সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-০২

0
1533

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_২
জাওয়াদ জামী জামী

কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। টলোমলো পায়ে বিছানা ছেড়ে এসে দাঁড়ায় দরজার কাছে। তার চোখেমুখে বিরক্তি স্পষ্ট। কিন্তু তার সুদর্শন চেহারায় বিরক্তিটাও বেশ মানিয়ে গেছে। কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের চেহারায় রাগ, বিরক্তি ভালোভাবেই মানিয়ে যায়। ছেলেটিও সেই দলেই পরে। ছেলেটি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, উটকো কেউ হলে তার মুখের মানচিত্র পাল্টে দেবে। কিন্তু দরজা খুলেই তাকে হতাশ হতে হল। দরজা খুলতেই বাহিরে দাঁড়ানো মেয়েটি হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকল।

” তুই কি মানুষ? কখন থেকে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি, অনবরত কলিং বেল চেপেই যাচ্ছি, কিন্তু দরজা খোলার কোন নামই নেই। দরজা খুলতে আরেকটু দেরি হলেই আমি নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন দিতাম। ”

” একে তো অসময়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছ, তারওপর আমাকেই ব্লেম করছ! আমার মনে হচ্ছে, তুমিই মানবসমাজের বাহিরের কেউ। এমনিতেই আমার হ্যাংওভার এখনো কাটেইনি, কিন্তু তুমি আমার মাথা ঠিকই হ্যাং করে দিচ্ছ। এই ব্যাটা, তোর বাপ এত কিপ্টা কেন? বাজার করার টাকা বাঁচাতে বউকে ছোট ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে? ”

” হ্যাং ওভার কাটেনি মানে! এই রাজ্য, তুই কি ড্রিংক করেছিস? ছি ছি ছি তোর এত অধঃপতন হয়েছে? একে-তো বিয়ে না করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস, আবার আসতে না আসতেই মদও খেয়েছিস? ”

” প্লিজ বইনা, স্টপ যাও। দুই পেগ ভদকা খেয়েছি মাত্র। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বারে ঢুঁ মেরেছিলাম। ”

” বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস কেন? তোর কোন ধারনা আছে নানা ভাইসহ পরিবারের প্রত্যেকে কত চিন্তার মধ্যে আছে? নানা ভাই অসুস্থ হয়ে গেছেন? মামী পাগলের মত কেঁদেই যাচ্ছে। আমাকে বারবার রিকুয়েষ্ট করছে, তোকে যেন দেশে পাঠিয়ে দেই। ”

” তুমি কি খাবার সাথে করে নিয়ে এসেছ নাকি এখানেই রান্না করবে? খুব ক্ষুধা লেগেছে। ”

মিশু বুঝল রাজ্য তার কথার উত্তর দেবেনা। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

” খাবার সাথে করে নিয়েই এসেছি। তুই ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নে। ”

রাজ্য বাধ্য ছেলের মত মাথা নেড়ে মিশুর ছেলেকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রুমে ঢুকল।

” তুই একা এতবড় বাসায় কিভাবে থাকিস বলতো? কতবার তোকে বললাম আমার বাসায় গিয়ে থাক। এতে অন্তত তোকে হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবেনা। ”

রাজ্যকে খেতে দিয়ে টুকটাক কথা বলছে মিশু। রাজ্যও মন দিয়ে শুনছে বোনের সব কথা। কিন্তু সে মিশুর কথাগুলো এক কানে শুনে আরেক কানে বের করে দিল। তবে মিশুকে খোঁচা দিতে ভুল করলনা।

” তোমার কিপ্টা জামাই আমাকে তোমার ফ্ল্যাটে স্থায়ীভাবে বাস করতে দেখলে চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক করবে। সে কি লেবেলের কিপ্টা সেটা আমি ভালো করেই জানি। খরচ করার ভয়ে দেশে যায়না পাঁচ বছর। ”

