অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
791

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_31
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আবরাজ দাঁড়িয়ে আছে লন্ডন ব্রিজের মধ্যে। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে সে প্রবাহমান টেমস নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে নানানো প্রশ্ন৷ এই পাঁচ বছরে তার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে, বয়স বেড়েছে সাথে মনের ক্ষতও গভীর হয়েছে। বিগত বছরগুলোয় সে একটিবারও দেশে ফেরেনি। ছবি বেগমের কাছে যা তথ্য পেয়েছে তাতে নিঝুম এখন ডাক্তার হিসেবে ঢাকা শহরে স্থায়ী হয়েছে। আবরাজ অনেকবার চেষ্টা করেছে নিঝুমের সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু নিঝুম সেরকম কোন সুযোগই রাখেনি। তাদের ডিভোর্স টাও এখনো কার্যকর হয়নি তাই নিঝুম এখন তারই স্ত্রী৷ অথচ আবরাজের অস্তিত্বই সে স্বীকার করতে চায় না। এসব ভেবেই আবরাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এমন সময় পিঠে কারো স্পর্শ পেতেই পিছনে ফিরে তাকায়৷ তার দিকে আকুল চোখে তাকিয়ে আছে এলিনা। মেয়েটার জীবনেও দুঃখের অন্ত নেই। বিয়ের পর ম্যাক্সের সাথে তার সংসার সুখেই চলছিল। তাদের ঘরে একটি ছেলে সন্তানও জন্ম নেয়, যার নাম এলেক্স। কিন্তু এত সুখ বোধহয় তাদের ভাগ্যে সহ্য হয়নি। আজ থেকে দুই বছর আগে একটা বিমান দূর্ঘটনায় ম্যাক্সের মৃত্যু ঘটে। তারপর এলিনা তার ছেলে এলেক্সকে নিয়ে একদম একা হয়ে পড়ে। এখন এলিনা ও আবরাজ দুজনেই তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। এলিনা আবরাজকে বিষন্ন দেখে জিজ্ঞেস করে,”আবারো নিঝুমের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছ?”

“কষ্ট না..কষ্ট না বড্ড অনুশোচনা হচ্ছে আমার। আজো আমার নিজেকে নিঝুমের মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে হয় জানো? আমি একটা রাতও ঠিকভাবে ঘুমাতে পারি না। যেদিন আমি জেনেছিলাম যে, নিঝুম কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে গেছে সেদিন থেকেই আমার এই অবস্থা। অতঃপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজে বাংলাদেশে গিয়ে নিঝুমকে খুঁজব এমন সময় আমার সৎমা আমায় জানালেন, নিঝুমের খোঁজ পাওয়া গেছে এবং ও এখন স্বাভাবিক আছে। আমি ওর সাথে কথা বলার সুযোগ চাই কিন্তু ও নাকি বলেছে আমার সাথে কোন কথাই বলতে চায়না। যদি আমি ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি তাহলে নাকি ও নিজেকে শেষ করে দেবে বা সত্যিই কোথাও হারিয়ে যাবে। এই কারণে আমিও আর এই বিষয়টা নিয়ে কোন জোরাজোরি করি নি। কারণ আমি চাই নি নিঝুমের কোন ক্ষতি হোক।”

“কিন্তু নিঝুমেরও তো বোঝা উচিত, যে তুমি সজ্ঞানে সেদিন কিছুই বলো নি। যা বলেছ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বলেছ।”

“সেটা ঠিক কিন্তু তবুও জ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানে আমার জন্যই তো নিঝুমের মা মারা গেছেন। এই দায় তো আমি অস্বীকার করতে পারি না।”

“তাহলে এখন কি করবে ভাবছ?”

