🔴বহুব্রীহি (পর্ব :২৩, ২৪, ২৫)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
ফরিদের এখন দিন কাটছে চিঠি লিখে। পোস্টাপিসের সামনে সে বল পয়েন্ট নিয়ে বসে। মনি অর্ডার লিখে দেয়, চিঠি লিখে দেয়। মানি অর্ডারে দুটািকা এনভেলাপের চিঠি এক টাকা, পোস্ট কার্ড আট আনা।
ফরিদ একা নয়। খুব কম করে হলেও পনেরো বিশজন মানুষ এই করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের একটা সমিতিও আছে- পত্র লেখক সমিতি। শুরুতে সমিতির লোকজন মারমুখো হয়ে ফরিদের দিকে এসেছিল। ফরিদের চেহারা এবং স্বাস্থ্য দেখে পিছিয়ে গেছে। ফরিদ তাদের সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করে নি। বরং মধুর স্বরে বলেছে, বেআইনী কোন কাজ আমি করব না। ভাইসাহেব। সমিতির সদস্য হব। চাঁদা কত বলুন?
তারা সমিতির সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায় নি। বরং চোখ গরম করে বলে গেছে। এই জায়গায় হবে না। অন্য জায়গা দেখেন। পুরান পাগল ভাত পায় না। নতুন পাগল।
অন্য জায়গা দেখার ব্যাপারে ফরিদ কিংবা কাদের কাউকে তেমন উৎসাহী মনে হল না। এই জায়গাই চমৎকার। কাজটাও ভাল। চিঠি লিখতে তার ভাল লাগে। চিঠি যারা লেখাতে আসে তাদের সঙ্গে অতি দ্রুত ফরিদের ভাব হয়ে যায়। ভাবের একটা নমুনা দেয়া যাক।
খালি গায়ের বুড়ো এক লোক চিঠি লিখাতে এসেছে। বুড়ো বলল- লোহেন পর সমাচার, আমি ভালই আছি।
ফরিদ বলল, পর সমাচার লিখব কেন? পর সমাচার মানেটা কি?
মানেতো বাবা জানি না।
যার কাছে লিখছেন তার নাম কি?
লতিফা।
আপনার কি হয়?
আমার ছোট মাইয়া।
তাহলে এই ভাবে লিখি— মা মনি লতিফা, তুমি কেমন আছ?
জ্বি আচ্ছা বাবা লেহেন। তারপর লেহেন আমি ভালই আছি। তবে তোমাদের জন্য বড়ই চিন্তাযুক্ত।
ফরিদ বলল, আমি একটু অন্য রকম করে লিখি? লিখি— আমার শরীর ভালই আছে তাবে সারাক্ষণ তোমাদের জন্যে চিন্তা করি বলে মন খুব খারাপ থাকে। লিখব?
জি জি লেহেন। আপনের মত কইরা লেহেন। এই মেয়ে আমার বড় আদরের।
আর কি লিখব বলুন?
আপনার মত কইরা লেহেন— ভাল-মন্দ মিশাইয়া।
ফরিদ তরতর করে লিখে চলেছে। এক পৃষ্ঠার জায়গায় তিন পৃষ্ঠা হয়ে যায়। সেই চিঠি পড়ে শুনানোর পর বৃদ্ধ বলে, বড় আনন্দ পাইলাম বাবাজী। বড় আনন্দ। মনের সব কয়টি কথা লোহা হইছে।
বৃদ্ধের আনন্দ দেখে ফরিদ আনন্দ বোধ করে। তার কাস্টমারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে। তবে তার নিয়ম হচ্ছে দিন চলার মত টাকা হয়ে গেলেই লেখালেখি বন্ধ। পার্কের কোন বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা।
এই ব্যাপারটা কাদেরের খুব অপছন্দ। সে চায় লেখালেখি রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত চলুক। মামার অকারণ আলস্যামী দুচোখে বিষ। লিখলেই যখন টাকা আসে তখন এই রকম না লিখে বেঞ্চিতে চুপচাপ শুয়ে থাকবে কেন? ফরিদের এই বিষয়ে যুক্তি খুব পরিষ্কার যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই উপার্জন করতে হবে তার বেশি না। সাধু সন্ন্যাসীরা যে পদ্ধতিতে ভিক্ষা করতেন। সেই পদ্ধতি। যেই এক বেলার মত খাবারের চাল পাওয়া গেল ওমি ভিক্ষা বন্ধ।
আপনের কথার মামা কোন আগাও নাই। মাথাও নাই।
মহা বিরক্ত হয়ে কাদের সিগারেট ধরায়। ফরিদ ক্ৰ কুঁচকে তাকালেই বলে এমন কইরা চাইয়েন না মামা। অখন আপনের সামনে সিগারেট খাইলে দোষের কিছুই নাই। বাড়ির বাইরে আপনেও পাবলিক, আমিও পাবলিক।
তুই পাবলিক ভাল কথা, আমার ঘারে বসে বসে খাচ্ছিস তোর একটু লজ্জা সরমা নেই? রোজগার পাতির চেষ্টা কর।
কী চেষ্টা?
রিকশা চালালে কেমন হয়? পারবি না?
কাদের কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, সৈয়দ বংশের পুলা হইয়া রিকশা চালামু? আপনে কন কি? বংশের একটা ইজ্জত আছে না?
ফরিদ কিছু বলল না। আসলে কথাবার্তা বলার চেয়ে বেঞ্চিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার ভাল লাগছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের পাল। এই সৌন্দর্য এতদিন চোখের আড়ালেই ছিল। ভাগ্যিস সে পথে নেমেছিল। পথে না নামলে কি এই দৃশ্য চোখে পড়ত? পড়ত না।
মামা?
কী।
চুপচাপ আপনের ঘাড়ে বইসা খাইতেও খারাপ লাগে। কি করি কন দেহি।
ভেবে কিছু একটা বের কর।
ছিনতাই করলে কেমন হয় মামা?
কি বললি?
ছিনতাই।
রিকশা চালানোয় আপত্তি আছে। ছিনতাই-এ আপত্তি নেই?
রিকশা চালাইলে দশটা লোকে দেখব মামা। আর ছিনতাই করলে জানিব কেন্ডা? কেউ না।
তুই আমার সাথে কথা বলবি না।
কি কইলেন মামা?
বললাম যে তুই আমার সথে কথা বলবি না। No talk কথা বললে চড় খাবি।
জে আচ্ছা।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে তুই আমার সঙ্গে হোটেলে খেতেও আসবি না। চোরদের প্ৰতি আমার কোন মমতা নেই।
কাদের ক্রদ্ধ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপরই হন হন করে হাঁটতে শুরু করল। মনে হল বিশেষ কোন কাজে যাচ্ছে। তার প্রায় মিনিট পনেরো পরে তাকে দৌড়তে দৌড়াতে এদিকে আসতে দেখা গেল। তার হাতে নতুন একটা শ্ৰীফকেইস। পেছনে জনা দশেকের একটি দল। ধর ধর আওয়াজ উঠছে।
ফরিদ ধড়মড় করে উঠে বসল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ব্যাপার কি রে? কাদের হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দৌড় দেন মামা।
তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে ফরিদ তৎক্ষণাৎ উঠে। ছুটতে শুরু করল। ছুটিতে ছুটতে বললেন, ব্যাপার কি রে?
ছিনতাই করেছি মামা।
সে কি?
