা শুনতে বাধ্য করার চেষ্টা করে।

“আগে নিজে বাঁচুন। তারপর আমাকে বাঁচাবেন।”

“বাঁচতে হলে একত্রেই বাঁচবো। যেতে হলেও একত্রেই যাবো। চলো…”

“বুঝার চেষ্টা করুন, প্লিজ। আমি ছুটে কূলাতে পারছি না। আমার জন্য আপনি ধরা পড়ে যাবেন। নিজেকে নিরাপত্তায় নিয়ে যান আগে। এটাই আপনার জন্য আপাতত উত্তম কোনো উপায় হবে। যতদ্রুত সম্ভব, আপনি এই এরিয়াটা ছেড়ে দিন।”

“আমাকে একা ছাড়তে তোমার ভয় করবে না?”

নওরিন নির্লিপ্ত চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় ব্যর্থতার ভারে। তার মনের অভিব্যক্তির ব্যাখ্যা তার কাছেই নেই। তার সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন, তার কেমন লাগছে; কেন তাকে এমন কঠোর পরিস্থিতিতে ফেলেছে! এতো নির্মম ভয়ের জন্ম এই মনে আর হয়নি এর আগে৷ অথচ এই লোক জানতে চায়, ভয় করবে কি না? ব্যর্থতার রেশ আরও এক ধাক্কা দেয় মনের অন্তস্তল থেকে। সে নিজেই পারবে না, তাকে একা ছাড়তে। অথচ মনোভয়, অতিসত্বর ধরা পড়ে যাবে বুঝি তারই জন্য থেমে থেমে। যেখানে তার এখন প্রবল গতিতে ছুটে পালানোর সময়। প্রকৃতির আলো যত উজ্জ্বলিত হতে থাকবে, তত বিপদ ঘনিয়ে আসবে।
নওরিন বসা থেকে উঠে আশপাশের বাসস্থানের দিকে তাকায়। একটু পানির ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। শুকনো গলা খুশখুশ করছে৷ কারো কল চেপে পানি আনতে পারলেও হতো। মানুষজন ঘুম ভেঙে জেগে গেছে কি না, কে জানে? শাবাবকেও অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অনেকটা রক্ত ঝরে গেছে দেহ থেকে। নিজের রক্তমাখা শুকনো হাতটার দিকে তাকালেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। শাবাবের পিঠ আর শার্টের দিকে না-ই বা দেখুক! একটু পানি খাওয়াতে পারলেও হয়তো এতোটা রক্ত ঝরতো না রক্তক্ষরণের সময়। মনের ভেতর ব্যাপক সংশয় রেখে সে পা বাড়িয়েছে মাত্র। শাবাব পিছু বলে,

“কোথায় যাও?”

“আসছি একটু। আপনি বসুন।”

“যাচ্ছো কোথায়, শুনি?”

“আমার পিপাসা পেয়েছে খুব। দেখি, একটু পানি পাই কি না।”

“আমিও যাবো।”

“না। আমি নিয়ে আসবো আপনার জন্য। চুপচাপ বসুন। নড়াচড়া করবেন না একদম।”

নওরিন এই মেহগনি বাগান পেরিয়ে আবাসস্থলের দিকে যায়। নিরব বাড়ি। ঘরে আলো জ্বললেও বাইরে কেউ নেই। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজে, পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য। তেমন কিছু না পাওয়ায় মাথায় ঘোমটা বড়ো করে টেনে টিউবওয়েলের কাছে যায়। সেখানে একটা সিলভারের বালতি রাখা আছে। নওরিন তাতে কাঙ্ক্ষিত একটা মগ পেয়ে যায়। বালতি থেকে পানি নিয়ে হাতটা ঘঁষে ঘঁষে পরিষ্কার করে নেয়। অতঃপর সাবধানে কল চেপে নিজের তৃষ্ণা মেটায়। এরইমধ্যে দরজার খিলির শব্দে পানি গলায় আটকে যায়। একটু ভয় পেয়ে গেছে বটে। কার না কার চোখে পড়ে যায়, লুকানোরও উপায় নেই। ওদিকে এক বুড়ি বেরিয়ে এসেছে দরজা খুলে।

“কে রে এনে?”

