তিথি পর্ব-০২

0
930

তিথি – ২ (কপি করা নিষেধ)

রায়না এসেছে বাসায়। আজকে বাড়িতে উৎসব। রায়নার ছেলের বয়স দেড় বছর। রামিম নাম। হাঁটতে শিখে গেছে। যতটা না হাঁটে তার চেয়ে বেশি দৌঁড়ায়। আর ধুপধাপ করে পড়ে। পড়ে ব্যথা পেয়ে কেঁদে দেয়। তারপর উঠে আবার দৌঁড় দেয়। ফোঁকলা গালে হেসে উঠলে টুকরো দাঁতগুলো ঝকমক করে ওঠে। কথা এখনো স্পষ্ট হয়নি, ওই আধো আধো কথাতেই হেসে গড়িয়ে পড়ে সবাই। খালেক সাহেব, আতিক, তিথি সবার আজকে আনন্দের দিন। শিরিনের আনন্দও বেশুমার, কিন্তু সেটা তিনি প্রকাশ করেন না। ঘরের কাজেই মনোযোগ তার। রান্নাঘরেই সময় কাটছে। রায়না কী খাবে, রামিমের জন্য চিকেন খিচুড়ি, রায়নার জামাই আসবে, স্পেশাল কয়েক পদ রাঁধতে হবে। রায়নার জামাই হেলাল সন্ধ্যায় আসবে। রাতের খাবার খেয়ে বউ আর ছেলেকে নিয়ে ফিরবে। রাতেই আয়োজন করতে হবে কিন্তু শিরিন দুপুরেই রাঁধাবাড়া করে ফেলবেন, সে চারটা বা পাঁচটা যাই বাজুক না কেন। দুপুরে গোসল করে দুটো ভাত মুখে নেবেন তো আর তার শরীর চলে না। সকাল থেকেই কাজ করে করে কোমর ধরে আছে। রক্তের প্রেশার বাড়তির দিকে, ঘাড়ে ব্যথা করছে। মেজাজও আগুন হয়ে আছে। তিথিকে দুবার ডেকেছেন। খবর নেই মেয়ের। একটু হাতে হাতে কাজ করে দেবে, তা না, রামিম কে নিয়েই পড়েছে। তাও যদি চুপচাপ বসে বাচ্চাটার সাথে খেলে তাও ভালো, কিন্তু তা তো করবে না। শুধু খোঁচাবে আর বাচ্চাটা ক্যাঁক্যাঁ করে কাঁদবে। রাগে শিরিনের গা জ্বলছে। গজগজ করছেন একা একাই।

—- “নবাবজাদী! নবাবজাদী হইছে। যাক শ্বশুরবাড়ি, শাশুড়ী ঘাড়ে ধরে কাজ করাবে আর দুনিয়ার কথা শুনাবে তখন বুঝবি। তখনও তো আমারই কথা শোনা লাগবে। বলবে মা কিছু শেখায়নি। দেখিস তখন, বাপ-মা তুলে কথা বললে কেমন লাগে?’

রায়না এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে। বলল,

—- ‘রাগ করছ কেন মা? আমাকে বলো, কী করতে হবে, আমি করে দিচ্ছি।’

— ‘এই তোরাই। তোরা ভাই-বোন আর তোদের বাপ, এরা তিনজন মিলেই ওই বজ্জাত মেয়েটাকে লাই দিয়ে দিয়ে এইরকম বানিয়েছিস। ভাবছিস কোনোদিন, বরের বাড়ি গিয়ে কী অবস্থা হবে ওর? পানিটা ঢেলে খায় না। কিছু একটা পড়ে থাকলেও হাত দিয়ে নাড়াবে না, পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আমি হইছি ওর বাপের বান্ধা চাকরানি। আমি মুখে তুলে না দিলে মহারানির পেটেও ভাত যাবে না। হারামজাদি!’

