তিথি – ১৫
তিথি নতুন বউ! বিয়ে না হলেও আশরাফ সাহেবের মাথায় গেঁথে গেছে তিথি নতুন বউ! তিনদিন নতুন বউ ঘর থেকে বেরোবে না, বিছানা থেকে নামবে না একান্ত জরুরি প্রয়োজন ব্যাতিত – এরকমই রেওয়াজ আছে তার পরিবারে। বড় ছেলের বিয়ের সময় রেহনুমাই ছিলেন কর্ত্রী, আশরাফ সাহেবকে কিছু ভাবতে হয়নি বা ভাবতে দেননি রেহনুমা। আনঅফিসিয়াল সেপারেশনের শর্তে পুত্রবন্টন হওয়ার সময় আরাফ মাকে বেছে নেওয়ায় তার উপর বা তার বিয়ে, বউয়ের উপর সবরকম অধিকার খর্ব হয়েছে আশরাফ সাহেবের। কয়েকদিন আগে আরাফের বিয়ে হয়েও যাচ্ছিল কিন্তু আশরাফ সাহেবের অনুমতি দূরের কথা মুখের সৌজন্যতায়ও কেউ তাকে জানায়নি কিছু। উনি জেনেছিলেন সবই, সব খবরই পাচ্ছিলেন তবু খিঁচ মেরে চুপ করে বসেছিলেন নিজের সময় আসার অপেক্ষায়। নিজেও দেখিয়ে দেবেন বলে।
তার হাতের আধুলি আশিক তো আছেই, আঁশ মিটিয়ে ছেলের বিয়ের আচার, বউবরণে পারিবারিক রেওয়াজ সবটুকু উপভোগ করবেন তিনি। আর্মিতে থাকার সুবাদে অলসতা জড়িয়ে থাকে না এই বয়সেও, সব কাজে পারদর্শীতাও আছে, প্রয়োজনীয় রান্নাটুকুও জানেন, তবুও আজকাল রান্নায় মন দিতে ইচ্ছে করে না। কে খাবে তাই ভেবে!
আশিকের খাদ্যরুচি নেই, যা দেবে খেয়ে নেবে। একপ্লেট টাটকা ঘাস সার্ভ করে দিলে ও চিবিয়ে চিবিয়ে প্লেট শেষ করে বলবে ‘লবন একটু কম হয়েছে। পরেরবার বাড়িয়ে দিও।’ এইটাইপ গোবর্ধনের জন্য রান্না করা রন্ধনশিল্পের জন্য অবমাননাকর। আর একার জন্য রাঁধতে ভালোও লাগে না। বেশিরভাগ দিনই তাই বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নেন। কী সব এপস এসেছে, স্মার্টফোনে টুক করে অর্ডার দিয়ে দিলে একেবারে দরজার সামনে এসে বেল টেপে। আবার ফেসবুকে কতকগুলো পেইজ আছে যারা একদম ঘরের রান্নার মতো খাবার তৈরি করে বলে দাবী করে। সেখান থেকেও হাঁসভুনা বা চ্যাপার পুলি অর্ডার করে খেয়েছেন। দামে বেশি পড়লেও চমৎকার স্বাদ। তাই বেশিরভাগ দিনই রান্নার ঝামেলা আর নেন না কাঁধে। অনভ্যাসে কীর্তিনাশ বলেও একটা কথা আছে। রেহনুমা থাকাকালে তো রান্নাঘরে কোনোদিন উঁকিঝুঁকিও দিতে হয়নি, নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। সেই অভ্যাস ভেঙে রান্না করতে একটু বিরক্তিও লাগে। অনেকদিন পরে আজ রেঁধেছেন, নিজের রন্ধনকৌশল উপুড় করে দিয়েছেন। নতুন বৌকে দেখিয়ে দেবেন, কত ভালো শশুর তিনি। মাংস, দুইরকম মাছ, জিরেফোঁড়নে টমেটোর ডাল, সাদা সবজি, সালাদ সবকিছুরই আয়োজন আছে। একটা স্পেশাল আইটেমও আছে। ইটালিয়ান এই ডিশটি ঝামেলামুক্ত