🔴বহুব্রীহি (পর্ব :২৬, ২৭)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
নিরিবিলি বাড়ির সামনে দুটি আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। টগর এবং নিশার জন্যে এই গাড়ি দুটি হচ্ছে ফরিদের উপহার। তারা আইসক্রীম খেতে চেয়েছে- ফরিদ দুগাড়ি আইসক্রম এনে বলেছে, খাও যত খাবে। আইসক্রিীম খাওয়া চলছে। খানিকটা মুখে দিয়েই— থু করে ফেলে দিতে আরেকটি হাতে নিচ্ছে। সারা মেঝেতে আইসক্রিমের স্তূপ। ঠাণ্ডায় দুজনেরই মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খাওয়া বন্ধ হচ্ছে না।
পুতুল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল। তার কেন জানি এই দৃশ্য দেখতে বড় ভাল লাগছে। গভীর আনন্দবোধ হচ্ছে। কে জানে কি এই আনন্দের উৎস। তার নিউ মার্কেটে যাবার কথা ছিল তা না গিয়ে সে দোতলায় আনিসের ঘরে চলে গেল। আনিস মাথা নিচু করে একমনে কি যেন লিখছিল। মাথা না তুলেই বলল, ভেতরে এসো পুতুল।
পুতুল ঘরে ঢুকল। বসল খাটের এক প্রান্তে।
কেমন আছ?
ভাল।
এমদাদ সাহেব এসেছিলেন, বললেন তোমার না-কি বিয়ে।
পুতুল কিছু বলল না। আনিস বলল, খবরটার মধ্যে একটা কিন্তু আছে বলে আমার ধারণা। আমি দূর থেকে যতদূর দেখেছি আমার মনে হয়েছে ডাক্তার এবং মিলির বিয়েটাই অবশ্যম্ভাবী। মাঝখান থেকে তুমি কি করে এলে বলতো?
আমি আসি নাই।
তাই না-কি?
আনিস লেখা বন্ধ করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। মাথা নিচু করে বসে থাকা গ্ৰাম্য বালিকাটিকে আজ কেন জানি আর গ্ৰাম্য বালিকা বলে মনে হচ্ছে না।
পুতুল।
জি।
এসো চ খেতে খেতে দুজন খানিকক্ষণ গল্পগুজব করি।
পুতুল সঙ্গে চা বানাতে বসল। আনিস চেয়ারে বসে তাকিয়ে আছে পুতুলের দিকে। সে চায়ের পানি গরম করছে। কেরোসিন কুকারের লালচে আভা এসে পড়েছে তার মুখে। সুন্দর লাগছে দেখতে। একটা মানুষকেই একেক পরিবেশে একেক রকম লাগে।
পুতুল, তুমি কি টগর এবং নিশার কাণ্ড দেখেছ? দুজন দুগাড়ি আইসক্রীম নিয়ে বসেছে।
পুতুল কিছু বলল না। মনে হল সে অন্য কিছু ভাবছে। জটিল কিছু যার সঙ্গে টগর নিশার তুচ্ছ কর্মকাণ্ডের কোন মিল নেই। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে সে গভীর সমুদ্রে পড়েছে।
কিছু ভাবছ পুতুল?
জি।
নিজের ভাবনার কথা কাউকে বলা ঠিক না। তবে তুমি যদি আমাকে বলতে চাও তাহলে বলতে পার।
বলতে চাই। আপনাকে অনেকদিন বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারি নাই। আজ বলব।
হঠাৎ করে আজ কেন?
