বহুব্রীহি পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
2

🔴বহুব্রীহি (পর্ব :১৬, ১৭, ১৮)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

সোবাহান সাহেব কোন কিছু না খেয়ে ১৬৬ ঘণ্টা পার করেছেন। মোটামুটি হাসি তামাশা হিসাবে যার শুরু হয়েছিল তার শেষটা সে রকম রইল না। মনসুর ঘোষণা করেছে আর বার ঘণ্টার ভেতর যদি কিছু খাওয়ানো না যায় তাহলে হাসপাতালে নিয়ে ফোর্স ফিডিং করা উচিত। রক্তে ইলেকট্রোলাইটের পরিমাণ কমে গেছে।

একমাত্র ফরিদকেই পুরো ব্যাপারটায় আনন্দিত মনে হচ্ছে। তার ছবির কাজ এখনো শুরু হয়নি। কারণ চিত্রনাট্যে শেষ মুহুর্তে একটা রদ-বদল করা হয়েছে। ফরিদ ঠিক করে পুরো দৃশ্যটা একটা গানের উপর করা হবে। গানটা এমন যার সঙ্গে ক্ষুধার কোন সম্পর্ক নেই। সেই গানও সিলেক্ট করা হয়েছেহলুদিয়া পাখি সোনার বরণ পাখিটি ছাড়িল কোঁ। গানের সঙ্গে ছবির যদিও কোন সম্পর্ক নেই। তবু ছবিটা এমন ভাবে করা হবে যে একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যাবে। খুবই কঠিন কাজ। তবে জীবনের আনন্দতো কঠিন কাজেই। সহজ কাজ সবাই পারে। কঠিন কাজ পারে কয়জনে?

ছবি নিয়ে মিলির সঙ্গে ছোটখাট ঝগড়ার মতও হল। মিলি চোখ মুখ লাল করে এসে বলল, একটা মানুষ মরে যাচ্ছে আর তুমি আছ ছবি নিয়ে?

ফরিদ বলেছে, জীবনটাই এরকম মিলি, কারো জন্যে কোন কিছু আটকে থাকে না। Life goes on.

মামা তুমি পাথরের তৈরি একজন মানুষ।

তুই নেহায়েৎ ভুল বলিসনি।

একটা মানুষ না খেয়ে মরে যাচ্ছে আর তুমি কিনা বানোচ্ছ ক্ষুধা-হে। মামা চক্ষু লজ্জারোতো একটা ব্যাপার আছে। আছে না?

শিল্প সাহিত্যের কাছে চক্ষু লজ্জা কিছু না-রে মা, শিল্প সাহিত্য চক্ষু লজ্জার অনেক উপরে।

তুমি কিছু মনে করো না মামা। তোমার বুদ্ধি শুদ্ধিও কম।

না আমি কিছুই মনে করছি না। স্বয়ং সক্রেটিসকে লোকে গাধা বলেছে। আর্কিমিডিসকে ছোটবেলায় ডাকা হত সিকি বুদ্ধির মানুষ–বুঝলি?

মিলি জবাব না দিয়ে উঠে পড়েছে। মামার সঙ্গে তর্ক করা অর্থহীন।

এ বাড়ির কাণ্ডকারখানা দেখে সবচেয়ে বেশি হকচকিয়ে গেছে এমদাদ। সে কল্পনাও করতে পোরনি। সত্যি সত্যি একটা মানুষ না খেয়ে এতদিন পার করে দেবে। এরকম অবস্থায় কোন কথাবার্তাও বলা যায় না। যে পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল সেই পরিকল্পনা কোন কাজে আসছে না। নাতনীটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। দেখে শুনে একটা বিয়ে দিয়ে দেয়া। গ্রামের বাড়িতে তাকে রাখা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। কিছু গুণ্ডা পাণ্ডা ছেলে পেছনে লেগেছে। এদের মতলব ভাল না। গত বর্ষায় বন্দি শেখের বেীকে ধরে পাটক্ষেতে নিয়ে গেছে। লজ্জায় এই ঘটনা বদি শেখ কাউকে বলেনি। না বললেও কারোর জানতে বাকি নেই। ঘটনার নায়করাই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে। এদেরই একজন পুতুলকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে এবং আকারান্তরে জানিয়েছে প্ৰস্তাবে রাজি না হলে পাটক্ষেতে যেতে হবে। এর পর আর গ্রামে থাকা সম্ভব না। এমদাদ নাতনীকে নিয়ে বলতে গেলে পালিয়েই এসেছে। সে জানে ঘটনা শুনলে সোবাহান সাহেব একটা ব্যবস্থা করবেনই কিন্তু ঘটনা শুনানোর সময়ইতো হল না। না খেয়ে মর মর অবস্থা।

সব মন্দ জিনিসের একটা ভাল দিকও আছে। সোবাহান সাহেবের এই অসুখের ফলে মনসুর নামের এই ডাক্তার ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হল। এই ছেলে ঘন ঘন আসছে। পুতুলের সঙ্গে এই ছেলের বিয়ে দেয়া কি একেবারেই অসম্ভব? পুতুল দেখতে তো খারাপ না। চোখে কাজল টাজল দিয়ে মাশাআল্লাহ ভাল লাগে। তবে মেয়েটা হয়েছে বাদ। যেটা করতে বলা হবে সেটা করবে না।

একটু সেজেগুজে ডাক্তারের সামনে হাঁটাহাঁটি করলে কি কোন অসুবিধে আছে? এক কাপ চা এনে দিবে। এক গ্রাস পানি আনবে। যাবার সময় বলবে, ডাক্তার সাব ভাল আছেন? আবার আসবেন। একটু ঢং ঢেং না করলে হয়? দুনিয়াটাই হচ্ছে ঢং ঢাংয়ের।

অবশ্যি এমদাদ চেষ্টার ক্ৰটি করছে না। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হলেই গল্প গুজব করছে। একটা সম্পর্ক পাতানের চেষ্টায় আছে। কোনমতে একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেললে নিশ্চিন্ত। সেই সম্পর্কও করা যাচ্ছে না। ডাক্তারকেও একটু বোকা কিসিমের বলে মনে হচ্ছে। এটা একদিক দিয়ে ভাল। স্বামী হিসেবে বোকাদের কোন তুলনা নেই। যত বোকা তত ভাল স্বামী। ডাক্তারটা কত বোকা সেটাও ঠিক ধরা যাচ্ছে না। তবে এই বাড়ির মিলি মেয়েটির সঙ্গে বড় বেশি খাতির। এটা একটা সন্দেহজনক ব্যাপার। একটু লক্ষ্য রাখতে হবে। গতকাল অবশ্যি ডাক্তারে চেম্বারে গিয়ে কিছু কাজ করা হয়েছে। এইসব কাজ ঠাণ্ডা মাথায় করতে হয়। এখন বয়স হয়ে গেছে। মাথা আগের মত ঠান্ডা না। গতকাল ডাক্তারের সঙ্গে কথাবার্তা যা হল তা হচ্ছে–

এমদাদ : এই যে ডাক্তার ভাই, শরীর ভাল? চিনছেন তো আমারে? আমি এমদাদ। পাকুন্দিয়ার এমদাদ। আমার নাতনীটার শরীরটা খারাপ। ভাবলাম একটু অষুধ আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাই।

ডাক্তার : কি অসুখ?