চাইয়া দেহেন নতুন ব্রীফকেইস। এখন ধরা পড়লে জানে শেষ করব। আরো শক্ত দৌড় দেন।
ফরিদ হতভম্ব হয়ে বলল, তুই ছিনতাই করেছিস। আমি দৌড়াচ্ছি কেন?
কাদের দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, পাবলিক বড় খারাপ জিনিস মামা। বড়ই খারাপ। এ দুনিয়ায় পাবলিকের মত খারাপ জিনিস নাই।
বিলু এবং আনিসকে স্টীমারে তুলে দিয়ে এসে সোবাহান সাহেব খবর পেলেন যে থানা থেকে টেলিফোন এসেছে। দুজন ছিনতাইকারী ধরা পড়েছে। তারা বলছে সোবাহান সাহেব তাদের চেনেন। তিনি যদি থানায় আসেন। তাহলে ভাল হয়। একটাকে দেখে মনে হচ্ছে গ্যাং লিডার- ইয়া লাস। সোবাহান সাহেব তৎক্ষণাৎ থানায় ছুটলেন। ফরিদ এবং কাদেরকে ছাড়িয়ে আনতে তাঁর বিশেষ বেগ পেতে হল।
স্টীমারে প্রথম শ্রেণীর যে কামরাটা রিজার্ভ করা হয়েছে তাতে দুটি বিছানা। দুর্সীটের কামরা দেখে বিলুর মুখ শুকিয়ে গেল। আনিস কি তার সঙ্গে এই কামরাতেই থাকবে? তা কি করে হয়? টিকিট আনিস করেছে। এই কাজটা কি ইচ্ছা করেই করা? ভদ্রলোক কি একবারও ভাবলেন না। একজন কুমারী মেয়ের সঙ্গে এক কামরায় সারারাত যাওয়া যায় না। বিলু। তার বাবার উপর রাগ করল। বাবার উচিত ছিল, কিভাবে যাওয়া হচ্ছে- এই সব জিজ্ঞেস করা। তিনি তাঁর কিছুই করলেন না। তাদের স্টীমারে উঠিয়ে দিয়ে অতি দ্রুত নেমে গেলেন।
এখন বিলু কি করবে?
আনিসকে ডেকে বলবে- আমরা দুজনেতো একসঙ্গে যেতে পারি না। সেটা শোভন নয়। আপনি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করুন। এই কথাও বা কিভাবে বলা যায়?
মানুষটা তো নির্বোধ নয়।
সে এমন নির্বোধের মত কাজ কিভাবে করল? না-কি এই কাজ নিবোঁধের নয়। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করা?
স্টীমার পাঁচটায় ছাড়ার কথা, ছাড়ল সাতটায়। আনিস জিনিসপত্র রুমে ঢুকিয়ে সেই যে উধাও হয়েছে আর দেখা নেই। স্টীমারেই কোথাও আছে নিশ্চয়ই। বিলুইচ্ছা করলেই তাকে খুঁজে বের করতে পারে। ইচ্ছা করছে না।
স্টীমারে বিলু কখনো ঘুমুতে পারে না। আজকের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে তো ঘুমানোর প্রশ্নই উঠে না। বিলু তিন চারটা গল্পের বই বের করল। জানিতে একটা গল্পের বই কখনো পড়া যায় না। কিছুক্ষণ পর পর বই বদলাতে হয়এখন যে পড়েছে রেমার্কের নাইট ইন লিসবন। নাটকীয় মুহুর্তে সোয়াৎস জার্মানিতে তার স্ত্রীর ঘরে লুকিয়ে আছে। স্ত্রীর বড় ভাই নাৎসী পার্টির সদস্য। আগে সে একবার সোয়ৎিসকে কনসানট্রেশান ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল। আবারো ধরা পড়লে মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই। এমন সব নাটকীয় মুহুর্ত তবুও বইয়ে মন বসছে না। চাপা এক ধরনের অস্বস্তিতে মন ঢাকা।
খাওয়া দাওয়া হয়েছে?
বিলু বই থেকে মুখ তুলল। আনিস দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। বিলু, শুকনো গলায় বলল, জ্বিনা, এখনো খাওয়া হয়নি।
রাত কিন্তু অনেক হয়েছে, খেয়ে নিন। দশটা পাঁচ বাজে।
আপনি খাবেন না?
আমি খেয়ে নিয়েছি।
কোথায় খেলেন? স্টীমারে?
জ্বি।
আমি কিন্তু সঙ্গে দুজনের মত খাবার এনেছিলাম।
কোন অসুবিধা নেই। আপনি খেয়ে নিন। খাওয়া-দাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে শুয়ে ঘুম দিন।
যে চাপা অস্বস্তি বিলুকে চাড়া দিচ্ছিল তা কেটে গেল। ভাগ্যিস যে নিজ থেকে কিছু বলেনি।
বললে খুব লজ্জায় পড়তে হত।
আনিস বলল, এক বেডের কামরা ছিল না বলে দুই বেডের কামরা নিতে হয়েছে। অনেকগুলো টাকা খামাখা বেশি গেল। আপনি খাওয়া দাওয়া সেরে নিন। ওদেরেকে বলেছি। এগারোটার সময় আপনাকে চা দিয়ে যাবে।
চা?
আমি একদিন লক্ষ্য করেছি। রাতের খাবারের পর পর আপনি চা খান, সেই কারণেই বলা।
আপনি ঘুমুবেন কোথায়?
ট্রেন, বাস এবং স্টীমারে আমি ঘুমুতে পারি না। প্লেনের কথা জানি না। প্লেনে কখনো চড়িনি। আমি তাহলে যাচ্ছি।
বিলুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আনিস চলে গেল। আর ঠিক তখন বিলুর মনে হল এই কামরায় গল্প করতে করতে দুজন রাতটা কাটিয়ে দিতে পারত। তাতে অসুবিধা কি হত? কিছুই না। আমরা আধুনিক হচ্ছি। কিন্তু মন থেকে সংস্কারের বাঘ তাড়াতে পারছি না। কি মূল্য আছে এইসব সংস্কারের?
বিলু চমকে উঠল, কি সব আজে বাজে কথা সে ভাবছে? তাহলে সে কি মনের কোন গভীর গোপনে আশা করেছিল আনিস থাকবে এই ঘরে? রাতটা কাটিয়ে দেবে গল্প করতে করতে? ছিঃ কি লজ্জার কথা। এমন একটা গোপন বাসনা তার কি সত্যি আছে? এই লজা সে কোথায় রাখবে? ভাগ্যিস একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের মনের গোপন জায়গাগুলো দেখতে পায় না। দেখতে পেলে পৃথিবী আচল হয়ে পড়তো।
রাতের খাবার বিলু খেতে পারল না। তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। টি-পটে করে চা দিয়ে গেল এগারোটার দিকে। তখন বিলুর মনে হলে দুজন মিলে এক সঙ্গে বসে চা তো খেতে পারে। এর মধ্যে তো অন্যায় কিছু নেই। এটা হচ্ছে সাধারণ ভদ্রতা। এই সাধারণ ভদ্রতাকে আনিস সাহেব নিশ্চয়ই অন্য কিছু ভেবে বসবেন না।
বিলু দরজা লক করে আনিসের খোজে বের হল।
আনিস দোতলায় ডেকে চাদর পেতে চুপচাপ বসেছিল। তার দৃষ্টি অন্ধকার নদীর দিকে। নদীতে টিমটিমে আলো জ্বলিয়ে মাছ ধরা নৌকা বের হয়েছে। আকাশের নক্ষত্রের মতো মাছধরা নৌকার আলোগুলো ঔজ্জ্বল্য বাড়ছে কমছে। আনিসের দৃষ্টিতে আত্মমগ্ন একটা ভাব যা দূর থেকে দেখেতে ভাল লাগে। কি ভাবছে। এই মানুষটি? তার স্ত্রীর কথা? কতটুকু ভালবাসতো সে তার স্ত্রীকে? সেই রকম ভাল কি অন্য কাউকে বাসা যায় না? না-কি এক জীবনে মানুষ একজনকেই ভালবাসতে পারে?
