সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৪৭+৪৮

0
436

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪৭
জাওয়াদ জামী জামী

” আবারও গাড়ি থামালেন কেন? আপনার কি বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই? সারারাত রাস্তায় কাটানোর প্ল্যান করেছেন নাকি? আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন, দাদু অসুস্থ। আমি তাকে দেখতেই যাচ্ছি। ” রাজ্যকে গাড়ি থামাতে দেখে পেখম বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” কিচ্ছু ভুলিনি আমি। ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আজ রাতে তুমি দাদুর দেখা পাচ্ছনা। তাকে দেখতে হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তোমার। ”

” আর সেজন্যই বুঝি রিল্যাক্সে ড্রাইভ করছেন? রং লেগেছে মনে? আপনার মনে রং লাগতেই পারে। কিন্তু আমার এসব মোটেও ভালো লাগছেনা। ”

” দাদুর জন্য চিন্তা একপাশে রাখলে দেখা যাবে সত্যিই আমার মনে রং লেগেছে। যাকে একনজর দেখবার জন্য, যার সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি দিনের পর দিন ছটফট করেছি, আমার সেই পরম আরাধ্য নারী আজ আমার পাশে বসে আছে। তাকে দেখার তৃষ্ণা পেলেই, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছি। তার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলেই, তার রিনরিনে গলা আমার কর্ণকুহরে ঝংকার তুলছে। এটা কি কম পাওয়া? ”

রাজ্যের কথায় পেখম একটু লজ্জাই পায়। পেছনে কানন আর রিশান আছে। তারা এসব কথা শুনলো কি ভাববে! পেখম এক ঝলক পেছনে তাকাল। ওদের দু’জনকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তি পেল।

” বাইরে এস। ” পেখমের ভাবনার মাঝে কখন যে রাজ্য ওর পাশের দরজা খুলেছে টেরই পায়নি পেখম।

রাস্তার পাশে ছোট একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে রাজ্য। রাত প্রায় একটা। এতরাতেও দোকানে দু’জন লোক বসে আছে। গাড়ি থামাতে দেখে তারাও উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। দোকানে দুইটা বেঞ্চ পাতা আছে।
রাজ্য সেদিকে যেতে যেতে বলল,

” বসবে নাকি? ”

” উঁহু। ”

পেখম গিয়ে দাঁড়ায় দোকানের একপাশের ফাঁকা জায়গায়। আলো-আঁধারির খেলা চলছে পুরো জায়গা জুড়ে। সামনেই একটা ছোট নালা। নালা পেরিয়েই বিস্তৃত মাঠ। শোঁ শোঁ শব্দে হিমেল হাওয়া বইছে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ চলছে। ঢাকায় শীত বোঝা না গেলেও এদিকে শীতের দাপট বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। ওড়না শরীরে পেঁচাতে গিয়ে লক্ষ্য করল, রাজ্যের শার্ট এখোনো ওর শরীরে। শীত থেকে বাঁচতে শার্টটাই গায়ে দিল। ওড়নায় পেঁচাল মাথা আর গলা।

” এই যে, উঁহু? তোমার চা এসে গেছে। ”

হঠাৎই এমন আজব সম্ভাষণ শুনে কপাল কুঁচকে পেছন ফিরে চাইল পেখম।

” কি বললেন? ”

” উঁহু। আমি কিছু বললেই বা জিজ্ঞেস করলেই একটা শব্দে উত্তর দাও, উঁহু। সেজন্য চিন্তা করে দেখলাম ‘ উঁহু ‘ নামটা তোমাকে দেয়াই যায়। মানাবে বেশ। ”

” অসহ্য লোক একটা। ”

” চা। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মজা পাবেনা। সাথে বিস্কুটও আছে। নিবা? ” একটা বিস্কুটের প্যাকেট বাড়িয়ে ধরল রাজ্য।

