তিথি পর্ব-০১

0
1482

তিথি – ১ (কপি করা নিষেধ)
আফসানা আশা

তিথির হাতে এক টুকরো জলপাই। সেদ্ধ করা। হাতের তালুতে একটু লবণ আর মরিচের গুঁড়ো রেখে তাতে জলপাইয়ের টুকরোটা ভালোভাবে মাখিয়ে, সামনের দাঁত দিয়ে ছোটো করে কামড় দিচ্ছে ও আর জিভ, টাকরা দিয়ে সম্মিলিত টকাশ, টকাশ শব্দ করে যাচ্ছে। ওর পরনে তিন সেট ভাঙা তিন রকম জামা, সালোয়ার, ওড়না। যখন যেটা সামনে পায় সেটাই টেনে নিয়ে পরে ফেলে। সেট মিলিয়ে জামাকাপড় ও খুঁজেই পায় না ওর ওয়্যারড্রবের ড্রয়ারে। যতক্ষণ না ওর মা শিরিন সব কাপড় নামিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে দেন ততক্ষণ ওর কাছে ওই ড্রয়ার জামা-কাপড়ের গহীণ অরণ্য! নির্দিষ্ট কোনো জামা, ওই জঙ্গলের ভিতর থেকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল তো বটেই আর সে যদি তিথির মতো অলস টাইপ মেয়ে হয় তার জন্য তো রীতিমতো সংগ্রাম। ছিপছিপে গড়নের সুন্দর মুখশ্রী আর উজ্জ্বল গায়ের রঙ তিথির। ওর সবচেয়ে বড়ো সৌন্দর্য ওর মেঘকালো একঢাল চুল। কোমর ছাপিয়ে নেমে গেছে সেগুলো। সেই চুলও এলোমেলো হয়ে আছে এখন। শিরিনের হাতে চিরুনির বাড়ি না খাওয়া পর্যন্ত চুলে তেল-চিরুনি পড়বে না। নানারকম হেয়ার প্যাক, ফেসপ্যাক কিনে আনে তিথি ত্বক-চুলের যত্ন নেওয়ার জন্য, কিন্তু ওই প্রথম দুটোদিনই উৎসাহ থাকে গগনচুম্বী! তারপরে আর না বাজে বাঁশি, না নাচে রাধা! সময়ের ব্যবধানে সবকিছুই গুরুত্বহীন হয়ে যায় ওর কাছে।

টিভিতে সনি চ্যানেল খোলা। ক্রাইম পেট্রোল চলছে। ‘ম্যা হু আনুপ সোনি অর একবার ফের আপকো সোয়াগাত।’ কাঠের সেন্টার টেবিলের উপর আসন দিয়ে বসে মুম্বাই পুলিশের কার্যক্রম দেখছে ও। জলপাই চাটা অবস্থায় যতটা নির্বিকারচিত্ত দেখাচ্ছে

ওকে, বাস্তবে ও ততখানিই অস্থির! একটু আগে আরশাদ ফোন করেছিল। এই ছেলেটার সাথেই বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে আছে তিথির। মাঝেমাঝেই ফোন করে। ওর ফোন এলেই তিথির নানি রেগে যায়। বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা একেবারেই পছন্দ করেন না তিনি। ‘মাইয়া মানুষ হইলো বেটাতাইনের ধারে ধাঁধাঁর লাহান! কখনো খুইলা দিতে নাই। খুইলা গেলেই ফুস! মাইয়া মানষের আর বেইল নাই!’ আরশাদের ফোন আসলেই তিনি খিটিমিটি করে ওঠেন। তাতে কী আসে যায়! সংসারে বুড়ো মানুষের কথার আর কী কদর?

শুধুমাত্র তিথির মায়ের কথার দাম আছে সংসারে!

আরশাদ বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে!

এই কথাটাই এইমাত্র জানিয়েছে ও তিথিকে।

তিথির আম্মু আর ওর কাকা অর্থাৎ শাহানা নামের মহিলাটা তার দেবরের হাত ধরে চলে গেছেন অনেক বছর আগে!

এই অজুহাতে আজ তিথির বিয়েটা ভেঙে গেল!

