তিথি পর্ব-০৪

0
554

তিথি – ৪

তিনদিনেই অস্থির হয়ে পড়েছেন খালেক সাহেব। তার সারাবাড়ি নাকি ফাঁকা হয়ে আছে। আতিক, জলজ্যান্ত শিরিন থাকতেও নাকি বাড়িটাকে আস্ত একটা মরাবাড়ি মনে হচ্ছে। একটু পরপরই হাহা করে উঠছেন আর বলছেন,
—- ‘আয়হায় আমার সারাবাড়ি তো অন্ধকার হয়ে আছে।’
পেপার পড়ার সময় টপ হেডিং বা ব্যতিক্রমী কোনো সংবাদে চোখ আটকে গেলেই একটু পরপরই তিথিকে ডাকছেন,
—- ‘তিথি, কই মা, দেখে যা কী হইছে।’

আবার চায়ের তৃষ্ণাও যেন বেশি বেশি লাগছে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না, চা নামক অমৃতে গলা ভেজাতে। শিরিন দুবার এসে জিজ্ঞাসা করে গেছেন চা দেবেন কি না?
তিথি ছাড়া চায়ে রুচি হয়নি খালেক সাহেবের। চা তো শুধু খাওয়া হয় না, চা একটা আসর। খালেক সাহেব চেয়ারে পা তুলে জমিয়ে বসেন। তিথি কাঠের সেন্টার টেবিলের উপর উঠে আসন দিয়ে বসে সারাদিনে শিরিন ওকে কতখানি বকেছে, শিরিনকে কীভাবে শায়েস্তা করা যাবে তার প্ল্যানিং হয় কিছুক্ষণ, দেশের ও সারাবিশ্বের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠক হয় কিছুটা সময়। সিনেমা, নাটক, সাহিত্য, সমুদ্র, মহাকাশ সবকিছুতেই নিজের নিজের পাণ্ডিত্য জাহির হয় সেই আড্ডায়। নিজের পরীক্ষায় কত নাম্বার এলো তার চেয়ে বেশি চিন্তিত দেখায় তিথিকে, শিরিনের রান্না করা তরকারির টেক্সচার ঠিকঠাক এলো কি না সেই ভাবনাতে। আর খালেক সাহেবের কাজ তিথির সবকিছুতেই তাল দিয়ে যাওয়া। তিথির কানে ফিসফিস করে বলে, ‘তোর মা আজকে ডালের বড়ায় ডাবল লবণ দিয়েছে, কিন্তু আমরা তো কোনো কমপ্লেইন করতে পারব না। দুনিয়া জুড়ে স্বৈরতন্ত্রের জয়জয়কার এখন।’

— ‘হুম, বলো না, বাবা। বললেই…ইন্না-লিল্লাহ’’
তর্জনী সংকেত দিয়ে নিজের গলার বাঁদিক থেকে ডানদিকে টেনে এনে জবাই হওয়ার ভঙ্গি দেখায় তিথি।

আতিক তিথিকে রায়নার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরেই ডাকাডাকি শুরু করেছে তিথিকে,
—- ‘তিতকুন্নী?’
বলেই জিভে কামড় দিয়েছে। বয়সে আতিক তিথির চাইতে পাঁচ বছরের বড়। অল্প বয়সেই একটু বেশি গাম্ভীর্য আর পরিপক্ক ব্যক্তিত্বের ছায়া এসে গেছে চেহারা ও আচরণে। তিথিকে কঠিন শাসনে রাখার অদম্য চেষ্টা ছোটবেলা থেকেই আছে ওর। সাথে তিথির আবদার, আহ্লাদ পূরণেও চেষ্টা অবিরত। তবে শাসনটা শুধু পড়াশুনার জন্যই। আর সবকিছুতেই তিথির অসীম স্বাধীনতা। একসাথে বসে বসে তিন ভাইবোনের তুমূল আড্ডা চলে, ক্ষেত্রবিশেষে মারামারি। আতিক আর রায়নার ভিতরেই মারাপিট বেশি হতো, তরেফারির কাজটা তিথির। রায়নার বিয়ের পরে শশুরবাড়ি চলে যাওয়াতে অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে আড্ডাটা। আড্ডার জায়গা নিয়ে নিয়েছে মুভি দেখা। প্রতিদিনই প্রায় দুইজনে মিলে সিনেমা দেখবে আর প্রতিটা ছবিকেই আতিক অখাদ্য বলে একপেশে রায় দিয়ে উঠে যাবে। মুভি দেখা নিয়েও বিতর্ক। তিথি তেতাল্লিশতমবার ‘মুঝসে দোস্তি কারোগি’ দেখবে তো আতিক দেখবে ‘উনিশে এপ্রিল’। কিন্তু একসাথেই দেখতে হবে, হজম হোক বা না হোক। তিথির একদিনের অনুপস্থিতিও তাই খালেক সাহেবের সাথে সাথে আতিককেও বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।

