তিথি পর্ব-১৬

0
318

তিথি – ১৬
আশিক খুব গোলমালে পড়ে গেল। কী হচ্ছে বা কী হবে সবগুলো সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করতে লাগল।
তিথির মা এসে তিথিকে নিয়ে যাবে। ওকে আতিকের সাথে বিয়ে দেবে। তাতে আশিকের কোনো সমস্যা নেই। চুলোয় যাক ওই মেয়ে, সাতরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্র‍্যাফিক কন্ট্রোল করুকগে! কিন্তু তিথির মায়ের আসতে সময় লাগবে। এক ঘন্টা বলেছেন, সেটা দেড়ঘন্টাও হতে পারে, চার ঘন্টাও হতে পারে।
নারীজাতি এক ঘন্টা বললে নরমালি চারঘন্টা ধরে নিতে হয়। যখন তারা বলে বাসা থেকে বেরুচ্ছি, তখন আসলে ঘুম থেকে উঠেছে। তারপর পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে গোসল করবে, সোয়া এক ঘন্টা ধরে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কী পরবে তাই বাছবে আর দুইঘন্টা ধরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় রঙ ঢঙ করবে। পুরো চারঘন্টা পরে এসে বলবে — ‘এত তাড়াহুড়ো কোনোদিন করিনি। শুধু জামাটা পাল্টিয়েই চলে এসেছি।’
এখানে যদিও একটু অন্য কেস, তাও আশিক শিওর এক ঘন্টায় তিথির মা আসবেন না। অন্যদিকে যানজট ঠেলেও আরাফের পৌঁছাতে সর্বোচ্চ আধাঘন্টা। আরাফ এসে চমকে যাবে ছিনতাইকারী মেয়েটাকে দেখে। পুরোনো রোমিও জেগে উঠবে। আবার এই মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠবে। আর এই ডাকাতনি জাদু জানে নিশ্চিত। যেই-সেই না, ব্ল্যাকম্যাজিক অবশ্যই জানে। এই সকালে আশিকের মতো ব্রক্ষ্মচারীকেও কুপোকাত করে ফেলেছিল ও! স্বর্গপরী মেনকা যেমন করে বিশ্বামিত্রের কঠোর তপস্যার আগুনে জল ঢেলেছিল তেমনি করে এই মেয়েও আশিকের কঠিন নারীবিদ্বেষের পালে প্রেমের বাতাস দিয়েছিল। একটু হলেও টলে উঠেছিল এত দিনের সংযম। আশিকের এখন নিজেকে বিশ্বামিত্রের চাইতেও বেশি শক্তিশালী মুনি-ঋষি মনে হচ্ছে৷ বিশ্বামিত্র, দুর্বাসার চাইতেও ও বড় সাধক সেই বিশ্বাস এসে গিয়েছে নিজের উপর।
প্রতিজ্ঞাতেই আবার শক্তিশালী ভাবে আবদ্ধ হয়ে উঠল ও। কিন্তু আরাফের তো এইরকম মনোভাবও নেই মনোবলও নেই। দুর্বলতর ব্যক্তিত্বের ভাইয়ের জন্য মন খারাপ হলো আশিকের।
আরাফ তিথিকে চাইলে, তিথি অবশ্যই আরাফকে ফিরিয়ে দেবে না৷ এই মেয়ে নিজ মুখেই বলেছে, আতিক ছাড়া পৃথিবীর যেকোনো কাউকে বিয়ে করতে রাজি আছে ও।
তার মানে পুরো ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, আরাফের সাথেই বিয়ে হবে তিথির!
ভবিষ্যৎ ভাবি হিসেবে তিথিকে কল্পনা করে, ভাইয়ের পর হয়ে যাওয়াটাও চোখের সামনে ভাসতে লাগল ওর। একদিনে যে খেলা এই মেয়ে দেখিয়েছে সে তো ভবিষ্যতে চোখের সামনে শুধু ভেল্কিবাজিই দেখাবে! আশিকের নিজেকে খুব অসহায় লাগতে লাগল।
ভেবে ভেবে অবশেষে দারুণ এক সমাধান বের করল আশিক। তা এতই মনে ধরল যে, নিজের পিঠটা নিজেরই চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করল ওর! তিথির মায়ের কথামতো, তার আসার খবর রেহনুমা জানায়নি তিথিকে, এমনকি ফোন করার কথাটাও বলেনি। আশিক তিথিকে সব বলে দেওয়ার বুদ্ধি করল। জানতে পারলে আবার এখান থেকেও পালাবে তিথি, সেটা জানে আশিক।
পালাক!
