তুমি রবে নীরবে পর্ব-২৩+২৪

0
19
তুমি রবে নীরবে

#তুমি_রবে_নীরবে (২৩)
~নাদিয়া সাউদ

ভয়ানক রাগ নিয়ে রওনকের দিকে হেঁটে গেল কুহু। রিশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল! শাহিনূর মাহির রিনরিনে গলায় প্রশ্ন করল রওনককে বিয়ে কবে করছে সে? আচমকা চলন্ত পা দুটো থেমে গেল কুহুর। আড় চোখ কুহুকে খেয়াল করছিল রওনক। ভীষণ অসস্থি লাগছে রওনকের কাছে। শাহিনূর মাহি ম্যাম খুব গায়ে পরা স্বভাবের। এই কারণে কলেজে কানাঘুষা কম হচ্ছে না। সদ্য নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। সেভাবে কিছু বলাও যায় না। রুদ্ধশ্বাসে রওনকের উত্তর শোনার অপেক্ষায় কুহু! প্যান্টের পকেটে এক হাত পুরে নিয়ে জবাব দিল রওনক,

“যেদিন উপযুক্ত সময় মনে হবে সেদিন শুভ কাজটা সেরে ফেলব।

পাশ থেকে শিক্ষার্থীরা হইহই করে উঠল। কয়েকজন ছাত্রের হাতে কেক। বাকি সব শিক্ষককরা এগিয়ে আসলেন। পাশেই একদল মেয়ে শাহিনূর মাহিকে নিয়ে বলাবলি করছে, স্যারের জন্মদিন আর তাতেই শাড়ি পরে চলে এসেছেন নূর ম্যাম। যেন আজ উনাদের এনগেজমেন্ট! কি একটা অবস্থা! সামনে থাকা সবকিছু ঝাপসা দেখছে কুহু। রওনক ভাই তাকে স্বীকৃতি দিল না! ধুপধাপ এলোমেলো পা ফেলে বিশাল ভবনের ভেতর চলে গেল সে।বিষয়টা দৃষ্টিগোচর হলো না রওনকের। কুহুর রাগ,কষ্ট স্পষ্ট তার চোখে ধরা দিয়েছে। কুহু এখানে পড়বে বলেই ইচ্ছে করে বিয়ের ব্যাপারটা চেপে গেছে রওনক। সবমিলিয়ে তার কাছে মনে হয়েছে এটা বলা ঠিক হবে না। রিশা ছুটেছে পাঁচতলা ভবনে। শূন্য কক্ষে জানালার ধারে বেঞ্চিতে বসে আছে কুহু। চোখের জল গাল ভিজিয়ে থুতনি চুইয়ে পড়ছে। নাক টা রক্তিম হয়ে উঠেছে। বাম হাতের উল্টোপিঠে বারংবার মুছে যাচ্ছে সে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলো রিশা। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল,

” কাঁদছিস কেন কুহু?

রিশার কথা শুনে পাশ ফিরে তাকাল না কুহু। কোনোরকম উত্তর দিল না। কন্ঠনালী শক্ত হয়ে চেপে আছে। চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে। কুহুর মাথায় হাত রাখল রিশা। ঘাড় ঘুরিয়ে ভাঙ্গা স্বরে বলল কুহু,

“আমার সামনে সব জলের মতো পরিষ্কার রিশু! রওনক ভাই আমাকে মানতেই পারেনি। বরং এতদিন মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আশেপাশে সবাই কতরকম কথা বলছে নতুন ম্যাম আর তোর ভাইকে নিয়ে। তবুও তিনি নিজেকে অবিবাহিত বললেন। এর মানে কি বোঝায় বল?

” হ্যাঁ, শুনেছি আমি। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে তুই কান্না কেন করবি? তুইও তো মন থেকে মেনে নিতে পারিসনি বিয়েটাকে। এখন এই সম্পর্ক নিয়ে ভাইয়া যাই বলুক এতে কি আসে যায় বল?

ক্রুদ্ধ স্বরে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল কুহু,

“আসে যায় রিশু! আমার কষ্ট হচ্ছে। ওই কথাটা আমি মেনে নিতে পারছি না। এবং ওই শাহিনূর ম্যামকে আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি এখানে পড়বই না।

রিশা স্তব্ধ হয়ে কুহুর কথা শুনছিল। কুহুর চোখেমুখে জেলাসি! এটাই তো ভালবাসার লক্ষণ! নিজের মানুষটার প্রতি অধিকার খাটানো। সেটা জোড় গলায় বলতে পারা এসবই তো ভালবাসারই ইঙ্গিত বহন করে। রিশার ঠোঁটের কার্নিশে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে কুহুকে বসিয়ে দিয়ে বলল,

” হ্যাঁ বুঝলাম তোর কষ্ট হচ্ছে। আর এও বুঝলাম তুই আমার ভাইকে ভালবাসিস। যার জন্য সামান্য কারণে এত উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিস। সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছিস!

