#রাজপুরুষ
#পর্ব_৪
হানিকে তুলার ব্যক্তিগত দাসী নিযুক্ত করা হলো। এ খবর মল্লিকার কানে গেলে সে ডেকে পাঠাল তুলাকে। তসবিহ হাতে নিজের ঘরে বসে আছে মল্লিকা। তুলা দরজায় কড়া নেড়ে ঘরে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে বলল,
‘ আসব আম্মা? ‘
মল্লিকা সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলো।
‘ আসো তুলা মা, আসো। ‘
তুলা ঘরে ঢুকতেই মল্লিকা উঠে তসবিহ রেখে দিলো। তুলা দাঁড়িয়ে আছে। মল্লিকা তাকে বসতে বললে চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসল। অপেক্ষা করতে লাগলো শাশুড়ির প্রশ্নের মুখোমুখি হবার জন্য। মল্লিকা তার অপেক্ষা দীর্ঘ করল না। তুলার পাশে বসতে বসতে বলল,
‘ একদিনের দেখা একটা মেয়েরে কি নিজের দাসী করা ঠিক হইলো মা? ‘
তুলা এবার খুব মিষ্টি করে হাসলো। মল্লিকা একধ্যানে তাকিয়ে আছে তার সুন্দরী পুত্রবধূর দিকে। তুলা বলল,
‘ ছোটো মেয়ে আম্মা। শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই হবে। ‘
‘ মেয়ে লোকের আবার ছোটো, বড়ো কি? আট বছর বয়সের পর সব মেয়েই সমান। হোইক আটাশ বা আঠারো। ‘
ঢোক গিলল তুলা। নরম গলায় বলল,
‘ এই মেয়ের আঠারো হয়নি আম্মা। বয়স তেরো চৌদ্দ হবে। ‘
মল্লিকার ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল। মাঝে মাঝে তুলাকে খুব বোকা আর সরল মনে হয়। আদতে তুলা তেমন ধরনের মেয়ে নয়৷ সে খুব দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সাহসী এবং বুদ্ধিমতী নারী। তার যেমন বুক ভর্তি মায়া, ভালোবাসা আছে ঠিক তেমনি প্রয়োজনে সে হিংস্র বাঘিনীও হতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মল্লিকা। বলল,
‘ যাচাই-বাছাই কইরা নিও তুলা মা। ‘
‘ আপনি চিন্তা করবেন না আম্মা। আমি অতো কাঁচা কাজ করব না৷ ভরসা করতে পারেন আমাকে। ‘
মল্লিকার দৃঢ় মুখ এবার সরল হলো। মৃদু হেসে বলল,
‘ তুমিই তো আমার ভরসা গো মা। ‘
তুলা মস্তক নত করে হাসে। মল্লিকা এবার একটু কাছে ঘেঁষে তার। ফিসফিস করে শুধায়,
‘ যেটা বলছিলাম মাথায় আছে? বলছো লেয়নরে? ‘
আকস্মিক মনে পড়তেই লজ্জায় মিইয়ে গেল তুলা। মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে না বোঝাল। মল্লিকার দৃষ্টিজোড়া ছোটো হয়ে গেল এতে। বলল,
‘ আর কত অপেক্ষা করাবা মা। দিন যে ফুরিয়ে আসতাছে। এইবার নাতি-নাতনির মুখ দেখাও। তোমাদের এখন বংশ বৃদ্ধি দরকার মা। আর দেরি কইরো না। ‘
তুলার লজ্জা প্রগাঢ় হয়৷ সে আর শাশুড়ির সামনে বসে থাকতে পারে না৷ চট করে উঠে দাঁড়িয়ে পালাতে উদ্যত হয়।
‘ আমি এখন আসি আম্মা। ‘
মল্লিকা অনুমতি দেয় না। বরং তুলার মাথায় আরও ভালো করে গেঁথে দেয়। বলে,
‘ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কখন পরিপূর্ণতা লাভ করে
জানো যখন তাদের কোল আলো করে সন্তান আসে। দুইজনের অংশ মিলে একটা প্রাণ তৈরি হয়ে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়। ‘
তুলার হৃদয় কেঁপে উঠে। শরীর জুড়ে বয়ে যায় শিহরণ। এবার সত্যি সময় এসেছে। লেয়নের সন্তানের মা হবে সে। মল্লিকা অনুমতি দেয় চলে যাওয়ার জন্য। তুলা এক ছুটে পালায় শাশুড়ির ঘর থেকে।
ভানু খালা হানিকে তৈরি করে দিয়েছে। তুলা একবার পরোখ করে নিলো। সে খুব পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে। তার চারপাশের সবকিছু খুব গুছিয়ে রাখে। অপরিষ্কার, নোংরা, অগোছালো জিনিসপত্র তার একদম পছন্দ নয়। তাই নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়েছে হানিকে৷ হানি এলে আপাদমস্তক তাকে দেখে নিলো একবার। ভানু খালা বেশ সাজিয়েছে। নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পরিয়েছে। কানে, গলায়, হাতে, পায়ে রূপোর গহনায় মুড়িয়েছে। চুলে বিনুনি গেঁথে আগা বেঁধেছে রূপোর কাটা দিয়ে। তুলার চোখ জুড়িয়ে গেল। মেয়েটা দেখতে মিষ্টি। ভেবেই হাত টেনে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করালো। এরপর কাজল এর কৌটা বের করে বলল,
‘ চোখে কাজল দাও। ‘
হানি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তুলার দিকে। তুলা বলল,
‘ ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? ভানু খালা কিছু বলেনি তোমাকে? ‘