*****
তিথির সাথে তেমন কোনো কথা না বলেই ভিতরে চলে যেতে বলেছিলেন রেহনুমা। তাই শিরিনের সাথে যে তার কথা হয়েছে তা অজানা তিথির কাছে। ও অবাক হচ্ছে এটা ভেবে যে আশিকের মা ওকে প্রায় কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছু ভাবছে মনে হয় ওরা। কী ভাবতে পারে তাই ভেবে অস্থির হচ্ছে এখন ও। এখন এই বাসা ছাড়তে হলে ও কোথায় যাবে? আশিকের জন্যই এইসব হলো। এই বান্দারে তিথি দেখেই ছাড়বে, সে ওর সাথে আর যাই হোক না কেন! কত অনুরোধ করেছে তিথি একটুখানি সাহায্যের জন্য। না হয় দুটোদিন থাকতই ওদের বাসায়। আচ্ছা, ডাকাত সন্দেহ হয়েছে, তার জন্য তো বাসায় সিসিটিভি লাগানো হয়েছে, বাসার নিচে কেয়ারটেকার আছে, দারোয়ান আছে। তারপরও? দুটোদিন গেলেই তিথির সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। শিরিনের মন নরম হতো নইলে আতিক যেভাবেই হোক না কেন যোগাযোগ করতো ওর সাথে। নড়াইলের সেই বাড়িটা কোন গ্রামে সেটা জানলেই হতো। বাড়ির রাস্তা, নদী, মসজিদ সব মনে আছে তিথির, শুধু নামটাই ভুলে গেছে। আতিক বলেছিল একবার, তাও মনে নেই। সেই সময়টাতে যা যাচ্ছিল মনের উপর দিয়ে, মনকেও দোষ দেওয়া যায় না। তিথি ভাবতে থাকে বসে বসে একমনে।
— ‘তিথি সুন্দরী, তোমার ঘন্টা তো বেজে গেছে, মুহাহাহা!’ যাত্রাপালার ভিলেনদের মতো করে আট কর গুণে অট্টহাসি দিতে দিতে ঘরে ঢুকল আশিক।
তিথি চোখ তুলে তাকাল শুধু। আশিক আবার বলল,
— ‘তোমার মাতাশ্রীকে ফোন দেওয়া হয়েছিল, সুন্দরী! তিনি তার সেনাবাহিনী সাজিয়ে নিয়ে আসছেন তোমায় নিয়ে যেতে।’
বলেই থমকে গেল ও। তিথির বড় বড় সুন্দর চোখে টলটলে জল। ভেজা চোখে একরাশ স্নিগ্ধতা। আশিক চোখ সরিয়ে নিলো। এই দুই চোখে তাকালের চিরদিনের জন্য বন্দি হয়ে যেতে হবে জানে ও। তিথি শব্দ করেই কেঁদে ফেলল,
— ‘আমি এখন কী করব? তুমি এমন ক্ষতি আমার করলে? তোমার কোনোদিন ভালো হবে না। আমার অভিশাপে তোম্যর প্রিয় কেউও এভাবেই কাঁদবে তোমার সামনে। তুমি কিছু করতে পারবে না।’
আশিক আবেগপ্রবণ হয়ে গেল তিথির অভিশাপ আর চোখের পানির ধাঁধাঁয় পড়ে। প্রিয় মানুষ বলতে আশিকের দুই ভাই। আশফি আর আরাফ। এরাই সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আশিকের। তিথির অভিশাপে কি সত্যিই এদের কোনো ক্ষতি হবে? এমন কি হয় কোনোদিন? শকুনের প্রার্থনায় কি গরু মরে কোনোদিন? হুহ, কিছু হবে না কারো, কোনো বিপদ হবে না। নিজেকে নিজেই স্বান্তনা দিলো আশিক। পরক্ষণেই আবার মনে হলো, যদি সত্যিই মেয়েটা