আর শিরিনের কাজ অনেকখানি কমে গেছে। তিথির পড়ার টেবিল গোছানো লাগেনি। প্রতি ঘন্টায় চায়ের যোগান দেওয়া লাগেনি। দুপুরের খাবার শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বিকেলের নাস্তা কী হবে তা নিয়ে কেউ ব্যতিব্যস্ত করে তোলেনি। সিরিয়ালের ইমোশনাল মোমেন্টে কেউ এসে রিমোট নিয়ে নেয়নি, ‘মা, সরোতো, এইসব বাংলা ঘরকাইজ্জা কী দেখো? বিগ বস শুরু হবে এখন। একটু যদি হিন্দিটা শিখে নিতে?’ তবুও শিরিনের ভালো লাগছে না কিছু। ঘন্টাদুই অন্তর অন্তর ফোন করছেন। তার ঘর যতটা শান্ত হয়ে আছে, মনটা ততটাই অশান্ত! কেউ কিছু বলছে না তো তিথিকে? রায়নার ননদ হেনা বড্ড ঠোঁটকাটা, টকাস টকাস করে কথা বলে। খারাপ কিছু যদি বলে বসে তিথিকে? রায়না কি পারবে সামলে নিতে? আবার তিথিও আছে, কারও কথা শুনে ইগনোর করে ফিরে আসার মতো মেয়েই না। কিল খেয়েও মান বাঁচাতে কখনো কখনো কিল চুরি করতে জানতে হয়। এই বিদ্যা পই পই করে শিখিয়েছেন শিরিন ওকে। কিন্তু ওই মেয়ে সেই ধাতুতে গড়া বুঝি? পালটা উত্তর না দিয়ে, ও জায়গা ছাড়বেই না। কেউ একটা কথা শুনালে ও দশটা বলবে। কী কান্ড রায়নার বাড়িতে ঘটিয়ে আসবে কে জানে? ‘মুখরা, হস্তিনী মেয়েমানুষ’ বলে তিথিকে গালাগাল করলেন মনে মনে।

