তিথি পর্ব-০৯

0
348

তিথি – ৯

অন্ধকার রাস্তায় নেমে তিথির কান্না পেয়ে গেল। প্রথম যে কথাটা মনে হলো, বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। অন্য কোথাও যে যাওয়া যায় এই কথাটাই ও জানে না। কিন্তু কীভাবে ফিরবে? যখন থেকে বুঝতে শিখেছে, জ্ঞানবুদ্ধি এসেছে তখন থেকেই জানে শিরিন ওর মা, খালেক সাহেব ওর বাবা, রায়না বড় বোন আর আতিক বড় ভাই। কখনো কোনো কিছুতেই আতিকের কাছে যেতে কোনোদিন সংকোচ হয়নি। শীতের রাতে টিভি দেখতে দেখতে এক কাঁথায় মাথা মোড়া দিয়েছে। বসার ঘরের সিঙ্গেল বেডে তিন জনের জায়গা হতো না। একজনের গায়ের উপর অন্যজন পা তুলে দিয়েছে অবলীলায়। বড় হওয়ার পরে, বাড়িতে কেউ আসলে ওড়না খোঁজাখুঁজি শুরু করত দুইবোনই। সেই কেউদের দলে আতিক ছিল না কখনোই। আতিককে কখনো ভাই ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়নি তিথির। আতিকের কাছে কোনোদিন কোনো লজ্জা ছিল না। ভাইকে ভাই ছাড়া অন্য কিছু কীভাবে ভাবা যায়, তিথি বোঝে না! মায়ের উপর রাগ হতে থাকল। কিন্তু তিথিকে ছাড়া শিরিনের দিন কাটবে কীভাবে ভেবে মনটা আবার ছটফট করে উঠিল। বাড়ি ফেরার পথ ধরতে ইচ্ছে করল। খালেক সাহেবের বাকি সবকিছু শিরিন করলেও খাবার রান্না আর খাওয়ানোর কাজটা তিথির। চামচ কেটে কেটে অল্প অল্প করে অনেকটা সময় নিয়ে খাওয়াতে হয়। খুব যত্ন নিয়ে করে তিথি। আতিকের সারাবছর গরম পানি লাগে গোসলে। শিরিন প্রচন্ড বিরক্ত হযন পানি গরম করতে। তিথিই করে এই কাজটা। গ্যাসের চুলায় পাতিলে করে পানি গরম করা হয়। তারপর সেই টগবগ করে ফোটা গরম পানির পাতিল লুসনিতে আঁকড়ে গোসলের বালতিতে ঢেলে দেয় তিথি। তারপরে আতিক গোসল করে। এর বিনিময়ে তিথিকে মাসকাবারি দুইশ করে টাকা দিতে হয় আতিকের। এরকম বহু খুঁটিনাটি করে দেওয়ার বিনিময়ে আতিকের পকেট সাফ করে ও। আতিক ঝগড়া করে কিন্তু তিথিকে ছাড়া তো ওর চলেই না। কিন্তু সে তো ভাইয়ের যেমন বোনকে ছাড়া চলে না সেইরকম। ভাই যেমন বোনকে চোখে হারায় আতিক তেমনি তিথিকে চোখে চোখে রাখে। ভাই যেমন স্নেহের বিনিময়ে অধিকার দাবি করে তেমনি আতিক ভালোবাসে তিথিকে।

বাইরের মানুষরা এই ভালোবাসার অন্য নাম দেবে, বদনামি করবে, কুৎসা রটাবে বলে নিজের মাও এই কাজ করবে? মায়ের প্রতি অভিমানে বুকের ভেতর কষ্ট জমাট বাঁধ,

—- ‘তুমি বুঝবে মা, এখন আমি নেই, আমি চলে যাচ্ছি। আর তো আমাকে তুমি কোনোদিন খুঁজে পাবে না। এখন তুমি বুঝবে, ঠিক বুঝবে, তিথি তোমাকে কত ভালোবাসত!’

বাড়ি ফেরার, মায়ের বুকে ফেরার পথ যদি মা নিজেই আটকে বসে থাকে তবে সন্তানের আর কোনো উপায়ই থাকে না। অনন্যপায় হয়ে তিথি এলোমেলো হয়ে হাঁটতে থাকল রাস্তার কিনার ধরে। গাছ বেয়ে নামতে গিয়ে হাতে-পায়ে লেগেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তবে ব্যথায় না, মনের কষ্টে কাঁদছে তিথি।

আতিকও কাঁদছিল ভীষণ। বলছিল,

—- ‘তোকে বোধহয় আমি মরার রাস্তায় পাঠিয়ে দিচ্ছি, তিতকুন্নী। তবে এর চেয়ে তাও ভালো। তুই মরে গেলেও আমার বোন হয়েই মরিস!’