নির্দোষী হয়? যা বলছে সব তো সত্যি জানাই গেল। যে বিয়ে থেকে পালিয়ে কঠিন সব বিপদে পড়েছে মেয়েটা, সেই বিয়ের ভেতর তাকে ঠেলে দিয়ে আরও বড় অন্যায় কি করছে না আশিক? কনফিউশনে ওর মাথা পুরোপুরি হ্যাং হয়ে গেলো। নিজের ভাইয়ের বউ হতে দেবে না বলে তিথিকে, তিথির মায়ের আগমনের আগাম খবর দিতে এসেছিল ও, যেন তিথি পালিয়ে যায়। এখন অপরাধবোধ জেগে উঠল। যদি সত্যিই পালায় তিথি, কোন বিপদে না জানি পড়বে আবার! কোথায় যেতে হবে সেই ঠিকানাও তো জানে না মেয়েটা। বিপদ একটা ঘটলে, নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবে না আশিক। ওর মা এসে ওকে নিয়ে যেত তাই ভালো হতো। তারপর যা হতো দেখা যেত। তবে তাতে আরাফের সাথে ওর বিয়ে হওয়ার একটা বড় সম্ভাবনা থেকেই যায়। হতোই না হয় তাই। আরাফের বউ হবে তিথি ভাবতেই, ভাই পর হওয়া ছাড়াও একটা কেমন জানি সূক্ষ্ম সুঁই ফুঁটল ওর বুকজুড়ে, কেমন জানি জ্বলুনি চিনচিনে! তার অর্থ বা কার্যকারণ আশিক জানে না।
অভিনয় করে নয় সত্যি সত্যিই কাঁদছে তিথি। অসহায় হয়ে কাঁদছে। মায়ের কাছ থেকে এইভাবে পালিয়ে বেড়ায় কি কোনোদিন কেউ? শিরিন তো বটেই সেই অচেনা শাহানার উপরেও আজ খুব অভিমান হচ্ছে তিথির। বিনাদোষে কেন তিথিকেই সবসময়ই শাস্তি পেতে হয়? কোনো অন্যায় হলেই কেউ যাচাই বাছাই করে না কোনোদিন, তিথির মাথার উপরে চাপিয়ে দেয় সব। কারণ ওর মায়ের অন্যায় করার রেকর্ড আছে তো হেরিডেটি সুত্রে ও তো অন্যায় করবেই। তিথি হাসলেই ফিসফাস, কাঁদলেও কানাকানি – এই বুঝি কারও সাথে ঢলাঢলি করে হাসছে বা ধরা খেয়ে কাঁদছে!
তিথি ঘরে থাকলে দোষ – নিশ্চয় কোথাও মুখ কালা করেছে তাই লুকিয়ে আছে। তিথি ঘর থেকে বেরোলে সবাই বলে, নাগর ধরতে বেরিয়েছে। বোরখা পরলে বলবে, শয়তানি করতে সুবিধা হয়, বোরখার নিচে শয়তান হাঁটে। সালোয়ার কামিজে দেখলে মুখ সিঁটিয়ে এরাই বলে ‘বেপর্দা।’
চোখের পানি দুইহাতের তালুতে মুছে তিথিও পণ করে নিলো এইবাড়ি থেকে বেরোলে আশিককে সাথে নিয়েই বেরোবে। ও ছাদের আশ্রয় ছাড়বে তো আশিককেও ঘরছাড়া করবে। ওকে যদি নরকে যেতে হয় তো আশিককেও হিড়হিড় করে টেনে নিজের সাথে নেবে ও। ওকে বাসা থেকে দূর করাটাই আশিকের সবচেয়ে বড় ইন্টারেস্ট বুঝেই বলল,
— ‘আমি এখুনি তোমাদের বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। তবে তুমিও যাবে আমার সাথে। আমি একা একা অচেনা জায়গায় যেতে পারবো না। আর যেহেতু তোমার ইয়ের সমস্যা আছে তুমি আমার জন্য হার্মলেস!’