“আমি ভাবছি খুব শীঘ্রই দেশে ফিরব। এতদিন ধরে আমি নিজেকে এটার জন্যই প্রস্তুত করছিলাম। দেশে ফিরে এবার আমি নিঝুমের সাথে দেখা করব। নিজে বসে ওর সাথে কথা বলব। আমাদের এই সম্পর্কটা যদি ও মেনে নিতে না পারে তাহলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্তি দিয়ে আসব যাতে অন্তত ও নতুন ভাবে জীবন টা শুরু করতে পারে। এতে আমি অন্তত কিছু টা দায়মুক্ত হবো।”

এলিনা বলে,”ম্যাক্সের মৃত্যুর পর আমি জীবন টাকে নতুন ভাবে অনুধাবন করতে পারছি আবরাজ। কাউকে ভালোবাসলে কতটা আত্মত্যাগ করা যায়, কতোটা নিজের কথা ভুলে তার চিন্তায় মগ্ন থাকা যায় সেটা আমি জানি। এই যে আমাকেই দেখো, ম্যাক্সের মৃত্যুর পর কম বিয়ের প্রস্তাব তো পেলাম না, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও চায় আমি বিয়ে করে নিজের জীবন আবার শুরু করি। প্রয়োজনে এলেক্সের দায়িত্বও তারা নিতে রাজি কিন্তু আমি পারলাম কৈ তা? ম্যাক্সকে আমি এতোটাই ভালোবাসি যে ওর মৃত্যুর পরেও ওর স্থান কাউকে দিতে পারছি না সেখানে তুমি কি পারবে নিঝুমের যায়গাটা অন্য কাউকে দিতে?”

আবরাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”এটা সম্ভব নয় এলিনা। তুমি তো জানো, আমি জীবনে কখনোই কাউকে ভালোবাসিনি। আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসা ছিল নিঝুম। যদিও ওকে আমি অন্য কারো সাথে….তবে আজ কেন জানি আমার মনে হয়, ওদের মধ্যে আসলে কিছু ছিল না। যদি থাকত তাহলে ইমরান আর নিঝুম নিশ্চয়ই এত গুলো বছরে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতো। হয়তো পুরোটা আমার ভুল ধারণা ছিল যার জন্য নিঝুমের মায়ের জীবন শেষ হয়ে গেছে। এর জন্য আমি অনুতপ্ত। আর সেজন্যই আমি নিঝুমকে মুক্তি দিতে চাই। কিন্তু আমি…আমি হয়তোবা নিঝুমের ভালোবাসা থেকে কখনো মুক্তি পাবো না। তবে আমি নিজের এই একতরফা অনুভূতির জালে ওকে আটকে রাখতে চাই না। আমি ওকে মুক্ত করে দিয়ে বাকি জীবনটা একাই কাটিয়ে দেব।”

এলিনা বুঝতে পারে আবরাজ আর সে একই পথের পথিক। ভালোবাসাকে হারিয়ে সারাজীবন একা থাকার প্রতিজ্ঞা তাদের দুজনেরই!

~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিঝুম তার ছেলে নির্ঝরকে খাইয়ে দিয়ে অতঃপর নিজেও একটু খেয়ে নিলো। এরমধ্যে সে নির্ঝরকে ঘুম পারিয়ে দিয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে লাগল। এমন সময় ছবি বেগম তার কাছে এলো। নিঝুম ছবি বেগম কে দেখে বলল,”চাচি, কিছু বলবেন?”

“নির্ঝর ঘুমিয়ে পড়েছে?”

“জ্বি।”

“ছেলেটা বড্ড জেদি হয়েছে জানো।”

‘হুম, তা একটু জেদি।’

“ওর মধ্যে যেন তোমার আর আবরাজের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। একই জেদ, রাগ তবে একটা ব্যাপারে ও এগিয়ে আছে। সেটা হলো ও কিছুটা হলেও বুঝদার। যদি তোমরাও ওর মতো একটু বুঝদার হতে তাহলে..”

“এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না চাচি।”

ছবি বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। নিঝুম বরাবরই বিষয়টা এভাবেই এড়িয়ে যায়। এরইমধ্যে হঠাৎ সেখানে চলে আসে মেডিকেল পড়ুয়া আনিকা। যে নিঝুমের মেডিকেল কলেজের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু যদিও তার থেকে দুই ব্যাচের ছোট। পরিচয়টা হয়েছিল আনিকার একটি এসাইনমেন্টে নিঝুমের সাহায্য নেয়ার মাধ্যমে। প্রথমে সিনিয়র-জিনিয়র সম্পর্ক থাকলেও একসময় তা বন্ধুত্বে রূপ নেয়। তবে তার আরও একটা পরিচয় আছে। সে আবিরের প্রেমিকা এবং হবু স্ত্রী। কিছু দিনের মধ্যেই তাদের বিয়ে। আনিকার সাথে আবিরের পরিচয় মূলত নিঝুমের মাঝেই। চলাফেরা করতে অক্ষম আবিরের সাথে দেখা করেই তার প্রতি কিছুটা করুণা তৈরি হয়েছিল আনিকার মনে। সেই করুণাই যে কখন ভালোবাসায় রূপ নেয় সেটা সে নিজেও জানে না। এক সময় তারা দুজন একে অপরের গভীর প্রেমে পড়ে। তাদের ভালোবাসার পথটা মসৃণ ছিল না। আবিরের এই অক্ষমতার জন্য আনিকার পরিবার তাদের এই সম্পর্কটা শুরু তে একদমই মেনে নেয়নি কিন্তু আনিকা নিজের জেদে অটল থেকে তাদের রাজি করিয়েছে। যার ফলস্বরূপ এখন তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার পথে।

আনিকা এসেই সবার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”কেমন আছ তোমরা সবাই?”

আনিকাকে দেখেই নিঝুম খুশি হয়ে বলে,”তুমি। কখন এলে/”

“এই তো এখন। আচ্ছা আমার নির্ঝর বাবু কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?”

‘হ্যাঁ, একটু আগেই ঘুমালো।’

“ওহ, ওর জন্য এই চকলেট গুলো এনেছি। রেখে দে তো।”

এমন সময় কেউ পেছন থেকে বলে উঠল,”তোমায় না কতবার বারণ করেছি নির্ঝরের জন্য এমন আনহেলদি খাবার আনবে না। ক্যাবেটি হবে তো?!”

আনিকা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে আসছে আবির। তাকে দেখেই সে মুখ বাকিয়ে বলে,”আহ আসছেন আমার মিস্টার খারুশ। আমি একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট বুঝলে? আমায় তোমার জ্ঞান দিতে হবে না।”

“তুমি মেডিকেল স্টুডেন্ট হতে পারো তবে আমাদের বাডিতে একজন ডাক্তার আছে। তাই আমারও এই বিষয়ে জানা আছে।”

এই নিয়ে তাদের দুজনের মাঝে ছোটখাটো একটা তর্ক লেগে যায় এবং ছবি বেগম ও নিঝুম এসব দেখে হেসে ফেলেন। ছবি বেগম বলেন,”যাক,আমার ছেলেটাকে সামলানোর জন্য কেউ তো এলো!”

to be continue…..

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_32
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুম ঘরে এসে ঘুমন্ত নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে হাসল। অতঃপর ছেলের মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,”তোমাকে ঘিরেই এখন আমার পুরোটা জীবন। আমার এই কষ্টে ভরা জীবনে তুমি আশা নিয়ে এসেছ। তোমার জন্যই আমি আজ অব্দি বেঁচে আছি নাহলে কবেই নিজেকে শেষ করে দিতাম! এখন আল্লাহর কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা করি,কেউ যাতে কোনদিনও তোমার থেকে আমায় আলাদা করতে না পারে।”

দরজায় দাঁড়িয়ে এসমস্ত দৃশ্য দেখেন ছবি বেগম। মা-ছেলের বন্ধন দেখে তার ভীষণ ভালো লাগে। তবে একইসাথে নিজের বক্ষে তীব্র ব্যাথাও অনুভূত হয়। তার কেন জানি বারংবার এটাই মনে হয় যে, তিনি ছোটবেলায় যেমন আবরাজকে তার বাবার থেকে আলাদা করে তার শৈশবের সমস্ত আনন্দ কেড়ে নিয়েছেনে ঠিক তেমনি একইভাবে তার সন্তানের কথা তার থেকে গোপন রেখে তাকে পিতৃত্বের স্বাদ থেকেও বঞ্চিত করছেন। এই অনুশোচনা নিয়ে তিনি প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে গিয়েও শান্তি পান না। এসব ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তিনি সরে আসেন। ড্রয়িংরুমে এসে দেখতে পান তার স্বামী আলমগীর খান বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন।

ছবি বেগমকে দেখেই তিনি বলে ওঠেন,”কি হলো? তোমায় এমন লাগছে কেন?”