এমদাদ : মাথার যন্ত্রণা। আরো কি সব যেন আছে। আমি নিয়ে আসবনে আপনের কাছে। দেখে শুনে যাই হোক একটা কিছু দিবেন। আপনের উপরে আবার খুব ভক্তি। আপনাকে খুবই ভাল পায়।

এই কথায় ডাক্তার খানিকক্ষণ খুক খুক করে কাশল। এটা খুব ভাল লক্ষণ। কাজেই কথাবার্তা এই লাইনেই চালানো ভাল। এমদাদ গলার স্বর খানিকটা নিচু করে বলল, মেয়েদের মন বোঝা বড় মুশকিল। ঐ দিন আপনারে নিয়া বিরাট ঝগড়া মিলির সঙ্গে।

ডাক্তার : (খানিকটা উৎসাহী) মিলির সঙ্গে ঝগড়া?

এমদাদ : জি।

ডাক্তার : কি জন্যে বলুন তো?

এমদাদ : মেয়েছেলের কারবারতো। মিলি একদিন বলল–ডাক্তার সাহেব বেকুব কিসিমের লোক এই শুইন্যা পুতুল রাগ করল।

ডাক্তার : (হতভম্ব) আমাকে বেকুব কিসিমের লোক বলল?

এমদাদ : বাদ দেন। বাদ দেন। মেয়েছেলের কারবার, তামশা কইরা বলছে। মেয়েছেলেরা তামশা কইরা অনেক কথা কয়। হে হে হে।

এমদাদ চেষ্টার চূড়ান্ত করছে, কিন্তু একা একা কত করবে? পুতুলের নিজেরও তো সাহায্য দরকার। সে যদি কাঠের টুকরার মত থাকে তাহলে হবে কিভাবে? শাড়িটা বদলাতে বললে বদলায় না। চুলটা আচড়িয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ক্ষতিতো কিছু নাই?

তাছাড়া অবস্থা এমন কিছু করারও সময় না। একজন ঝিম ধরে পড়ে আছে। এখন যায়। তখন যায় অবস্থা। ক্ষুধা কি জিনিস বুঝতে চায়। আরে বাবা আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা না ক্ষুধা কি জিনিস তুমি বোঝ। যদি আল্লাহতালার সেই রকম ইচ্ছা থাকত তোমারে গরিব বানিয়ে পাঠাত। খামোকা ভড়ং।

এ বাড়িতে এমন্দাদের সব সময় মুখ শুকনা করে থাকতে হয়। ভাব দেখাতে হয় যে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। এসব কি ভাল লাগে? আর বুড়া যদি সত্যি সত্যি মরে যায় তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ। সে যাবে কোথায়?

সন্ধ্যাবেলা আকাশ অন্ধকার করে মেঘ করল। কালবৈশাখীর প্রথম ঝাপ্টা। হাওয়ায় ঘরের দরজা জানালা উড়িয়ে নিয়ে যাবার মত অবস্থা। টগর এবং নিশার আনন্দের সীমা নেই। বৃষ্টির মধ্যে খুব লাফাচ্ছে। বৃষ্টির জল অসম্ভব ঠাণ্ডা। শীতে একেকজন থারথার করে কপিছে তাতেও আনন্দ বাধা মানছে না। আনিস ঘর থেকে এই দৃশ্য দেখছে তবে চুপচাপই আছে। তার মুখে মৃদু হাসি দেখে মনে হচ্ছে সেও বেশ মজাই পাচ্ছে হয়ত সে পানিতে নামবে। টগর বলল, বাবা পানিতে নামবে?

আনিস হাসি মুখে বলল, ঠাণ্ডা কেমন তার উপর নির্ভর করছে।

নিশা শীতে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, একদম ঠাণ্ডা না বাবা। গরম পানি।

খুব গরম?

হ্যাঁ খুব গরম।

আনিসও নেমে পড়ল। শীতে জমে যাবার মত অবস্থা। তবু বাচ্চাদের সঙ্গে হৈচৈ করে ভিজতে ভাল লাগছে। সবার ঠাণ্ডা লেগে যাবে বলাই বাহুল্য। নিশা এখনই হাঁচি দিচ্ছে।

আর বোধ হয় মেয়েটাকে পানিতে থাকতে দেয়া উচিত হবে না। কিন্তু ওঠে যেতে বলতেও খারাপ লাগছে। করুক, একটু আনন্দ-করুক।

নিশা শীতে কাঁপতে কাপতে বলল, বাবা আজ সারা রাত আমরা পানিতে ভিজব–কেমন?

আমার আপত্তি নেই।

পানিতে বেশিক্ষণ ভেজা গেল না। শীলা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দৌড়ে সবাইকে ঘরে ঢুকতে হল। তিনজনেই শীতে থর থর করে কাঁপছে। নিশার গায়ে সম্ভবত জ্বর উঠেই গেছে। সে একটু পর পরই হাঁচি দিচ্ছে। বিলুর কাছ থেকে অষুধ এনে খাইয়ে দেয়া দরকার। আনিসকে বিলুর কাছে যেতে হল না। বিলু নিজেই এসে উপস্থিত।

বিলু মুখ শুকনো করে বলল, আপনারা মনে হচ্ছে খুব মজা করলেন। আনিস বলল, হ্যাঁ করলাম। অনেকদিন পর পানিতে ভিজলাম। যাকে বলে শৈশবে ফিরে যাওয়া।

আপনার সঙ্গে একটা কথা বলার জন্যে এসেছিলাম আনিস সাহেব।

বলুন।

আপনার বাচ্চাগুলোর গা মুছিয়ে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিন তারপর আমার সঙ্গে নিচে আসুন, বলছি।

মনে হচ্ছে খারাপ খবর। আমাদের জন্যে খারাপ খরব আপনার জন্যে কেমন তা জানি না। বাবার ব্লাড প্রেসার খুব ফল করেছে।

বলেন কি?

বাড়ির একটা মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে পড়ে আছে এবং তা পড়ে আছে আপনার উল্টা পাল্টা কথা শুনে। অথচ আপনি এদিনও তাঁকে দেখতে যান নি।

আনিস বলল, চলুন যাই দেখে আসি।

ঠাট্টা করছেন?

আমি ঠাট্টা করি না। একজন মানুষ ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে চাচ্ছে এটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে বলেই আমি চুপ করে আছি।

একজন মানুষ মরে যাবে তারপরও আপনি চুপ করে থাকবেন?

আনিস হাসি মুখে বলল, মানুষ এত সহজে মরে না। চলুন যাই অনশন ভাঙিয়ে দিয়ে আসি। বিলু বিস্মিত গলায় বলল, আমরা সবাই মিলে যা পারলাম না। আপনি তাই করবেন। অনশন ভাঙ্গাবেন?

