#জামাই_শ্বশুর
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২
ওমায়ের আলীর মেয়ের বিয়ে হবে আর গোটা দেশ জানবে না তা-ও হয়? এক সপ্তাহের মধ্যেই কাছের-দূরের যত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব ছিল, সবাইকে তিনি বিয়ের দিন উপস্থিত করে ফেললেন। সেইসাথে বিয়ের আগেরদিন সন্ধ্যা থেকে কাওয়ালীর আয়োজন করে, হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়লেন। তবে সবদিক থেকে নির্বিকার মেহমাদের বাবা মোশাররফ হোসেন। বিয়ের আয়োজনে তিনি প্রয়োজনের বাইরে এক পয়সাও খরচ করেননি। বিয়ের পোশাক-আশাক ও বাড়ি সাজানো থেকে শুরু করে ওয়ালিমার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই খরচ করেছেন। সারাদিনের ভূরিভোজন শেষে সন্ধ্যের পর কনে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ওয়ালিমার আয়োজনটা আগামীকাল হবে তাই গ্রামের সবাইকেই দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
বিয়ে নিয়ে একটা মেয়ের মনের ভেতর যত আবেগ থাকে, জেনিফারের সব আবেগ সেদিন চাপা পড়েছিল বাবার কঠিন সিদ্ধান্তের ওপর। তবে মায়ের কথা ভেবে বিদায়ের সময় চোখে পানি এসেছে তার। ছোটো ভাইকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। যদিও গ্রামের মেয়ে, গ্রামেই থাকছে তবুও মনকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছিল না জেনিফার। শহরে বেড়ে ওঠার কারণে এই গ্রামের প্রতি তার বিশেষ টান নেই, শুধু মায়ের টানেই মাসের শেষ সপ্তাহ এখানে কাটায়। মায়ের কবরের আশেপাশে হেঁটে বেরিয়ে নিজেকে শান্ত করে।
বধূবরণ করে, নতুন বউকে মিষ্টিমুখ করিয়ে, মেহমাদের মা রেজি সুলতানা আনন্দের আতিশয্যে চোখের পানি ফেলে দু’জনকে দোয়া করে বললেন, “আমার একটামাত্র ছেলে। তুমি তার জীবনসঙ্গিনী। জীবনে মেয়ে নিয়ে আমার ভীষণ আফসোস ছিল। আজ সব আফসোস দূর হলো। এই ঘরে তুমি নিজের মতো করে থাকতে পারবে। চিন্তা ও ভয়ের কিচ্ছু নেই।”
খুব ছোটোবেলায় মাকে হারিয়ে, মায়ের আদর-শাসন ছাড়াই বড়ো হয়েছে জেনিফার। এই সম্পর্ক যে কারণেই হোক না কেন, শাশুড়ি মায়ের আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে গেল তার। চোখভরা অশ্রু নিয়ে কদমবুসি করে বলল, “আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
পাশে থেকে মেহমাদ খুকখুক শব্দে কেশে উঠল। যেন জেনিফারকে সতর্ক করল। কাশির শব্দে জেনিফার চোখ তুলে তাকালে মেহমাদ মুখে হাত চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল। জেনিফার বলল, “হাসছেন কেন?”
“মায়েদের দোয়া কিন্তু বিফলে যায় না।”
“তো?”