ছবি বেগম আফসোস এর সুরে বলেন,”ঐ একই ভাবনা যা আমায় দীর্ঘ ৫ বছর থেকে শান্তিতে দিচ্ছে না।”

আলমগীর খান গম্ভীর স্বরে বলেন,”এই ব্যাপারে আমি আগেও তোমাকে বলেছি। দেখো, নির্ঝর আমার বংশের সন্তান, ও আমার নাতি হয়..অথচ ওর নিজের বাবাই ওর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। ব্যাপারটা কি এতটাই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পেরেছি আমি? মোটেই না, আমি নিজেও তোমার আর নিঝুমের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত এটা নিয়ে। এমনিতেই ছোটবেলায় আমি নিজের ছেলেকে ওভাবে একা ফেলে যাওয়ায় আজ অব্দি ওর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারিনি, আমার ছেলেটা আমাকে বাবা বলে ডাকে না। তার উপর ও যখন জানবে, ওর সন্তানের পরিচয় আমি এত গুলো বছর লুকিয়ে রেখেছিলাম তখন তো আমার মুখের উপর থু থু ছিটাবে। কিন্তু আমারও যে হাত-পা বাঁধা৷ নিঝুম আর তোমার জেদের কাছে বারংবার হার মানতে হলো আমায়। তবে এবার আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আর চুপ থাকব না। এতদিন যা হওয়ার হয়েছে এবার আমি আবরাজকে সমস্ত সত্যটা জানাবো। সামনেই তো আবিরের বিয়ে। আবরাজকেও আমি আবিরের বিয়ে উপলক্ষে দেশে আসতে বলব। তারপর ও দেশে ফেরার পর ঠাণ্ডা মাথায় বসে ওকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলব। তারপর যা হবার হবে।”

নিজের স্বামীর মুখে এহেন কথা শুনে চমকে ওঠেন ছবি বেগম। বলে ওঠেন,”এটা তুমি কি বলছ? এমনটা হলে যে নিঝুম আর আবরাজের মধ্যে আবার একটা নতুন লড়াই বেধে যাবে!”

“তো আর কি করব আমি? হাত-পা গুটিয়ে অনেক বসে থেকেছি আর নয়।”

“আমার কথাটা মনযোগ দিয়ে শোন, আবরাজ ও নিঝুমের মধ্যকার সম্পর্কটাকে কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। আমি নিঝুমকে নানা ভাবে বুঝিয়ে এই পাঁচ বছর ওদের সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছি৷ তাই, আমি চাই এবার ওদের পুনঃমিলনের ব্যবস্থা করতে। আমি চাই আবরাজ, নিঝুম, নির্ঝর সবাই একত্রে মিলে একটা সুখী সংসার গঠন করুক।”

“সেটা কিভাবে সম্ভব?”

“সবটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি নিজে আবিরের বিয়ে উপলক্ষে আবরাজকে দেশে আসতে বলব। তারপর সমস্ত ব্যাপার আমি সামলে নেব।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কয়েক দিন পর,
আবরাজ নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পায় দৌড়াতে দৌড়াতে এলেক্স এগিয়ে আসছে। সে এসেই আবরাজকে বলে,”আঙ্কেল, তুমি কি কোথাও যাচ্ছ?”

আবরাজ হেসে এলেক্সকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”হ্যাঁ, এলেক্স আমি সিলেটে যাচ্ছি।”

এলেক্স অনেক কষ্টে বলে,”সি…সিল.. এটা কোথায়?”