হানি এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। তুলা একগাল হেসে নিজেই হানিকে কাজল দিয়ে দিলো। তারপর একটা নীল রঙের টিপ পরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আজ থেকে তোমাকে আমার দাসী নিযুক্ত করা হয়েছে। ভয় পেও না। আমার তেমন কাজ নেই। সারাক্ষণ আমাকে সঙ্গ দেওয়াই হবে তোমার কাজ। ‘
ঘনঘন চোখের পলক ফেলল হানি। তুলা এক মুহুর্ত ভাবলো কিছু। তারপর শুধাল,
‘ তুমি কী কী কাজ পারো হানি? ‘
হানি নিচু গলায় থেমে থেমে বলল,
‘ ভাত রান্ধন পারি। উঠান ঝাড়া পারি। ছাঁই তুলাও পারি। উঁকুন আনতে পারি আর কাপড় ধোঁয়া পারি। ‘
হানির কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তুলা। তার হাসির শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেল হানি। তুলা হাসতে হাসতে হানির কাঁধে মৃদু চাপড় দিয়ে বলল,
‘ বাব্বাহ উঁকুন আনতে পারো? আমার মাথায় তো উঁকুন নেই হানি৷ আমার স্বামী মাথায় উঁকুন ওয়ালা মেয়ে মানুষ পছন্দ করে না। ‘
বলেই হানির হাত টেনে তিনতলা পেরিয়ে ছাদে চলে গেল। উদ্দেশ্য হানির সঙ্গে গল্প করা। বড়ো মামি ছাদে আচার শুকোতে দিয়েছেন। তুলা গিয়ে একপাশ থেকে আচার তুলে হানিকে একটু দিলো, নিজেও নিলো। তারপর আচার খেতে খেতে গিয়ে বসল দোলনায়। হানি দাঁড়িয়ে আছে। তুলা তাকে পাশে বসতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে হানি গিয়ে বসল পাশে। তুলা বলল,
‘ তোমার বাড়ির কথা মনে পড়ে না হানি? ‘
হানি মাথা নাড়িয়ে না করল। তুলা ফের শুধাল,
‘ বাবা, মায়ের কথা? ‘
হানি নিশ্চুপ, নিরুত্তর, প্রতিক্রিয়া হীন। বুদ্ধিমতী তুলা তখন বলল,
‘ তাহলে কার কথা মনে পড়ে তোমার? ‘
এবারে হানি উত্তর দিলো।
‘ আপা। ‘
তুলা অবাক হয়ে বলল,
‘ তোমার আপা আছে? ‘
‘ নেই। ‘
‘ তাহলে? ‘
‘ মইরা গেছে! ‘
চমকে উঠল তুলা। মইরা গেছে কথাটায় কি ক্ষোভ মিশে ছিল? হানির কণ্ঠ কেমন অদ্ভুত লাগলো এখন। পরোক্ষণেই মনের ভুল ভেবে বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। মায়াভরে তাকাল হানির দিকে। বলল,
‘ আহারে মন খারাপ করো না। আজ থেকে তুমি আমাকে আপা বলে ডাকবে কেমন? ‘
হানি মাথা কাত করল। তুলা হাসলো। সুন্দর প্রশ্রয়ের হাসি। তারপর হানিকে বলতে লাগলো সে রোজ কী কী করতে ভালোবাসে। আর কোন কোন কাজে হানির সঙ্গ লাগবে। হানি সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনল। কিছুক্ষণ পরেই ছাদে উপস্থিতি ঘটল শাহজাহান লেয়নের। লেয়নের সঙ্গে আরও কয়েকজন লোক। তাদের মধ্যে ম্যানেজার সাহেবও রয়েছে। এমন সময়ে এখানে লেয়নকে দেখে আতঙ্কিত হলো তুলা। চটজলদি উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টানলো। লেয়ন ম্যানেজার সাহেব সহ সবাইকে ছাদ ঘরের দিকে চলে যেতে বলল। এরপর সে মৃদু পায়ে এগিয়ে এলো তুলার কাছে। গুরুগম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। তুলা আমতাআমতা মনোভাবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। হানি চুপচাপ বসে আছে। তার মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে তার দৃষ্টি লম্বা, চওড়া, কৃষ্ণাঙ্গ, গম্ভীর লেয়নের দিকে। অথচ লেয়ন হানিকে খেয়ালই করল না। সে সম্পূর্ণ মনোযোগী তার স্ত্রীর প্রতি।
‘ এখানে কী করছিস? ‘
‘ হানির সঙ্গে গল্প করছিলাম। আপনি এ সময়ে? ‘
‘ বলেছিলাম তোকে। আজ মিটিং আছে। আর সেটা বাড়িতেই করব। ‘
চমকে উঠল তুলা। হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে জিভ কামড়ে ধরল। লেয়নের দৃষ্টিজোড়া ছোটো হলো এতে। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা। আমার বলা কোনো কথা তুই ভুলে গেছিস। ‘
আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না লেয়ন। চলে গেল গটগট পায়ে। ছাদ ঘরে ঢোকার পূর্বে ঘাড় ঘুরিয়ে তুলার দিকে তাকাল একবার। ও দৃষ্টির অর্থ ‘এক্ষুনি নিচে যাবি তুলা, এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। ‘ সহসা তুলার বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠল। সে হন্তদন্ত হয়ে হানিকে নিয়ে নেমে গেল নিচে। হানি অবুঝ চোখে সবটাই দেখল। বুঝল না কিছুই। তবে লেয়নের গুরুগম্ভীর মুখটা তার মনে পড়তে লাগলো বারবার। কিন্তু কেন?
চলবে…
®জান্নাতুল নাঈমা