খালেক সাহেবের কথা মনে করে আরও জোরে কেঁদে ফেলল তিথি,

—- ‘বাবা থাকলে কখনো কেউ আমার সাথে এমন করতে পারত না!’’

অভিমানেই চোখ গলল ওর। বলেই জিভ কাটল,

—- ‘বাবা আছেন। বাবা তো আছেনই। অসুস্থ, কিন্তু আছেন। সবসময়ই থাকবেন।’

নানা কথার, নানা কল্পনা আর পেছনে ফেলে আসা সব স্মৃতির উত্তেজনায় ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে তিথির, পাও স্লথ হয়ে এসেছে। শাড়ি পায়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ার মতো টালমাটাল অবস্থা। লোকজন তাকিয়ে দেখছে ওকে। কেউ একবার তাকিয়েই ফিরে যাচ্ছে। পথচারীরা কেউ বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে। কৌতুহল সবার চোখেই। এমন এলোমেলো করে নতুন শাড়ি পরে, অল্পবয়সী একটা রূপবতী মেয়ে এভাবে রাস্তার ধার ধরে জোরে জোরে কাঁদবে, দৃশ্যটা যে কারো চোখেই অস্বাভাবিক।

তিথির গায়ে কড়কড়ে নতুন শাড়ি জড়ানো। কিছু না না করেও শিরিনের মন মানেনি শেষ পর্যন্ত। এক প্রতিবেশিকে দিয়ে একজোড়া কানপাশা বিক্রি করিয়ে এই শাড়িটা আর টুকটাক কিছু কিনিয়ে এনেছেন তিনি। জনাবিশেক মানুষের খাবারের আয়োজনও করেছেন। টুকটুকে লাল সেই শাড়ির আঁচল ধূলায় লুটাচ্ছে এখন। বুকে পাহাড়সম অভিমানের পাহাড় নিয়ে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো তিথি। পুশ ডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকল। চার পা ঢুকে ওয়েটিং চেয়ারগুলোর একটায় ধপ করে বসল। বাড়ি থেকে পালানোর পরে ঘন্টাখানেক হেঁটেছে। এমনিতে আধাঘন্টার রাস্তা। আজ এলোমেলো হেঁটে দ্বিগুণ সময় লেগেছে। চেনা রাস্তা। মামাবাড়ি যাওয়ার সময় বাবার হাত ধরে এখানে আসত তিথি। বাবা মানে খালেক সাহেব।

আতিক বলেছে মামাবাড়ি না গিয়ে তিথির বাবার বাড়ি যেতে। সেই বাবার নাম জাহিদ। আজও মানুষটার মুখটা মনে আছে। তেলতেলে শরীর, উদোম গায়ে শুয়ে আছে উপুড় হয়ে আর তিথি লাফিয়ে লাফিয়ে ডিঙিয়ে যাচ্ছে বাবার শরীরটা। মাঝে মাঝেই লাফ দিয়ে পিঠের উপর পড়ছে আর খিলখিল করে হেসে উঠছে তিথি আর সেই মানুষটা। মানুষটা তো মরেই গেছে। তবে সেখানে গিয়ে তিথি কী করবে? আতিক তো মানা করেই দিলো যেন মামাবাড়ি না যায়। ওখানে সবার সাথে মায়ের যোগাযোগ আছে। কী বিপদেই না ফেলেছে ওকে ওর মা! মা যেদিন জানবে সেদিন নিজের হাত নিজে কামড়াবে, নিজের কপালে চাপড় মেরে মেরে অনুতাপ করবে। কিন্তু বিপদ যে আরও বড় তা তিথি টের পেলো যখন বুঝতে পারল, আতিকের বলা ঠিকানার নড়াইলটুকুই শুধু মনে আছে আর বাকি কিছু মনে নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা ঢোঁক গিলে নিলো তিথি। ডিজিটাল ঘড়িতে নয়টা তেরো নির্দেশ করছে। গিজগিজে মানুষের ঢাকা শহরে বেশি রাত হয়নি। রাস্তায় এখনো অনেক মেয়ে, কেউ অফিসফেরতা, কেউ শপিং করে ফিরছে, কেউ টিউশন করে ক্লান্ত কেউবা পরিবারের সাথে রেঁস্তোরায় ডিনার করে সুখি সুখি মুখে বাড়ি ফিরছে। তিথিরই শুধু কোনো বাড়ি নেই। কোনোদিনই ছিল না। মাঝে কয়েকদিনের জন্য একটা ঠিকানা জুটেছিল, আজ মাথা গুঁজে নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর সেই আশ্রয়টাও মাথার উপর থেকে সরে গেল!