কিন্তু তার হাতে খুব ভালো খেলে। এর নাম ‘স্যামন উইথ গ্রেনোলাটা সস’। নামে সস হলেও ভাজা মাছের উপর কুঁচোনো পারসলে পাতা, কমলার খোসার হলুদ অংশর কুঁচি আর রসুন কুঁচি মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই এক ডিশেই মাথা খারাপ অবস্থা। খুশিতে মনের সাথে সাথে খিদেটাও চনমন করে উঠল আশরাফ সাহেবের। তবে খুশিটা বেশিক্ষণ রইল না। খাবার শেষ করার আগেই রেহনুমা এসে হাজির হলেন বাসায়। তার সাথে দুজন মহিলা, তাদেরকে রুম দেখিয়ে দিলো রেহনুমা আর গটগট করে সেই মহিলা দুটো আশরাফ সাহেবের বেডরুমে ঢুকে ওয়াইন আর হুইস্কির বোতলগুলো কিচেনে নিয়ে ভাঙল। দশ মিনিটের ভেতর ঘরের ভেতর টুকরো বার কাউন্টারের আর অস্তিত্ব থাকল না। রেহনুমা বুদ্ধি করেই এসেছেন, মহিলাদের জায়গায় কোনো পুরুষ থাকলে ব্যপারটি এত সহজ হতো না। সহজ কী একেবারেই সম্ভব হতো না। আশরাফ সাহেবের এক আর্মিপাঞ্চে ধরাশায়ী হতো গুন্ডা ষন্ডারাও! আশরাফ সাহেব মনে মনে রেহনুমার বুদ্ধির প্রশংসা করলেন কিন্তু খাবার ছেড়ে উঠলেন না। খালি প্লেট নিয়েই নটঘট করতে থাকলেন। রেহনুমা আড়চোখে তাকিয়ে বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসে বললেন,
— ‘আমি বহুবার এসব ফেলেছি, বহুবার নতুন চেহারায় এসে ঢুকেছে। আবার ঢুকবে জানি, কিন্তু আমি যতক্ষণ এই বাসায় আছি, হারাম জিনিস আমার আশেপাশে থাকবে না।’
আশরাফ সাহেব একটা শব্দও করলেন না। তিনি মনেপ্রাণে চাইছিলেন স্ত্রী ফিরে আসুক কিন্তু নিজের মেল ইগোর কাছে পরাস্ত হয়ে স্ত্রীর বিরুদ্ধচারণ শুরু করেছিলেন। রেহনুমা ফিরে আসাতে তার যারপরনাই আনন্দ হলো। কিন্তু সেটা তিনি প্রকাশ করতে চাইলেন না একেবারেই।
রেহনুমা ফিরে আসেননি। আশিকের কথা শুনে তড়িঘড়ি বাসায় এসেছেন কী কান্ড হয়েছে তাই দেখতে। তিনি সোফায় বসে আশিককে ডাকলেন,
— ‘আশিক, কই দেখি তোর বউকে ডাক। তাকে দেখি?’
আশিক ক্ষেপে উঠল,
— ‘কীসের বউ? ও আমার বউ না।’
— ‘বউ না? তাহলে একেবারে বাড়ি উঠে বসলো? কিছু একটা তো তুই করেছিসই। যেদিন মাকে ছেড়ে বাবার হাত ধরলি সেদিনই বুঝেছি তুই অকাজ কুকাজের বাদশাহ হবি।’
— ‘মা, আমি তোমাকে ডেকেছি ওই মেয়েটাকে বের করে দেওয়ার জন্য।’
— ‘ফাইজলামি পাইছিস নাকি? তোর বাপে আমার সাথে যা ইচ্ছা করেছে, তুইও একটা মেয়ের সাথে যা ইচ্ছা তাই করবি? আমি একটা মা, আমি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এতবড় ক্ষতি হতে দেবো না। যেমন বাপে বদ, তেমনি বদ ছেলে। বাপে মেদো মাতাল, পোলা মেয়েছেলে ঘরে এনে তুলেছে। বাহ!’