হ্যাঁ।

আনিস সোবাহান সাহেবের সঙ্গে কি কথা বলব। কেউ জানল না। কারণ ঘরে তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না। কিন্তু দেখা গেল আনিস ঘর থেকে বেরুবার পর পরই সোবাহান সাহেব বললেন, আমাকে এক গ্লাস দুধ দাও।

খবর শুন হতভম্ব হয়ে গেল ফরিদ। এটা কি কথা? চিত্ৰনাট্য এখন কমপ্লিট আর এখনি কি-না অনশন ভঙ্গ। আর দুদিন পর ভাঙলে অসুবিধাটা কি হত? এই দুদিনে ইস্পটেন্ট কিছু সন্ট নিয়ে নেয়া যেত! মহৎ কাজে পদে পদে বাধা আসে এটাই হচ্ছে খাটি কথা। মহাপুরুষদের যে বাণী–তোমার পথ কুসুমান্তীর্ণ নয় এটাই হচ্ছে আদি সত্য।

রাগ করে রাতে ফরিদ ভাত খেল না। এই রাগ তার নিজের উপর না, দুলাভাইয়ের উপরও না। এই রাগ হচ্ছে প্রকৃতির উপর। যে প্রকৃতি পদে পদে মানুষকে আশাহত করে।

সোবাহান সাহেব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। মিলি বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার পাশেই আছে। ডাক্তারের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে কারণ এই অনশনের কারণে খুব ঘন ঘন সে এ বাড়িতে আসতে পেরেছে। এখন অনশন ভাঙায় একটু সমস্যা হয়েছে আর হয়ত ঘন ঘন আশা সম্ভব হবে না। তবে ভাগ্য যদি ভাল হয় তাহলে হয়ত তৃষ্ণার্তা মানুষের কষ্ট বোঝানোর জন্যে এই লোক পানি খাওয়া বন্ধ করবেন। সেই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছে। মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব। আপনি এখনো বসে আছেন কেন চলে যান। মনসুর বলল, না আমার কোন অসুবিধা নেই। এগারোটার দিকে প্রেসারটা মেপে তারপর যাব।

তাহলে আসুন আমাদের সঙ্গে চারটা ভাত খান।

জি আচ্ছা।

মিলি হাসতে হাসতে বলল, কেউ ভাত খেতে বলতেই আপনি বুঝি রাজি হয়ে যান? এ রকম চট করে রাজি হওয়াটা কি ভাল? আমাদের হয়ত ভাত খাওয়াবার ইচ্ছা নেই ভদ্রতা করে বলেছি।

মিলি হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছে। শুনতে কি ভালই না লাগছে। আচ্ছা এই মেয়ের সঙ্গে তার যদি কোনদিন বিয়ে হয় তাহলে সেকি কোনদিন তার সঙ্গে কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করবে? না করবে না। কোনদিন না। এই মেয়েকে সে কোনদিন কোন কড়া কথা বলতে পারবে না। এই মেয়ের খুব কঠিন কথায়ও সে রাগ করতে পারবে না।

ডাক্তার সাহেব।

জি।

আপনি আনিস সাহেবের ছোট মেয়েটাকে একবার দেখে যাবেন। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছে। আপনি বরং উপর থেকে রুগী দেখে আসুন— আমি ভাত দিতে বলি।

জি আচ্ছা।

নিশার জ্বর তেমন কিছু না। একশর কিছু বেশি। তবে লাংস পরিষ্কার না। কেমন যেন ঘড়ি ঘড় শব্দ হচ্ছে। আনিস বলল, কেমন দেখলেন?

মনসুর বলল, ভাল।

সত্যি ভাল তো? আপনার গলায় তেমন জোর পেলাম না।

লাংসে কেমন ঘড়ি ঘড় শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে বুকে বোধ হয়। কফ জমে গেছে। সকাল পর্যন্ত দেখব। তারপর এন্টিবায়োটিক দেব।

আপনার ভিজিট কত ডাক্তার সাহেব?

মনসুর খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আনিস সাহেব। আমি বাচ্চাদের সঙ্গে খুব ভাল মিশতে পারি না। কিছু কিছু মানুষ আছে ভালবাসা প্ৰকাশ করতে পারে না। আমি সেই রকম। আমি আপনার বাচ্চা দুটাকে যে কি পরিমাণ পছন্দ করি তা ওরা জানে না। কিন্তু আমি জানি, আমার হৃদয় জানে। আপনি ভিজিটের কথাটা তুলে খুব কষ্ট দিলেন।

আনিস লজ্জিত স্বরে বলল, ভাই কিছু মনে করবেন না।

না। আমি কিছু মনে করিনি।

আনিস হাসতে হাসতে বলল, আমিও আপনাকে খুব পছন্দ করি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনাকে খানিক সাহায্য করতে পারি।

মনসুর অবাক হয়ে বলল, আমাকে সাহায্য করতে পারেন?

হ্যাঁ পারি। আমার মনে হয় আপনার কিছু উপদেশের প্রয়োজন আছে।

মনসুর তাকিয়ে রইল। আনিস বলল, যে কথাটা আপনি বলতে পারেন না, লজ্জা বোধ করেন বা সংকোচ বোধ করেন সেটা বলে ফেলবেন। পেটে জমিয়ে রাখবেন না। এই হচ্ছে উপদেশ।

আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।

ধরুন আপনি কাউকে ভালবাসেন। রূপবতী কোন এক তরুণীকে। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছেন না। সব সময়ই আপনার মনে এক ধরনের ভয়। এক ধরনের শংকা। ঐ ভয়, ঐ শংকা দূর করে ফেলুন। যখন মেয়েটিকে একা দেখবেন এগিয়ে যাবেন, সহজ স্বাভাবিক গলায় বলবেন, আমি তোমাকে ভালবাসি। এতে অতীতে কাজ হয়েছে। বর্তমানে হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। আমার মনে হয় অনেকদিন থেকেই এ কথাটা আপনি কাউকে বলতে চাচ্ছেন। সাহস পাচ্ছেন না।

আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন?

আপনাকে বলছি কারণ আপনি নিতান্তই একজন ভাল মানুষ, আমি আপনার উপকার করতে চাই।

আমার উপকার করা নিয়ে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

মনসুর নিচে নেমে এল কিন্তু আনিসের কথা মাথা থেকে দূর করতে পারল না। ব্যাপারটা তো আসলেই তাই। কাছে যাওয়া এবং এক পযায়ে শান্ত গলায় আসল কথাটা বলে ফেলা— আমি তোমাকে ভালবাসি। I love you.

