তিথি পর্ব-০৬

0
426

তিথি – ৬

তিথি বড় হয়েছে অনেকটা ঘাত-প্রতিঘাত সইতে সইতে। যে বয়সটাতে মায়ের আঁচলের তলায় বাবার সাথে আহ্লাদী করার কথা সেই বয়সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে ওকে। একদম বাচ্চা হলে ভালো হতো, কিছু মনে থাকত না। কিন্তু তিথির বয়স ছিল সাত, সব ওর মনে আছে। শুধু মনে আছে তা না, একটা বয়স পর্যন্ত সেই স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে এসে এসে ওকে আহত করে যেত। ওর মা হারিয়ে গেল, বাবাও মরে গেল। বাবার সব স্মৃতি তিথির মনে আছে। সুন্দর করে টেনে টেনে ডাকত ‘আমমমমায়ায়ায়া’। বাবা অফিস করে আসলেই, হয়তো কাপড় ছাড়ার সময়ও দিতো না, কোলে চড়ে বসত, সারাদিনে শাহানা কতটা বকেছে, সেইসব নালিশ শুরু হতো। তিথিকে পাশে না নিয়ে ওর বাবা খেতেই বসত না। হয়তো শাহানা ওকে আগেই খাইয়ে দিত তবুও মাছের পেটিটা, মাংসের টুকরোটা ভেঙে মেয়ের মুখে না দিলে তার খাওয়া হতো না। শাহানা রেগে যেত। বলত

—- ‘ওকে তো ওর যতটুকু দরকার দিয়েছিই।’

একটু মোটাসোটা লোকটা মিষ্টি হেসে বলত,

—- ‘আমার আম্মা খাইলেই আমার পেট ভরে যায়, তাই না, আম্মা?’

আহ্লাদে গলে গিয়ে তিথি বাবার পিঠ জড়িয়ে ধরত ছোট দুই হাত দিয়ে।

বাবার সাথে একটা খুব মজার খেলা মনে পড়ে তিথির। বাবা আর ও দুজনেই গাল ফুলিয়ে বেলুন বানাতো। তারপর গালে গালে ঠোকাঠুকি চলত, কার বেলুন আগে ফাটে। প্রতিবারই তিথির ফুলোগালই আগে ফেটে যেত ওর খিলখিল হাসিতে।

অনেকগুলো রাত ও চুপিচুপি কাঁদত বালিশ ভিজিয়ে ভিজিয়ে। লোকে ওকে দেখেই সহানুভূতির ডালা উপুড় করে দিতো। আহারে, উহুরে! আর তারপরেই বিকৃত সব কৌতূহল, অশালীন সব প্রশ্ন!

—- ‘এই তিথি, তোর মা আর ছোটকাকা জাফররে একসাথে দেখছিস কোনোদিন? কী করতে দেখছিস? বল তো?’

ফুফুদের বাড়ি, দাদির বাড়ি আর নানার বাড়ি ঘুরে ঘুরে শিরিনের বাড়ি আসতে ওর ছয়মাস লেগেছিল। শিরিনের কাছে এসে ও আবার পরিবার পেয়েছে, মা-বাবা, ভাই-বোন সব পেয়েছে। অপর্যাপ্ত আদর পেয়েছে কিন্তু মরে যাওয়া বাবা তো আর ফিরে আসেনি। কোথায় একটা অভাব আছে, ঠিকঠাক যেন বাজে না সবগুলো সুর, একটা আড়াল আছে। তিথির মনের গোপনে সবচেয়ে আদরের জায়গায় রয়ে গেছে ওই ‘আম্মা’ ডাকটুকু। ক্রমশ নিজেকে গোপন করতে করতে, ব্যথা গোপন করতে করতে তিথি হয়ে উঠেছে মানসিকতায় পরিপক্ক। পরিবারের কাছে যতটা আলাভোলা, বাইরে থেকে যতটা নরম ভিতরে ভিতরে তিথি ততটাই বুদ্ধিমতি। আজ এই বিপদে পড়েও ও ভড়কে গেল না। চেতনানাশকের প্রভাবে ওর জ্ঞান লোপ পাচ্ছিল, শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছিল, চোখ বুজে আসছিল। হাসিবের দিকে তাকাল ও, ঝাপসা হতে শুরু করেছে দৃষ্টি।

