#তুমি_রবে_নীরবে (৩৭)
~নাদিয়া সাউদ
কথাটুকু বলেই কুহুকে কোলে তুলে নিল রওনক। নেমে যাওয়ার জন্য হাত,পা ছোড়াছুড়ি করলো কুহু। খাটে এসে কুহুকে নামিয়ে দিয়ে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলো রওনক। কুহুর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। নিশ্চুপ হয়ে রইল। মাথা তুলে কুহুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রওনক। মাথা কাত করে অন্যপাশে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে কুহু। চোখদুটো জলে ভাসা মনে হচ্ছে। নাকের ডগা রক্তিম হয়ে উঠলো। যে কোনো সময় কেঁদে ফেলবে ভাব! মুচকি হাসলো রওনক। মাথা নুইয়ে কুহুর থুতনিতে চুমু খেল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল কুহু,
“আপনার এই আদিখ্যেতা ভালো লাগছে না আমার। আমাকে যখন আপনার পছন্দই নয় তাহলে সেদিন বিয়ে কেন করেছিলেন? এইসব আমার প্রতি আপনার দয়া আর সহানুভূতি নয় তো? আপ…..
কুহুর ঠোঁটের মাঝে আঙ্গুল রেখে কথা থামিয়ে দিল রওনক।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
” তো তোমার কি ধারণা? এই বোকামোর জন্য ভালোবেসে ফেলবো তোমাকে? এমন গর্দভ মেয়েকে কি ভালোবাসা যায়? তোমার বন্ধুরা তো ভাবছে আগে থেকেই কিছু চলছে আমাদের মাঝে। সেটাই ক্লিয়ার করে দিয়ে আসলাম।
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল কুহু। কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়লো। রওনক ভাই তাকে কথা থেকে বাঁচাতেই তবে ওই কথাটা বলেছেন? মুহূর্তে অপ্রতিভ হলো। বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে বলল, ফেশ হতে যাবে সে। রওনক ছাড়লো না। আরেকটুখানি শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আজ গোটা শহর আমাদের প্রেমের সাক্ষী হবে। যাও তৈরি হয়ে এসো। শাড়ি পরবে। বের হবো এখন। যতদূর চোখ যায় হাতে হাত রেখে হাঁটবো।
কুহু কিছু বলতে গিয়েও বলল না। হঠাৎই ইচ্ছে জেগে উঠলো তার। রওনক ভাইয়ের সঙ্গে এভাবে কখনো বের হওয়া হয়নি তার। চট করেই কেমন মন ভালো হয়ে গেল। হাতের বাঁধন আলগা করে দিল রওনক। উঠে চলে গেল কুহু।
◼️
শয্যারত বাবার দিকে তাকিয়ে আছে রাতিম। চোখদুটো তার জলে ভাসা। পাশে বসা মায়ের মলিন মুখশ্রী। বাবার লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে করাতে ঋণ গলা অবধি ছুঁয়েছে। দিনশেষে বাবার জীবিত মুখখানা দেখলে কোথাও একটা শান্তি কাজ করে। মুখে আঁচল গুঁজে চোখের পানি ফেলছেন পারভীন বেগম। ইচ্ছে ছিল সামর্থ্য মতো ধুমধামে একমাত্র ছেলের বিয়ে দিবে। তা আর হচ্ছে কোথায়? স্বামীর শেষ ইচ্ছে মতো কোনোভাবে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে সম্পন্ন করবেন। কেন যে এত করুণ দিন আসে! হাতে করে গরম গরম ভাতের ঝাউ নিয়ে আসলো রূপা। গায়ে সুতির মলিন একটা নীল রঙা শাড়ি। আঁচল গুঁজে রাখা কোমড়ে। ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসলো। পারভীন বেগম মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখছে কাজে মনোযোগী রূপাকে। মেয়েটা রাতদিন খেটে যাচ্ছে অসুস্থ মানুষটার জন্য। রাতিমের দিকে দৃষ্টি পরতেই তাড়া দিল রূপা। হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলল। খাবার সাজিয়ে এসেছে সে। তপ্ত শ্বাস ফেলে চলে গেল রাতিম। তীব্র মন খারাপ আজ ঘিরে রেখেছে তাঁকে। রিশার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করায় কলিজা ছি ড়ে যাচ্ছিল! করুণ, কান্নামাখা সেই মুখখানা ভেতর চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। রূপা দ্রুত ভেতরের রুমে চলে গেল রাতিমকে