“এমনকিছু চাইবেন না, যাতে করে আপনার এখান থেকে যেতে কষ্ট হয়।”
জেনিফারকে সতর্ক করে দিয়ে মেহমাদ ফ্রেশ হয়ে পোশাক পরিবর্তন করল। এরমধ্যেই ড্রয়িংরুম থেকে হৈচৈ ভেসে এলে ছুটে এসে দেখল, ওমায়ের আলী উপস্থিত। সে দ্রুত তাঁর পাশে গিয়ে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম শ্বশুর আব্বা। এই সময়ে আপনি! মেয়েকে চোখে হারাচ্ছেন? আধাঘণ্টাও হয়নি কিন্তু।”
ওমায়ের আলী বললেন, “কী আর করব জামাই? মা মরা মেয়ে, দূরে রেখে তো শান্তি পাই না।”
মেহমাদ ঘরে থাকা কাজের লোকেদের উদ্দেশ্যে বলল, “কে কোথায় আছো, আমার শ্বশুর আব্বাকে নাশতা-পানি দাও। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে প্রথম পা পড়েছে ওনার। ভালো করে যত্নটত্ন করো।”
ঘরে থাকা প্রত্যেকেই ওমায়ের আলীকে যথাসম্ভব যত্ন ও সম্মানের সাথে চা-নাশতা এগিয়ে দিল। মেহমাদ বলল, “আমাকে মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়ে আপনি খুশি হয়েছেন তো শ্বশুর আব্বা? আমি কিন্তু বিরাট খুশি। সবাই এখন আমাকে এক নামে চিনবে। শহরের নামকরা সংসদ সদস্য ওমায়ের আলীর একমাত্র মেয়ের জামাই ইফতেখার হোসেন। রাস্তায় বের হলে সবাই নিশ্চয়ই ফুলের মালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে! আহা… কী সৌভাগ্য! আপনার হাত আমার মাথায় রেখে আশীর্বাদ করেন তো, যেন ভবিষ্যতে আপনার মতোই হতে পারি।”
ওমায়ের আলী ভীষণ খুশি হয়ে মেহমাদকে আশীর্বাদ করে বললেন, “অফকোর্স তুমি আমার মতোই হবে। আমি তো সেটাই চাই।”
“জি, অবশ্যই। না হলে লোকে আমাদের দেখলে বলবে কী করে, ওই দ্যাখ্ দ্যাখ্ জামাই-শ্বশুর কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে হাঁটছে? আমি তো এখুনি কল্পনা করে ফেলছি সব।”
ওমায়ের আলী এবার গদগদ হয়ে মেহমাদের হাত দু’খানা চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন, “আমি একটা জরুরী কাজে এসেছি।”
“তাই? আগে বলবেন তো! কী জরুরী কাজ?” শ্বশুরের ফিসফিস শোনে মেহমাদও ফিসফিস করেই প্রশ্ন ছুঁড়ল।
বড়শির টোপ যে মাছ গিলে ফেলেছে, এতক্ষণে নিশ্চিত হলেন ওমায়ের আলী। তাই প্রথম দান ছুঁড়তে বললেন, “ইয়ে মানে, তুমি এমনিতে কী কাজ করো?”
“আমি? কিছুই করি না। এই দেখুন, আমার পকেটে মাত্র এই ক’টা টাকা পড়ে আছে।”
পকেটে থাকা পাঁচশো, একশো ও পঞ্চাশ টাকার যে কয়টা নোট ও পাঁচ টাকার কয়েন ছিল, সব শ্বশুরের সামনে রেখে মেহমাদ বলল, “দেখেন, আমি তো আমার বাবার টাকায় চলি। এজন্যই আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হইনি। বিয়ে করে বউয়ের ভরণপোষণ নেয়ারই ক্ষমতা নেই। অথচ আপনি আমাকে বুঝলেন না। কেমন করে লজ্জায় ফেলে দিলেন। দেশের সবাই যদি জানে, আপনার মেয়ের জামাই বেকার, তখন কী হবে বলুন তো?”
ওমায়ের আলী একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। চাকরিবাকরি করে না, তাহলে পোলাপান নিয়ে এই ছেলে এত তর্জনগর্জন করে কীভাবে? মনে প্রশ্ন চেপে রেখে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললেন, “সত্যিই কোনো চাকরি করো না?”
“কোনো চাকরিই করি না। পড়াশোনা শেষ করে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করছি। বাবার ক্ষমতার জোরে ভেবেছিলাম একটা সরকারি চাকরি জুটিয়ে নিব, কিন্তু তার এক কথা, তিনি ছেলের জন্য কোথাও সুপারিশ করবেন না। মেধা আছে কী করতে? ওটাকে কেন কাজে লাগাচ্ছি না? এমনসব কথা শুনিয়ে মেজাজ খারাপ করে দেন। কী যে করি! টেনশনে আমি তো অন্ধ হয়ে যাচ্ছি শ্বশুর আব্বা। একটা চাকরি না হলে আপনার মেয়ের শখ-আহ্লাদ পূরণ করব কী করে?”
