অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-২৭+২৮

0
812

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_27
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুম ঘরে বসে নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। আজ রাতেই তার লন্ডন থেকে সিলেটে ফেরার ফ্লাইট। তাই দেশে ফেরার জন্য সে শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিঝুম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পোশাক ঠিক করছিল। এমন সময় তার দরজায় কেউ নক করে। নিঝুম দরজা খুলতেই দেখতে পায় আবরাজ দাঁড়িয়ে আছে৷ আবরাজ এগিয়ে এসে নিঝুমকে বলে,”তুমি তৈরি হয়ে নিয়েছ?”

“হুম।”

“ধন্যবাদ, আমার কথাটা রাখার জন্য। আজকের দিনটা আমার সাথে কাটানোর জন্য। চলো, তোমাকে লন্ডন শহরটা ঘুরে নিয়ে আসি।”

নিঝুম মূলত আজ আবরাজের অনুরোধেই সেজে উঠেছে। কারণ আবরাজ তাকে শেষ একটা অনুরোধ করেছিল তাকে নিয়ে লন্ডন শহর ঘুরছে দেখার। নিঝুম বাইরে আসে। আবরাজ নিজের গাড়ি বের করতেই নিঝুম সেই গাড়িতে উঠে বসে। গাড়িতে উঠে বসে সে বলতে থাকে,”কোথায় যাব আমরা?”

“চলো আজ লং ড্রাইভে তোমায় গোটা লন্ডন শহর টা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”

নিঝুম ও আবরাজ দুজনে গাড়িতে করে বসে যেতে থাকে। আবরাজ নিঝুমকে গাড়িতে করে অনেক দূরে নিয়ে যায়। যেতে যেতে বলে,”আজ আমার একটা বাংলা গান ভীষণ মনে হচ্ছে।”

“কোন গান?”

“এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?”

নিঝুম কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। আবরাজ নিঝুমকে বলে,”তবে আমাদের পথ চলা বুঝি আজকে এখানেই শেষ হবে। তাই না?”

“হয়তো।”

নিঝুম কথাটা বলে মাথা নিচু করে নেয়। আবরাজ নিঝুমকে বলে,”শুরুর দিকে তোমার এই জেদটাই আমার ভালো লাগত না। তবে তোমার এই জেদটা আমি বুঝতে পেরেছি৷ তুমি এটাই চাও তো, যাতে করে নিজের মতো করে নিজের জীবন কাটাতে পারো? নিজে একা একাই সাবলম্বী হতে চাও। বেশ, তুমি যেন সফল হতে চাও সেই কামনাই করি।”

“সাবধানে ড্রাইভ করুন।”

“অসুবিধা নেই, আমার অভ্যাস আছে।”

নিঝুম জানালা দিয়ে লন্ডনের রাস্তা দেখতে থাকে। চারিদিকের সৌন্দর্য, উঁচু উচু দালান কোঠা। আবরাজ নিঝুমকে বলে,”জানো এই লন্ডনে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে। আমি এই লন্ডনে মামীর হাত ধরে প্রথম স্কুলে আসি, লন্ডনে আমার জীবনের অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি৷ তবে সিলেটে আমার জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে আমি এমন কিছু পাই, যা আমার কাছে সবথেকে দামী ছিল। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। তোমায় প্রথমে আমি ভুল বুঝেছিলাম সেসময় আমারো কিছু ভুল ছিল। তবে আমার পরিস্থিতি টাও তখন ঠিক ছিল না।”

“এসব কথা বলে কোন লাভ নেই।”

“জানি, তুমি আজ সিলেটে ফিরবে। আমি বাধা দেব না। তুমি যাতে করে সুখী হবে আমি তাতেই রাজি আছি। তোমার ভবিষ্যত জীবন সুখী হোক। তুমি একজন ভালো ডাক্তার হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারো সেই কামনা করি।”

নিঝুম চুপচাপ আবরাজের কথা শুনছিল। আবরাজের চোখে এক ধরনের গভীরতা ছিল। যেন কোনো চিন্তা বা স্মৃতি তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। আবরাজের কথাগুলো তাকে অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করছিল, কিন্তু সে নিজের মনোভাব স্পষ্ট করতে পারছিল না। আবরাজ যতই বলছিল, “তোমার ভবিষ্যত জীবন সুখী হোক,” ততই যেন সেই অজানা দুঃখ আর বেদনা তাকে ঘিরে ধরছিল।