হাসিব দ্রুত ক্যানভাসে বেইজ কালারের তুলি বোলাচ্ছে। নষ্ট করার মতো সময় নেই হাতে। খুব দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। এমন না যে এভাবে মডেল সামনে না রেখে ও আঁকতে পারত না। তবু্ও কল্পনায় আঁকা আর রক্তমাংসের মানবীকে সামনে রেখে ছবি আঁকা আলাদা ব্যাপার। শুধু রঙ গুলাতে জানলেই আর কিছু স্ট্রোক দিতে জানলেই কেউ শিল্পি হয়না। শিল্প আলাদা ব্যাপার। কিছুটা আলৌকিক। নারীদেহের স্ট্রাকচার ড্র করলেই সেটা শিল্প হবে না। নিমীলিত চোখে, অচেতন, আলুথালু বস্ত্রহীনা রক্তমাংসের নারী সামনে থাকলে শিল্পের দেবী, সৃজনশীলতার দেবী জুপিটারকন্যা মিনার্ভা স্বয়ং ভর করবে ওকে। একটু একটু করে রঙে রঙে ফুটে উঠবে অসাধারণ এক পেইন্টিং। অনেকটা কাজ এগিয়ে রেখেছে। আলো- আঁধারি খেলা জমবে – স্পটলাইট ঠিকঠাক সেট করা আছে। মিডিয়াম গুলে রঙ তৈরি করা হয়েছে। ঠিক পরিকল্পনামাফিক রঙ এসেই গেছে। সবুজ জামা পরতে বলেছিল তিথিকে। তিথি পরেছে। ঠিকঠাক রঙটা আসেনি। ফসলের মাঠে খেলা করা গাঢ় সবুজ পরেছে। এই রঙটা এমনিতেই যেকোনো মেয়েকে সুন্দর, কমনীয় করে দেয়। কিন্তু শিল্পিমাত্রই কড়া রঙ অপছন্দ। একটু ফ্যাকাসে সবুজ হলে ভালো হতো। ওটা হাসিব ঠিক করে নিতে পারবে।

শরীরের একপাশে বড় অযত্নে পড়ে থাকবে এক টুকরো আবরণ। কফির কাপে চুমুক দিলো ও। সমস্ত মন ক্যানভাসে। এই একটা ছবির জন্য দুইদিন ধরে ক্রমাগত বকবক করতে থাকা ইরিটেটিং মেয়েটাকে ও সহ্য করে গেছে। শুধু সহ্যই নয়, প্যাম্পার করে গেছে। আজেবাজে কতগুলো ছবি এঁকে এঁকে টাকায় কেনা রঙ নষ্ট করে গেছে। বড্ড বেশি পরিশ্রম গেছে। পরিশ্রমেই সাফল্য আসে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। পুরানের ঢঙে ছবি আঁকবে হাসিব। আঁকবে গ্রীক মিথলজির কোনো দেবিকে, ব্যাকগ্রাউন্ডে হয়তো অলিম্পাসের চুড়া দেখা যাবে তবে আদৌতে ও আঁকবে দেবাঙ্গীনি ইন্দ্রানীকে। সুরাসক্ত ইন্দ্রানি নির্বসনা হয়ে মদ্যপানে সম্বিত হারিয়েছে। সে অগোছালো, এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। মদিরার পাত্র হয়তো হাতের কাছেই আছে। নিমিলিত চোখ কিন্তু নেশাতুর মুখ। সেই দেবির পুরো শরীরই মদিরা, সে নিজেই মাতাল করা সুরা। এভাবে দেবিকে আঁকায় একটা বিতর্ক তৈরি হবে। ফিসফাস থেকে আন্দোলন পর্যন্ত গড়াতে পারে। সেটাই চায় হাসিব। একদিকে শিল্পবোদ্ধারা আকন্ঠ প্রশংসা করবে অন্যদিকে দেবিভক্তরা সমালোচনা করবে। মাঝের থেকে হিট হয়ে যাবে হাসিব। সেই কাঙ্ক্ষিত কিক, কাঙ্ক্ষিত ছবি। আর একবার হিট হয়ে গেলে ওর পরের গার্বেজগুলোও অকারণ প্রশংসা পেতে শুরু করবে।