আচ্ছা সে যদি এখন আনিসের পাশে গিয়ে বসে তাহলে তা কি খুব অশোভন হবে? সে-কি বসবে তার পাশে? হালকা গলায় বলবে আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম। আপনি কি ভাবছেন?
আনিস সাহেব নিশ্চয় লজ্জা পাওয়া গলায় বলবেন, কিছু ভাবছি নাতো। সে বলবে, কি দেখছেন? তিনি বলবেন, কিছু দেখছি না, তাকিয়ে আছি। সে বলবে, আপনাদের এদিকে খুব হাওয়াতো।
ভেবে রাখা কথাবার্তা কিছুই হলো না। আনিস এক সময় হঠাৎ লক্ষ্য করল বিলু দাঁড়িয়ে। সে উঠে এল। বিলু বলল, আপনার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে একটু উঠে আসুনতো। আনিস উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কোন সমস্যা হয়েছে না-কি?
হ্যাঁ সমস্যা হয়েছে।
কি সমস্যা?
কেবিনে আসুন তারপর বলব। স্টীমারে কেবিনে দুজন মুখোমুখি বসল। বিলু বলল, আগে চা শেষ করুন তারপর বলছি। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কি-না কে জানে; অনেকক্ষণ আগে দিয়ে গেছে।
আনিস নিঃশব্দে চা শেষ করল। বিলুর আচার-আচরণ ভাবভঙ্গি সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাকে খানিকটা বিভ্রান্ত, খানিকটা উত্তেজিত মনে হচ্ছে। বারবার শাড়ির আঁচলে সে কপাল মুছছে। আনিস বলল, ব্যাপার কি বলুন তো?
বলছি। ব্যাপার কিছু না। আপনাকে চা খাবার জন্যে ডেকেছি। না-কি এক কেবিনে আমার সঙ্গে বসে চা খেতে আপনার আপত্তি আছে?
আনিস বিস্মত হয়ে বলল, আপত্তি থাকবে কেন?
আমাকে এখানে রেখে হুট কর পালিয়ে গেলেন সেই জন্যে বলছি।
আনিস নিজেও এবার খানিকটা বিভ্ৰান্ত হল। এই মেয়েটি এ রকম কেন?
বিলু বলল, চুপ করে বসে আছেন কেন? গল্প করুন।
কি গল্প করব?
আপনার স্ত্রীর কথা বলুন।
তার কোন কথা?
আচ্ছা তাকে কি আপনি খুব ভালবাসতেন।
এখনো বাসি।
খুব বেশি?
হ্যাঁ খুব বেশি।
আচ্ছা আপনার যদি অনেক টাকা পয়সা থাকতো তাহলে আপনি কি আপনার স্ত্রীর জন্যে তাজমহল জাতীয় কিছু বানাতেন?
না।
না কেন?
ভালবাসা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঢাক ঢোল পিটিয়ে তার প্রচার করার কোন কারণ দেখি না।
আচ্ছা আপনাদের বিয়ে কিভাবে হয়?
কোর্টে হয়। ওর বাবা মা আমার মত ভ্যাগবন্ডের কাছে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। এদিকে ও নিজেও খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল কাজেই….
আপনি কিছু মনে করবেন না একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করছি— আমি তোমাকে ভালবাসি। এই বাক্যটা আপনাদের দুজনের মধ্যে কে প্রথম ব্যবহার করল?
আমার স্ত্রী।
আমিও তাই ভেবেছিলাম। বিয়ের প্রসঙ্গ কে প্রথম তুলল, আপনি না উনি?
সেই তুলল! সে খুব লাজুক ধরনের মেয়ে ছিল কিন্তু নিজের কথা বলার ব্যাপারে সে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করেনি।
বিলু আবারো শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল ঘসল। উদ্বিগ্ন চোখে এদিক ওদিক তাকাল তার পরপরই আনিসকে সম্পূর্ণ হতচকিত করে বলল, আমি আপনাকে ভালবাসি এবং আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হোক এটা আমি মনেপ্ৰাণে চাই। এই কথাগুলো অনেকদিন আমার মনের মধ্যে ছিল বলতে না পেরে কষ্ট পাচ্ছিলাম। আজ বলে ফেললাম। আপনি যদি আমাকে বেহায়া ভাবেন তাতেও আমার কিছু যায় আসে না।
আনিস কিছুই বলল না।
অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। এত বিস্মিত সে এর আগে কখনো হয় নি।
বিলু মাথা নিচু করে বলল, আপনি যদি এখন চলে যেতে চান চলে যেতে পারেন। আর যদি চান আমরা দুজনে মিলে সারা রাত গল্প করি তাও করতে পারেন।
আনিস দেখল বিলুর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এই কারণেই সে মাথা নিচু করে বসে আছে।
আনিস বলল, বিলু তোমার কি দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বরিশালে আছে?
হ্যাঁ আছে।
তাহলে বরিশালে নেমেই আমরা যে কাজটা করব তা হচ্ছে ঐ দুজনকে নিয়ে ম্যারেজ রেজিস্টারের কাছে যাব। কি বল?
আচ্ছা।
আমার মত অবস্থায় লোকজনকে জানিয়ে পাগড়ি টাগড়ি পরে বিয়ে করার অর্থ হয় না। এইবার তুমি চোখ মুছে আমার দিকে তাকাও তো। কাঁদবার মত কিছু হয় নি। আমার মত একজন অভাজনের জন্যে তোমার মত একটা মেয়ে কাঁদবে তা হতেই পারে না। তাকাও আমার দিকে।
না। আমি তাকাতে-টাকাতে পারব না।
বিলু বলল, তাকাতে পারবে না। কিন্তু জলভরা চোখে তাকাল। এই কয়েকটি মুহুর্তের জন্যে বিলুকে কি সুন্দর যে দেখাল তা সে কোনদিন জানবে না।
পর্ব ২৩ শেষ 📌
🔴পর্ব :২৪🔴
সোবাহান সাহেব বারান্দায় বসে আছেন। তার কোলে মোটা একটা খাতা, যে খাতায় গৃহহীন মানুষদের দুঃখ গাঁথা এবং তার দূরীকরণের নানান পদ্ধতি নিয়ে ক্ৰমাগত লিখে যাচ্ছেন। এখন অবশ্যি লিখছেন না। এখন ভাবছেন, তবে খাতা খোলা। মাঝে মাঝে চোখ বুলাচ্ছেন। ফরিদ এসে গম্ভীর মুখে পাশে দাঁড়াল। হাজত থেকে বের হয়ে এই প্রথম সে দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। সোবাহান সাহেব বললেন, কিছু বলবে?
জ্বি।
কোন প্রসঙ্গে?