ভাইবোন সবার মধ্যে বড় হওয়াতে শিরিন একটু বেশিই ভালোবাসতেন সবাইকে। শাহানাও ছিল তার খুব আদরের। দ্বিতীয়বারের মতো মা হতে যাওয়ার সংবাদটাও শুধু শিরিনই জানতেন। শীতকাল ছিল তখনও। আমের আচারের আবদার করেছিল শাহানা। অনেক খুঁজেও আম পাননি কোথাও। শাহানার পছন্দের পিঠেপুলি আর জলপাইয়ের আচার বানানোতে মনোযোগ দিয়েছিলেন শিরিন। শিরিনের হাতে আচারের বয়ম দেখলেই সবাই সব বুঝে যাবে, এই কথাই চিঠিতে লিখেছিল শাহানা। সব ঠিকঠাকই ছিল, একদিন হয়তো দেরি হয়েছিল শিরিনের শাহানার বাড়ি পৌঁছাতে, আতিকের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার দিনটা পিছিয়ে গিয়েছিল একদিন। তার ভেতরেই অঘটন ঘটল। বাড়ি বসেই খবর পেলেন, শাহানা তার দেবর জাফরের হাত ধরে নিরুদ্দেশ হয়েছে। আর তার তিনদিনের মাথায়ই আরেকটা খবর পেলেন, শাহানার স্বামি জাহিদ স্ত্রী আর ভাইয়ের দেওয়া এই অপমান মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। কী সময়টাই না গেছে সেই দিনগুলো! আজও মনে পড়লে শিরিনের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। শাহানার স্মৃতি, এতিম তিথি ফুফুর বাড়ি, দাদার বাড়ি, নানাবাড়ি ঘুরে মাসছয় পরে এসে জোটে শিরিনের কোলে। ততদিনে নিজের ছেলেমেয়ে আতিক আর রায়না স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, দূরে সরতে শুরু করেছে। বোনের আদর, তার অনুপস্থিত মায়ের স্নেহের সাথে মিলে দ্বিগুণ হয়ে, তিথিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি। সেই বাঁধন আর আলগা করতে পারেননি। তিথির স্কুল-কলেজের এটেন্ডেস খুবই কম। আজ ঠান্ডা, কাল গরম বেশি, বৃষ্টি হলেই রেইনি ডের স্বঘোষিত ছুটি এসব নানা অজুহাতে পারলে বাইরের দুনিয়ায় না পাঠিয়ে ঘরের চার দেয়ালে, নিজের চোখের সামনেই আটকে রাখতেন তিথিকে তিনি। তবে সংসারে তার ইচ্ছেতেই তো সব চলে না, সেই আক্ষেপ আছে শিরিনের!

তিথি এইদিকে খুব আনন্দেই আছে। রায়না নতুন চকচকে ফার্নিচার দিয়ে ঘরগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছে, দুটো বেডরুমের ফ্ল্যাট, বারোশো স্কয়ার ফিট। দক্ষিণ দিকে খোলা। আলো বাতাসে ভরপুর। প্রায় সব গোছগাছ শেষ রায়নার। নতুন ভাঁজখোলা বেডশিটগুলো বিছিয়ে দিতে সাহায্য করল তিথি। হোমটেক্সের চাদর। সুন্দর ডিজাইন। পুরো ঘরের চেহারাই বদলে গেল। প্রতিবার নতুন বিছানার চাদর দিলে, তিথির পুরো বাড়ি এমনকি নিজেকেও নতুন বলে মনে হয়। ছুটা বুয়া এসে ফ্লোর পরিষ্কার করে দিলেই ধুলোময়লা দূর হয়ে সারাদিনের কাজ শেষ হলো রায়নার। রামিমকে গোসল করিয়ে, খাইয়ে, ঘুম পাড়ানোর কাজটা তিথি করে দিয়েছে। এমনকি রামিমের খিচুড়িও ওই রেঁধেছে আজ। এখন ঘুমন্ত রামিমের পাশে বসে বসে মোবাইল গুতাগুতি করছে। করুক, রামিমের জন্য কিছু করতে হয়নি এতেই অনেকটা হেল্প হয়েছে ওর। ‘মা শুধু শুধুই বকে তিথিকে’ মনে মনে বলল রায়না। তার উপর বিছানাগুলোও গুছিয়ে দিয়েছে তিথি। দুই বেডরুমে দুটো কিংসাইজ খাট ফেলার পরেও ড্রইংরুমে একটা সিংগেল খাট বসিয়েছে হেলাল। কেন কে জানে? মানুষ তো মোটে দুজন, রামিম তো একটুকু জায়গা নেয়!

দুপুরের খাবার নিয়ে চলেও এলো হেলাল। তিনতলা, চারতলার সবাই খাবে একসাথে। তবে রান্নাবান্নার প্যারা নেবে না রায়না আজকে। বিরিয়ানি এসেছে দুপুরে আর রাতে চাইনিজ হবে। হেনা, হেনার বেকার জামাই, ওদের মেয়ে মিমি এসে গেছে। মিমি ঢুকেই রামিমের পিঠে দুই ঘুষি মারল। কান্নারত রামিমকে কোলে তুলে নিয়ে তিথি মিমিকে আদর করে বলল,
—- ‘মামণি, তোমার তো ছোটোভাই হয়, এভাবে মারে কেউ? রামিম তোমাকে বড় আপা বলে ডাকবে তো? বড় আপারা কি ছোটভাইকে মারে কখনো?’

