সুগন্ধি ফুল পর্ব-০১

0
4

#সুগন্ধি_ফুল
#সূচনা_পর্ব
#জান্নাত_সুলতানা

বিয়ের তিন বছর পর ফিজার স্বামী আবরাজ খান দেশে ফিরছে আজ। বিয়ের দিন রাতেই পুরুষ টা জার্মানি চলে গিয়েছিল। ফিজার পুরুষ টাকে এক পলক দেখার ভাগ্য হলেও একবার কথা বলার ভাগ্য হয় নি।
তাদের বিয়ে টা পারিবারিক ভাবে হয়েছিলো। ফিজার মা আবরাজ এর বাবা-র কোম্পানিতে জব করতেন। সেখান থেকে তাদের পরিচয় আবরাজ এর বাবা-র সাথে। ফিজা কে তিনি খুব ভালো করে চিনতেন। আর তিনিই প্রথম নিজের বড় ছেলে আবরাজ খান এর জন্য ফিজার মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
ফিজা তখন সবেমাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ছাত্রী ছিলো। সে মোটেও ওই সময় বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। তবুও বাবা নেই। ছোট বোন আর মা কে নিয়ে তার পরিবার। মায়ের বয়স হয়েছে ঘরে দুই দুই জন যুবতী মেয়ে। তার বিয়ে হলে আবার ছোট বোন কেও বিয়ে দিতে হবে। নিজের ইচ্ছে না থাকা শর্তেও বিয়ের জন্য রাজি হতে হয়েছিলো।
প্রথম দেখায় আবরাজ খান নামক সুদর্শন পুরুষ টার উপর মুগ্ধ হয়েছিল ফিজা। চোখ আঁটকে গিয়েছিল পুরুষ টার সৌন্দর্যে। পুরুষ টার গায়ে ছিলো সাদা রঙের শার্ট। শার্ট এর উপরে কালো রঙের ব্লেজার। হাতে দামী একটা কালো ফিতার ঘড়ি। পায়ে কালো সু। চুল গুলো সিল্কি। কপালে ছুঁয়ে ছিলো। মুখে একটা দাড়ির বালাই নেই। একদম ক্লিন শেইভ করা। পুরুষ টার অধর জোড়া গোলাপি রঙের। যেদিন তাদের প্রথম দেখা হলো সেদিন সন্ধ্যায় ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয়ে ছিলো। কিন্তু কবুল বলে আবরাজ ফিজাদের বাড়ি ছেড়ে ছিলো। তারপর আর পুরুষ টাকে চোখের দেখা সে দেখতে পায় নি। এরপর ফিজা খান বাড়িতে এসেছিলো মিলন খান এর সাথে। সেই থেকে সে আবরাজ এর রুমে থাকছে। এখানে থেকে সে ভার্সিটি করতে। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। যদিও ফিজা এখন মাস্টার্স করছে।
ফিজা রুমে বসে এসব ভাবছে। কিছুক্ষণ পূর্বে তার ননদী মিষ্টি এসে বলে গিয়েছে আবরাজ আধঘন্টার মধ্যে বাড়ি এসে পৌঁছাবে। ফিজা যেনো নিচে উপস্থিত থাকে। ফিজার শরীর তখন থেকে কাঁপছে। অস্থির লাগছে। এখানে যাওয়া কি তার ঠিক হবে? বিয়ের দিন রাতে যে পুরুষ নিজের স্ত্রী কে ফেলে বিদেশ চলে গিয়েছে। মাঝে একবার খোঁজ নেই নি। সেই পুরুষ টার সামনে ফিজা কিভাবে বেহায়ার মতো গিয়ে দাঁড়াবে? শত ভাবনার পরেও ফিজা উত্তর খুঁজে পায় না। এরমধ্যে নিজের শাশুড়ী সার্ভেন্ট কে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে। ফিজা উঠে দাঁড়ালো। চুল গুলো হাত খোঁপা করে ওড়না মাথায় দিয়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে এলো। সময় টা সন্ধ্যা সাড়ে ছয় টা।
দোতলার একদম কর্নার আবরাজ নামক পুরুষ টার রুম। সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে বেশ লম্বা করিডর পাড়ি দিতে হয়। ফিজা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে সিঁড়ির কাছে চলে গেলো। সেখান থেকে লিভিং স্পষ্ট দেখা যায়। ফিজা সিঁড়িতে পা রাখার আগেই নজরে পড়লো নিচে মানুষের সমাগম। রোজকার কিছু পরিচিত মুখ ছাড়া-ও আরো তিন টা মুখ অপরিচিত। তবে একটা মুখ তিন বছর আগে একবার দেখার সৌভাগ্য তার হয়েছিলো। ফিজার বুক টা যেমন ধুকধুক করতে লাগলো। তেমন গলা টায় যেন হঠাৎ কান্না এসে দলাপাকিয়ে গেলো।
সুন্দরী এক রমণী আবরাজ এর এক বাহু জড়িয়ে ধরে আছে। নিচে যে এটা দেখে কারোর যে ভালো লাগছে না ব্যাপার টা সেটা তাদের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে।
ফিজা দ্বিধায় পড়লো। নিচে কি যাবে সে? আর এই মেয়ে টা কে? এমন করে আবরাজ হাত জড়িয়ে আছে ফিজার বুকে সুক্ষ্ম এক ব্যাথা হতে লাগলো। যতোই হউক পুরুষ টা তার স্বামী। তিন কবুল পড়ে একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিজের স্বামীর পাশে অন্য নারী। এটা কোনো স্ত্রী দেখে নিজে কে ভেতর থেকে স্বাভাবিক রাখতে পারবে না।
এরমধ্যে আবরাজ এর বাবা মিলন খান এদিকে তাকিয়ে ফিজা কে ডাকলো। ফিজা চমাকলো। সবার দৃষ্টি তখন ফিজার উপর। ফিজা অপ্রস্তুত হলো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নামলো। মিলন খান এগিয়ে এলো। ফিজা কে এক হাতে নিজের সাথে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মেয়ে টার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হেঁসে তিনি বলে উঠলো,

