#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( দশম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১২>
সেদিন এরপর দুপুরের দিকে খাবার নিয়ে এসেছিল অস্মিতা। অর্ণব ঘুমিয়ে পড়েছিল ক্লান্ত শরীরে সেই সময়। অস্মিতা যেন না চাইতেও এই মুহূর্তে স্থিরভাবে চেয়েছিল কিছুক্ষণ ওর দিকে। কি নিষ্পাপ শিশুর মতন মুখটা! কলেজে পড়ার সময় অর্ণবের এই নিষ্পাপ মুখটাই ওকে সব থেকে বেশি আকর্ষণ করতো। মনে হতো হাত দিয়ে চুলগুলো ধরে ঘেঁটে দিক। তাহলে আরো বাচ্চাদের মতন লাগবে। কথাগুলো মনে পড়তেই আবার নিজেকে সামলালো অস্মিতা। পুরনো কথা কেন ভাবছে ও! এইসব ভাবনা গুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। কথাটা ভেবেই ও আলতো স্বরে অর্ণবকে ডাকলো ঘুম থেকে। অর্ণব এই সময় চোখ খুলে অস্মিতাকে দেখে নিজের স্বপ্নের ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসেছিল যেন। অস্মিতা এই সময় আস্তে গলায়ই বলেছিল,
———” দুপুরের খাবার এনেছি তোমার জন্য। খেয়ে নাও। ”
অর্ণব এই কথায় দু সেকেন্ড চুপ থেকে বলেছিল,
———” আমার জন্য এত কিছু না করলেও চলবে। আমি তো এমনিই ভীষণ খারাপ। ”
অস্মিতা এটা শুনে বেশ ক্লান্ত স্বরে বলেছিল,
———–” আমি নতুন করে এই নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না। এখন তোমার ওষুধ আছে। তাই প্লিজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ”
কথাগুলো বলতে বলতে অস্মিতা হঠাৎ খেয়াল করেছিল অর্ণবের হাতের ড্রেসিংটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। অস্মিতা এই সময় কেমন এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
———-” এ কি! তোমার ড্রেসিংটা থেকে তো ব্লাড বেরোচ্ছে। চেঞ্জ করতে হবে ওটা এক্ষুনি। ”
এই কথায় অর্ণব এই মুহূর্তে কিরকম অস্থির স্বরে বলেছিল,
———” কোন দরকার নেই। কিছুক্ষণ বাদে এমনি ঠিক হয়ে যাবে। তুমি প্লিজ যাও। আমাকে নিয়ে আর নিজের টাইম ওয়েস্ট কোরো না। ”
কথাটায় অস্মিতা এবার বেশ গম্ভীর গলায় বলেছিল,
———” থামবে তুমি। আমি ফাস্ট বক্স নিয়ে আসছি। ”
কথাটা বলেই ও তাড়াতাড়ি একটা ফাস্টএড বক্স নিজের বাড়ি থেকে নিয়ে এসে অর্ণবের কাছে গেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে ও খেয়াল করেছিল অর্ণবের চোখে জল। ছেলেটার কি কষ্ট হচ্ছে! ভেবেই বেশ চিন্তা নিয়ে বলেছিল,
———-” তোমার কি যন্ত্রণা হচ্ছে? ভিতরে জ্বালা যন্ত্রণা করছে? তাহলে বলো, আমি ডাক্তার ডাকছি। ”
এই কথায় অর্ণব ভেজা চোখেই খেয়াল করেছিল অস্মিতার অন্ধকার মুখটা! মেয়েটা ওকে নিয়ে এত কনসার্ন, অথচ মুখে বলে ভালোবাসে না। এটা কি করে সম্ভব! কথাগুলো ভেবেই ও আস্তে গলায় বলেছিল,
——–” ঠিক আছি আমি। ডোন্ট ওরি.. ”
কথাটা শুনে অস্মিতা এবার অর্ণবের হাত থেকে ব্যান্ডেজটা খুলে দেখেছিল ওর দগদগে কাটা জায়গাগুলো। দৃশ্যটা দেখে অস্মিতা কেমন থমকে গেছিল যেন। মনে হচ্ছিল এই যন্ত্রণার মধ্যে কি ও ছেলেটার সাথে রেগে রেগে কথা বলে ফেলছে! এটা ঠিক করছে না। অর্ণব কে এই সময় কোনভাবেই হার্ট করা উচিত না। তাই ড্রেসিং করার পর খুব নরম স্বরেই বলেছিল,
———” আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। ডান হাতটা বেশি নাড়াতে হবে না। তাহলে ব্লিডিং হতে পারে। ”
কথাটায় অর্ণবও আর কিছু বলেনি। চুপ করে খেয়ে নিচ্ছিল এরপর। কিন্তু অস্মিতার এলোমেলো চুলগুলো যখন চোখের সামনে আসছিল বার বার, অর্ণব সেই সময় আগের মতন হঠাৎ কিছু না বলে অস্মিতার চুলটা আলতোভাবে সরিয়ে দিয়েছিল ওর কপাল থেকে। এই মুহূর্তে দুজনেই যেন কেমন স্থির হয়ে গিয়েছিল সময়টায়। অস্মিতার অভিমানের পাহাড়টা যেন ধীরে ধীরে গলতে শুরু করেছিল হঠাৎ। এই ছেলেটা আরেকবার এসে মনটা ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
তবে পরেরদিন দুপুরে অর্ণবকে খাবার দিতে গিয়ে অস্মিতার পা টা থমকে গেছিল। অর্ণব এর ঘরে তিতলি। মেয়েটা স্যুপ, নুডলস এইসব নিয়ে এসে কি আদিখ্যেতা শুরু করেছে! বেশ আলতো মিষ্টি স্বরেই অর্ণবের প্রায় গায়ের ওপর উঠে বলছে,