ছয় বছর বয়স মিমির। মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
—- ‘ও আমার ভাই না মোটেও। আমার মায়ের পেট থেকে যে আসবে, সেই আমার ভাই হবে। এই বিচ্ছুটাকে তো আমি মেরেই ফেলব।’

হেনা আর হেনার জামাই মেয়ের বুদ্ধিতে হেসে উঠল। — ‘দেখলে, মেয়ে কেমন সব বোঝে? ওর মায়ের পেট থেকে আসলেই যে ভাই হবে কী সুন্দর করে বলল!’ তিথি অবাক হলো মানুষ এতো নির্লজ্জ কী করে হয়? ওদের মেয়ের শেষ কথাটা কি শোনেনি? সন্তানে মুগ্ধতা থাকে সব বাবা মায়েরই। বাচ্চা যা করে তাই তাতেই নিজের বাচ্চাকে সেরা মনে হয়। কিন্তু এ কোন শিক্ষা দিচ্ছে মিমির বাবা মা ওকে? শিরিনের কথা মনে হলো তিথির। মিমি যা করেছে তা যদি তিথি করত এতক্ষণে রুটি বেলার বেলন তিথির পিঠে ভাঙতেন শিরিন।

তিথি আস্তে করে হেনাকে বলল,
—- ‘আপা, মিমিকে একটু শিখাবেন, রামিমকে যেন না মারে।’

— ‘তুমি কী বলো এইগুলা? চাইল্ড সাইকোলজি জানো? ন্যাচারাল বিহেভিয়ার এইগুলো সব বাচ্চারই। সিবলিংকেই মারে আর রামিম তো কাজিন। টেন্ডার এইজের বাচ্চাকে কন্ট্রোল করতে গেলে মনের উপর প্রেশার পড়ে। ওদের ক্রিয়েটিভিটি ডেভলপমেনটে হার্ডলস তৈরি হয়।’

হেনার গালভরা ইংরেজি টার্মস আর চাইল্ড সাইকোলজির উপরে লেকচার শুনে তিথির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। অন্য কেউ হলে ও আচ্ছামতো ঝাড়ত কিন্তু এখানে আসার আগে শিরিন ওকে পাখিপড়া করে বুঝিয়েছেন, যেন কার সাথে কোনোরকম বেয়াদবি না হয় আর রায়নাও শিখিয়েছে হেনাকে একটু সমঝে চলতে। তিথি যদি ওকে একটা কথা শুনায় তো হেনা রায়নার উপর দিয়ে সেই ঝাল দশগুণে ঝাড়বে। নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই কিন্তু রায়নার ঝামেলা হবে সেই আশঙ্কায় ও নিজেকে যথাসম্ভব চুপ করিয়ে বলল,
—- ‘আপা, চাইল্ড সাইকোলজি আপনার যথেষ্ট জানা আছে আমি বুঝতে পারছি। তবে আমি শাসন করতে বলছি না, একটু সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন প্লিজ! আর কিছু মনে করবেন না, আমার মনে হচ্ছে ও একটু বেশিই ফিউরিয়াস, যেটা ঠিক নরমাল না। আপনি ওর পেডিয়াট্রিশিয়ানের সাথে একটু আলাপ করেন।’

সন্তান সম্পর্কে এরকম কিছু শুনলে যেকোনো মায়ের জন্যই সহ্য করা কঠিন। হেনাও ব্যতিক্রম হলো না। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তার উপরে রায়নার বোন নিয়ে আদিখ্যেতা একদম বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে। তিথি মোটামুটি চক্ষুশূল ওর। ও রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—- ‘কী বললে তুমি? কী বললে? আমার মেয়ে এবনরমাল? এই মেয়ে, ঠিক করে বলো, তুমি কি এটাই বলার চেষ্টা করলে?’