“এটা বাংলাদেশে। আমার বাসা তো ওখানে।”

“ও, তাহলে আমাকেও ওখানে নিয়ে চলো না আঙ্কেল। আমিও তোমার সাথে যেতে চাই।”

“ওখানে যেতে তো অনেক সময় লাগবে। এখন তো তোমায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এরপর যদি আমি কখনো যাই, তাহলে তোমায় নিয়ে যাব। কেমন?”

“আচ্ছা।”

এমন সময় এলিনাও চলে আসে। সে এসে আবরাজকে বলে,”তাহলে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবার নিজের দেশে ফিরছ?”

আবরাজ বলে,”হুম। আমার সৎমা ভীষণ অনুরোধ করল যেতে। বলল, পরশু নাকি ওনার ছেলের বিয়ে। তাছাড়া আমার নিজেরও ইচ্ছা ছিল ফেরার। এবার আমি দেশে ফিরেই নিঝুমের মুখোমুখি হবো৷ নিঝুমের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে সেসব মিটিয়ে নেব।”

“যাই করো ভেবে চিন্তে করো। তোমাদের সম্পর্ক এমনিতেই খুব একটা ভালো না আর..”

“আমি নিঝুমের উপর আর কোন জোর করব না। এবার শুধু ওর কাছে এটুকুই জানতে চাইব ও এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চায় কিনা৷ যদি ও মুক্তি চায় তো মুক্তি দিয়ে ফিরে আসব।”

বলেই আবরাজ নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এলিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তুমি মুখে যতো যাই বলো, আমি জানি তুমি নিঝুমকে কতটা ভালোবাসো। আমি গডের কাছে প্রার্থনা করব যেন তোমরা নিজেদের মধ্যে সব ভুল-বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিতে পারো।”