গাড়িটি ধীরে ধীরে চলতে থাকে। আবরাজ চোখে-মুখে এক ধরনের নিরবতা রেখেই ড্রাইভ করছিল। নিঝুম জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চিন্তা করছিল, আজকের দিনটা তার জীবনে কী মানে রাখবে? আবরাজের জন্য, লন্ডন শহর, তার মিষ্টি স্মৃতি, সবই যেন এক নতুন সূর্যের আলোয় দেখা হচ্ছিল। তবে নিঝুম জানত, তার পথচলা কখনোই সহজ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই, একাধিক বেদনা তাকে পার করতে হয়েছে। সেই বেদনা তাকে আরও শক্তিশালী করেছে, কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছিল না তার হৃদয়ের সত্যিকারের চাওয়া কী।

“তুমি কী ভাবছো?” আবরাজ প্রশ্ন করল।

“ভাবেছি, জীবন আসলে কতটা অনিশ্চিত। কেউ জানে না আগামীর কথা,”
নিঝুম আস্তে করে বলল।

“হ্যাঁ, জীবন কখনোই একরকম থাকে না। আজ যা মনে হয়, কাল তা হয়তো আর মনে নাও হতে পারে। আমাদের ভাবনা সব সময় পরিবর্তন হয়।,” আবরাজ বলল গম্ভীর কণ্ঠে।

গাড়ি এক জায়গায় থেমে গেল। আবরাজ পেছন ফিরে দেখল, “আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম?”

নিঝুম জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তাদের গাড়ি একটি পার্কের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে অনেক পরিবার ও তরুণ-তরুণী ঘুরছিল। চারিদিকে সবুজ ঘাস, ফুলের গন্ধ আর দূরে দেখা যাচ্ছিল লন্ডনের উজ্জ্বল আলোকমালা। নিঝুম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর বলল,”এই জায়গাটা খুব ভালো।”

“হ্যাঁ, এটা আমার খুব প্রিয় জায়গা। এখানে আসলে মনটা কিছুটা শান্ত লাগে।”

তারা দুজনই পার্কের মধ্যে হাঁটতে শুরু করল। নিঝুম আর আবরাজ একসঙ্গে চলতে থাকল, তবে তাদের মাঝে কোন কথোপকথন ছিল না। শুধু নিঝুমের মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা বড়, কিন্তু তার ভেতর কিছু নিঃসঙ্গতা, কিছু কষ্ট জমে থাকত।

এমন সময় হঠাৎ করে নিঝুমের ফোন বেজে ওঠে। নিঝুম দেখে ইমরান ফোন দিয়েছে। নিঝুম এটা দেখে আবরাজের দিকে তাকায়। আবরাজ বলে,”ফোনটা রিসিভ করো।”

নিঝুম ফোনটা রিসিভ করতেই ইমরান বলে,”কিরে নিঝুম? কোথায় তুই?”

“আমি তো একটু বাইরে এসেছি। কেন?”

“তুই নাকি আজ রাতেই সিলেটে ফিরবি?”

“হুম, তেমনই কথা আছে।”

“ওহ, তাহলে যাওয়ার আগে একবার অন্তত আমার সাথে দেখা করে যা। তোর সাথে অনেক কথা বলার আছে আমার।”

“কি কথা?”

“তুই আমার কফিশপে আয় তারপর বলছি।”

“বেশ।”

বলেই নিঝুম ফোনটা রেখে দেয়। আবরাজ নিঝুমকে জিজ্ঞেস করে,”কে ফোন দিয়েছিল, ইমরান?”

“হুম।”

” কি বলল?”

“ও আমার সাথে দেখা করতে চাইছে।”

“বেশ, চলো। আমি তাহলে তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”

“আপনার কোন আপত্তি নেই?”

“আপত্তি করার জন্য তো অধিকার থাকা লাগে। আমার কি তোমার উপর কোন অধিকার আছে?”

আবরাজের এই কথা যেন নিঝুমের বুকে তীরের মতো বিদ্ধ করে। তারা দুজন আবার গাড়িতে উঠে বসে। আবরাজ নিঝুমকে নিয়ে গিয়ে ইমরানের কফিশপের সামনে নামিয়ে দেয়।

নিঝুম কফিশপে ঢুকেই দেখতে পায় ইমরান অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল। নিঝুমকে দেখেই সে বলে,”তুই এসেছিস।”

‘হুম, এখন বল তো কি হয়েছে? হঠাৎ এভাবে আমায় ডাকলি কেন?’

“তুই ভেতরে চল। এখানে সবার সামনে বলা যাবে না। ভেতরের রুমটা যে আছে ওখানে বসে কথা বলি।”

“আচ্ছা।”

ইমরানের কথামতো নিঝুম তার সাথে যেতেই নিঝুমকে ইমরান বলে,”তুই ঐ আবরাজকে ডিভোর্স কবে দিবি?”