একটা একুশ বছরের মেয়ের জন্য বিয়ে ভাঙাটা নিশ্চয়ই খুব লজ্জার, অপমানজনক, ব্যথাদায়ক অনুভূতি, তবে তিথি সেসব কিছু টের পাচ্ছে না। ওর চারপাশটা হঠাৎ করেই খালি হয়ে গেছে। মাথার উপরে কুয়াশা জমে আছে। সেই কুয়াশাজড়ানো স্মৃতিতে সাঁতার কেটে কেটে একটা দিন ওর চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে আছে। তিথির বয়স তখন ছয় কি সাত! ফুফুর বাড়ি গেছে। একাই গেছে নাকি আরও কেউ ওর সাথে গেছে তিথির মনে নেই। আব্বা কি ছিলেন সাথে? নাকি অতটুকুন একটা বাচ্চামেয়েকে একাই পাঠিয়েছিলেন? ফুফু খুব আদর করতেন, তবে সেবার আদরের সাথে অন্য কিছুও হয়তো দেখেছিল তিথির বাচ্চা মনটা, আর কোনোদিন ফুফুর সাথে সহজ হওয়া হয়নি। আজকে বুঝতে পারছে দুই ভাইয়ের জীবনে একসাথে ঘটে যাওয়া কেলেংকারিতে তার মাথা ছিল খারাপ আবার অত্যধিক দুষ্টু তিথি সারাজীবনের জন্য তার ঘাড়েই চেপে বসবে কীনা, সেই টেনশনও ছিল সাথে! ভাইয়ের বাচ্চার জন্য টানও ছিল কিন্তু পরিবারে স্বামী আছে, সন্তানেরা বড়ো হয়েছে, তিথিকে মেনে নেওয়া তাদের জন্য সময়সাপেক্ষ। ফুফুর বড়োমেয়ে সামিয়ার তখন মেয়ে হয়েছে। তিন মাস বয়স বাচ্চাটার। সাত বছরের ছোট্ট তিথিও আন্টি হয়ে গেছে, ফুফুর ছেলেমেয়েদের সাথে সাথেই আনন্দে উৎসাহী হয়ে তিথি সামিয়া আপুর মেয়েকে আম্মু, আম্মু বলে ডাকছিল। ফুফুর বড়োছেলে আনিস তখন কলেজে পড়ে, তিথিকে ঝাঁড়ি দিয়ে বলেছিল,

—- ‘এই তুই বাবুকে আম্মু ডাকবি না, খবরদার।’

বলেই তিথির আম্মু ডাকটার সাথে নিকৃষ্ট কিছু শব্দও জুড়ে দিয়েছিল, যেন তিথির আম্মুর প্রতিশব্দই ওই নোংরা, উচ্চারণ অযোগ্য শব্দগুলো।

বহুবছর ধরে মাথার ভেতর আটকে থাকা সেই শব্দগুলোই আজকে সবার উপরে উঠে তিথির কানে এসে বাজছে!

একটা ভুলে যাওয়া অধ্যায়, যাকে কীনা স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে হয় তাই আজকে তিথিকে খুঁচিয়ে চলেছে!

যাকে তিথি মা, বাবা ডাকে, তারা সম্পর্কে ওর খালা আর খালু। তিথির খুব ভালো করে জানা আছে এসব। তবুও জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটা ও ভুলে ছিল, জোর করে ভুলে থাকতে থাকতে সত্যিকারেই ভুলে গেছে!

শিরিন খুঁতখুঁত করা টাইপ মহিলা, শুচিবাই আছে, সবকিছু টিপটপ রাখতে পছন্দ করেন, প্রচুর কাজ করতে পারেন। বড়ো সংসার কি বড়ো ঘর, একাই সারাদিনের কাজ গুছিয়ে আনতে পারেন। বয়সের সাথে সাথে হাই প্রেশারের অসুখ যোগ হয়ে, আজকাল অল্প পরিশ্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তার উপর তিথি অতি অলস মেয়ে। একুশ বছর পার করেছে, কাজকামে যেমন আনাড়ি তেমনি অনিচ্ছা সব কাজেই। পরিণামে সারাদিন বকা শুনছে। কেঁদে ঠোঁট ফুলাচ্ছে। সর্বদা অনুযোগের ঝুঁড়ি পেতে দিচ্ছে। ‘এমন দজ্জাল মা আর কারো নেই, কেউ আমাকে ভালোবাসে না’ বলে বলে কাঁদতে কাঁদতে শ্রান্ত হয়ে যখন ঘুমিয়ে যায় তখন শিরিন এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ান। অমনি তিথি লাফ দিয়ে উঠে পায়রাবাচ্চার মতো মায়ের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে,

—- ‘আমাকে বকলে তোমারই বেশি কষ্ট হয়, তবে বকো কেন?’

শিরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যান। এতটা স্নেহ দেওয়া ঠিক হয়নি মেয়েকে! আদর বেশি হওয়াতে অভিমানটাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। অল্পতেই কষ্ট পায়, চোখের পানিতে হাবুডুবু খায়। একটা কোনো কথা ছোঁয়ানো যায় না তিথিকে। শিরিন সবসময়ই আড়াল করে এসেছেন তিথিকে কিন্তু ওর একটা জীবনের পুরোটাই তো পড়ে আছে সামনে। মানুষের কথা, খোঁটা, নোংরামির সামনে তো ওকে পড়তেই হবে। ঠিক কতটা বঞ্চনা এই মেয়ের কপালে আছে, সেই লাঞ্চনা সইবার জন্য শক্ত করে গড়েপিঠে দেওয়া উচিত ছিল। এসব ভেবেভেবে মাঝেমাঝেই তিথিক্র খুব শক্ত বকা দেন শিরিন কিন্তু তিথি পাখির ছানার মতো এমন আহ্লাদী শুরু করে যে তার মিথ্যে রাগগুলো পালানোর জায়গা খুঁজে ছুটতে শুরু করে।

শিরিন আরও জোরে বুকে চেপে ধরেন তিথিকে, যদি এমন করেই তার বুকে রেখে দিতে পারতেন মেয়েটাকে সারাজীবনের জন্য!

কেন বিয়ে দিতে হয় মেয়েদেরকে, মায়ের কোল থেকে ঝেড়ে ফেলে কেন পর করে দিতে হয়?

আদর কেড়ে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তিথির। শিরিনের স্বামী খালেক সাহেব। শালী যখন স্বামী সন্তান ফেলে রেখে চলে গেল তখন শালীর ফেলে দেওয়া সন্তান তিথি এসে যোগ হলো তার সংসারে, উটকো ঝামেলার মতো। ভদ্রলোক তিনি বরাবর, মনের তিক্ততা মুখে আনতেন না, তবে তিথিকে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু অফিসফেরত খালেক সাহেব যখন ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতেন, টলমল পায়ে, ছোটোছোটো হাতে লুংগিটা এগিয়ে দিতো তিথি, দৌঁড়ে পানির গ্লাসটা ভরে আনতো, গ্লাসের অর্ধেক পানি হয়তো ছলকে তিথির গায়ে আর অর্ধেক খালেক সাহেবের হাতে পৌঁছাতে পারত। ওই অর্ধেক গ্লাস পানিই প্রশান্তিতে পিপাসা মুছিয়ে দিতো খালেক সাহেবের। দিনে দিনে তিথি তার জন্যও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মাতৃসম্বোধন ছাড়া তার মুখে অন্য কোনো ডাক আসে না তিথির জন্য। শিরিনের সমস্ত বকুনি থেকে মেয়েকে বাঁচানোর জন্য তিনি সবসময়ই রেসকিউ টিম সাজিয়ে বসে থাকেন।

এই রেসকিউ টিমের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আতিক। খালেক সাহেবের ছেলে। একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করছে। নামমাত্র বেতন। বিসিএস এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই তিথির সমস্ত আবদার, আহ্লাদের একমাত্র জায়গা আতিক। তিথি কিছু চেয়েছে আর আতিক দেয়নি এমন ঘটেনি আজ পর্যন্ত। যা সামান্য বেতন পায় তা তিথি আর রায়নার ছেলের জন্যই বরাদ্দ।

শিরিনের বিপক্ষে গঠিত এই রেসকিউ টিমের আরেক অন্যতম সদস্য রায়না, শিরিনের বড়ো মেয়ে, ছোটো মেয়ে তিথির সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গা, দুইবোন তো দুইসখী। রায়নার বিয়ে হয়ে শশুরবাড়ি গেছে আজ তিন বছর।

