#রাজপুরুষ – ৫
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার,
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার…
প্রিয়তম আমার ওগো প্রিয় পুরুষ, ত্রিশতম জন্ম বার্ষিকীর শুভেচ্ছা রইল।
আজ তুলার অর্ধাঙ্গ শাহজাহান লেয়নের জন্মদিন। তাই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের কবিতার তিন লাইন লিখে সঙ্গে জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা জানালো তুলা। চিঠির লেখাটা আবার তাঁর নতুন দাসী হানিকে একবার পড়ে শুনালো। তারপর হানির সামনেই লেখা গুলোর ওপর আলতো হাত বুলিয়ে চুমু খেলো। এরপর চিঠি ভাঁজ করে রেখে দিলো লেয়নের বালিশের তলায়। হানি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তুলা ওর চাউনি দেখে মুচকি হাসলো। থুতনিতে আলতো ছুঁয়ে শুধাল,
-‘ লজ্জা পেলি হানি? ‘
ঘনঘন চোখের পাপড়ি ঝাটপালো হানি। এদিকওদিক মাথা নাড়িয়ে বলল,
-‘ না। ‘
তুলা ফিক করে হেসে বলল,
– ‘ তুই কী রে হানি.. কিছুতেই দেখি লজ্জা পাস না। ‘
কথাটা বলেই হানির হাত ধরে চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল সে। সকাল থেকে লেয়ন খুব ব্যস্ত। আজ আর রাত নামার আগে ঘরে ফিরবে না। তাই সে হানিকে নিয়ে তাদের পুকুর ঘাটে চলে গেল। পুকুরটা বাড়ির পেছনে। বাগান ঘরের পাশেই ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুরের চারপাশ এত পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। পুকুর পাড়ে আবার ইট গেঁথে বসার জায়গা করে দেওয়া। তুলা হানিকে নিয়ে গিয়ে ওখানেই বসল। হানি আশপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে বাগান ঘরে আটকাইতেই তুলা মিষ্টি হেসে বলল,
-‘ এই ঘরটা তোর রক্ষাকর্তা মানে আমার স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় ঘর। যখনি কোনো শুভদিন আসে। আমরা এ ঘরে এসে সময় কাটাই, রাত্রিযাপন করি। আমাদের প্রথম বাসরও হয়েছে এ ঘরে। ‘
আচমকা কথাটা বলেই লজ্জায় চুপ করে গেল তুলা। আড়চোখে হানিকে দেখল একবার। মেয়েটা বরাবরের মতো এখনো গম্ভীর। এবার বেশ অবাক হলো তুলা। চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে বলল,
– ‘ বাসর মানে কি বুঝিস তুই? ‘
চট করে উত্তর দিলো হানি।
-‘ আমি এখনো বাসর করি নাই তাই বুঝি না। ‘
তুলার চোখে-মুখে বিস্ময় প্রকাশ পেলো। বিস্ময়াপন্ন কণ্ঠে সে ফের শুধাল,
-‘ তুই তো মনে হচ্ছে সবই বুঝিস হানি। বয়স ভেদে তুই অনেক বেশিই বড়ো মনে হচ্ছে। ‘
হানির মস্তক নত হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুলা। আকস্মিক দুষ্টু হাসির দেখা মিলল তার ঠোঁটে। আর কথা বাড়ালো না। এবার কাজের পালা। হানিকে নিয়ে সে বাগান ঘরে গেল। ইট সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ছোট্ট একটা ঘর। কোনো রঙের ছিটেফোঁটা নেই। বাইরের দৃশ্য এমন হলেও ভেতরের দৃশ্য খুবই মনোরঞ্জন। চারপাশ বাহারি রকমের তাজা ফুল দিয়ে সাজানো। হরেক রকম এই ফুলের ঘ্রাণে হানির মুখের গম্ভীর ভাবটা কাটতে শুরু করল। তুলা খেয়াল করল হানিকে। পাশাপাশি ঘরজুড়ে ঘুরে ঘুরে ফুল গুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। হানির নজর তখন বিছানায় কোণে থাকা ছোট্ট টেবিলে। যেখানে একটি মাটির ফুলদানিতে তাজা গোলাপ গুচ্ছ রাখা। আনমনেই হানির পা দুটো এগিয়ে চলল সেদিকে। গোলাপ স্পর্শ করতেই নিতেই তুলা খপ করে ওর হাত ধরে ফেললো। চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘ উহুম, এই ফুল আমার রাজার জন্য। ‘