” একদম ফালতু কথা বলবিনা, বজ্জাত ছেলে। সে মোটেও কিপ্টে নয়। তুই এটা স্বীকার কর যে, আমার ফ্ল্যাটে গেলে তুই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারবিনা। সাকী সেটা এলাও করবেনা। তোকে ভদ্র হয়ে থাকতে হবে, যেখানে তুই মোটেও ভদ্রলোক নয়। ”

” খাবার খাইয়ে অপমানও করছ? আমাকে কোন দিক দিয়ে তোমার অভদ্র মনে হয়! জীবনে কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালামনা, আর সেই আমাকে তুমি অভদ্র বলছ! ”

” পেখমের সাথে কি করেছিস সেটা ভুলে গেছিস এত তাড়াতাড়ি? মেয়েটার আবেগ নিয়ে খেলেছিস তুই। সমাজের চোখে মেয়েটাকে জড়বস্তু বানিয়ে দিয়েছিস। ”

” পেখম কে? যাকে চিনিইনা তার আবেগ নিয়ে খেললাম কিভাবে! আর কোন ইস্যু থাকলে বল, অযথা এভাবে দোষারোপ করোনা। ”

” বাহ্ এখন মেয়েটাকেও চিনতে পারছিসনা! যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, তুই পালিয়ে না আসলে যে তোর বাড়িতে বউ হয়ে থাকত, তোর বউ হয়ে থাকত, তাকেই ভুলে বসে আছিস! ”

মিশুর কথায় চোখ তুলে চায় রাজ্য। ওর ভ্রুযুগল সামান্য বেঁকে আছে। মিশু মুগ্ধ হয়ে দেখছে রাজ্যকে। তার এই মামাতো ভাইটি ছোট থেকেই ভিষণ সুদর্শন। নানা ভাইয়ের চেহারার সাথে রাজ্যর চেহারায় ভিষণ মিল। এজন্যই বোধহয় সকলেই রাজ্যকে একটু বেশিই ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলের ভালোবাসা পেয়ে সবার মাথায় উঠে নাচে ছেলেটা। সকলের ভালোবাসা ওকে বেহোমিয়ান বানিয়েছে। কারও কথা শুনবেনা, নিজের ইচ্ছেমত চলবে। মিশুর ভাবনার মাঝেই কথা বলল রাজ্য।

” আমি কিন্তু বিয়েটা করতেই চাইনি। দেশে গেলাম দাদু, বাবা, চাচ্চুরা আই মিন পরিবারের সবাই জোর করল বিয়ের জন্য। ওদের মন রাখতে হ্যাঁ বলে দিলাম। পাত্রী কে সেটা জানার প্রয়োজনবোধ করলামনা। কিন্তু কয়েকদিন পর থেকেই বারবার মনে হতে থাকল, জীবনটা যেখানে শুরুই হয়নি, সেখানে বিয়ের মত প্যারা ঘাড়ে নিয়ে বয়ে বেড়ানোর প্রশ্নই ওঠেনা। পেট চালানোর জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যাব চালাতে হয় যার, সে বউয়ের আবদার পূরণ করবে কিভাবে? এমন অনেক কিছু ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলাম চলে আসব। ব্যাস কাহিনী খতম। ”

” তুই ক্যাব চালাচ্ছিস স্বভাব দোষে। নানা ভাই তোর এ্যাকাউন্টে হিউজ এ্যামাউন্ট ফিক্সড করে রেখেছেন। মামাও সেটাই করেছে। কিন্তু তোর ফ্রেন্ড সার্কেলের জন্য সেই এ্যামাউন্ট কম হয়ে যায়। এত বড় ফ্ল্যাটের তোর কোনও প্রয়োজন আছে? এক রুমের ফ্ল্যাটে থাকলে তোর জাত যাবে? কিংবা আমার ফ্ল্যাটে থাকলে? তা থাকবি কেন? সপ্তাহে দুইদিন বন্ধুদের নিয়ে পার্টি দিবি, মদের আড্ডা বসাবি। সেগুলোতো এক রুমের ফ্ল্যাট কিংবা আমার ফ্ল্যাটে হবেনা। এতবড় ফ্ল্যাটের রেন্টতো কম নয়। তোর একবারও মনে হয়না এগুলো করলে টাকা যায়। কিন্তু তুই বিয়ে করে বউয়ের আবদার পূরণ করবি কিভাবে সেই চিন্তায় পরিবারের সবাইকে আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষের সামনে অপমান করতে রেখে চলে আসলি। বাহ্ পুরুষ বাহ্। ”