তিথির কখনো মনে হয় না এই পরিবারটা ওর নিজের পরিবার না। শিরিন ওর মা, খালেক সাহেব ওর বাবা, আতিক ওর নিজের ভাই, রায়না ওর কলিজার বোন। অন্য পরিচয় যে তিথির আছে তা এতদিন ও ভুলেই ছিল। খুব বিশ্রিভাবে এটা আজকে ওকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরশাদ জানতে চেয়েছিল,

—- ‘তোমার মা ভেগে গেছে এই কথাটা তোমরা আমাদেরকে আগে জানাওনি কেন?’

বলার ভঙ্গি খুব নোংরা ছিল ওর।

তিথি চুপ করেছিল।

আরশাদ আবার জানতে বলেছিল,

—- ‘এমন ভাব করছ যেন, কিছু জানো না তুমি। তোমার মা যখন ওই কান্ড করেছিল,তখন তোমার বয়স সাত বছর। ওই বয়সের সবকিছু মনে থাকে সবার। এত এত কথা বললে এত দিনে, এই কথাটা আমাকে বলার প্রয়োজন মনে হয়নি তোমার? নাকি ভেবেছ, আমাকে ভালোমতোই গেঁথে ফেলেছ, এবার শুধু টেনে তুলবে? তোমার প্রেমে এমন হাবুডুবু খাচ্ছি যে তোমার মায়ের হিস্ট্রি জেনেও আমার তোমাকে ছাড়ার উপায় থাকবে না?’

তিথি চুপ করেই ছিল। ওর কিছু বলারও ছিল না। অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। বিয়েশাদির ঘটনায়, তিথির মায়ের এই কেলেংকারী অবশ্যই জানানো উচিত ছিল। কিন্তু তিথির মনেই ছিল না। শিরিন ওর মা না, অনেকদিন আগে হারিয়ে যাওয়া শাহানা নামের কেউ ওর মা এই কথাটাই ও বেমালুম ভুলে বসে আছে। ওর চুপ করে থাকাটা সম্ভবত ওর অপরাধ স্বীকার করে নেওয়াই মনে হয়েছে আরশাদের কাছে। তাই আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়েছে সে।

—- ‘তোমরা ভাবছিলা, মায়ের ক্যারেক্টার শুনলে তোমাকে কেউ নিবে না। সত্যি কথা, কোনো বুদ্ধিমান মানুষ নষ্ট চরিত্রের মায়ের মেয়েকে জেনেশুনে বউ করবে না। মা নষ্টা হলে, মেয়েও ভ্রষ্টাই হবে। তোমারে বিয়ে করা সম্ভব না। যা কিছু কেনাকাটা করে দিছি বিয়ের জন্য সব ফেরত দিবা। আমি লোক পাঠাব, লিস্ট করা আছে সবকিছুর, কিছু রেখে দেওয়ার চেষ্টা কইরো না। আর খবরদার কান্নাকাটি করে আমারে ভুলানোর চেষ্টাই করবা না। ইনফ্যাক্ট, কান্নাকাটি দূরের কথা, আমারে তুমি কোনোদিন ফোনই দিবা না। এভরিথিং ইজ ওভার। ওভার!’

খুব জোরে জোরেই চিৎকার করছিল আরশাদ। সেসব আর তিথির কানে ঢুকছিল না, ফুলকো হাওয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছিল। কানে লেগেছিল শুধু বাজে ওই শব্দগুলো! শৈশবের অনেকটা সময় জুড়ে ওর বসবাস ছিল ওই শব্দগুলোর সাথে। অনেক শব্দের অর্থ জানত না ও, শুধু বক্তার অভিব্যক্তি দেখেই বুঝে নিতো ওগুলোর অর্থ মোটেও সুখপ্রদ না।