ছিনতাই প্রসঙ্গে। দুলাভাই আপনার হয়ত ধারণা হয়েছে। ঐ দিনের ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত।
সোবাহান সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, এখন অন্য কাজে ব্যস্ত আছি। তোমার প্রসঙ্গে নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।
আপনাকে কথা বলতে হবে না। আমি কথা বলব। আপনি শুনবেন।
আমি কিছু শুনতেও চাচ্ছি না।
ও আচ্ছা।
ফরিদ বিমর্ষ মুখে ঘরে ভেতর ঢুকল। মিলির সঙ্গে দেখা হল। সে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। এখন তাকে কিছু বললেই সে বলবে, মামা আমি ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। হাতে একদম সময় নেই। অদ্ভুত এই বাঙালি জাতি। হাতে কোন কাজ নেই। তবু সারাক্ষণ ব্যস্ত ভঙ্গি। এই ভঙ্গিটা বাঙালি জাতি কোথায় শিখল কে জানে।
মিলি।
জ্বি মামা।
খুব ব্যস্ত?
জ্বি না।
তাহলে তোর সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলি ঐ ছিনতাইটা প্রসঙ্গে। তোদের সবার হয়ত ধারণা হয়েছে। ঐ দিনকার ঘটনার পেছনে আমার হাত আছে। আসলে তা নেই। ব্যাপারটা হল কি…
মামা আমার তো এখন ক্লাস আছে। ক্লাসে যাচ্ছি।
তবে যে বললি- তুই ব্যস্ত না।
ব্যস্ত না তা ঠিক, ক্লাস আছে তাও ঠিক।
ও আচ্ছা তুই তাহলে আমার কথা শোনায় আগ্রহী না?
তুই ঠিকই ধরেছ মামা।
ঐদিনকার ঘটনার মূল নায়ক কাদেরকে আমি শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
খুব ভাল করেছে মামা। শাস্তি দাও। আমি এখন যাই?
কি শাস্তি দিচ্ছি সেটা শুনে যা। তোর ইউনিভার্সিটিতো পালিয়ে যাচ্ছে না। এক মিনিট লাগবে। আমি অবশ্যি চেষ্টা করব-তোর চেয়েও কম সময়ে কাজ সারতে। ধরা পাচ পঞ্চাশ সেকেন্ড।
বল কি বলবে।
কাদেরকে মানসিক শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কঠিন মানসিক শাস্তি। তার গলায় সাইনবোর্ড বুলিয়ে দেয়া হবে। সেখানে লেখা থাকবে- আমি চোর। এই অপমান সূচক বিজ্ঞাপন গলায় বুলিয়ে সে এক লক্ষ বার কানে ধরে উঠবে এবং বসবে। প্রতি উঠবোসের সময় উঁচু গলায় বলবে। আমি চোর।
বাহ চমৎকার শাস্তি।
এখানেও শেষ না। প্রতি রাতে তাকে একটা করে শিক্ষামূলক ছবি দেখানো হবে। এটা করা হবে আত্মশুদ্ধির জন্যে।
এখন যাই মামা? তোমার কথা নিশ্চয়ই শেষ হয়েছে।
শেষ হয়নি।
সময়তো শেষ হয়ে গেছে। এক মিনিট চেয়েছিলে, তুমি কথা বলেছ। এক মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড। তেত্ৰিশ সেকেন্ড বেশি নিয়ে নিয়েছ। খোদা হাফেজ।
মিলি আর দাঁড়ালো না। চট করে চলে এলো বারান্দায়। বারান্দায় পা দিয়েই খানিকটা শংকিত বোধ করল— বাবার হাতে খাতাপত্ৰ। চট করে বলে বসতে পারেন— মা একটু শুনতো কি লিখলাম। মিলি অবশ্যই বলতে পারে আমি ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। কিছু শুনতে পারব না। কিন্তু বলা সম্ভব না। কারণ সে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না। যাচ্ছে মনসুরের কাছে। বাবার কাছে মিথ্যা বলা সম্ভব না। মিথ্যা কথাগুলো এই মানুষটার সামনে এলেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়।
সোবাহান সাহেব মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিস? মিলি হ্যাঁ না কিছুই বলল না। মধুর ভঙ্গিতে হাসল। সোবাহান সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, দুদিন হয়ে গেল অথচ আনিস আসছে না। ব্যাপারটা কি বলতো?
দু এক দিন থেকে, দেখে টেখে আসছে আর কি?
তবু চিন্তা লাগেছে। আজ না এলে মনে করিস তো— মেডিকেল কলেজের রেজিষ্ট্রারের বাসায় একটা টেলিফোন করব।
আচ্ছা।
তুই যাচ্ছিস কোথায়?
মনসুর সাহেবের ফার্মেসিতে যাচ্ছি বাবা।
যাচ্ছিস যখন ওকে বলিস আমার সঙ্গে দেখা করতে। জরুরি দরকার আছে।
কি দরকার বাবা?
এমদাদ সাহেব তার নাতনীকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। তার ধারণা আমি বললেই হয়। ভদ্ৰলোকের যখন এত শখ বলে দেখি।
বললে লাভ হবে না। বাবা। উনি কিছুতেই পুতুলকে বিয়ে করতে রাজি হবেন না।
রাজি হবে না কেন? পুতুল মেয়েটাতো বড়ই ভাল। দেখতেও সুন্দর। মেয়েটা গরিব। গরিব হওয়াতো দোষের কিছু না। আমি বুঝিয়ে বললেই রাজি হবে।
মিলি কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সোবাহান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, সামান্য মুখের কথায় যদি মেয়েটার একটা গতি হয় তো মন্দ কি?
কিছু বলার দরকার নেই বাবা।
দরকার নেই কেন তুই আমাকে বুঝিয়ে বল।
শেষে রাজি হবে না। মাঝখান থেকে তুমি লজ্জা পাবে।
লজ্জার কি আছে? লজ্জার কিছুই নেই। তাছাড়া আমার ধারণা সে রাজি হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যদি মনে কর সে রাজি হবে তাহলে বলে দেখ।
তুই হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলি কেন তাওতো বুঝলাম না।
মিলি কিছু না বলেই নিচে নেমে গেল। তার মন বেশ খারাপ হয়েছে।
মন আরো খারাপ হল যখন ডাক্তারকে ফার্মেসীতে পাওয়া গেল না। মিলি ঘণ্টা খানিক অপেক্ষা করে একটা চিঠি লিখে এল।
ডাক্তার সাহেব,
আপনাকে না পেয়ে চলে যাচ্ছি। একবার বাসায় আসবেন। বাবা আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। তবে দয়া করে বাবার সঙ্গে কথা বলার আগে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। খুব জরুরি।
বিনীতা, মিলি।
মিলি বাসায় ফিরে দেখে কাদেরের শাস্তি পর্ব শুরু হয়েছে। তার গলায় সাইনবোর্ড আমি চোর। সে মহানন্দে উঠবোস করছে। ফরিদ উঠবোসের হিসাব রাখছে। প্ৰতি পঞ্চশবার উঠবোসের পর দশ মিনিট বিরতি। মিলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এইসব ছেলে মানুষির কোন মানে হয়? কিন্তু মামাকে এই কথা কে বুঝাবে? এই বাড়ির সব মানুষ এমন পাগল ধরনের কেন?
মিলি মন খারাপ করে নিজের ঘরে ঢুকল। কেন জানি কিছু ভাল লাগছে। না। ঘর সংসার সবে ফেলে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। মাঝে মাঝে তার এরকম হয়। কদিন ধরে ঘন ঘন হচ্ছে। রহিমার মা ঘরে ঢুকল। তার মুখ ভর্তি হাসি। কাদেরের শাস্তিতে সে বড়ই আনন্দ বোধ করছে।
আফা আপনেরে বুলায়।
কে বুলায়?