রায়না পেঁয়াজের ঝুড়ি টেনে নিয়ে পেঁয়াজ কাটতে বসল। মায়ের কথার উত্তর দিলো না। এত যে অভিযোগ করে গেলেন শিরিন, রায়না খুব ভালো করেই জানে, তিথিকে আদুরে বাঁদর বানানোর প্রধান কারিগর শিরিন নিজেই। কখনো কখনো রায়নার মনে হয় তিথিই হয়তো শিরিনের নিজের গর্ভজাত আর রায়না-আতিকই বোনের ছেলেমেয়ে। অথচ মারটা বরাবর তিথিই বেশি খেয়েছে, এপেটাইজার হিসেবে ভাতের সাথে বকুনি না খেলে ওর খাবার হজম হয়নি কোনো বেলায়।

শিরিন জানতে চাইলেন,

—- ‘হেলালের মা কেমন আছে? তোর ননদ তো তোদের সাথেই থাকে এখন? ফ্ল্যাট কি লিখে দিছে? উঠবি কবে তোরা?’

— ‘ভালো আছে সবাই। ডেইলি দুইবেলা ইনসুলিন নেবে আর খাবেও সমানে। ভাত, গোশ, মিষ্টি কিছুই ছাড়ে না। কিছু বলতে গেলেই বলবে, তোগোটা খাই? পাইছে এক বাড়ি। ডেভেলপাররে দিয়া আটটা ফ্ল্যাট ভাগে পাইছে। সব পোলাপানরে দুইটা করে দিছে। হাসিবরেও দুইটা, রামিমের আব্বারেও দুইটা। নিজের দুইটা ভাড়া দিয়ে, হাসিবের সাথে থাকে। মাস গেলেই ত্রিশ হাজার ক্যাশ। টাকার গরমে তারে আর পায় কে? হাঁটাচলা, কাজকামের ধারে নাই, সুস্থ থাকবে কেমনে? আমার একটা তো ভাড়া দিছি, আর যেটা আমাদের জন্য সেইটাতে কাজ এখনো বাকি আছে কিছু। টাইলসের কাজ করতেছে। দশ বারোদিনের মধ্যেই কাজ শেষ হইলেই উঠে যাব। তিথিরে তখন পাঠাই দিও, মা। আতিকরে দিয়া পাঠাইয়ো। আমারে একটু গোছগাছ করে দেবে।’

— ‘তিথি করবে গোছগাছ? ধামড়ি মাইয়া নিজের জামাটা গোছাই পরতে পারে?’

— ‘তা থাক। আমার কিছু করে দেওয়া লাগবে না। রামিমের কাছে কাছে থাকলেই হবে। আমার শাশুড়ীতো বিরাট পেনশন পাইছে, ছুঁয়েও দেখবে না কিছু। হেনার মেয়ে শুধু মারে রামিমকে। কিন্তু হেনা নিজের মেয়েকে একটু শাসনও করে না। একটা তাড়াও দেবে না কখনো। কখনো বলবে না, রামিম ছোটো, ওকে মারতে হয় না।’

— ‘থাক, অন্যে কীভাবে বাচ্চা মানুষ করবে সেইটা এত বলবি না। আমি নিজেই নিজের বাচ্চাগুলোরে মানুষ করতে পারলাম না। পাষাণ সব। একটু মায়া-দয়া নাই। মরতে মরতে হলেও সবার ফরমাশ খাটা লাগবে। আমি মইরা গেলেও ভুত হয়ে এসে এদের খাওন যোগায় যাইতে হবে।’

রায়না চুপ করে থাকল। ও জানে মা ক্ষেপে আছেন। মাকে ঘাঁটালে পরিস্থিতি বেগতিক হবে। শুধু হাঁউকাউ করতে করতে বিপি হাই হবে। ফলাফল বেঁহুশ হয়ে যাবেন। তিথি ফোনে জানিয়েছিল, এখন সহজে জ্ঞান ফেরে না মায়ের। মুখ দিয়ে ফেনা ওঠে।

