তিথি পর্ব-০৩

0
754

#তিথি – ৩

রায়নার বাসা শিফট করাটা খুব বেশি ঝামেলার হলো না। শুধু নিচ থেকে উপরে ওঠা।

সাত কাঠা জায়গার উপর হেলালদের টিনশেডের বাড়ি ছিল। সারি সারি ঘর করে ভাড়া দেওয়া ছিল। ঘরগুলোর ভাড়ার টাকাই একমাত্র আয়ের উৎস ছিল রাবেয়া খাতুনের। অল্পবয়সে বিধবা হয়ে দুই ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে জীবনিপাত করেছেন। ঘরভাড়ার টাকা, নিজে সেলাই করতেন, আশেপাশের বউঝিদের অল্প দামে পেটিকোট, ব্লাউজ, মেক্সি, জামা, বাচ্চাদের ফ্রক সেলাই করে দিতেন, এভাবেই সংসার ধরে রেখেছেন। হেলাল খুব অল্প বয়স থেকেই টিউশনি করত। তবুও পাঁচটা মানুষের খোরাকি সংকুলান হতো না। একটু আলুভর্তাও কয়েক ভাগে ভাগ করে সবার পেটে ঢুকানোর ব্যবস্থা করেছেন। অনেক দিন গেছে দোকান থেকে দুইটাকা দিয়ে কেনা সিঙ্গারার ভেতরের আলু দিয়ে ঠান্ডাভাত খেয়ে দিনের একবেলা খাবার অভ্যাস করেছেন। অনেক কষ্টে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করিয়েছেন। তাও বোর্ড পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের সময় দ্বারে দ্বারে হাত পাতা লাগত। হেলাল তো ভালো ছাত্র হওয়ায় স্কুল কমিটিই ফর্ম ফিলআপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। হেনা আর হাসিবের জন্য পড়ার খরচ বহন করা খুব কষ্টের ছিল। হাসিবকে তো নতুন বই কখনো দেওয়াই সম্ভব হয়নি। স্কুলে ইউনিফর্ম ছাড়াই যেতে হতো, সেশনের কয়েকমাস চলে গেলে কারও ছেঁড়াফাঁটা পুরোনো ইউনিফর্ম জোড়াতালি দিতে পিটি স্যারের মাইরের হাত থেকে বাঁচার উপায় বের করা হতো। হেলালের বিয়ে দিতেও দেরি হয়েছে। ওর চাকরি হওয়ার পর সংসার একটু সুষম হয়েছে, মেয়েদের সুপাত্রে দিতে পেরেছেন। কিন্তু কমবয়সী বউ আনাটা ঠিক হয়নি। রায়নাকে যখন হেলালের বউ করে এনেছিলেন তখন হেলাল আটত্রিশ আর রায়না একুশ। এত ব্যবধানের সুন্দরী বউ পেয়ে ছেলের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আহ্লাদী আর ন্যাকামিপনা দেখতে দেখতে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের মাথায় গাধার ভার চাপানোর অপরাধবোধও ছিল। তাই ছেলের সংসারে নাক না গলিয়ে নিজে আড়াল হওয়াটাই ভালো মনে করেছেন। করুকগে ওরা যা খুশি। চোখের উপর না দেখতে হলেই হলো!