সুযোগ পেয়ে এবার ওমায়ের আলী বললেন, “টেনশনের কিছু নেই। আমি আছি তো। ঠিকই একটা সরকারি চাকরি জুটিয়ে দিতে পারব। তবে এরজন্য অবশ্যই তোমাকে আমার কথামতো চলতে হবে।”
মেহমাদ একপায়ে খাড়া হয়ে বললেন, “কোনো সমস্যা নেই। আমি আপনার কথামতোই চলব, আগে আমাকে একটা চাকরি দিন তো। বেকার জীবন আর ভালো লাগছে না।”
তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, বেকারদের টাকা দিয়েই বশ করতে হয়। এজন্যই দারুণ অফার নিয়ে এসেছেন। মেহমাদের মনের খবর পেয়ে তিনি চুপিসারে বললেন, “আরও কিছুদিন যাক, আমি তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেব।”
“অসুবিধা নেই।”
ওমায়ের আলী সাথে আনা ব্যাগের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হাজার টাকার কয়েকটা বান্ডিলসহ ব্যাগটা মেহমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা রাখো। এখানে দশ লাখ আছে। চাকরি না হওয়ার আগ পর্যন্ত আরামসে দিন চলে যাবে।”
মেহমাদের চোখদুটো চকচক করে উঠল। ব্যাগের ভেতর চেক করে খুশিতে দিকদিশা হারিয়ে বলল, “আল্লাহ, কী করেছেন শ্বশুর আব্বা? এত্ত টাকা!”
ওমায়ের আলী ঝটপট মেহমাদের হাত চেপে ধরে বললেন, “লাগলে আরও দিব, কিন্তু কথা একটাই, আমার দলের একজন হতে হবে।”
“সেটা আমি হয়েই গেছি শ্বশুর আব্বা। থ্যাংক ইউ সো মাচ্। এত টাকা একসাথে পেলে কেউ আর আপনার বিপক্ষে যাবে না। আজ থেকে আমি আপনার দলে, ডিসিশন ফাইনাল।”
মোশাররফ হোসেন বউ ঘরে তুলে, বিশেষ কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখলেন জামাই-শ্বশুর খোশমেজাজে গল্প করছে। যত যা-ই হোক, মন থেকে এই বিয়ে মানতে পারেননি মোশাররফ হোসেন। সাথে ছেলের এই ধরনের আচরণ দেখে তিনি মহাবিরক্ত। এমনিতেই মেজাজে আগুন, তারমধ্যে এই দৃশ্য দেখে ছেলের দিকে আগুনঝরা দৃষ্টি দিলে, মেহমাদ নিজেও চোখের ইশারায় বাবাকে কিছু একটা বুঝিয়ে ফেলল। এরপর বলল, “বাবা, এসো এখানে। তোমার বেয়াইয়ের সাথে গল্প করো। কতদূর থেকে এসেছেন উনি। আমি আর কতক্ষণ গল্প করব? আমার অনেক কাজ আছে। তুমি একটু ওনার পাশে বসো, আমি জেনিফারকে পাঠাচ্ছি। শ্বশুর আব্বার সাথে দেখা করে যাক, কী বলো?”
ব্যাগটা নিয়ে টুপ করে সরে পড়ল মেহমাদ। রুমে এসে দরজা আটকে, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপর ব্যাগটা আলমারিতে রেখে বিছানায় চোখ পড়তেই চমকাল। ফুলে ফুলে সাজানো বিছানার একপাশে সাধারণ একটা জামা পরে শুয়ে আছে জেনিফার। তার আগমন বোধহয় টের পায়নি। ঘুমিয়ে পড়ল কি না নিশ্চিত হতে বিছানার এককোণে দাঁড়িয়ে মেহমাদ বলল, “জেনিফার, আপনার বাবা এসেছেন।”
জেনিফার ওদিকে মুখ রেখেই বলল, “বাবাকে চলে যেতে বলুন। আমি ওনার সাথে দেখা করব না।”
“কেন?”
“আমার ইচ্ছে নেই, তাই।”
“কিন্তু উনি আপনার বাবা! কষ্ট করে যেহেতু এসেছেন, দেখা করে ওনাকে একবার নিশ্চয়তা দিন যে, আপনি এখানে ঠিক আছেন।”
“তাতে কী লাভ?”
“আপনি লাভ-ক্ষতি ছাড়া কিছু বুঝেন না, না?”
“না বুঝি না। যখন ইচ্ছে হলো মেয়েকে ভাসিয়ে দিলাম, যখন ইচ্ছে হলো, দেখতে এসে মহান সেজে গেলাম। এই ধরনের অতি আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না।”
মেহমাদ বুঝতে পারল, বিয়ে নিয়ে এখনও জেনিফার নিজের মনে রাগ ও ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছে। সে তাকে বুঝানোর চেষ্টায় বলল, “আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন?”