—- ‘তুমি চিল্লাপাল্লা না করে ওকে ডেকে একটা দুটো কাজ তো দিতে পারো? কিছু বললে তো করে।’

— ‘হ্যাঁ করে! পরশুদিন তোর বাপের দুইটা শার্ট ভিজাই রাখছি। গোসলের সময় কাঁচব ভাবছি। এদিকে রান্নাবাড়া শেষ করতে বেলা যায়, ওরে বলছি কাপড় দুইটা ধুইয়া গোসল কইরা আসতে। দুইটা শার্ট ধুইতে বাথরুমে মোড়া ঢুকাইছে, ব্রাশ লাগছে তার শার্ট ঘষতে আরও যে কত ঢং। তারপর শুধু ধুয়েই কাজ সারা। মেলেও দেয় নাই। কারণ আমি মেলে দিতে তো বলি নাই। রোদ চলে যাবে বলেই ওরে ধুইতে দিছি, সেই কাজই আমার হলো না। আর গিয়া দেখ, শার্টের কলার, হাতার ভাঁজে ময়লার দাগ রয়ে গেছে। আবার আমার কাঁচতে হবে।’

— ‘ও তো কাপড় কাঁচতে পারে না, মা।’

— ‘এত সাপোর্ট দিবি না, রায়না। কাপড় কাচতে পারে না! কোন কাজটা পারে? দুইটা পেঁয়াজ কাটতে দিলে সারাদিন লাগায়। আমি শেষে বিরক্ত হয়ে বলি লাগবে না। এত শিখাইলাম রুটি কেমনে গোল হবে, মন দিয়ে শিখল তো! ছুটা বুয়া দিয়ে কাজ করাই, সে আজ আসে তো কাল আসে না। ঢাকা শহরে এসে সব নবাবজাদি হয়ে বসছে। তিথিরে বলছি ফ্লোরটা মুছে আয়। এই জায়গায় মুছছে তো ওই জায়গায় মুছে নাই। ময়লা ধুলা কিছু পরিষ্কার হয় নাই, শুধু ঘর ভিজাই রেখে গেছে। তাছাড়া করবে কী? একটা দশ মিনিটের কাজ করতে পনেরো মিনিট টিভি দেখবে, দশবার মোবাইল টিপবে! তোর বাপে চিংড়ি মাছ আনছে, বলছি মাছগুলো বেছে রাখ। ছোটো ছোটো মাছ। এইটুকু। আমি শাক বাছতেছি। আধাঘন্টা পরে এসে দেখি ছাই আর বটি নিয়ে কুটকুট করতেছে। আমার মাথায় হাত। কোনোদিন করতে দেই নাই বলে কি, আমাকে করতে দেখিসও নাই?’

— ‘আস্তে, আস্তে শিখে যাবে, তুমি রাগ কইরো না।’

— ‘মেঘে মেঘে বেলা কম হয় নাই। ও একেবারে ছোটো না। তোর বাপে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হইছে। তোর মতো কপাল নিয়ে তো আসে নাই। তোর শাশুড়ী তোদের কিছুতে থাকে না, ভালোতেও নাই, মন্দেও নাই। তোদের কোনোকিছুতেই সে কথা বলে না। নাড়েও না, ঘাটেও না। তুই তোর জামাই আর বাচ্চারে নিয়ে থাকিস। কীভাবে থাকলি, রান্না করলি কী বাচ্চারে না খাওয়ায় রাখলি, ঝগড়া করলি কি ঘুমায় থাকলি সে দেখেও না এসে। এইরকম পাবে তিথি? সংসারের দশটা মানুষের সাথে মিলেই তো থাকতে হবে। রাজার বাড়ি বিয়ে হইলেও তো নইড়াচইড়া খাইতে হবে। আর যে কপাল নিয়ে আসছে, আরেকজনের দোষে কত কথাই তো শুনতে হবে। আমি একটু জোরে কথা বললেই তো কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলে। তখন ক্যামনে সহ্য করবে?’