জানালা গলিয়ে দৃষ্টি বাইরে রেখে নাক টেনে বলল কুহু,

“ভালবাসি না তোর ভাইকে। তুই একদম আর উল্টাপাল্টা কিছু বোঝাবি না আমাকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল রিশা,

” ঠিক আছে বোঝাব না। ভাইয়া যা ইচ্ছে হয় বলুক শাহিনূর ম্যামকে তাতে তোর কি? ভাইয়াকে তুই হারিয়ে ফেললেই বা কি বল?

রিশার কথাগুলো ভাল লাগল না কুহুর। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। রওনক ভাই হারিয়ে যাবে বা অন্য কারো হয়ে যাবে কথাটা ভাবতেও পারছে না কুহু! সবকিছু অসহ্য আর বিরক্তিকর লাগছে।রিশা আনমনে বাইরে তাকিয়ে ভাবতে বসল, প্রিয় মানুষটাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখা খুব যন্ত্রণা দায়ক! অথচ তার খুশির জন্য নীরবে হাসিমুখে চলে আসতে হয়! দিনশেষে মন মানে? বরঞ প্রতিনিয়ত মন – মস্তিষ্কের সঙ্গে চলে যু-দ্ধ! কুহু খুব অনায়সে ভেতরে থাকা কষ্টটুকু প্রকাশ করে দিচ্ছে! অধিকার আছে বলেই! অথচ রিশা দিনের পর দিন কষ্ট চেপে ভেতরে ভেতরে জ্ব-লেপু-ড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে! কুহুর এই পাগলামো দেখে ভাল লাগছে রিশার। খুব শিঘ্রই হয়তো নিজের অনুভূতি টুকু প্রকাশ করবে কুহু। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কুহুর সমস্ত কথা শুনেছে রওনক। এসেছিল নির্বোধ মেয়েটাকে বোঝাতে। এখন মনে হচ্ছে উল্টো আরো জেলাসি বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই রওনকের কার্য হাসিল হতে বেশি সময় লাগবে না। দু-হাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় কুহু। রিশার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে,

“শাহিনূর ম্যাম কি আমার চেয়েও দেখতে সুন্দরী?

কুহুর কথায় বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলে তাকাল রিশা। মনে হচ্ছে সবদিকেই হিংসায় জর্জরিত হয়ে গেছে কুহু। থুতনিতে হাত রেখে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলল রিশা,

” উহুম! কোথায় শাহিনূর মাহি ম্যাম আর কোথায় তুই! আমাদের কলেজে কত ছেলেপেলে তোর পেছনে ঘুরেছে সে কথা কি ভুলে গেছি আমি?

“তোর ভাই তো বোঝে না। চোখের সামনে সুন্দরী মেয়ে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করলেও বাইরে এসে এসব মহিলাদের দিকে নজর দিবে। এটা আমার খারাপ লাগবে না বল?

” তুই এক কাজ করতে পারিস। সারাক্ষণ সেজেগুজে থাকবি। তাহলে দেখবি ভাইয়ার নজর এদিক-সেদিক যাবে না।

কুহু যেন ঘোর ভাবনায় পরলো।এই মুহূর্তে কিভাবে রওনক ভাইকে নিজের দিকে আকর্ষিত করবে সেটাই মাথায় ঘুরতে থাকল! ঈষৎ হেঁসে প্রস্থান করলো রওনক। আচমকাই মন ভীষণ ভাল হয়ে গেল তার। সম্ভব হলে এই মুহূর্তে শাহিনূর মাহি ম্যামকে বড়োসরো একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসতো। তার জন্যই কুহুর মনের কথাটা অনায়সে জানা হয়ে গেল। অথচ এই বিষয়টা নিয়ে সংশয়ে ছিল রওনক। আদৌ কুহুর মনে তার অস্তিত্ব আছে কিনা! বোকা মেয়ে নিজের অনুভূতিটুকুই বুঝতে পারে না সে কি করে অন্যের ভালবাসা উপলব্ধি করবে?


ক্লাস করানোর সময় বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে ছিল রওনক। কুহুকে যেন চিনেও না সে। অনেকদিন পর রুপসা,সোহা নয়ন আর আরিয়ানের সঙ্গে দেখা হলো কুহু,রিশার। ছুটির পর ক্যাম্পাসে আড্ডা হলো বন্ধুমহলের। সবার মনেই প্রশ্নরা দানা বেঁধে ছিল রওনক স্যার আর নূর ম্যামকে নিয়ে। রিশা উপস্থিত থাকায় কেউ কোনোরকম প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। রিশা বাড়ি চলে যেতে চাইলে কুহু জানাল একটুপর যাবে সে। অনেকদিন পর বেরিয়েছে তার উপর আজকে বেজায় মন খারাপ তার। খানিক্ষন পর রওনকেরও ছুটি। দু’জন একসঙ্গে যাবে ভেবে চলে গেল রিশা। এই গরমে বসে থাকতে ভাল লাগছে না তার। রিশা চলে যেতেই রওনকের টপিক নিয়ে কথা তুলল নয়ন।একে একে বাকিরা তাল মেলাল। নিশ্চুপ ছিল কুহু। সবার মুখে মুখে এসব শুনতে ভাল লাগছে না তার। চোখে আবারও জলেরা ভীর জমাতে চাইছে! মনে হচ্ছে এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে কান্না লুকিয়ে রাখা দুষ্কর হয়ে যাবে। চট করেই উঠে দাঁড়ায় কুহু। করিডোর পেরোনোর সময় কুহুকে ক্যাম্পাসে লক্ষ্য করেছে রওনক। ক্লাস চলাকালীনও বারবার বাইরে খেয়াল করছিল কুহুকে। আচমকা রিশাকে সঙ্গে না দেখে ভারী অবাকই হলো। ভাবনার মাঝেই দেখল আরিয়ানের পিঠে ধুপধাপ কিল বসাচ্ছে কুহু। খিলখিল করে হাসছে ছেলেটা। মুহূর্তে মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল রওনকের! রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। হাত ঘড়ি দেখে নিল সে। মিনিট পাঁচের মধ্যে পরবর্তী ক্লাসে যেতে হবে তাকে। চাইলেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না সে।