খাবার দিতে। খানিকক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে চলে আসলো রাতিম। ততক্ষণে খাবার বেড়ে নিয়েছে রূপা। নিঃশব্দে খাওয়া আরম্ভ করল রাতিম। পাশেই মেঝেতে হাঁটু তুলে বসে রইল রূপা। হলদেটে আলোয় রাতিমের মুখের জৌলুশ বেড়েছে যেন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বোধহয় একজন পুরুষের মায়াবী মুখ! সম্পূর্ণ খাবার শেষ করতে পারলো না রাতিম। গিলতে কষ্ট হলো। কন্ঠনালী চেপে আছে কেমন। উঠে চলে গেল সে। রূপা করুণ চোখে রাতিমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। বাবার দুশ্চিন্তায় নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে লোকটা। সম্ভব হলে সবকিছু ঠিক করে দিত রূপা।
,
সারারুম অন্ধকার করে শুয়ে আছে রিশা। খানিক্ষন আগে জোড় করে মা তাকে খাইয়ে দিয়ে গেছে। এখন কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে বালিশ ভেজাচ্ছে। ফোন বারকয়েক হাতে নিয়েও রেখে দিয়েছে। রাতিম ভাইকে নির্লজ্জের মতো আর ফোন করবে না। মানুষটা নিজের মুখে বলেই দিলো রিশার জন্য তার মনে কোনো ভালোবাসা নেই। তাহলে এত কেন কষ্ট হচ্ছে রিশার? দম বন্ধকর লাগছে। ফোনের টুংটাং শব্দে ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার। পাশ থেকে ফোন নিতেই দেখলো রাতিমের ফোন। বুক ধ্বক করে উঠলো মুহুর্তে! শোয়া থেকে তৎক্ষনাৎ উঠে বসলো সে৷ ফোন রিসিভ করে কানে জড়ালো। শরীর মৃদু কাঁপছে রিশার। ওপাশ থেকে বেশ গম্ভীর স্বর ভেসে আসলো।
“তুমি কি ঠিক আছ, আইরিশ? খেয়েছ রাতে?
” ঠিক নেই আমি। একটুও ঠিক নেই। সেটা আপনিও জানেন। জেনে-বুঝে কেন কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে?
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল রাতিম,
“রাস্তায় তোমার এমন করা উচিত হয়নি। তোমার প্রতি আমার কখনো অনুভূতি ছিল না, আইরিশ। তুমি অযথা কষ্ট পেয়ো না।
” ঠিকাছে মেনে নিলাম আপনার কোনো অনুভূতি নেই! কিন্তু আমার আছে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। বাসা থেকে বিয়ের কথা বলেছিল। আমি রাজি হইনি।
“কি পাগলামো করছো? বিয়েতে রাজি হয়ে যাও, যদিও আমার জন্য অনুভূতি থেকে থাকে তাহলে বলবো ভুলে যাও। পৃথিবীতে সবাই সবকিছু পেতে আসে না। তেমনি আমাকে তুমি পাবে না।
কথাটুকু বলেই লাইন কেটে দিল রাতিম। কন্ঠস্বর কাঁপছে তার। কান্না লুকিয়ে রাখা দায় হয়ে যাবে। রিশা হতভম্ব হয়ে বসে রইল। কোনো অনুভূতিই আর স্পর্শ করতে পারলো না তাকে। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রাতিম। নিয়তি মাঝেমধ্যে বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে যায়। রিশার প্রতি অনুভূতি নীরবেই রয়ে যাবে আজন্ম। হয়তো প্রকাশ করা হবে না কখনো।ভাগ্যে রিশার ভালোবাসাই ছিল, একত্রে সংসার করা নয়। নুপুরের শব্দ পেয়ে ভাবনার ঘোর কাটলো রাতিমের। রূপা এগিয়ে আসছে ধীর পায়ে। চোখেমুখে ঈষৎ হাসি। শাড়ির আঁচল ভাসছে বাতাসে। রাতিম দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। রূপার বিষয়টাও তার ভাবতে হবে। চাচা, চাচীর মৃত্যুর পর বাবা নিজেই রূপার দায়িত্ব নিয়েছে। ভিটেবাড়িই তাদের শেষ সম্বল। সেখান থেকে কিছুটা বিক্রি করে দিলে কেবল রূপার ভাগটাই থাকবে। সেটুকু রক্ষা করতেই বাবা, মায়ের ইচ্ছে রূপাকে বিয়ে করতে হবে রাতিমের। এই টানাপোড়েন জীবনে কি রিশাকে পাওয়ার স্পর্ধা দেখানো যায়? চাঁদ যে চাইলেই ছোঁয়া যায় না। জ্ব-লসে যাবে সব। রাতিমের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো রূপা। দৃষ্টি রাখলো চাঁদের পানে। রাতিম পাশ ফিরে তাকালো। দৃষ্টি আঁটকালো রূপার কাজল টানা চোখে। হলুদাভ মুখশ্রী চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে! এতসব রূপ কি রাতিমকে আকৃষ্ট করতে পারবে? মন যে অন্যত্র! বেশ অনেকটা নীরবতার পর বলল রূপা,