পেখম প্যাকেট থেকে একটা বিস্কুট নিয়ে চায়ের কাপ নিল। আয়েশ করে চুমুক দিল।

ধীরেসুস্থে চা শেষ করে পেছনে তাকাল। কিন্তু রাজ্যকে আশেপাশে কোথাও দেখলনা। দৌড়ে গাড়ির কাছে গেল। ভেতরে শুধু কানন আর রিশান। তারাও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল পেখম। চায়ের দোকানীসহ বসে থাকা দু’জন ব্যাক্তি ওকে আগ্রহ নিয়ে দেখছে। এবার একটু ভয় পায় পেখম। সিদ্ধান্ত নিল কাননকে ডেকে তুলবে।

” কি হয়েছে? এমন অস্থির লাগছে কেন তোমাকে? ”

রাজ্যের গলা পেয়ে হাঁফ ছাড়ল পেখম। ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল,

” কোথায় গিয়েছিলেন? ”

” এইতো ঐদিকে। ”

” আমাকে বললেননা কেন? সাথে নিলেননা কেন আমাকে? ”

পেখমের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে রাজ্য। মাথা চুলকে তাকাল পেখমের দিকে।

” কথা বলছেননা কেন? আমাকে সাথে নিলেননা কেন? ” আবারও জিজ্ঞেস করল পেখম।

” তোমাকে কিভাবে নেব! আমিতো এইটা করতে গিয়েছিলাম। মানুষটা খারাপ হলেও লজ্জা জিনিসটা এখনো আমার আছে। পিওর ভার্জিন আমি। ভার্জিন পুরুষদের লজ্জা সম্পর্কে তোমার বোধহয় কোন ধারনাই নেই! নাকি দৃষ্টি দিয়েই আমার ইজ্জত হরণের চিন্তা করছিলে ” কনিষ্ঠ আঙুলের দিকে ইশারা করে বলল রাজ্য।

রাজ্যের ইশারা বুঝতে পেরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল পেখম। তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে বসল। তার আগে রাজ্যকে ভৎসনা করতে ভুললনা।

” অসভ্য পুরুষ। ”

” এ কি এখনই গাড়িতে উঠলে কেন! আরেক কাপ চা খাই চল? ”

রাজ্যের কথার উত্তর দিলনা পেখম। মুখ গুঁজে বসে রইল গাড়িতে।

পেখমকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রাজ্য বুঝতে পারল ও লজ্জা পেয়েছে। তাই আর ওকে ঘাঁটালনা।

” বুঝলে রমনী, তুমি যদি আজ পুরোটা রাত আমার সাথে কাটাও, তবে আমি নিশ্চিত তুমি নির্ঘাত আমার প্রেমে পড়ে যাবে। তুমি খুব চতুর। কথাটা বুঝতে পেরেই তাড়াতাড়ি কেটে পরার চিন্তা করছ। ” ড্রাইভ করতে করতে আপনমনে বলল রাজ্য। ও কথাগুলো ধীরে বললেও পেখমের কানে ঠিকই পৌঁছে গেছে।

পেখম রাজ্যের কথা শুনেও নিরব থাকল। ও জানে ও রাজ্যের কথার উত্তর দিলেই কথা বাড়বে বৈ কমবেনা।

রাত তিনটা দশে ওদের গাড়ি এসে দাঁড়ায় সৈয়দ বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে পেখম বড়মাকে ফোন দিল। রাবেয়া সুলতানা হসপিটালে শ্বশুরের কাছে আছেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই খুলে গেল সৈয়দ বাড়ির মূল দরজা। কাজের মেয়েকে সাথে নিয়ে বাহিরে আসলেন পারভীন আক্তার। ততক্ষণে কানন আর রিশানেরও ঘুম ভেঙেছে।

” এস তোমরা ভেতরে এস। ” পারভীন আক্তার সবাইকে ভেতরে ডাকলেন।

” না বড়মা, আমরা এখন বাড়িতে যাব। আপনার মেয়েকে আপনার কাছে দিতেই এসেছিলাম। নয়তো কখন বাড়িতে চলে যেতাম। ” রাজ্য হাসিমুখে বলল।