— ‘এই মেয়ে, ইয়ের সমস্যা মানে কী?’
— ‘মানে তুমি ওইটাইপ, সেটাই আরকি!’ চোখ টিপে দিলো তিথি।
রাগে লাল হতে হতে আশিক বলল,
— ‘ফাজিল মেয়ে, ওইটাইপ মানে কী? কী বলতে চাও? ভালো হবে না বলছি।’
— ‘সে ভালো হবে না আমি জানি। তোমার মতো গান্ডুর সাথে একসাথে থাকাটা ভালো হতে পারে কোনোদিন? তবুও আমি তোমার সাথে যাব, তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। বাড়ি খুঁজে আমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে তবে তোমার ছুটি।’
— ‘এহ! ইয়ার্কি নাকি? আমি কেন যাব?’
— ‘তুমি তো যাবেই। যাবে কারণ, আমাকে এই বাসা থেকে বের করতে যা যা করার সবই তুমি করবে আমি জানি। এই যে আমার মা আসছে এই খবরটা তুমি আমাকে নাও দিতে পারতে। আমার মা আসত, আমাকে নিয়ে যেত, তোমার ঝামেলা শেষ। কিন্তু না। তুমি চুপ করে থাকলে না। আমার মা আসছে, তার সাথে তোমরা কন্টাক্ট করেছ আমি কিন্তু জানি না। কিন্তু তুমি আমাকে জানালে। আমার এই উপকার তুমি অকারণে তো করোনি। বড় একটা ঘটনা আছে পেছনে। সেটা কী আমি জানি না। তবে এটা বুঝতে পারছি, তুমি কোন ইনটেনশন নিয়েই বলেছ আমাকে। আমি এখানে থাকলে, আমার মা আমাকে নিতে আসলে তোমার কোনো একটা সমস্যা নিশ্চয়ই আছে। আমি জানি না সেটা কী? তবে কিছু একটা তো অবশ্যই। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ কথাটা শুনেছ তো? আমি এখন সেটাই করব। নিজে মরব কিন্তু তোমাকেও শান্তি পেতে দেব না। আমি আমার মায়ের জন্যই এইখানে ওয়েট করছি।’
বলেই গ্যাঁট হয়ে খাটের উপর বসে পড়ল তিথি।
বাহ! এ কোন গ্যাঁড়াকলে পড়ল আশিক? যেই বুদ্ধিই বাগাচ্ছে না কেন, সেটাই ওর উপরে পড়ে ওকেই কাটছে। আশিকের এখন যেতেও কাটছে, আসতেও কাটছে! তিথিকে গাড্ডায় ফেলছে ও, আর সেই গাড্ডায় তিথি পড়ছে তো ওরই ঘাড়ের ওপর। ওর ঘাড়টা মটকে দিয়ে আবার ওকে মই বানিয়ে দিব্যি গর্ত থেকে উপরে উঠে আসছে। বেশ ব্যাপার একটা! আশিক কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তিথি তো আসন পেতে বসে পড়লো বেশ করে, এখন আরাফ এসে পড়লেই সারা! তিথির সাথে আরাফের বিয়ে, এ ভাবতেই পারছে না আশিক।
এ কী মেয়ে নাকি বিষফোঁড়া? ব্যথা দিয়েই যাচ্ছে, কেটে যে ফেলবে তারও তো ব্যথা আছে। আশিক ভাবতে বসল কোন ব্যথাটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক – ফোঁড়ার নাকি ফোঁড়া কেটে ফেলার ব্যথা? আরাফের সাথে তিথির বিয়ে বেশি যন্ত্রণার নাকি এই ঝামেলা কাঁধে নিয়ে তিথির সাথে যাওয়াটা?’