“এই মুহূর্তে আমার কি মনে হচ্ছে জানো রাতিম ভাই? তুমি যদি হলুদ পাঞ্জাবী পরতে তাহলে তুমি হতে হিমু আর আমি তোমার রূপা! দেখো নীল শাড়ি পরেই আছি আমি।
দূরে চাঁদের পানে দৃষ্টি রাখলো রাতিম। রূপার কথায় স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেয়েটা তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে দিয়েছে। রাতিম যে স্বাভাবিক হতে পারছে না।৷ থমথমে গলায় বলল,
” হিমুরা কেমন হয় জানিস তুই? আমি যদি সত্যিই হিমু হই মেনে নিবি তুই?
“না না! তুমি বরং বাস্তব জীবনের রূপার রাতিম হইয়ো। ঠিক তোমার মতো।
কথাটুকু বলতেই চোখমুখ খিঁচিয়ে নিল নিল রূপা। জিভ কামড়ে ধরলো। পরক্ষণে দ্রুত নেমে গেল। ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাতিম।
◼️
রাস্তায় দুপাশে সোডিয়াম আলো জ্বলছে। কুহুর হাতে ওয়ানটাইম কাপ চা। কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। পেছনে পকেটে হাত পুরে হাঁটছে রওনক। ওষ্ঠকোণে তার মৃদু হাসি। পাগলাটে মেয়ে আজ বাচ্চাদের মতো সব বায়না করেছে। কুহুর শাড়ির আঁচল পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে শাড়ির আঁচল কুঁড়িয়ে নিল রওনক। আঙ্গুলে পেচিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো কুহুর পাশাপাশি। কুহু বকবক করেই যাচ্ছে। কে বলবে এই মেয়েটার খানিক্ষন আগে রাগ ছিল? কুহুর খোঁপায় বেলি ফুলের মালা বাঁধা। যেটা কিছুক্ষণ আগে রওনক পরিয়ে দিয়েছে। মিষ্টি এক ঘ্রাণ ভেসে আসছে সেটা থেকে। সামনে রিকশা পেতেই ডাকলো রওনক। রাত ভালোই হয়েছে। এতটা সময় কখন পাড় হয় খেয়ালেই ছিল না! হাতের কাপটা ফেলে রিকশায় উঠে বসলো কুহু। পাশে বসলো রওনক। খানিকটা মাথা এলিয়ে দিল কুহুর কাঁধে। এই সুমিষ্ট ফুলের ঘ্রাণে নাক ডুবিয়ে দিল। অদ্ভুত এক মায়ার আবেশে জড়িয়ে গেল। কুহু আর কোনোরকম কথা বলল না। দৃষ্টি পাশ ঘুরিয়ে রাখলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ধরা দিল তার। রওনক ভাইকে পাওয়ার পর সবচেয়ে সুন্দরতম দিন ছিল আজ। উষ্ণ শ্বাস গন্ডস্থল ছুঁয়ে যাচ্ছিল কুহুর। অন্যরকম এক ভালো লাগা ছুঁয়ে দিচ্ছিল। চোখ বুজে প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে তাকালো কুহু। গুনগুন সুর তোলে গান গাইতে আরম্ভ করলো।
‘তোমার ইচ্ছেগুলো ইচ্ছে হলে আমায় দিতে পারো,
আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা তোমায় দিব আরো’
রওনক মাথা তুলে তাকালো। কুহুর হাতটা টেনে নিল নিজের হাতের মুঠোয়। দমকা একগুচ্ছ হাওয়া ছুঁয়ে দিলো কুহুর চোখেমুখে। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখাচোখি হলো। দৃষ্টি নিচু করলো কুহু। অপর হাত রাখলো রওনকের হাতের উপর।
◼️
মাস খানেক পাড় হলো। রাতিমের নাম্বার থেকে আর ফোন আসেনি। এই কয়টাদিন চাতকের মতো অপেক্ষা করে গিয়েছে রিশা। যে বারবার ফিরিয়ে দেয় তার দুয়ারে কতবার গিয়ে দাঁড়ানো যায়? বেলা মধ্যাহ্নে। জানালার পাশে বই নিয়ে বসে আছে রিশা। পড়াশোনা থেকে বেশ অনেকদিনই দূরে ছিল। এভাবে জীবন চলে না। কয়েকদিন পরেই সেমিস্টার পরীক্ষা। কষ্ট ভুলতে পুনরায় পড়াশোনায় মনোযোগী হলো রিশা। তার বিশ্বাস রাতিম ভাই চাকরি পেলে ঠিক আগের মতোই হয়ে যাবে। ভালো কিছু পেতে অবশ্যই দূরত্বের প্রয়োজন।
“কিরে পড়া হলো তোর? গোসল করেছিস? নাকি পড়ছিস এখনো? হয়েছিস তো ভাইয়ের মতোই। পড়া ছাড়া বুঝিস কিছু?