এতো সাবধানে কল চাপার পরও শব্দ কান ছুঁয়ে নিয়েছে বুড়ির। নওরিন মুখের পানি গিলে নিচু শব্দে জবাব দেয়,

“আমিই দাদি।”

“আমি কেডা? কী করছ?”

“একটু হাতমুখ ধুচ্ছিলাম।”

বেনারসিতে বুড়ির দৃষ্টি জোড়া বুঝি একটু বেশিই আকর্ষিত হয়। তুরতুরিয়ে চলে আসে নওরিনের নিকট। ড্যাবড্যাব করে তাকাতেই অস্বস্তি ঘিরে ফেলে নওরিনকে। বুড়ি চোখের কোটরে বিস্ময় জাগিয়ে কণ্ঠ করে ফিসফিসে।

“চিনা চিনা লাগে! নিয়াজির মাইয়া নি?”

বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠে নওরিনের। বুড়ি গলায় বিস্ময় তুলে আবারও বলে,

“তুই বুঝি কাল পালাইছত হুনলাম! এহনো বাইরে ঘুরতাছত? তোর বাপ ভাই তো গেরাম আউলাইয়া খুঁজতাছে!”

নওরিন ভীত গলায় তাৎক্ষণিক আকুতি জুড়ে দেয়।

“আল্লাহর দোহাই, কাউকে কিছু বলবেন না দাদি। আমার খুব বিপদ।”

“না, কারে কমু? আমি ওই গেরামে যাই নাকি! ছুডো পোলা রাইতে বাড়ি ফিরা জানাইলো।”

“আপনি কাউকেই জানতে দিয়েন না, আমি যে এদিকে এসেছিলাম। একটু পানি নিয়ে যাই, দাদি। মগটা এক্ষুনি দিয়ে যাবো।”

বুড়ি হয়তো বুঝতে পেরেছেন যার সঙ্গে পালিয়েছে, সঙ্গী আশপাশেই আছে। তাই কোনো অতিরিক্ত প্রশ্ন করলেন না। নাকি শত রঙের ভাবনায় চুপ করে আছেন, কে জানে! নওরিন একটু এগিয়ে আবার ফিরে আসে।

“আমাকে একটা শার্ট দিতে পারবেন, দাদি? অনেক দূর যেতে হবে। তার শার্টটা ছুরির কোপে ছিঁড়ে গেছে। নয়তো একটা পুরাতন চাদর হলেও চলবে। গায়ে জড়ানোর মতো।”

“আল্লাহ! কছ কী! কোপ মারছে! কাটে নাই?”

“লেগেছে একটু।”

“খাড়া, আমি দেখতাছি।”

বুড়ি ঘরে গেলেও নওরিন দাঁড়িয়ে রয়নি। এক মগ পানি নিয়ে তুরন্ত পায়ে ছুটে যায় শাবাবের কাছে। শাবাবকে পানি পান করতে দেয়। পিপাসা মিটিয়ে শাবাব বাকি পানি চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয় এবং পায়ের পাতায় ঢালে। শামুকের ভাঙা খোলে নিজের পা কেটে আরও বেশি হা হয়ে আছে। ক্ষত জায়গায় হালকা পরিষ্কার করে নেয় সে। ঠিকমতো ধোয়া না হওয়ায় নওরিন জিজ্ঞেস করে,

“আরও পানি আনবো?”

“আর লাগবে না। আমাদের যাওয়া প্রয়োজন।”

“আসছি। মগটা দিয়ে আসি।”

“কেউ দেখেছে?”

তার আর জবাব দিলো না নওরিন। পা আলগা আলগা রেখে আধো পায়ের ভর ফেলে চলে গেলো পুনরায়৷ ফিরে দেখে বুড়ি বাড়ির সম্মুখ পথে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে হাতে একটা শার্ট আর একটা ওড়না নিয়ে। নওরিনকে আর ভেতরে যেতে হয়নি। বুড়ি ফিসফিসিয়ে বলে,

“শার্টটা লাগবো নি?”