নিজে সারাজীবন কষ্ট করেছেন। খাওয়া-পরার অসহ্য যন্ত্রণা স্বীকার করেছেন এখন একটু আরামের খোঁজে পাঁচ কাঠা জায়গা ডেভলপারকে দিয়ে দিয়েছেন। আটটা ফ্ল্যাট আর ক্যাশ পেয়েছেন কিছু। দুই ছেলেকে দুটো করে চারটা, দুই মেয়েকে দুটো ফ্ল্যাট লিখেপড়ে দিয়ে দিয়েছেন। নিজের নামে দুটো ফ্ল্যাট রেখেছেন। সেই দুটো ভাড়া দিয়ে ছোটছেলে হাসিবের সাথে থাকেন, তিনতলায়। হাসিব ছবি আঁকে, শখকেই পেশা করেছে, কিন্তু উপার্জনের ব্যবস্থা এখনো খুব একটা হয়ন। তাকে বিয়ে দিয়ে তার সাথেই থাকবেন কীনা রাবেয়া খাতুন এখনো ভেবে দেখেননি। হেলাল পড়াশুনা করেছে, ভালো চাকরিও পেয়েছে। ভালো মেয়ে, ভালো পরিবার খুঁজে বিয়ে দিয়েছেন, বাচ্চা হয়েছে। তার সংসার আলাদা করে দিয়েছেন। চারতলার ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে, তিনতলায় পাশাপাশি থাকবে দুই ভাই। বড় মেয়ে হেনা স্বামী-সন্তান নিয়ে নিজের ভাগের ফ্ল্যাটে থাকে। ছোটমেয়ে হাফসাকে সম্প্রতি বিয়ে দিয়েছেন, সে শশুরবাড়িতে থাকে। ওর ভাগেরটা এখনো রেডি হয়নি পুরোপুরি। রাবেয়া খাতুন কাউকে বেচতে দেবেন না একটা ফ্ল্যাটও, তাই রেডি হওয়ার পরে সেটাও ভাড়া দেওয়া হবে। এতোদিন সবাই টিনের চালওয়ালা ঘরেই থাকত, হাসিবের ফ্ল্যাট পুরোপুরি কমপ্লিট হওয়ার আগেই সে ফ্ল্যাটে উঠে গেছে মাকে নিয়ে। ফ্ল্যাটে ওঠার পরে টাইলস, কিচেন ফিটিংস এর কাজ হয়েছে। হেলাল আর রায়না দেরি করেছে। ফ্ল্যাটের কাজ পুরোপুরি শেষ করিয়ে, নতুন ফার্নিচারে সাজিয়ে তারপরে গৃহপ্রবেশ ঘটছে। আগের ঘরের ফার্নিচার দু’একটা উপরে উঠেছে। কাপড়চোপড়, ক্রোকারিজ, বই, রামিমের খেলনা এসবই গুছিয়ে গাছিয়ে নিতে হচ্ছে শুধু। তাও রায়না আগের থেকে একটু একটু করে গুছিয়ে রেখেছে। এখন শুধু নিজের ফ্ল্যাট সাজিয়ে নেওয়া অল্প অল্প করে, সাধ্যমতো। রান্নার ঝামেলা নেই, হেলাল বাইরে থেকে খাবার আনাবে। টুকটাক কাজগুলো রায়না গুছিয়ে নেবে, তিথি শুধু রামিমকে চোখে চোখে রাখবে। হেনার মেয়ে রামিমকে পেলেই দুমদাম কিল বসিয়ে দেয়। কিন্তু ওকে মানা করতে গেলেও ওর মা হুলস্থুল করে ছাড়ে। তাই ঝামেলা এড়াতে রায়না রামিমকেই একটু সামলে সুমলে রাখে। আর দরজা খোলা পেয়ে রামিম দুড়দাড় সিঁড়ি বাইতে শুরু করে। টলমল পায়ে কখন হোঁচট খাবে, পিছলে পড়ে যাবে, রায়নার খুব ভয় হয়। আতঙ্কিত থাকে। তিথি সাথে থাকলে হুড়োহুড়ি হলেও রামিমের আঘাত পাওয়ার ভয় কম। তবে তার চেয়েও বেশি তিথিকে রায়নার দরকার, শিরিনের খবরদারি থেকে বেরিয়ে দুইবোনের একটু আলাদা সময় একসাথে থাকার জন্য। দুটো গল্প, একটু হাহাহিহি, বিবাহিত জীবনের কঠিন হিসাব-নিকাশের বাইরে তিথি ওর জন্য একটু মুক্তির জানালা। হেলাল সারাদিন বাইরে, শাশুড়ী সংসারের কিছুতে না থেকেও সবকিছুতে মাথার উপরে, ননদের খবরদারি – সবকিছু উজার করে বলার একটাই জায়গা রায়নার। দুজনে টিভিতে সিনেমা দেখবে, দুপুরে রামিমকে ঘুম পাড়িয়ে ভাতঘুমের বদলে দুকাপ চা নিয়ে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে পুরোনো দিনের স্মৃতি হাতড়াবে, ছোটবেলার আচার বা লাঠি চকলেটের স্বাদ আস্বাদন করতে মরিয়া হবে, একটু টুকটাক শপিং, টুকরো ঝগড়া, হেলাল আসলে শালী-দুলাভাই ঠুনঠুনি আড্ডা – খুব ভালো সময় যায় রায়নার।

