জামাই শ্বশুর পর্ব-০৫

0
177

#জামাই_শ্বশুর
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৫

অসুস্থতা ও শারিরীক দুর্বলতার কারণে পরবর্তী দুটো সপ্তাহ বাড়িতেই কাটিয়ে দিল মেহমাদ। প্রয়োজনীয় যত কাজ, সব ফোনে সেরেছে। ওমায়ের আলী এরমধ্যে আর এদিকে আসেননি। তিনি যে ভীষণ চাপে আছেন, সেটা ভেবেই হাসি পায় মেহমাদের। এখনও আসল ধাক্কাটা দেয়নি। খুব শীঘ্রই দিবে। তার আগে তাকে পুরোপুরি সুস্থ হতে হবে। এই দু’সপ্তাহে পিঠের সেলাই শুকিয়ে গেছে। সেটাকে কাটিয়ে এনে এখন নিয়মিত ঔষধ ব্যবহার করছে যেন জোড়ায় ফাঁক সৃষ্টি না হয়। আর এই ক’দিন তাকে পরিপূর্ণ সেবাশুশ্রূষা দিয়ে এসেছে তার নামমাত্র জেনিফার। জ্বরের ঘোরে প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে সেদিন যখন মেহমাদ একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছিল, জেনিফারই তাকে সামলেছিল। ঔষধ খাওয়া থেকে শুরু করে, শরীর মুছিয়ে দেয়া, খাবার খাইয়ে দেয়া, মাথায় পানি ঢেলে দেয়া, সবকিছুই করেছে। এসব কারণে মেহমাদ স্ত্রীর প্রতি যতবেশি কৃতজ্ঞ, ততবেশি চিন্তিতও। এই সম্পর্কটা স্থায়ীভাবে টিকে থাকুক, সেটা জেনিফার চায় না, কিন্তু তবুও কীসের টানে সে তার প্রতি এত যত্নশীল হলো, সময়ে-অসময়ে ভরসায় ন্যায় পাশে থাকল, এসবই তাকে ভাবাচ্ছে বেশি। যতবারই এই ভাবনাগুলো মনে উদয় হচ্ছে, ততবারই চিন্তার ভাঁজ পড়ছে কপালে।

সকালের নাশতা খেয়ে ড্রয়িংরুমে বসে টেলিভিশন দেখতে দেখতে সম্পর্ক ও তার অগ্রগতি নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবনায় ডুবেছিল মেহমাদ। ভাবনা থামল শ্বশুরের ডাকে, “কেমন আছো, জামাই?”

মেহমাদ তাকে সালাম দিয়ে, ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“এইতো আছি একরকম। শুনলাম তুমি অসুস্থ! কী হয়েছিল?”

“তেমন কিছু না। সামান্য জ্বর। এটাকে আবার অসুস্থতা বলে না কি?”

“তা ঠিক। তোমার যা বয়স, এই বয়সে জ্বরের মতো সাধারণ অসুস্থতাকে খুব একটা গায়ে লাগার কথা না।”

“একদমই তাই। আপনার কথা বলুন, এই ক’দিন এদিকে আসেননি কেন? আপনার মেয়ে প্রতিদিন আপনার অপেক্ষায় পথচেয়ে থাকত, এইবুঝি আপনি এসে তাকে চমকে দিলেন। আমি কত বুঝালাম, আপনি ব্যস্ত মানুষ। আমাদের মতো সাধারণ ও বেকার নন যে, যখন-তখন মেয়ের বাড়িতে ছুটে আসবেন। কিন্তু আপনার মেয়ে শুনতে নারাজ। কেঁদেকেটে গালমুখ ভাসিয়ে দিত একদম। দেখতে তখন পাঁচ বছর বয়সী একটা ছোট্ট বাচ্চাই মনে হতো তাকে।”