জগতের সবচে পুরাতন কথা আবার সবচে নতুন কথা। এই কথা বলতে এত সংকোচ কেন? এত দ্বিধা কেন? সে মিলিকে এই কথা বলার পর মিলি কি করতে পারে? সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখা যাক।

ক. মিলি মাথা নিচু করে ফেলল। তার ঠোঁট অল্প অল্প করে কাঁপছে। চোখের কোণ আন্দ্রে। ক্ষীণ গলায় ছোট্ট করে বলল— তুমি এসব কি বলছ? যাঃ আমার লজ্জা লাগছে। (মিলির এটা কখনো করবে না। মিলি প্রকৃতি এটা নয়।)

খ. মিলি কড়া চোখে তাকাবে তারপর বলবে, মনে হচ্ছে কয়েক রাত আপনার ঘুম হয়নি। দয়া করে প্রতি রাতে দশ মিলিগ্রাম করে সিডেটিভ খেয়ে ঘুমুবেন। আর যে কথাটা এখন বললেন সেই কথা ভুলেও উচ্চারণ করবেন না। (মিলি এই জাতীয় কিছু বলবে বলেও মনে হয় না। তার হৃদয় এত কঠিন নয়।)

গ. মিলি হো হো করে হেসে উঠবে তারপর যার সঙ্গেই দেখা হবে তাকেই ঘটনাটা বলবে। এই সম্ভাবনাই সবচে বেশি।

খাবার ঘরে প্রায় ফাঁকা। রহিমার মা টেবিলে খাবার দিচ্ছে। মিলি বসে আছে একা একা। অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্যে। মনসুর খাবার ঘরে ঢোকার আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। মিলিকে কি কথাটা বলে ফেলবে? মন্দ কি? মানসিক যাতনা ভোগ করার চেয়ে হুট করে বলে ফেললেই হয়।

কখন বললে ভাল হবে? খাওয়ার আগে খাওয়ার মাঝখানে নাকি খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর? সবচে ভাল হবে চলে যাবার সময় বললে। মিলি তাকে গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসবে তখন সে বলবে সেই বিশেষ কথা। বলেই অপেক্ষা করবে না। লম্বা লম্বা পা ফেলে পগার পার। রাতের টেনশান কমানোর জন্যে দশ মিলিগ্রাম রিল্যাক্সেন অবশ্যি খেতে হবে। তাতেও টেনশান কমবে বলে। মনে হয় না।

ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মনসুর খাবার ঘরে এল। মিলি টেবিলে সাজাতে ব্যস্ত। তাকে লক্ষ্য করল না। ঘরে দ্বিতীয় প্ৰাণী নেই। রহিমার মা পানির জগ বা অন্য কিছু আনতে গেছে। এক্ষুণি হয়ত চলে আসবে। কথাটা বলে ফেললে কেমন হয়? এইতো সুযোগ।

গুছিয়ে কিছু চিন্তা করার আগেই সম্পূর্ণ নিজের অজান্তে মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মিলি আমি তোমাকে ভালবাসি।

মনসুর বুঝতে পারছে মিলি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়েছে। মনসুর তার চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, অনেকদিন থেকেই কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম, বলতে পারছিলাম না। আজ বলে ফেললাম। মিলি আমি তোমাকে ভালবাসি।

ডাক্তার সাহেব, আমি বিলু। আপনি বসুন। আমি আপনার কথা মিলিকে বলে দেব। মিলি এখানে নেই।

মনসুরের মনে হল খুব বড় একজন সার্জন, ধারাল ছুরি দিয়ে তার শরীর থেকে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম কেটে বের করে নিয়ে গেছে। তার শরীরে এখন কোন বোধ নেই, চেতনা নেই। সে কোন মানুষ না–সে একজন জন্বি। বিলু বলল, ডাক্তার সাহেব বসুন।

মনসুর বসল।

ঘরে খাবার তেমন কিছু নেই। মিলি কি যেন রাঁধতে গেছে।

ডাক্তার মাথা নিচু করে বসে রইল। বিলু অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্যে বলল, আপনি এত নাৰ্ভাস হচ্ছেন কেন? এ রকম ছোট খাট ভুলতো মানুষ সব সময় করে। করে না?

মনসুর যন্ত্রের মত মাথা নাড়ল।

মিলি ডিম ভেজে এনেছে। ঘরে ঢুকেই ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কি হয়েছে?

কিছু হয় নি।

মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব আপনার কি হার্ট এ্যাটাক হচ্ছে? এ রকম ঘামছেন কেন?

মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে মিস মিলি। আজ আমি কিছু খাব না।

ডাক্তার কাউকে কিছু বলার অবকাশ দিল না। দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে গেল। মিলি কিছুই বুঝতে পারছে না। হাসতে হাসতে বিলু ভেঙে পড়ছে। তার বড় মজা লাগছে। মিলি বলল, হচ্ছে কি আপা? এত হাসি কিসের?

বিলু বলল, ডাক্তার চমৎকার করে প্ৰেম নিবেদন করল। তাই দেখে হাসছি।

প্ৰেম নিবেদন করল মানে?

ও তোর প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছে। ড়ুবে মরে যাবার আগে ওকে বিয়ে করে ফেল। ও ভাল ছেলে।

পর্ব ১৬ শেষ 📌

🔴পর্ব :১৭)🔴

দুজনই দেব শিশু।
দেখে মনে হচ্ছে তারা তাদের ছোট্ট ডানা দুটি ঘরের বাইরে রেখে খেলতে বসেছে। এই খেলাও অদ্ভুত খেলা। একজনের হাতে একটা কাঁচি, অন্যজন বিছানার চাদর ধরে আছে। কচ কিচ করে চাদর কাটা হচ্ছে। বাচ্চা দুজনের কারো মুখেই কোন বিকার নেই!

পুতুল অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। বাচ্চা দুটিকে সে চেনে তবে এখনো ভাল পরিচয় হয়নি। আজ পরিচয় করার জন্যেই এসেছিল। এসে দেখে এই কাণ্ড। তার বাধা দেয়া উচিত। কিন্তু বাধা দেয়ার পর্যায় পার হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটি বিছানার চাদর কেটেছে, বালিশ কেটেছে একটা লেপ কেটেছে। ঘরময় তুলা উড়ছে। ভয়াবহ অবস্থা।

পুতুল বলল, এইসব কি?

নিশা হালকা গলায় বলল, কিছু না।

তোমরা এইসব কেন করতাছ?

কাটাকুটি খেলছি।

বোনের এই কথা টগরের পছন্দ হল না। সে বলল, আমরা দরজি দরজি খেলছি।

দরজি দরজি খেলতাছ?

হুঁ।

বলেই টগর হাসল। অনেকদিন থেকেই এই খেলাটা তার খুব পছন্দ।

রাস্তার ওপাশে নতুন দরজির দোকান হয়েছে— ক্যালকাটা সুদৃটিং সেখানে খচখচ করে রাত দিন কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটা হয়, টগর গভীর আগ্রহে দেখে। আজ অনেক দিন পর এই খেলার সুযোগ পাওয়া গেল। কাঁচি অনেক কষ্টে নিশা মিলির কাছ থেকে জোগাড় করেছে।

পুতুল বলল, তোমাদের আব্বা তোমাদের মারবে না?

টগর বলল, মারবে। তারপরেও এই রকম করতাছ?

হুঁ।

কেন?

নিশা ছোট্ট করে হেসে বলল, বেশি মারবে না। অল্প মারবে।

অল্প মারবে কেন?

