অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-১৬

0
763

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_16
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আবরাজ নিজের ঘরে বসে ছিল৷ এমন সময় ম্যাক্স তার ঘরে প্রবেশ করে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দেয়। আবরাজ চোখ তুলে ম্যাক্সের দিকে তাকিয়ে বলে,”কে আপনি!”

ম্যাক্স হেসে বলে,”আমার সামনে এসব নাটক করতে হবে না তোমায়। তো বলো, স্মৃতি হারানোর অভিনয় করে কেমন লাগছে?”

আবরাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”মোটামুটি। বুঝলাম না, তোমার আর এলার মাথা থেকে এটা কেমন বুদ্ধি বের হলো। এই অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত।”

“তুমিই তো নিঝুমের আসল রূপটা দেখতে চেয়েছিলে। জানতে চেয়েছিলে যে নিঝুম কি আসলেই ভালো মেয়ে নাকি লোভী। সেটা জানার জন্যই তো আমরা তোমাকে এই বুদ্ধি দিলাম।”

ম্যাক্সের কথাটা শুনেই আবরাজ মনে করে সেদিন কার ঘটনাটা। সেদিন তার এক্সিডেন্ট হলেও সে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। মাথায় সামান্য আঘাত লেগেছিল। আবরাজ সেই অবস্থায় স্থানীয় একটি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল। অতঃপর সেখান থেকেই ভিডিও কলের মাধ্যমে এলা ও ম্যাক্সের সাথে যোগাযোগ করে। সেই সময় এলা আবরাজকে অনেক বকাবকি করে বলে,”শুধু শুধু তুমি নিঝুমের সাথে ঝগড়া করে নিজের এত বড় একটা বিপদ ডেকে আনতে যাচ্ছিলে। এত সামান্য বিষয় নিয়ে কেউ ঝগড়া করে? এত ইগো কেন তোমার?”

আবরাজ বলে,”তুমি নারীবাদী সেটা ঠিক আছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি শুধু আমার দোষটাই দেখবে। নিঝুম মেয়েটাও কিন্তু কম নয়।”

তাদের তর্ক লেগেই যাচ্ছিল এমন সময় ম্যাক্স বলে ওঠে,”আমার মনে হয় এভাবে ঝগড়া করে কোন লাভ নেই৷ আমরা একটা সুন্দর সমাধান আনতে পারি!”

এলা ও আবরাজ দুজনেই জানতে চায়,”কি সমাধান?”

ম্যাক্স বলে ওঠে,”তোমার তো একটাই সন্দেহ তাই না? যে নিঝুম একটা লোভী মেয়ে যে তোমার সাথে প্রতারণা করে বিয়ে করেছে। তো তুমি যদি নিশ্চিত ভাবে জানতে পারো যে নিঝুমের আসল চরিত্রটা কেমন তাহলে তো এই নিয়ে ঝামেলাটা কাটবে?”

আবরাজ সম্মতি জানিয়ে বলে,”হুম,কিন্তু কিভাবে জানবো?”

ম্যাক্স বলে,”আমি একটা ভালো বুদ্ধি দিতে পারি। আসলে এই রকম একটা মুভি দেখেছিলাম তাই মাথায় বুদ্ধিটা এলো।”

“কি বুদ্ধি?”

“তুমি একটা কাজ করতে পারো, নিজের স্মৃতি হারানোর নাটক করে তারপর নিঝুমকে পরীক্ষা করে দেখতে পারো সে আসলেই লোভী নাকি ভালো মনের মেয়ে। যদি নিঝুম সত্যিই লোভী হয় তাহলে নিশ্চয়ই এই সময়ের সদ্ব্যবহার করবে।”

এলা বলে ওঠে,”এটা কি কাজে দেবে? সিনেমা আর বাস্তব জীবন তো এক নয়।”

ম্যাক্স বলে,”কাজ করলেও করতে পারে। আর এতে করে আর যাই হোক না কেন, এদের নিত্য নতুন এই ঝগড়া তো থামবে!”

আবরাজ সে সময় বলছিল,”এসব কি বলছ ম্যাক্স? আমি কেন এমন অভিনয় করতে যাব?”

“একটু ভেবে দেখো পরামর্শটা কিন্তু খারাপ নয়। আর হ্যাঁ, এই অভিনয়ের সময় কিন্তু তুমি নিঝুমের সাথে ভালো ব্যবহার করবে।”~~~বলে ওঠে এলা।

আবরাজ বলে ওঠে,”অসম্ভব! ঐ মেয়ের সাথে আমি ভালো ব্যবহার করতে পারব না।”

ম্যাক্স সেসময় বলেছিল,”সেটা নাহয় সময়ের উপর ছেড়ে দাও। যদি নিঝুম তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে,তোমার অসুস্থতার সুযোগ না নিয়ে তোমাকে সহানুভূতি দেখায় তাহলে ওর সাথে ভালো ব্যবহার করো। আর যদি ও সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে তাহলে তুমি সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিও। তখন আমি এবং এলা তোমার পাশে থাকব। এলা যে এখন নিঝুমকে সাপোর্ট করছে পরে যদি প্রমাণিত হয় যে নিঝুম আসলে একজন প্রতারক তখন ও তোরই পাশে থাকবে।”

এলা বলে,”একদম।”

এভাবে কিছু সময় ধরে তারা আবরাজকে বোঝানোর পর আবরাজ রাজি হয়েছিল৷ এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা তাদের এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে। তাকে অনেক মানিয়ে এই নাটকটা সাজায়।

অতীতের এই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে আবরাজ। ম্যাক্স আবরাজকে জিজ্ঞেস করে,”নিঝুমের ব্যবহার কেমন লাগছে তোমার?”