,

রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে রাতিম আর রিশা। রাস্তায় হঠাৎই দেখা লোকটার সঙ্গে। একই রাস্তা ধরে যাবে বলে নিজের রিকশায় ডেকে নিল রিশা। রাতিমের গোছানো কথাগুলো খুব ভাল লাগে তার। চমৎকার ব্যাক্তিত্বের পুরুষ। হাসিমুখে কতরকম কথা বলে যাচ্ছিল রাতিম।আড়াআড়িভাবে সূর্য রশ্মি পরেছে ফর্সা কপাল,গালে। মুহূর্তে জায়গাটা রক্তিম হয়ে উঠেছে। বিষয়টা দৃষ্টি এড়ায়নি রিশার। খানিকক্ষণ আগে মন প্রচন্ড খারাপ থাকলেও এখন অন্যরকম এক ভাল লাগা কাজ করছে। রাতিম ভাই ঠিকই বলেছেন,তিনি মন ভাল করে দেওয়ার স্পেশালিষ্ট! তার উপস্থিতি মষ্তিকে ডোপামিনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিষন্ন ভাব কেটে গেছে যেন। রাতিমের প্রতিটা কথা,বলার ভঙ্গিমা খুব নিখুঁত আর যৌক্তিক! আচমকা রিশার ওড়নায় তীব্র টান অনুভব হতেই ভাবনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসল সে।ততক্ষণে রিকশার চাকায় সম্পূর্ণ ওড়না পেচিয়ে গলায় টাইট হয়ে লেগে গেল রিশার।অত্যল্পকালে নিঃশ্বাস আঁটকে গেল তার। ভয়ানক আৎকে উঠলো রাতিম! দ্রুত গলায় থাকা ওড়নাটা ঢিলে করার প্রয়াসে টেনে ধরল!চিৎ-কার করতেই রিকশা থেমে গেছে অনেক্ক্ষণ আগেই।আশপাশ থেকে জনতার হই-চই শুরু হয়ে গেল। কোনোরকমে টেনে ওড়নাটা খুলে নিল রাতিম। গলার অনেকাংশে ছুঁ-লে গেল।চোখমুখ খিচে ঘনঘন দম ফেলল রিশা। গলা ব্যাথা হয়ে গেছে তার। রাতিম বারংবার পাগলের মতো জিগ্যেস করে যাচ্ছে রিশার কষ্ট হচ্ছে কিনা? হসপিটালে নিয়ে যাবে কিনা? জলে ভাসা চোখ নিয়ে বিচলিত,চিন্তিত রাতিমের মুখে তাকাল রিশা। এই ছেলেটা না থাকলে আজ সত্যিই ম-রে যেত সে! আশেপাশের ভীর কমে এসেছে। ওড়না প্রায় ছিঁড়ে গেছে অনেক জায়গায়। সেটা রাস্তায় পরে আছে অবহেলায়। রিশার কৃতজ্ঞ ভরা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গা থেকে নিজের শার্টটা খুলে দিল রাতিম। তার পরনে এই মুহূর্তে একটা সফেদ সেন্ডো গেঞ্জি। রিশা আশ্চর্যে কথা বলতে পারল না। রাতিম জানে রিশা পোশাকআশাকে যতেষ্ট ভদ্রতা বজায় রাখে। ওড়না দিয়ে গা সম্পূর্ণ ঢাকাই থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে সবাই তাকে দেখছে সেটা ভাল লাগছে না রাতিমের। নিশ্চুপ শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিল রিশা। থমথমে দৃষ্টি রাখল নিচে। পাশে একটা দশ,বারো বয়সী মেয়ে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। সবার মতো দাঁড়িয়ে সেও হয়তো দূর্ঘটনা দেখছিল। কি ভেবে যেন মেয়েটা এগিয়ে আসলো। মুক্তার মতো দাঁত নিয়ে হেঁসে বলল,

“আপনে ভাবীরে অনেক ভালবাসেন তাই না ভাইজান?