জেনিফার শাশুড়ি মায়ের সাথে রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিল। কোনোদিন রান্নাঘরে যায়নি, কোনটা কীভাবে রাঁধে, সেটাও জানে না। অথচ এখানে নিজ আগ্রহেই এসব করছে। রেজি সুলতানা তাকে রান্না শিখিয়ে দিচ্ছেন। জেনিফার যে-ই রান্না শিখছে, অনভ্যস্ত হাতে সেটাই চেষ্টা করছে রেঁধেবেড়ে সবাইকে খাওয়ানোর। প্রতিদিন খাবার টেবিলে এখন তার আনাড়িহাতের একটা রান্না থাকেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, সে-ই রান্নায় তেলমশলা বেশি হলেও বাড়ির সবাই-ই অল্প করে মুখে তুলে। আর মেহমাদ পারলে সম্পূর্ণ বাটিটাই ঢেলে দেয় প্লেটে। যেহেতু অখাদ্য না, খাবার উপযোগীই হয়, তাই সেটাকে অপচয় না করেই খেয়ে নেয়। আর জেনিফারও নিজের রান্নার ভুলত্রুটি শিখে শিখে, এখন মোটামুটি দু’একটা আইটেম নিজেই তৈরী করতে পারে। হয়তো একটু এদিক-ওদিক হয়ে যায়, তবুও তার আনন্দ লাগে, আর কিছু না পারলেও রান্নাটা আস্তেধীরে শিখে যাচ্ছে এসব ভেবে।

রান্নার ফাঁকেই মেহমাদের এই কথাগুলো কানে এলো জেনিফারের। সে চোখদুটো বড়ো বড়ো করে ওইদিকে তাকিয়ে রইল। এরমধ্যেই মেহমাদ দুষ্টুমি করে চোখ দিয়ে টিপ্পনী কেটে বউকে ডেকে বলল, “শ্বশুর আব্বাকে কিছু খেতে দিন, জেনিফার। আপনি কফি খুব ভালো বানান। ওটা দিয়েই আপ্যায়ন শুরু করুন।”

ওমায়ের আলী অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন, “জেনিফার রান্না করছে?”

“জি, সারাদিন ঘরে বসে থাকতে তার ভালো লাগে না। তাই মাকে একটু হেল্প করেন আরকি। আপনি ভাবতেও পারবেন না শ্বশুর আব্বা, এই ক’দিনে আপনার মেয়ে এই বাড়ির যোগ্য পুত্রবধূ হয়ে উঠেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে, তার চেষ্টা ও আগ্রহের জন্য।”

“কী বলো! ও তো কোনোদিন রান্নাঘরেই যায়নি।”

“যায়নি বলে এখন যাবে না, এটা ভাবলে তো চলবে না। সময়ের সাথে সাথে মানুষের অভ্যাসেও পরিবর্তন চলে আসে।”

ওমায়ের আলী চিন্তিতমনে বললেন, “আমি আসলে একটা দরকারে এসেছি।”

মেহমাদ ভ্রু কুঁচকে নিয়ে বলল, “কী? আমার চাকরিবাকরি কিছু কি হয়ে গেছে?”

“সেটা পরে দেখা যাবে, জামাই। কিছুদিন ধৈর্য্য ধরো।”

“ওহ, তা দরকারটা কী?”

“আমি জেনিফারকে নিতে এসেছি। মানে কিছুদিনের জন্য অ্যামেরিকা যাব। ওখানে আমার বোন থাকে জানো তো। ওর কাছেই যেতাম।”

ওমায়ের আলীর পরবর্তী প্লান কী, সেটা মুহূর্তের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল মেহমাদের কাছে। সে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল, “কবে যেতে চান?”