আমাদের মা মারা গেছেতো। মা মারা গেলে বাচ্চাদের বেশি মারার নিয়ম থাকে না। কম মারতে হয়।

পুতুল বলল, অনেক খেলা হইছে এখন হাত থাইক্যা কেচিটা নামাও। না হইলে হাত কাটব।

টগর বলল, আপনি এখন যানতো। আপনি আমাদের বিরক্ত করবেন না। পুতুল নড়ল না। এমন মজার একটি দৃশ্যের আকর্ষণ এড়িয়ে সে যেতে পারছে। না। বাচ্চা দুটি টুকটুক করে কথা বলছে।

নিশা বলল, আপনি আমার জন্যে এক গ্লাস খাওয়ার পানি আনেন তো। এমন ভাবে বলল যেন কতদিনের পরিচিত। কত দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্টতা। পুতুল পানি আনতে গেল।

পানি এনে দুই দরজির কাউকেই পাওয়া গেল না। তারা অদৃশ্য। ডেকেও সারা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ আনিস ঘরে এসেছে। তার সাড়া পাওয়ার পরই এই অবস্থা।

পুতুল আনিসকে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, স্নামালিকুম।

আনিস বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। তুমি এমদাদ সাহেবের নাতনী তাই না? পুতুল তোমার নাম?

জি।

দেখেছ কি অবস্থা?

পুতুল কিছু না বলে মুখ নিচু করে হাসল। আনিস বলল, এদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছি। এরা যা করছে তার নাম দুষ্টুমি না। এ হচ্ছে ইচ্ছা করে আমাকে কষ্ট দেয়া! তোমার পানির গ্রাসটা কি আমাকে দিতে পার?

পুতুল গ্লাস এগিয়ে দিল। আনিস এক চুমুকে পানি খেয়ে ফেলল। বিষণ্ণ গলায় বলল, এই ঘটনা কিন্তু আজ নতুন ঘটছে না। এটা পুরনো ঘটনা। আগেও কাটাকুটি খেলা একবার হয়েছে। তখন তারা প্ৰতিজ্ঞা করেছিল আর কোনদিন খেলবে না। বার বার তো এটা হতে দেয়া যায় না।

পুতুল বলল, বাদ দেন। এরা ছোট মানুষ।

তুমি ভুল বলছ পুতুল–ওরা ছোট হলেও আমার সঙ্গে যা শুরু করেছে তা বড় মানুষদের খেলা। এক ধরনের দাবা খেলা। তারা একরকম চাল দিচ্ছে। আমি এক রকম চাল দিচ্ছি। আমার সংসার টিকে থাকবে কি থাকবে না। এটা নির্ভর করছে এই খেলায় জয় পরাজয়ের উপর।

এই মানুষটার কথাগুলো পুতুলের বড় ভাল লাগছে। কি সহজ সরল ভঙ্গিতেই না পুতুলের সঙ্গে কথা বলছে। যেন পুতুল তার কত দীর্ঘদিনের চেনা মানুষ অথচ এর আগে একদিন মাত্র কথা হয়েছে। তাও–কি নাম? দেশ কোথায়? এ রকম কথা।

পুতুল।

জ্বি।

ওরা কোথায় পালিয়েছে তোমার কোন ধারণা আছে?

জ্বি না,

আচ্ছা ওদের খুঁজে বের করছি, তার আগে এসো আমরা দুজন এক কাপ করে চা খাই। না কি তুমি চা খাও না?

খাই।

তাহলে বরং চা বানাও। চা খাবার পর ঠিক করব টগর এবং নিশাকে কি শাস্তি দেয়া যায়।

কত সহজ কত আন্তরিকভাবেই না লোকটা কথা বলছে, শুনতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে তারা সবাই একই ছাদের নিচে দীর্ঘদিন ধরে আছে, যে ছাদের উপর ঝড়ে পড়েছে কত বৃষ্টি কত জ্যোৎস্না।

চা বানানোর কেরোসিন কুকার ঘরের এক কোণেই আছে। কোরোসিন কুকার ধরাতে অসুবিধা হল না। চা বানাতে বানাতে ছোট ছোট সব কথা হতে লাগল। প্রতিটি প্রশ্নের জবাব আনিস খুব মমতার সঙ্গে দিল। যেমন পুতুল বলল, ভাইজান আফনে কি করেন?

আনিস হাসতে হাসতে বলল, আমি কিছুই করি না, আবার অনেক কিছুই করি।

সেইটা কেমুন?

আমি লিখি! একজন লেখককে দেখলে কখনো মনে হবে না। সে বিশেষ কিছু করছে। হাতে হেলাফেলা করে ধরা একটা কাগজ। একটা কলম বা পেন্সিল। একজন শ্রমিককে বিশাল এক খণ্ড পাথর উপড়ে তুলতে কত না পরিশ্রম করতে হয়। টপ টপ করে তার মাথা বেয়ে ঘাম পড়ে অথচ একজন লেখককে দেখবে কত অনায়াসে লিখছে— অপূর্ব সব লেখা। এইসব লেখা কি তুমি কখনো পড়েছ?

পুতুলের কথা শুনতেই ভাল লাগছে, জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না। ওদিকের মানুষটি বোধ হয় তা বুঝতে পারছে। সে বলছে–দেখা পুতুল লেখালেখি কি অদ্ভুত জিনিস মাত্র চার লাইনের একটা কবিতা, মাত্র দুলাইনের দুটি বাক্যে ধরা দিতে পারে মহান কোন বোধ, জীবনের গভীর ক্ৰন্দন।

পুতুল চুপি চুপি বলল, একটা বলবেন?

হ্যাঁ বলব। আমি টগর ও নিশাকে প্রায়ই বলি। তুমি যদি আসি তুমিও শুনবে। আজ না আজ থাক। আজ আমার মনটা খারাপ। বাচ্চা দুটি বডড কষ্ট দিচ্ছে। কি চাচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না। পুতুল।

জি।

তুমি কি আমাকে আরেক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবে?

কত সামান্য কথা অথচ পুতুলের এত ভাল লাগল। তার ইচ্ছা করছে আনন্দে একটু কাব্দে। তার কেন এত আনন্দ হল? এই আনন্দের উৎসব কোথায়? এইত চোখ ভিজে উঠছে। কেন, চোখ ভিজে উঠল কেন?

টগর ও নিশা বিলুর পেছনে পেছনে রাত দশটায় শোবার ঘরে ঢুকল এবং কোনদিকে না তাকিয়ে বিছানায় উঠে পড়ল। মুহুর্তের মধ্যে তাদের চোখ বন্ধ। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। যেন ঘুমিয়ে কাদা। বিলু বলল, আনিস সাহেব দয়া করে এবারের মত বাচ্চাদের ক্ষমা করে দিন। ওরা যা করেছে তার জন্যে খুব লজ্জিত, দুঃখিত এবং অনুতপ্ত! ভয়ে এ ঘরে আসতে চাচ্ছিল না। আমি অভয় দিয়ে নিয়ে এসেছি।

আনিস বলল, থ্যাংকস।

ওরা আমাকে কথা দিয়েছে আর কোনদিন এরকম করবে না।

এই কথা, কথা পর্যন্তই! ওরা আবারো এ রকম করবে এবং আপনার মতো অন্য কাউকে ধরে নিয়ে আসবে যাতে ক্ষমা করা হয়। কাজেই এবার ক্ষমার প্রশ্নই উঠে না।

বিলু অবাক হয়ে বলল, আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি তারপরেও আপনি ক্ষমা করবেন না? তারপরেও এরকম কঠিন করে কথা বলছেন?