— ‘না আপা, আমি মোটেও ওটা বলার চেষ্টা করিনি। আমি বলেছি যে মিমির বিহেভিয়ার ঠিক নরমাল না। কোনো একটা বিহেভিয়ারেল ডিসঅর্ডার আছে। ডাক্তার দেখিয়ে শিওর হয়ে নিন।’

— ‘বেয়াদব মেয়ে। আমাদের বাড়ি এসে আমাদেরকে এত বড় কথা?’

— ‘মোটেও আমি আপনাদের বাড়ি আসিনি। আপনার বাড়ি আমি কেন আসব? আমি আমার বোনের কাছে এসেছি। আপনার বাড়ি হলে আমি জীবনেও আসতাম না।’

রায়না রান্নাঘরে টমেটো, শসা, পেঁয়াজ কাটছিল। এদিকে আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি এসে দেখে, যা ভয় পাচ্ছিল তাই। তিথিকে বারবার সাবধান করেছে ও, যেন হেনাকে একেবারেই না ঘাঁটায়!
রায়নাকে দেখেই হেনা চিৎকার করল,
— ‘এই যে আসছ, দেখো তোমার বোন কত্তবড় বেয়াদব। অবশ্য কী আর দেখবা, তুমিও তো একই দলের।’
রাগে কথা বলতে পারছে না হেনা। ফোঁসফোঁস করতে লাগল,
—- ‘’বলে কি না আমার মেয়ে নাকি প্রতিবন্ধী?’

তিথি বলার চেষ্টা করল,
—- ‘আমি মোটেও সেই কথা বলিনি। আপনি মিথ্যা কথা বলছেন কেন?’

রায়নার ধমকে তিথির কথা চাপা পড়ে গেল,
—- ‘তোকে না কতবার মা শিখিয়েছে, বড়দের মুখে মুখে কথা না বলতে? আসলেই তুই বেয়াদব হয়ে গেছিস! বেয়াদবি করলে মানুষ বেয়াদব বলবে না? তোকে বলছি রামিমের সাথে থাকতে। তুই ওকে নিয়ে থাক। ওকে সামলে রাখ। মিমির আশেপাশে আনিস না। তাহলেই তো হবে।’

হেনা তখনও ফোঁসফোঁস করছে। সাতবছর দাম্পত্যর পরে অনেক ডাক্তার, কবিরাজ, টোটকার পরে তার মেয়ে এই মিমি। কতখানি আকুলতার পরে গর্ভজাত সন্তানের মুখ দেখতে পেরেছে তা ওই জানে। প্রায় তুলোর মধ্যে রেখেই মেয়েকে বড় করেছে ও। মিমির হাঁটাচলা, খাওয়া, কথা বলা সবকিছুতেই ওকে দারুণ মেধাবী আর বুদ্ধিমান মনে হয় হেনার। কোনো খুঁত নেই মিমির। তাই তিথির কথাগুলোকে মনের ভেতরেই তিল থেকে তাল করে নিয়েছে।

হাসিব আর রাবেয়া খাতুন ততক্ষণে চলে এসেছেন। ওদেরকে দেখে হেনা শান্ত হলো। মায়ের কাছে নালিশ করে কোনো লাভ নেই। রাবেয়া খাতুন রায়নাকে কিছুই বলেন না, হাজারটা অন্যায় করলেও চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখেন না। তবে রায়নার কোনো কাজে সাহায্য করতেও তাকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়না। রামিম যখন পেটে, অন্তঃসত্বা রায়না একা একা সংসারের সব কাজ করে উঠতে পারত না। মর্নিং সিকনেসের কারণে সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে উঠতে পারত না। বেশিরভাগ দিন হেলাল বাইরে থেকে নাস্তা আনাতো। রাবেয়া খাতুন আলাদা সংসার করে দিয়েছিলেন বিয়ের মাস তিনের মধ্যেই। হেনার জন্য সকালে আটার রুটি ঠিকই করতেন তবে রায়নাকে দুটো রুটি গড়িয়ে দিতে তাকে কখনোই দেখা যায়নি। তিনি কথার খোঁটা দেন না, হেনা রায়নাকে কথা শোনাক তাও চান না, রায়নার প্রতি একরকম বিতৃষ্ণা আছে তার। তার অতি কষ্টের গড়া সংসারের মধুটুকু নিংড়ে নিচ্ছে রায়না, এটাই তার মনের ভেতর বসত করা গোপন অভিযোগ রায়নার প্রতি! তবে হেলালের হাসিমুখ কল্পনা করেই ছাড় দেন ওকে। থাক না হেলাল আর রায়না, সুখে থাক। কোনো অশান্তি তিনি চান না।