অতঃপর সেও এলেক্সকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

~~~~~~~~~~~~~~~
১ দিন পর,
পুরো খান ভিলা যেন এখন এক নতুন রূপে সেজে উঠেছে। আগামীকাল আবিরের সাথে আনিকার বিয়ে। সেই বিয়েরই আয়োজন চলছে পুরো বাড়িজুড়ে। নির্ঝরের জন্য যেন এই বিয়ে এক উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করেছে। সে তো আজ সারাদিন বাড়িজুড়ে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। নিঝুমও নিজের ছেলের এই আনন্দে আনন্দিত। তবে তবুও সে নির্ঝরকে সতর্ক করে বলল,”নির্ঝর শোনো, গুড বয় হয়ে থাকবে। আমি এখন হাসপাতালে যাচ্ছি। ফিরে এসে যেন তোমার গ্রানির কাছে না শুনি যে তুমি কোন দুষ্টামি করেছ, কেমন?”

“আচ্ছা, আম্মু। নির্ঝর কথা দিচ্ছে সে কোন দুষ্টামি করবে না।”

নিজের ছেলের মুখে এই কথা শুনে নিঝুম তার গালে একটা হামি দেয়। অতঃপর সামনের দিকে পা বাড়ায়। ছবি বেগম নিঝুমকে যেতে দেখে তার মুখোমুখি হয়ে বলেন,”আজকের দিনে হাসপাতাল না গেলেই নয়?”

“আসলে চাচি অনেক রোগী এসেছে সিলেট মেডিকেলে..আমার এমনিতেই আগামীকাল ছুটি নেয়া। তাই আজ আর নতুন করে ছুটি ম্যানেজ করা যায়নি।”

‘ওহ, ঠিক আছে। তবে চেষ্টা করো আজ তাড়াতাড়ি আসার।’

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব আজ যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার।”

বলেই নিঝুম বেরিয়ে যায়। নিঝুম বেরিয়ে যেতেই ছবি বেগমের মুখে রহস্যময় হাসি দেখা যায়। মনে মনে বলেন,”এবার সবকিছু ঠিক হবার পালা। একটি ভাঙা পরিবার জোড়া লাগার পালা।”

নির্ঝর তখনো নিজের মতো খেলার ছলে ব্যস্ত ছিল। ছবি বেগম নির্ঝরের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বলেন,”এই ছোট্ট ছেলেটার জীবনেও এবার বাবার ভালোবাসা আসুক।”

এমন সময় নির্ঝরের খেলনা বলটি গড়িয়ে গড়িয়ে দরজার দিকে যায়। নির্ঝর বলটি নিতে ছুটে যায় দরজার দিকে। এমন সময় দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় কেউ। অতঃপর নিজের হাতে সেই বলটা তুলে নেয়। নির্ঝর আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা আমার বল, আমায় দিয়ে দাও।”

আগন্তুক বলে,”তাই বুঝি? তোমার বল এটা?”

“হুম, দাও আমায়। অন্যের জিনিস নেয়া পচা কাজ।”

“এটা তোমায় কে বলেছে?”

“আমার আম্মু বলেছে।”

“তোমার আম্মু কোথায়?”

“আমার আম্মু হাসপাতালে গেছে। আমায় বলটা দাও।”

আগন্তুক বিস্মিত চোখে নির্ঝরের দিকে তাকায়। এমন সময় ছবি বেগম দরজার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ওঠেন,”আবরাজ, তুমি এসেছ!”

to be continue…..

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_33
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আবরাজ তখনো অব্দি নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে ছিল অবাক চোখে। ছবি বেগম এগিয়ে এসে আবরাজকে বলল,”কত বছর পর তুমি দেশে ফিরলে। আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”

আবরাজ হালকা হেসে বলল,”না, কোন অসুবিধা হয়নি।”

ততক্ষণে নির্ঝর তার বল নিয়ে খেলতে খেলতে আবারো সামনের দিকে চলে গেছে৷ আবরাজের চোখে রেখে গেছে হাজারো প্রশ্ন। ছবি বেগম সবটাই পরখ করছিলেন। তিনি আবরাজকে বলেন,”যাও, তোমার জন্য আমি গেস্টরুমটা পরিস্কার করে রেখেছি। ওখানে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

আবরাজ মাথা নাড়িয়ে বলে,”আচ্ছা, ঠিক আছে। তবে বাচ্চাটা কে ছিল? বেশ কিউট তো!”

ছবি বেগম আবরাজের মুখে এই কথা শুনে মনে মনে চাপা কষ্ট অনুভব করেন। তার ইচ্ছা করছিল আবরাজকে এখনই সমস্ত সত্যটা জানিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি অপারগ ছিলেন৷ তিনি চান না,এখনই আবরাজ সবটা তার মুখ থেকে শুনুক। তিনি চান, আবরাজ ও নিঝুম নিজেরাই নিজেদের সব মিটমাট করে নিক। তাই তো তিনি বলেন,”ও তো আমাদের এক আত্মীয়র ছেলে। তুমি চিনবে না। যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।”

আবরাজ গেস্টরুমের দিকে পা বাড়ায়। ছবি বেগম আবরাজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”আশা করি,এবার সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে তোমার আর নিঝুমের পুনঃমিলন ঘটবে। তোমাদের সন্তানও একটি সুন্দর জীবন পাবে।”

~~~~~~~~~~~~
নিঝুম হাসপাতালে এলেও তার মনটা কেমন জানি ছটফট করছিল। নিঝুম বুঝতে পারে না হঠাৎ করে তার এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে। সে নিজের চেম্বারেই বসে ছিল৷ হঠাৎ করে একজন নার্স তার কেবিনে এসে বলে,” ডক্টর নিঝুম, আসব?”

নিঝুম নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে,”জ্বি, কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ, আসলে একজন নতুন পেশেন্ট এসেছেন। উনি সম্ভবত মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন কিছু সিন আগে কিন্তু সঠিক সময় চিকিৎসা করান নি৷ এখন ওনার মাথা বেশ ফুলে গেছে। আপনি যদি ওনাকে একটু চেক করে দিতেন।”

“আপনি যান, আমি আসছি।”

বলেই নিঝুম উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ায় নিউরোলজি ডিপার্টমেন্টের দিকে। কারণ বর্তমানে সে একজন নিউরোলজিস্ট। কেবিনে প্রবেশ করতেই নিঝুম হতবাক হয়ে যায়। কারণ হসপিটাল বেডে রোগী হয়ে শুয়ে ছিলেন নাজমুল খান! নিঝুমের বাবা। এতদিন পর নিজের বাবার মুখোমুখি হয়ে নিঝুম যতটা না অবাক হয় তার থেকেও বেশি অবাক হয় তাকে এই অবস্থায় দেখে। নিজের বিস্ময়তা কাটিয়ে এগিয়ে যায়। অতঃপর জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে আপনার?”