মেয়েটির মুখে এমন কিছু শুনবে ভাবেনি রাতিম। রিশা মাথা তুলে তাকাল অবাক দৃষ্টিতে! রাতিম অপ্রস্তুত হলো। ছোট্ট একটা হাসি ফিরিয়ে দিল মেয়েটিকে। হাতে থাকা গোলাপ থেকে একটা গোলাপ নিয়ে রাতিমকে দিয়ে বলল মেয়েটি,

” এইটা ভাবীরে দ্যান। ট্যাকা লাগব না।

রিশা এবার অসস্থিতে পরে গেল।রাতিম কিছু বলার পূর্বেই মেয়েটির হাত থেকে গোলাপ নিয়ে নিল রিশা। ব্যাপারটা কেন জানি অদ্ভুত ভাল লাগা ছুঁয়ে দিল রাতিমকে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে মেয়েটিকে একশো টাকার একটা নোট দিল সে। মেয়েটি নিতে নারাজ।রাতিম জানাল খুশি হয়েই দিয়েছে সে।পরক্ষণে টাকা নিয়ে চলে গেল মেয়েটা। রাতিমের অনুমতি পেয়ে রিকশা চালাতে আরম্ভ করলেন চালক। রিশাকে সহজ করতে বলল রাতিম,

“মেয়েটা খুব সুন্দর মনের। সে জন্যই হয়তো ফুল বিক্রিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে । প্রতিদিন কত মানুষের খুশির কারণ হয় মেয়েটা হয়তো নিজেও জানে না! অবশ্য কাউকে খুশি করতে পারলে তার মূল্য অর্থ দিয়ে বিচার করা যায় না। ফুল একটা জীবন্ত ভালবাসা। আর ভালবাসাও টাকা দিয়ে পরিমাপ হয় না। ভেবে দেখ মেয়েটা প্রতিনিয়ত খুশি,ভালবাসা বিক্রি করে চলেছে!

রাতিমের কথায় পদে পদে মুগ্ধ হয় রিশা। যার ভাবনা সুন্দর সে সত্যিই সুন্দর মনের মানুষ!


ঘড়িতে রাত এগারোটা। বাড়ি ফেরার পর কুহুর সঙ্গে কোনোরকম কথা বলেনি রওনক। আরিয়ানের সঙ্গে বাড়ি ফিরেছে মেয়েটা। অথচ রওনকের থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি! সন্ধ্যার পর মেয়েটার দেখা আর পায়নি রওনক। আজকে ঘটনা বোধহয় মনে দা-গ কে-টেছে ভালই! যাইহোক মান ভাঙ্গাবে না সে। অবুঝের মতো বসে থাকবে। এবার নির্বোধ মেয়েটা বুঝুক কতখানি ক-ষ্ট হয়।আচমকা রুমের লাইট বন্ধ হয়ে গেল। ভাবনার জাল ছিন্ন হলো রওনকের।তৎক্ষনাৎ বাইরে তাকাল সে। আশেপাশে প্রতিটি বিল্ডিংয়ে আলো জ্বলছে! বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই সামনে এক টুকরো পিঙ্গল আলো জ্বলে উঠল। তাতে কুহুর মোহনীয় রূপ ভেসে উঠলো! একহাতে সাদা রঙা মোমবাতি আর অপর হাতে কিছু একটা নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসলো কুহু। পরনে গাঢ় নীল রঙা শাড়ি! আশ্চর্যের মূক হয়ে গেল রওনক! সে কি ঘুমের ঘোরে নাকি এটা স্বপ্ন? নাকি কুহুর বেশে কোনো রূপবতী পরীর আগমন ঘটলো? বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে গেল রওনকের।চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল সে। মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে রওনকের সামনে ডান হাত তুলে ধরল কুহু। ছোট একটা চকলেট কাপকেক! সেদিকে দৃষ্টি পরতেই ভ্রু কুঁচকে আসলো রওনকের।এইটুকু কেক নিয়ে এসেছে কেন বোকা মেয়েটা?

“এই ছোট কেকটা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই!প্রথমত আমি আপনার উপর অভিমান করেছি, দ্বিতীয়ত আপনার জন্মদিন পালন করতেও ইচ্ছে করছিল। রাগের কারণে এই ছোট কেকটা নিয়ে এসেছি। আর আপনার মতো পুরুষের এটাই প্রাপ্য!

চলবে…..

#তুমি_রবে_নীরবে (২৪)
~নাদিয়া সাউদ

কুহুর কথায় আশ্চর্যে মূক হয়ে গেল রওনক! ততক্ষণে খাটের পাশ টেবিলে মোমবাতি রেখে পুনরায় রওনকের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল কুহু। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে রওনকের দিকে ছু্ঁ-ড়ি বাড়িয়ে ধরলো। ভ্রু উঁচিয়ে বলল রওনক,

“এইটুকু কেক কা-টতে আবার নাইফের প্রয়োজন আছে নাকি? তোমার মাথায় সমস্যা আছে বলে অন্যের মাথাও খারাপ হবে ভেবেছ?