” এটা কি বললে তুমি? এতরাতে বাড়িতে যাবে? কানন, চলতো ভেতরে। রাজ্য তুমিও চল। ”

” বড়মা, আজকে আর যাবোনা। কালকে আসব। সকালে আপনাকে নিয়েই হসপিটালে যাব। ” কাননও যেতে চাইলনা। আজ রাজ্যকে ছাড়া একা এই বাড়িতে যেতে ওর খারাপ লাগছে। আবার ঋতকে ছাড়া এই বাড়িতে থাকতে ওর খারাপ লাগবে।

পারভীন আক্তার এতরাতে আর জোড়াজুড়ি করলেননা। তিনি দু’জনের সমস্যা বুঝতে পারছেন। তিনি পেখমের ব্যাগ কাজের মেয়ের কাছে দিয়ে রিশানের হাত ধরলেন।

” তাহলে বাড়িতেই যাও। কাল সকাল সকাল চলে এস। আমরা আটটার ভেতরই বেরিয়ে যাব। রাজ্য তুমিও এস। ”

” আসব, বড়মা। ”

পারভীন আক্তার বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই রাজ্য পেখমের মুখোমুখি হল।

” প্রেমে পড়া থেকে বাঁচিয়ে দিলাম তোমাকে। আমাকে নিয়ে ভাববার সময় দিলাম। যত ভাববে ততই আমার ভালোবাসার জালে জড়িয়ে যাবে তুমি। আমার ভালোবাসা তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেবে তার মায়ায়। আমি তোমাকে প্রেমে পড়া থেকে বাঁচালে কি হবে, আমার ভালোবাসা তোমাকে ছাড় দেবেনা একরত্তি। ধরা দিতে বাধ্য হবে তুমি। ”

রাজ্যের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল পেখম। ওর শরীর কাঁপছে, বুক দুরুদুরু করছে। বারবার মনে হচ্ছে, লোকটার কথায় এত জোর কিসের?

***

” পেখম, দাদুর কাছে যাবিনা, মা? ” পারভীন আক্তার পেখমের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। পেখম এখনো বিছানা ছাড়েনি।

” যাব, বড়মা। ”

” তাহলে ওঠ। তৈরী হয়ে নে। আটটা বাজতে দেরি নেই। কাননও যেকোন মুহূর্তে এসে যাবে।

সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি পেখম ফজরের নামাজ আদায় করার অনেক পরে একটু ঘুমিয়েছে।

” আমাকে দশ মিনিট সময় দাও, বড়মা। আমি তৈরী হয়ে আসছি। ” আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল পেখম।

পারভীন আক্তার চলে যাওয়ার পরও বিছানায় শুয়ে রইল পেখম। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে বসল। চুল খোঁপা করে ফোন হাতে নিতেই চোখ গেল বালিশের পাশে রাখা শার্টের দিকে। ভালোভাবে শার্টটা গুছিয়ে শপিং ব্যাগে তুলে রাখল। এরপর রাজ্যর সাথে দেখা হলে শার্টটা তাকে ফিরিয়ে দেবে।

***

দাদুকে বেডে শুয়ে থাকতে দেখে কান্না পেল পেখমের। তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। পারভীন আক্তার শ্বশুরের কাছে গিয়ে বসলেন। রাবেয়া সুলতানা একপাশে বসে আছেন।

” রাবেয়া, তুই রাকিবের বাসায় যা। ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নে৷ ততক্ষণ আমি এখানে থাকব। কানন, তুমি রাবেয়াকে নিয়ে যাও। ”

” আবার আমি কেন, বড়মা? জানেনইতো আমার শ্বাশুড়ি আমাকে দু’চোখে দেখতে পারেনা। ”

” কে বলেছে দেখতে পারেনা? একবার যেয়েই দেখ। মেহনাজ কাল কতবার তোমার কথা বলেছে জান? দেখো গিয়ে তোমার জন্য রান্না শুরু করে দিয়েছে। ”