হ্যাঁ বলছি। কারণ আপনার আগে আপনার বাবা এদের একবার নিয়ে এসেছেন, আপনার মা নিয়ে এসেছেন, মিলি এনেছে। একবার কাদের প্রটেকসন দিয়ে এনেছে।

বিলু কঠিন স্বরে বলল, অর্থাৎ আপনি ওদের শাস্তি দেবেন?

হ্যাঁ।

কি শান্তি জানতে পারি?

ওরা জানে কি শাস্তি। ওদেরকে আমি বলে রেখেছি যে, আবার যদি তারা কাটাকুটি খেলা খেলে তাহলে ওদের ফেলে রেখে আমি চলে যাব।

আপনি ওদের ফেলে রেখে চলে যাবেন?

হ্যাঁ।

বেশ চলে যান। আপনার সংসার আপনি চালাবেন। যেভাবে চললে ভাল হয় সে ভাবে চালাবেন।

আনিস রাত ১১টা দশ মিনিটে ব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বিলু। সারাক্ষণই ভাবছিল এটা এক ধরনের ঠাট্টা হয়ত গোট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসবে। দেখা গেল ব্যাপার মোটেই ঠাট্টা না। আনিস সত্যি সত্যি চলে গেছে।

পর্ব ১৭ শেষ 📌

🔴পর্ব :১৮🔴

এমদাদ বলল, ভাইসাব এখন তাহলে উঠি? এগারোটার উপরে বাজে। সোবাহান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আমার লেখাটা পছন্দ হচ্ছে না?

এমদাদ চোখ বড় বড় করে বলল, পছন্দ হচ্ছে না! এইটা ভাইসাব কি বললেন। জীবনের সারকথা তো সবটাই আপনার লেখার মধ্যে। ক্ষুধা বিষয়টা যে কি আপনের লেখা পড়ার আগে জানতাম না। উপাষ দিছি। ঠিকই কিন্তু ক্ষুধা বুঝি নাই। এখন বুঝলাম।

সোবাহান সাহেব বললেন, তাহলে কি বাকিটা পড়ব?

অবশ্যই পড়বেন।

দেড়শ পৃষ্ঠার মত লেখা হয়েছে আমি ভাবছি আরো শ দুই পৃষ্ঠা লিখে ফেলব। মোটামুটি সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার একটা কাজ।

ভাইসাব টেনে টুনে এটারে পাঁচশ করেন। একটা কাজ যখন হইতেছে ভাল করেই হোক।

পড়তে শুরু করি তাহলে?

আলহামদুলিল্লাহ।

এমদাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে চেয়ারে পা তুলে বসল। গত দুঘণ্টা যাবত এই জিনিস শুনতে হচ্ছে। এখন মাথা ঘুরছে ভন ভন করে অথচ বলতে হচ্ছে অসাধারণ। এর নাম কপাল।

এমদাদ সাহেব।

জি।

আপনি যদি কোন পয়েন্টে আমার সঙ্গে ডিফার করেন তাহলে দয়া করে বলে ফেলবেন। সংকোচ করবেন না। আমি নোট রাখব। কারণ বইটা অনেকবার রিরাইট করতে হবে। শুরু করি তাহলে?

জি আচ্ছা।

সোবাহান সাহেব শুরু করলেন,

আমি ক্ষুধা সম্পর্কে প্রচুর উক্তি সংগ্ৰহ করিয়াছি। আগে জানিতে চাহিয়াছি অন্যে ক্ষুধা প্রসঙ্গে কি ভাবিয়াছেন। তাহাদের ভাবনা আপাতত অত্যন্ত মনকাড়া হইলেও আমার কাছে কেন জানি ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিয়মান হইতেছে। ক্ষুধা নিয়া বড় বড় মানুষ রঙ্গ রসিকতা করিয়াছেন, মূল ধরিতে পারেন নাই। যেমন ফ্রাংকলিন বলিয়াছেন, না খেয়ে মানুষকে মরতে দেখেছি খুবই কম, অতিরিক্ত খেয়ে মরতে দেখেছি অনেককে।

ইহাকে আমি রসিকতা ছাড়া আর কি বলিব?

উইল রজার বলিয়াছেন–ক্ষুধার্তারা তীক্ষ্ণ তলোয়ারের চেয়েও ধারালো।

ইহাও কি একটি সুন্দর মিথ্যা নয়? ক্ষুধার্তরা তীক্ষ্ণ তলোয়ারের মত ধারালো হইলে দেশে বিপ্লব হইয়া যাইত। যাহা হয় নাই।…

এমদাদ সাহেব কি ঘুমিয়ে পড়লেন না-কি?

জ্বি না! এই চোখ বন্ধ করে আছি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, চউখটা বন্ধ থাকলে শুনতে ভাল লাগে।

ঠিক বলেছেন— আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে— ক্ষুধা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মানুষদের ধ্যান ধারণা চিন্তা ভাবনা সঠিক ছিল নয়। ক্ষুধার ভয়াবহ রূপ তাঁরা ধরতে পারেন নি। তবে সবাই যে পারেননি তা না। যাঁরা নিজেরা ক্ষুধার্ত থেকেছেন। অভুক্ত থেকেছেন তারা পেরেছেন। যেমন ইংল্যান্ডের চার্লস ডিকেন্স এবং রাশিয়ার ম্যাক্সিম গর্কি। হ্যাংগার বা ক্ষুধা নামক একটা বিখ্যাত গ্রন্থ আছে। নুট হামসুনের লেখা। সেই বইটিতেও ক্ষুধার ভয়াবহ বৰ্ণনা আছে। যদিও সেই বর্ণনা আমার কাছে যথাযথ মনে হয় নি। এমদাদ সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন না-কি?

জ্বি না।

মনে হচ্ছিল নাক ডাকের মত শব্দ হচ্ছে।

জনাব এইটা হইল আমার অভ্যাস। খুব চিন্তাযুক্ত হইয়া যদি কিছু শুনি তখন এই রকম শব্দ হয়।

আজি না হয় থাক। অন্য আরেকদিন পড়ব। এমদাদ উঠতে উঠতে বলল, এইসব আসলে আমাদের শুনায়ে কোন লাভ নাই। আমরা আছিইবা কয়দিন। এইসব শোনা দরকার অল্প বয়স্ক পুলাপানদের। যেমন ধরেন এই বাড়ির ফরিদী, তারপর ধরেন ডাক্তার। সোবাহান সাহেব উৎসাহিত হয়ে বললেন,

কথাটা ভুল বলেন নি। ডাক্তার অনেকদিন আসছেও না— আচ্ছা দেখি কাল খবর পাঠাব।

এমদাদ হাঁপ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্ষুধা বিষয়ে পড়ার চেয়ে ক্ষুধায় ছটফট করতে করতে মরে যাওয়া ভাল। ভাইসাব তাহলে যাই— স্নামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম। কাল দুপুর থেকে বসে যাব। বাকিটা একটানে পড়ব কেমন।

এমদাদ শুকনো গলায় বললেন, জি আচ্ছা।

রাতে মশারি ফেলতে এসে মিলি বলল, বাবা আনিস সাহেব যে পালিয়ে গেছেন সেই খবরটা কি শুনেছ?