“না ভুলিনি।” একরোখা কণ্ঠে উত্তর দিল জেনিফার।
“তাহলে তৃতীয় পক্ষের সামনে কেন সম্পর্কটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন?”
“বাবা তৃতীয়পক্ষ?”
“স্বামী-স্ত্রী দু’জনের মাঝখানে বাকিরা তৃতীয়পক্ষই। এখন যান, রাগ-ক্ষোভ একপাশে রেখে ওনার সাথে দেখা করে আসুন।”
“যাব না বলেছি একবার।”
“আপনি আমার কথাটাও রাখবেন না?”
“অবশ্যই না। আমরা শুধু একটা সমস্যার সমাধান করতে এই সম্পর্কে জড়িয়েছি, কারও আদেশ-নিষেধ শুনতে নই। আপনি আমাকে কোনোকিছু নিয়ে জোর করতে পারেন না।”
“ওকে, এ্যাজ ইউওর উইশ।”
মেহমাদ আবারও ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হলে ওমায়ের আলী বললেন, “জেনি আসেনি? দেখা করে যেতাম।”
“ওর খুব মাথাব্যথা করছে শ্বশুর আব্বা, ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“সে কী কথা? এখন মাথাব্যথা?”
“টেনশনের কিছু নেই। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। ঘুমিয়ে যখন পড়েছে, ঘুম ভাঙানোর দরকার নেই। এতে আরও ব্যথা বাড়বে। আপনি কাল একবার এসে মেয়েকে দেখে যাবেন! অবশ্য আপনি চাইলে প্রতিদিন আসতে পারেন। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। এটা তো আপনার মেয়েরই বাড়ি।”
***
রাত দুটোর দিকে জেনিফারের যখন ঘুম ভাঙল, চোখ মেলে মোবাইলে সময় দেখে, আবছা আলোয় প্রথমেই আবিষ্কার করল, রুমের ভেতরে থাকা ডিভানে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে মেহমাদ। বাবার ওপর থাকা অভিমানের কারণে রাতে কিছু খায়নি। তবে শাশুড়ি মায়ের আদর-যত্ন তাকে অভুক্তও রাখেনি। সবার খাওয়া শেষে তিনি নিজে এসে বউমাকে মুখে তুলে খাইয়েছেন। এরপর কখন যে দু’চোখে ঘুম নেমে এসেছিল, টেরই পায়নি সে। মেহমাদও রুমে আসেনি আর।
এখন, এতরাতে মেহমাদকে ওইভাবে ল্যাপটপের স্ক্রিনে ডুবে থাকতে দেখে ঘুমঘুম কণ্ঠে জেনিফার বলল, “আপনি ঘুমাননি?”
মেহমাদ একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও ল্যাপটপে চোখ ডুবিয়ে বলল, “ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছি।”
“কী?”
বালিশ ছেড়ে মাথা তুলে প্রশ্ন করল জেনিফার। মেহমাদ উঠে দাঁড়িয়ে রুমের বাতি জ্বালিয়ে আলমারির কাছে গেল। লক খুলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বিছানার ওপরপাশে বসে কাগজগুলো জেনিফারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এগুলো দেখুন।”
“এসব কীসের কাগজ?” হাতে নিয়ে প্রশ্ন করল জেনিফার।
“রাস্তার দলিল, নকশা আর আপনার বাবার জায়গাজমির একটা পরিপূর্ণ হিসেব।”
জেনিফার সবকিছু দেখেও কোথায় কী আগামাথা কিছুই বুঝল না। মেহমাদ তাকে নকশায় থাকা তাদের বাড়ি ও রাস্তার দাগ কোথা থেকে কতটুকু গিয়েছে, সবটুকু দেখিয়ে হাতের পেন্সিল দিয়ে গোলাকার জায়গাটুকু ইশারা করে বলল, “এই সম্পূর্ণ জায়গায় আপনাদের বাড়িটা ঢুকে গেছে। শুধু বাড়ি নয়, ওইদিকে বেশকিছু জমিও আছে, যেটুকু বহুবছর আগে রাস্তা ছিল। আর গ্রামের মানুষজন নিজেদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ওই রাস্তাটাই ব্যবহার করেছে বেশি।”
“কিন্তু এখানে আমাদের বাড়িটা ঢুকল কীভাবে? রাস্তা যেহেতু ছিল, কেউ কেন সেটা ব্লক করে দিবে?”