দৃষ্টি দৃঢ় হলো হানির। তুলা মুহুর্তেই ওর হাত ছেড়ে বিছানার এক কোণে গিয়ে বসল। তারপর পা ঝুলাতে ঝুলাতে বলল,
– ‘ এই ঘর আজ এভাবে সাজানো হয়েছে কেন জানিস? এখানে আজ আমার আর তোর রক্ষাকর্তা মানে আমার রাজপুরুষের ফুলশয্যা হবে। সারারাত আমরা পরস্পরকে ভালোবাসবো। ‘
হানি প্রতিক্রিয়াহীন। পুকুর ঘাট থেকে তক্ষুনি ডাক এলো সাঁঝমালতীর। লেয়নের ছোটো মামার বারো বছর বয়সী মেয়ে সাঁঝমালতীর ডাকে ত্বরিত বাগান ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল তুলা। হানি বেরুলো না। সাঁঝমালতী হাঁপাচ্ছে খুব। তুলা গিয়ে শুধাল,
-‘ কী হয়েছে সাঁঝ? ‘
– ‘ তাড়াতাড়ি এসো ভাবি, ভাইয়ার হাত কে’টে রক্ত পড়ছে! ‘
সাঁঝের মুখে ভীত কণ্ঠে এহেন বাক্য শুনতেই তুলার বুকের ভেতর চিড়িক দিয়ে উঠল। এক মুহুর্ত স্থির থাকতে পারলো না সে। ছুটতে ছুটতে গিয়ে পৌঁছাল গৌরব গৃহের দোরগোড়ায়। দেখতে পেলো লেয়নকে ঘিরে রয়েছে বাড়ির প্রতিটি সদস্য। বাম হাতের অনামিকায় রক্ত ঝরছে। মা মল্লিকা চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেই রক্ত পরিষ্কার করে দিচ্ছে। তুলার চোখ গলে অশ্রু নামলো। ত্বরিত গিয়ে চিকিৎসা বাক্স নিয়ে এসে লেয়নের সামনে ধপ করে বসে পড়ল সে। নিমেষে লেয়নের মুখে হাসি ফুটল। তাকে ঘিরে তুলার এই উতলা রূপ, হৃদয় পোড়া যন্ত্রণাকে বড্ড ভালোবাসে সে। পৃথিবীতে এতটুকু সুখ সে অন্য কিছু তে অনুভব করে না। যতটা তার জন্য তুলার সব ধরনের অনুভূতিকে করে। একমাত্র ঘৃণা ছাড়া। যেদিন তুলা তাকে ঘৃণা করবে। ঠিক সেদিন এ পৃথিবীর বুক থেকে শাহজাহান লেয়নের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে।
কাঁদতে কাঁদতে চোখ, মুখ লাল করে ফেলেছে তুলা। লেয়নের অনামিকা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো সে। লেয়ন অপলকে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। সে চাউনি দেখে তুলার কান্না বাড়লো। লেয়নের সার্বক্ষণিক সঙ্গী রুস্তমকে বলল,
-‘ এমন অঘটন কী করে ঘটল রুস্তম ভাই? ‘
রুস্তম ভীত চোখে লেয়নের দিকে তাকাল। লেয়ন ইশারায় নিষেধ করল বলতে। রুস্তম আর কিচ্ছুটি বলল না। তুলার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। শাসানো দৃষ্টিতে লেয়নকে দেখতে লাগলো আপাদমস্তক।
প্রতি বছর একের পর এক বিশেষ দিন, বিশেষ মুহুর্ত আসে লেয়ন তুলার জীবনে। আর সব বিশেষ দিনই তারা বিশেষ ভাবে সময় কাটায়। এবারো তার অন্যথা হবে না। সব গুছিয়েই রেখেছে তুলা। লেয়ন জানে। তাই আজ সন্ধ্যার পরই তুলা বাগান ঘরে চলে গেল। লেয়ন ততক্ষণে নিজের ঘরে গিয়ে চিঠি পেয়েছে। সে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাগান ঘরে যাওয়ার। সেখানে তার একমাত্র ঘরণী অপেক্ষা করছে।
বুকের ভেতর তীব্র উত্তেজনা, একরাশ ভালোবাসাময় অনুভূতি নিয়ে বাগান ঘরে প্রবেশ করল তুলা। মুহুর্তেই স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। তার ফুলশয্যার ঘরটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। চারদিকে ছিন্নভিন্ন ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তুলার হৃদয় টুকুও যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এরপর দৃষ্টি পড়ল বিছানায়। পুরো বিছানা ভর্তি কাঁটাযুক্ত অসংখ্য ডাল। নিমেষে বুক কেঁপে উঠে তুলার। থরথর করে কাঁপতে থাকে সারা অঙ্গ। তার আর লেয়নের ফুলশয্যাকে কে কণ্টক শয্যায় রূপ দিলো!
চলমান-
®জান্নাতুল নাঈমা