মায়ের কথায় ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার। ততক্ষণে মেয়ের রুম গোছাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন শারমিন বেগম। বই খাতা গুছিয়ে নিল রিশা। ওয়ারড্রব থেকে কাপড় বের করলো। মেয়ের দিকে এপলক তাকিয়ে নিয়ে বললেন শারমিন বেগম,
” আশফিক দেশে আসছে সামনের সপ্তাহে। তোর সঙ্গে আশফিকের বিয়ে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাকি কথা খাওয়ার সময় তোর বাবা বলবে। তাড়াতাড়ি গোসল করে খেতে আয়।
চলবে…….
#তুমি_রবে_নীরবে (৩৮)
~নাদিয়া সাউদ
মায়ের কথাটুকু শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল রিশা। আশফিক ভাইয়ের তো পছন্দের মানুষ আছে জেনিথ! রিশাকে কেন বিয়ে করতে চাইছে সে? নাকি মা আর খালামণির প্ল্যান এটা? শত ভাবনা রেখে ফোন খুঁজতে লাগলো রিশা। কয়েক মাস কেটে গেছে আশফিক ভাইয়ের আইডি তার দেখা হয় না। কোনোরকম ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে গিয়ে আশফিকের নাম সার্চ করতেই আইডি চলে আসলো। তবে লক করা। মুহূর্তেই হতাশ হয়ে গেল রিশা। মন বলছে কিছু তো একটা হয়েছে। যে ছেলের আইডিতে শতশত ফলোয়ার সে কেন হুট করে আইডি লক করে দিবে? সরাসরি আশফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা না হলে জানা যাবে না। একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। সবমিলিয়ে হাপিয়ে উঠেছে রিশা। পুরোনো দিনগুলো মনে পড়লেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। আশফিকের গুড লুকিং, পরিপাটি চলাফেরা মূলত রিশাকে আকৃষ্ট করতো। চোখের ভালো লাগা তো আর মনকে ছুঁতে পারে না। ভালোবাসা তো অতকিছু দেখে বা ভেবে হয় না। ছোট বেলায় পছন্দের খেলনা না পেলে যেমন মন খারাপ করতো, আশফিককে পাবেনা ভেবেও রিশার ঠিক তেমনটাই খারাপ লেগেছিল। কিন্তু ভালোবাসার বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন! রাতিম ভাইকে পাওয়ার পর যেটা উপলব্ধি করেছে রিশা। যাকে ছাড়া বেঁচে থাকা চিন্তা করা যায় না। ভাবনার মাঝেই কুহুর আগমন ঘটলো। রিশাকে কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈষৎ রাগ হলো কুহু। ঠেলেঠুলে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিল। রিশা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। দরজা আঁটকে দিল। আনন্দ কিছুক্ষণ ফাঁকা ঘরে নাচলো কুহু। পরক্ষণে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সেদিন আশফিককে ম্যাসেজ দিয়ে ভুল করেনি সে। বরং সবটা ঠিক করতে সক্ষম হয়েছে। রিশার ভালোবাসা সত্য, স্নিগ্ধ ছিল। তাইতো এত সহজে সব ঠিক হয়ে গেল। আশফিক আগে থেকেই জানতো রিশা তাকে পছন্দ করে, সেদিন কুহু ইচ্ছাকৃতই মিথ্যে ভালবাসে বলেছিল। ব্যাপারটা জানার পর খুব ভালো লাগছে কুহুর। অন্তত আশফিকের চোখে ছোট হয়ে রয়নি সে। রিশাকে বিয়ের কথা বলতে ভয় পাচ্ছিল আশফিক। জোড় গলায়ই তো জেনিথের কথা বলে গিয়েছিল। এখন কোন মুখে সামনে এসে দাঁড়াবে? কুহু তার সমস্ত সংশয় দূর করে দিয়েছে। রিশা এখনো আশফিকের আশায় আছে জানাতেই একপ্রকার ছুটে আসছে আশফিক৷ বাইরে থেকে রওনকের ডাক আসতেই বেরিয়ে গেল কুহু।