নড়াইল যাওয়া হয়েছে হাতে গোণা কয়েকবার। মামাবাড়ি ওটা। মা, বাবার হাত ধরে রায়না, আতিকের সাথে খুনসুটি করতে করতে যাওয়া হতো। রাস্তাঘাট চেনা নেই। ঈদ বা গরমের ছুটিতে তিন চারদিনের জন্য যাওয়া হতো। মামাদের ছেলেমেয়েদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করতে করতেই সেটুকু সময় চলে যেত। বড়জোর চিত্রা নইলে মধুমতীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়া। পথ ঘাট বাজার কিছু চেনা নেই। কী করবে ও সেই অচেনা শহরে গিয়ে?

চেনা ঢাকা শহরের রাস্তায় নেমে পড়ল একা তিথি। এলোমেলো দুপা হেঁটে বুঝতে পারল, ঢাকা মোটেও ওর চেনা শহর নয়। এই শহরের কঠিন রাস্তায় শিরিন কোনোদিন ওর পা পড়তে দেয়নি। খেয়ালে খেয়ালে রেখেছে সবসময়ই। হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিয়েছে। আজ কেন মা এমন করল?

আতিকের জায়গায় অন্য কোনো গোঁফওয়ালা, টাকপড়া, তামিল সিনেমার ভিলেনের মতো দেখতে কেউ হলেও তো তিথি না করত না। আতিক তো ওর ভাই হয়। ভাইবোন কি রক্তের সম্পর্কে হয় শুধু? আত্মার সম্পর্কে গড়ে ওঠে না শুদ্ধতম এই বন্ধন? জেদে আবারও চোখমুখ শক্ত করে ফেলল ও। একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে আতিককে ফোন করল নড়াইলের ঠিকানা জানার জন্য। ফোন বন্ধ!

তিথির খুব অসহায় লাগতে লাগল। এবার?

কোথায় যাবে ও?

কার কাছে যাবে?

দশটা বেজে গেছে। রাস্তা খালি হতে শুরু করছে। রাস্তার দোকানগুলোর শাটার নামতে শুরু করেছে। রাস্তার ঝকমকে আলো উজ্জ্বল হচ্ছে, গাড়ির আলো কমে আঁধার ঘনীভূত হচ্ছে। ভয়ভয় লাগতে শুরু তিথির। দুহাতে ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরে একটা শপিং মলের সিঁড়িতে গিয়ে বসল। মল বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় মানুষ কম। রাস্তায় গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে নিজের মতো করে, যার যার গন্তব্যে। কোথায় যাবে তিথি?

মলের সিকিউরিটি গার্ডের চাহনিটা মোটেই ভালো লাগছে না ওর। কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। একটু আগেই জিজ্ঞাসা করে গেল,

—- ‘এই আপা? আপনে এইখানে বসে আছেন কখন থেকে। কেউ আসবে?’

তিথি বুদ্ধি করে বলেছে,

—- ‘আমার ভাইয়া আসবে। রাস্তায় জ্যামে পড়েছে।’

এক একটা মিনিট যেন কাটছেই না। গার্ড লোকটাও বারে বারে তাকাচ্ছে আর ফোনে কেমন চাপাস্বরে কথা বলছে,

—- ‘জলদি আয়। এক মিনিটের মইদ্যে আয়।’

এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই তিথি লাফ দিয়ে উঠল। প্রায় দৌঁড়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। গার্ডটা হতচকিত হলো কিন্তু সেও পেছন থেকে ডাকল,

—- ‘আরেহ, আপা, কই যান? আপনের না ভাই আসবো?’

তিথি আরও জোরে দৌঁড়াতে লাগল। পাশের আবাসিক এলাকার রাস্তায় ঢুকে গেল। ভয়ের ব্যাপার হলো গার্ডটাকেও পেছন পেছন আসতে দেখল। আরও ভয় পেলো তিথি, গার্ডটা একা না সাথে আরেকটা লোককেও দেখা যাচ্ছে।