বিয়ে নিয়ে তিথির এমনিতেই খুব বেশিরকম উৎসাহ কিছু ছিল না। খালেক সাহেবের একটা মাইনর এটাক গেছে কয়েকদিন আগে। তারপরেই তিথির বিয়ে নিয়ে হুলস্থুল লাগিয়ে দিয়েছেন। পরিচিত এমন কেউ নেই যাকে বলেননি তিথির বিয়ের জন্য পাত্র দেখতে। এত হাঙ্গামা দেখে আতিক রীতিমতো বিরক্ত, ক্ষিপ্ত। মাত্র তো একুশ বছর বয়স ওর, কী দরকার এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার? খালেক সাহেব নিজের কথা ভাবছিলেন, একটা এটাক গিয়েছে, ছোটো হোক তবুও তো শরীরটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। যতটা না শরীরে ঝাঁকি লেগেছে, তার চেয়ে বেশি মন দুর্বল হয়ে পড়েছে। কখন না জানি ধাক্কাটা বড়ো হয়ে আসে তাই চিন্তায় ব্যাকুল হয়েছেন তিনি। চিন্তা তিথির জন্য। তিথির জীবনটাকে সাজিয়ে দিতে পারলেই আরামে চোখ বুজতে পারবেন তিনি।

আতিকের চিল্লাপাল্লাতে একটু স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল পাত্র খোঁজার অভিযান। আতিক খালেক সাহেবকে আশ্বস্ত করেছিল, ওর চাকরি একটা হয়ে গেলেই, তারপরে পরিবার আর তিথির দায়িত্ব ওই নিতে পারবে। খালেক সাহেবের চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। তখনই আরশাদের বাড়ি থেকে প্রস্তাব আসে। দেখাদেখি ছাড়াই একেবারে অফিসিয়াল প্রস্তাব দিয়ে বসে ওর পরিবার থেকে। দুটো বড়ো শপিংমলের মালিক ওরা। একটাই ছেলে আরশাদ। শপিং মলের দোকানগুলোর ভাড়া নেওয়ার পাশাপাশি, বড়ো বড়ো কয়েকটা শোরুম আছে মোবাইল সেট ও এক্সেসরিজের। কাঁচা টাকা। দেখতেও দারুণ সুপুরুষ। খালেক সাহেবের অফিস কলিগের ভায়রা আরশাদের বাবা, কোনো এক কাজে অফিসে এসেছিলেন আর সেদিনই তিথিও গিয়েছিল বাবার কাছে, ভার্সিটিফেরত, একসাথে বাসায় ফিরবে বলে। তিথিকে এক দেখাতেই এত বেশি পছন্দ হয়ে গেছে যে পরেরদিনই ভায়রাসমেত নিজের স্ত্রী আর পুত্রকে নিয়ে বাড়িতে হাজির। আর একেবারেই সোনার চুড়ি পরিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করতে চলে এলেন। ছেলেকে দেখে আর ওদের এত আগ্রহ দেখে শিরিন আর খালেক সাহেব আর না করতে পারেননি। পরের দিন সাতেক মনে হয় টুকটাক ফোনে কথা হয়েছে, একবার একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঘন্টা দুয়েক একসাথে সময় কাটানো আর বিয়ের শপিং – নাহ, আরশাদকে ভালোই লেগেছিল তিথির। যেভাবে আচমকা বিয়েটা চেপে বসেছিল মাথায় তেমনি হুট করে নেমেও গেল!

বিয়েটা ভেঙে যাওয়াতেও খুব বেশি কিছু কষ্ট হলো না তিথির তবে মা আর বাবার জন্য মন খারাপ করল আর পুরোনো স্মৃতিগুলো সব মনে পড়ে গেল। বিভিষীকাময় দিনগুলো সব।

আর মনে করিয়ে দিলো, একটা বেশ ঢলোঢলো, মিষ্টি মুখ। নাকের ডগা বেশ খাড়া আর দুপাশে চমৎকার খাঁজকাটা। চুলগুলো চোখের উপর এসে পড়ছে। তিথির কপালে একটা চুমু দিলো, তারপর দুইগালে, দুই চোখের পাতায়। শাহানা। তিথির আম্মু। এইটুকু একটা ছবিই শুধু চোখের সামনে ভাসে। এত নোংরা বর্ণনা যে মানুষটার তার এমন মায়াবতী রূপটা কেন মনে আছে শুধু, জানে না তিথি। জানতে ইচ্ছেও করে না। মা বলতেই শিরিন এসে হাজির হয় ওর চোখের সামনে, খান্ডারনি চেহারা নিয়ে।

— ‘অসভ্য, বদ, অলক্ষি মেয়ে একটা। এক কাপ চা বানাতে গিয়ে তিনটা পাতিল নষ্ট করেছিস? এগুলো কি তোর বাপ ধুবে?’