টগরের আকবা।
উনি এসেছেন?
হ।
তুমি গিয়ে বল এখন যেতে পারব না। পরে এক সময় যাব।
জি আচ্ছা।
আরেকটা কথা শোন, ডাক্তার সাহেব এলেই তুমি আমাকে খবর দেবে।
রহিমার মা ফিক করে হেসেই সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল।
মিলি তিক্ত গলায় বলল, হাসলে কেন রহিমার মা?
বুড়ো হইছি তো আফা, মাথার নাই ঠিক। বিনা কারণে হাসি পায় আবার চউক্ষে পানি আয়!
ঠিক আছে তুমি যাও।
রহিমার মা আবার ফিক করে হাসল। তার বড় মজা লাগছে। চোখের সামনে ভাব ভালবাসা দেখতে ভাল লাগে। সে ফরিদের ঘরের দিকে রওয়ানা হল। কাদেরের শাস্তি আরো খানিকক্ষণ দেখা যাক। কাউকে শাস্তি পেতে দেখলেও মন ভাল হয়। কেন হয় কে জানে।
দশ মিনিট শাস্তির পর এখন বিরতি চলেছে। বিমর্ষ মুখে এমদাদ বসে। আছে। অনেকক্ষণ ধরেই সে একটা কথা বলতে চাচ্ছিল। সুযোগের অভাবে বলতে পারছিল না। এখন সুযোগ পাওয়ায় মুখ খুলল।
ভাইজান একটা কথা বলব?
বলুন।
এই শাস্তিতে চোরের কিছু হয় না। চোরের আসল শাস্তি হইল মাইর।
ফরিদ বলল, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এ আপনি বুঝবেন না।
ছোট্ট একটা পরামর্শ দেই ভাইজান? রাখা না রাখা আপনার ইচ্ছা।
দিন পরামর্শ।
দুই হাতে দশটা কইরা ইট দিয়া রইদে খাড়া করাইয়া দেন, ইট হাতে লইয়া উঠি বোস।
আপনার পরামর্শ শুনলাম। দয়া করে আর কথা বলবেন না।
জি আচ্ছা।
পর্ব ২৪ শেষ 📌
🔴পর্ব :২৫🔴
তিন তারিখটা মনসুরের জন্যে খুব শুভ।
মিলির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল তিন তারিখে। প্রথম যেদিন মিলি তাকে ডাক্তার হিসেবে তাদের বাড়িতে ডাকে ঐ দিনও ছিল তিন তারিখ। নিউম্যারোলজি এই সংখ্যাটি সম্পর্কে কি বলে সে জানে না- তবে কিছু নিশ্চয়ই বলে।
আজ হচ্ছে তিন তারিখ।
সকাল থেকেই মনসুরের মনে হচ্ছিল আজ তার জীবনে বড় কোন ঘটনা ঘটবে। সকালে দাঁত মাজতে মাজতে লক্ষ্য করল দুটি শালিক কিচিরমিচির করেছে। খুবই শুভ লক্ষণ, দুই শালিক মানেই হচ্ছে আনন্দ। আনন্দময় কিছু আজ ঘটবেই। দিনটাও চমৎকার। আকাশ ঘন নীল। বাতাসও কেমন জানি মধুর।
মনসুর নাস্তা খেয়েই মিলিদের বাড়ির দিকে রওয়া হল। সাত সকালে ঐ বাড়িতে উপস্থিত হবার জন্যে কোন একটা অজুহাত দরকার। সেই অজুহাতও তৈরি করা হয়েছে। মনসুর গিয়ে বলবে কয়েক দিনের জন্যে দেশের বাড়িতে যাবার আগে দেখা করতে এলাম ইত্যাদি।
নিরিবিলি বাড়ির গেট খুলে ভিতরে ঢোকার সময়ও আরেকটি সুলক্ষণ দেখা গেল। আবারো দুটি শালিক। আনন্দে মনসুরের বুক টিপটপ করতে লাগল। সে মনস্থির করে ফেলল, যে করেই হোক মিলিকে সেই বিশেষ বাক্যটি বলবে। দরকার হলে চোখ বন্ধ করে বলবে- আমি তোমাকে ভালবাসি। তবে বলার আগে দেখে নিতে হবে কথাগুলো মিলিকেই বলা হচ্ছে, অন্য কাউকে না। রং নাম্বার না হয়ে যায়।
সোবাহান সাহেব বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে তামাক টানছিলেন।
ডাক্তাকে দেখে হাসি মুখে বললেন, কেমন আছ ডাক্তার?
স্যার ভাল আছি।
অনেক দিন আস না। এদিকে ৷
খুব ব্যস্ত থাকি আসা হয়ে উঠে না।
তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। বস এখানে।
মনসুর বসল। তার বুক ধক ধক করছে। কি সেই জরুরি কথা?
প্ৰবন্ধ পড়ে শুনাবেন নাতো? এছাড়া আর কি জরুরি বিষয় থাকতে পারে? আজও যদি প্ৰবন্ধ শুনতে হয় তাহলে সাড়ে সর্বনাশ। শালিক দুটি এখনো ঘুরছে। লক্ষণ শুভ। একটি যদি উড়ে চলে যায় তাহলে বুঝতে হবে প্ৰবন্ধ শুনতে হবে। এখনো উড়ছে না।
ডাক্তার!
জি স্যার।
তোমাকে যে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি তা কি তুমি জান?
মনসুরের ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। কথাবার্তা কোন দিকে এগুচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। তার তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে।
আমি চাই ভাল একটি মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে হোক। সুখী হবার জন্যে ভাল একটি মেয়ের পাশে থাকা দরকার।
মনসুরের হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। কি পরম সৌভাগ্য। স্বপ্ন নাতো আবার? না। স্বপ্ন বোধ হয় না। স্বপ্নে ঘাণ পাওয়া যায় না- এইতো তামাকের কড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
আমি তোমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি। বলতে পারি তো?
অবশ্যই পারেন, অবশ্যই।
প্ৰস্তাবটি তোমার কাছে গ্ৰহণযোগ্য হবে বলেই আমি মনে করি। কারণ আমি শুনেছি মেয়েটিকে তুমি পছন্দ কর।
এসব ক্ষেত্রে চুপ থাকাই বাঞ্ছনীয়। মনসুর তা পারল না। মনের উত্তেজনায় বলে ফেলল- স্যার আপনি ঠিকই শুনেছেন।
বিয়ের ব্যাপারে তোমার তাহলে আপত্তি নেই?