নওরিন শার্টটা হাতে নিয়ে দেখে এবং বলে,
“হয়ে যাবে, সমস্যা নেই। অনেক অনেক ধন্যবাদ, দাদি। ঋণী হয়ে গেলাম আপনার কাছে। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”

বুড়ি ওড়না এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এইডাও নে।”

“এটা লাগবে না।”

“ধর বেডি। শাড়ির ওপরে জড়াইয়া নে। মানসের চোক্ষে পইড়া যাবি নইলে।”

নওরিন তা-ও গ্রহণ করে। যেতে যেতে মেহগনি বাগানেরই ঢালুতে জন্মানো ওষুধি গাছ টেনে নেয় সাথে। ফিরে এসে এর রষ নিংড়ে ক্ষততে দেওয়ার জন্য শাবাবের বাঁধা শার্ট খুলে নিতে চায়।

“দেখি একটু, কতটা কেটেছে। এগুলো দেন, একটু কাজে আসতে পারে।”

“মাথা নষ্ট তোমার! মরেই যাবো।”

নওরিনের হৃদয়টা তিরতিরিয়ে কেঁপে উঠে। গত আট-দশ ঘন্টায় মরণ শব্দটা তাকে হাজারবার ছুরিকাঘাত করেছে। এই মরণ থেকে বাঁচতেই তো রাতের আঁধারকে ভয় করতে ভুলে যাওয়া। নওরিন হাতের ওষুধি গাছগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এগুলো কাটা ঘায়ে দিলে জ্বালা করে ভীষণ। শাবাবের ক্ষতটা যেহেতু বেশি, এই মুহূর্তে শাবাবকে “ওহ্” শব্দ করতেও দেখতে পারবে না সে। সংগ্রহ করে আনা শার্টটাকে ঝেড়ে এগিয়ে দেয় শাবাবের সামনে। তাতেই শাবাব জানতে চায়,
“কার শার্ট নিয়ে চলে এলে?”

“কার, তা জানার প্রয়োজন নেই। কার জন্য এনেছি, তাতে মনোযোগ দিন। পরে নিন দ্রুত।”

“কোথায় পেলে এগুলো, শুনি?”

“চেয়ে নিয়ে এসেছি ওই বাড়ির দাদির কাছে। চুরি করার মতো মেন্টালিটি আজও জন্মায়নি। পরুন।”

“কে বলেছে তোমাকে এসব করতে? কার না কার শার্ট আমি পরবো!”

“জমিদারিত্ব কম ফলান। চুপচাপ পরুন।”

“জমিদার আমি না, তোমার বাপ ভাই।”

“এ তো সময়ই বলে দিচ্ছে। বাপ ভাইয়ের মর্যাদার গৌরব, আর আপনার অহংবোধ।”

“আমার এলার্জি আছে। চুলকাবে।”

“চুলকানোর সময় খুলে নিয়েন। এখান থেকে যেতে হলে নিজেকে লুকাতে হবে। খালি গায়ে কতটা দৌড়াবেন? আপনার এই রক্তভেজা শার্টই কতজনকে দেখাবেন?”

“তোমার ভাইয়ের শার্ট হলেও তো চলতো। আমার শার্টটা যে কেটে দিয়েছে।”

“বিরক্ত লাগছে কিন্তু এখন আমার।”

একটু দাঁত চাপা শক্ত গলায় কথা বলে নওরিন। শাবাব আপাতত তাকে আর বিরক্ত করতে চাইছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শার্টটা পরে নেয়। বাম হাতটা নাড়াতে গেলেই মুখাবয়বে তীব্র ব্যথার প্রতিক্রিয়া ভেসে উঠে। তার প্রতিক্রিয়ায় নওরিনের মুখ হয়ে উঠে ফ্যাকাসে। যেন ব্যথাটা সে পেলো। এগিয়ে সে সহযোগিতা করে শার্ট পরতে। পরা শেষ হতেই শাবাব হাত মেলে দেখায় হাতা প্রায় দেড় ইঞ্চি শর্ট।
“দেখেছো?”