নিঝুমের কন্ঠ শুনে ভীষণ কষ্টে তার দিকে ফিরে তাকান নাজমুল খান। কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে থাকেন নিঝুমের পানে। অতঃপর মলিন হেসে বলেন,”বেশি কিছু না। এসবই আমার পাপের ফল।”

নিঝুম নিশ্চুপ। নাজমুল খান বলতে থাকেন,”কোথাও একটা শুনেছিলাম, আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না আজ সেটার সত্যতার প্রমাণ পেলাম। জানেন, ডাক্তার আমি না জীবনে অনেক পাপ করেছিলাম….আমার স্ত্রী-সন্তানের সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আমার মেয়ের জীবন আমি বরবাদ করে দিয়েছি। নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও তাকে দেখতে যাইনি….নিজের আপনজনকে ভুলে অন্য এক নারীকে আপন করে নিয়েছিলাম। অথচ যার জন্য আমি নিজের পরিবারকে ত্যাগ করেছিলাম সেই আমাকে ত্যাগ করে দিল! এক বছর আগে, আমার ব্ল্যাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। এটা জানার পরপরই আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আমায় ত্যাগ করে চলে যায়। তারপর থেকে আমি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি। চিকিৎসা করলে হয়তো আমায় সারানো যেত কিন্তু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা আমার কাছে ছিল না। তার উপর এই রোগে আক্রান্ত হবার পর আমাকে নিজের অতীতের করা পাপগুলো কষ্ট দিচ্ছিল তাই আমি নিজেই এই রোগটাকে নিজের জন্য একটা শাস্তি হিসেবে দেখতে শুরু করি৷ আর তেমন চিকিৎসাও করিনি। ধীরে ধীরে রোগটা আমায় তীব্র যন্ত্রণা দিতে থাকে। কিছুদিন আগে তো ডাক্তার বলে দিলেন,আমি লাস্ট স্টেজে আছি আর বেশিদিন বাঁচব না। এরইমধ্যে আবার একদিন বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাই। অনেক রক্তও পড়ে। আমি এটাকেও নিজেদের শাস্তি হিসেবে নেই। ডাক্তার দেখাই না।”

নিঝুমের কেন জানি এবার কিছুটা কষ্ট অনুভব হয় নাজমুল খানের জন্য। যদিও তিনি যা করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য কিন্তু হাজার হোক বাবা তো! তাই সে বলে,”আপনার উচিৎ ছিল ডাক্তার দেখানো। আপনি যা অন্যায় করেছেন তার শাস্তি আল্লাহ আপনাকে নিশ্চয়ই দেবে কিন্তু নিজে থেকে এভাবে শাস্তি ভোগ করার তো মানে হয়না।”

নাজমুল খান কেঁদে উঠে বলেন,”কি করব ডাক্তার বলুন? আমি যে একটা রাতও ঠিক করতে ঘুমাতে পারি না। অতীতের করা অন্যায় গুলো আমায় ভীষণ কষ্ট দেয়। আমার স্ত্রীর কাছে আমি ক্ষমা চাইতে পারিনি,সেই সুযোগ আর পাবো না। তবে আমি নিজের মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে চাই। আমি জানি,আমার জন্য আমার মেয়ের জীবনটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে আমি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছি। এসবের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ওর কাছে ক্ষমা চাই। জানি ও হয়তো আমায় ক্ষমা করবে না কিন্তু এর থেকে বেশি যে আমার কিছু করারও সামর্থ্য নেই। জানেন, তাকে নিজের বাবা বলে পরিচালনা দেওয়ারও সামর্থ্য আমার আর নেই এতোটাই অন্যায় করেছি আমি।”