“মানে?”

“দেখ, আমি আর এত কথা ঘোরাতে চাই না। তাই স্পষ্ট করে বলি, আমি তোকে শুধু বন্ধুর নজরে দেখি না। তার থেকে আরো বেশি কিছুর নজরে দেখি। আমি তোকে ভালোবাসি নিঝুম!”

“ইমরান! এসব কি বলছিস তুই?”

“ঠিকই বলছি। সেই ছোটবেলা থেকে আমি তোকে ভালোবাসি। তুই ঐ আবরাজকে ডিভোর্স দিয়ে আমার হয়ে যা।”

“এটা আমি তোর থেকে আশা করি নি।”

“ও কাম অন, শোন হয়তো বা এখনো তোদের বিয়ের ৬ মাস হয়নি তাই ডিভোর্স হচ্ছে না কিন্তু কোন অসুবিধা নেই। তুই একটা কাজ কর, আজ সিলেটে না ফিরে আমার এখানে চলে আয়। লন্ডনে রুলস আছে বিয়ে ছাড়াই আমরা একসাথে লিভ ইন রিলেশনশিপে থাকতে পারব।”

নিঝুম ভীষণ রেগে ইমরামকে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। রাগী কন্ঠে বলে,”তুই এত জঘন্য আমি ভাবতেই পারি নি। ভালো চাইলে সরে যা আমার সামনে থেকে।”

ইমরান নিঝুমকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জোর করে তার ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে বলে,”ঐ আবরাজ যখন জোর করেছিল তখন তো ভালো লেগেছিল তাহলে এখন কেন খারাপ লাগছে? এর আগে তোকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজের করতে পারিনি ঐ আবরাজের জন্য কিন্তু আজ তোকে আমার হওয়ার থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

“ইমরান ছাড় আমায়!”

এমন সময় আবরাজ এসে বলে,”কি হচ্ছে এখানে?”
to be continue…..

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_28
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আবরাজকে দেখামাত্রই ইমরান নিঝুমের থেকে দূরে সরে গিয়ে বলে,”আরে ব্রো, আপনি। তেমন কিছু না। আমি আর নিঝুম তো একটু ফ্রেন্ডলি আলাপ করছিলাম, তাই না নিঝুম?”

নিঝুম ঘৃণাভাজন দৃষ্টি নিয়ে ইমরানের দিকে তাকায়। কিন্তু আবরাজের সামনে কিছু বলতেও পারে না লজ্জার খাতিরে। এদিকে আবরাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলে,”ফ্রেন্ডলি আলাপ? এক বিবাহিত নারীর শরীরে হাত দিয়ে, তাকে জড়িয়ে ধরে তুমি ফ্রেন্ডলি আলাপ করছিলে?”

ইমরান আমতাআমতা করে বলে,”আপনি ভুল ভাবছেন। নিঝুম..তুই কিছু বলছিস না কেন? বল। আবরাজ ব্রো তো ভুল বুঝছে।”

আবরাজ এগিয়ে এসে ইমরানের শার্টের কলার ধরে বলে,”ভুল আমি কখনোই বুঝিনি৷ তোকে বরাবরই আমি ঠিকই বুঝেছি। তবে এতদিন অন্য একজনকে ঠিক ভেবেছিলাম যা ছিল আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল।”

নিঝুমের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে আবরাজ। নিঝুম অবাক চোখে তাকায়৷ ইমরান এটা বুঝতে পেরে উল্টো চাল দিয়ে বলে,”ওকে ব্রো, তুমি যখন বুঝেই গেছ সবটা তখন আর নাটক করে লাভ নেই। আমি আর নিঝুম একে অপরকে ভালোবাসি সেই স্কুল লাইফ থেকে। ক্লাস ৭ এ পড়াকালীন সময় থেকেই আমাদের মধ্যে রিলেশন ছিল৷ তারপর তো আমাকে পরিবারের সাথে UK তে চলতে আসতে হয় তাই আমাদের সম্পর্কে একটা ফাটল তৈরী হয়। কিন্তু এখানে এসে এত বছর পর একে অপরকে দেখে আমাদের সেই পুরাতন ভালোবাসা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷ আর তাই তো নিঝুম চায় আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে আসতে।”

নিঝুম ইমরানের এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার শুনে হতবাক হয়ে যায়। প্রতিবাদ করে বলে,”এসব তুই কি যাতা বলছিস ইমরান? তুই খুব ভালো করেই জানিস তোকে আমি কখনোই বন্ধুর থেকে বেশি দেখিনি। তোকে আমি বন্ধু হিসেবে বিশ্বাস করেই এখানে এসেছিলাম কিন্তু তুই আমাদের বন্ধুত্বকে কলঙ্কিত করে আমার সাথে জোরজবরদস্তি করে…আর এখন আমার নামে এসব মিথ্যা বলছিস। তোর মনে কি আল্লাহর প্রতি একটুও ভয় নেই? এভাবে মিথ্যাচার করতে বাঁধছে না তোর?”