” মিথ্যা লোভ দেখাবেননা, বড়মা। পরে ধোঁকা খাব। ”

” কানন, কখন এসেছ? ” রাকিব আহমেদ কেবিনে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন।

” এইতো চাচা, কিছুক্ষণ আগে। ”

” তাহলে তুমিই মেজো ভাবীকে নিয়ে বাসায় যাও। আমি আব্বার কাছে কিছুক্ষণ বসি। আজকে অফিস থেকে বেড়োতে দেরি হবে। অফিসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আব্বার কাছেই থাকি আমি। ”

” আচ্ছা, চাচা। ”

” শ্বশুরকে ‘ আব্বু ‘ ডাকা বাদ দিয়ে ‘ চাচা ‘ডাকছ কেন? তুমি হলে রাকিবের বড় মেয়ের স্বামী। আর সেউ তুমিই কিনা ওকে ‘ চাচা ‘ডাকছ? ” রাবেয়া সুলতানা ধমক দিয়ে বললেন।

” পুরোনো অভ্যাসতো, বড়মা। বদলাতে সময় লাগবে। ”

” তাহলে যাও, দেরি করোনা। পেখম, তুইও যাবি নাকি? ”

” আমি পরে যাব, চাচা। এখন কানন ভাইয়া যাক। ”
কানন বেরিয়ে গেল শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

***

এগারোটার দিকে রাজ্য রাজিয়া পারভীনকে নিয়ে হসপিটালে আসল। রাজিয়া পারভীন গিয়ে বসলেন সৈয়দ শামসুল হকের কাছে। তিনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। তার ঘুম ভাঙ্গতে সময় লাগবে৷

” পেখম, তুই রাকিবের বাসায় যা। সকালে কিছু না খেয়েই চলে এসেছিস। আবার মেহনাজের পাঠানো খাবারও খেলিনা। ক্ষুধা লাগেনি তোর? এতক্ষণে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তোকে কি খেতে দেব বলতো? ”

” সে কি পেখম, তুই এখনো আসনি! আমি খাবার আনতে চাইলাম কিন্তু ভাবী নিষেধ করল। ” পারভীন আক্তারের কথা শুনে চিন্তিত বদনে বললেন রাজিয়া পারভীন।

” আমার ক্ষুধা নেই। ক্ষুধা লাগলে চাচার বাসায় চলে যাব। ”

রাজ্য এতক্ষণ সোফায় বসে ছিল। বড়মার কথা শোনার পর কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরল কিছুক্ষণ পর। ওর হাতে অনেকগুলো প্যাকেট।

” বড়মা, আপনি নাকি নান রুটি খেতে পছন্দ করেন? একদিন ঋত বলেছিল। আপনার জন্য নান রুটি এনেছি। সাথে সস আর চিকেন চাপ। আম্মু, তোমার জন্য পরোটা আর শিক কাবাব। আর বড়মার আদরের মেয়ে কি খেতে পছন্দ করে সেটাতো জানিনা। তাই তার জন্য তন্দুরি, চিকেন, কাবাব, চিকেন চাপ, সস সবগুলো এনেছি। তার যেটা ভালো লাগবে সেটাই যেন খায়। ”

রাজ্যের কথা শুনে হাসলেন রাজিয়া পারভীন আর পারভীন আক্তার। তারা বেশ বুঝতে পারছেন, পেখমকে খাওয়াতেই রাজ্যের এত আয়োজন। এদিকে পেখম রাজ্যের এমন কাজে হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে বড়মার দিকে। লোকটা ওকে লজ্জায় ফেলতে বদ্ধপরিকর।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪৮
জাওয়াদ জামী জামী

” পরী বুবু, তুমি এসেছ? আমার কাছে এসে বস। কিছু কথা বলি তোমার সাথে। ” জ্ঞান ফিরতেই সামনে পেখমকে দেখে অতিকষ্টে বললেন সৈয়দ শামসুল হক।

দাদুকে কথা বলতে শুনে খুশিতে পেখম এগিয়ে গেল দাদুর নিকটে।

” দাদু, তুমি কথা বলছ! এখন একটু ভালো লাগছে, দাদু? কিছু খাবে? ” পেখম ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল।