নিঝুম নিজেকে সামলে বলে,”আমি আপনার মাথায় ড্রেসিং করে দিচ্ছি আর কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। সেসব খেয়ে নেবেন কিছুটা স্বস্তি অনুভব করবেন।”

বলেই নিঝুম নাজমুল খান এর মাথায় ড্রেসিং করে দিয়ে কিছু মেডিসিন লিখে দিয়ে চলে যায়। নাজমুল খান নিঝুমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলেন,”আমি জানতাম রে, তুই আমায় কখনো ক্ষমা করবি। আমি তোর ক্ষমার যোগ্যও না। তবে আল্লাহর কাছে এতটুকুই চাইব, যদি আমি জীবনে কোন একটাও ভালো কাজ করে থাকি তাহলে সেই ভালো কাজের বিনিময়ে হলেও তোর জন্য সুখের দোয়া করছি সেটা যেন কবুল হয়। নাহলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না। আমার অন্যায়ের ফল তোকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হলে যে আমার রুহ শান্তি পাবে না! হে আল্লাহ, তুমি আমার মেয়েটার জীবনে একটু সুখের হদিস দাও। ওকে আর কষ্টে রেখো না।”

বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি।

~~~~~~~~~~~~~
আবরাজ আবিরের সাথে দেখা করে। আবির আবরাজকে দেখে ভীষণ খুশি। আবরাজকে তো সে নিজের বড় ভাই হিসেবেই সম্মান দেয়। আবরাজ আবিরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমি যেই নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছ, তা যেন সুখের হয়। এই দোয়াই করি।”

“আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া।”

আবরাজ স্মিত হাসে। হঠাৎ করেই তার মনে পডে যায় নিঝুমের কথা। নিঝুমের সাথে তার বিয়ে, তারপরের সমস্ত ঘটনা। সেও তো অনেক আশা নিয়ে এভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল। অথচ বিয়ের আসরে তার সমস্ত আশা ভেস্তে যায়। এতে কি তার রাগ হওয়া স্বাভাবিক ছিল না? এজন্যই তো নিঝুমের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল সে।

এদিকে আবির ভাবে আবরাজের থেকে সে এতদিন সব সত্য লুকিয়েছে কিন্তু এবার আর না। এবার সে সমস্ত সত্য আবরাজকে বলে দেবে। এতে তার মা আর নিঝুম যা প্রতিক্রিয়া দেখায় দেখাক। তাই আবির আবরাজকে বলে,”ভাইয়া, আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।”

“হ্যাঁ, বলো।”

“আমি জানি না,এসব শোনার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। হয়তো আপনি অনেক অবাক হবেন,রেগেও যেতে পারেন। কারণ ব্যাপারটা নিঝুম আপিকে নিয়ে!”

নিঝুমের নাম শুনতেই আবরাজ চমকে ওঠে। বিস্মিত স্বরে বলে,”নিঝুম! কোথায় ও? তুমি কি ওর কোন খবর জানো?”

আবির বলে,”হুম, জানি। আপি এই বাড়িতেই আছে আর…”

আবির নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারে না এমন সময় নিঝুম সেখানে চলে আসে। এসেই বলে ওঠে,”আবির, আনিকা নাকি তোমায় ফোন করছে বারবার। তুমি রিসিভ করছ না কেন? ও কিন্তু রেগে গেছে।”

বলেই হালকা হাসে। তখনো নিঝুম আবরাজকে লক্ষ্য করে নি। সে জানেও না আবরাজ দেশে এসেছে। একটু আগেই সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। এদিকে নিঝুমের কন্ঠ শুনেই পেছন ফিরে তাকায় আবরাজ। দীর্ঘ ৫ বছর পর নিঝুমকে দেখে সে অবাক। নিঝুমেরও নজর যায় আবরাজের দিকে। দীর্ঘ ৫ বছর পর আজ তারা আবারো মুখোমুখি!

to be continue…..