— ‘মা, আমি কাউকে আনিনি। আমি মেয়েদেরকে ঘৃণা করি।’
— ‘মেয়েদেরকে ঘৃণা করিস, মানে কী? তোমরা সব বীরপুরুষেররা সেইন্ট আর মেয়েরা পাপিতাপি, পাপের বাকসো? তা বীরপুঙ্গব, বীরপুত্র, ডাকো, তোমার বউকে ডাকো?’
আশিকের ইচ্ছে হলো নিজের হাত কামড়াতে। আবারও ওর প্ল্যান পানিতে গুলে গেছে। নারীজাতির উপরে ওর যে বিতৃষ্ণা তার পেছনে রেহনুমার ভূমিকাও কম না। সবকিছু একলাইন বেশি বুঝলে হয়তো সামাল দেওয়া যায়, ওর মা বোঝে আটলাইন বেশি যার বেশিরভাগই ভুল। আশরাফ সাহেবকে নিচু দেখাতে হেন কাজ নেই তা রেহনুমা করতে বাকি রাখবেন। আর এটা শুধু সাম্প্রতিক কয়েকবছরের ঘটনা না, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এটা দেখে আসছে আশিক। তিনভাই মিলে অনেক চেষ্টা করেছে বাবা-মায়ের ভেতর সন্ধি করাতে কিন্তু পূর্বে আর পশ্চিমে মিল হতে কেউ কি কোনোদিন দেখেছে?
আশিকের ডাকা লাগল না, তিথি আগেই এসে আড়ালে দাঁড়িয়েছিল।
তিথি নিজের বুদ্ধিতে অটল আছে। যে গল্প আশরাফ সাহেবকে শুনিয়েছিল সেই গল্পই ওনার স্ত্রীকেও শোনাবে বলে মনস্থির করেছে। তবে নতুন কিছু যোগ করতে হবে। আশিক বাবার ভয়ে ওকে মেনে নিচ্ছে না এই কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে। একদিনে এটা বুঝে গেছে তিথি, আশিকের বাবা তিথিকে মেনে নেয়নি এটা যদি প্রমাণ করতে পারে তবে আশিকের মা তিথিকে মাথায় করে রাখবে, গ্র্যান্ডস্টাইলে বধুবরণ হবে। এমন কিছু কঠিন হবে না কাজটা। আশরাফ সাহেব যেমন নিজের ইগোকে জেতানোর জন্য আশিকের চাইতে তিথিকে বেশি বিশ্বাস করেছে তেমনি আশিকের মাও নিজের ইগোকে জেতানোর জন্য আশিকের বাবার চাইতে তিথির কথাকেই সত্য বলে মেনে নেবে।
*****
কাকতাল কথাটা শোনা গেছে, কিন্তু ভরদুপুরে আশরাফ সাহেবের বসার ঘরে ভয়াবহ রকমের চিলতাল ঘটল। তিথি না চিনলেও আশিকের মা একবার দেখেই চিনে ফেললেন তিথিকে। তিথির সাথেই তার মেজছেলে আরাফের বিয়ের কথা হয়েছিল। তিনি শুধু ছবিতে দেখেছিলেন তিথিকে, আর আরাফ একবার একটা রেস্টুরেন্টে দেখেছিল। ওদের মধ্যে কথা হয়নি কিছু। তিথিকে না জানিয়েই ওকে নিয়ে আসা হয়েছিল। ওইটুকুতেই আরাফ পছন্দ করেছিল ওকে। বিয়ের তোড়জোড়ও করছিলেন রেহনুমা, পাকা কথার জন্য খালেক সাহেবের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল তখনই তিথির মায়ের অতীত মিলিয়ে আরও কী কী বাজে খবর কানে এসেছিল। তখনই রেহনুমা আর না এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলেন। আরাফ মনক্ষুন্ন হয়েছিল কিন্তু মাতৃআজ্ঞা তার জন্য শিরোধার্য তাই তিথির ছবিটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
রেহনুমা তিথির দিকে হতভম্ব হতে তাকিয়ে থাকলেন একটু। একে তিথি ছবির চাইতে বাস্তবে অনেক বেশি সুন্দর, একদম রূপকথার পরি মনে হলো ওকে। আর দ্বিতীয়ত এই মেয়ে দাবী করছে এ নাকি আশিকের বউ! কিছুক্ষণের জন্য তিনি ভুলে গেলেন সব। তারপর নিজের চাচতো ননদকে ফোন করলেন যিনি ছিলেন এই না হওয়া বিয়ের ঘটক। একটু বাদেই শিরিনের ফোন নাম্বার এসে গেল তার হাতে।