কফির কাপে ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে ও মগ্ন হলো সেই স্বপ্নের ঘোরে! ছোট একটা দুঃশ্চিন্তা আছে মনে, যদি ঠিকঠাক আলুথালু, মাতাল দেবিকে ফুটিয়ে না তুলতে পারে? তাতে অবশ্য বেশি ভাবার কিছু নেই। একবারে না পারিলে দেখো শতবার! আর তিথি তো আছেই। এখন থেকে তিথি ওর হাতের পুতুল হয়ে যাবে। যখন ডাকবে তখনই আসতে বাধ্য। বারবার আসতে বাধ্য। তিথিকে শয্যাসঙ্গী করতেও আর কোনো বাঁধা নেই। তবে বিয়ে ওকে হাসিব করবে না। এমন সোজাসাপ্টা মেয়ে ওর পছন্দ না। ও বিয়ে করবে একটু গেঁয়ো, একটু মিষ্টি আর অনেকখানি রহস্যঘেরা কাউকে, যার প্রতি পরতে পরতে থাকবে নতুন আবিস্কারের হাতছানি!

হাসিবের ঘন ঘন কফি খাওয়ার অভ্যাস। কখনো কখনো আঁকাতে মন থাকলে টানা চব্বিশ ঘন্টাও নির্ঘুম কাটে। বারে বারে কফি খেতে রাবেয়া খাতুনকে বিরক্ত করা যায় না। ওয়াটার হিটার আর দুধ, চিনি, কফির গুঁড়ো এই ঘরেই ব্যবস্থা করা আছে। হাসিবের একটা অভ্যাস আছে, তিথি আগেই খেয়াল করেছে সেটা। কফি তৈরি করে ও হিটার আনপ্লাগ করে না, যতক্ষণ না পানি আবার ফুটে উঠে অটোমেটিকভাবে মেশিনটা বন্ধ হয়ে যায়। অজ্ঞান হওয়ার আগমুহূর্তে ও হাসিবের এই ছোট্ট ভুলটার সর্বোচ্চ সুযোগ নিলো। নিজের সমস্ত শক্তিটুকু এক করে ওয়াটার হিটারটা টেনে নিলো আর টগবগ করে ফুটতে থাকা পানিটুকু নিক্ষেপ করল হাসিবের মুখ লক্ষ্য করে। আর তারপরেই জ্ঞান হারাল। আসলেই কি ঠিকঠাক কাজটা করতে পেরেছে কীনা জেনে নেওয়ার সময়টা পেলো না।

বিকট আর্তচিৎকার আর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠল ঘরটা, তিথি টের পেলো না কিছুই। ও তখন জ্ঞানহীন, নিশ্চিন্ত তন্দ্রাঘোরে।