হাসিব একটু ভাবুক প্রকৃতির ছেলে। শিল্পীসুলভ গাম্ভীর্যের আবরণে মোড়া। সবসময়ই চোখে স্বপ্নালু দৃষ্টি। সবখানেই শিল্প খোঁজে ওর শিল্পীসত্ত্বা। মাপা কথা বলে, মেপে মেপে খায়, পরিমাপ করেই হাসে। তিথি আগেও এসেছে এই বাড়িতে অনেকবার, যখন নিচতলার টিনের ঘরে সবাই একসাথে ছিল তখনও এসেছে। অল্পসময় থেকেছে, সালাম আদান-প্রদান, কুশল জিজ্ঞাসা ছাড়া তেমন কোনো কথা হয়নি কখনো। আজকে তিথির দিকে চোখ ঘুরছে বারবার, তিথির মুখের কাটা দাগটাও যেন বারবার চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে ওকে।

তিথি দৌঁড়ে দৌঁড়ে রায়নাকে সাহায্য করছে। লেবুটা এগিয়ে দিচ্ছে, বোনপ্লেট বের করছে, পানি ঢেলে দিচ্ছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া বচসার কালিমার ছিঁটেফোঁটাও নেই মুখে। ছোট্ট এক টুকরো অমলিন হাসি ঠোঁটের কোণা ধরে ঝুলছে। মিমিকে রোস্টের মাংস খুলতে সাহায্য করেছে, মিমি খাবার নিয়ে বাহানা করলে চকলেটও অফার করেছে ওকে, কোনো তিক্ততাই ওর মনের ভিতর বসত করে থাকে না। এখন রাগ হয়েছে, টুং করে মাথার তার দুটো ছিঁড়ে কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে নইলে একদম গাল ফুলিয়ে হফ মেরে চুপ করে থাকবে। কথা বলবে না, খাবে না, টিভি দেখবে না। আবার একটু সময় গড়াতেই অভিমানটুকু পারদের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেও কোনো কারণ লাগে না।

— ‘তিথি, তুমি কি রাগ করেছ আমার সাথে? কথা বলছ না, তাকাচ্ছ না?’
খাওয়া শেষ করে সবাইকে চা দিয়ে নিজের কাপটা নিয়ে রামিমকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে সবে একটা চুমুক দিয়েছিল তিথি তখনই হাসিব এসে কথাটা বলল।

সাবধানে গরম চায়ের কাপটা বেডসাইড টেবিলে রেখে রামিমকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে তিথি বলল,
—- ‘অবশ্যই রাগ করেছি, হাসিব ভাই। অনেক রাগ করেছি। রাগ তো করবই, আপনি ঠিক বুঝেছেন। আপনি জানেন না, কেন রাগ করেছি?’

— ‘হুম, বুঝতে পারছি। তবে কেন আমি তোমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করলাম না তার ভালো কারণ আছে আমার কাছে। আমি অজুহাত দাঁড় করাতে পারি খুব ভালো।’

তিথি বুঝতে পারল না, হাসিব কী বলতে চাইছে!