আবরাজ হাত তালি দিতে থাকে। নিঝুম অবাক চোখে দেখে। আবরাজ হাত তালি দিতে দিতে আবরাজ এর সামনে এসে বলে,”বাহ, কি সুন্দর অভিনয়। এত সুন্দর অভিনয় কিভাবে শিখলে তুমি নিঝুম?”

“আপনি ভুল ভাবছেন..”

“ভুল কিছু আমি ভাবছি না। আমি যা ঠিক তাই ভাবছি। প্রথমেই আমি তোমাকে ঠিক ভেবেছিলাম। তুমি আসলেই একটি লোভী,প্রতারক মেয়ে। তারপর আমি ভাবলাম, তুমি একটা ভালো মেয়ে। আর আমার সেই ভাবনাটাই ভুল ছিল।”

নিঝুম বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। আবরাজ পুরোপুরি তাকে ভুল ভাবছে। আবরাজ একটু থেমে বলে,”আমার যা সিদ্ধান্ত নেবার তা আমি নিয়ে ফেলেছি। তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে এই ইমরানকে বিয়ে করতে চাও তো? বেশ, ভালো কথা। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের দুজনের বিয়ে দেব। শুধু তাই নয়, ডিভোর্সের পর তোমার খোরপোষের জন্য যদি টাকা লাগে সেটার জন্যেও বলতে পারো। আমি তাতেও রাজি আছি। এটাই তো চেয়েছিলে তোমরা? যাও আমি তোমাদেরই খুশি করে দিলাম।”

নিঝুমের চোখে অশ্রু চলে আসে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমি এসব কিছুই চাই না। না তো আমি ইমরানকে বিয়ে করতে চাই আর না তো আমি আপনার থেকে কোন টাকা চাই৷ আমি শুধু আত্মনির্ভরশীল হতে চাই, একজন ডাক্তার হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। ব্যস।”

আবরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,”এখানে এই বদ্ধ রুমে কি সেই ডাক্তারি হওয়ার ট্রেনিং নিতে এসেছিলে নিজের বন্ধুর কাছে?”

নিঝুম বুঝতে পারে আবরাজ কোন দিকে ইঙ্গিত করছে। সে চরম ঘৃণা নিয়ে বলে,”মিস্টার আবরাজ!”

“হুশ, একদম চোখ রাঙাবে না। দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে। এই নাও তোমার পাসপোর্ট, ভিসা, প্লেনের টিকিট সব এখানে এসব নাও আর দূর হও। দুই মাস পর তোমার কাছে ডিভোর্স লেটারস পাঠিয়ে দেব।”

বলেই নিঝুমের মুখের উপর সব ডকুমেন্টস ছিটিয়ে দিয়ে চলে যায় আবরাজ। নিঝুম সেসব ডকুমেন্টস তুলে নেয়। অতঃপর ইমরানের দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ শুধুমাত্র তোর জন্য উনি আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলার সাহস পেলেন। তোকে আমি কখনো ক্ষমা করবো, কখনোই না।”