সৈয়দ শামসুল হককে কথা বলতে দেখে কেবিনে উপস্থিত সকলেই খুশি হলেন। রাবেয়া সুলতানা, পারভীন আক্তার খুশিতে কেঁদে ফেললেন।

” আমার কাছে এস। আমার হাতে আর সময় নেই। আমার ডাক এসে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে তোমাদের ছেড়ে যেতে হবে। যাওয়ার আগেই কিছু কথা বলতে চাই তোমার সাথে। ”

দাদুর মুখে এমন কথা শুনে হাউমাউ কেঁদে উঠল পেখম।

” ও দাদু, এভাবে বলোনা। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে? কে আমাদের আগলে রাখবে? তুমি ছাড়া আর কেইবা আছে। ”

” তোমাকে নিয়েই আমার যত চিন্তা। সারাজীবন সুখের দেখা পাওনি। বউমা, রিশান, তুমি শুধু লড়াই করেই গেছ। তোমার ভালো করতে গিয়ে আমরা শুধু তোমার ক্ষতিই করেছি। বড় ইচ্ছে ছিল তোমার সুখ দেখেই মরব। কিন্তু আমার এই ইচ্ছেটা বোধহয় পূরণ হওয়ার নয়। তোমার পরিপূর্ণ সুখী চেহারা দেখার বড্ড সাধ হয় আমার। দোয়া করি তুমি সুখী হও। বউমা আর রিশানের দ্বায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। ” কথাগুলো বলেই হাঁপিয়ে উঠলেন সৈয়দ শামসুল হক।

পেখম বুঝতে পারছে ওর জন্য দাদু বেশি চিন্তা করছেন। তবুও দাদুকে সাহস দিতে পিছপা হলোনা৷

” তুমি সুস্থ হয়ে যাবে, দাদু। আমাদের জন্যই তোমাকে সুস্থ হতে হবে। আমি জব করব, তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। ততদিন তোমাকে সুস্থ থাকতেই হবে। ”

” আমরা চাইলেও সবকিছু নিজের মত করতে পারিনা, বুবু। আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ তো আমাদের হাতে নেই যে চাইলেই হাজার বছর বেঁচে থাকব। ” অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি ক্লান্তিতে চোখ বুজলেন।

দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল সত্যিই দাদু আর ওদের মাঝে বেশিদিন থাকবেনা। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে পেখমের। দাদুকে ছাড়া ওরা কিভাবে থাকবে, ভেবেই দুনিয়া এলোমেলো লাগছে। দু-চোখ বাঁধ ভেঙে অঝোরে ঝরছে পানি।

***

” এই তুমি পেখম না? আমাকে চিনেছ? আমি তোমার দাদীর বাবার বাড়ির পাশেই থাকি। তোমাকে কিছুদিন আগেই নবগ্রামে দেখেছি। সেজন্যই চিনলাম। ” দাদুর সাথে কথা বলে করিডরে এসে দাঁড়াতেই একজন এসে পেখমকে জিজ্ঞেস করল কথাটা।

পেখম ঘুরে তাকায় মহিলার দিকে। কিন্তু চিনতে পারলনা। ও কিছুদিন আগে বড়মার সাথে নবগ্রাম গিয়েছিল। কয়েক ঘন্টা ছিল সেখানে। কিন্তু দাদির ভাইয়ের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যায়নি। তাই সেখানের কাউকে চেনেওনা।

” আমিতো সেখানের কাউকেই তেমন চিনিনা। ” পেখম একবাক্যে উত্তর দিল। ওর মন ভালো নেই। তাই কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা।

” এখানে কেন এসেছ? অসুস্থ নাকি? ”

” দাদু অসুস্থ। এখানেই এ্যাডমিট করা হয়েছে তাকে। ”

