সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-১০

0
1028

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_১০
জাওয়াদ জামী জামী

” আমি ভুল করেছি, বড়মা। ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। প্রয়োজনে বাকি সবার কাছেই ক্ষমা চাইব। একটা সুযোগ কি আমাকে দেয়া যায়না? ” পারভীন আক্তারের দু-হাত জড়িয়ে ধরে বলল রাজ্য। পারভীন আক্তার আজকেও মীর রেজাউল করিমকে দেখতে এসেছেন। তখনই সুযোগ বুঝে রাজ্য তার কাছে ক্ষমা চাইল।

রাজ্যকে নতমস্তকে দেখে অবাক হলেন পারভীন আক্তার। ছেলেটার চেহারায় অনুতাপ ফুটে উঠেছে চরমভাবে। তার একটু খারাপই লাগল।

” আমার হাতে আর কিছুই নেই, রাজ্য। আমার কাছে ক্ষমা চাইছ কেন! তুমি পেখমের কাছে দোষী, দোষী পুরো সৈয়দ পরিবারের নিকট। শুধু তোমার জন্য দুই পরিবারের সম্পর্ক আর আগের মত নেই। ভবিষ্যতে বোধকরি হবেওনা। আমি কিভাবে তোমার কথা বাড়িতে তুলব, সেটা আমার জানা নেই। ”

” প্লিজ, বড়মা। আমাকে একটা সুযোগ দাও। ”

” আজ যখন সেই সম্পর্কে জড়াতেই চাইছ, তবে সেদিন কেন পালিয়েছিলে? সেদিন তোমার একবারও মনে হয়নি, তোমার একটা ভুল সিদ্ধান্ত কতজনকে কাঁদাবে? একটা মেয়েকে হেনস্তা করবে সমাজ? ”

” আমি সেদিন পালাইনি, বড়মা। শুধু জীবনকে উপভোগ করব বলে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু একটা সময় নিজের ভুল আমি বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, আমার জন্য দুই দাদু কষ্ট কষ্ট পাচ্ছেন। একটা মেয়ের মন ভেঙেছি আমি। তার চোখে অপরাধী হয়েছি চিরকালের জন্য। ”

” তাই নিজের ভুল শোধরাতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছ? পেখমকে ভালোবেসে কিংবা ওর দ্বায়িত্ব নিতে নয়? ”

” বলতে দ্বিধা নেই, আমি ওকে ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। হ্যাঁ, অপরাধ যখন করেছি, তখন ক্ষমা চাওয়াও আমার নৈতিক দ্বায়িত্বের মাঝেই পরে। ভুল করেছি তাই ভুলের মাশুল দিতেও রাজি আছি। কিন্তু ভুল শোধরাতে পেখমকে নিজের করে পেতে চাইনা। ভালোবেসে ওকে জয় করতে চাই, ওর পরম নির্ভর কেউ হতে চাই। ”

পারভীন আক্তার বিস্ময়ে চাইলেন রাজ্য’র দিকে। রাজ্য পেখমকে ভালোবাসে কথাটা তার বোধগম্য হচ্ছেনা কিছুতেই।

” এখন কি সেটা সম্ভব বলে তুমি মনে কর? সবাই মানলেও পেখম কি তোমাকে মেনে নেবে? মেনে নেয়া কি উচিত? তোমার কোন ধারনাই নেই, তুমি চলে যাওয়ায় মেয়েটাকে কত কথা শুনতে হয়েছে। নিজের বাড়ি থেকে শুরু করে গ্রামের প্রতিটি মানুষ ওর দিকে আঙুল তুলেছে। রাগে-অভিমানে মেয়েটা বাড়ি ছেড়েছিল। আড়াই বছর পর গ্রামে ফিরেছে তাও সবার জোড়াজুড়িতে। বিষয়টা তুমি যত সহজ মনে করছ, ততটা সহজ নয়, রাজ্য। পেখমের মত শান্ত, চাপা স্বভাবের মেয়েরা কখন রাগে-অভিমানে বাড়ি ছাড়ে জানো? অশান্ত সাগরের উথাল-পাথাল ঢেউয়ে যখন আঁকড়ে ধরার কিছুই না থাকে, তখন সেই ঢেউকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় ডুবন্ত ব্যাক্তি। পেখমও তেমনি শত অপমান আর কটুকথা সহ্য করেও পড়াশোনা আঁকড়ে ধরেছে। একটু একটু করে এগোচ্ছে স্বপ্ন পূরণের পথে। ঠিক তখনই তুমি ওর পুরোনো ক্ষতে আবারও নতুনভাবে আঘাত চাইছ? এটা কেউ হতে দেবেনা। ”