— ‘যে ওরে বিয়ে করবে সে নিশ্চয় বুঝবে, সবার ছোটোমেয়ে, আহ্লাদী। দেখবা ওর জামাই ঠিকই ওরে যত্ন করবে?’

—- ‘আর জামাই!’

কথা বলতে বলতেই মাংস কষানো শেষ করে ঝোলের পানি ঢেলে দিলেন শিরিন। তারপর রায়নার মুখোমুখি বসে ফিসফিস করে বললেন,

—- ‘এই বিয়েটাও ভাঙল। তিথিরে আর বলি নাই কিছু। কম প্রস্তাব তো আসে না। ভালো ভালো ছেলেরাই তো বিয়ে করতে চায়। কিন্তু যেই ওই কাহিনী শোনে সেই পিছায়া যায়। মানুষ নেবে সদাই, দোকানী কেমন তা দিয়া তোদের কী দরকার? সদাই ভালো হলেই তো চলে। তিথি আমার এত ভালো মেয়ে!’

এই মাত্রই শিরিন তিথির কাজকর্মে অমনোযোগ নিয়ে বিষোদগার করছিলেন। রায়না মনে মনে হাসল। নিজের মা, অথচ তিথির জন্য এত ভালোবাসা দেখে ওর একটুও হিংসা হয় না।

– ‘এই বিয়েগুলো ভেঙে যাচ্ছে, কারণ এরা কেউই আমাদের তিথির যোগ্য না। যে মানুষটা তিথির মূল্য বুঝবে সে ঠিক আসবে। তোমার পায়ে পড়ে তোমার মেয়েকে চেয়ে নিয়ে যাবে, তুমি দেখো মা। আমাদের তিতকুন্নীর খুব ভালো বিয়ে হবে।’

—- ‘আল্লাহ যেন তাই করে। আমি মরার আগে, আমাদের মতো করে ওকে ভালোবাসবে এমন মানুষের কাছে ওকে দিয়ে যেতে পারলেই শান্তিতে মরতে পারতাম।’

সেই সময়ই রামিম দৌড়ে এসে শিরিনের পাদুটো পেছন থেকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল আর লাফাতে থাকল। তিথিকেও পেছন পেছন দেখা গেল,

—- ‘ধর, ধর, রামিমকে ধর। ধরে ধরে টপাটপ খেয়ে ফেল।’

বলতে বলতে রান্নাঘরেই এসে পড়ল ও। শিরিন সবে লবণের বয়ম খুলেছেন, ঘটনার আকস্মিকতায় বয়ম হাত থেকে পড়ে উলটে সারা রান্নাঘরে ছড়িয়ে গেল। শিরিন মূহুর্তে অগ্নিমূর্তি নিলেন,

—- ‘অলক্ষির ঘরের অলক্ষি! তোরে না বলছি, বাচ্চাডারে নিয়া চুপ করে খেলতে। তোর বয়স কি রামিমের সমান? বুড়ি হইছিস। বইসা বইসা বুড়া বাপের অন্নধ্বংস ছাড়া একটা কোনো সাহায্য তুই করিস? লবনের দাম জানিস? পুরা এক কেজি লবণ। কালকেই প্যাকেট ভাঙছি। লবণ গলে এখনই পানি হবে৷ রান্নাঘরটা লোদ লোদ হয়ে যাবে। কে পরিষ্কার করবে? আমারে দাসীবান্দি পাইছিস তুই? পেটের মেয়ে তো না। খাওয়া -পরা দিয়ে কোকিলের ছানা পালতেছি। নিজের মা হলে ঠিকই কষ্ট বুঝতিস!’