তিথি প্রাণপণে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে দৌঁড়াচ্ছে। বাড়িগুলোর সামনে আলো আছে কিন্তু শুনশান চারিদিক। মেইন রাস্তায় গাড়ি চলছিল এখন তাও নেই। তিথি দৌঁড়াচ্ছে আর দুইচোখে খুঁজছে যদি সাহায্য করার জন্য কাউকে পাওয়া যায়! বড় বড় উঁচু উঁচু এপার্টমেন্ট হাউজ রাস্তার দুপাশে চলে গেছে, সারি সারি যতদুর চোখ যায়, কিন্তু মানুষ নেই একটাও। ডানদিকে মোড় নিলো তিথি। একটা লোককে দেখা যাচ্ছে। ট্রাউজার আর স্লিভকাটা জ্যাকেট পরা। জ্যাকেটে আবার হুড আছে। হুডটা মাথায় টেনে দেওয়া। হালকা ওয়ার্ম আপ এক্সারসাইজ করছে। স্কোয়াটস বলে এটাকে। দুইহাতের তালু আটকে, দুইপা ফাঁক করে অর্ধেক বসার ভান করছে আর সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাগল নাকি?

এই রাত দশটা এগারোটায় কেউ ব্যায়াম করে?

ছেলেটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। সেটা জরুরি না তিথির কাছে। আপাতত বিপদ থেকে বাঁচার জন্য খড়কুটোটুকু তো পাওয়া গেল। তিথি এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার কাছে গিয়ে হাত ধরে ফেলল। ছেলেটা লাফ দিয়ে উঠে কককক করে বলে উঠল,

—- ‘এই কে? কে আপনি? কী চান?’

— ‘ভাইয়া, আমি অনেক বিপদে পড়েছি। দুটো লোক স্টক করছে আমাকে। আমাকে একটু হেল্প করেন প্লিজ।’

— ‘এই ছাড়েন, ছাড়েন। কে আপনি? আমি কেন আপনাকে হেল্প করতে যাব?’

— ‘ভাইয়া প্লিজ! আমি খুব বিপদে পড়েছি। একটু সামান্য হেল্প। বেশি কিছু না। যাস্ট একটু বাস স্টপেজ পর্যন্ত পৌঁছে দিন প্লিজ।’

— ‘কী বিপদ? ড্রামা করেন? বিপদ ট্যাকেল দিতে পারবেন না তো রাস্তায় বের হয়েছেন কেন? আজব! আমি কি সব মেয়েদের বাসস্টান্ডে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছি, নাকি? ছাড়েন আমার হাত ছাড়েন?’

— ‘ভাইয়া যাস্ট বড় রাস্তাটায় একটু এগিয়ে দেন প্লিজ।’

— ‘এই আপনি অজ্ঞান পার্টি না তো? চিপায় নিয়ে আমার মুখে ক্লোরোফর্ম চেপে ধরবেন? সাবধান। আমি কিন্তু ব্ল্যাক বেল্ট। ব্ল্যাক বেল্ট বুঝেন? মাসল দেখেছেন আমার? এই দেখেন? আপনার সাথের পান্ডাগুলোও আমার এক ঘুষিতে কাত।’

বলেই ছেলেটা কারাতের স্টেপও দেখালো একটা। আবার তিথির হাত ঝাড়া দিলো ও,

—- ‘ছাড়েন হাত, ভালো হবে না বলছি।’

নতুন কাকে গু খাওয়া শিখলে, হাবড়ে জাবড়ে খায়। হুহ! এর অবস্থা হয়েছে তাই। তিথি মুখ বাঁকালো মনে মনে। নতুন নতুন কারাতে ক্লাসে যাচ্ছে হয়তো, তাই এই রাত করে এক্সাইরসাইজের ঘটা, আবার ব্ল্যাক বেল্ট! পাশের বাড়িটার দারোয়ান বেরিয়ে এসেছে, চিল্লাপাল্লা আর গোলমাল শুনে। দুজন লোক নেমে এসেছে আর ফ্ল্যাটগুলোর বারান্দায় বারান্দায় উৎসুক চোখ তো আছেই।

—- ‘’কী হয়েছে, স্যার? সমস্যা কোনো?’

এই ছেলেটি লাগোয়া এই বাড়িটাতেই থাকে বুঝল তিথি। অন্য লোকদুটিও মনে হয় এই বাড়িরই বাসিন্দা। তারাও এগিয়ে এলো,

—- ‘আশিক, কী সমস্যা?’