” তার বয়স অনেক হয়েছে। আর কতদিন বাঁচবে বল। এছাড়া তোমার জন্যও বোধহয় চিন্তা করে। শুনলাম তোমার নাকি ডিভোর্স হয়েছে। এছাড়া তোমার বাবাও কাছে নেই যে তোমাদের দেখাশোনা করবে। আচ্ছা, তুমি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিলে কেন? মানছি পুরুষ মানুষ একটু ত্যাড়াই হয়। তারা লাইনে-বেলাইনে যায় সুযোগ পেলেই। কিন্তু তাই বলে মানিয়ে নেবেনা তুমি? তাকে টাইট দেবেনা? ছেড়ে দিলেই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল? এত ভালো ঘর-বর কেউ হাতছাড়া করে! একবারও ভেবে দেখেছ, তোমাকে বিয়ে করবে কে? আজকাল সুন্দরী ডিভোর্সি মেয়েদেরই বিয়ে হওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। তারমধ্যে তোমার বোধহয় এখনো পড়াশোনাই শেষ হয়নি। তোমার বাবাও তোমাদের ছেড়ে গেছে। সে থাকলে নাহয় তোমাকে দেখেশুনে বিয়ে দিতে পারত। তোমার মা তোমাকে নিয়ে মহাবিপদে পরবে তোমার দাদু মারা গেলে। তোমরা এখনকার মেয়েরা চিন্তাভাবনা করে কোন কাজ করোনা। আরে বাবা ডিভোর্স দেয়ার আগে সবদিক একশোবার করে ভাবতে হয়। এখন তোমাকে দুই বাচ্চার বাপ ছাড়া কে বিয়ে করবে? সমাজের লোক ডিভোর্সি মেয়েদের নিয়ে কত কথা বলে জানো? জানলে ডিভোর্স দিতেনা। ”

মহিলাটির কথা শুনে পেখম লজ্জায় পারলে মাটিতে মিশে যায়। ভদ্রমহিলা আজ ওকে চরম অপমান করল। কেউ যেন ওর গলা চেপে ধরেছে। ওর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই আশেপাশের সবাই ওকে নিয়ে এসব কথাই ভাবে।

” পেখমের কি হবে, কে ওকে বিয়ে করবে সেসব চিন্তা আপনাকে করতে হবেনা। কেউ আপনাকে চিন্তা করতেও বলেনি। ও ডিভোর্সি, ওর বাবা নেই কিন্তু চাচারা আছে। ও নিজেও যোগ্য, পরিপূর্ণ একজন মানুষ। নিজের দ্বায়িত্ব নিজে নেয়ার মত যোগ্যতা, ক্ষমতা ওর আছে। কোন দুই বাচ্চার বাপ নয়, বরং ওকে বিয়ে করতে অবিবাহিত যুবকেরা অপেক্ষা করছে। আপনার বোধহয় এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। তাই সহজেই বলে দিলেন দুই বাচ্চার বাপের কথা। নিশ্চয়ই আপনার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে এমন কেউ ছিল যে ডিভোর্সি। পরবর্তীতে তার বিয়ে হয়েছিল দুই বাচ্চার বাপের সাথে। নাকি আপনিই সেই ব্যাক্তি? সবাইকে নিজের পাল্লায় মাপতে যাবেননা। মনে রাখবেন, সমাজের সব মেয়েই পেখম নয়। সবার ভাগ্যই পেখমের মত হয়না। পেখমের মত মেধাবী, গুণবতী, ধৈর্য্যশীলা, সাহসী সকল নারীই হয়না। পেখমের মত হতে গেলে নিজেকে অনেকভাবে তৈরী করতে হবে। পেখমের বিষয়ে মাথা না ঘামালেও আপনার চলবে। ওকে নিয়ে ভাববার জন্য ওর পরিবারের লোকজন আছে। তাই এসব থেকে দূরে থাকুন। ”