তবে শিরিন একেবারেই ছাড়তে চান না তিথিকে, নিজের সুরক্ষাবলয়ের ভেতর তিথিকে আগলে রাখতে চান সবসময়ই। এমনকি রাতে তিথি না ঘুমালে শিরিন ঘুমাতেও যান না! অথচ তিথি রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত ফেসবুক-ইউটিউবে জেগে থাকবে। এই নিয়ে খটমট লেগেই থাকে। প্রতি রাতেই শিরিন-তিথি মহাভারত হয় ছোটোখাটো। তিথিকে নিয়ে চরম ইনসিকিউরড ফিল করেন শিরিন, সর্বদা – হারিয়ে ফেলার ভয় যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে তাকে। বাইরের দুনিয়ার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা যে তিথির জন্যই একেবারেই সুখপ্রদ হবে না তা তিনি ভালো করেই জানেন। কতগুলো বাজে কথা, বাজে আগ্রহ ওকে ঘিরে ধরবে। কিন্তু সেইসব বাজে কথা, বাজে মানুষগুলোকে ফেস করতে না শিখিয়ে তিথিকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখার প্রবণতাই তার বেশি। রায়নার কাছে পাঠাতেও তাই চরম আপত্তি। এবারে তিথি একরকম জোর করেই এসেছে সাথে!

এই বাসা পাল্টানোর অজুহাতে তিথিকে কয়েকদিন কাছে রাখতে পারবে, দুইবোনে ভালো একটা সময় কাটাবে, এই পরিকল্পনাই করেই তিথিকে ডেকেছে রায়না। তিথির মনটাও একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। গুলশানের সম্বন্ধটাও ভেঙে গেছে। যদিও তিথিকে সেইভাবে জানানো হয়নি। আতিক, শিরিন আর খালেক সাহেব মিলে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন, সেখানেই তিথির অজান্তে দেখাদেখির পর্বটা সেরে ফেলা হয়েছে। তবুও ওর অজানা কিছুই না। ও যে জানে সেটা আবার ও কাউকে বুঝতে দেয় না। মনের ভেতর যে টানাপোড়েন সেটার আঁচও ও কাউকে পেতে দেয় না। কারো প্রতি, জীবনের প্রতি ওর কোনো আক্ষেপ নেই, অভিযোগ নেই। যতটুকু পেয়েছে, মায়ের, বাবার, ভাইয়ের, বোনের স্নেহ, নিজের জন্য ওর যথেষ্ট মনে হয়৷ কতজন তো এইটুকুও পায় না। সেই কতজনের কথা ভেবে নিজেকে বরং ওর ভাগ্যবতীই মনে হয়। শান্তি সবজায়গাতেই। শুধু চোখের সামনে একটা মুখ ভেসে বেড়ায় – মায়াময়, শীতসকালে ঘাসের ডগায় ঝিকিমিকি করা টলটলে শিশিরবিন্দুর মতো স্নিগ্ধ মুখটা, সেই মায়াবতীর সামনে দাঁড়াতে খুব ইচ্ছে করে। একবার একটা বোঝাপড়ার সুযোগ খোঁজে মন।

