অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-৩৬+৩৭

0
836

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_36
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আবরাজ নিঝুমের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। তার সব হিসেব কেন গোলমেলে লাগছে। নির্ঝরের ভাষ্যমতে নিঝুম তার মা কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? তাহলে নির্ঝরের বাবা কে? এই প্রশ্নই ঘুরছে তার মাথায়৷ এদিকে নিঝুম পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কি করবে কিছু বুঝতে পারছিল না। যেই ভয়টা সে পাচ্ছিল অবশেষে সেটাই কি তবে সত্য হলো?! নিঝুম ভাবতে লাগল এখন কিভাবে সে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।

নিঝুমের ভাবনার মাঝেই আবরাজ বলে ওঠে,”নির্ঝর তোমার ছেলে নিঝুম? তাহলে ওর বাবা কে?”

নিঝুম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। নির্ঝর পরিস্থিতির কিছুই আঁচ করতে পারে না। সে আবরাজের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,”তুমি আমার আম্মুর নাম কিভাবে জানলে সুপারহিরো? তুমি কি আমার আম্মুকে চেনো?”

আবরাজ নির্ঝরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”অনেক ভালো ভাবেই চিনি।”

নিঝুম বুঝতে পারছিল না এখন সে কি করবে। তবে এই পরিস্থিতিতে তার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই সে আবরাজলে এড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইল। নির্ঝরের হাত ধরে বলে উঠল,”চলো এখান থেকে।”

নিঝুম সামনের দিকে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় আবরাজ নিঝুমের পথ আটকে ধরল। নিঝুম আর এগোতে পারল না। আবরাজের চোখে আজ বিস্ময় এবং ক্রোধ। এত দিন নিঝুম তার থেকে অনেক কিছু গোপন করেছে কিন্তু আজ সে সব প্রশ্নের উত্তর জানবেই। এটাই সংকল্প করে নিয়েছে আবরাজ। তাই সে নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুমি আর এক পাও সামনে এগোতে পারবে না, নিঝুম। এতদিন তুমি অনেক কিছুই লুকিয়েছ আমার থেকে কিন্তু আর নয়।”

নিঝুম বলে,”আমার সামনে থেকে সরুন প্লিজ।”

“না, আজ আমি সরবো না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিচ্ছ ততক্ষণ আমি এখান থেকে একটুও সরবো না। বলো নির্ঝর তোমাকে আম্মু বলছে কেন? ও কি তোমার সন্তান?”

“হ্যাঁ, নির্ঝর আমার ছেলে। আমি ওর মা।”

কাপা কাপা কন্ঠে বলে নিঝুম। আবরাজ জিজ্ঞাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”তাহলে ওর বাবা কে?”

নিঝুম এবার আর কিছু বলে না। আবরাজের ধৈর্যের সীমা অতিক্রম হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলে,”চুপ করে আছ কেন? বলো ওর বাবা কে? আমার জানামতে, যেহেতু আমার সাথে তোমার এখনো ডিভোর্স হয়নি তাই তুমি এখনো বিয়েও করো নি। তাহলে তোমার বাচ্চা এলো কোথা থেকে? নাকি এটা কোন অবৈধ…”

“মিস্টার আবরাজ!”

হুংকার দিয়ে বলে ওঠে নিঝুম। নির্ঝরের হাত শক্ত করে ধরে বলে,”নিঝুম আমার সন্তান ও পবিত্র ওকে নিয়ে এমন কথা আমি বরদাস্ত করব না। আপনি নিজের সীমা অতিক্রম করবেন না।”

আবরাজ ক্রোধে ফেটে পড়ে নিঝুমকে শক্ত করে ধরে বলে,”আমি সীমা অতিক্রম করছি? নাকি তুমি করছ? একেই তোমার বাবা আমাকে ঠকিয়ে তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিল যার কারণে প্রথম প্রথম আমি তোমায় মেনে নিতে পারি নি আর তারপর যখন তোমায় মেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম তখন তুমি নিজের জেদ দেখিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিলে। নিজের বন্ধু ইমরানের সাথে…..আমি তো আরো ভেবেছিলাম সবটা আমারই ভুল ছিল৷ এই ভেবে ৫ বছরে কত কষ্ট পেলাম অথচ এই ৫ বছর পর তো মনে হচ্ছে আমার ভাবনাই ঠিক ছিল। শুধু শুধুই তোমার মতো একটা চরিত্রহীন মেয়ের জন্য আমি নিজের জীবনের ৫ টা বছর নষ্ট করলাম। এই বাচ্চাটা নিশ্চয়ই তোমার আর ইমরানের নষ্টামির ফসল তাই না?”