,
ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে সবাই। কুহু দাঁড়িয়ে এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে। জুলেখা কয়েকদিন ছুটিতে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে রিশা আসলো মলিন মুখে। রাশেদ জামাল খাওয়ায় মনোযোগী। এই প্রস্তাবে তাকে খুব একটা উৎফুল্ল মনে হলো না। বেশ হাসিমুখেই কথা বলে যাচ্ছেন শারমিন বেগম। তার বোনের ছেলের প্রশংসায় মাতিয়ে রেখেছেন টেবিল। কোনো ভাবান্তর হলো না রাশেদ জামালের। আত্নীয়ের মধ্যে আত্নীয়তা পছন্দ নয় তার। আশফিক খুব যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলে। তবে মেয়েকে বিয়ে পর কানাডায় চলে যেতে হবে ভাবলেই বাবার বুক ফাঁকা হয়ে আসে। আশফিকের বাবা, মা জানিয়েছে ছেলে দেশে আসার পর একসঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিবে সবাই। কবে নাগাদ বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করা যায়। রওনকের একটাই কথা রিশা যা বলবে তাই হবে। তবে খুব একটা যে তার পছন্দ এমন নয়। আশফিকের চলাফেরা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে তার। ফেইসবুকে প্রায়ই একটা মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবিতে দেখেছে। দেশে থাকাকালীন কলেজ জীবনে কতশত প্রেমই করেছে। খাবার নিয়ে অনেক্ক্ষণ যাবৎ নাড়াচাড়া করছে রিশা। মনে হচ্ছে এবারও তাকে নিজ থেকে রাতিম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। একটা মানুষ এতটা কঠোর কিভাবে হয়? তার কি সত্যিই মন নেই? নাকি রিশার জন্য তার অনুভূতিই ছিল না কখনো? থমথমে গলায় বলল রিশা,
“এই মুহূর্তে আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না বাবা। আগে পড়াশোনা শেষ হোক। তারপর ভেবে দেখবো।
মেয়ের এমন কথায় যেন খুশিই হলেন রাশেদ জামাল। রওনক জানাল এই নিয়ে রিশাকে যেন জোরজবরদস্তি করা না হয়। কুহু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এটা কি সত্যি রিশার কথা? লজ্জায়ই কি এমনটা বলছে? মেয়ের কথায় খানিক অবাকই হলেন শারমিন বেগম। বোন তো তাকে জানিয়েছেন রিশা আর আশফিক দুজন দু’জনকে পছন্দ করে আগে থেকেই! তবে এখন তো দেখা যাচ্ছে মেয়ে উল্টো সুর গাইছে। অর্ধেকটা খাবার রেখেই চলে গেল রিশা। মেয়েকে আর ডাকলেন না শারমিন বেগম।
◼️
পরীক্ষার আর হাতে গোনা কয়েকদিন বাকি। কুহুকে বাড়িতে থেকে ভালোভাবে প্রিপারেশন নিতে বলল রওনক। একগাদা বই সামনে খোলা পড়ে আছে। মুখ ফুলিয়ে খাটের মধ্যিখানে বসে আছে কুহু। কাল রাতে পড়তে পড়তে কখন চোখ লেগেছিল টের পায়নি। রওনক তৈরি হচ্ছে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। আয়নায় চোখ রেখে কুহুকে পর্যবেক্ষণ করছে। ঈষৎ হাসি ফুটে উঠলো তার ওষ্ঠকোণে। গম্ভীর ভরাট স্বরে বলল,
” কালকে রাতের মতোই ভোলানোর ইচ্ছে হচ্ছে নাকি? তুমি যে এতখানি দুষ্টু আগে বুঝিনি! ফাকিবাজ মেয়ে। এসে যেন দেখি সব পড়া কমপ্লিট!