*****
শিরিনের শরীর ছেড়ে দিয়েছে। মাথা ভেজা। বারবার মাথায় পানি ঢালা লাগছে। তবুও গরম ভাপ বেরোচ্ছে মাথার তালু থেকে। চোখ ফেটে যাচ্ছে, কপালের দুপাশের শিরা দপদপ করেই যাচ্ছে। রাতে কয়েকবার ফিট হয়েছেন, এখন মনে হয় আর সেই শক্তিটুকুও আর নেই। তিথির চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। আতিকের উপর পড়েছে তার সব রাগ। ইচ্ছেমতো মেরেছেন আতিককে। ওর ফোন ভেঙে ফেলেছেন। কীভাবে পারল আতিক, অসহায় অবস্থায় তিথিকে বের করে দিতে? ও নিজেও তো বের হয়ে যেতে পারত। নিজের বাপ-মা, সংসার, চাকরি দেখেছে! তিথির দিকটা একবারও দেখল না? কী করছে তিথি, কোথায় আছে?
শিরিন যেন আর ভাবতেই চাইছেন না। এতটুকু তিথিকে একটু একটু করে বড় করেছেন তিনি। ফুলের টোকাও লাগতে দেননি। শিরিন খুব ভালো করে বুঝে গেছেন, তার ঘর ছাড়া আর তার কোলহারা হলে তিথি কোথাও ভালো থাকবে না। সুযোগ পেলেই অতীত নিয়ে সবাই ওকে টেনে টেনে ছিঁড়বে। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তিথির জন্যই। অন্য কোথাও অন্য কারো কাছে সুখ পাবে না মেয়েটা। এই কথাটা আগে কেন ভাবেননি তাই ভাবছেন এখন। আগে ভাবলে তো তিথি আর আতিক ভাইবোনের মতো বড় হতো না।
শিরিন একবারও নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তটাকে ভুল ভাবছেন না। বরং নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে আতিককে জোর করছেন তিথিকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু আতিকও তো জানে না তিথি কোথায়? খোঁজ জানলে, মায়ের পাগলামি দেখে হয়তো বিয়েতে রাজিও হয়ে যেত!
শিরিনের বালিশের নিচে ফোনটা বেজে যাচ্ছে। ফোনটা বের করে দেখলেন অচেনা নাম্বার। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ওনার। মানুষের কৌতুহল নিবৃত্ত করার কোন শক্তিই অবশিষ্ট নেই আর। চারিদিকে শুধু প্রশ্ন,
‘তিথি বিয়েতে রাজি ছিল না?’
‘জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন?’
‘তিথির প্রেমিক আছে?’
‘প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে?’
‘মায়ের মতই হইছে মেয়ে, না?’
‘ওর মা তো এমনই ছিল, তাই না?’
‘আপনার বুকে কীভাবে ছুরি মারল?’
‘মারবেই তো! রাস্তা থেকে নিয়ে আসছিলেন না? কালসাপ, ছোঁবল তো দেবেই।’
‘অমুকের মেয়ে আছে খুব সুন্দরী। আতিকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন।’
‘ভালো হয়েছে, আতিকের ভাগ্য ভালো, ওই মেয়ের সাথে বিয়ে হলো না।’
শিরিন একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছেন, আর কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। স্বান্তনা দিতে এসে সবাই তিথির মায়ের চরিত্র ধরে যেভাবে তিথির চরিত্রের পোস্টমর্টেম করছে তাতে নিজের সিদ্ধান্ত আরও বেশি যৌক্তিক মনে হলো, আরও অটল আস্থা এলো, তার কাছে ছাড়া অন্য কোথাও ভালো থাকবে না তিথি!