তিথি নিশ্চুপ। কান্নায় গলারোধ হয়ে আসছে ওর। আগে কখনো এই কথা বলেনি শিরিন। ইদানীং কথা উঠলেই,

‘পেটের মেয়ে না, কোকিলের ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটাইছি, নিজের মা হলে মায়া করতিস’ এসব বলে শিরিন তীব্র ব্যথা দেন ওকে। বহু কষ্টে তিথি বলল,

—- ‘আমার কী দোষ? আমি কি রামিমকে বলছি, রান্নাঘরে আসতে?’

—- ‘ধামড়ি মেয়ে। বেয়াদব। পেটজাইতা খাওয়ায়ে বেয়াদব বানাইছি আমি। খালি কথা কাটে। না, তোমার কোনো দোষ নাই, গুণের অবতার তুমি। আমারে মাফ করো, মা। আমার ভুল হয়ে গেছে। গুণের ঠেলায় বিয়ে দিয়ে পার করতেও পারছি না। সপ্তাহে সপ্তাহে পাত্রপক্ষ আসবে, হাজার হাজার টাকার বাজার করে তাদের খাওয়াইতে খাওয়াইতে আমি ফতুর। অলক্ষির বিদায় হওয়ার নামই নেই।’

তিথির বড় বড় দুচোখ এবার জলে ভেসে যেতে লাগল। রায়না পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল,

—- ‘আহ মা কীসব বলছ। কী কথা থেকে কী কথা শুরু করলে? তিথির কী দোষ? রামিম কি কম দুষ্টু? আর তিথি, তুইও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিস? যা, না, রামিমকে নিয়ে ঘরে যা।’

—- ‘আমি রান্নাঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাই, আপা।?’ ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল তিথি।

— ‘খবরদার, ও যেন আমার রান্নাঘরে না ঢোকে। ঊনো কাজ দুনো করবে।’

শিরিন চিৎকার করে উঠলেন।

রামিমকে কোলে নিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা লাগালো তিথি।

— ‘দেখলি, কত বড় বেয়াদব মেয়ে? দেখলি? অন্যায় করবে অথচ কোনো কথা ছোঁয়ানো যাবে না। শাসন করতে পারব না?’

—- ‘এইটাকে তুমি শাসন বলো? সারাক্ষণ কটু কথা বললে শাসন হয়? এই বাজে বাজে কথা বললা আবার দুই মিনিট পার হতে পারবে না, গিয়ে হাতে পায়ে চুম্মা দিয়া আহ্লাদ করা শুরু করবা। তোমার প্যারেন্টিং শেখার দরকার আছে, মা। সামান্য একটা ব্যাপাররে তুমি কই থেকে কই নিয়া গেলা। তুমিই ওরে বিগরাইছো। ভালোবাসলে তারে এতো তিতা কথা বলার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। যাকে ভালোবাসো, স্নেহ করো, পেটের ভেতর না রেখে তারে জানাইতেও হয় তুমি তারে ভালোবাসো। একদিন তোমার এই মুখের কথাই তোমার বিপদ ডেকে আনবে।’

—- ‘দুই দিনের ছেমড়ি, এক বাচ্চা পয়দা করেই লায়েক হয়ে গেছিস? মারে শিখাস তুই? নিজের গর্ভধারিণীরে শিখাস কীভাবে বাচ্চা পালতে হবে? তিনটা বাচ্চা পাইলা সেয়ানা বানাই দিছি, এখন তোর কাছে আমার প্যারেন্টিং শিখতে হবে? দেখব, কেমন বাচ্চা পালিস তুই। একটারেই মানুষ করে দেখা। তোদের মতো মুখে মুখে জান,কলিজা আমি বলতে পারি না। আমার ভালোবাসা আমার মনে। ভালোবাসি বলেই শাসন করি। তোরা আমার বাচ্চা, জান দেই তোদের জন্য। তোদের তো বোঝা উচিত, মায়ের কোনটা রাগ আর কোনটা ভালোবাসা। ভালোবাসি বলেই তো শাসন করি। মা হয়ে শাসন করতেও পারব না?