রওনকের কথা মুহূর্তে রাগ ধরিয়ে দিল কুহুকে। সুন্দর মুহূর্তটুকু ঠিক বিগড়ে দিল লোকটা! সন্ধ্যা থেকে বসে বসে রোমান্টিক মুভি দেখে জন্মদিন পালনের এই আইডিয়াটা পেয়েছে সে।শুধু কাপ কেকের বুদ্ধিটা তার নিজের। ভেবেছিল রওনক ভাই খুশি হবে। উল্টো মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে! চোখমুখ শক্ত করে রওনকের বক্ষস্থলের ঠিক বাম পাশে ছুঁ-ড়ি ঠেকিয়ে ধরল কুহু। টিশার্ট ভেদ করে সুক্ষ্ম খোঁচা স্পষ্ট টের পাচ্ছিল রওনক। নিনির্মেষ দৃষ্টি ফেলে আবছা আলোয় কুহুর রাগী চোখেমুখে তাকিয়ে রইল সে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল কুহু,

” নাইফ এনেছি আপনার বুক চি-রে হৃদ-পিণ্ড বের করে ফেলব তাই। যেন অন্য কোনো মেয়ে আপনার হৃদয়ে না থাকে। তারপর চোখ দু’টোও খুঁ-চিয়ে তু-লে নিব। যেন পরনারীর দিকে তাকাতে না পারেন।

বাম হাতে ছুঁ-ড়িটা মুঠো করে ধরল রওনক। অপর হাত কুহুর কোমড়ের পেছনে রেখে টেনে নিল কাছে। হকচকিয়ে উঠলো কুহু! অপ্রতিভ হয়ে বারকয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো। ঘোর লাগা দৃষ্টি রওনকের। কুহুর কপালে পরে থাকা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,

“এত ক-ষ্ট করে মা-রবার তো কোনো প্রয়োজন নেই! এত আয়োজন করে সামনে এসে দাঁড়ালে তোমার রূপেই তো ঘায়েল হয়ে ম-রে যাব! নয়তো একবার বলে দেখ, ক-লিজা কেঁ-টে হাতে দিয়ে দিব।

রওনককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল কুহু। শক্ত পুরুষালি হাত তার উন্মুক্ত কটিদেশ স্পর্শ করতেই মৃদু কেঁ-পে উঠলো যেন। কিছু বলতে গিয়েও পারল না কুহু। জানালা গলিয়ে বাতাস আসছে সুরসুর করে।পর্দা দুলছে বেগতিক। যে কোনো সময় মোমবাতি নিভিয়ে দিবে দিবে ভাব। রওনকের হৃৎস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কুহু! কোনোরকম তুতলিয়ে বলল সে,

” কে…কেক কাটবেন না?

কুহুর হাত থেকে ছুঁ-ড়ি নিয়ে ফেলে দিল রওনক। অপর হাত থেকে কেক নিয়ে কা-মড় বসাল তাতে। বাকি কেকটুকু কুহুর মুখে পুরে দিল। বিস্ময়ে চোখ গোল গোল হয়ে গেল কুহুর! এঁটো কেকটা তাকে খাইয়ে দিল? কিছু বলতে গেলে ঠোঁটের মাঝে আঙ্গুল রেখে কথা থামিয়ে দিল রওনক।বাঁকা হেঁসে বলল,

” এত রাগের মাঝেও আমার জন্মদিনটা পালন করতে ভুলে যাওনি তুমি। এর মানে কি দাঁড়ায় নির্বোধ মেয়ে? একটু তো নিজেকে বুঝতে চেষ্টা করো। তাহলেই অন্যের অনুভূতি সহজে বুঝতে পারবে!