*****
আধাঘন্টার ভেতর তিথি আর আশিককে দেখা গেল হানিফ এন্টারপ্রাইজ এর বাস কাউন্টারে বসে বাসের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায়। ওদের গন্তব্য নড়াইল। নড়াইল ছাড়া আর কিছু জানে না তিথি। তবে স্মৃতিতে আবছাভাবে কিছু ছবি ভেসে আসে। একটা নদী, নদীর পাড় ধরে ধানের বীজক্ষেতের আল ধরে ধরে কিছুদূর হেঁটে গেলে একটা চার্চ, অনেক বড় চার্চ, চার্চের সামনে একটা স্কুল, চার্চের মাথায় যেমন একটা ক্রুশ তেমনি স্কুলের বড় তোরণের উপরও একটা ক্রুশ। স্কুল ধরে টানা ইটবিছানো লালরাস্তা, সেই রাস্তার উঠে গেছে একটা লোহার ব্রিজের কাছে। ব্রিজের নিচে খাল, শ্যাওলাপড়া, কচুরিপানার ফুলে ভরা। সেই খাল এঁকেবেঁকে এসে মিশেছে নদীটায়। স্মৃতিগুলো কেমন বেখাপ্পা হয়ে মনে এঁটে থাকে। যা মনে থাকা দরকার তার কিছুই মনে থাকে না, অকাজের গল্প দিয়ে মাথা ভরা স্মৃতি। সেই গ্রাম, সেই বাড়ি, বাড়ির মানুষ, তাদের নাম কিছুই মনে নেই, মনজুড়ে কোথাকার কোন চার্চ, স্কুল আর ব্রিজ। মানে হয় এসবের? তাও সেটুকুও স্মৃতিতে ঠিকঠাক আছে কি-না কে জানে? নাকি কোনো নাটক সিনেমার দৃশ্যর সাথে গুলিয়ে রেখেছে তাই বা কে বলবে!
দুটো টিকেট কনফার্ম করে তিথি আশিককে সঙ্গে করে একটা মার্কেটে গিয়ে ঢুকল জুয়েলারি দোকানে যাওয়ার জন্য। গহনাগুলো বেচে দেবে। যে মায়ের জন্য জীবনটা উলোটপালোট, সেই মায়ের স্মৃতি রাখার কোনো দরকার নেই। আশিক মুখ ভোঁতা করে পাশে পাশে হাঁটছে। ইন্দ্রানি জুয়েলার্স নামে একটা বড় দোকানে ঢুকলো ওরা। পুলডোর টেনে দোকানে ঢুকতে ঢুকতে আশিককে কনুই দিয়ে গুতো দিলো তিথি,
— ‘এরকম মুখ করে রেখেছ কেন? মনে হচ্ছে তুমি ব্রাজিল আর এইমাত্র জার্মানি তোমাকে ছয় গোল ভরে দিয়েছে আর সামনে আরেকটা দেবে!’
আশিক মুখটা আরও কালো করে ফেলল। বেচারা আসলেই হলুদ-সবুজের সাপোর্টার। তিথিও তা জানে। আশিকের ঘরভরা পেলে রোনালদিনহো, রোনালদো, রবার্তো কার্লোস, কাকা, কাফু, রোমারিওর ছবির পেপার কাটিং, পোস্টার ভরা।
তিথি মুখ টিপে হাসল শুধু। হাসি বেশক্ষণ থাকল না। জুয়েলার্সের লোকটা গহনাগুলো ভালো করে পরীক্ষা করল অনেক সময় নিয়ে, তারপরে জানতে চাইল,
— ‘অনেক পুরোনো গহনা। সনাতন সোনা। আট আনা খাঁদ। মানিরিসিট কই?
— ‘পুরোনো তো আপনিই বলছেন। মানি রিসিট কোথায় পাব?’
তিথি বিরক্ত হলো।’
লোকটা পান খাচ্ছিল, পানের রস জোরে ঢোঁক গিলে নিয়ে বলল,
— ‘হুম। তা গয়না কি আপনার নিজের?’
এবারে মেজাজ খারাপ হলো তিথির। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— ‘এগুলো তো উড়ে উড়ে আসেনি। আমি নিয়ে এসেছি। আমি যখন নিয়ে এসেছি তখন অবশ্যই আমার।’
— ‘না, আজকাল মেয়েরা লায়েক হলে, মায়ের গয়না চুরি করে প্রেমিকের সাথে হাঁটা দেয়। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!’
