#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_29
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নিঝুমের জীবনে একয়দিনে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ লন্ডন থেকে আসার পর আজ এক মাসের কাছাকাছি হতে চলল৷ এই এক মাসে আবরাজের সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। সিলেট মেডিকেলে চান্স পাবার পর আপাতত নিঝুম পড়াশোনাতেই মনযোগ দিয়েছে যাতে নিজের একটা সুন্দর জীবন গড়তে পারে। তবে সব সময় আমাদের জীবন তো আমরা যেমন চাই সেভাবে এগোয় না। নিঝুমের ক্ষেত্রেও তাই হলো। সে যেভাবে ভেবেছিল সেভাবে জীবন আগাতে পারল না।
কিছুদিন থেকেই নিঝুম বেশ অসুস্থ বোধ করছে। মাথা ব্যাথা, বমি বমি ভাব এসব উপসর্গের কারণে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো তাকে। ডাক্তার নয়না খান সব উপসর্গ শুনে জিজ্ঞেস করেন,”আপনার শেষ পিরিয়ড কবে হয়েছিল?”
নিঝুম কিছুটা বিব্রত বোধ করে বলে,”বেশ অনেক আগেই হয়েছিল।”
“একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে তো আপনার সন্দেহ করার কথা ছিল বিষয়টা নিয়ে।”
নিঝুম বলে,”আমার ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু আমার মনে একটা ভয় ছিল আর সেজন্যই আমি এই বিষয়টা নিতে ভাবতে চাইনি।”
“বিয়ের কয়দিন হলো?”
“জ্বি, ৫ মাসের মতো।”
“আপনার স্বামী জানে এই বিষয়ে?”
“আমার স্বামী লন্ডনে থাকে। আর ওনার সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক না।”
“ওহ। বুঝতে পেরেছি। যাইহোক, সত্যটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। আমি প্রায় নিশ্চিত যে আপনি প্রেগন্যান্ট। বাকিটা তো রিপোর্ট আসলেই জানা যাবে।”
নিঝুম একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এই ভয়টাই সে পাচ্ছিল। জীবনে এমন একটা মোড় আসবে সেটা সে চিন্তাও করতে পারে নি। আল্লাহর কাছে কত অনুরোধ করেছে এমনটা যাতে না হয়। কারণ যেখানে এই সম্পর্কেরই মূল্য নেই সেখানে একটা নতুন প্রাণের আগমনে তো পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করবে।
নিঝুম এসব ভেবেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল৷ এমন সময় একজন নার্স নিঝুমের রিপোর্টটা নিয়ে আসে। ডাক্তার নয়না খান রিপোর্টটা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”যা ভেবেছিলাম তাই সত্য। আপনি প্রেগন্যান্ট।”
নিঝুম পুরোপুরি ভাষাহীন হয়ে পড়ে। বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। ডাক্তার নয়না খান তার দিকে রিপোর্ট কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,”আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থাটা জটিল তবে আপনাকে পরামর্শ দেব, নিজের খেয়াল রাখুন। স্বাস্থ্যকর খাবার খান,যেহেতু আপনি মেডিকেল স্টুডেন্ট তাই এই ব্যাপারে আশা করি আপনার জ্ঞান আছে।”
নিঝুম শুকনো মুখে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে আসে। তার চোখের কোণে জল জমে। এই মুহুর্তে তার মনে পড়ে যাচ্ছে আবরাজ কিভাবে জোরপূর্বক তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছিল৷ এই ঘটনাটা মনে করে সে বলে,”এর জন্য আমি আপনাকে কখনোই ক্ষমা করবো না মিস্টার আবরাজ।”
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বাসায় ফিরে নিজের রুমে এসে চুপচাপ বসে আছে নিঝুম। শান্তি বেগম নিঝুমের পাশেই তার রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছেন। মা হিসেবে নিঝুমের কষ্টটা তিনি বুঝতে পারছেন। তাই তিনি বলেন,”এখন কি সিদ্ধান্ত নিবি তুই? এব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?”
নিঝুম বলে,”ভাবার কি আছে? এই বাচ্চাটা আমার৷ আমি সেটা অস্বীকার করতে পারবো না। এই বাচ্চাটা আমি রাখবো এবং নিজের পরিচয়েই এই বাচ্চাটাকে বড় করব।”
“কি বলছিস ভেবে বলছিস তো তুই নিঝুম? এই সমাজে একটা বাচ্চাকে বাবার পরিচয় ছাড়া বড় করবি তুই?”
