রাজপুরুষ পর্ব-০৩

0
251

#রাজপুরুষ
#পর্ব_৩
হানির বাহু টেনে লেয়নের সামনে থেকে সরিয়ে আনে তুলা। চোখ রাঙিয়ে প্রশ্ন করে,

‘ উনার পেছনে কেন লুকাচ্ছো? উনি তোমাকে বাঁচাবে? ‘

প্রশ্ন ছুঁড়তেই চটজলদি মাথা নাড়ায় হানি। তুলা আশ্চর্য হয়ে যায়। লেয়নের দৃষ্টি স্তম্ভিত। তুলার কৌতূহল জাগে ভীষণ। উচু গলা নামিয়ে নিচু কণ্ঠে শুধায়।

‘ কেন মনে হয় উনি তোমাকে বাঁচাবে? ‘

লেয়ন তাকিয়ে আছে হানির দিকে। এবারে হানিও তাকাল তার দিকে। বুক ভর্তি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,

‘ কাইল বাঁচাইছে, আইজ বাঁচাবো না ক্যা? ‘

হানির সরল ভাষায় লেয়নের চোখ কপালে উঠে। তুলা বিস্মিত হয়৷ এই মেয়ে তবে বোবা নয়। কথা জানে বেশ। তার মানে লেয়ন মেয়েটাকে গতকাল কোনো বিপদ থেকে বাঁচিয়ে এনেছে। তুলা সতর্ক হয়। হানিকে চাপা স্বরে আদেশ করে,

‘ এ ঘর ছাড়ো। চলে যাও নিচে। ‘

হানি চলে যাওয়া দূরে থাক। একটুখানি নড়লও না। তুলা এতে রেগে গেল ভীষণ। এই এক রত্তি মেয়ের এত স্পর্ধা! লেয়ন খেয়াল করল তার অর্ধাঙ্গিনী রেগে যাচ্ছে। রাগত তুলাতে কী আশ্চর্য সৌন্দর্য যে ভর করে। লেয়ন মুগ্ধ হয়ে যায়। এখনো হলো। তুলা চিৎকার করে উঠল।

‘ বেরিয়ে যাও। ‘

হানি বেরুলো না। লেয়ন তুলার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হানির দিকে তাকালো। বড্ড ত্যাঁড়া মেয়ে তো। তার বউ এত বড়ো বড়ো ধমক দিচ্ছে তবুও যাচ্ছে না। হাসি পেয়ে গেল খুব। তবুও তুলাকে তো বেশি রাগানো যাবে। অতিরিক্ত রাগলে আবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। তাই সে এবার হানিকে ঘর থেকে বের করার উদ্যেগ নিলো। খুব শান্তভাবে বলল,

‘ হানি বেরিয়ে যাও। ‘

একবার লেয়নের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল হানি। তুলা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে হানির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। লেয়ন মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে গিয়ে বসল বিছানায়। তুলা এবার দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে লেয়নের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো। সে দৃষ্টিতে লেয়ন তাকাতেই আগুন জল হয়ে গেল। এখন তুলার চোখ টলমল করছে।

মেঝেতে ধপাধপ্ পা ফেলে এগিয়ে এলো তুলা। কণ্ঠস্বর নিচু অথচ কঠিন করে বলল,

‘ মেয়েটা কে লেয়ন? ‘

লেয়ন বাঁকা হেসে সিগারেট ধরালো। তুলা অসহনীয় কণ্ঠে বলল,

‘ আমার উত্তর চাই। ‘

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো লেয়ন। তুলার দৃষ্টি দৃঢ় হয়। লেয়ন তাকায় সে দৃঢ় হয়ে আসা দৃষ্টিতে। বলে,

‘ উত্তর তো তোকেই দিই। ‘

‘ তাহলে এখন দিচ্ছেন না কেন? ‘

‘ অধৈর্য্য হোস না। ‘

আচমকা মেঝেতে বসে পড়ল তুলা। নরম গলায় বলল,

‘ আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না আমি। ‘

‘ কেন পারছিস না। বাচ্চা একটা মেয়ে। এত ভয় কেন পাচ্ছিস। ‘

‘ ভয় পাচ্ছি মানে? আর বাচ্চা মেয়ে মানে কী? ‘

‘ সতীনের ভয় নেই বলছিস? ‘

হুহু করে কেঁদে ফেলল তুলা। লেয়নের মুচকি হাসিটা বাড়লো এতে। তুলা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আপনি সবটা বুঝেও আমাকে আতঙ্কে রাখছেন। ‘

‘ কীসের আতঙ্ক। অমন বাচ্চা মেয়ে নিয়ে আতঙ্কের কী আছে? ‘

তুলা চটে গেল।

‘ মেয়ের আবার বাচ্চা, বুড়ি কি। পুরুষ মানুষের তো মেয়ে হলেই হয়। আর আপনি তো রাজপুরুষ! ‘

‘ তুলা! ‘

সহসা চমকে উঠল তুলা। লেয়ন রাজবংশের ছেলে। এই সত্যিটা লেয়ন সহ্য করতে পারে না। জানে তুলা। তবুও মুখ ফস্কে বলে ফেলেছে।

লেয়নের চোখ কঠিন হয়ে গেছে। চোয়াল জোড়া শক্ত। তুলা উঠে এসে লেয়নের পাশে বসল। কাঁধে মাথা রেখে নরম সুরে বলল,

‘ ক্ষমা করবেন। ‘

লেয়ন উঠে গেল সটান। কাঠ কাঠ গলায় বলতে শুরু করল গত রাতের ঘটনা। তুলা নির্বাক শ্রোতা।