রাজ্য কোথায় থেকে এসে পেখমের পাশে দাঁড়ালো। ওর হয়ে অচেনা মহিলার কথার জবাব দিল। পেখম শুধু এক ঝলক তাকালো রাজ্যের দিকে। ঝাপসা চোখে দেখল রাজ্যের চোখমুখ রাগে শক্ত হয়ে গেছে। পরক্ষণেই অন্যদিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল। জীবন ওকে কতবার মানুষের সামনে হেনস্তা করবে।

রাজ্যের কঠিন কথায় মহিলাটি বেশ অপমানিত হয়। আর কিছু না বলে প্রস্থান করল সেখান থেকে।

রাজ্য পেছন থেকেই পেখমকে দেখে বুঝল ও কাঁদছে। একটা চিনচিনে ব্যথা ওর বুক থেকে ছড়িয়ে পরল সর্বত্র। এই মেয়েটার চোখের পানি ও সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু আজ ওকে শান্তনা দেয়ার মত অধিকারও নেই তার। পেখম সে অধিকার দেয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও পা বাড়াল কেবিনের দিকে।

***

” দাদু ভাই, তুমি মনে কষ্ট নিওনা। রাগ করোনা আমার পরী বুবুর ওপর। ও তোমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেনা বলে, ওর ক্ষতি হোক সেটা চেওনা। তুমিতো সবই জানো। কেন ও এতটা পাষান হয়েছে। কেন ওর এত পরিবর্তন। পারলে তুমি পরী বুবুকে ভুলে যেও। ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও। এটা আমার অনুরোধ। ” সৈয়দ শামসুল হক রাজ্যের হাত ধরে অনুরোধ করলেন।

” তোমার এই অনুরোধ আমি রাখতে পারবনা, দাদু ভাই। তোমার নাতনিকে ভোলা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। সে ছাড়া আমার জীবনে দ্বিতীয় কোন নারী আসবেনা। সে আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা৷ আমার হৃদয়াসনে অন্য কোন নারীর জায়গা নেই। সেখানে রাজত্ব করছে তোমার নাতনি। আর জানোতো, যাকে ভালোবাসা যায়, তার ক্ষতি কিছুতেই চাওয়া যায়না? ভালোবাসা যেখানে থাকে, সেখানে রাগের কোন অস্তিত্বই থাকেনা। দিনকে দিন তার ওপর আমার ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। সেখানে রাগ, ঘৃণা কিংবা প্রতিশোধের বিন্দুমাত্র স্থানও নেই। তুমি শুধু শুধু এসব চিন্তা করে নিজের আয়ু কমাচ্ছ। তার চেয়ে বরং দোয়া কর। যাতে তোমার নাতনির মন নরম হয়। আমার জন্য একটু ভালোবাসা জন্মায় তার মনে। বয়সতো কম হলোনা, আর কতদিন বউকে তোমাদের কাছে রেখে একা একা বিনিদ্র রজনী কাটাব বল? ”

কেবিনে ঢুকতেই রাজ্যের কথাগুলো কানে আসল পেখমের। ও বুঝতেই পারেনি ভদ্রমহিলাকে কথা শুনিয়ে রাজ্য দাদুর কাছে এসেছে। রাজ্যের কথা শুনে ও থমকে দাঁড়ায়।

” আমিও চাই পরী বুবু তোমাকে মেনে নিক। তোমাদের দু’জনকে একসাথে দেখে আমি চোখ বুঝি। তোমার হাতে ওকে তুলে দিতে পারলে আমি শান্তিতে মরতে পারতাম। কিন্তু সেটা বোধহয় আর সম্ভব নয়। আমি পরী বুবুকে জোর করতে চাইনা। স্বেচ্ছায় ও যদি চায় তোমাকে বিয়ে করতে, তবেই বিয়েটা হবে। তার আগে নয়৷ ”

পেখম চুপিসারে দরজা থেকে সরে গেল।

***

” মা, বড়মা তোমাদের সাথে কিছু কথা ছিল। ”