নিঝুম আর নিজেকে সামলাতে পারে না। ঠাস করে থা*প্পড় বসিয়ে দেয় আবরাজের গালে। ক্রোধান্বিত স্বরে বলে,”ব্যস, অনেক বলে নিয়েছেন আপনি। আর না। এবার আপনার মুখটা বন্ধ করুন। নির্ঝর আমার ছেলে আর এটাই ওর একমাত্র পরিচয়। বুঝলেন? ওকে নিয়ে আর একটা খারাপ কথাও বলবেন না।”

এদিকে এতক্ষণ ধরে চিৎকার চেচামেচিতে চারপাশে অনেক লোক জমে গেছে। তাদের সবার ভীড় ঠেলে ছবি বেগম এগিয়ে এসে বলেন,”তোমরা এখানে আর কোন ঝামেলা করো না। এটা আমার অনুরোধ। এটা আমাদের নতুন কুটুম বাড়ি৷ এখানে এসব ভালো দেখাচ্ছে না। আবরাজ, নিঝুম তোমরা বাড়িতে ফিরি চলো। ওখানে বসে ঠান্ডা মাথায় কথা বলা যাবে।”

আবরাজ এবার ছবি বেগমকেও রাগ দেখিয়ে বলে,”আপনি চুপ করুন! আপনিও আমাকে কম ঠকান নি। কি যেন বলেছিলেন? নির্ঝর আপনার কোন আত্মীয়র ছেলে। এই নিঝুমের পাশাপাশি আপনিও আমার সাথেও ৫ বছরই ধরে প্রতারণা করছেন। সমস্ত সত্যটা জেনেও আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। আপনার আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না। আপনারা সবাই ঠকবাজ। আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকব না। তবে যাওয়ার আগে আমি এই চরিত্রহীন মেয়েটার সাথে নিজের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে যাব।”

বলেই আবরাজ নিঝুমের হাতটা শক্ত করে ধরে। অতঃপর সবার সামনে থেকে টানতে টানতে তাকে নিয়ে যেতে থাকে। নিঝুম বলে ওঠে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

আবরাজ বলে,”এসেছিলাম তোমাকে মুক্তি দিতে তবে এবার আমি নিজে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাবো। তোমার মতো একটা ঠকবাজ, দুশ্চরিত্র মেয়ের ছায়াও নিজের উপর আর পড়তে দেব না।”

নিঝুমের দুই চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। আবরাজ নিঝুমকে নিয়ে জোরপূর্বক গাড়িতে ওঠায়। অতঃপর গাড়ি নিয়ে যেতে থাকে কোর্টের দিকে। এদিকে নির্ঝর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সমস্ত ঘটনায় সে বেশ ঘাবড়ে গেছে। তাই তো ছবি বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,”সুপারহিরো আম্মুকে কোথায় নিয়ে গেল গ্রানি? আমার তো ভীষণ ভয় করছে।”

ছবি বেগম বলেন,”চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আলমগীর খান এগিয়ে এসে ছবি বেগমকে বলেন,”এজন্যই আমি চেয়েছিলাম আবরাজকে সমস্ত সত্যটা জানাতে। এখন পরিস্থিতি কেমন হয়ে গেছে দেখলে? আমাত কথা তো তখন শুনলে।”

বরবেশে থাকা আবিরের মধ্যেও চিন্তার ছাপ। আনিকা নিজের সদ্য বিবাহিত স্বামীর চিন্তাটা বুঝতে পারছে। আবির হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে এসে ছবি বেগমকে জিজ্ঞেস করে,”এখন কি হবে আম্মু? আবরাজ ভাইয়া কি এবার সত্যি নিঝুম আপিকে ডিভোর্স দিবে? ওদের কি আর এক হওয়া হবে না?”

ছবি বেগম বলেন,”ওদের ডিভোর্স কিছুতেই হবে না। ওরা এবার এক হবেই।”

আলমগীর খান হতাশ স্বরে বলেন,”এত কিছুর পরেও তুমি কোন মুখে এই কথা বলছ?”

“বলছি তার কারণ আছে।”

এরইমধ্যে তার ফোন বেজে ওঠে। ছবি বেগম ফোন রিসিভ করেই হাসিমুখে বলেন,”আপনারা এসে গেছেন? আসলে একটা সমস্যা হয়ে গেছে আপনারা আসার আগেই আবরাজের সামনে সমস্ত সত্যটা চলে এসেছে। তাই আবরাজ রেগে গিয়ে নিঝুমকে নিয়ে আদালতের দিকে গেছে। আপনি এখন সংকরপুর আদালতের দিকে যান। ওখানে গেলেই ওদের দেখা পাবেন।”

বলেই তিনি ফোন রেখে দেন। আলমগীর খান প্রশ্ন করেন,”কার সাথে কথা বললে তুমি? কে এসেছে?”