“এখনো অব্দি তো সব ঠিকঠাকই লাগছে৷ তবে এখনো নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।”

“সেটাই। তুমি আরো কিছুদিন এই অভিনয় চালিয়ে যাও আর নিঝুমের আরো বেশি করে পরীক্ষা নাও। তাহলেই ওর প্রকৃত রূপটাকে চিনতে পারবে।”

“হুম..তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ও আমার প্রতি এখন যা যত্ন করছে সবটাই মন থেকে সহানুভূতির কারণে..এটাকে আমার লোক দেখানো অভিনয় লাগছে না।”

ম্যাক্স বলে,”আমার আর এলারও তো এটাই মত। আমাদের মনে হয়, নিঝুম একটা ভালো মেয়ে। এখন আশা করি তুমিও সেটা বুঝতে পারবে।”

আবরাজ বলে,”বুঝতে পারলেও বা কি! ঐ মেয়েটা প্রতারক নয় এটা বুঝতে পারলে ওর প্রতি আমার নেগেটিভ ভাবনাটাই শুধু দূর হবে। কিন্তু তোমরা যদি ভেবে থাকো এজন্য আমি ওর সাথে এই সম্পর্কটাকে মেনে নেবো তাহলে তোমরা বোকার স্বর্গে বাস করছ। ঐ মেয়েটাকে আমি কখনোই স্ত্রী হিসেবে মানতে পারবো না। কারণ এই বিয়েটা আমি মন থেকে করি নি।”

ম্যাক্স একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”বাদ দাও সেসব কথা। কাল তোমার মামা আসছেন।”

“মামা? হঠাৎ?”

“আসলে উনি কোনভাবে তোমার অসুস্থতার খবর জেনে গেছেন। মনে হয়, তোমার বাবা জানিয়েছেন। তাই উনি আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। এবিষয়ে জানতে চাইলে আমি বলতে বাধ্য হই যে তুমি সত্যি সত্যি স্মৃতি হারিয়েছ। আর এটা শুনেই তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

আবরাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”মামাকে সব সত্যটা জানানো দরকার। নাহলে উনি চিন্তিত হয়ে যাবেন।”

“কিন্তু উনি সবটা জানলে কি মনে করবেন?”

“সেটাও অবশ্য ঠিক। আচ্ছা, আমি দেখছি কিভাবে সবটা ম্যানেজ করা যায়।”

এরইমধ্যে দরজায় কেউ নক করে। আবরাজ ম্যাক্সকে বলে,”নিঝুম এসেছে বোধহয়।”

“দাড়াও আমি দেখছি।”

বলেই ম্যাক্স এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। নিঝুম হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এসে বলে,”উনি ঠিক আছেন তো? আপনাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে যায় নি তো?”

নিঝুমের চোখেমুখে চিন্তা স্পষ্ট। ম্যাক্স বলে ওঠে,”রিল্যাক্স সব ঠিক আছে

নিঝুম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”উনি…”

আবরাজ তখন শুয়ে ছিল৷ ম্যাক্স বলে,”আমি ওকে ভুলভাল বুঝিয়ে শান্ত করে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছি৷ চিন্তা করার কিছু নেই।”

নিঝুম বলে,”আসলে এই এক্সিডেন্টের পর উনি যেমন হয়ে গেছেন তাতে করে আমি অনেক চিন্তিত।”

“আমি বুঝতে পারছি তোমার চিন্তাটা। মুখে যাই বলো, তোমার মতো সাধারণ বাঙালি মেয়েরা যে বিয়েকে হালকা ভাবে নাও না এবং স্বামীর জন্য ভীষণ ভাবে চিন্তিত এটা আমি বুঝি।”

নিঝুম হেসে বলে,”একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের জন্য চিন্তা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি যা করছি সবটাই মানবিকতার খাতিরে।”

“সত্যিই তাই? তাহলে আজ যদি আবরাজের বদলে আমার এই অবস্থা হতো তাহলেও কি তুমি আমার জন্য এই একই রকম কনসার্ন দেখাতে? বা এলার যদি এমন হতো তাও কি ওর এতটা খেয়াল রাখতে যতো টা আবরাজের রাখছ?”

নিঝুম বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না৷ ম্যাক্স বলে,”সত্যটা তুমিও খুব ভালো করে জানো। তুমি আবরাজের এতটা কেয়ার করছ এর একমাত্র কারণ ও তোমার স্বামী। ওর প্রতি তোমার একটা দায়বদ্ধতা আছে।”

নিঝুম আর অস্বীকার করে কিছু বলতে পারে না। তাই সে বলে,”ঠিক বলেছেন আপনি। উনি আমার দায়িত্ব। আর আমি এটাকে দায়িত্বশীলতার খাতিরেই দেখছি। আমি জানি এই সম্পর্কের কোন ভবিষ্যত নেই। ওনার কাছ থেকে আমি কোন আশাও রাখি না। এখন স্মৃতি হারানোর জন্য উনি আমার সাথে যে ভালো ব্যবহার গুলো করছেন এজন্য আমি তাতে গা ভাসাতে চাই না। কারণ আমি জানি ওনার স্মৃতি ফেরত এলে উনি আবার আগের মতো হয়ে যাবেন। এই সম্পর্কের ইতি টানবেন।”

আবেগঘন স্বরে বলে নিঝুম৷ ম্যাক্স বলে,”কি হয় না হয় তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়না। জীবন পাল্টাতে সময় নেয় না।”

এদিকে শুয়ে থাকা আবরাজ এসব কথা শুনে বলে,”সত্যিই কি সবটা পাল্টাবে?”

to be continue…..