আতিক আর তিথির সম্পর্ক সহজ করতে যা যা করার দরকার তার সবটাই তিনি করবেন। যতদিন বেঁচে থাকবেন, তিথিকে নিজের আঁচলেই বেঁধে রাখবেন। কিন্তু কোথায় তিথি? আরেকবার ডুকরে কেঁদে মনে মনে ডাকলেন, ‘এই তিথি?’
ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে না তবুও ফোনটা ধরলেন। সবুজ রঙের বাটনটা চেপে দিলেন।
— ‘হ্যালো?’
— ‘হ্যালো, আসসালামু ওয়ালাইকুম। খালেক সাহেবের মিসেস বলছেন?’
— ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। জ্বি বলছি। আপনি কে?’
— ‘আমি রেহনুমা সুলতানা বলছি। রেবেকার ভাবি। আপনার হাজবেন্ডের সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। উনি আমাকে চেনেন।’
— ‘আমিও চিনতে পেরেছি। এতদিন পরে কী মনে করে?’
— ‘আপনার মেয়ে কোথায়?’
শিরিন দুই ঠোঁট চেপে রাগ থামিয়ে বললেন,
— ‘আমার মেয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে আছে।’
— ‘না না, আমি আপনার ছোটমেয়ের কথা জানতে চাইছি।’
— ‘আমার একটাই মেয়ে। একটাই ছেলে।’
শিরিনের কন্ঠের কাঠিন্যে রেহনুমা খানিকটা বিব্রতই হলেন। ইতস্ততভাবে বললেন,
— ‘জান্নাত? আমি জান্নাতের কথা জানতে চাইছি।’
এইসব খবর মানুষের কাছে কতটা উপাদেয় যে সম্পর্ক তৈরির আগেই ভেঙে দেওয়ার এতদিন পরেও এই মহিলা ফোন করে জানতে চাইছেন তিথির কথা। কতদূরে পৌঁছে যায় মেয়ে পালানোর খবর? শুচিবায়ু থাকা স্বত্তেও ঘৃণায় ঘরের ভেতরেই থুতু ফেললেন শিরিন।
— ‘সে কোথায় সেই খবরে আপনার তো কোনো দরকার নেই। আর বেশি জানার দরকার হলে, যাদের কাছ থেকে এইটুকু জেনেছেন তাদের কাছ থেকেই বাকিটুকুও জেনে নিন।’
— ‘আপনি রেগে যাচ্ছেন। আমি শুধু জানতে চেয়েছি, জান্নাতের কি গতকাল বিয়ে ছিল? সে কি বিয়ে না করেই পালিয়েছে? কারো সাথে রিলেশন আছে?’
— ‘এত কথার উত্তর আমি আপনাকে কেন দেবো? আমি রাখছি। আল্লাহ হাফেজ। ‘
— ‘প্লিজ ফোনটা রাখবেন না। আমাকে উত্তর দেবেন কারণ জান্নাত এখন আমার বাসায় আর সে দাবী করছে আমার ছেলের সাথে ওর রিলেশন আর ওর জন্যই জান্নাত বিয়ে বা করে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে।’
— ‘আপনার ছেলেকে তো তিথি কোনোদিন দেখেই নি! কোনোরকম কথাবার্তাও হয়নি ওদের মধ্যে। তিথি জানেই না আপনার ছেলের কথা।’
— ‘আপনি ভুল ভাবছেন। আমার ছেলে আরাফ না ছোটছেলে আশিকের সাথে প্রেম নাকি ওর।’
— ‘অসম্ভব। কারো সাথেই ওর কোনো সম্পর্ক নেই। আর থাকুক বা না থাকুক, ওর বিয়ে আমার ছেলে আতিকের সাথেই হবে আর আমার কাছেই থাকবে ও। আপনি ওকে জানাবেন না। ঠিকানা দিন। আমি আসছি ওকে নিতে।’
রেহনুমা অবাক হয়ে গেলেন তিথির প্রতি শিরিনের পজেসিভনেস দেখে। এতটা তো ভালো নয়। সব মা-ই চায় সন্তানের মঙ্গল। কখনো পড়াশোনার জন্য, কখনো চাকরির জন্য, কখনোবা বিয়ে দিয়ে সেই সন্তানকে তো কাছছাড়া করতেই হয়। এত কেন ভয় শিরিনের?