ছবি বেগম তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলেন,”এমন কেউ যে তাদের মধ্যকার সবকিছু ঠিক করতে পারবে।”

~~~~~~~~~~~
নিঝুমকে টানতে টানতে কোর্টের ভেতরে নিয়ে আসে আবরাজ। অতঃপর গলা খাকারি দিয়ে তার উকিল মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনাকে যেই ডিভোর্স পেপারস রেডি করতে রাখতে বলেছিলাম তা এক্ষুনি এদিকে দিন।”

আবদুল হাকিম এমন ধমক শুনে দ্রুত ডিভোর্স পেপারস বাড়িয়ে দেয় তাদের দিকে। আবরাজ নিঝুমের দিকে ডিভোর্স পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে,”জলদি এখানে সই করে আমায় মুক্তি দাও এই সম্পর্ক থেকে।”

নিঝুমের চোখ তখন অশ্রুজলে পূর্ণ। যেমনটা ছিল বিয়ের দিন। কাপা কাপা হাতে সে ডিভোর্স পেপারসে সই করতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে এক গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলে ওঠেন,”দাঁড়াও।”

আবরাজ গলার স্বর অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে বলে,”মামা তুমি!”

মিজানুর রহমান এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,”হ্যাঁ, আমি। তবে আমি একা আসিনি। সঙ্গে একজনকে নিয়েও এসেছি।”

বলেই তিনি পেছনে ফিরে বলেন,”ভেতরে এসো।”

সেই ব্যক্তিটি ভেতরে প্রবেশ করতেই আবরাজ ও নিঝুম দুজনেই হতবাক হয়ে যায়। নিঝুম হতবাক স্বরে বলে,”ইমরান!”
to be continue…..

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_37(ধামাকাদার পর্ব)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুম ও আবরাজ দুজনকেই হতবাক চোখে ইমরানের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ এত দিন পর এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আবারো তাদের যে ইমরানের মুখোমুখি হতে হবে এটা তাদের কেউই আশা করে নি৷ আবরাজ তো ইমরানকে দেখেই ক্ষেপে গেল। ছুটে গিয়ে ইমরানের কাছে গিয়ে তার গলার কলার চেপে ধরে বলল,”কেন এসেছ এখানে?”

ইমরান আবরাজের থেকে চোখ সরিয়ে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,”নিজের অতীতে করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এসেছি।”

মিজানুর রহমান আবরাজকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”ইমরানকে ছেড়ে দাও আবরাজ। ওর থেকে তোমার অনেক কিছু জানার আছে। ও আজ এখানে কোন ঝামেলা তৈরি করতে আসে নি বরং সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে দিতে এসেছে। এত দিনের জমা সব ভুল বোঝাবুঝি আজ মিটিয়ে দেবে ও।”

ইমরান মাথা নাড়িয়ে বলে,”জ্বি। আমার আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে আবরাজ ব্রো। আপনি এতদিন ধরে অনেক ভুল ভেবেছেন, আমার জন্যই আপনার আর নিঝুমের মধ্যে ৫ বছর আগের এত বিশাল ঝামেলা হয়েছিল যার ফলে আপনারা দুজন আলাদা হয়ে পড়েছেন।”

আবরাজ অবাক স্বরে জানতে চায়,”এসবের মানে কি?”

ইমরান নিঝুমের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে,”প্রথমেই আমি তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি নিঝুম৷ আমি জানি, আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। আমি তোর মতো পবিত্র চরিত্রের মেয়ের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছি, আমাকে কতটা বিশ্বাস করতিস তুই নিজের বন্ধু না ভাইয়ের মতো দেখতি অথচ আমি সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পারি নি।”

নিঝুমের চোখে তখনো জল ছলছল করছিল। আবরাজ অধৈর্য হয়ে বলে,”যা বলার স্পষ্ট করে বলো।”