জ্বি না।
এদেশের ছেলেদের একটি প্রবণতা হচ্ছে বিয়ের পর স্ত্রীকে অবহেলা করা— আশা করি তুমি তা করবে না।
অবশ্যই না।
স্ত্রীর পড়াশোনার দিকটিও দেখবে। যেন তাকে পড়াশোনা ছাড়তে না হয়।
কোন দিন ছাড়তে হবে না।
তোমার কথায় খুশী হলাম। তুমি বস আমি এমদাদ সাহেবকে খবরটা দেই। ভদ্রলোক খুশী হবেন। নাতনীকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছিলেন। মেয়েটি ভাল। তুমি সুখী হবে।
মনসুরের মুখ থেকে কু কু জাতীয় শব্দ হল। আদি মানুষ গাছের ডালে বসে এই রকম শব্দেই মনের ভাব প্ৰকাশ করত। প্ৰাথমিক ধাক্কাটা এই শব্দের উপর দিয়েই গেল। তারপর খুব ঘাম হতে লাগল। সোবাহান সাহেব দ্বিতীয়বার বললেন, তুমি বস আমি সংবাদটা এমদাদ সাহেবকে দিয়ে আসি। উনি খুশী হবেন। মনসুর কিছু বলল না। তার ইচ্ছা করল ছুটে পালিয়ে যেতে তাও সে পারছে না। মনে হচ্ছে পেরেক দিয়ে কেউ তাকে চেয়ারের সঙ্গে গেঁথে ফেলেছে।
ডাক্তার পুতুলকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এই সংবাদ মিলি শুনল এমদাদ সাহেবের কাছে। ডাক্তারকে সে চিঠি লিখে এসেছিল। গাধা ডাক্তার কি চিঠি পড়েনি? মিলি তীক্ষা কণ্ঠে বলল, ডাক্তার রাজি হয়েছে?
ষোল আনার উপরে দুই আনা, আঠারো আনা রাজি।
কি বলছেন। আপনি?
সত্যি কথা বলতেছি ভইন। আইজ হইল মঙ্গলবার সত্য দিবস। সত্য দিবসে মিথ্যা বলি ক্যামনে? এখন তুমি ভইন পুতুলারে একটু সাজায়ে দেও।
এখন সাজিয়ে দিতে হবে কেন?
ডাক্তার বইসা আছে। পুতুলরে নিয়া ঘুরা ফিরা করবে। একটু রং ঢং আর কি? এতে দোষের কিছু নাই। দুদিন পরে বিবাহ। বিবাহ না হইলে অন্য কথা ছিল। ভইন একটা ভাল দেইখ্যা শাড়ি পরায়ে দেও। লাল রঙ্গে পুতুলারে মানায় ভাল।
ডাক্তার যতটা হতভম্ব হয়েছিল। মিলি তারচে বেশি হতভম্ব হল। তার চোখ জ্বালা করছে। গলার কাছে কি যেন আটকে আছে। নিজেকে সামলাতে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। বাথরুমে দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ হিউমাউ করে কাদতে পারলে ভাল লাগত। কাঁদতেও ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে ইট ভাঙা মুগুর দিয়ে ডাক্তারের মাথায় প্ৰচণ্ড একটা বারি দিতে।
এমদাদ বলল, তাড়াতাড়ি কর ভইন। পুতুলের মুখে পাউডার একটু বেশি কইরা দিবা। মাইয়া আবার শ্যামলা ধাঁচের। পাউডার ছাড়া এই মাইয়ার গতি নাই।
পুতুলকে পাঠিয়ে দিন আমি সাজিয়ে দিচ্ছি।
এক্ষণ পাঠাইতেছি।
ডাক্তার তাহলে পুতুলকে নিয়ে বেড়াবার জন্যে বসে আছে?
এমদাদ হাসিমুখে মাথা নাড়ল।
ব্যাপারটা সত্যি নয়। ডাক্তার বসে আছে কারণ এমদাদ তাকে বলেছেএকটু বাস, তোমার সাথে সোবাহান সাহেবের জরুরি কথা আছে। ডাক্তার বসে আছে জরুরি কথা শোনার জন্যে।
এমদাদ পুতুলকে সাজিয়ে ডাক্তারের সামনে উপস্থিত করল। হাসিমুখে বলল, সোবাহান সাহেব বলছেন পুতুলকে নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখাইয়া আনতে। এতে তোমাদের পরিচয়টা ভালো হইব। বিবাহের আগে পরিচয়ের দরকার আছে। আমাদের সময় দরকার ছিল না। কিন্তু এখন যুগ ভিন্ন। যে যুগের যে বাতাস।
মনসুর যন্ত্রের মত উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল গেটের দিকে। পুতুল তাকে অনুসরণ করল। পুতুলের মুখ হাসি হাসি। তাকে দেখাচ্ছেও চমৎকার। চাপা আনন্দে তা চোখ চিকমিক করছে। মনসুর বলল, তুমি চিড়িয়াখানায় যেতে চাও?
জি চাই।
মনসুর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। পুতুল বলল, আপনার যেতে ইচ্ছা না করলে যাওয়া লাগবে না।
মনসুর ইতস্তত করে বলল, একটা সমস্যা হয়ে গেছে পুতুল।
পুতুল বলল, আমি জানি।
হতচকিত ডাক্তার বলল, তুমি জান?
জানব না কেন? আমিতো বোকা না। আমি সবই জানি।
কি জান?
আমি জানি যে দাদাজানের কথার প্যাচে আপনি রাজি হয়েছেন। আসলে আপনি রাজি না।
কি করে বুঝলে?
পুতুল মুখ নিচু করে বলল, আপনি যে এই বাড়িতে মিলি আপারে দেখার জন্য আসেন সেটাতো সবাই জানে ৷
ও আচ্ছা।
মনসুরের বুকের উপর চেপে থাকা আধমণি পাথর সরে গেল। তার নিঃশ্বাস-প্ৰশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। দুই শালিক দেখা তাহলে পুরোপরি বৃথা হয়নি। বড় ভাল লাগল পুতুলকে। চমৎকার মেয়ে। মেয়েটা যে এত চমৎকার তা আগে বোঝা যায় নি।
পুতুল। চল চিড়িয়াখানায় যাই।
কেন?
কারণ তুমি খুব ভাল একটা মেয়ে। আচ্ছা পুতুল তুমি যে খুব ভাল মেয়ে তা কি তুমি জান?
পুতুল হাসতে হাসতে বলল, জানি।
পুতুলের এই কথায়ও ডাক্তার বিস্মিত হল। পুতুলকে সে লাজুক ধরনের গ্ৰাম্য বালিকা হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে সে মোটেই লাজুক নয়। কথাও বলছে চমৎকার ভঙ্গিতে।
পুতুল।
জি।
দুপুরে আজ আমরা কোন একটা হোটেল খাব। বিকেলে মহিলা সমিতিতে নাটক দেখব। তোমাকে বাসায় দিয়ে আসব। অনেক রাতে।
কেন?
তোমার দাদাজানকে আমি দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিতে চাই। তাছাড়া তোমার সাথে আমি আলোচনাও করতে চাই।
কি আলোচনা?
এই জট থেকে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায়। সেই বিষয়ে আলোচনা।
বলতে বলতে কি মনে করে যেন মনসুর হেসে ফেলল। সেই হাসি দেখে হাসতে লাগল পুতুল। অনেকদিন সে অকারণে এমন করে হাসেনি। তারা লক্ষ্য করল না যে তাদের অকারণ হাসাহাসি এবং রিকশায় পাশাপাশি বসার পুরো দৃশ্যটি গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে দুজন। গেটের ফাঁক দিয়ে এমদাদ খোন্দকার এবং দােতলার ছাদ থেকে মিলি। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে এমদাদ খোন্দকারের মুখ চাপা হাসিতে ভরে গেল। মিলির চোখ ভরে গেল জলে। অনেক চেষ্টা করেও সে সেই জল সামলাতে পারল না।
আনিস তার লেখা নিয়ে বসেছিল। নিশা তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, মিলি খালা কাঁদছে। ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বাবা বড়দের কি কাঁদা উচিত?
আনিস বলল, না উচিত না। তবে মাঝে মাঝে বড়রাও কাঁদে। বড়দের জীবনেও দুঃখ-কষ্ট আসে।
আমি কি উনাকে জিজ্ঞেস করব কেন কাঁদছে?