“এটা করেছেন আপনার দাদার বাবা। দেশ স্বাধীন হওয়ারও অনেক আগে, বংশবৃদ্ধির কারণে উনি যেখানে পেরেছেন, নিজের সন্তানদের মাথাগুঁজার ঠাঁই করে দিয়েছেন। তখন এসব দখলদারিতে মানুষের মাথাব্যথা খুব কম ছিল। কারণ, আপনাদের বংশের সবাইকে গ্রামের লোকজন অনেক সম্মান করত। আর ওই সময় গ্রামে আপনাদের পরিবারের একটা ক্ষমতা ছিল, যে-ই ক্ষমতার জোরে আপনার দাদার বাবা যা কিছু তা-ই করতে পারতেন। এতে কেউ কিচ্ছু বলত না। সময়ের সাথে সাথে আপনাদের বংশের বাকি সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ কেউ এই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। শুধু আপনার দাদা থেকে গিয়েছেন। এবং তিনি নিজের হাতে সবকিছুর মালিকানা পেয়ে যাওয়াতে সম্পূর্ণ এড়িয়া ভোগদখলের জন্য নকল দলিলপত্র তৈরী করে সবকিছু নিজের নামে করে নেন আর রাস্তাসহ যতটুকু ফসলিজমি ছিল, সব জমিকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট একটা দাগ টেনে প্রাচীর তুলে দেন।”
জেনিফার এত কথা কখনওই শুনেনি, শুনার আগ্রহ ছিল না তার। সে শুধু জানত, তার পূর্বপুরুষের অনেক জমিজমা ও অনেক অর্থসম্পদ ছিল। এখনও আছে। তবে এসব যে অন্যায়ভাবে দখল করে নেয়া, সেসবের কিছুই তার বাবা তাকে বলেননি। শুনে তার অবিশ্বাস্য মনে না হলেও ভেতরে একটা খটকার জন্ম নিল। সন্দিহান চোখে চেয়ে থেকে বলল, “আপনি এত কথা জানলেন কী করে? আপনি তো গ্রামে ছিলেন না।”
“আমি এই মাসেই জেনেছি। আগে টুকটাক জেনেছিলাম তবে খুব একটা গায়ে মাখিনি আর বিশ্বাসও হয়নি। এই কিছুদিন ধরে যখন গ্রামের লোকজন বাবার কাছে এসে রাস্তার জন্য হা-হুতাশ শুরু করল, তখন কিছু কথা বাবার কাছ থেকে জানলাম আর কিছু কথা জানতে হলো, পুরনো সব কাগজপত্র ঘেঁটে। বিশেষ করে, রাস্তার এই ম্যাপটা এই কাজে আমাকে অনেক হেল্প করেছে।”
“সবই বুঝলাম। এখন এই রাস্তা আপনি বের করবেন কী করে? কম চেষ্টা তো করেননি। লাভ তো কিছুই হয়নি। উল্টে আপনি বাবার কেনা গোলাম হয়ে গেলেন।”
জেনিফারের কথায় হেসে উঠল মেহমাদ। বলল, “আপনি দেখেছেন?”
“আমি বাবাকে চিনি, মেহমাদ। ক্ষমতায় থাকার জন্য বাবা সব করতে পারে। আপনার মতো মানুষকেও কিনে ফেলতে পারে।”
“আমাকে কিনে ফেলা এত সহজ?” ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল মেহমাদ।
“আলমারিতে কিছু একটা তুলতে দেখেছি। ওগুলো যে বাবার দেয়া টাকা, সেটা বুঝতে দেরী হয়নি। শেষপর্যন্ত অর্থের লোভে পড়ে গেলেন?”
“আপনি আমাকে চিনেন না, জেনিফার। আমার পেশা, আমার সততা, আমার বিবেকবুদ্ধি কখনওই আমাকে অন্যায় কাজকে সাপোর্ট করতে দেয়নি। আগামীতেও দেবে না।”
সব কথার মাঝে জেনিফার আটকাল একটা কথায়, মেহমাদের পেশা। সে বিস্মিতভাব নিয়ে জানতে চাইল, “কী করেন আপনি? আমি তো আপনাকে বেকার বলেই জানি।”
মুখ লুকিয়ে দাঁত দিয়ে জিভ কাটল মেহমাদ। একটুর জন্য মুখফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছিল সব। জেনিফার যে এত বুদ্ধিমতী বুঝতে পারেনি। সে কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “আমি তো বেকারই। ওটা তো একটা কথার কথা।”
জেনিফার বিশ্বাস করল না। নিঃশব্দে হেসে বলল, “আপনার ফেসবুক পেইজের নাম কি ‘সন অব মোশাররফ হোসেন’ যার নিকনেম মেহমাদ?”