“এই মাসের শেষেই যাব।”

মনে মনে হেসে মেহমাদ বলল, “ঠিক আছে, আপনি মেয়ের সাথে কথা বলুন।”

জেনিফার কফি নিয়ে এসে বাবার পাশে বসল। ওমায়ের আলী বললেন, “আমি ক’দিনের জন্য বাইরে যেতে চাইছি। তুইও আমার সাথে চল। তোর ফুপির ওখানে গেলে ভালো লাগবে।”

“ভাই যাবে?” ছোটো ভাই জায়ানের কথা জানতে চাইল জেনিফার।

ওমায়ের আলী বললেন, “হ্যাঁ যাবে তো।”

“তাহলে তুমি ওকে নিয়েই যাও। আমি এখন কোথাও যাব না।”

“কেন?”

“আমার ইচ্ছে নেই।”

“সেটা কী করে হয়! তোকে ছাড়া আমি যেতে পারব না।”

“কেন? ক’দিনের জন্যই তো যাচ্ছ।”

“তুই বুঝতে পারছিস না, জেনি। তোকে সাথে না নিলে তোর ফুপি রাগ করবে। কষ্ট পাবে।”

জেনিফার একটু রেগে গিয়ে বলল, “যখন যা বলেছ, করেছি। যাকে বিয়ে করতে বলেছ, করেছি। আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য দাওনি তুমি। আমি এখন বিবাহিতা। তোমার মেয়ে নই যে, এখনও তোমার সব কথা শোনে চলব। এখন আমাকে একটু আমার মতো বাঁচতে দাও।”

“এসব কী ধরনের কথা, জেনি?”

“তোমার হয়তো খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত এটাই। আমি এখন কোথাও যাব না।”

জেনিফার উঠে আবারও রান্নাঘরে চলে গেল। ওমায়ের আলী চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই ক’দিনের মধ্যে মেহমাদ কীভাবে তার মেয়েকে বশ করে নিল! কিছুই তো বুঝতে পারছেন না। আবার মেহমাদও রাস্তা নিয়ে কোনো কথা বলছে না। একেবারে ঠাণ্ডা মেরে বসে আছে। যেন ওই রাস্তা নিয়ে ওর আর মাথাব্যথা নেই। অথচ এই ছেলেটাই কিছুদিন ধরে রাস্তা নিয়ে মারাত্মক পেরেশানিতে ফেলেছিল তাকে। তিনি ঠোঁট কামড়ে একাধারে ভেবে গেলেন কিছু একটা। এরপর মেহমাদকে বললেন, “বিয়ের পর তোমরা তো কোথাও হানিমুনে যাওনি। কোথায় যাবে? যেখানেই যাও, হানিমুনের সব খরচ আমার। তোমাকে টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

মেহমাদ বিটলামি করে বলল, “আমাদের হানিমুন আর কোথায়? নদীরপাড়ে। ওখানে যেতে টিকেট-পাসপোর্ট কিছুই লাগবে না। শুধু হাঁটার জন্য শরীরে একটু অ্যানার্জি লাগবে। আর লাগবে মাঝিকে দেয়ার জন্য অল্পকিছু টিপস্‌। সেটা আমার পকেটের টাকাতেই হয়ে যাবে। ব্যাপার না।”

“কী বলো? হানিমুনে যাবে না?”

“যাব না বলিনি, নদীরপাড়ে যাব বলেছি।”

“নদীরপাড়ে কেউ হানিমুন করে? টাকা-পয়সার অভাবে তোমার মাথা একেবারে গেছে।”

“কী করব শ্বশুর আব্বা? বেকার যে। আমাদের হানিমুনের জন্য নদীরপাড়ই উপযুক্ত জায়গা। বেকার জামাই আপনার ইজ্জত ডুবাবে এখন। চিন্তা করবেন না। বাবার পেশার বদৌলতে আপনার ডুবে যাওয়া ইজ্জতও বেঁচে যাবে।”

ওমায়ের আলী এক হাজার টাকার পাঁচটা বান্ডিল জামাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এগুলো রাখো, তা-ও নদীরপাড়ে যেয়ো না। এই টাকা দিয়ে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসো।”

“টাকা লাগবে না, শ্বশুর আব্বা। আমরা নদীরপাড়েই যাব। ডিসিশন ফাইনাল।”