-“আমার বড় ছেলের স্ত্রী। ফিজা সিদ্দিকী পুষ্প।”

ফিজা তাকালো না মাথা তুলে। তবুও অনুমান করতে পারছে সামনে দাঁড়ানো সুন্দরী রমণী সহ দু’জন পুরুষই তার দিকে তাকিয়ে আছে।

-“হু। ফিজা খান পুষ্প। নট সিদ্দিকী।”

ফিজা চমকালো। রাশভারী কণ্ঠে এরূপ কথায় ত্বরিত মাথা তুলে সামনে তাকালো।
গম্ভীর পুরুষ টা শান্ত। তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। সে আগে যেমন ফিজার দিকে তাকিয়ে ছিলো তেমন তাকিয়ে আছে ফিজার দিকে।
ফিজার বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা অনল টা যেন মূহুর্তে নিবে গেলো। হৃদপিণ্ডটা দ্রুত উঠানামা করলেও বুকের ভেতর প্রশান্তি এলো।
কিছু না বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো। পেছন থেকে কয়েক জোড়া চোখ সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
এরমধ্যে একজন অবাক চোখে শুধু ফিজা কে দেখে গেলো। বিশ্বাস হচ্ছে না এই সেই রমণী যে তার ভাইয়ের বিয়ে করে ফেলে যাওয়া বউ। বুকের ভেতর মুচড় দিলো। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যাকে সে ভালোবেসে পাঁচ বছর আগে দেশ ছাড়ালো সেই রমণী তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী এবং তার একমাত্র ভাবি!