পুতুল এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চায়ের কাপ আনিসের সামনে রাখতে রাখতে প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে চাই। এই কথাটা আমি অনেকদিন বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারি নাই। আজ বললাম। বলে যদি কোন অপরাধ করে থাকি ক্ষমা করবেন।
পুতুল কিছুক্ষণ সরাসরি আনিসের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। আনিস স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তাকে এই জাতীয় সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তা সে কখনো কল্পনাও করেনি।
আজকের সকালটা লেখালেখির জন্যে চমৎকার ছিল। বাচ্চারা পাশে নেই, কেউ হৈচৈ করছে না। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। বাতাসেও ফুলের মিষ্টি সৌরভ। সম্পূর্ণ অন্য রকম এটা সকাল অথচ সকালটা এক মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেছে।
আনিস ভেবে পেল না কি করা উচিত। সে কি চুপ করে থাকবে? না-কি পুতুলকে ডেকে বুঝিয়ে বলবে? মনে হচ্ছে বুঝিয়ে বলাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। কিন্তু কি বলবে সে পুতুলকে? অন্ধ আবেগ কোন যুক্তি মানে না। চুপ করে থাকাই বোধ হয়। ভাল। বাচ্চা একটি মেয়ে তার প্রতি এ জাতীয় আবেগ লালন করছে তা বুঝতে তার এত সময় লাগল কেন? অনেক আগেই তো ব্যাপারটা তা চোখে পড়া উচিত ছিল। সেও কি অন্ধ?
আনিস কি ঘরে আছ?
আনিস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফরিদ মামা ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে কেমন যেন বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে, যেন জীবনের ভীত নড়ে গেছে। সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে।
ফরিদ নিষ্প্রাণ গলায় বলল।
আশা করি আমার সাম্প্রতিক উত্থানের সংবাদ শুনেছ।
জ্বি শুনেছি।
এই উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নানান ধরনের পরিবর্তন আমার মধ্যে হয়েছে। প্রথম পরিবর্তন কথাবার্তায় প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার করছি। কেন করছি সেটাও একটা রহস্য। দ্বিতীয় পরিবর্তন রাতে ঘুম হচ্ছে না।
ঘুম হচ্ছে না কেন?
জানি না কেন। নিঘুম রাত পার করছি। গত রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমালাম তাও ভাল ঘুম হল না। মাঝরাতে স্বপ্নে দেখি আমার ওপর দিয়ে বালু বোঝাই এক ট্রাক চলে গেছে। বাকি রাত আর ঘুম হল না।
আপনার মনোজগতে সাময়িক পরিবর্তন হয়েছে। এই তারই প্রভাব। খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাবে বলে আমার ধারণা।
মোটেই কাটবে না। আমি খুব দ্রুত এই টাকার হাত থেকে মুক্তি পেতে চাই। তুমি চিন্তা ভাবনা করে একটা ব্যবস্থা কর যাতে এই টাকাটা কাজে লাগে। আমি আগে যেমন দুলাভাইয়ের ঘাড়ে বসে কাটিয়েছি, ভবিষ্যতেও কারো না কারোর ঘাড়ে বসেই কাটিয়ে দেব।
মিলি আছে বিলুও আছে। ওরা আমাকে পছন্দ করে। আমাকে ফেলবে না।
আপনি মানুষটা খুব অদ্ভুত মামা।
মোটেই অদ্ভুত না। আমি একজন অপদার্থ। অপদাৰ্থ নাম্বার ওয়ান। তবে তার জন্যে আমার মনে কোন খেদ নেই। আমি একজন সুখী মানুষ। সুখী মানুষ হিসেবেই আমি মরতে চাই।
আপনারতো মামা অনেক রকম পরিকল্পনা ছিল, সেই সব পরিকল্পনা কাজে লাগান। ছবি বানান, ক্ষুধা নিয়ে ছবি বানাতে চাচ্ছিলেন, মাছ নিয়ে ছবি বানাতে চাচ্ছিলেন। সেই সুযোগ তো এখন আছে।
ফরিদ মরা গলায় বলল, আরে দূর দূর। এইসব করতে প্রতিভা লাগে। আমার কোন প্ৰতিভা নেই। টাকাটা পাওয়ার পর এই ব্যাপারটা টের পেলাম তার আগে টের পাইনি।
চা খাবেন মামা?
চা দিলে খাব কিন্তু চায়ে কোন স্বাদ পাব না। জগৎটা আমার কাছে বিস্বাদ হয়ে গেছে আনিস। The winter of discontent.
ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বোঝা যাচ্ছে তার এই মানসিক যন্ত্রণা কোন মেকি যন্ত্রণা নয়। আনিস অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে এই অদ্ভুত মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল।
পুতুলকে বাইরে থেকে খুব স্বাভাবিক দেখালেও সে যে গত দুদিন ধরে ক্ৰমাগত কাঁদছে তা এমদাদ খোন্দকার বুঝতে পারছে কিন্তু রহস্যটা ধরতে পারছে না। তার প্রথম ধারণা হয়েছিল ব্যাটা ডাক্তার বোধ হয় ঐ দিন বেড়াতে নিয়ে আজে বাজে কিছু বলেছে। পুতুলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে সে কিছুই বলেনি। অবশ্যি বিয়ের কথাবার্তা ঠিকঠাক হলে মেয়েরা কাঁদতে শুরু করে। এটা সে ধরনের কান্নাও হতে পারে। তা যদি হয় তাহলে অবশ্যি ভয়ের কিছু নেই। বরং আনন্দের কথা। পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হবার জন্যে পুতুলকে আড়ালে নিয়ে গেল।
তুই কি জন্যে কাঁদছিসরে পুতুল?
পুতুল চুপ করে রইল।
ডাক্তার কিছু বলেছে?
না।
ডাক্তারকে কি তোর পছন্দ না?
আমার মত মেয়ের আবার পছন্দ অপছন্দ কি? তুমি যেখানে বিয়ে দিবা সেইখানে বিয়া হইব।
এতক্ষণে একটা ভাল কথা বললি। মনে শান্তি পাইলাম।
মনে অশান্তি পাইবা এমন একটা কথা তোমারে এখন বলব দাদাজান।
কি কথা?
ডাক্তার মিলি আপাকে বিয়ে করবে। তুমি এত বুদ্ধিমান, এই সহজ জিনিসটা তুমি বোঝা না?
আমারেতো বলল অন্য কথা।
বিপদে পড়ে বলেছে। তোমার হাতে থেকে বাঁচার জন্য বলেছে।
ও আচ্ছা।
খোন্দকার হতভম্ব হয়ে পড়েছে। তার হতভম্ব ভাব কিছুতেই কাটছে না। কি বলে এই মেয়ে?
তুমি বড় বোকা দাদাজান। তুমি বড়ই বোকা।
পুতুল তার দাদাজানকে বারান্দায় রেখে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে সে এখন কিছুক্ষণ কাঁদবে। পানির কল ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। যাতে কেউ কান্না শব্দ শুনতে না পায়। তার কষ্ট জানবে শুধু বহমান জলধারা। তাই ভাল। তার দুঃখ জলে চাপা থাক।
পর্ব ২৬ শেষ 📌
🔴পর্ব :২৭🔴
সোবাহান সাহেব ঘুমুবার আয়োজন করছিলেন। এই সময় মিলি এসে কিছুক্ষণ বাবার সঙ্গে হালকা গল্প গুজব করে। গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। পিঠ চুলকে দেয়। আজো সে এসেছে। তাবে আজ তার মুখ পাথরের মত। বসেছে চেয়ারে। তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। মনে হচ্ছে কঠিন কিছু বলবে। সোবাহান সাহেব তরল গলায় বললেন, কেমন আছিসরে মা?
ভাল আছি। বাবা।
কিছু বলবি?
হ্যাঁ।
বলে ফেল।
মিলি এবার বাবার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় বলায়, আমি একজনকে বিয়ে করে ফেলব বলে মন ঠিক করে ফেলেছি। বাবা। আমার সব কথা আমি সবার আগে তোমাকে বলি। আজও বললাম। সোবাহান সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন,
ব্যাপারটা কি বলতো?