হাসিব ছটফট করতে করতে ডাইনিং বেসিনে এসে পানির কল খুলে মুখটা কলের নিচে দিয়ে রেখেছে। ওর চিৎকার শুনে উপর থেকে হেনা, রাবেয়া খাতুন নেমে এসেছেন। রায়নাও রামিমকে কোলে নিয়ে ছুটে এসেছে। হাসিবকে চেনার উপায় নেই। মুখ-চোখে ফোসকা ধরে গেছে। পানি দিয়েও লাভ হয়নি। ফুটোনো গরম পানি কেরমতি দেখাতে শুরু করেছে। হাসিব চিৎকার করছে আর কাঁদছে৷ তিথিকে গালাগাল করছে। তাড়াতাড়ি করে হেনা এম্বুলেন্স ডাকল। কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। কিভাবে পুড়ল আর তিথি এলো কোথা থেকে এর ভিতর? রায়না হতবাক। হেনা ফ্রিজে যত বরফ, জমাট হওয়া মাছ, মাংস ছিল সব এনে হাসিবের মুখে চেপে ধরল। রাবেয়া খাতুন কেঁদেই যাচ্ছেন। হাসিবের অসহ্য যন্ত্রণায় কান্নার শব্দে রামিমও ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল। রায়না ওকে জড়িয়ে ধরে তিথিকে খুঁজতে লাগল। বেডরুমে ঢুকেই রায়না আঁতকে উঠল। সারা ঘরে পানি। ইজেল উলটে রয়েছে, রঙ ছড়িয়ে রয়েছে। ছোট বেতের ডিভানে পড়ে রয়েছে তিথি। এত এত শব্দেও ওঠেনি। রায়না রামিমকে নামিয়ে দিয়ে তিথিকে ধাক্কা দিয়ে ওঠাতে গেল কিন্তু কিছুতেই ও সাড়া দিলো না কোনো।

রায়নাও কেঁদে ফেলল।

****

গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে ছোট্ট মেয়েটি। শপিংয়ে এসেছে মায়ের সাথে। মেয়েটির জন্য একটা পুতুল কিনতে হবে। যে ডল বাচ্চাটার মায়ের মতো সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরে। এতগুলো দোকান ঘুরেও শাড়ি পরা একটা পুতুলও পাওয়া গেল না। অভিমানে মেয়েটার ঠোঁট ফুলছে। চোখে পানি টলটল করছে। মায়ের সাথে আড়ি হবে এখন। মা বলেছে জামা পরা পুতুল নিয়ে তাকে ছোট্ট একটা শাড়ি পরিয়ে দিলেই হবে৷ কিন্তু ছোট শাড়িও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মা আরেকটা সমাধান দিয়েছে। একটা ওড়না কেটে নিলেই শাড়ি হয়ে যাবে। এতেই রাগ হয়েছে বাচ্চাটার। মা এত বোকা বোকা কথা কেন বলে। কোনো মা কি কখনো এমন বোকা হয়? ওড়না দিয়ে কি শাড়ি হয়? ওর তো ওর মায়ের শাড়ির মতো সুন্দর শাড়ি চাই। কী সুন্দর একটা শাড়ি আজকেও পরেছে ওর মা! টাটকা কমলার মতো রঙ! এমন শাড়িই তো চাই ওর। এমন পঁচা মাকে একটা শাস্তি দিতেই হবে। বড় একটা ব্র‍্যান্ডের শোরুমে মা একটা একটা করে শাড়ি, জামা উল্টেপাল্টে দেখছে। বাচ্চাটা মায়ের কাছ থেকে আস্তে করে সরে গেল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ট্রায়াল রুমের দিকে। সেখানে ঢুকেই নবটা ঘুরিয়ে লক করে দিলো আর চুপ করে বসে থাকল৷ মায়ের হঠাৎ খেয়াল হলো মেয়ে নেই পাশে। এদিক ওদিক খুঁজল। কোথাও নেই। উত্তেজনা আর টেনশনে মায়ের খেয়াল হলো না, যে দোকানের চারিদিকে সিসি ক্যামেরা আছে। সে চিৎকার করে ডাকতে থাকল মেয়েকে। সেই ডাক মেয়ের কানে পৌঁছাতেই সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু নবলকটা জ্যাম হয়ে গেছে। কিছুতেই খুলছে না। মেয়েটা ডানে-বামে ঘুরাচ্ছে কিন্তু খুলছেই না। ভয় পেয়ে বাচ্চাটাও কেঁদে ফেলল,

—- ‘মা? ও মা?’