— ‘চলো, আমার সাথে। একটা দারুণ জিনিস দেখাব। তখন আর রাগ করে থাকতে পারবে না তুমি তিথিরাণী!’
কৌতুক করে বলল হাসিব।
—- ‘আর তোমার ওই ননীগোপালকে তার মাতৃহস্তে অর্পণ করে চলো, আশ্চর্য জিনিস দেখাব তোমাকে।’

রামিমকে হাসিবই কোলে তুলে নিলো। বাইরের ঘরে রায়না আর হেলাল শুধু। হেনারা চলে গেছে। রাবেয়া খাতুনও তাদের সাথেই চারতলায় গেছেন। সিরিয়াল দেখবেন। আজকাল মেয়েবুড়ো ভেদাভেদ নেই। দাদি-নাতনি, মা-মেয়ে সবাই একসাথে সিরিয়াল দেখছে। হাসিবের ফ্ল্যাটে টিভি নেই। তাই রাবেয়া খাতুন উপরে মেয়ের বাসায় যান টিভি দেখতে। রামিমের সাথে কিছুক্ষণ দলাই-মলাই, হুটোপুটি করে ওকে রায়না’র কোলে দিলো হাসিব। তারপর বলল,
—- ‘তোমার বোনকে আমার স্টুডিও দেখিয়ে নিয়ে আসি ভাবি। তুমি কিছুক্ষণ তোমার ছেলে সামলাও।’

রায়নার চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট লেখা ছিল, প্রস্তাবটা ওর একেবারেই পছন্দ হয়নি। অনিচ্ছায় সম্মতি দিলো, — ‘যাক, তবে পাঁচ মিনিটের ভেতর চলে আসবি, তিথি। বিকেলের জন্য পাকোড়া ভাঁজব। তুই রামিমকে রাখবি।’

আটতলা বাড়ির প্রতি ফ্লোরে তিনটা করে ইউনিট। লিফট, করিডোর, স্টেয়ারকেস মিলিয়ে বারোশো স্কয়ার ফিট প্রতিটি। হাজার পঞ্চাশের মতো হবে প্রতিটা ইনডিভিজুয়াল এপার্টমেন্ট। মাঝারি আয়তনের। দুটো বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং আর দুটো করে বারান্দা,ওয়াশরুম। নো ডিস্টার্বেন্স টাইপ ডিজাইন। ড্রইং, ডাইনিংয়ের লম্বা জায়গা পেরিয়ে দুইপাশে দুটো বেডরুম। একটা বেডরুম হাসিবের, অন্যটা রাবেয়া খাতুনের। হাসিবের পেছন পেছন তিথি একেবারে হাসিবের বেডরুমে গেল। এটাই স্টুডিও। একপাশে বেড পাতা আছে কিন্তু সেটা গৌণ। এই ঘরের মূল আসবাব ইজেল, বিভিন্ন সাইজের ক্যানভাস, আর্ট পেপার আর পোস্টার পেপারের স্তুপ করে রাখা রোল। বিভিন্ন রকম রঙের ছড়াছড়ি আর চারিদিকের দেওয়াল জুড়ে সমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত পেইন্টিং আর পেন্সিল, নানা সাইজের ব্রাশ! ঘরের ঠিক মাঝামাঝি একটা ইজেল। ছাদেরটা না। এটা আলাদা। সেই ইজেলে ক্যানভাসে কালি আর কলমে আঁকা তিথি! অবিকল তিথির সাদাকালো ভার্শন। তিথির চোখের পাঁপড়ি একটা একটা করে গোণা যাচ্ছে, এলোমেলো চুলগুলো চোখের অর্ধেকটা ঢেকে দিয়েছে, তিথির নাক, গালের কাটা দাগ, চোখের তারায় অসহায়ত্ব, তিলটা – প্রতিটা ডিটেইল। আর সাদাকালো মুখের একপাশে লাল,কমলা, হলুদ রঙের বর্ণীল ছোঁয়া!
কী সুন্দর! এটাই তিথি!

পেছন থেকে হাসিব বলে চলেছে,
—- ‘ওই সময়ই ছবির আইডিয়াটা মাথায় আসলো আর মাথায় এই ছবিটা ছাড়া অন্য সব ফাঁকা হয়ে গেল! একঘন্টা ঝড়ের বেগে হাত চালিয়েছি যেন মাথা থেকে ছবিটা সরে না যায়। তাই তো তোমার জন্য অপেক্ষা না করেই নেমে এসেছিলাম। তোমার পছন্দ হয়েছে, তিথি?’

চলবে…
আফসানা আশা