রাজ্য পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। ওর চোখের কোনে জমেছে নোনাজল। কিন্তু সেটা বড়মাকে দেখাতে চায়না। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক করে চোখ তুলে চাইল রাজ্য। ততক্ষণে ওর ঠোঁটের কোনে শোভা পাচ্ছে বিষাদের হাসি। বিষাদের মেদুর অভ্রে ছেয়ে গেছে মুখব্যাদান।

” ঠিক আছে বড়মা, তোমার কথা মেনে নিলাম। তোমরা তোমাদের মেয়েকে আমার কাছে দিতে না চাইলে দিওনা। আমি নিজের অধিকার নিজেই আদায় করতে জানি। আর নিজের জিনিসকে নিজের করে নিতেও জানি। এতদিন আমার সম্পদ তোমাদের বাড়িতে রাখার জন্য সরি। এবার আমার সম্পদ আমার কাছে এনেই রাখব। দেখি আমাকে কে আটকায়। তাকে নিজের কাছে রাখতে প্রয়োজনে আমি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেব। যুদ্ধ করব পুরো দুনিয়ার বিপক্ষে। তাকে যদি আমার করতে না পারি তবে আমার নাম পাল্টে হিরো আলম রাখব। ”

পারভীন আক্তার বিস্ময়ে চাইলেন রাজ্যের দিকে। রাজ্যের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মুখাবয়ব দেখে তিনি বোধকরি চমকালেন। তিনি আরও চমকালেন যখন দেখলেন রাজ্যের চোখ জুড়ে খেলা করছে প্রনয়ের দল। তবে তিনি নিজের বিস্ময় চেপে রাখলেন। রাজ্যকে বুঝতে দিতে চাননা তার অভিব্যক্তি।

” কি করতে চাইছ তুমি? পেখমকে জোর করতে পারোনা কিছুতেই। আমার ছেলেরা যদি জানতে পারে তুমি পেখমকে বিরক্ত করছ, তবে তারা তোমাকে ছাড়বেনা। তাদের কাছে তাদের বোনের সম্মান সবকিছুর উর্দ্ধে। আর এমনিতেও তারা তোমার ওপর মোটেও খুশি নয়। ”

” আমাকে কি তোমার রাস্তার বখাটে মনে হয়! আমি কেন আমার বিহঙ্গীনিকে বিরক্ত করব! তাকে শুধু নিজের করব এই আর কি।
মম বিহঙ্গী আর কতদিন রইবে অপর কূলে! ”

পারভীন আক্তার রাজ্যের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলেননা। তিনি ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে রইলেন জানালার বাহিরে।

***

” মা, আমি ঢাকা যেতে চাই। তুমি দাদুর কাছ থেকে অনুমতি নাও। ”

মেয়ের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন রাবেয়া সুলতানা। মেয়েটা বাড়িতে এসেছে কয়েকদিন হল, এর মধ্যেই আবার ঢাকা ফিরে যেতে চাইছে কেন এটাই তার বোধগম্য হচ্ছেনা।

” এসব কি বলছিস, পেখম! তুই বাড়িতে এসেছিস জন্য তোর চাচা-চাচীরাও এসেছে। কোথায় সবার সাথে মিলে আনন্দ করবি, তা না করে তুই ঢাকা ফিরতে চাইছিস? শোন মা, পড়াশোনা করার সুযোগ জীবনে অনেক পাবি। ক্লাস শুরুর আগে কয়েকটা দিন বাড়িতে সবার সাথে আনন্দ কর৷ আরও কয়েকটা দিন থেকে যা। ”

” মা, তুমি বুঝতে পারছনা। আমার আগেই যেতে হবে। এখন যে ফ্ল্যাটে আছি, সেটা ছাড়তে হবে। নতুন বাসা খুঁজতে খুঁজতে আমাকে হয়রান হতে হবে। নতুন বাসায় ওঠেই গোছগাছ করতে হবে। আমার সামনে কত কাজ ঘুরঘুর করছে সেটা বুঝতে পারছ? ”

” না রে, মা, আমি কিছুই বুঝিনা। জীবনে কোনদিন স্কুলের বারান্দায় গেছি আমি? কিভাবে জানব পড়াশোনা করতে হলে কত ঝামেলা পোহাতে হয়! ”

” মা, তুমি কি বলছ সেটা বুঝতে পারছ! আমি একবারও বলিনি তুমি লেখাপড়া করোনি। তুমি গ্রাজুয়েট সেটা সবাই জানে। তাই আজেবাজে না বকে আমার কথা শোন। আমার ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা কর। নয়তো আমি হুট করে একাই চলে যাব। তোমরা কেউ আটকাতে পারবেনা আমাকে। ”