এপাশে মা কাঁদছে।

ওপাশ থেকে বাচ্চাটা ডাকছে,

—- ‘মা, মা?’

এপাশে বাচ্চাটা কাঁদছে।

ওপাশ থেকে মা ডাকছে,

—- ‘তিথি? এই তিথি?’

*****

— ‘তিথি? এই তিথি?’

তিথি ধড়ফড় করে উঠল। উঠেই মুখের উপর রায়নার মুখটা ঝুলে থাকতে পেলো। কেঁদেকেটে ফোলা চোখ। গড়ানো পানির দাগ গালে শুকিয়ে গেছে। ফুলে ছোট হয়ে যাওয়া চোখজুড়ে উৎকন্ঠা আর দুঃশ্চিন্তা। রায়না ঝুঁকে এসেছে ওর মুখের ওপর। আর ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ডাকছে,

—- ‘তিথি? এই তিথি?’

অনেক কষ্টে তিথিকে টেনে ঘরে এনেছে ও। তিথি হালকা পাতলা হওয়াতে আনতে পেরেছে। হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল কিন্তু হেলাল ব্যস্ত, হাসিবকে নিয়ে হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে আছে হাসিব। মুখের বাঁপাশ একেবারেই পুড়ে গেছে ওর। চোখেও আঘাত লেগেছে। বাঁচোখে আর দেখতে পাবে না বলে দিয়েছেন ডাক্তার। হেলাল ফোনের ভিতরেই গালাগাল করেছে রায়নাকে। তিথিকে পুলিশে দেবে বলেও হুমকি দিয়েছে।

রায়না ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে পড়েছে!

তিথির জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় সবাই। প্রায় চারঘন্টা পরে তিথি জাগল। হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পারল না। এখনও চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। মাথায় অসম্ভব চাপা ব্যথা। স্বপ্ন দেখছিল ও। স্বপ্নে শাহানা ডাকছিল ওকে। রায়নার ব্যাকুল ডাকই শাহানার ডাক হয়ে কানে এসেছিল।

— ‘তিথি? ঠিক আছিস তুই?’

রায়না পানির গ্লাস নিয়ে মুখের সামনে ধরল।

হাত দিয়ে গ্লাসটা সরিয়ে দিলো ও। বমি পাচ্ছে। চারপাশটা বনবন করে ঘুরছে। রায়নার ধাক্কাধাক্কিতেই চেতনানাশকের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও জ্ঞান ফিরেছে ওর। তবে স্মৃতি ফেরেনি এখনো। কী হয়েছে মনে করতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ল।

রায়নাও হতাশ হয়ে পাশে বসল। কত শত চিন্তা। কিছু একটা হয়েছে তিথির সাথে তা স্পষ্ট। কিন্তু শরীরের কাপড়চোপড়ও ঠিক আছে, আর অন্য কোনো দুর্ঘটনার কোনো লক্ষণও নেই। তবে হাসিবের সাথে কী হলো, কে করল? তিথি? কেন? তবে তিথি অজ্ঞান হলো কিভাবে? কে করল? কেন? এত এত প্রশ্ন মনে নিয়ে ওর মাথা ঘুরছে।

মাকে বা বাবাকে কিছু জানায়নি। শুধু আতিককে ফোন করেছে। আতিক ঠান্ডা মাথার মানুষ। হঠাৎ করে শুনেও বুদ্ধি হারায়নি। রায়নাকে শক্ত হতে বলেছে। কী ঘটেছে, তিথির জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত জানা যাবে না। তবে একটা মেডিকেল চেকআপের দরকার আছে, সেটা অনুধাবন করেছে আর পরিচিত ডাক্তার আর আইনি বিশেষজ্ঞর সাথে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে। আধাঘন্টা অন্তর ফোনও দিচ্ছে।