“কিছু হবে না এইটুকুতে।”

“চলুন, যেখানেই নিয়ে যান; দ্রুত চলুন। সূর্য জাগার সাথে জনপথও জেগে উঠবে। তখন লোক চোখ ফাঁকি দেওয়া যাবে না।”

তাকে তাড়া দিয়ে নিজেই একটু ওষুধি গাছের রসে নিজের চিকিৎসা চালায় নওরিন। পায়ের পাতা জুড়ে কোনোরকম ঘঁষে নেয়। অতঃপর ক্লান্ত দেহটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায়। পায়ের ক্ষত যথারীতি বেদনাদায়ক পীড়া দিয়ে যাচ্ছে। শাবাব দৌড়াচ্ছে না। দ্রুত বেগে হাঁটছেও না। সে জানে, নওরিনের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। এদিকে নিজ দেহের একাংশও অবশ হয়ে আসছে। পায়ের অবস্থায় আর গুরুত্ব না-ই দিক। কাঁধের অবশতার প্রভাব হাতটা ঝুলিয়ে রাখতেও অনিচ্ছা প্রকাশ করছে। কাঁধ ফুলতে থাকছে, সেটা না দেখলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে। হাতের ব্যথাটা নখ পর্যন্ত অবশতা নামাতে উঠেপড়ে লেগেছে। বাম পাশের এই হাতটা হাঁটার ঝাকুনিতে কিঞ্চিৎ নড়েও তাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু নওরিনকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। এক রাতেই ফুলের মুখটা কাটায় ক্ষত হয়ে গেছে। এই ক্ষত কবে সেরে উঠবে, আল্লাহ ভালো জানেন। তারউপর নিজের ক্ষত ফুলের উপর চাপাতে পারবে না। তারা আবার চলতে শুর করে এই নিমতলি গ্রামটাও ছেড়ে দেওয়ার নিমিত্তে।

ওদিকে নওরিনের বাড়ির পরিবেশ থমকে আছে। গমগমে বাড়িটায় একটু পরপরই হুঙ্কার উঠে। একদল গ্রাম ঘুরে আর ঘন্টাখানেক পরপর এসে খবর দেয়, পাওয়া যায়নি। ফজরের আজান দিলে তারা ওই পথ থেকে ফিরে এসেছিলো। দিনের আলোয় হাতে দা, লাঠি নিয়ে হাঁটলে সমস্যা আছে। তবে তালাশে বিরতি নিচ্ছে না। বাড়ি এসে একটু জিরোয়, আবার বের হয়। আজানের সময় এসে দলটি এখনো যায়নি দেখছে নিয়াজি। চিন্তা ভাবনা করছে, গ্রামের বাইরে বেরিয়ে যেতে পেরেছে কি না। নাকি গ্রামেই কারো বাড়ি আশ্রয় নিয়েছে? তাদের এখন কোন দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার? এই ব্যাপারেই দুয়ারে ছোট ছেলের সাথে সাঙ্গপাঙ্গরা দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলো। নিয়াজি আবারও হুঙ্কার তুলে বলেন,

“তোরা এখনো বাড়িতে ক্যা? এতো ভাবাভাবির কী আছে? ঘরে ঘরেই খোঁজ কর। তারপর বাইরেও যা।”

“হুঁ, আব্বা। ঘরে ঘরেই খবর লাগাবো ভাবছি।”

“আর গুলা কই?”

“তারা সন্ধানে আছে রাস্তার দিকেই। বের করে ফেলবো শীঘ্রই। চিন্তা করবেন না। খবর পেলেই আপনাকে জানাবো।”

“খবর পেলে শুধু কবর দিবি৷ আর কিছু না।”

চলবে…