বলেই নিঝুম ইমরানের কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকে লন্ডনের রাস্তা দিয়ে।

~~~~~~~~~~~~~~~
আবরাজ বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকে একের পর এক জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে থাকে৷ রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে রুমে এভাবে তাণ্ডব চালানোর পর আবরাজ একটু শান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবে,”আমি কি নিঝুমকে সত্যিই ভুল বুঝলাম? কিন্তু যা দেখলাম সব তো ওর বিরুদ্ধেই।”

এদিকে,
নিঝুম চলে এসেছে এয়ারপোর্টের সামনে। তার ফ্লাইটের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আপাতত সে ইমিগ্রেশন বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এয়ারপোর্টের ভেতরে যাবার আগেই শেষ বারের মতো লন্ডন শহরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে নিঝুম। অতঃপর বলে,”এই শহর আমার দুঃখময় জীবনে সুখ আনতে পারে নি। বরং আরো বেশি দুঃখে নিমজ্জিত করেছে। এই শহরে আমি কোন আশা নিয়ে পা রাখিনি কিন্তু এতটা অপমান নিয়ে ফিরতে হবে সেটাও ভাবিনি। ভালো থেকো লন্ডন শহর।”

বলেই সে সামনের দিকে পা বাড়ায়। আর একটিবারও পেছন ফিরে তাকায় না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কয়েক দিন পর,
আবরাজ আজ আবারো একটি বারে এসেছে। এখানে এসে ক্রমান্বয়ে মদ্যপান করে চলেছে। ম্যাক্স ঠিক তার পাশেই বসে। আবরাজকে এ অবস্থায় দেখে সে বলে,”ভাই, এবার থামো। আর কত খাবে? এবার তো শরীর খারাপ করবে। অনেক রাতও হয়ে গেছে। চলো ফিরে চলি।”

আবরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,”তোমার ঘরে তো বউ আছে, এজন্য তো ফিরতে চলেছ। বাসায় ফিরে বউয়ের সাথে সময় কাটাবে কিন্তু আমার কি হবে? আমার জন্য তো কেউ নেই আমার এপার্টমেন্টে। সেখানে গেলেই যে একাকীত্ব ঘিরে ধরবে আমায়।”

ম্যাক্স একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজের এই বন্ধুটার কষ্ট সে বুঝতে পারছে। আবরাজ যে নিজের অজান্তেই ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে নিঝুমকে। নিজের ইগো পাশে ঠেলে কতই না অনুরোধ করল নিঝুমকে তার সাথে থাকার জন্য অথচ মেয়টার তার কষ্ট বুঝল না। যদিও আবরাজ তাকে স্পষ্ট করে কিছু বলে নি, তবে যতটুকু বলেছে তাতে ম্যাক্স এতটুকু বুঝেছে নিঝুম দেশে ফিরে যাবার আগে এমন কোন ঘটনা ঘটেছিল যা তাদের মধ্যকার দূরত্ব অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল।

ম্যাক্স এসব ভেবেই মনে মনে বলে,”আচ্ছা, নিঝুম এখন কেমন আছে? আবরাজকে এত কষ্টে রেখে সে কি সুখী হতে পেরেছে?”

—–
“সুখ সবার কপালে থাকে না,আম্মু। আমার কপালে এই সুখ সবসময় অধরাই ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।”

হতাশ স্বরে শান্তি বেগমকে কথাটা বলে নিঝুম। শান্তি বেগম তা শুনে নিঝুমের মাথায় ভরসার হাত বুলিয়ে বলেন,”চিন্তা করিস না, মা। আল্লাহ আছেন, তার উপর ভরসা রাখ। ভালো ভাবে মেডিকেল ভর্তির প্রিপারেশন নে। তোর হাতে তো আর বেশি সময় নেই। আগামী সপ্তাহেই মেডিকেল ভর্তি এক্সাম। মনে রাখিস, যারা তোকে অপমান করেছে তাদের যোগ্য জবাব দিতে মেডিকেলে তোকে চান্স পেতেই হবে।””

“আমি লন্ডনে গিয়েও যথাসাধ্য পড়াশোনা চালিয়েছি। আশা করি, সফলতা পাবো।”

১ সপ্তাহ পর,
নিঝুম চঞ্চলতার সাথে পায়চারি করছে পুরো ঘরময়। আজ তার মেডিকেল ভর্তির রেজাল্ট আসার কথা। গতকালই সে এক্সাম দিয়েছে আজই রেজাল্ট আসবে। নিঝুম আল্লাহর কাছে দোয়া করছিল যেন চান্সটা হয়ে যায়। ছবি বেগম, শান্তি বেগম দুজনই তাকে বলে,”এতটা অস্থির হস না। দেখবি সব ঠিক হবে। চান্স পেয়ে যাবি।”

এদিকে আবির কম্পিউটারে সার্চ করছিল রেজাল্ট দেখার জন্য। একটু পরেই সে হঠাৎ করে বলে,”এটা কি হলো?”

নিঝুম হতাশ স্বরে বলে,”আমার চান্স হয় নি?”

আবির একটু হতাশ স্বরে বলে,”হয়েছে কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে হয়নি সিলেট মেডিকেলে হয়েছে।”

শান্তি বেগম বলে ওঠেন,”শোকর আলহামদুলিল্লাহ। চিন্তা করার কিছু নেই, আল্লাহ সহায় হলে এখান থেকেই কিনা হবে।”

ছবি বেগম বলে,”আমি মিষ্টি আনছি৷ এত খুশির খবর, নিঝুম ডাক্তার হবে।”

এদিকে নিঝুম বলে,”এবার আমি সবাইকে জবাব দেব, যারা সারাটা জীবন আমায় অপমান করে গেছে।”

to be continue…..