—- ‘না, বাপের বউ ধুবে।’

— ‘ফাজিল মেয়ে! মায়ের কষ্ট বোঝে না।’

— ‘কি কষ্ট কষ্ট করছ? চা না, কফি বানাইছি। ডালগোনা কফি। আর তিনটা না দুইটা পাতিল। চোখে কি বেশি দেখতেছ আজকাল? বলো তো, তোমার সামনে কয়টা তিথি? একটা নাকি দুইটা?’

— ‘একটা, দুইটা, সবগুলা, তোর চোদ্দগুষ্টি নিয়ে বাইর হ হারামজাদি, এক্ষন বাইর হ।’

শিরিনের রনচন্ডি মূর্তি আর কথোপকথন মনে করে ফিক করে হেসে ফেলে তিথি। ওই মা কালির অবতার শিরিনই ওর মা – আর সব মিথ্যে! এই সত্যিটুকুকে ভালোবেসে কি ওর জীবনে কেউ আসতে পারে না?

ছাদে চলে এলো তিথি। যে ফোনটা তিথির কাছে এসেছে একটু আগে, সেটা শিরিনের কাছেও আসবে। হয়তো এসেও পড়েছে। একটু সময় লাগবে শিরিনের সামলে নিতে। সেইটুকু সময় মাকে দিতে তিথি ছাদে চলে গেলো।

ছাদটা আধাখেঁচড়া করে রাখা। দোতলা করার খুব ইচ্ছে ছিল খালেক সাহেবের। পিলারগুলো উঠে গেছে। তারপরেই রায়নার বিয়ের কথা উঠল। বিয়ের খরচ সামলাতে গিয়ে বাড়ি কমপ্লিট করার জন্য আলাদা করে রাখা টাকাগুলো খরচ হয়ে গেল। পিলারগুলোর উপরে ছাদ দেওয়ার সামর্থ্য আর হয়নি।

সেদিকে তাকিয়ে তিথি ভাবতে শুরু করল –

রায়না আপার বিয়েটাও তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। কী অসুবিধা হয় মেয়েদের বিয়ে না হলে? রায়না আপুরও বিয়ে না হতো যদি, ওরও বিয়ে হতো না। মাছের পেটি নিয়ে মারামারি, আচারের বয়ম নিয়ে কাড়াকাড়ি, কে বিছানায় দেয়ালের দিকে ঘুমাবে আর কে বাইরের পাশে তাই নিয়ে ঝগড়া। একই ডিজাইন জামায় কে কোন রঙটা নেবে তাই নিয়ে বচসা – তবুও কী সুন্দর দিনগুলো, মিলিয়ে গেল! এখন সারাদিন বাবু সামলাতে হিমশিম অবস্থা। বাবুটাও কী কিউট! তিথিকে ডাকে ‘তিতি?’ ইন্ডিয়ান বাংলা একটা ডেইলি সোপে ভিলেনের নাম তিতি। বাবুটা তিতি ডাকলেই তিথির মেজাজ খারাপ হয়। খালা বলে ডাকতে শেখালে বলে, ‘তালা।’ রায়না আপা, দুলাভাই হেসে গড়াগড়ি খায় ছেলের কর্মে। ওদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তিথি বলে, ‘তিতি ওয়াজ বেটার, আমার বাপ!’