কথাটুকু বলেই কুহুকে কোলে তুলে নিল রওনক। জড়তা,সংকোচবোধ ক্রমেই ঝেকে ধরলো কুহুকে। এত কষ্ট করে সেজে আসলো,অথচ রওনক ভাই কোনো প্রসংশাই করলো না! ভাল করে দেখলো না পর্যন্ত! এই ছেলের মাথায় নির্ঘাত উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা ঘুরছে! খাটে এসে পেলব বিছানায় কুহুকে নামিয়ে দিল রওনক। আচমকা ধপ করে নিভে গেল মোমবাতিটা! ভয়ে কুহুর সর্বাঙ্গ কা-টা কা-টা করে তুলল! অন্ধকারে রওনকের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। কুহুর দিকে ঝুঁকে আছে সে। আঁটসাঁট করে বাঁধা খোপাটা হাত বাড়িয়ে খুলে দিল রওনক। মুহূর্তে পৃষ্ঠদেশ ছড়িয়ে গেল কালো মেঘের মতো কেশগুচ্ছ। চোখ বুজে ফেলল কুহু। রওনক ভাইয়ের সান্নিধ্যে তার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়িয়ে দিল! গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ পেতেই ভয়ানক চমকে উঠলো! চোখ মেলবার সাহস করে উঠতে পারলো না। শ্বাস আঁ-টকে রইল যেন। দ্রুত খাট থেকে পা নামিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো কুহু। আঁচলে টান পরতেই থমকে গেল। দুইহাত অনবরত দলাই-মলাই করতে লাগল। কোনোরকম জড়ানো স্বরে জানাল, রিশা তাকে ডেকেছে অনেক্ক্ষণ আগেই। আবছা আঁধারে মুচকি হাসলো রওনক। কুহুর পরিস্থিতি এই মুহূর্তে বুঝতে পারছে সে। তাকে এভাবে উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় অশান্ত করে দিয়ে তো পালাতে পারে না মেয়েটা! সহজে ছাড়বেও না রওনক। উঠে দাঁড়িয়ে কুহুকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। কুহুর গলা যেন শুকিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা! এই মুহূর্তে তৃষ্ণার্ত গলা একটুখানি জলের স্পর্শ না পেলে নির্ঘাত মা-রা পরবে সে। রওনকের ভারী নিশ্বাস আছড়ে পরছে কুহুর গ্রীবাদেশে। বরফের মতো জমে যাচ্ছে কুহু। একুশ বছরের জীবনে এত ভয়ানক অনুভূতির কবলে বোধহয় কখনো পরেনি সে। ঘাড়ের পেছন থেকে চুল সরিয়ে কানের পাশে ফিসফিস করে বলল রওনক,

“পুরুষ সকল যু-দ্ধ ক্ষেত্রে জয়ী হয়ে ফিরলেও, অনুভূতির যু-দ্ধ তাকে কাবু করে ফেলে সহজে! তোমার এত সাজসজ্জা সবই তো আমার জন্য! তাহলে কেন পালাতে চাইছ বোকা মেয়ে?

কুহু কোনো উত্তর দিতে পারলো না। সবকিছু তালগোল পাকাল তার। যেচে বাঘের গুহায় ধরা দিয়েছে সে। কুহুকে ফের কোলে তুলে নিল রওনক। জড়তা বুঝি এবার সম্পূর্ণ গলাধঃকরণ করে নিল কুহুকে। কুন্ঠায় পায়ের তলানি শিরশিরিয়ে উঠল। কুহুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গলায় ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিল রওনক। অত্যল্পকালে ভয়ানক কেঁপে উঠলো কুহু! কোনোরকম বলে উঠলো,

“নারীর রূপে পরাজিত হয় কাপুরষ! আপনি বীরপুরুষের মতো ভালবেসে ছুঁয়ে দিন! আমি বিনা দ্বিধায় সম্পূর্ণ উজার করে দিব নিজেকে!

কথাগুলো বলতে বলতে কুহুর গলা ধরে আসলো। আচমকা মাথা তুলে তাকাল রওনক। অন্ধকারে কুহুর মুখের অবস্থা ঠিক বুঝতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

” কি বলতে চাইছ?

এলোমেলো শাড়ি নিয়ে কোনোরকম উঠে বসল কুহু। নিজেকে জড়োসড়ো করে নিয়ে বাইরে দৃষ্টি রাখল। সত্যিই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। আজকের ঘটনাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। শাহিনূর মাহি ম্যামের সঙ্গে হেঁসে কথা বলছিল রওনক ভাই। তার উপহার সরুপ দেওয়া ঘড়িটা বাসায়ও নিয়ে এসেছে! এদিকে কুহু যে অভিমান করেছে সেটুকু বুঝতে পারেনি? মান ভাঙ্গিয়েছে? তাহলে কোন অধিকারে ছুঁয়ে দিচ্ছে? নারীর রূপই কি পুরুষের কাছে সব? ভাঙ্গা স্বর বলল কুহু,

” আমি সেজেছি সেটা কি খেয়াল করেছেন আপনি? শুরুতে এসেই বলেছি আমি অভিমান করেছি। কারণ জিগ্যেস করেছেন আপনি? উল্টো এঁটো কেক খাইয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছেন।

মহারানীর ভেতরে কি চলছে এতক্ষণে বুঝতে সক্ষম হলো রওনক। অভিমানের কারণটা তার জানা। কুহু তার জন্য এত সেজেগুজে আসায় ভীষণ ভাল লেগেছে। আগেপিছে ভাবনায় আর কিছু আসেনি।অবশ্য নতুন করে এই বোকা মেয়ের রূপের আর কি বর্ননা দিবে? বহু আগে থেকেই তো কুহু তার নজরবন্ধী! সত্যি বলতে আজকে শাহিনূর মাহি ম্যাম কি রঙের ড্রেস পরে এসেছে সেটাও খেয়ালে ছিল না রওনকের। সর্বক্ষণ আজ কুহুর চিন্তা ছিল মস্তিষ্ক জুড়ে! ভেবেছিল আজ বুঝি বাসায় র-ণ-ক্ষেত্র ঘটিয়ে দিবে মেয়েটা! অথচ পরিস্থিতি ভিন্ন দেখে একমুহূর্তের জন্য সব ভুলে বসে ছিল সে! কিয়ৎক্ষণ ভেবে বলল,

“ওহ আচ্ছা! তা কিসের জন্য রানী এলিজাবেথের অভিমান শুনি?