” তুই আগে এমন জিদ্দি ছিলিনাতো, পেখম। এত বদলে গেলি কেন! আমি আমার আগের সেই পেখমকে ফেরৎ চাই সেটা বুঝিসনা? আমার সেই শান্ত, নম্র মেয়েটার স্নিগ্ধ হাসি দেখতে চাই। ওকে পাখির মত উড়তে দেখতে চাই। এখনকার কাটখোট্টা পেখমকে মোটেও চাইনা। ” ধরা গলায় বললেন রাবেয়া সুলতানা।

মা’য়ের কথায় পেখম একটুখানি হাসল। সে হাসির আদ্যোপান্ত জুড়ে রয়েছে ক্লেশ।

” মা, তুমি সবটা জেনেও এমন কেন বলছ! আমি এমনই বেশ আছি। ”

” ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিটা মানুষের জীবনেই আসে। তাই বলে কি তারা নিজেকে এতটাই বদলে ফেলে? কখনো কখনো ঝড়-ঝঞ্ঝার সাথে পাল্লা দিয়ে বাঁচতে শিখতে হয়। তুই তো ঝড়-ঝঞ্ঝাকে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস। একবার সেই ঝঞ্ঝার মুখোমুখি হয়ে দেখ, দেখবি সবকিছু কেমন সহজ লাগে। একজন মা হিসেবে আমিও তোকে সাফল্যের স্বর্ণচূড়ায় দেখতে চাই। কিন্তু নিজের মেয়েকে এমন ভীতু রূপে দেখতে চাইনা। আমি প্রতিবাদী পেখমকে দেখতে চাই। ”

” সব বুঝলাম, মা। এরপর থেকে তোমার কথাগুলো মাথায় রেখেই যা করার করব। তবে এবারের মত আমার ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা কর। ”

রাবেয়া সুলতানা বুঝলেন তার মেয়ে কথা শুনবেনা। তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। আজ রাতেই শ্বশুরের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন।

***

” এখন তোর আসার সময় হল? আমি সেই কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি আর মশার কামড় খাচ্ছি। তোর বাপ – চাচারা কি কিপ্টে ভাবা যায়! বাড়ির আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করেনা। আজ বুঝলাম সৈয়দ দাদুর এত টাকাপয়সা কিভাবে হয়েছে। এই মশা সর। আমি কি রক্তের গোডাউন যে আসার পর থেকে কামড়াচ্ছিস? ” কানন পুরো শরীর চুলকাচ্ছে।

কাননের শেষের কথাগুলো শুনে ঋত হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায়না। কাননের প্রথম কথাগুলো শুনে ওর রাগ হলেও বেচারাকে মশার কামড় খেতে দেখে একটু মায়া হল। ছেলেটার গালের কয়েক জায়গায় লালচে দানার মত হয়েছে।

” সরি, আম্মু জেগে ছিল তাই আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু তুমি হনুমানের মত ঝোঁপের ভেতর দাঁড়িয়ে আছ কেন? করিম চাচার বাগানে গিয়ে দাঁড়ালে কি হত? আমি বাহিরে এসে তোমাকে ফোন দিতাম। ”

” চিন্তা করেছ, নুরু! আজকাল ভালো মানুষের কোন দামই নেই। আমি যে ওর জন্য মশার কামড় খেয়ে একঘন্টা ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করছি, আর সে আমাকে বলে কিনা আমি হনুমান! ”

কাননের কথা শুনে ঋত এদিক-ওদিক তাকায়। অন্ধকারেই ও খোঁজার চেষ্টা করছে, কানন কাকে নুরু বলে সম্মোধন করল। কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখলনা।

” নুরু কে? সে কোথায় লুকিয়ে আছে? আমরা গোপনে দেখা করছি এটা কি ভুলে বসে আছ? ”

” আমাকে কি তোর মত গাধা মনে হয়? আমি একাই এসেছি। ”

” তবে নুরু কাকে বললে? মিথ্যা বলবেনা বলে দিলাম। কোথায় নুরু নামের থার্ড পার্সন সিংগুলার নাম্বার? ” ঋত চারপাশটা ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করল।

ঋতকে উদগ্রীব হতে দেখে হাসল কানন। মেয়েটার চোখের তারায় ভয় খেলা করছে।

” দূর পাগলী, কেউ নেই এখানে। আমি শুধু কথার কথা বলতেই নুরু নামটা বলেছি। এদিকে আয়, তোকে দু-চোখ ভরে দেখি। কতদিন তোকে দু-চোখ ভরে দেখিনা। আমার তৃষিত নয়ন তোকেই খুঁজে ফেরে বারবার, সে কি তুই বুঝিসনা? ”

কাননের আবেগ মাখা কণ্ঠস্বর ঋতের শরীরে শিহরণ জাগায়। মনের দুকূল ছাপিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস দোলা দেয়। মেয়েটা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় তার কৈশোরের প্রেমের দিকে৷

চলবে…