সোবাহান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, পালিয়ে গেছে মানে?

বাচ্চা দুটিকে রেখে বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়েছেন।

কারণটা কি?

বাচ্চারা তার কথা শুনে না। তিনি বাচ্চা দুটিকে শিক্ষা দিতে চান।

ওরা কান্নাকাটি করছে না?

না ওরা সুখেই আছে। বিলু আপার সঙ্গে শুয়েছে। বিলু আপা ক্ৰমাগত কবিতা আবৃত্তি করছে ওরা শুনছে। এত রাত হয়েছে অথচ ঘুমুবার কোন লক্ষণ নেই।

বাচ্চা দুটি তাহলে ব্যাপারটা সহজভাবে নিয়েছে?

হ্যাঁ। এবং মনে হচ্ছে এই নাটকীয় ঘটনায় তারা বেশ আনন্দিত।

সোবাহান সাহেব অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে পড়লেন। মিলি খুব হালকা গলায় বলল, বাবা বিলু আপা বাচ্চা দুটিকে যে কি রকম পছন্দ করে তা কি তুমি জান?

না জানি না।

অতিরিক্ত রকমের পছন্দ। এর ফল ভাল নাও হতে পারে বাবা।

ফল ভাল হবে না কেন?

সব কিছু আমি তোমাকে গুছিয়ে বলতে পারব না। আমার লজ্জা লাগবে। শুধু এইটুকু বলি ছোট মেয়েটি বিলু আপাকে আড়ালে ডাকে- আম্মি।

তাতে অসুবিধা কি? আমরাতো অনেকই মা ডাকি।

তা ডাকি। তবে আড়ালে ডাকি না- এই মেয়েটা ডাকছে আড়ালে।

ও।

এই নাও বাবা তোমার রিলক্সিন। খেয়ে ঘুমাও!

বিলুকে একটু ডেকে আনতো কথা বলি।

আজ থাক বাবা। আজ বিলু আপা ওদের কবিতা শোনাচ্ছে।

মিলি।

জি।

ঐ ডাক্তার অনেকদিন আসছে না ব্যাপারটা কি?

মিলি। ঈষৎ লাল হয়ে বলল, আমি জানি না কেন আসছে না।

ওকে খবর পাঠাস তো।

মিলি আবার লাল হয়ে বলল, খবর পাঠাতে হবে না। ও এমিতেই আসবে।

সোবাহান সাহেব হঠাৎ অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বললেন, ডাক্তার ছেলেটা ভাল। মিলি থমথমে গলায় বলল, বার বার তার প্রসঙ্গ আসছে কেন বাবা?

ওকে ক্ষুধা বিষয়ক রচনাটা পড়ে শুনাতে চাই। খবর দিবিতো।

আচ্ছা দেব।

গোপনে গোপনে আম্মি ডাকছে। এটাও চিন্তার বিষয়।

তোমাকে এত চিন্তা করতে হবে না।

তোর মা এখন আমার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে না। আলাদা ঘুমুচ্ছে এই বিষয়টা কি বলতো?

জানি না বাবা, এটা তোমাদের ব্যাপার তোমরা ফয়সালা করবে। আমি যাচ্ছি। আর কিছু তোমার লাগবে?

না। খাওয়ার পানি দিয়েছিস?

হ্যাঁ।

যাবার আগে ক্ষুধা সম্পর্কে লাস্ট যে পাতাটা লিখলাম সেটা কি পড়ব, শুনবি?

রক্ষা কর বাবা। ক্ষুধা সম্পর্কে জানার আমার কোন আগ্রহ নেই। তুমি জেনেছ এইতো যথেষ্ট। একটা ফ্যামিলি থেকে একজন জানাই কি অনেক জানা না? ফ্যামিলির সব মেম্বারদের জানতে হবে?

হ্যাঁ হবে। আমি এই জিনিসটা তোর মাকে বুঝাতে পারি না।

বাবা তুমি ঘুমাও তো…

টগর এবং নিশা জেগে আছে। জেগে আছে বিলু। সে পড়ছে দেবতার গ্রাস। খুব সহজ কোন কবিতা না। কিন্তু টগর এবং নিশা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। টগরের চোখে জল। একটু পর পর তার ঠোঁট কেঁপে উঠছে। বিলু অবাক হয়েছে। একটা বাচ্চা ছেলের মধ্যে এত আবেগ। আশ্চর্য তো!

রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা—
অন্নদা লোকের মুখে শুনে সে বারতা
ছুটে আসি বলে, বাছা কোথা যাবি ওরে!
রাখাল কহিল হাসি, চলিনু সাগরে।
আবার ফিরিব মাসি! পাগলের প্রায়
অন্নদা কহিল ডাকি, ঠাকুরমশায়
বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,
কে তাহারে সামালিবে! জন্ম হতে তার
মাসি ছাড়া বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও।

পড়া এইটুকু আসতেই টগর বিলুকে হতভম্ব করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। নিশাও ঘন ঘন চোখ মুছছে।

বিস্মিত বিলু বলল, এ রকম কাঁদার তো কিছু হয় নি। কাঁদছ কেন টগর? টগর কিছু বলল না। নিশা বলল, টগর এমন করে কাঁদছে কারণ আমাদের আম্মু এই কবিতা আমাদের শুনাতো। আম্মু বই পড়ে বলতো না। পুরোটা মুখস্থ বলতো।

বিলু বলল, এটা ছাড়া আর কোন কবিতা তিনি বলতেন?

সামান্য ক্ষতি কবিতাটাও বলতেন।

ঐটাও অবিশ্যি খুব সুন্দর।

টগর লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, এই কবিতাটা আম্মু বলতো নেচে নেচে। বিলু অবাক হয়ে বলল, নেচে নেচে মানে?