শিরিনও জানেন তার ভয়টা বেশি বেশি, বাড়াবাড়ি! তবুও নিজের মনকে বোঝাতে পারেন না। হয়তো অন্য কোথাও তিথির একটা ভরা সংসার হতেই পারে তবু অমঙ্গল আশঙ্কার কাছে পরাজিত হন তিনি। হয়তো বিয়ে না দিয়েও তিথিকে নিজের কাছে রাখতে পারতেন শিরিন, কিন্তু বদনামের ভাগ তাতে কম হতো না। হাসিবের মা যে নোংরা ইঙ্গিত করে গিয়েছে তারপরে যেন আশেপাশের প্রতিটি মানুষের চোখে তিনি সে ইঙ্গিতই দেখতে পান। সবকিছু থেকে তিথিকে বাঁচানোর একটা উপায়ই পেয়েছেন তিনি আর সেটাই সবচেয়ে ভালো।
*****
আবারও সবটা আশিকের জন্য বুমেরাং হলো। আরাফের সাথে তিথির বিয়ের ভাঙানি আশিকই দিয়েছিল। লোক লাগিয়ে তিথির দুর্বল জায়গাটা খোঁজ করে এনেছিল আর আরও খানিক রঙ চড়িয়ে মায়ের কানে তুলেছিল।
কেন করবে না আশিক?
আশফি বউ পেয়ে ভাইদের একেবারে ভুলে গেছে। দৈবাৎ ফোনটোন করে। আরাফই এখন সব আশিকের। মাতৃভক্ত আরাফ মায়ের সাথে চলে গেলেও প্রতিটা সন্ধ্যে একসাথে কাটে দুই ভাইয়ের, রাতে একসাথে পাবজি খেলা, কখনো টিম হয়ে কখনো রুম কার্ড দিয়ে অপনেন্ট হয়ে। সেই ভাই যদি শেষ বিকেলের এক রাউন্ড কফির টেবিলে সতেরোবার ‘জান্নাত’ নাম নেয় তো তাকে উপড়ে ফেলাটাই ভালো মনে করেছিল আশিক। এতটা রাগ হয়েছিল যে কখনো মেয়েটার ছবির দিকেই তাকায়নি আশিক, একবারের জন্যও না।
সেদিন ঠিক কাজ করেছিল আশিক। ও নিজেও বিয়ে করবে না আরাফকেও বিয়ে করতে দেবে না। ভাই পর করা কোনো মেয়ে ওদের মাঝখানে আসবে না কোনোদিন। তাও যদি আরাফ এতটা লাট্টু না হতো ওই মেয়ের জন্য, নিজেকে বোঝাতে পারতো আশিক, কিন্তু ভাই তো একেবারে লাইলির জন্য মজনু হয়ে গেল। ভাগ্যিস দেখাদেখির সম্বন্ধ ছিল, আরাফ জানত না ওই মেয়ের কোনো ফোন নাম্বার, রেস্টুরেন্টে দেখা করায় বাড়ির ঠিকানাও অজানা ছিল তাই আরাফ আর যোগাযোগই করতে পারেনি তাই ওকে সামলানো সহজ হয়েছিল। ভাগ্যিস!
নইলে এই ভয়ানক মেয়েটাই ওর ভাবি হয়ে এসে ভাইটাকে একেবারেই কেড়ে নিতো ওর কাছ থেকে!
আশিক প্রমাদ গুণল। গতরাত থেকেই আরাফকে আপডেট দিয়ে যাচ্ছে সবকিছুর। আর এই একটু আগে আরাফ জানিয়েছে অফিসফেরত পথে ও আসছে এই বাড়িতে।
অন্য জায়গায় বিয়ের কথা চলছে আরাফের, কিন্তু এখানে এসে এই ডাকাত মেয়েকে দেখলে আবার তো লাট্টু হয়ে যাবে!
আর ভাবতে পারলো না আশিক…
চলবে…
আফসানা আশা