—- ‘এইটা বলে তুমি মিথ্যা গর্ব করো। শোঅফ করতে বলি নাই তোমারে। কিন্তু যেভাবে তুমি লিমিটক্রস করে যাও, তিথির সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে। সাবধান করলাম তোমারে। শাসন করবা, অন্যায় করলে অবশ্যই শাসন করবা। কিন্তু আজেবাজে কথা বলবা কেন?’

—- ‘সাবধান করলি, মানে কী? কী করবে ও আমারে? মারবে? ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে?’

—- ‘তার চেয়ে ভয়ানক কিছু। এখনও সাবধান হও, মা। বাদ দেও। গুলশানের যে প্রপোজাল ছিল সেইটার কী হলো? তোমরা কি কথা বলার আগে সব খুইলা বলো না? কথা আগাইলাম, বিয়ের কেনাকাটা হয়ে গেল তারপরে সব জানাজানি হবে, বিয়ে ভাঙবে। মানে কী এইগুলার? মেয়েটার মন কয়বার ভাঙবা? ও কিছু বলে না দেইখা ওর কষ্টটা বুঝবা না? সব শুরুতেই বলে দিবা। তারপরে যদি তারা আগায়, কথা হবে। নইলে বাদ। বিসমিল্লায় গলদ রেখে বিয়াশাদী আগানো ঠিক? আর এগুলো কি চেপে রাখা যায়? শাহানা খালার কাহিনি সবাই একদিন না একদিন জানবেই। এইটা গোপন রেখে তিথির বিয়ে দেওয়া যাবে না। কোনোভাবে বিয়ে হয়ে গেলেও পরে অশান্তি হবে।’

— ‘আরশাদরাই পঁচাইতেছে বেশি। এমন একটা ভাব যে ওদেরকে আমরাই মনে হয় ডাইকা আনছিলাম। আসলে তিথিরে দেখে ওরাই তো পাগল হয়ে গেছিল। এখন তিথিরে পাইতেছে না এটাও সহ্য করতে পারতেছে না। আবার তিথিরে নিতেও পারতেছে না। গা জ্বলতেছে। ওদের পরে চারটা সম্বন্ধ এলো, সবগুলোই ওরা ভাঙানি দিলো। গুলশানেরটা খুব ভালো প্রস্তাব। মা আর দুইটা ছেলে শুধু। বড়ছেলে বউ নিয়া আমেরিকায়। আর ছোটটা বিবিএ করছে, এমবিএ করতে অস্ট্রেলিয়া গেছে। মহাখালীতে ছয়তলা বাড়ি, গুলশানে ফ্ল্যাট। তিথির ছবি দেখছে, বেটির মুখে আর রা নাই। তিথিরে চাইই তার। এক মনে চাইতেছে শাহানার কথা সব বলে দেই। আবার মনে হইতেছে একদম ঝামেলা ছাড়া পরিবার, এমন কি তিথির ভাগ্যে আর হবে? মায়ের দোষে মেয়ের কপাল কেন কাটা পড়বে? লোভ লাগতেছে। না কইয়াই বিয়েটা ঘটায় দিতে ইচ্ছে করতেছে। তারপর যা হয় হোক, আল্লাহ ভরসা। একবার মনের মিল হয়ে গেলে তিথিরে আর কেউ সরাইতে পারবে না।’

—- ‘না, মা। আমাদের সমাজ, সমাজের শিক্ষিত মানুষেরাও এখনো এইগুলো মেনে নেওয়ার মতো ম্যাচিউরড হয় নাই। গোপন করে বিয়ে দেওয়া ঠিক না। তিথি সারাজীবনের জন্য ছোটো হয়ে যাবে। তারপরে দেখা যাবে বিয়েটা এগিয়েছে কতকটা তারপর আবার কেউ কুটনামি করল আর আবার মেয়েটার কপাল পুড়বে।’