কাল রাতের কথা মনে হতেই লজ্জায় দৃষ্টি নামালো কুহু। একটুও পড়ার ইচ্ছে ছিল না তখন। শাড়ি পরেও তো এই জল্লাদটার মন গলানো গেল না রাতে! সারাক্ষণ পড়া আর পড়া! এলোমেলো শাড়ি নিয়ে উঠে চলে গেল ওয়াশরুমে। তপ্ত শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল রওনক।
,
আড়মোড়া ভেঙ্গে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠলো রিশা। পরিস্থিতি দিনদিন আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার জন্য। আপাতত পরীক্ষার চিন্তা মাথায় রেখেছে। গতকাল আশফিক ভাই দেশে ফিরেছে। আজকে আসার কথা। রাতিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা না হওয়া পর্যন্ত আশফিককে কিছু বলাও সম্ভব নয় রিশার। সবমিলিয়ে এলোমেলো লাগছে সব। এদিকে কুহু বেশ আনন্দ নিয়েই আছে আশফিকের সঙ্গে বিয়ের কথা শোনার পর থেকে। সবকিছু খুলে না বলায় শান্তিও লাগছে না রিশার। মিথ্যে এক হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হচ্ছে সর্বক্ষণ।
,
বিকেল নাগাদ কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতে চলে গেল কুহু। আশফিকের অপেক্ষাতেই যেন ছিল এতক্ষণ যাবৎ। শাশুড়ির সঙ্গে আজ হাতে হাতে অনেক কিছুই রান্না করেছে। মনে মনে এই বাড়ির জামাই হিসেবেই ধরে নিয়েছে আশফিককে। কুহুর সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে, খালার খোজে ভেতরের রুমে চলে গেল আশফিক। বসার রুমেই বসে আছেন রাশেদ জামাল আর শারমিন বেগম। দুজনকে সালাম জানাল আশফিক। হাসিমুখে খোঁজখবর নিলেন রাশেদ জামাল। বারংবার এদিকসেদিক দৃষ্টি ফেলে রিশাকে খুঁজে যাচ্ছিল আশফিক। মেয়েটা কি তার আসার খবর পায়নি আজ? কিছু একটা বুঝতে পেরে আশফিককে নিয়ে ভেতরের রুমে চলে গেল কুহু। রুমে আসতেই দেখলো রিশা নেই। বিকেল দিকে সচরাচর ছাদেই থাকে মেয়েটা৷ আশফিককে ছাদে পাঠিয়ে দিয়ে টেবিলে খাবার গোছাতে চলে গেল কুহু।
মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। গাঢ় বেগুনি রঙা সুতির থ্রিপিস পরে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে রিশা। শুভ্র রঙা ওড়নাটা বাতাসে ভাসছে। আশফিক কিছু সময় মন দিয়ে তাকিয়ে দেখলো। অসম্ভব মায়াবী লাগছে! এতটা যত্ন নিয়ে ভালোলাগার দৃষ্টিতে কখনো দেখেছিল রিশ’কে? অজান্তেই মন ভালো হয়ে গেল তার। এই কদিন যাবৎ বিষাদে ডুবে ছিল। রিশ একদিন যত্ন নিয়ে সবটা কাটিয়ে দেবে এই বিশ্বাস আছে। ঠোঁটের কার্নিশে একটুখানি হাসি নিয়ে এগিয়ে গেল আশফিক। ডাকলো রিশাকে। ভাবনার অলীক জগত থেকে বেরিয়ে আসলো রিশা। চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে এসেছে তার। অন্য সময় হলে আশফিক ভাইয়ের আগমন তাকে খুশি আর আনন্দ দিত। অথচ আজকে কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। সময় বদলায়। পৃথিবীর নিয়ম মতোই চলতে হয় আমাদের৷ মাঝেমধ্যে মন শুধু আঁটকে দেয় কিছু কিছু পরিস্থিতির কাছে। হাত ভাজ করে নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো রিশা,
“সব ছেড়েছুড়ে আমার কাছে চলে এসেছেন আশফিক ভাই?আপনার এতদিনের প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ, স্মৃতি ওসব?