———–” অর্ণবদা, আমি দুদিন মামার বাড়ি গেলাম, আর এ কি অবস্থা হলো তোমার! ইশ, কতটা লেগেছে! যাইহোক, আমি এরপর তোমার দেখাশোনা করবো। দ্যাখো তোমার জন্য স্যুপ নুডলস নিজের হাতে বানিয়ে নিয়ে এসেছি। এই রকম শরীর খারাপের সময় একটু টেস্টি খাবার খেলে মনটা ভালো হয়ে যায়। ”
কথাটা বলেই তিতলি আলতো করে হাত ধরেছিল অর্ণবের। কিন্তু এটা দেখে অস্মিতার পা থেকে মাথা অব্দি জ্বলে গেছিল যেন। দরজার সামনে কিরকম পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে অর্ণব এই মুহূর্তে অস্মিতাকে খেয়াল করেই কেমন ঢোঁক গিলে ছিল। ভয়েতে গলা শুকিয়ে আসছে ওর। এই দুদিনে যা ও বা বরফ গলেছিল, এই তিতলির চক্করে সবটা আবার না আগের মতন রুক্ষ সূক্ষ হয়ে যায়। কথাটা ভেবেই অর্ণব তাড়াতাড়ি নিজের হাতটা তিতলির থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেশ জোর গলায় বলেছিল,
——–” এ কি অস্মিতা! তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো। লাঞ্চ এনেছ তো আমার? ”
কেমন বিগলিত স্বরে কথাগুলো বলেছিল অর্ণব। অস্মিতা এটা শুনে বেশ কঠিন মুখ করেই ভিতরে এসেছিল। তবে তিতলি ওকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করে উঠেছিল,
———” এ কি অস্মিতাদি? তুমি এখানে? ”
এই প্রশ্নে অস্মিতার যেন ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটেছিল। ও এবার বেশ তীক্ষ্ণ স্বরে বলেছিল,
———-” কেন তিতলি? এখানে আসতে গেলে কি তোমার পারমিশন নিতে হবে? ”
এই কথায় অর্ণব বুঝেছিল পারদ চড়ছে। তাই নিজেই বলে উঠেছিল,
———-” এ বাবা। এসব কি কথা! আর অস্মিতা ছিল বলেই তো আমি সুস্থ হয়েছি। ও যদি আমার খেয়াল না রাখতো তাহলে এত তাড়াতাড়ি রিকোভার করতামই না।”
কথাগুলো শুনে অস্মিতা ভদ্রতার হাসি হেসেই বলেছিল,
———-” থাক। হয়েছে। যাইহোক, আমি দুপুরের খাবার দিতে এসেছিলাম। কিন্তু এখন তো দেখছি তিতলি বেশ ভালো ভালো টেস্টি খাবার রান্না করে এনেছে তোমার জন্য। তাই আজ আমি খাবারটা নিয়ে গেলাম। তুমি বরং এইসবই খাও। ”
অস্মিতার কথাটা শেষ হতেই তিতলি বেশ জোর দিয়ে বললো,
———” হ্যাঁ, অস্মিতাদি। সে ই বরং ভালো। তুমি এখন এসো। আর চিন্তা কোরো না। আমি তো আছি অর্ণবদার সাথে! ”
কথাটা শুনে অস্মিতার মুখের পেশি শক্ত হয়ে গেছিল। তাও সেই ভদ্রতার হাসি হেসেই বললো,
——–” হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার চিন্তার কি আছে! তুমি তো আছোই অর্ণবের সাথে। আমি আসছি। ”
কথাগুলো বলেই অস্মিতা চলে যাচ্ছিল। তখনই অর্ণব বলে উঠলো কিরকম কাতর স্বরে,
———” কোথায় যাচ্ছো তুমি? আর আমার এইসব স্যুপ নুডলস ভালো লাগে না। তুমি যেই খাবারটা এনেছো সেটাই! ”
না, ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই অস্মিতা বলে উঠলো এবার,
———-” থাক না অর্ণব। তিতলি এত ভালোবেসে রান্না করে এনেছে, শুধুমাত্র তোমার জন্য! তুমি আজ ওটাই খাও।”
কথাগুলো বলে আর কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই অস্মিতা চলে গেছিল সেই মুহূর্তে। কান মাথা যেন জ্বালা করছে এখন রাগে। নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে আরো বেশি। কেন আনতে গেল শুধু শুধু এইসব খাবার! অর্ণব এর খেয়াল রাখার মতন তো অনেকে আছে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন ফিরে এসেছিল বাড়ি। তবে অর্ণবের মনটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। ও আজ আর তিতলিকে সহ্য করতে পারছিল না যেন এরপর। এই মেয়েটার বাড়াবাড়ির জন্যই অস্মিতা চলে গেল! কথাটা ভেবেই অর্ণব তিতলিকে বলে উঠেছিল,
——–” তুমি প্লিজ এসো এবার। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আর এইসব খাবারও নিয়ে যাও প্লিজ। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
কথাগুলো শুনে তিতলি বেশ ম্লান মুখে বলেছিল,
———” কিন্তু আমি এইসব! ”
ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই অর্ণব বলেছিল,
———” তিতলি প্লিজ। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি একটু ঘুমোতে চাই। ”
না, এরপর আর তিতলি কিছু বলতে পারেনি। চলে গেছিল চুপচাপ।
(চলবে।