এসব ভাবতে ভাবতেই ছাদে উঠল তিথি রামিমকে নিয়ে। সদ্য লিফট লেগেছে। লিফটের বোতাম টিপে ওঠানামা করতে তিথিরও মজা লাগে, নামার সময় হঠাৎ ভরহীন হওয়াতে রামিমও খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। দুজনের ভারী এক নতুন খেলা হয়েছে। ছাদে উঁচু ঢালাই দিয়ে কেয়ারি বানানো হয়েছে। গাছ লাগাবে বিল্ডিংয়ের বাসিন্দারা। কেয়ারিগুলোর চারিপাশে টাইলস জড়ো করে রাখা, নতুন মাটি তুলে ভরা হয়েছে সদ্যই। কিছু আমের চারা, লেবুর চারাও আছে।

ছাদে উঠেই রামিম দেয় ভোঁ দৌঁড়! ওর পেছন পেছন তিথিও দৌঁড়ানো শুরু করে। এবারে এক দৌঁড় দিয়ে রামিম ঝপ করে গিয়ে পড়ল একডালা রঙের কৌটোর উপর। মূহুর্তে সব রঙ উপুড় হয়ে একাকার! সেদিকে অবাক, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে হাসিব। ইজেলে ক্যানভাস পেতে রঙ চড়িয়েছিল। সারা সকালের পরিশ্রমে ছবিটা ফুটে উঠতেও শুরু করেছে। নিজের কোনো আয়-রোজগার নেই। সব ভাইবোনের ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া হয়ে গেলেও ওর ফ্ল্যাটেই ভাড়াটিয়া ওঠেনি। ক্যানভাস, রঙ কেনার জন্য রাবেয়া খাতুনের পায়ে পায়ে ঘোরা লাগে। অতি সাবধানে রঙের ব্যবহার করে ও, একটুও যেন অপচয় না হয়। বারবার রাফ করে নেয়, যেন অতিরিক্ত ক্যানভাসের দরকার না পড়ে। মাত্রই রঙের কৌটোগুলো খুলেছিল, সবটা পড়ে গেছে! সারা মাস এখন ওর রঙহীন কাটাতে হবে।

ল্যান্ডস্কেপ ধরেছিল। সামনের উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর মাথায় মধ্যদুপুরের রোদ খেলা করছে, অনেক চেষ্টায় সেই রোদ ও ক্যানভাসে ধরেছিল। আঁকা ছবিতেও রোদটুকু জ্যান্ত হয়ে আটকে গেছে। কী টকটকে রোদ! ঘিলু টগবগ করে ফোটা রোদ। চোখে অন্ধকার দেখা আলো। এমন দারুণ একটা ছবি কোনোদিনও আঁকেনি হাসিব। আরেকটুখানিই হয়তো বাকি ছিল, যাস্ট লাস্ট ফিনিশিংটুকু!

আবার রঙ কিনে এনে কবে শেষ করতে পারবে! সেদিনও কি আজকের মতই হাত খুলবে? একটা দারুণ ছবি, একটা কিক! কীনা করছে, একটা কিক পাওয়ার জন্য?

একজন পেইন্টারের জীবনে একটা কিকই দরকার শুধু, যাস্ট একবার ফোকাসটা নিজের দিকে আনতে পারলেই বাকি সব এলোমেলো ক্যানভাসও দামী আর্টিস্টিক পেইন্টিং হয়ে যায়!

রাতদিন এক করে ভাবে শুধু হাসিব, শুধু পরকল্পনাই করে যায়, স্বপ্নেও ফাঁকা ক্যানভাস চোখের সামনে ইজেলবন্ধ হয়ে থাকে। সেখানেও রঙের অভাব! অভাব সবখানেই – স্বপ্নের রঙগুলো মাত্রই তো রঙিন হতে শুরু করেছিল, সব থমকে গেল। হাসিবের কান্না পেতে লাগল! আর্টিস্টদের মন কি খুব নরম হয়? খুব কি স্পর্শকাতর? সব অনুভূতিগুলোই কি খুব বেশি ধারালো হয়? হাসিবের দুই চোখে প্লাবন ডাকল। টুপ টুপ করে মেঘগলা জলে ভারী হতে লাগল চোখের কোল!

কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিথি প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে হাসিবের দিকে। মাথার উপর ঠাডাভাঙা রোদ, সেই রোদের ঝিলিক সামনের পেইন্টিংয়ে, তার সামনে হাপুসনয়নে কাঁদছে বছর আটাশের তাগড়া পুরুষ। ক্যানভাসের রোদ আর হাসিবের চোখের বৃষ্টি – দুইয়ে মিলেমিশে অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু তীব্র কষ্টমাখা একটা পরিপূর্ণ ছবি যেন! তিথিকে নাড়া দিয়ে গেল এই দৃশ্য! মন খারাপ হলো ওর। বিষাদে ভরে গেল বুকটা। অপরাধবোধও জাগল খুব। ওর জন্যই রামিম এত জোরে দৌঁড়াল আর অঘটন ঘটল। তিথি যদি সামলে রাখত ওকে তবে হাসিবের এত বড় ক্ষতিটা হতো না!

হোঁচট করে পড়ে যাওয়া রামিমকে কোলে তুলে নিয়ে হাসিবের পাশে দাঁড়াল তিথি। আস্তে করে হাসিবের কাঁধে হাত ছোঁয়ালো ও,

—- ‘হাসিব ভাই, খুব সুন্দর হয়েছে, আপনি পুরোটা শেষ করে ফেলতে পারবেন। খুব দারুণ একটা ছবি হবে।’

হাসিব তাকালো তিথির দিকে। ওকে হাসিব নিজের ভাবির চঞ্চল, অবাধ্য, দুষ্টু বোন বলেই জানে ও। লাউড একটা মেয়ে। ভীষণ জোরে কথা বলে, জোরে জোরে হাসে – হাসিবের বিরক্তি লাগে।

মেয়েরা হবে কোমল, আঙুরলতার মতো নরম, পুরুষের অবলম্বন পেঁচিয়ে নিজের সৌন্দর্য মেলে ধরবে, থাকবে রহস্যময় আলো-আঁধারি চোখ জুড়ে! তিথির মতো এমন খোলামেলা, লাউড, বোল্ড, ঝাঁকানাকা টাইপ মেয়ে আর্টিস্টদের কাছে পছন্দ হওয়ার কোনো কারণই নেই। একটু রহস্য না থাকলে সব উঁচু টোনে কি ভালো সুর হয়, চড়া রঙে কি থ্রিল জাগে?

পড়ে গিয়ে উপুড় হওয়া রঙের বোতলের কিয়দংশ রঙ রামিমের হাতজুড়ে। সেই রঙে হাত রাঙিয়ে বালখিল্য আনন্দে তিথির মুখখানিও রাঙিয়ে দিয়েছে ও। তিথির সারা মুখ জুড়ে হলুদ, কমলা, লাল রঙের ছড়াছড়ি। এত রঙ আর রঙিন তিথি, শিল্পীর চোখে শৈল্পিক নান্দনিকতা ধরা পড়ল।

হাসিবের চোখ আটকে গেল তিথিতে। অনেকখানি খাঁড়া নাক, নাকের দুপাশে চমৎকার খাঁজকাটা, গোল পূর্নিমার চাঁদের মতো মুখ, গালের একপাশে কাটা দাগ যেন সেই পূর্ণচাঁদেরই কলঙ্ক। বাসী বিনুনির ফাঁক গলে অবিন্যস্ত চুলগুলো কপাল ছড়িয়ে কানের দুপাশে নেমে গেছে, পাতলা ঠোঁটের দুইঞ্চি নিচে চমৎকার একটা তিল। আর্টিস্টের চোখে নারীমুখের সবচেয়ে প্রিয় চিহ্ন। হাসিবের নিজস্ব একটা ভাবনা আছে এই বিউটি স্পট নিয়ে। ভুরুর কোণে, চোখের নিচে, কপোলে বা ঠোঁটের কোণে যেখানেই তিল থাকুক না কেন আলাদা আলাদা নারীতে সেটাই দেয় আলাদা ব্যাঞ্জনা, যার মুখে যেখানেই হোকনা কেন, সেখানেই যেন তিলের অবস্থানটা পারফেক্ট। যারটা চোখের কোণ ঘেঁষে, তাকে ওইভাবেই সুন্দর লাগে, ঠোঁটের নিচের তিলটা তাকে যেন কিছুতেই মানাতো না!