আমি কষ্ট পাচ্ছি। বাবা। আর সহ্য কতে পারছি না।
সোবাহান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আমি তোমার চিন্তায়, কাজে-কর্মে কখনো বাধা দেই না। এখনো দেব না। যদি তোমার কোন ছেলেকে সত্যি সত্যি পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই বিয়ে করবে। ছেলেটা কে?
ছেলে নিচে বসে আছে।
ও আচ্ছা।
এখানে নিয়ে আসব?
তার দরকার দেখি না।
তাহলে তুমি পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে নিচে আস।
তোর হল কি মা বলতো? তুইতো এ রকম ছিলি না।
মিলির চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে চোখের পানি সামলে বলল, ছেলেটা সব কিছু জট পাকিয়ে ফেলে বাবা। ভাবে একটা করে আরেকটা। নিজে কষ্ট পায় অন্যকে কষ্ট দেয়। কাজেই আমার মনে হয় বিয়েটা অতি দ্রুত হওয়া দরকার।
হবে, দ্রুতই হবে।
আজ রাতে হলেই ভাল হয় বাবা।
তুই কি বলছিস মা?
মিলির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সোবাহান সাহেব উঠে এসে মেয়ের হাতে হাত রাখলেন। জ্বরে মিলির গা পুরে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে কিভাবে কে জানে। স্বাভাবিকভাইে যে কথা বলছে তা ভাবাও ঠিক না। কথা বলার ভঙ্গি এবং বিষয়বস্তু দুই-ই অস্বাভাবিক। সোবাহান সাহেব মেয়ের হাত ধরে নিচে নেমে এলেন।
ডাক্তার সোফায় বসে আছে। বাড়ির সব সদস্যই উপস্থিত। শুধু তাই না একজন কাজি সাহেবও আছেন। যে কোন কারণেই হোক কাজি সাহেবকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।
সোবাহান সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। এত আয়োজন কখন হল, কি ভাবে হল, কেনইবা হল? তিনি কেন কিছু জানেন না?
মনসুর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, স্যারের শরীর কেমন?
ভাল।
ব্যাপার কি মনসুর?
বিয়ে হচ্ছে স্যার।
তা তো দেখছি। রহস্যটা কি?
মিনু শান্ত গলায় বললেন, তোমাকে রহস্য জানতে হবে না। তুমি চুপ করে বস।
মিনু রহস্য ভাঙ্গাতে চান না। অতি দ্রুত পুরো ব্যাপারটা ঘটার মূলে তাঁর হাত আছে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তিনি কি কারণে মিলির ঘরে গেছেন। দরজা খোলা, ঘর অন্ধকার, মিলি নেই। তিনি ঘরে ঢুকে বাতি জুলালেন। মিলি টেবিলে মুখ বন্ধ করা খাম। খামের উপরে লেখা, বাবা ও মাকে।
তিনি খাম খুলে আঁৎকে উঠলেন। গোটা গোটা হরফে লেখা- মা আমি কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। বেঁচে থাকা আমার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। তোমরা আমাকে বিদায় দাও।
অন্য কোন সুন্দর ভুবনে তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। চিঠি পড়ে তাঁর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
মিনু খোঁজ নিয়ে জানলেন কিছুক্ষণ আগে মিলি ডাক্তারখানায় গেছে মাথা ব্যথার ওষুধ কিনতে। তিনি তৎক্ষণাৎ ডাক্তারখানায় ছুটে গেলেন। ফিরলেন ডাক্তারকে সঙ্গে করে। কাদেরকে পাঠিয়ে মগবাজারের কাজি সাহেবকে আনলেন। সোবাহান সাহেবকে জানানো হল সবার পরে কারণ তার ধারণা ছিল— সোবাহান সাহেব বেঁকে বসবেন।
কাজি সাহেব বললেন, দেন মোহরানা কত ধার্য হল?