না, তা ঠিক হবে না। ছোটরা কাঁদলে জিজ্ঞেস করা যায়। বড়দের যায় না।
উনাকে কাঁদতে দেখে আমারো কাঁদতে ইচ্ছা করছে বাবা।
কাঁদতে ইচ্ছা করলে কাঁদ।
শব্দ করে কাদবো না আস্তে আস্তে কাঁদবো?
আমার মনে হয় নিঃশব্দে কাঁদাই ভাল হবে।
নিশা বিছানায় চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আনিস ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। আজ অনেকদিন পর সে তার লেখার খাতা নিয়ে বসছে। লেখায় মন বসছে না। এক ঘণ্টায় মাত্র দশ লাইন লেখা হয়েছে। এই দশ লাইনে তারপর শব্দটা তিনবার। তার লেখালেখির ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কি-না কে জানে। হয়ত যাচ্ছে। আনিস প্ৰাণপণে চেষ্টা করছে মন লাগাতে- অভ্যোসটা যেন পুরোপরি চলে না যায়।
নিশা চোখ মুছে বলল, কি করছ বাবা?
লিখছি।
গল্প।
হুঁ।
বড়দের না ছোটদের?
লেখার মধ্যে বড়দের ছোটদের কিছু নেই মা। লেখা সবার জন্যে।
নিশা মাথা নেড়ে বলল, বড়দের লেখায় প্ৰেম থাকে। ছোটদের লেখায় থাকে না। তুমি আসলে কিছু জান না।
আনিস এই প্রসঙ্গ পুরোপুরি এড়িয়ে যাবে ঠিক করেও মনের ভুলে জিজ্ঞেস করে ফেলল– প্ৰেম কি মা?
নিশা মিষ্টি করে হাসল। তার হাসি দেখে মনে হল প্ৰেম কি তা সে জানে তাবে এই বিষয়ে বাবাকে কিছু বলবে না। আনিস গল্প লেখা বন্ধ করে চিঠি লিখতে বসল। খুব চমৎকার করে বিলুকে এটা চিঠি লিখতে হবে। খুব দীর্ঘ চিঠি না। সংক্ষিপ্ত চিঠি— বিলু তুমি চলে এস। চলে এস, চলে এস, চলে এস।
ফরিদ দুপুরে খাওয়া শেষ করে দিবানিদ্রার আয়োজন করছে এমন সময় তার ডাক পড়ল। সোবাহান সাহেব জরুরি তলব পাঠিয়েছেন। ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। দুলাভাইয়ের এমন কোন জরুরি কথা তার সঙ্গে থাকতে পারে না। যার জন্যে দুপুরের ঘুম বাদ দিতে হবে। ট্রপিক্যাল কান্ট্রির মানুষদের জন্যে দুপুরের ঘুম যে কত দরকারী তা কাউকে বুঝানো যাচ্ছে না।
কি ব্যাপার দুলাভাই?
বস ফরিদ।
অফিস খুলে বসেছেন মনে হচ্ছে। কাগজ পত্রের ছড়াছড়ি।
সোবাহান সাহেব কিছু বললেন না। নতুন একটা ফাইল খুললেন। কাগজপত্রের স্তুপের সঙ্গে আরো কিছু কাগজপত্র যোগ হল। ফরিদ আতংকিত স্বরে বলল, কিছু পড়ে শোনানোর মতলব করছেন নাতো? আপনার মহৎ কোন রচনা পড়বার বা শুনবার তেমন আগ্ৰহবোধ করছি না। আশা করি এই সত্য কথাটা বলে ফেলার অপরাধ ক্ষমা করবেন।
তোমাকে কিছু পড়ে শোনাব না।
ধন্যবাদ।
তোমাকে যে জন্যে ডেকেছি তা বলার জন্যে কিছু ভূমিকা প্রয়োজন।
ভূমিকা বাদ দিয়ে মূল প্রসঙ্গে চলে এলে ভাল হয়। আমার ঘুমের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমুতে না গেলে আর ঘুম আসবে না। ঘুম ব্যাপারটা মানব জীবনের একটা আনসলভডমিষ্ট্রি।
সোবাহান সাহেব ফরিদের দিকে একটা সবুজ মলাটের ফাইল এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, এটা পড়। মন দিয়ে পড়।
কিছু পড়তে পারব না দুলাভাই। মন দিয়ে পড়ারতো প্রশ্নই আসে না। কি বলতে চান সংক্ষেপে বলে ফেলুন।
ফরিদ, পরতে না চাইলেও এটা তোমার ফাইল। তোমার সঙ্গেই থাকবে। এতদিন আমি হেফাজতে রেখেছি।
এতদিন যখন রেখেছেন এখনো রাখেন। আমার পক্ষে ফাইল রাখা সম্ভব নয়। একটা ফাইলে আমার যাবতীয় পরীক্ষার সার্টিফিকেট এবং মার্কশীট রেখেছিলাম। গত চার বছর ধরে ফাইল মিসিং। আমিও গেছে ছালাও গেছে। সাটিফিকেট গেছে যাক। ফাইলটার জন্যে আফসোস হচ্ছে। সুন্দর ফাইল ছিল।
সোবাহান সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। প্ৰচণ্ড ধমক দিতে যাচ্ছিলেন নিজেকে সামলে নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অতি জরুরি একটা কাজ করবেন— মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা দরকার। সোবাহান সাহেবের শ্বশুর ফরিদের বাবা বেশ কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলেন। জামাইকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন টাকাটা যেন গচ্ছিত থাকে। যদি কোন দিন মনে হয় ফরিদের মাথা ঠিক হয়েছে তাহলেই টাকাটা তাকে দেয়া যাবে। সেই টাকা ব্যাংকের নিরাপদ আশ্রয়ে বেড়ে বেড়ে হুলুস্কুল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফরিদের মাথা ঠিক হয়েছে। এ রকম কোন ধারণা সোবাহান সাহেবের হয়নি। তবু তিনি টাকাটা দিয়ে দিতে চান। সে করুক তার যা করতে মন চায়।
ফরিদ।
জ্বি দুলাভাই।
পড়।
ফরিদ নিতান্ত অনিচ্ছায় পড়ল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এখনো সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। কোন লেখাই সে দ্বিতীয়বার পড়ে না। এই লেখাগুলো তাকে দ্বিতীয়বার পড়তে দেখা গেল।
দুলাভাই, এতো কেলেংকারিয়াস ব্যাপার।
সোবাহান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কেলেংকারিয়াস ব্যাপার মানে? একটা স্ল্যাং ব্যবহার করলাম। স্ল্যাংটার মানে হচ্ছে দারুণ ব্যাপার। এই টাকাটা কি সত্যি আমাকে দিয়ে দিচ্ছেন?
হুঁ।
আমি যা ইচ্ছা তা করতে পারি?
সোবাহান সাহেব কিছু বললেন না। ফরিদ চিন্তিত গলায় বলল, এত টাকা দিয়ে কি করব তাইতো বুঝতে পারছি না। আপনি বরং অর্ধেক রেখে দিননো প্রবলেম।
তুমি এখন আমার ঘরে থেকে বিদেয় হও।
বিদেয় হতে বলছেন?
হ্যাঁ।
টাকার পরিমাণ এখানে কি ঠিকঠাক লেখা? মানে দশমিকের ফোটা এদিক ওদিক হয়নিতো?