” আমার ফ্রেন্ডদের তোমার কেন এত অপছন্দ সেটা আজও বুঝলামনা। ওরা কেউই খারাপ নয়। হ্যাঁ একটু-আধটু ভদকা,স্যাম্পেন খায় ওরা। কিন্তু মানুষ হিসেবে ওরা পারফেক্ট। আর আমি চলে আসায় পরিবারের সবাই কেন অপমানিত হবে সেটাই বুঝলামনা! আমি ঠিক কাজটাই করেছি। ”

” যে বুঝেও অবুঝ সাজে, তাকে বোঝানোর সাধ্য কার আছে! পরিবারের কথা চিন্তা না করে তুই বন্ধুদের কথা ভাবছিস? তারা একটু-আধটু ভদকা, স্যাম্পেন খায়! দেশে যাওয়ার আগে আমি এখানে এসে দশটা স্যাম্পেনের খালি বোতল আমি দেখেছি। আর ঐ নিগ্রো কি যেন নাম? মনে পরেছে ,ম্যাক লুথার ঐটা একটা রাক্ষস। কেমন গোগ্রাসে গিলতে থাকে! একটাবারও ভাবেনা, এই ছেলেটা ক্যাব চালিয়ে ওদের জন্য পার্টি রাখে। আরেকটা আছে, মরিস ব্লিক। ঐটা একটা ক্যারেক্টারলেস। একে একে বলব সবার সম্পর্কে? আর একদিন যদি শুনেছি ওদের নামে সাফাই গাইতে, তবে তোর মুখের ভেতর একটাও দাঁত থাকবেনা। ”

” ব্লিক কি কিছু বলেছে তোমাকে? আই মিন অশালীন কিছু? ও যদি তেমন কিছু বলে থাকে তবে ওর চৌদ্দটা বাজিয়ে দেব। ”

” কিছুই বলেনি আমাকে। আমাকে কিছু বললে জুতিয়ে ওর মুখ সোজা করে দিতাম। তবে একদিন পার্কিংয়ে একটা মেয়ের সাথে চিপকাচিপকি করতে দেখেছিলাম। ”

গল্পে গল্পে খাওয়া শেষ করল রাজ্য। আরও এক ঘন্টা পর মিশু ফিরে গেল ফ্ল্যাটে।

***

” আগেই বলেছিলাম এই মেয়ের বিয়ে নিয়ে এত বাদ্যিবাজনা না বাজাতে। খুব বেশি হলে দশজনকে দাওয়াত করে খাইয়ে দিলেই হত। এতে খরচও বাঁচত আবার অতিথীসেবাও হত। কিন্তু আমার কথা কে শুনবে! এখনতো আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষের কাছে মুখ পুড়ল? সকলে এবার বুঝুক ঠ্যালা। মেয়েরও বাড় বেড়েছিল। এবার জোঁকের মুখে লবন পরেছে। খুব সাধ জেগেছিল মীর বাড়ির বউ হওয়ার। কিন্তু নিজের যোগ্যতার কথা মাথায় ছিলনা। রাজ্য সেটা হাড়েহাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে। মা-মেয়ে ভেবেছিল ধনীর ছেলেকে হাতিয়ে নিজেরা সারাজীবন বিলাসিতা করবে। সে শখ আর পূরণ হলোনা। এখন ছেলে খুঁজতে মা-মেয়েকে রাস্তায় নামতে হবে। এদের জন্য ঐ বাড়ির সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক চিরদিনের মত ঘুচল। ”