মনসুর হড়বড় করে বলল, যা ইচ্ছা ধাৰ্য করেন। শুধু আমাকে একটা মিনিট সময় দিন। আমি যাব। আর আসব। আমার একটা নতুন পাঞ্জাবী আছে— রাজশাহী সিল্ক। ঐটা গায়ে দিয়ে আসি। আমি যাব। আর আসব।
কারোর অনুমতির অপেক্ষা না করেই মনসুর উল্কার বেগে বের হয়ে গেল। রাস্তা পার হবার সময় দুজন পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে নিজে চলন্ত রিকশার সামনে পড়ে গেল। তার জ্ঞান হল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। চোখ মেলে তাকানো মাত্র সে শুনল ফরিদের গলা— মিলি, গাধাটার জ্ঞান ফিরেছে মনে হয়, কষে একটা চড় দে তো!
মনসুর তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলল। অজ্ঞান হবার ভান করাই ভাল। মিলি পাশেই আছে। এই আনন্দই যথেষ্ট। শারীরিক কোন কষ্টকেই এখন আর কষ্ট মনে হচ্ছে না। তবে বা হাত ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছে। কম্পাউন্ড ফেকচার কি-না কে জানে। হোক যা ইচ্ছা-মিলি পাশে। দুটা হাত ভেঙে গেলেও ক্ষতি নেই। এতে বরং মিলির সহানুভূতি বেশি পাওয়া যাবে।
রাত দুটার দিকে হাসপাতাল থেকে মনসুর ভাল আছে খবর পাবার পর সোবাহান সাহেব ঘুমুতে গেলেন। মিনু ঘুমুতে গেলেন না। তিনি জেগে রইলেন। এতবড় একটা সমস্যাতেও তাঁকে খুব একটা বিচলিত মনে হল না। সোবাহান সাহেব মৃদু স্বরে ডাকলেন, মিনু তোমাকে একটা কথা বলি, রাগ করো না।
বল।
মিলি যেমন নিজের বর নিজে পছন্দ করেছে বিলু কি তাই করবে? তোমার কি মনে হয়?
মিনু জবাব দিলেন না। সোবাহান সাহেব বললেন, আমার মনে হয় না। বিলু সে রকম মেয়ে না। এই মেয়টাকে আমি আমার পছন্দের একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। আমার ধারণা আমি বললেই সে রাজি হবে।
ছেলেটা কে?
ছেলেটা হল আনিস। বুঝতে পারছি আমার কথা শুনেই তুমি চমকে উঠছ। চমকে উঠারই কথা। বিপত্নীক এটা ছেলে। বয়স বেশি– দুটা বাচ্চা আছে। তবু— মানে… অর্থাৎ ছেলেটাকে আমার খুবই পছন্দ।
মিনি চুপ করে রইলেন। তাঁকে খুব বিচলিত মনে হল না। সোবাহান সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে বিলুকে চিঠিতে আমার মতামতটা জানাই।
মিনি সহজ গলায় বললেন, তোমার মতামত জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। বিলু আনিসকে বিয়ে করে বসে আছে।
সে কি?
ভয়ে কাউকে জানায় নি। আমি আজই জানলাম।
আজই জানলে?
হ্যাঁ।
কার কাছ থেকে জানলে?
বিলুর কাছ থেকে।
বিলু এসেছে না-কি?
হুঁ! তোমরা সবাই যখন হাসপাতলে তখন এসেছে। ভয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করছে না।
যাও ডেকে নিয়ে আসে।
ও আনিসের ঘরে আছে। এখন ডাকা ঠিক হবে না।
হুঁ! সেটাও কথা।
বাতি কি নিভিয়ে দেব? ঘুমুবে?
বারান্দায় গিয়ে খানিকক্ষণ বসি। মিনু আজ কি পূর্ণিমা?
জানি না।
মনে হচ্ছে পূর্ণিমা।
সোবাহান সাহেব বারান্দায় এসে দেখলেন— সত্যি পূর্ণিমা। তিনি মনে মনে বললেন, এমন চাঁদের আলো। মারি যদি সেও ভাল। সে মরণও স্বৰ্গ সমান। অনেকদিন আগে পড়া এই লাইন দুটি কেন যে তার মনে এল কে জানে।
চলবে। 📌