চোখমুখ শক্ত করে বলল কুহু,

” আজকে তো নীল শাড়িতে শাহিনূর ম্যামকে খুব সুন্দরী লাগছিল! অন্য কেউ নীল শাড়ি পরলেও চোখে পরে না।

“পরবে কি করে? রুমের লাইট তো শুরুতেই বন্ধ করে দিয়েছ তুমি। আমার চোখে কি দৈব শক্তি আছে যে অন্ধকারেও সব দেখতে পাব?

কুহুকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে কথাগুলো বলল রওনক। মেয়ে মানুষ হচ্ছে জগতের সবচেয়ে আশ্চর্য প্রাণী! এদের মনে কখন কি চলে বোঝা মুশকিল! একটু ভুল হলেই পুরুষ তুমি শেষ! এই মুহূর্তে রওনকের ঠিক এই অবস্থা! কুহু কোনো উত্তর দিল না। কাঁদছে নাকি বুঝতে পারলো না রওনক। উঠে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিল। চুপচাপ বসে আছে মেয়েটা। ফের কুহুর সামনে এসে বসে বলল রওনক,

” মানলাম আমি কাপুরষ তাই তোমার রূপে মজে গিয়েছিলাম। তুমি তো বীরনারী! ভালবেসে ছুঁয়ে দিতে পারো! আমি নিজেকে তোমার জন্য উজার করেই বসে আছি দেখ!

তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কুহু। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ফেলে বলল,

” নির্লজ্জ কোথাকার!

” ভালবাসার মাঝে নির্লজ্জ বলে কোনো শব্দ হয় না। এখন আবার এটা বলো না,তুমি আমাকে ভালবাস না। নয়তো শাহিনূর ম্যামকে নিয়ে এত রেগে যেতে না। আর আমার অনুভূতি নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলতে না।

আচমকা তেড়ে আসলো কুহু। দুহাতে রওনকের টিশার্ট আঁকড়ে ধরলো। দাঁত চিবিয়ে বলল,

” ভালবাসি না আপনার মতো বেহায়া পুরুষকে। আরেকবার যদি ওই শাহিনূর নামটা উচ্চারণ করতে শুনেছি,আপনার জিভ কেঁ-টে ফেলব।

চোখেমুখে কৃত্রিম ভয় টেনে বলল রওনক,

“না প্লিজ! আমি সারাক্ষণ শুধু কুহু,কুহু উচ্চারণ করব। বউ ছাড়া কিছু বুঝবই না! এত সুন্দরী বউ যার ঘরে আছে সে পুরুষ কেন বাইরে নজর দিবে বলো?

থতমত খেল কুহু। নিজের কথায় নিজেই ফেঁ-সে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। বারকয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে দৃষ্টি নিচু করলো সে। হাতের বাঁধন আলগা করতেই খপ করে হাত ধরে নিয়ে বলল রওনক,

” ছাড়ছো কেন? কাছে যখন এসেছ একটু নমনীয়ও তো হতে পার মেয়ে! কখনো কখনো রাগ,জেদ,হিংসার মানে অন্য কিছুও হয়।

কথাটুকু বলেই কুহুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো রওনক। শব্দ করে হাসলো খানিক। নির্বোধ মেয়ের অন্তর তো সে স্পর্শ করেই ফেলেছে! এখন মেয়েটার মুখ থেকে শোনবার পালা! ততদিন অনুভূতির সঙ্গে যু-দ্ধ করেই হয়তো দিন কাটাতে হবে রওনককে। কুহু নড়লো না। ঘাপটি মেরে রইল শক্তপোক্ত বক্ষস্থলে। রওনক খানিক অবাকই হলো। পাগ-লাটে বউকে কতখানি বশে আনতে পেরেছে কে জানে! আচমকা রওনকের হাতে দৃষ্টি পরতেই বিচলিত হয়ে উঠলো কুহু! বাম হাত কে-টে গিয়ে লম্বাটে গাঢ় লা-ল দাগ বসে আছে। র-ক্ত জমাট বেঁধে আছে! হাত নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল কুহু,

“হাতটা কা-টলো কি করে?

রওনকের অবাক দৃষ্টি কুহুর চিন্তিত মুখোপানে। মেয়েটার চোখেমুখে ভালবাসা প্রকাশ পাচ্ছে। নিনির্মেষ দৃষ্টি রেখেই বলল সে,

” তখন নিজের হৃ-দপিণ্ড র-ক্ষা করতে গিয়ে বোধহয় হাত কেটে ফেলেছি। যেভাবে বুকে ছু-ড়ি বসিয়ে দিয়েছিলে!