“৫ বছর আগে আমি আপনাকে যা বলেছিলাম তার সবই মিথ্যা ছিল। আমার সাথে নিঝুমের কোন অবৈধ সম্পর্ক ছিল না৷ বরং সেদিন কফিশপের মধ্যে আমিই নিঝুমকে জোরপূর্বক নিজের কাছে টেনে নিয়ে…”

ইমরান নিজের পুরো কথা শেষ করার আগেই আবরাজ তার নাক বরাবর একটা ঘু*ষি মারে। ইমরান দূরে ছিটকে পড়ে। আবরাজ গর্জে উঠে বলে,”শয়তানের বাচ্চা! তুই জানিস না তোর জন্য কত কি ঘটে গেছে৷ তোর জন্য আমি নিঝুমকে ভুল বুঝেছি, নিঝুমের মাকে মদ্যপ হয়ে এমন সব কথা বলেছি যার ফলে ওর মা মারা গেছে, এমনকি আমি আজো নিঝুমের চরিত্র নিয়ে কত খারাপ কথা বলেছি৷ আমি ভেবেছি নিঝুমের বাচ্চাটা তোর। তোকে আজ আমি শেষ করে দেব..”

বলে যখন না আবরাজ ইমরানের দিকে এগোতে নেবে তখনই তার মামা তার পথ আটকে ধরে বলেন,”দাঁড়াও, আবরাজ। ও নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত এবং নিজের ভুলের যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছে। ও ক্যান্সারে আক্রান্ত, লাস্ট স্টেজে ও আর বেশি দিন বাঁচবেও না। ওকে আর এভাবে মেরো না।”

মিজানুর রহমান এর কথা শুনে আবরাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ নিঝুমও অবাক হয়৷ ইমরান উঠে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে বলে,”আর বেশি দিন সময় নেই আমার হাতে। তাই মৃত্যুর আগে, নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে এলাম। এতে যদি পাপের বোঝা একটু কমে!”

ইমরানের এমন কথা শুনে আবরাজের মন কিছুটা নরম হয়। একইসাথে সে আত্মোপোলব্ধি করে অনেক কিছু। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”সব দোষ আমারই..আমি সব সময় নিঝুমকে ভুল বুঝে গেছি। ওকে কষ্ট দিয়েছি। আমার জন্যই নিঝুমের মা আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। নিঝুম..আমি তোমার অপরাধী, দয়া করে আমার সব অপরাধের শাস্তি তুমি আমায় দাও। তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব।”

মিজানুর রহমান নিজের ভাগ্নের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”না,আবরাজ। সব দোষ তোমার একার নয়। নিঝুমও অনেক অন্যায় করেছে৷ ওর অন্যায়ের মধ্যে ছিল তুমি যখন নিজের সাথে ওর সম্পর্ক ঠিক করতে চেয়েছ তখন ও তোমার বারবার অনুরোধ করার পরেও সম্পর্ক ঠিক করেনি, তোমার বারণ সত্ত্বেও ইমরানের সাথে মেলামেশা করে গেছে, তুমি যখন ইমরানক কেন্দ্র করে ওকে ভুল বুঝেছিলে ও তখন নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট কিছুই করেনি। আর সবথেকে বড় অপরাধ ও যা করেছে তোমার থেকে এত গুলো বছর তোমার সন্তানের কথা লুকিয়ে রেখেছে। দীর্ঘ ৫ বছর যাবত তুমি জানতে পারো নি, তোমার একটা সন্তান আছে। তোমার ছেলের শৈশব কেটেছে তোমার সান্নিধ্য ছাড়াই। এসব ভুলের জন্য নিঝুমকেও আমি অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি।”

আবরাজ অবাক হয়ে বলে,”মানে? নির্ঝর..ও কি তাহলে?”

“হ্যাঁ, নির্ঝর তোমারই ছেলে আবরাজ। আর এই হলো তোমার আর নির্ঝরের ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট। যা দ্বারা তুমি শতভাগ নিশ্চিত হতে পারো যে নির্ঝর তোমারই সন্তান। ছবি বেগম তোমার আর নির্ঝরের চুল নিয়ে একটা ল্যাবে দিয়েছিলেন। আমি সেটার রিপোর্টই নিয়ে এসেছি। এই রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া যায় যে নির্ঝর তোমারই ছেলে।”