সৈয়দ রাশেদ আহমেদের স্ত্রী মেহনাজ বরাবরই ঠোঁটকাটা স্বভাবের। সে থেকে থেকেই পেখমকে বিভিন্নভাবে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। দুইদিন যাবৎ লুকিয়ে ছাপিয়ে বিভিন্ন কথা বললেও এখন সে সরাসরিই পেখমকে শুনিয়ে কথাগুলো বলল। মেহনাজের কথা শুনে বিরক্ত হলেন তার বড় জা পারভীন। তিনি এ ধরনের কথা মোটেও পছন্দ করেননা। তার নিজের কোন মেয়ে না থাকায় পেখমকে নিজের মেয়ের থেকে কম কিছু ভাবেননা।

” মেহনাজ, তুই থামবি? অনেক বলেছিস, আর না। তোর যদি এসব দেখতে ভালো না লাগে, তবে কিছুদিন বাবার বাড়ি গিয়ে বেরিয়ে আয়। আর তোকে এসব ভালো লাগতেই হবে এমনটাও নয় তোর ভালো লাগা না লাগায় কিছুই যায় আসেনা। আমাদের ভাবনা আমারদেরই ভাবতে দে। আর সম্পর্ক জিনিসটা এতটাই ঠুনকো নয় যে একটা সামান্য বিষয় নিয়েই ভেঙে যাবে। যদি ঠুনকোই হত, তবে তুই এত বছর এই বাড়িতে টিকতে পারতিনা। ”

” তোমাদের ভাবনা মানে! আমি কি এই বাড়ির কেউই নই? এই পরিবারের ভালোমন্দ নিয়ে আমি ভাবতে পারবনা? আমিও এই পরিবারের বউ। অধিকার আমারও আছে। উচিত কথা বললেই আমি খারাপ? আমাকে কথা শোনানো হয়। আমি জানি কে কেমন। ”

” আমরাও জানি তুই কেমন। যে সব সময় ভালোটা ভাবে, তার মন্দটা ভাবার অধিকারও আছে। কিন্তু তুই ভালো কম মন্দটাই ভাবিস সবসময়। তাই ভালোমন্দ কোনটাই ভাবার দরকার নেই। তুই সব সময় যেমন নিজের মতই থাকিস, এখনো তাই থাক। যা নিজের ঘরে যা। সেখানেই তোর খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি আবারও বলছি, এখন থেকে কোনটাই ভাববিনা তুই। বেশি ভাবতে গেলে সেটা এবার থেকে রাশেদের কানে যাবে। তখন বিষয়টা নিশ্চয়ই ভালো হবেনা? ”

বড় জা এর প্রচ্ছন্ন হুমকিতে কাজ হল। মেহনাজ গজগজ করতে করতে রুমে চলে গেল।
এতক্ষণ সব শুনছিলেন রাবেয়া সুলতানা। মেহনাজ সব সময়ই তাকে আর পেখমকে নানাভাবে কথা শুনিয়েছে। কিন্তু এতদিন তিনি সবকিছু শুনেও না শোনার ভান করে থেকেছেন। এখনও কি সেটা সম্ভব হবে?

ছোট চাচীর কথা শুনে পেখমের দু-চোখ ভরে গেছে অশ্রুকনায়। ও আজও বুঝলনা ছোট চাচী কেন ওদের পছন্দ করেনা। একজন আরেকজনকে অপছন্দ করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে কি কারও নামে এত বাজে কথা বলা যায়? ও-তো বিয়ে করতেই চায়নি। নেহাৎই দাদুর অনুরোধ রাখতে রাজি হয়েছিল। সেই রাজি হওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজারটা মিথ্যা অপবাদ সইতে হবে। শুনতে হবে হাজারও কটুকথা। চোখ মুছে পেখম পা বাড়াল দাদুর রুমের দিকে।

চলবে…