হাত পা দুলিয়ে নাচত। নেচে নেচে বলত।

বাহ চমৎকারতো। তোমাদের তো দেখছি অদ্ভুত একটা মা ছিল।

হ্যাঁ ছিল।

সেই রাতে বাকি কবিতাটা আর পড়া হল না।

রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে আনিস। খারাপ লাগছে না। ভালই লাগছে। বিয়ের আগে এইভাবে হেঁটে হেঁটে কত রাত সে পার করে দিয়েছে। রাতের ঢাকায় কত কি দেখার আছে। রূপহীনা কিছু তরুণী কেমন মাছের মত চোখে তাকায় চলমান পুরুষদের দিকে। যদি কেউ তাকে পছন্দ করে। যদি কেউ এগিয়ে আসে। অর্থ দিয়ে অল্প কিছু আনন্দ যদি কিনে নিতে চায়। সৃষ্টির কোন এক লগ্নে বিধাতা শরীর দিয়ে মানব এবং মানবী পাঠিয়েছিলেন। সেই শরীরে বপন করেছেন ব্যাখ্যাতিত ভালবাসা। সেই ভালবাসার একটি কদৰ্য অংশ টাকায় কেনা যায়। আনিস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। কেমন অকাতরে মানুষজন ঘুমুচ্ছে। কেউ কেউ জেগে উঠে বিড়ি ধরিয়ে পাশের মানুষের সঙ্গে গল্প করছে। এদের দেখে মনে হচ্ছে এরা কত না সুখী।

আনন্দিত হবার অসাধারণ ক্ষমতা এই মানুষের। আকাশে এক ফালি চাঁদ দেখলে এরা খুশী হয়। একটি অবোধ শিশুকে হেসে ফেলতে দেখলে এরা খুশী হয়। আম গাছ যখন নতুন পাতা ছাড়ে তখন তাই দেখেও আনন্দে অভিভূত হয়। মানুষ প্রকৃতির এত চমৎকার একটি সৃষ্টি প্রকৃতি তবু নানান শিকলে তাকে বাঁধলেন। ক্ষুধার শিকল, তৃষ্ণার শিকল… প্রকৃতির নিশ্চয়ই তার প্রয়ােজনীয়তা বোধ করেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন মানুষ নামক এই প্রাণীটাকে নানান দিক থেকে বেঁধে না রাখলে সে শেষ পর্যন্ত একটা ভয়াবহ কাণ্ড করে বসবে। স্বৰ্গমর্ত পাতাল জয় করবে।— গ্রহ থেকে গ্রহান্তরকে সে নিয়ে আসবে তার পায়ের নিচে এবং এক সময় প্রকৃতিকেই প্রশ্ন করে বসবে— কে তুমি? কি তোমার পরিচয়? কি চাও তুমি মানুষের কাছে? কেন তুমি আমাদের এই পৃথিবীতে এনেছ? কোথায় তুমি আমাদের নিয়ে যেতে চাও?

আনিস সিগারেট ধরিয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের দিকে রওনা হল। আজকের রাতটা সে লঞ্চ টামিনালেই কাটাবে।

স্যার।

আনিস চমকে তাকাল। মেয়ে লাগব স্যার? কলেজ গার্ল। বিশ্বাস না করলে সাটিফিকেট দেখবেন।

কি নাম মেয়ের?

মেয়ে তো একটা না। অনেক আছে। নাম দিয়া কি হইবে? কি রকম চান বলেন। হোটেলে ব্যবস্থা করা আছে। কোন সমস্যা না।

আনিস হাসি মুখে বলল, এমন কোন মেয়ে যদি আপনার সন্ধানে থাকে যার নাম রাত্রি তাহলে যেতে পারি। আমার স্ত্রীর ভাল নাম রেশমা, ডাক নাম রাত্রি। এই নামের কাউকে পাওয়া গেলে খানিকক্ষণ গল্প করতাম।

লোকটি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। রাতের ঢাকায় হেঁটে বেড়ানোর এই হচ্ছে এক সমস্যা- কিছুক্ষণ পর পর দালালদের হাতে পড়তে হয়। আনিসের মাথায় চট করে কবিতার একটা লাইন চলে এল— কিছু ভালবাসা কিনিব অল্প দামে।

কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে প্রথম লাইনটিই শুধু এসেছে। দ্বিতীয় লাইনটি আর আসবে না। প্রকৃতি মানুষের সঙ্গে রসিকতা করতে বডড পছন্দ করে। একটা অসাধারণ লাইন পাঠায়। দ্বিতীয় লাইনটা আর পাঠায় না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত দ্বিতীয় লাইনটার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। যা আর আসে না।

আচ্ছা রাত্রির মত দ্বিতীয় কোন তরুণী কি আসবে তার জীবনে? সে গভীর রাতে হঠাৎ অকারণ পুলকে মাথার লম্বা চুল খোপা করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সাজবে। বাতি নিভিয়ে মোমবাতি জ্বলিয়ে মদির গলায় বলবে এখন আমি নাচব। তুমি বসে বসে দেখবে–

সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা।
চলিল কুসুম কাননে।
কৌতুকরসে পাগলপরানী
শাখা ধরি সবে করে টানাটানি,
সহসা সবারে ডাক দিয়া রাণী
কহে সহাস্য আননে–
ওগো তোরা আয়, এই দেখা যায়
কুটির কাহার অদূরে!

না। রাত্রির মত মেয়েরা বার বার আসে না। এদের হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়। আসীম সৌভাগ্যবান কোন পুরুষ হঠাৎ এদের পেয়ে যান। সে যেমন পেয়েছিল। রাত্রির মৃত্যুর সময় সে তার হাতে হাত রেখে বসেছিল। এক সময় আনিস বলল, কষ্ট হচ্ছে?

রাত্রি বলল, হ্যাঁ।

আনিস সহজভাবে বলল, কষ্টের কিছু নেই রাত্রি আবার দেখা হবে। রাত্রি চোখের পানি মুছে বলল, এই কথাটা ভুল। আর দেখা হবে না। যা দেখার এই বেলা দেখে নাও।

পরকাল আছে কি না এটা নিয়ে আনিস মাথায় ঘামায় না। তবে আর কোনদিন দেখা হবে না। এই কথা আনিস গ্রহণ করে নি। দেখা হয়েছে। রাত্রির সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। অন্য একটি মেয়ে হঠাৎ হয়ত অবিকল রাত্রির মত করে হাসল। আবার দেখা হল রাত্রির সঙ্গে।

বিটের দুজন পুলিশ আনিসকে থামাল।

আপনি কে?

আমার নাম আনিস?

যান কোথায়?

আনিস চুপ করে রইল। বিটের পুলিশ বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছে। রাতের শহরে বিটের পুলিশরাও বড় বিরক্ত করে।

কথা বলেন না কেন? যান কোথায়?

কোথাও যাই না- হাঁটি।

দেখি আপনার ঝুলির মধ্যে কি আছে?

ঝুলির মধ্যে তেমন কিছু পাওয়া গেল না- স্কট মামাডের লেখা একটি উপন্যাস House made of down আনিসের জন্মদিনে রাত্রি উপহার দিয়েছিল। গোটা গোটা হরফে লেখা— আনিস, তুমি এত ভাল কেন?

আনিস বিটের পুলিশের দিকে তাকিয়ে বলল, এই বইটি আমার স্ত্রী আমার জন্মদিনে আমাকে উপহার দিয়েছেন। এইখানে আমার প্রসঙ্গে কি লেখা আছে আপনি পড়ে দেখতে পারেন। আমার স্ত্রীর ধারণা আমি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ। মেয়েরা অবশ্যি সব সময়ই একটু বাড়িয়ে কথা বলে। তবু…

পুলিশ আনিসকে ঘাঁটাল না। এগিয়ে গেল। এরকম নিশি পাগলের সঙ্গে তাদের সব সময় দেখা হয়। এদের নিয়ে মাথা ঘামালে তাদের চলে না।

চলবে। 📌