“তাছাড়া আমি কি করবো বলো আম্মু?”
“আমার মনে হয়, তোর আবরাজের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত। যতো যাইহোক এই বাচ্চাটা তো আবরাজেরই। ওরও তো একটা দায়িত্ব আছে।”
“তোমার মনে হয়, উনি এই বাচ্চার দায়িত্ব নেবেন? উনি তো আমাকেই মেনে নিতে চান নি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু বাচ্চাটাকে তো মানতে পারে।”
নিঝুমের মনে পড়ে যায় আবরাজের বলা শেষ কথাগুলো। সেসব ভেবে সে মনে মনে বলে,”ওনাকে যদি আমি এই বাচ্চার ব্যাপারে জানাই, তাহলে নিশ্চয়ই উনি এটাই সন্দেহ করবেন যেই এই বাচ্চাটা ওনার নয়। এই বাচ্চাটা ইমরানের। উনি তো আমাকে দুশ্চরিত্রা বলেই দিয়েছেন। এখন আর যাইহোক, এই বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আমি নিজের বাচ্চার দিকে কোন আঙুল উঠতে দেব না। আমি কিছুতেই এটা মেনে নেবো না, যে আমার বাচ্চাকে জারজ বলা হবে।”
তাই নিঝুম তার মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এই বাচ্চাটাকে আমি একাই মানুষ করব।”
বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। শান্তি বেগম নিঝুমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,”তুই যতো যাই বলিস না, কেন। এসব তোর আবেগের কথা। আমি বাস্তবতাটা বুঝি রে। তাই তোকে কোন ভুল পথে পা বাড়াতে দেব না। তোর মা হিসেবে তোর ভালোর চিন্তা আমাকেই করতে হবে।”
এমন ভাবনা থেকেই শান্তি বেগম ছবি বেগমের সাথে কথা বলতে যান। ছবি বেগম তখন বসে টিভি দেখছিলেন। শান্তি বেগমকে দেখেই তিনি টিভি বন্ধ করে বলেন,”শান্তি তুমি! আচ্ছা, নিঝুমের কি খবর গো? ও না ডাক্তার দেখাতে গেল। ডাক্তার কি বলল?”
“অনেক বড় খুশির খবর আছে আপা। আপনি দাদি হতে চলেছেন।”
ছবি বেগম অবাক হয়ে বলেন,”বাহ, এটা তো অনেক খুশির খবর। আমি আগেই জানতাম, একসাথে থাকলে ওদের মধ্যকার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আমার মনে হয়, ওদের মধ্যে সব ঠিক হয়েছিল তারপর আবার কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। নিঝুম তো আমাদের কিছু খুলে বলে নি। আমি একটা কাজ করি, আবরাজকে খুশির সংবাদ টা দিয়ে দেই।”
“জ্বি, আপা। আপনি আবরাজকে একটা ফোন দিন। আমি ওর সাথে কথা বলব। এরা দুজনেই অনেক জেদি। আমাদেরকেই এদের বোঝাতে হবে।”
“হুম।”
ছবি বেগম আবরাজকে কল দেন। আবরাজ তখন সবেমাত্র বার থেকে ফিরেছে। সে তখনো মদ্যপ ছিল। নেশার ঘোরে তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, নিঝুম ও ইমরানের একত্র অবস্থায় দেখে ফেলার ঘটনাটা। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠতেই সে বিরক্ত স্বরে বলে,”এত রাতে কে ফোন করল! ধুর!”
ফোনটা কোনরকমে রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে ছবি বেগম বলেন,”আবরাজ কেমন আছ তুমি?”
“ভালো, আপনি?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
শান্তি বেগম বলেন,”আপা আমায় ফোনটা দিন। আমি একটু আবরাজের সাথে কথা বলি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আবরাজ এই নে। তোর শাশুড়ী তোর সাথে কথা বলবে।”
শান্তি বেগম ফোনটা হাতে নিয়েই বলেন,”আবরাজ শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?”
“হুম, পাচ্ছি।”
“আমি নিঝুমের মা বলছি। দেখো বাবা,আমি জানি তোমাদের বিয়েটা সে অবস্থায় হয়েছে সেটা স্বাভাবিক ছিল না। এ নিয়ে তোমাদের মধ্যে ঝামেলা হওয়াও স্বাভাবিক। কিন্তু বিয়ে তো একটা পবিত্র সম্পর্ক। এটাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। তাই তোমরা যদি তোমাদের মধ্যে সব সম্পর্ক ঠিক করে নিতে..আর তোমাদের ভবিষ্যত..”