আশিকের দিকে তাকিয়ে লোকটা মিটিমিটি হাসতে থাকল যেন বিরাট কোনো রহস্য উদঘাটন করে ফেলেছে। তারপর গয়নাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
— ‘দশহাজার দিতে পারি।’
তিথি অবাক হয়ে গেল। তিন ভরির মতো সোনা আছে। ওর আপত্তি শুনে লোকটা মাছি তাড়ানোর মতো করে বলল,
— ‘চোরাজিনিস এর চাইতে বেশি কেউ দেবে না।’
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তিথি সেখান থেকে বেরোতে গেল। আশিক আগে আগে দরজা ঠেলে বের হলো। তিথি পেছন পেছন। আশিক বের হয়ে কাচের দরজা ধরে না রেখে ছেড়ে দিলো। তিথি বুঝতে পারেনি, আশিকের ছেড়ে দেওয়া দরজা ওর নাকে, কপালে এসে ধাক্কা দিলো। কপাল সাথে সাথে ফুলে উঠল। কপাল চেপে ধরে ডলতে ডলতে কাতর শব্দ করল ও। আশিক পাশে এসে ফিসফিস করে বলল,
— ‘এবার তোমায় কেমন দেখাচ্ছে জানো? প্রেগন্যান্ট কুকুরের মতো, দুষ্ট ছেলেরা ল্যাজে আগুন দিয়েছে, ভয়ে সে নর্দমার পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে, এখন শরীর ঝাঁকিয়ে নর্দমার পানি ঝাড়ছে আর কুঁইকুঁই করছে!’
তিথি তীব্রভাবে তাকালো ওর দিকে যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে।
আরও পাঁচ দোকানে ঘুরল ওরা। সবজায়গাতেই একই রকমের অভিজ্ঞতা পেলো। আশিক অসম্ভব মজা পাচ্ছে। রাতশুরুর অন্ধকারের চেয়ে তিথির মুখের অন্ধকার আরও ঘন যেন। আশিক টিটকারি দিলো,
— ‘পেটমোটা ডিমওয়ালা টিকটিকি দেখেছ? খসে পড়ে গিয়ে ইতং বিতং লাফাতে থাকা লেজটার দিকে টিকটিকিটা যেমন করে তাকিয়ে থাকে তোমাকে ঠিক সেইরকম দেখাচ্ছে।’
অবশেষে এক দোকানে একুশ হাজার টাকায় সব বিক্রি করে ওইটুকু আর ওর সবকিছু কঠিন করে দেওয়া আশিককে সম্বল করে রাত নয়টা পঁয়তাল্লিশের বাসে চেপে বসল তিথি।
বাস ছাড়তে পাঁচমিনিট দেরি হলো। তারপর হাঁকডাক, কোলাহল আর কোটি মানুষের ব্যস্ত শহরের দুপাশের আলো কেটে শোঁশোঁ করে চলতে শুরু করল ওরা। জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে দেখছে তিথি। কত মানুষের কত রকম সংগ্রামের গল্পে আঁকা এই শহরটা, তিথির মতো এমন অদ্ভুত গল্প কি কারো জীবনে আছে? আপনজনেরা একা করে দেয় ওকে একেকবার আর ও অন্য কাউকে আঁকড়ে পথচলা শুরু করে। প্রথমে মা আর বাবা ওকে একা ফেলে চলে গেল। ও বাঁচল খালা আর খালুর কাছে। আজ ওরা যখন ওকে বাধ্য করল রাস্তায় নামতে, নিতান্ত অপরিচিত আশিক আজ ওর চলার সাথী। এ কেমন জীবন ওর, কেমন পথচলা?
রাস্তার আলো মাঝেমাঝেই আলোকিত করে দিচ্ছে বাসের ভেতরটা। সেই আলোয় তিথির চোখের টলমল পানি হিরের মতো জ্বলে উঠছে। বিরক্ত, ক্রুদ্ধ আশিকের কেন জানি হাত নিশপিশ করতে থাকল তিথির চোখের অশ্রুবিন্দুটুকু মুছে দেওয়ার গল্পটা লিখবে বলে …

চলবে…
আফসানা আশা