সোজা হয়ে উঠে যাওয়া অর্ধসমাপ্ত পিলারগুলোর উপরে চার ফিটের মতো রড বেরিয়ে আছে। তার ফাঁকে ফাঁকে বিকেলের আকাশটা অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। পৌষের বিকেলে এমন সুন্দর আকাশ দেখা যায় না সাধারণত। দারুণ একটা নীল রঙ আর পেঁজা পেঁজা সাদা তুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেন পুরো আকাশটাতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মনের সমস্ত ব্যথাগুলো বিশাল আকাশের এক কোনায় চুপচাপ জমা রেখে দিয়ে ও চঞ্চল হয়ে উঠল। আধাঘন্টার মতো হয়ে গেছে। শিরিন এখনো খোঁজেননি ওকে। ব্যাপারটা কী দেখতে হবে, ভাবল ও। নেমে এলো আস্তে করে। ছাদে ওঠার আগে সদর দরজা চাপা দিয়ে রেখে গিয়েছিল, সেভাবেই আছে। ও চুপচাপ, নিঃশব্দে, আওয়াজ না করার চেষ্টা করে ঘরে ঢুকল। শিরিনকে কোথাও দেখা গেল না। বিকেল বেলা বসার ঘরের লম্বা সোফাটায় আধশোয়া হয়ে স্টার জলসা আর জি বাংলায় সিরিয়াল দেখেন শিরিন। সারাদিনের খাটুনির শেষে, দুপুরের খাওয়ার পরই শরীরটা ছেড়ে দেয় ওনার, এলিয়ে পড়েন একেবারে। মাগরিবের আযান পর্যন্ত এই সময়টুকু চাইই নিজের সাথে কাটাতে, একটু বিশ্রামের জন্য। টিভিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনো কখনো ঝিমুনি এসে যায়, দুই দশ পাঁচ মিনিটের ওইটুকু ভাতঘুম ক্লান্তি দূর করে দেয়। এই সময়ে কোনো রকমের ডিস্টার্বেন্স তাই একেবারেই অপছন্দ শিরিনের। চঞ্চল তিথির ধুপধাপ হাঁটার শব্দও তাকে অসম্ভব বিরক্ত করে। ক্ষেপে যান একেবারে। আজকে টিভির সামনে মা নেই, তার মানে অঘটন এতক্ষণে ঘটে গেছে, প্রমাদ গুণল ও।

— ‘মা, ও মা?’

ভয়ার্ত গলায় খানিক তোতলাতে তোতলাতে ও ডাকল শিরিনকে। সাড়া পাওয়া গেল না। রান্নাঘরে উঁকি দিলো, সেখানেও শিরিন নেই।

দুরুদুরু করে কাঁপছে তিথির বুক। বেডরুমে উঁকি দিলো ও।

—- ‘মা?’

এবারে শিরিনের দেখা মিলল। পালঙ্কের একপাশে মাথা ঠেশ দিয়ে আছেন। তিথি আরও দুইবার ডাকল,

—- ‘মা, ও মা?’

কাছে গিয়ে দুবার ধাক্কাও দিলো।

যা ভেবে ভয় পাচ্ছিল, তাই। দাঁতকপাটি লেগেছে। তিথি বহুবার এই পরিস্থিতি সামলেছে। সামান্য কোনো দুশ্চিন্তাতেই শিরিন দাঁত এটে সেন্সলেস হয়ে যান। মরাবাড়ি বা হাসপাতালে অসুস্থ কাউকে দেখতে গেলে, রায়না, আতিক বা তিথির পরীক্ষার রেজাল্টের আগে বা ঝগড়া করলেও একবার তো ধপ করে ভারী শরীর নিয়ে পড়বেনই। এমনকি টিভি-পর্দাতেও সেনসিটিভ দৃশ্য দেখলে শিরিনের বিপি বেড়ে যায়, বেঁহুশ হয়ে যান। আজকাল এটা বেড়েছে। আগে একবার চোখেমুখে পানির ছিটা দিলেই জ্ঞান ফিরে আসত। এখন দেরি হয়৷ জোরে জোরে পানির ছিটা দিতে দিতে শিরিনের চুল, কাপড় সব ভিজে গেল। তিথি তাড়াতাড়ি করে মগে করে পানি নিয়ে এসে শিরিনের জ্ঞান ফেরাতে চাইল। এক মিনিটের মাথায় শিরিন নড়েচড়ে উঠলেন আর একটু বাদেই সোজা হয়ে উঠে আবার বালিশে মাথা দিয়ে কাঁত হয়ে আধশোয়া হলেন। তিথি তেলের বোতল এনে, খানিকটা তেলে জবজবে করে দিলো শিরিনের মাথা। শিরিন নিঃশব্দে কান্নার চেষ্টা করছেন। কেঁপেকেঁপে উঠছে শরীর। সেদিকে তাকিয়ে তিথিরও খুব কান্না পেতে লাগল। ওর মায়ের কেন এত কষ্ট?

শুধুই তিথির জন্য!

চলবে…
আফসানা আশা