মিনিট দুয়েক যেতেই তিথি আবার চোখ খুলল। ভয়ার্ত, আতঙ্কিত, অসহায় চাহনি। চোখ খুলেই রায়নার মুখ দেখে হুহু করে কেঁদে ফেলল, হুমড়ি খেয়ে পড়ল ওর বুকে। বোনের আকুলপারা কান্না দেখে রায়নার বুকজুড়ে আন্দোলন শুরু হলো। ও নিজেও হাউমাউ কান্না জুড়ে দিলো। মা আর খালাকে কাঁদতে দেখে রামিম ভয় পেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল।

*****

সারারাতে কেউ ফিরল না হাসপাতাল থেকে। হেলালও আর ফোন করেনি। রায়নার ফোনও ধরেনি। রাবেয়া খাতুন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিথিকে তিনি শাস্তি দেবেনই। জেলের ভাত খাইয়েই ছাড়বেন। তার ছেলে আর কোনোদিনই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। সার্জারি হয়েছে রাতেই একটা। বাঁ-চোখ একেবারেই গলে গেছে। আর কখনোই ওই চোখে দৃষ্টি পাবে না। ডানচোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তবে আস্তে আস্তে সেই চোখের দৃষ্টিক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকবে। আর পোড়া চেহারা তো বয়ে নিয়ে বেড়াতেই হবে আজীবন। এত বড় সর্বনাশ যে করল তাকে শাস্তি তো পেতেই হবে। হেনার জামাইকে দিয়ে তার এডভোকেট বন্ধুকে ফোন করিয়ে সব ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন তিনি। এটেম্পট টু মার্ডার মামলা করবেন। তিথি বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছিল হাসিবকে, হাসিব রাজি না হওয়ায় ওকে পুড়িয়ে দিয়েছে, এভাবেই মামলা সাজাবেন। এডভোকেট সাহেব সব ঘটনা শুনে সাবধান করেছেন। তিথি আর রায়নাকে তিনটে দিন সামলে, চাপ তৈরি করে রাখতে বলেছেন। কোনোভাবেই যেন পুলিশের সামনে না আসে, মামলা তিনদিন পরে করার পরামর্শ দিয়েছেন। এই তিনদিনে তিথির শরীর থেকে চেতনানাশক পদার্থ বেরিয়ে যাবে, ট্রেস করা যাবে না। তখন মামলাটা শক্ত গ্রাউন্ড পাবে।

হেলালের ভালোবাসার প্রকাশ খুব স্থুল। বউয়ের শাড়ি-জামার সাথে ম্যাচিং করা পাঞ্জাবি-শার্ট কেনে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। রায়নার লম্বা চুল মুছতে কষ্ট হয় তাই টাওয়েল নিয়ে ভেজা চুল মুছে দেবে। মুখে তুলে খাইয়ে দেবে সবার সামনে। বউ বউ বলে ডেকে ডেকে হয়রান হবে মায়ের সামনেই। রায়নার কাপড় কেঁচে দেবে, সিরিয়াল দেখতে বসলে চা করে দেবে।

অথচ বিপদের সময় ও রায়নার পাশে থাকল না।

সকালে হাসপাতাল থেকে এসেই শুনল আতিক তিথির ব্লাড স্যাম্পল, ইউরিন স্যাম্পল নিয়ে গেছে ইনভেস্টিগেশনের জন্য। মাথায় বাড়ি পড়েছে সবার এই খবরে। আরও বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে ফেটে পড়েছে। তিথি আর রায়নাকে সমানে গালাগাল করছে হেনা আর হেলাল। এক পর্যায়ে রামিমসহ রায়না আর তিথিকে একবস্ত্রে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো বাড়ি থেকে।

চলবে…
আফসানা আশা