ব্যবসার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন শহর আর দেশে যেতে হয় লেয়নকে। কিন্তু এবার গিয়েছিল সে এক গ্রামে। সেখানে বড়ো মামা এক জমি দেখেছিল। লেয়ন গিয়ে সে জমি দেখতেই পছন্দ হয়ে যায় খুব। ওই গ্রামেই লেয়নের বড়ো খালার শশুর বাড়ি। তাই সেখানেই অবস্থান করে। পাশাপাশি জমি দেখেশুনে একদম নিজের নামে দলিলও করে নেয়৷ এরপর পরিকল্পনা করতে থাকে এই জমিতে কিসের ব্যবসা করা যায়। অনেক ভেবেচিন্তে সে মস্ত বড়ো এক পুকুর কাটে। উদ্দেশ্য মাছ চাষ করা। দুমাস সময় কেটে যায়। তবুও পুকুর কাটার কাজ সম্পন্ন হয় না। এদিকে তুলাকে দেখার জন্য লেয়নের মন উতলা হয়ে যায়। সে মধ্য রাতেই তার চারজন রক্ষী নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঘন জঙ্গল পেরোনোর সময় আকস্মিক শুনতে পায় মেয়েলোকের কান্না। চতুর লেয়ন কান সজাগ করে। মশাল হাতে রক্ষীদের ইশারা করে পিছু নিতে। তারা পথ বদলে বামদিকের জঙ্গলে ঢুলে দেখতে পায় চার পাঁচজন পুরুষ মিলে অল্প বয়সী এক মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে কোথায় যেন নেওয়ার চেষ্টা করে। বাচ্চা একটা মেয়েকে দুর্বল পেয়ে এমন বলবান চারজন পুরুষ সুবিধা করছে! মাথা খারাপ হয়ে যায় লেয়নের। রক্ষীদের ইশারা করতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র চার পুরুষের ওপর। হানির সঙ্গে লেয়নের দেখা হয় সেই ক্ষণেই। ভয়ে জর্জরিত মেয়েটা লেয়নকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার তাগিদে। লেয়ন অনায়াসে আশ্রয় দেয় হানিকে। এরপর অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসা করে। নাম কী? বাড়ি কোথায়? হানি নিজের নাম ছাড়া সেই রাতে আর কিছুই বলতে পারে না। ভয়ে থরথর করে শুধু কাঁপতে থাকে। লেয়ন তখন জিজ্ঞেস করে,

‘ আমার সাথে যাবে? ‘

হানি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। সম্মতি পেয়েই হানিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে লেয়ন। সেই রাতে হানি যদি একবার অসম্মত হতো। লেয়ন তাকে নিয়ে আসতো না। হানি এখানে এসেছে সম্পূর্ণ তার নিজের ইচ্ছাতে।

সব কথা শুনে তুলা স্বাভাবিক হয়। বিস্ময় প্রকাশ করে শুধায়।

‘ আপনি যদি ঠিক সময় ওখানে না পৌঁছাতেন মেয়েটার কী হতো! ‘

লেয়ন সিগারেটের ধোঁয়া উড়ায়। তুলা নিজে থেকেই উত্তর দেয়।

‘ সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেত। ‘

এরপর একটু থামে। লেয়নের দিকে তাকায়। মিষ্টি হেসে বলে,

‘ এজন্যই বুঝি হানি আপনাকে রক্ষকর্তা মানে?’

লেয়ন হাসে পাত্তাহীন ভাবে। তুলা ফের বলে,

‘ হানিকে কি তাহলে এ বাড়িতে রেখে দেবেন? ‘

লেয়ন নিরুত্তর। তুলা আবার বলে,

‘ নিজের ইচ্ছে তে যখন এসেছে রেখে দিন। আমার কাজ যে করতো ওই যে রূপা তার যেন কী অসুখ হয়েছে। তার মা এসে খবর দিলো রূপা আসতে পারবে না বড়ো অসুখ পড়েছে। আমি কবিরাজ পাঠিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে কিছু টাকাও। রূপা যতদিন না আসতে পারে রূপার পরিবর্তে হানিকে কাজে লাগাই। আমার কী কাজ আসলে আপনার অনুপস্থিতিতে আমার একজন সঙ্গীই তো দরকার। ‘

লেয়ন জবাব দেয় না। তুলা জানে তার সিদ্ধান্ত, তার ইচ্ছেতে আপত্তি করবে না লেয়ন। তাই বলল,

‘ তাহলে ভানু খালাকে গিয়ে বলি হানিকে পয়পরিষ্কার করে ভালো কাপড় পরিয়ে দিতে। বাকি যা বোঝানোর আমি বুঝিয়ে দিব। ‘

লেয়ন শান্ত চোখে তাকাল। তুলা হাসলো একটু। বলল,

‘ যাই নিচে যাই। আপনার খাবারও গুছাতে হবে। ঠিক সময় চলে আসবেন কিন্তু। ডাকতে আর উপরে আসতে পারবো না। ‘

লেয়নের দৃষ্টি ছোটো হয়। তুলা ও দৃষ্টিতে না তাকিয়েই চটপট বেরিয়ে যায়। সে জানে ঘরে এসে তোষামোদ না করলে লেয়ন নিচে খেতে যাবে না। তার আসতেই হবে আবার। তবুও আসবে না বলে গেল। সে নিজেও জানে ঠিক সময় ঠিকই আসবে। তোষামোদ করে স্বামীকে নিয়ে যাবে বাড়ির সবার সঙ্গে খাবার খেতে। তুলার তোষামোদ ছাড়া যেখানে লেয়নের নিঃশ্বাস চলে না। সেখানে গলা দিয়ে খাবার নামবে কী করে?

®জান্নাতুল নাঈমা
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।