না। তুমি বহিস্কার হও।
হচ্ছি। কেলেংকারিয়াস ব্যাপার হয়ে গেল দুলাভাই। আশা করছি ব্যাপারটা স্বপ্ন হলে যখন ঘুম ভাংবে। তখন দারুণ একটা শাক পাব।
ফরিদ ঘর থেকে বের হল। প্রথমেই দেখা রহিমার মার সঙ্গে। ফরিদ হাসি মুখে বলল, কেমন আছ রহিমার মা?
জ্বি মামা ভাল। আমার কাছে তোমার যদি কিছু চাওয়ার থাকে চাইতে পার। আজ যা চাইবে—তাই পাবে। Sky is the Iimit কি চাও?
রহিমার মা বেশ কিছু সময় ভেবে বলল, পাঁচটা টাকা দেন মামা। ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মানুষের আশা-আকাঙক্ষা কত সীমিত। যা ইচ্ছা তাই চাইতে বলা হয়েছে। সে চেয়েছে পাঁচটা টাকা। বড় কিছু চিন্তা করার মত অবস্থাও এদের নেই। সব চিন্তা ক্ষুদ্র চিন্তা। অভাব অনটন মানুষের কল্পনাশক্তিকেও সম্ভবত খর্ব করে।
এই নাও পাঁচ টাকা। তুমি যে কত বড় ভুল করলে তুমি জান না রহিমার মা। যা চাইতে তাই পাইতে— Sky is the limit.
রহিমার মা দাঁত বের করে হাসল। হাসি না থামিয়েই বলল, তাইলে মামা আরো পাঁচটা টাকা দেন।
ফরিদ আরেকটা পাঁচ টাকার নোট বের করল। রহিমার মার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল।
বসার ঘরে শুকনো মুখে মিলি বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে বড় ধরনের একটা ঝড় বয়ে গেছে। ফরিদ যখন বলল, তুই আমার কাছে কি চাস মিলি? যা কিছু চাইবার তাড়াতাড়ি চেয়ে ফেল— টাইম নেই।
মিলি কঠিন গলায় বলল, তুমি মামা বড় বিরক্ত কর। এখন যাও।
কিছু চাইবি না?
না।
এই সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়বার আসবে না Once in a life time.
প্লীজ যাওতো! প্লীজ। যাচ্ছি। তুই এমন মুখ করে বসে আছিস কেন? মনে হচ্ছে তুই আলফ্রেড হিচককের কোন ছবির নায়িকা।
এমদাদ খোন্দকারকে যখন জিজ্ঞেস করা হল- আপনার যদি আমার কাছে কিছু চাইবার থাকে তাহলে চাইতে পারেন। যা প্রার্থনা করবেন তাই পাবেন।
এমদাদ খোন্দকার অনেক ভেবে চিন্তে বলল, একখান সিগারেট খাওয়ান বাবাজী, বিদেশী। দেশীটা খাইলে গলা খুসখুসি করে।
ফরিদ নিজেই দোকান থেকে এক কাঠি বেনসন এন্ড হেজেস এনে দিল। এমদাদ খোন্দকার গাঢ় স্বরে বলল, বাবাজীর ব্যবহারে প্রীত হইলাম। বড়ই প্রীত হইলাম।
এমদাদ সাহেব!
জ্বি।
আজ আমার মনটা বড়ই প্ৰফুল্ল। আজ আমি কোন ভিক্ষুককে বড় ধরনের সাহায্য করতে চাই।
সাহায্য করলেও লাভ নেই। ভিক্ষুক হইল গিয়া আফনের ভিক্ষুক।
সে যেন আর ভিক্ষুক না থাকে। সেই চেষ্টাই করা হবে। আমি ঠিক করেছি আগামী এক ঘণ্টার ভেতর যে ভিক্ষুক এই বাড়িতে আসবে তাকে দশ হাজার টাকা দেব।
বাবাজী কি বললেন?
আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে যে ভিক্ষুক এ বাড়িতে আসবে তাকে দেয়া হবে দশ হাজার টাকা। আমি বেশ কিছু টাকা পেয়েছি। দশ হাজার টাকা এখন কোন ব্যাপারই না। এখন বাজছে দুটা পাঁচ। তিনটা পাঁচের মধ্যে যে আসবে সেই পাবে।
হতভম্ব ভাব কাটাতে এমদাদ খোন্দকারের অনেক সময় লাগল। পাগল শ্রেণীর অনেকের সঙ্গেই তার পরিচয় আছে- এই রকম পাগল সে দেখেনি।
বাবাজী একখান কথা বলি?
বলেন।
আমিও বলতে গেলে ভিক্ষুক শ্রেণীর। টাকা পয়সা নেই। ঘর বাড়িও নাই। পরান্নভোজী আমি যদি ভিক্ষুক না হই তা হইলে আর ভিক্ষুক কে?
আপনার কথা আসছে না। যারা রাস্তায় থাকে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তাদের কথা হচ্ছে। ঘড়ির দিকে লক্ষ্য রাখুন। তিনটা পাঁচ বাজা মাত্রই সময় শেষ।
অন্যদিন ভিক্ষুকের যন্ত্রণায় ঘরে থাকা যায় না। আজই ব্যতিক্রম হল, ভিক্ষুক এল না। এমদাদ খোন্দকার হাসি মুখে বলল, টাইম শেষ বাবাজী।
ফরিদ বিষণ্ণমুখে বলল, তাইতো দেখছি।
রাতে ফরিদ একেবারেই ঘুমুতে পারল না। পুরো রাতটাই বিছানায় জেগে কাটাল। দুবার মাথায় পানি ঢেলে এল। ছাদে খানিকক্ষণ হেঁটে এল। কোন লাভ হল না। তার মাথায় দুপাশের শিরা দপদপ করছে, চোখ জ্বালা করছে। বুকে এক ধরনের চাপা ব্যথা অনুভব করছে। ধনী হওয়ার যে এত যন্ত্রণা তা কে জানত?
মিলিও ঘুমুতে পারল না।
সে লক্ষ্য করেছে পুতুল ফিরেছে। হাসি মুখে। তার সারা চোখ মুখে আনন্দে ঝলমল করছে। হাতে বড় একটা চকোলেটের টিন। টিন খুলে সবাইকে সে চকোলেট বিলি করছে। মিলিকে দিতে এসেছিল, মিলি কঠিন স্বরে বলেছে— আমি চকলেট খাই না।
এই কথায় সে ফিক করে হেসে ফেলেছে। সেই হাসি মিলির বুকে শেলের মত বিধেছে। এসব কি? কি হচ্ছে এসব? বোঝার উপর শাকের আঁটির মত বড়। আপার একটি চিঠিও এস উপস্থিত— সেই চিঠির ভাব ভাষা সবই যেন কেমন অদ্ভুত—
মিলি,
আমি ভুল করেছি কি-না তা জানি না। হয়ত করেছি। করলেও এ ভুল মধুর ভুল। সব মানুষই তার জীবনে অনেক ভুল করে। কিন্তু আনন্দময় ভুল প্রায় কখনোই করে না। আমি করলাম। তার জন্যে কি তোমরা আমাকে ত্যাগ করবে…
এই রকম চিঠি লেখার মানে কি? আপা এমন কি ভুল করবে যার জন্যে তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। পৃথিবীর সবাই ভুল করতে পারে, আপা পারে না। তারপরও যদি কোন ভুল করে থাকে তাহলে কি সেই ভুল? ভুলের ব্যাপারটা সে স্পষ্ট করে বলছে না কেন?
চলবে📌