রিশার প্রশ্নে থতমত খেল আশফিক। তাচ্ছিল্যই শোনালো কেমন। অপ্রস্তুত হয়ে বারকয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে বলল,
” আমি সেচ্ছায় ছাড়িনি। জেনিথ চিট করেছে। আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য দেয়নি। একেবারে ভেঙ্গে দিয়েছে আমাকে৷ আসলে আমরা যখন ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলি তখন এভাবেই তার দাম পাই। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি রিশ। তুই আমাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসতিস এটাও জানি।
তাচ্ছিল্য হেসে বলল রিশা,
“তাহলে তো জানেনই দেখছি। আপনার কি ধারণা আমি এখনো বোকার মতো আপনার আশা নিয়ে বসে থাকবো? জেনিথ প্রতারণা করেছে বলেই আপনি ফিরে এসেছেন। হৃদয় ভেঙ্গে গেছে আপনার! তার দায়ভার এখন আমি কেন নিব? ভালবাসতাম বলে? আপনি কি সত্যিই আমায় মন থেকে ভালোবাসেন আশফিক ভাই?
নির্বাক হয়ে রিশার কথা শুনছে আশফিক। কথাগুলো অবশ্যই যৌক্তিক। এটা ভেবেই আসতে চায়নি সে। কুহু তাকে পুনরায় না বোঝালে কখনই আসতো না। খুব ভালো করেই জানতো এই কথাগুলো তাকে শুনতে হবে। শক্ত গলায় বলল,
” আমি তোকে কখনও সেভাবে দেখিনি রিশ। কিন্তু তোর মনে আমি ছিলাম। সেটা বুঝতে পারি অনেকটা পরে। ততদিনে জেনিথ আমার জীবনে চলে আসে। আমি তোকে কোনো দায়ভার দিতে চাচ্ছি না। ভাঙ্গা আমিটা একটু সুখের সন্ধানে এসেছে এতটুকুই! তুই রাজি না থাকলে জোড় করার সাধ্য আমার নেই। তোর মনে কি অন্যকেউ আছে?
আচমকাই ভেতর অস্থির হয়ে উঠলো রিশার। হাত ছেড়ে উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়াল সে। শিরশিরে বাতাসটা দম বন্ধ করে দিতে চাইলো। মাথায় জমলো ঘাম বিন্দু। অনিশ্চিত পরিস্থিতির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে কি করে রাতিম ভাইয়ের নামটা বলবে? বারংবার যে ফিরিয়েই দিয়েছে তাকে। কন্ঠনালী যেন চেপে ধরলো কেউ। ঢোক গিলতে কষ্ট হলো। উত্তরের অপেক্ষায় চাতকের মতো তাকিয়ে রইল আশফিক। চোখ বুজে ফেলল রিশা। দুফোঁটা জল গাল ভেজালো। ঠোঁট কাঁপলো তিরতির করে। কাঁপা স্বরে কোনোরকম বলল,
“না, কেউ নেই।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল আশফিক। তার প্রতি রিশার অভিমান জমেছে খুব করে বুঝতে পারলো। বাকি আর কথা বাড়ালো না। চলে গেল। রিশা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাতিমের উপর প্রচন্ড রাগ, ক্ষোভ জন্মালো। কেন কয়েকটাদিনের জন্য তার জীবনে এসে সব এলোমেলো করে দিল? নয়তো আজকের দিনটা খুব সুন্দরও হতো!
,
ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টায়। সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সময় কখন চলে গেল খেয়ালই করেনি।আচমকা রওনকের কথা মনে পড়লো তার। লোকটা এখনো ফিরলো না! দ্রুত রুমে গেল দৌড়ে। খাটের উপর পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। দ্রুত ওপেন করলো সেটা। সম্পূর্ণ ম্যাসেজ পড়ে যেন কুহুর মাথায় বাজ পড়লো! রওনক আর শাহিনূর মাহি ম্যাম নাকি একত্রে একটা রিসোর্টে গিয়েছেন। তার ঠিকানাটা আর রুম নাম্বারটাও লেখা আছে স্পষ্ট ভাবে! মুহূর্তেই হাত কাঁপতে লাগলো কুহুর। এই জন্যই কি তবে রওনক ভাই আজকে ভার্সিটিতে যেতে নিষেধ করেছে তাকে? ভেতর ঠেলেঠুলে কান্না আসতে চাইলো। এলোমেলো ভাবে কোনোমতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল কুহু।
চলবে…….