তিথিকেও আজ খুব ভালো লাগল হাসিবের। শিল্পির চোখে, মানবের চোখে, পুরুষের চোখে!

তিথির সমবেদনা তাই ওকে স্পর্শ করল। মন খারাপটা মিলিয়ে গেল। ভেজা চোখ হাতের উল্টোপিঠে ঘষে শুকিয়ে নিয়ে একটু হেসে তিথিকে আশ্বাস দিলো,

—- ‘ঠিক বলেছ, সুন্দর ছবি হবে। তবে রঙটা আসবে কোথথেকে? টাকা পাবো কোথায়? আমি ফকিরগোত্রের শিল্পিসাধক।’

— ‘ঠিক আছে ভাইয়া, আমি দুলাভাইকে বলব।’

—- ‘না, রঙ কেনার টাকাটা তুমি আর তোমার এই ননীগোপাল যোগাড় করে দেবে। তবেই মাফ পাবে। তবেই মাসী আর বোনপো মাফ পাবে।’

তিথি এবার করুন চোখে তাকালো। হাসিব মৃদু হাসলো। তাড়াতাড়ি করে বলল,

—- ‘তবে যদি ‘তালামণি’ এখন চমৎকার করে এক গ্লাস বরফঢাকা পানি খাওয়ায় তবে শাস্তি কমতে পারে।’

বিব্রতকর পরিস্থিতি সহজ আবদারে পালটে দিলো হাসিব।

রামিম যে তালামণি বলে ডাকে তিথিকে এটা খেয়াল করেছে ও। তিথি হাসল,

—- ‘আমি আসছি, হাসিব ভাই।’

তিথি রামিমকে কোলে নিয়ে দৌড়ে তিনতলায় নামল। ফ্রিজ খুলে তিন টুকরো বরফ নিয়ে স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে গলাপানি ঢালল। রামিমকে কোলে নিয়েই আবার দৌঁড়ে ছাদে এলো। ছাদে উঠে হাসিবকে পেলো না কোথাও। ক্যানভাস গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে ও। তিনতলায়ই নেমে গেছে হয়তো। তিথি যখন ফ্রিজ থেকে আইসট্রে নামানোতে ব্যস্ত তখনই হয়তো নেমে গেছে। এভাবে পানি আনতে বলে চলে গেল?

কেয়ারির বাঁধানো ইটের প্লাস্টারহীন দেয়ালের উপর পানির গ্লাসটা রাখল তিথি। বরফ গলতে শুরু করেছে, সাদা রঙের চৌকোনা জীবনপাথর ডুবছে ভাসছে তরল পানির ভেতর। বিন্দু বিন্দু পানি গ্লাসের গায়ে জমা হয়েছে। ওর খুব তৃষ্ণা পেলো তখন। টনসিলে গলা ফুলে ব্যথা হবে, সেসব না ভেবেই ঢকঢক করে গিলে নিলো সবটুকু ঠান্ডা পানি, শেষ বিন্দুটুকুও।
ইজেলটা দাঁড়িয়ে আছে তখনো।
খালি গ্লাস আর শূন্য ইজেলের মতো ওর নিজেকেও খুব ফাঁকা লাগতে লাগলো, একাকি আর নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগল। অকারণে চোখদুটো পোড়াতে লাগল

চলবে…
আফসানা আশা