—- ‘না, মহিলা অনেক পছন্দ করছে তিথিরে। এইবার মনে হয় বিয়েটা হয়েই যাবে।’

— ‘তবুও মা। না বলে এবারে আগানো ঠিক হবে না। আরশাদের মা যে গন্ডগোলটা করল।’

— ‘আরশাদের বাপ, মা সবাই তিথিরে খুব পছন্দ করছিল। ওর বাবা দেখেই তো পাগল হইছিল। লোকজন দাওয়াত দিয়া শেষ করল। হয়ত ঝামেলা করত ও না। কিন্তু আরশাদের মায়ের পাল্লা আছে ওর জালের সাথে। ঠাঁট, বাট, টাকা-পয়সা, বাচ্চারা কে কী করল সব নিয়েই পাল্লা চলে। কে কার আগে যাইতে পারবে, কার ছেলে কত ভালো, কার মেয়ের কত ভালো বিয়ে হইছে, কার ছেলের বউ কত সুন্দরী এইসব নিয়ে লাইগাই থাকে। সেই জালের বাপের বাড়ি আর শাহানার শশুরবাড়ি এক জায়গায়। আরশাদের মা চাইছিল, তিথির মায়ের ব্যাপারটা চেপে যাবে, সেই উপায়ও থাকল না। তিথিরে নিতেও পারতেছে না আবার ফিরায় দিতেও কলিজায় কামড় দিছে, তাই অত ক্ষেপছিল।’

— ‘সেইটা তাদের সমস্যা। বাড়ির উপর এসে বিয়ের কেনাকাটা ফিরায় নিতে যে সিনক্রিয়েট করল, আমরা কি বলছিলাম যে জিনিস দিবো না? ছোটলোক কিন্তু আসলে, তুমি যত কথাই বলো মা। তুমিই বলো, তোমার তো এত এত টাকাপয়সা নাই, তাও বিয়ের কেনাকাটা এইভাবে ফিরায় নিয়ে আসতে পারতা? আর নিলো নিলো, নিকগা, এমনিতেও ওইসব কিছুতে তিথি হাত দিতো না, কিন্তু কী ব্যবহারটা আরশাদের মা করল! চিল্লাপাল্লা করে পুরো এলাকা জানান দিলো, তিথি আর কোথাও মুখ দেখাতে পারে না। আমার শাশুড়ীর কানে পর্যন্ত চলে গেছে! আমিও খোঁটা শুনছি তার কাছে। আমারে বলতেছে, খালার এই ঘটনা চেপে আমার মা আমারে বিয়ে দিলো কেমনে? বোঝো! তুমি পাত্রপক্ষরে না জানায়ে এইবার তিথিরে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো না। দেখাদেখি পর্যন্তই যাইয়ো না!’

—- ‘আরে, ওদেরও সমস্যা আছে। ছেলের মা আর বাপ আলাদা থাকে। সেপারেশন হয়ে গেছে। ওরা এত বেশি ঘাঁটাবে না।’

—- ‘মা, ডিভোর্স আলাদা বিষয় আর শাহানা খালার এইভাবে চলে যাওয়া আলাদা বিষয়। ডিভোর্স, সেপারেশন এখন আমাদের কাছে সাধারণ বিষয়, কিন্তু বাপ-মায়ের অবৈধ সম্পর্ক বাচ্চারাই মানতে পারে না, বাইরের মানুষ তো অসম্ভব।’

শিরিনকে একটু চিন্তিত দেখা গেল, রায়নার কথাগুলো একটু ভাবাচ্ছে তাকে। তিথির বিয়ের জন্য তিনি মরিয়া হয়ে গেছেন। তবে বিয়ের পরেও তো সমস্যা ফেস করতে হতে পারে। রায়নার কথা শিরিনের অভিজ্ঞ ভাবনাগুলোকেও নাড়া দিয়েছে। মাকে চুপ করে থাকতে দেখে রায়না আবার কথা বলল,

—- ‘তিথি কিছু বলে না? এত পাত্রপক্ষ আসতেছে, ও চুপচাপ মেনে নেয়?’