“হুঁ…।”
“এই নাম কেন?”
“এমনিতেই।”
“আপনি তো বলেছিলেন, আপনার নাম ইফতেখার হোসেন। সেই নাম কোনো কাজে লাগে না?”
“সবাই তো মেহমাদ নামেই চিনে।”
“তাহলে ওইদিন কেন পরিচয় দিতে গিয়ে ইফতেখার হোসেন বলেছিলেন?”
“এসব জানা আপনার জন্য জরুরী নয়, জেনিফার।”
“তারপরও জানতে চাইছি।”
মেহমাদ গভীরভাবে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “ভার্সিটির সবাই আমাকে ইফতেখার হোসেন নামেই চিনে, ওই নামেই ডাকে। আমার সার্টিফিকেট, আইডেন্টিটি সবকিছুতে ওই নামই আছে। মেহমাদ কোত্থাও নেই। ওই নামটা মা রেখেছেন আর সবসময় মেহমাদই ডাকেন। এজন্য সবার মুখে এটাই বেশি শোনা যায়।”
মেহমাদের বলা এতগুলো কথা ভীষণই অযৌক্তিক মনে হলো জেনিফারের। সে আর কিছু জানতে না চেয়ে চুপ করে বসে রইল। মেহমাদ কাগজপত্র আলমারিতে তুলে রেখে, ল্যাপটপটা বন্ধ করে, স্টাডিটেবিলের ওপর রেখে রুমের বাতি নিভিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। জেনিফার বিছানায় বসে হাঁটুতে মাথা রেখে একদৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল। মেহমাদ কতক্ষণ আকাশ দেখে সময় কাটালেও পরবর্তীতে রেলিঙে হেলান দিয়ে যখন দরজার দিকে ফিরল, আবছা আলোয় একজোড়া বিস্ময়কর দৃষ্টি দেখে ওখান থেকেই বলল, “ঘুমাচ্ছেন না কেন?”
জেনিফার প্রশ্ন করল, “আপনি ঘুমাবেন না?”
“আমার রাত জাগার অভ্যাস আছে।”
“অকারণ রাত জাগবেন কেন?”
“অকারণ যে জাগব না সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কারণটাও বুঝতে পারছেন!”
বিয়ের রাতের এমন অদ্ভুত বাসরের অভিজ্ঞতা হওয়াতে জেনিফারের প্রচণ্ড হাসি পেল। সে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে হাসতে হাসতে বিছানায় পড়ে লুটোপুটি খেতে লাগল। একসময় পেটের কাছে হাত চেপে জানতে চাইল, “কখনও প্রেম করেননি?”
মেহমাদ চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বলল, “এটা আবার কেমন প্রশ্ন?”
“যেমন আচরণ তেমন প্রশ্ন।”
“আমার আচরণে খারাপ কী দেখলেন?”
“কিছুই না। তবে এইটুকু স্পষ্ট যে, এর আগে কোনো মেয়ে আপনার এত কাছে আসেনি। সম্পর্ক থেকে শুরু করে আপনার বিছানা-বালিশ এমনকি ঘরের প্রতিটা কোণার দখলদারি নেয়া এমনকি আমার উপস্থিতিটাও আপনাকে ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।”
মৃদু আলোর মধ্যেও মেহমাদের নিঃশব্দের ওই হাসিটা চোখে পড়ল জেনিফারের। সে নিজের দিক স্পষ্ট করে বলল, “ভয় নেই, নিজের ওপর যদি আপনার আত্মবিশ্বাস থাকে, এবং নিজেকে যদি আপনি সৎ মনে করেন, তাহলে বিছানার একপাশে এসে ঘুমাতে পারেন। আমার হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। আমি কাউকে বিরক্তও করি না। যেদিকে চোখ বন্ধ করি, সেদিকেই চোখ খুলি। আপনি নিঃসংকোচে বিছানায় আসতে পারেন। এটা আপনার ঘর, আপনার বাড়ি, আপনার সবকিছু। আপনি কেন অযথা নির্ঘুম রাত কাটাবেন? ঘুমান তো। এসব ফিল্মি ফিল্মি সিন আমার ভালো লাগছে না। চোখ জ্বলছে। গুডনাইট।”
কথা শেষ করে মুহূর্তের মধ্যেই গভীরঘুমে ডুবে গেল জেনিফার। মেহমাদ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। কোনো এক অজানা কারণে রুমে আসার সাহস পেল না। তার শুধু মনে হলো, প্রতিটা মেয়েমানুষ বশীকরণ তাবিজের ন্যায় ভীষণই আকর্ষণীয় বস্তু ও প্রবল শক্তিশালী। যেকোনো সময় বিপদে ফেলে দিতে পারে। আগ বাড়িয়ে নিজেকে সে কোনো ধরনের বিপদে ফেলবে না বরং সব ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে অতি সুক্ষ্মভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে।
***
চলবে…
‘গাছের দিকে তাকিয়ে আছো কেন?’