আবরাজের নেশা তখন বাড়ছিল তার উপর নিঝুমের নাম শুনে মাথায় রাগও চড়ে বসে। সে বলে ওঠে,”আপনার ঐ দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে আমি সংসার করবো এটা কিভাবে ভাবলেন?”
“কিসব বলছ তুমি বাবা? আমার মেয়ে এমন নয়।”
“আপনার মেয়ে কেমন সেটা আমি নিজের চোখে দেখছি। অন্য একটা ছেলের সাথে ওকে আমি একটা বদ্ধ রুমে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছি। আর আপনি এসেছেন আপনার সেই মেয়ের হয়ে দালালি করতে!”
শান্তি বেগমের বুকের বা পাশে হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভূত হয়। তিনি বলেন,”না, আমার মেয়ে এমন নয়।”
“আপনার মেয়ে এমনই। ও একটা চরিত্রহীন, একটা ব্যাভিচারী মেয়ে।”
ছবি বেগম শান্তি বেগমের দিকে খেয়াল করে বলেন,”কি হয়েছে তোমার শান্তি? হঠাত এমন করছ কেন?”
এদিকে শান্ত বেগম প্রচণ্ড ঘামতে থাকেন। তার বুকের ব্যাথা বাড়তে থাকে। তার মেয়েকে নিয়েই তো তার আশা ছিল৷ সব হারিয়ে এই মেয়েকে নিয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার চরিত্র সম্পর্কে এমন কথা তার সহ্য হয়না। শান্তি বেগম বুকে হাত দিয়ে পড়ে যান মাটিতে। নিঝুম এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। নিজের মাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে সে দ্রুত ছুটে এসে হলে,”আম্মু কি হয়েছে তোমার?”
শান্তি বেগম নিঝুমের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেন কিন্তু পারেন না। তার আগেই তার দুচোখ চিরজীবনের মতো বন্ধ হয়ে যায়।
to be continue…..
#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_30(নতুন বছরে নতুন অধ্যায়)
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নিঝুম অনিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে তার মায়ের নিথর দেহের পানে৷ তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। একটু আগেই ডাক্তার এসে বলে গেলেন, শান্তি বেগম আর বেঁচে নেই। ডাক্তারের বলা সেই শব্দটা এখনো নিঝুমের কানে বাজছে৷ সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না৷ যেন বিশাল এক ধাক্কা তাকে বধীর করে দিয়েছে। ছবি বেগম নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে কান্না আরম্ভ করলেন৷ কিন্তু নিঝুম একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে।
পুরো বাড়ি যেন হঠাৎ করে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল৷ শান্তি বেগমের মৃত্যুর খবর জানালো হলো নাজমুল খানকে। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, যেহেতু শান্তি বেগমকে তিনি ত্যাগ করেছেন তাই তার মৃত্যুতে তার কিছুই যায় আসে না। এদিকে শান্তি বেগমের শেষ বিদায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। নিঝুম পুরোটা সময় নিশ্চুপ পাথরের মূর্তির মতো হয়ে থাকে। নিঝুমকে এভাবে স্তব্ধ দেখে ছবি বেগম বলে ওঠেন,”এভাবে চুপ হয়ে থেকো না নিঝুম। কিছু একটু বলো…তোমার মা আর বেঁচে নেই। একটু কান্না করো।”
নিঝুমের তবুও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। নিঝুমের এই অবস্থা দেখে ছবি বেগম নিজেই কেঁদে ফেলেন। একজন মানুষটা কতটা কষ্ট পেলে এভাবে পাথর হয়ে যায়!