” পেখম, তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? দুই ঘন্টা হয়ে গেছে তোর কোন খবর নেই। এদিকে আমরা চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। ফোনও বন্ধ রেখেছিস। রাকিব, কানন, রিশান তোকে পাগলের মত এদিকওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। রাজ্যও তোকে খুঁজতে বেড়িয়েছে সেই কখন। ” পেখমকে দেখে রেগে গেলেন রাবেয়া সুলতানা। মেয়েকে দেখে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

” মা, আমি আমার পুরোনো কলেজে গিয়েছিলাম। এতক্ষণ কলেজের বাগানেই বসে ছিলাম। তুমি এত টেনশন করছ কেন? আমি কি ছোট মানুষ যে হারিয়ে যাব! ”

” ফোন বন্ধ রেখেছিস কেন? চিন্তা হয়না আমাদের? বলেইবা গেলিনা কেন? ” পারভীন আক্তার তেজী গলায় বললেন।

” নিজেকে সময় দিচ্ছিলাম, বড়মা। এবার তোমরা আমার কথা শুনবে? ”

” বল কি বলবি। এতক্ষণ পাগল পাগল লাগছিল। ”

পেখম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। ঠোঁট কামড়ে রেখেছে দাঁত দিয়ে। কিছু একটা ভাবছে৷

রাবেয়া সুলতানা, পারভীন আক্তার ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

” তো..তোমরা রাজি থাকলে রাজ্য ভাইয়াকে ব..বিয়ে করতে চাই। এবং আজই। ”

পেখমের বলা দুইটা বাক্যই স্তব করে দিল তাদের দুই জা’কে। একে-অপরের মুখপানে চাইলেন দু’জনেই৷

” বড়মা, কোথাও পেলামনা ওকে। ” হঠাৎই রাজ্য হুড়মুড়িয়ে ঢুকল কেবিনে। পরক্ষণেই পেখমকে দেখে শ্বাস ছাড়ল। স্বস্তিতে দু-চোখ বন্ধ করল।

” কোথায় ছিল সে এতক্ষণ? ” আবারও কথা বলল রাজ্য।

” জামাই বাবা, কাজী ডাক। আজকের পর থেকে ওকেই সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করো। ” পারভীন আক্তার হেসে বললেন।

রাজ্য বড়মার কথার মানে কিছুই বুঝলনা। ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। এদিকে পারভীন আক্তার ফোন করলেন রাজিয়া পারভীনকে। তাকে জানালেন বিয়ের কথা।

***

রাকিব আহমেদের বাসায় দুই পরিবারের লোকজনের উপস্থিতিতে বিয়ে হল রাজ্য-পেখমের। রাজ্যের ঘোর এখনো কাটেনি। ও বিশ্বাসই করতে পারছেনা এসব। বারবার মনে হচ্ছে ও বুঝি স্বপ্ন দেখছে।

” রাজ্য, পেখমকে নিয়ে হসপিটাল চল। আব্বার কাছ থেকে দোয়া নিবে। ঘুম ভেঙে আব্বা তোমাদের দু’জনকে দেখলে খুশি হবেন। ” পারভীন আক্তার তাড়া দিলেন৷

***

সৈয়দ শামসুল হক বধূ বেশে পেখমকে দেখে কাঁদছেন। তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তারা দু বন্ধু চেয়েছিলেন রাজ্য পেখমের মিলন। কিন্তু তার বন্ধুটি নাতবউ দেখতে পেলেননা ভেবে তিনি কাঁদছেন। তিনি কাঁদছেন পেখমের ভবিষ্যৎ ভেবে। মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে হবেনা। সুখে ভরে উঠবে ওর প্রতিটাক্ষন।

” দাদু ভাই, আবারও কাঁদছ কেন! আমার কথা ভেবে চিন্তা হচ্ছে তোমার? তোমার নাতনিকে একটু বুঝিয়ে বল, আমার ওপর অত্যাচার যেন না করে। আমি নিরীহ মানুষ। কাউকে কিছু বলতে পারবনা, নীরবে সব সয়ে যাব। ”

রাজ্যের কথা শুনে কেবিনে উপস্থিত সকলেই হাসলেও পেখম বিরক্তিতে তাকিয়ে থাকে।

চলবে…