সুনাইরা ঢোক গিলল। নীহারিকা বলেছে, আশেপাশে কেউ আসে কি না, সেটা যেন খেয়াল রাখে। পাকা আম খাওয়ার আনন্দে এটাই ভুলে গিয়েছিল সে। তাহরীমের কণ্ঠস্বর শোনে চমকে গিয়ে বুকে ফুঁ দিল। তখুনি টুপ করে দুটো আম পড়ল ছাদে। তাহরীম অবাক হলো, ঝড়তুফান কিছুই নেই, অথচ আম এসে পড়ল! সে আস্তো দুটো রসালো আম হাতে তুলে নিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আম পড়ল কী করে?’
সন্দিহান চোখে গাছের দিকে তাকিয়ে রইল তাহরীম। কিছুই দেখতে পেল না। তবে নিশ্চিতও হতে পারল না। নীহারিকার গাছে ছড়ার অভ্যাস আছে। বিয়ের পর প্রথমবার যখন গাছে চড়েছিল, পিচ্ছিল গাছ থেকে দড়াম করে পড়ে গিয়েছিল। হাত-পা না ভাঙলেও কোমরে বেশ জখম হয়েছিল। এখনও মাঝেমধ্যে সেই ব্যথাটা তার উপস্থিতি জানান দিলে, ব্যথার যন্ত্রণায় ঘুম হয় না মেয়েটার। তাই সন্দেহ মনে নিয়েই গাছের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখল সে। তাহরীমের ভীরু চাহনি ও প্রশ্ন শোনে সুনাইরা বলল,
‘কাঠবেড়ালী এসেছে বোধহয়।’
‘এই গাছে কাঠবেড়ালী আসে না।’
উপরের দিকে দৃষ্টি দিয়েই বলল তাহরীম। সুনাইরা গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে নীহারিকাকে খুঁজল। মেয়েটা বড্ড চালাক। পরেছে সবুজ জামা। লুকিয়ে সবুজ পাতার ভীড়ে। তাহরীম দেখেও দেখল না। সুনাইরা বলে উঠল,
‘বললেই হলো। গাছে আম আছে আর কাঠবেড়ালী আসবে না, এটাও যেন আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।’
‘আসে না রে বাবা। বিশ্বাস কোরো। এদিকে আর কোনো গাছ নেই। একটাই আমগাছ। কাঠবেড়ালী আসবে কী করে?’
‘আরেহ্, ওসব ছাড়ো। চলো, আম খাই। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ ইয়াম্মি হবে। নীহার বলছিল, এই গাছের আম অনেক টেস্টি।’
তাহরীম ছোটো ছোটো চোখে সুনাইরাকে দেখে বলল,
‘নীহার বলেছিল এই কথা?’
সুনাইরা না বুঝেই উপরনিচ মাথা নাড়ল। আম ফেলে গাছের ডালের দিকে পা বাড়াল তাহরীম। ফটাফট এদিক থেকে ওদিক উঠে ফাঁকফোকরে নীহারিকাকে খুঁজতে শুরু করল। সুনাইরা বলল,
‘তুমি গাছে উঠলে কেন?’
‘নীহার গাছে আছে। স্টুপিড মেয়েটা বিপদ বাড়াবে।’
***
পড়ুন ই-বই ‘ভাঙা মন, বাঁধে ঘর’
https://link.boitoi.com.bd/hDPh
***