—- ‘আরশাদরা ওই কান্ড করার পরে একটু ঘাউরামি করছিল, অনেক চেতে ছিল, এখন একেবারে চুপ, ওই ব্যাপারে কিছুই কয় না।’

— ‘আচ্ছা মা, শাহানা খালারে আর খুঁজলা না কেন তোমরা? আসলেই কি সে এই কাজ করছিল? আমি তখন দশ বছরের, মনে আছে কিছু। খালা তো ওইরকম ছিল না।’

— ‘জানি না রে বাবা। আমিও তো ওরে কোনোদিন খারাপ দেখি নাই। কী যে হইছিল, জানতেও পারলাম না কোনোদিন। শাহানারে তো পাইলামই না, জাহিদ ভাইও গলায় ফাঁস নিলো। শাহানা পোয়াতি ছিল, জাফরেরও আর কোনোদিন কোনো খবর পাইলাম না। আল্লাহ জানে ভালো।’

— ‘তোমরা খোঁজ করো নাই?’

— ‘যে হারায়ে যায় তারে খোঁজা যায়, যে ইচ্ছা করে হারায় তারে কীভাবে খুঁজব? জাহিদ ভাই খুঁজছিল, তোদের নানা, মামারা খুঁজছিল। জাহিদ ভাইয়ের বোনেরা খুঁজছিল। পাই নাই কোনোদিন, কোনো খবরই পাই নাই।’

— ‘খালা এই কাজটা কেন করছিল? তিথিরে ফালায়ও গেল, সারাজীবনের জন্য মাথায় কলঙ্কও দিয়ে গেল।’

—- ‘অথচ, এই তিথি শাহানার খুব আদরের ছিল। সারাদিন মেয়ের দিকে তাকায়েও আঁশ মিটত না ওর। মুরব্বিরা বলত, মায়ের ওইভাবে পোলাপানের দিকে তাকাইতে নাই। নজর লাগে। মায়ের নজরই নাকি সবচেয়ে বেশি লাগে। ও শুনত না, বলত, কেমন মা হইছি যে আমার নজর লাগবে আমার বাচ্চার? তিথির খাওয়া, ঘুমানো সবকিছুর জন্য নিজের সব বিসর্জন দিয়ে রাখছিল। সারাদিন শুধু তিথি আর তিথি! কেমনে ছেড়ে আছে কে জানে!’

—- ‘আচ্ছা, তোমার আর কিছু করে দেওয়া লাগবে? আমি রামিমের খিচুড়ি বসায় দিচ্ছি, তুমি আর ঝামেলা বাড়ায়ো না। আমি তিথিরে ডাকি। এমন বাজে কথা তুমি বললা, মেয়েটার মুখ এতটুকু হয়ে গেছে। পারোও তুমি। আবার ওর জন্যই জান কোরবান তোমার। এ তোমার কেমন ভালোবাসা কে জানে?’

— ‘হ্যাঁ, ভালো শুধু তোরা বাসিস। আর আমি যে বোনের মেয়েরে নিজের মেয়ের চেয়ে বেশি আদর দিলাম?’

—- ‘সেই আদর তুমি কথা দিয়ে তুলেও নাও, মা। মনে রেখো, কারো নতুন জীবন তুমি দিতেই পারো, কিন্তু জীবন তুমি দিছো বলেই সেই জীবনের পরে তোমার অধিকার জন্মায় যায় না। তুমি ভালোবাসো বলেই সেই জোরে তুমি যা ইচ্ছে তাই বলতেও পারো না, ওরে দিয়ে করাইতেও পারো না। অধিকারের একটা সীমারেখা থাকে। জোর করে তা ভাঙলে শুধু ভাসিয়েই নিয়ে যায়, কূল পাওয়া যায় না আর!’

চলবে…
আফসানা আশা