একটু পর জানাজার উদ্দ্যেশ্যে শান্তি বেগমকে নিয়ে যাওয়া হলো। নিঝুম শুধু নির্বিকার চোখে তাকিয়ে রইল। জানাজা শেষ হতেই যখন শান্তি বেগমকে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু হয় সেই সময় হঠাৎ নিঝুম দৌড়ে তার মায়ের খাটিয়ার সামনে গিয়ে বলে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমার আম্মুকে? আমার আম্মুকে নিয়ে যাবেন না দয়া করে। আমার আম্মু ছাড়া যে এই দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই। আমার আম্মুকে আমার থেকে আলাদা করবেন না।”
আলমগীর খান শান্তি বেগমের খাটিয়া বহন করছিলেন। তিনি নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”এমন পাগলামো করো না, নিঝুম। তোমার আম্মু মারা গেছেন। এই সত্যটা তোমায় মেনে নিতে হবে। কেউই চিরকাল বেঁচে থাকে না।”
নিঝুম বলে,”না, আমার আম্মু আমাকে ছেড়ে যেতে পারেন না। ভুল বলছেন আপনারা। আমার আম্মুকে আমার থেকে আলাদা করবেন না। নিয়ে যাবেন না আমার আম্মুকে।”
ছবি বেগম সহ তাদের পাড়া-প্রতিবেশী আরো কিছু মহিলা ছুটে এসে নিঝুমকে টেনে নিয়ে আসে। নিঝুম বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে আহাজারি করতে থাকে। ছবি বেগম তাকে থামানোর জন্য নিঝুমকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”শান্ত হও, নিঝুম। আল্লাহ তোমায় এই শোক সহ্য করার ক্ষমতা দিক।”
নিঝুম কাঁদতে কাঁদতে ওখানেই জ্ঞান হারায়।
——
রাতের বেলা, ছবি বেগম নিঝুমের সামনে ভাতের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নিঝুম হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ছবি বেগম নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”একটু কিছু মুখে দাও নিঝুম৷ এভাবে না খেয়ে থাকলে যে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। নিজের কথা না ভাবলেও নিজের বাচ্চাটার কথা ভাবো। তার জন্য হলেও তোমায় সুস্থ থাকতে হবে।”
নিঝুম মাথাটা তুলে বলে,”আম্মু কিভাবে পারল আমায় এভাবে ছেড়ে যেতে? আম্মু কি জানে না, সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই?”
“এটা তুমি কি বলছ নিঝুম? আমরা কি তোমার কেউ নই?”
নিঝুম হা করে তাকিয়ে থাকে ছবি বেগমের পানে। ছবি তুলতে নিঝুমের মুখের সামনে ভাত ধরে বলে,”এই ভাতটুকু খেয়ে নাও। এই অবস্থায় না খেয়ে থাকলে তো চলবে না।”
নিঝুম চোখের জল মুছে ভাতটুকু খেয়ে নেয়। ছবি বেগম বলেন,”এই তো ভালো মেয়ের মতো কথা শুনছ।”
এমন সময় আবির হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে এসে বলে,”আম্মু, আবরাজ ভাইয়া কল করেছিল। আমি আবরাজ ভাইয়াকে কাকির মৃত্যুর ব্যাপারে বললাম। সব শুনে ভাইয়াকে ভীষণ অস্থির লাগছিল। ভাইয়া বলল, নিঝুম আপিকে সামলানোর জন্য সে সিলেটে আসছে শীঘ্রই।”
নিঝুম এটা শুনেই ক্ষেপে গিয়ে বলে,”কেন আসবেন উনি এখানে? আমার মাকে মে*রে ফেলেও কি ওনার শান্তি হয়নি? এখন কি আমাকেও মারতে চান?”
ছবি বেগম বলেন,”তুমি এভাবে বলছ কেন নিঝুম? আবরাজ তো আর ইচ্ছা করে কিছু করে নি।”
“ওনার জন্যই আমার মা মারা গেছেন। আমি ওনাকে কক্ষনো ক্ষমা করবো না।”
“দেখো, আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থাটা কিন্তু…”
“চাচি, আমি একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?”
“হুম বলো।”
“আপনারা দয়া করে মিস্টার আবরাজকে জানিয়ে দিন, যে মায়ের মৃত্যুর পর আমি সিলেট শহর ত্যাগ করে কোথাও চলে গেছি। কোথায় গেছি সেটা বলে যাইনি এবং আমার খোঁজ না করতে বলেছি। আর আমি যে প্রেগন্যান্ট এটাও যেন উনি না জানেন।”
“এটা তুমি কি বলছ?”
“দয়া করে আমার এই কথাটা রাখুন, নাহলে আমি সত্যি সত্যি চলে যাব।”
“নিঝুম!”
নিঝুম উঠে বসে বলে,”আমার মায়ের খু**নির ছায়াও আমি আমার বা আমার বাচ্চার জীবনে পড়তে দিতে চাই না। এখন আপনারা ভেবে দেখুন আপনারা কি করবেন।”
আবির তার মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”নিঝুম আপির কথা মেনে নাও আম্মু। ওর এখন যা মানসিক অবস্থা যদি সত্যি এমন কিছু ঘটিয়ে ফেলে তাহলে কি হবে?”