আবরাজ ডিএনএ রিপোর্ট টা হাতে নিয়ে দেখে অবাক হয়ে তাকায় নিঝুমের দিকে। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নিঝুমের দিকে। নরম অথচ অভিযোগের সুরে বলে,”কেন নিঝুম কেন? কেন করলে আমার সাথে এমন? আমার প্রতি তোমার রাগ থাকতেই পারে কিন্তু তাই বলে এত গুলো বছর আমার থেকে এত বড় একটা সত্য লুকিয়ে রাখলে! আমাকে আমার সন্তানের থেকে বিছিন্ন রাখলে এত গুলো বছর। এটা তোমার কেমন বিচার নিঝুম? কি পেলে এসব করে তুমি?”

নিঝুম কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,”তো কি করতাম আমি? আপনি তো আমাকে বিশ্বাসই করেন নি কখনো। যদি আমি আপনাকে এই সন্তানের ব্যাপারে বলতাম তাহলে এখন যেমন আপনি নির্ঝর আমার ছেলে এটা জানার পর অবলীলায় ভেবে নিলেন যে এটা ইমরানের সন্তান তখনও নিশ্চয়ই তাই ভাবতেন। আমাকে আরো অপমান করতেন। আমার সন্তানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। সেসব কিভাবে মেনে নিতাম আমি?”

আবরাজ রেগে বলে,”তুমি সবসময় আমার দোষটাই কেন দেখতে পাও নিঝুম? নিজের ভুলগুলো কি তুমি দেখো না? একেই তুমি এতগুলো বছর আমার থেকে আমার সন্তানের কথা লুকিয়ে রাখলে, আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখলে, আবার দেশে ফেরার পর আমার সন্তানের কথা না জানিয়ে ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে সায় জানালে অতঃপর আমি যখন তোমার সন্তানের ব্যাপারে জেনে ওর ব্যাপারে তোমায় প্রশ্ন করলাম তখনো তুমি একবারো বললে না যে নির্ঝর আমার সন্তান। এমনকি ডিভোর্স পেপারে সই করা অব্দি এই কথাটা জানালে না। আজ যদি ডিভোর্সটা হয়েও যেত আর মামা এসে সব সত্য না বলতেন তাহলেও বোধহয় কখনো আমার জানা হতো না যে, নির্ঝর আমার সন্তান। তুমি সব সময় নিজের টাই ভেবে গেলে নিঝুম। কখনো আমার ব্যাপারে ভাবলে না। তোমার ইগো, তোমার স্বার্থপরতা তোমাকে সম্পূর্ণ অন্ধ বানিয়ে দিয়েছে।”

নিঝুম কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছবি বেগমের হাত ধরে কোর্টের মধ্যে ছুটে এলো নির্ঝর। আলমগীর খান এমনকি নববিবাহিত দম্পত্তি আবির-আনিকাও এসেছে এখানে। নির্ঝর এসেই ছুট লাগালো নিঝুমের দিকে এবং নিঝুমের সামনে এসে বললো,”আম্মু..সুপারহিরো কি আমার বাবা? গ্রানি বলল যে এই সুপারহিরোই নাকি আমার বাবা?”

নিঝুম কিছু বলার আগেই আবরাজ নির্ঝরকে নিজের কোলে তুলে নিলো এবং বলল,”হ্যাঁ, বাবু, আমি তোমার বাবা। তুমি আমার ছেলে। আমাকে একবার বাবা বলে ডাকো।”

নির্ঝর হেসে বলে,”বাবা..”

আবরাজ আবেগঘন হয়ে পড়ে। নির্ঝরের গালে ও কপালে অনেক গুলো চুমু খায়। সবাই বাবা-ছেলের এই মিলনের দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। ছবি বেগম, আলমগীর খান দুজনের চোখেই জল। আলমগীর খান বলেন,”আমি আর কখনোই আবরাজের মুখোমুখি হতে পারব না ছবি। একেই তো আমি ওর থেকে ওর শৈশব কেড়ে নিয়েছি আর ওর পিতৃত্ব কেড়ে নেয়াও নীরবে সহ্য করেছি।”

ছবি বেগমও কান্নারত স্বরে বলেন,”আমিও।”

এদিকে নির্ঝর নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,”আম্মু..তুমি দূরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমাদের কাছে এসো? গ্রানি তো বলল আমরা সবাই একই ফ্যামিলি আমাদের একসাথে থাকা উচিত..তুমি এসো না আমাদের পাশে।”

ছবি বেগমও নিঝুমকে বললেন,”নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকতেই পারে কিন্তু নিজের সন্তানের উপর তার প্রভাব পড়তে দিও না। যাও, আবরাজ আর নির্ঝরের পাশে গিয়ে দাঁড়াও।”

নিঝুম সমস্ত ভাবনা শেষে ছুটে যায় আবরাজের পাশে গিয়েই নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কান্না করে ফেলে। বলে,”সরি সোনা..তোমার থেকে এতদিন সবকিছু লুকিয়ে রেখেছিলাম।”

to be continue…..