——-

সেই যে ফিজা রান্না ঘরে ঢুকেছে এরপর আর মেয়ে টা বেরুনোর নাম নেই। ইলা বেগম অনেক বলেকয়ে রুমে পাঠাতে পারলো না। খাবার খেতে বসেছে সবাই। ফিজা তখন রান্না ঘরে একজন সার্ভেন্ট এর সাথে কথা বলে জানতে পারলো সুন্দরী রমণী আবরাজ এর ফ্রেন্ড। নাম তার তৃণা। বাংলাদেশ ঘুরতে এসছে। চলে যাবে আবার। কিন্তু মেয়ে টার ব্যবহার দেখে ফিজার বেশ সন্দেহ হলো।
এদিকে ইলা বেগম ফিজা কে ডাকতে ডাকতে রান্না ঘরে চলে এলো। এসেই বলে উঠলো,

-“পুষ্প। খেতে আয় মা।”

ফিজার পেটে মুচড় দিলো। সে কিছুতেই এই পুরুষ টার সাথে বসে একই টেবিল খাবার খেতে পারবে না। গলা দিয়ে খাবার নামবে না। ফিজা কোনোরকম নিজে কে সামলে জবাব দিলো,

-“আম্মু আমি পরে খেয়ে নেবো। তোমরা খাও।”

ইলা বেগম মানলেন না। অনেক জোরাজুরি করতে লাগলো। ফিজা গ্যাসের প্রবলেম হচ্ছে বলে ঔষধ খেয়ে তারপর খাবার খাবে বলে আশ্বস্ত করলো। ইলা বেগম মানলেন। ঔষধ খেয়ে খেতে বলে নিজে চলে গেলো। ফিজা তপ্ত শ্বাস ফেলে রান্না ঘরের একটা টুলে বসে আপেল খেতে লাগলো।

——–

রাত প্রায় সাড়ে এগারো টা। সবাই যে যার মতো খাবার খেয়ে আড্ডা দিয়ে চলে গিয়েছে। বাড়ির কাজের লোকেরাও ঘুমতে চলে যাবে। ফিজা কে খাবার দিয়ে যেতে বললেও ফিজা নিষেধ করলো। নিজে খাবার নিয়ে খেয়ে নিবে বলে জানালো।
রান্না ঘর ফাঁকা হতে অনেক্ক্ষণ বসে রইলো ফিজা। এরপর প্লেটে খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে গেলো। ডাইনিং-এ লাইট অফ। রান্না ঘর থেকে লাইট এর আলো এসে খাবার টেবিলে অল্প আলোকিত করে রেখেছে। ফিজা দুই লুকমা ভাত মুখে দেওয়ার পরই নিজের উপর লম্বা ছায়া পড়েছে বুঝতে সক্ষম হলো।
হাত থেমে গেলো। চোখ জোরা ভীতু হলো। কে আসলে এই সময় মাথায় আসে না।
ফিজার ভয়ে অধর কাঁপছে। মনে সাহস সঞ্চয় করে তবুও কাঁপা কাঁপা অধর কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

-“কে?”

ফিজা প্রশ্ন টা করার সাথে সাথে ত্বরিত কেউ এসে ফিজার বা পাশে দাঁড়ালো। বেশ তড়িঘড়ি করে পুরুষ টা বলে উঠলো,

-“পুষ্প আমি। আব্রাহাম। তোমার মনে নেই আমরা এক সাথে স্কুলে পড়তাম।”

ফিজা এবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আব্রাহাম এর দিকে। সুদর্শন হয়েছে দেখতে বেশ। সে সন্ধ্যায় তো খেয়াল করে নি পুরুষ টাকে। ফিজা হাসার চেষ্টা করলো।

-“ভাবি লাগে। নেক্সট টাইম থেকে নাম নয় ভাবি বলবি।”

ফিজা নিজে কে ধাতস্থ করে প্রতিত্তোরে কিছু বলার আগে পেছন থেকে খুব পরিচিত আবার অপরিচিত একটা রাশভারি কণ্ঠ স্বর শুনে থেমে গেলো।
আচমকাই চোখ জোড়া তুলনামূলক ভাবে বড়ো আকৃতি ধারণ করলো।
কণ্ঠে পুরুষ টার স্পষ্ট অধিকারবোধ। ফিজা বাকহারা।
তবে অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,

-“আবরাজ!”

#চলবে……

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]