‘কিন্তু…’
ছবি বেগম একটু চিন্তা করে বলেন,”বেশ, যদি এমনটাতেই নিঝুম ভালো থাকে তাহলে তাই হোক।”
সেদিনই ছবি বেগম আবরাজকে ফোন করে এসমস্ত কথা বলেন। এসব শুনে আবরাজ ভীষণ কষ্ট পায়। তার বুক ছিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে। কঠিন মানুষটার চোখেও জল৷ আবরাজ অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,”নিঝুম এভাবে কিভাবে সবটা ছেড়ে চলে গেল? একবার আমাকে সরি বলার সুযোগটাও দিল না। আমি তো সজ্ঞানে ওর মাকে কিছু বলিনি..সেই সময় আমি নেশাগ্রস্ত ছিলাম তাই না জানি কি বলতে কি বলে ফেলেছি..”
“জানি আবরাজ, তুমি স্বেচ্ছায় কিছু করো নি। আমরা চেষ্টা করছি নিঝুমকে খোঁজার। যদি কোথাও ওর খোঁজ পাই তাহলে তোমাকে জানাবো।”
আবরাজ ফোনটা রেখে দেয়। নিজের চোখের জল মুছে বলে,”এভাবে আমার জীবন থেকে একেবারে হারিয়ে গেলে নিঝুম। আর কখনো কি আমি তোমার দেখা পাবো না? সবকিছু শেষ করার একটা শেষ সুযোগ কি তুমি আমায় দেবে না?”
আবরাজের এই দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে তার এপার্টমেন্টের চার দেয়ালের মাঝে।
এদিকে, নিঝুম নিজের মায়ের ছবির উপর হাত বুলিয়ে বলে,”এখন আমি নিজের জীবনের উপর ফোকাস করব। আমার আম্মু তো চেয়েছিল আমি বড় ডাক্তার হই, আম্মুর সেই স্বপ্ন আমি পূরণ করবোই।”
অতঃপর সে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”একইসাথে নিজের অনাগত সন্তানকে আমাকে একটা সুন্দর জীবন দিতে হবে। আমার আম্মু আমায় যেভাবে আগলে বড় করেছে আমিও আমার বাচ্চাকে ঠিক সেভাবেই বড় করব।”
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
৫ বছর পর,
পুড়ো বাড়ি জুড়ে ছুট্টে বেড়াচ্ছে ৫ বছর ছুঁইছুঁই ছোট্ট একটা ছেলে। ছবি বেগম সেই বাচ্চাটার পেছনে সমানে দৌড়ে যাচ্ছে ভাত নিয়ে। বাচ্চাটা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই বলছে,”আম্মু না আসা পর্যন্ত আমি কিচ্ছু খাবো না।”
ছবি বেগম এক স্থানে দাঁড়িয়ে হাফাতে হাফাতে বলেন,”এমন করো না দাদুভাই, আমি বয়স্ক মানুষ তোমার সাথে সাথে কি দৌড়াতে পারি? এই ভাতটুকু খেয়ে নাও। তোমার আম্মুর আসতে একটু দেরি হবে।”
“না, না, না। আম্মু না আসা অব্দি আমি খাবো না মানে খাবো না।”
এমন সময় ডাক্তারি পোশাক পরিহিত নিঝুম সেখানে চলে আসল৷ নিজের ছেলের এহেন কথা শুনে বলে,”এটা কেমন কথা? আমার নির্ঝর না গুড বয়। ও না আমাকে কথা দিয়েছিল আমি না থাকলে গুড বয় হয়ে থাকবে।”
নিজের মায়ের কন্ঠ শুনেই দরজার দিকে তাকায় নির্ঝর। নিজের মাকে দেখতে পেয়েই ছুট্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,”ইয়ে, আমার আম্মু এসে গেছে। এখন আমার আম্মু আমায় নিজের হাতে খাইয়ে দেবে।”
নিঝুম হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলে,”আম্মু একটু ফ্রেশ হয়ে আসুক,তারপর নির্ঝরকে খাইয়ে দেবে।”
“হুম জানি তো, আম্মু বাইরে থেকে এসেছে তাই আম্মুর শরীরে অনেক জামস আছে। তাই আম্মুকে ফ্রেশ হতে হবে।”
নিঝুম প্রসারিত হেসে বলে,”এই তো আমার সোনা ছেলে। তাহলে ততক্ষণে তুমি গ্র্যানির হাতে খাওয়া শুরু করো, আচ্ছা?”
“ঠিক আছে।”
নিঝুম তার রুমের দিকে পা বাড়ায়। মনে মনে ভাবে,”সময় কত দ্রুত পেরিয়ে গেল!”
to be continue…..