কুহুর চোখেমুখে অপরাধীর ছাপ পরলো। দ্রুত নেমে গেল সে ফাস্টএইড বক্স আনতে। রওনক বেশ মনোযোগ নিয়ে কুহুর কান্ড দেখছিল। বেখেয়ালি মেয়েটার যে শাড়ি গলিয়ে শুভ্র রঙা উদর বেরিয়ে আছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ আছে? মাথা খানিক ঝাঁকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল রওনক। কখন নেশা ধরে খেই হারিয়ে যায় ঠিক নেই! যেমনটা কিছুক্ষণ আগে ঘটেছিল। জগৎ ভুলে রূপবতীর মায়ার জালে ফেঁ-সে গিয়েছিল একদম। হাত কখন কেঁ-টেছে সেটুকু টের পর্যন্ত পায়নি! অথচ কেঁ-টেছে অনেকক্ষানি! এখন ঠিক জ্বা-লা করছে! কোমড়ে আঁচল গুঁজে রওনকের সামনে এসে বসল কুহু। তুলাতে স্যাভলন লাগিয়ে রওনকের হাত ড্রে-সিং করতে আরম্ভ করলো। এই মুহূর্তে খোলা চুলে খুব আদুরে লাগছে কুহুকে। নিবিষ্ট দৃষ্টি ফেলে দেখে যাচ্ছে রওনক। খুব করে ইচ্ছে করছে একটু ছুঁয়ে দিক শুভ্র ফুল! গম্ভীর ভরাট স্বরে বলল সে,

” আর কখনো শাড়ি পরে হুটহাট আমাকে এভাবে সারপ্রাইজ দিবে না। দেখবে হার্ট অ্যা-টাক হয়ে যাবে নয়তো তোমার চোখে নির্লজ্জ পুরুষ বনে যাব!

রওনকের কথা শুনে কেবল দৃষ্টি তুলে তাকাল কুহু। চোখ রাঙালো কিঞ্চিৎ! মৃদু হাসলো রওনক। সাদা গজ বের করে খুব যত্ন নিয়ে হাত বাঁধতে শুরু করলো কুহু। তপ্ত শ্বাস ফেলে গালে হাত রেখে তাকিয়ে রইল রওনক। অপর পাশের মানুষটার যত্নে, আচরণে যখন ভালবাসা প্রকাশ পায়,তখন অনুভূতি, মায়া আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়।


রাতিমের শার্ট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিশা। কালকে জোরপূর্বক ডাক্তারও দেখিয়েছে। আসার সময় ফোন নম্বরও দিয়ে গেছে। বলেছে সুযোগ পেলে শার্টটা ফিরিয়ে দিতে। কাল সারারাত একটা বিষয় ভেবেছে রিশা। তার প্রতি রাতিম ভাইয়ের যত্ন, খেয়াল অন্যরকম ছিল। তবে একটা বিষয় খুব খারাপ লাগছে রিশার। কালকে এতবার বলার শর্তেও বাড়িতে আসেনি রাতিম ভাই। নিজেকে কেমন অকৃতজ্ঞ মনে হয়েছে রিশার। এখন শার্টটা কেঁচে ফেরত দিবে কিনা এটা নিয়েও দোনোমোনো ভাব লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে একদম নতুন,ফ্রেশ চেইক শার্ট! কাঁচতে গেলে ভাজ নষ্ট হবে। খানিক্ষন পরেই ভার্সিটির জন্য বেরোবে রিশা। তারপর ফোন করেই না হয় রাতিম ভাইকে ফিরিয়ে দিবে শার্টটা। তপ্ত শ্বাস ফেলে শার্ট ভাজ করতে বসলো রিশা।

“রিশু! জানু! সর্বনাশ! তলে তলে এতকিছু? কার শার্ট এটা? প্রেমিক জোটালি কবে তুই? আর আমাকে বললি না? এটা অবিচার!

কুহুর একনাগাড়ে বলা কথাগুলো শুনে শার্ট রেখে হাত ভাজ করে দাঁড়াল রিশা। তাকে কিছু বলার তো সুযোগ দিবে! এগিয়ে এসে শার্ট হাতে তুলে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে বলল কুহু,

” বাহ খুব চমৎকার! ভাবী হয়ে গেছি বলে কি বান্ধবীর পদ থেকে নামিয়ে দিবি আমাকে?

“তুই চুপ করবি? না জেনেশুনে বকবক করেই যাচ্ছিস! আমার ব্যাপারটা তো তুই জানিসই! জীবনে একজন পুরুষকে মনে ধরেছিল আর সেটা আশফিক ভাই!

” তাহলে তুই ছেলেদের শার্ট কেন কিনতে গেলি? এটা একদম পরিস না রিশু! বিচ্ছিরি লাগবে তোকে।

কপাল চাপড়ে বলল রিশা,

“বলতে তো দে আমায়!

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কুহু। মাথা কাত করে সায় জানাল।তপ্ত শ্বাস ফেলে কালকের পুরো কাহিনি খুলে বলল রিশা। কুহু ভয় পেয়ে গেল শুনে। ভাগ্যিস কোনো অঘ-টন ঘটেনি! শেষে রিশার মুখে রাতিম নাম শুনতেই স্তব্ধ হয়ে গেল কুহু! ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

” রাতিম ভাই?

চলবে…..