‘এইটার নাম তাহলে আশিক!’ বুঝে নিলো তিথি।

আশিক তোতলাতে তোতলাতে বলল,

—- ‘আংকেল দেখেন না, একটা স্টকার। অজ্ঞান পার্টি নাকি ছিনতাইকারী কে জানে! আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরে মাত্রই ডিনার করে একটা নাইট ওয়াক নিতে এসেছি অমনি আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে।’

— ‘বলো কী? এ তো সাংঘাতিক! পুলিশে খবর দিয়েছে কেউ? এখনই থানায় জানানো দরকার।’ বলল একজন।

তিথির রোখ চেপে গেছে। বুদ্ধি তো বরাবরই বেশি। অনেক বিপদেও ও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। হাসিবের হাত থেকেও বেঁচে ফিরেছে এই ঠান্ডা মাথার বুদ্ধির জন্যই। লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলল,

—- ‘এই যে থামেন। আংকেল, আপনারা ভালোভাবে দেখে বলেন, আমাকে কি ছিনতাইকারী মনে হচ্ছে? কোনদিক থেকে আমাকে ছিনতাইকারী লাগছে?’

আশিক তাড়াতাড়ি করে বলল,

—- ‘এহ, ছিনতাইকারীরা, তারপর অজ্ঞানপার্টিরা কি কপালে ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, যে দেখো এই যে আমার কপালে লেখা আমি হলাম বিশিষ্ট অজ্ঞানপার্টি?’

— ‘চুপ, তুমি একদম চুপ?’

তিথির ধমক খেয়ে আশিক থতমত খেয়ে গেল। মেয়েটা ওকে তুমি করে বলছে, এতে আরও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।

তিথি লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। হেসে বলল,

—- ‘আংকেল দেখেন, আমার পরনে লাল শাড়ি। দেখেন, আমার ব্যাগে গয়নাও আছে।’

ওর মায়ের গয়নাগুলো বের করে দেখালো তিথি,

—’আমাকে দেখে মিষ্টি একটা বউ মনে হচ্ছে না, আংকেল? মনে হচ্ছে না, আমি কোনো বিয়ের কনে? বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছি?’

লোকগুলো দ্বিধায় পড়ে গেল। আসলেই ওকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ের কনে।

— ‘বাবা মা কত শখ করে, ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিচ্ছিল, জানেন? ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার! আর আমি কিনা পালালাম। কার জন্য পালালাম। এই ডাম্বটার জন্য! যে আমাকে চিনছেই না এখন। এখন আমার কী হবে গো…। আমি তো আর বাড়ি ফিরতেই পারব না গো…। আমার আব্বু আমাকে জবাই করে ফেলবে গো…। আমি এই রাতে কোথায় যাব?’

সুর করে করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তিথি।

আরও দুএকজন লোক নেমে এসেছে উপর থেকে। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।

আশিক হতভম্ব! তোতলাতে তোতলাতে বলল,

—- ‘মিথ্যেবাদি, ডাকাত একটা। কেউ বিশ্বাস করবেন না একে। আমি জীবনেও দেখিনি একে।’

তিথি আরও জোরে কেঁদে দিলো,

—- ‘আশিক, তুমি আমাকে এইভাবে অস্বীকার করছ? আমি কত ভালোবাসলাম তোমাকে। আমার দেহ-মন সবই তোমাকে দিলাম। সব পেয়ে গেলেই বুঝি প্রেমিকাকে ট্যিস্যু পেপারের মতো ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়? কসম আশিক, আমি কিছু চাইব না। মোটা ভাত আর মোটা কাপড়েই খুশি থাকব। তোমার জন্য রান্না করব। তোমার কাপড় ধুয়ে দেবো। ঘরও মুছে দেবো। তোমার ঘরে, তোমার পায়ে আমাকে একটু আশ্রয় দাও। আমার তো আর কোনো জায়গা নেই। এই দুনিয়ায় অসহায় এই মেয়েটার আশিক ছাড়া কেউ নেই আর!’

তিথির নকল কান্না আর সিনেমাটিক সংলাপে সবাইকে আচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত মনে হলো। আশিকের কোনো আপত্তি ধোপে টিকল না। আশিক যত তিথিকে অস্বীকার করতে থাকল ততই সবাই প্রেমিকের প্রতারণা ভেবে নিলো আর সবার মনে তিথির জন্য করুণা জাগ্রত হলো।

আপাতত রাস্তায় না দাঁড়িয়ে আশিকদের ফ্ল্যাটে গিয়েই সমাধান করতে চাইল সবাই। অভিভাবকদের সামনেই হোক বিচার। সবাই লিফটের দিকে পা বাড়ালো।

তিথি পেছনে তাকিয়ে দেখল শপিং মলের সেই গার্ডটা আর তার সাথের লোকটি এখনো ঘাপটি মেরে আছে কয়েক গজ দূরে! আজকের রাতটা তো এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রশ্নই আসে না, ভাবল তিথি।

চলবে…
আফসানা আশা