এরপর একটু চিৎকার দিয়ে বকুলকে ডেকে বলল, “এ্যাই বকুল, তোমার ভাবীকে রেডি হতে বলো তো। ঘুরতে যাব। ঘরে বসে থেকে হাত-পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে।”

ওমায়ের আলী হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। মেহমাদ বলল, “শ্বশুর আব্বা, আপনি বসুন। বাবা মনে হয় জরুরী কাজে বাইরে গিয়েছেন। ফিরে আসবেন এখুনি। বাবা এলে, যতক্ষণ খুশি আড্ডা দিতে পারেন। আমি এখন যাই। নদীরপাড়ে হানিমুনে যেতে হবে।”

***

শাশুড়ি মায়ের অনুরোধ ও বকুলের জোরাজুরিতে চমৎকার একটা জলপাই রঙের জামদানী শাড়ি পরেছে জেনিফার। বিয়ের পর থেকে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। সারাদিন ঘরে বসে থাকতে গিয়ে মন-মেজারেরও বারোটা বেজে গেছে। তারমধ্যে মেহমাদ এক আজিব বান্দা। ঘর-সংসার নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই একটুও। ভালোমন্দ কথার বাইরে কখনওই বাড়তি কোনো কথা বলে না। সমস্যার সমাধান কতটুকু হলো, সেটাও প্রকাশ করছে না। কী যে করে দিনরাত, সেটা নিয়েই জেনিফারের যত চিন্তা ও ভয়।

আজ হঠাৎ করে নদীরপাড়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা শোনে যেমন অবাক হলো, তেমনই হাসিও পেল। কেন যে তার বাবাকে এই ছেলে এত খোঁচাচ্ছে সেটা বুঝতে না পেরে মনের মধ্যে কৌতূহলও জন্মাল। তবুও কাউকে কোনো প্রশ্ন করল না। সম্পূর্ণ তৈরী হয়ে খোঁপায় একটা বেলিফুলের গাঁজরা দিল। বকুলই সব ঠিকঠাক করে দিয়েছে। নিজ হাতে গাঁজরা বানিয়ে দিয়েছে। ফুলের ঘ্রাণ ও সৌন্দর্যে সবটুকু মন খারাপ দূরে পালিয়ে গেছে তার। সাজগোজ শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল, সবকিছু পারফেক্ট কি না।

এমন সময় মেহমাদও কালো ও সাদা রঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বকুলকে বলল, “বকুল, তুমি বৈঠা টানতে পারো?”

বকুল জেনিফারের শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক হয়েছে কি না সেটা একনজরে দেখে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, পারি তো।”

“ঠিক আছে, তাহলে আর মাঝি লাগবে না। তোমার ভাবীকে মাঝখানে রেখে আমরা দুইজন দু’দিক থেকে বৈঠা টানব। এরপর মাঝনদীতে গিয়ে একধাক্কায় তাকে ওখানে ফেলে চলে আসব। ভালো হবে না?”

বকুল হাসতে হাসতে বলল, “ভাইজান, আপনি প্রচুর দুষ্টু আছেন। দেখলে মনেই হয় না।”

“কেন? দেখলে কী মনে হয়?”

বকুল উত্তর না দিয়ে হাসল। এদিকে জেনিফার রেগেমেগে অ্যাটোমব্যোম হয়ে গেছে। সে নাকে আঙুল ঘষে কোমরে হাত চেপে বলল, “ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে না বলে সরাসরি বলুন যে, আপনার আমাকে বোঝা মনে হচ্ছে। একমাসও হয়নি, অথচ এখুনি আপনি হয়রান হয়ে গেছেন। যে একজন নারীকে সামাল দিতে হিমশিম খায়, সে কী করে গ্রামবাসীকে সাহায্য করবে? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে।”

এরপর বকুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোন বকুল, গ্রামের মানুষকে বুঝা, এখনও সময় আছে। তাদেরকে বল, এই ছেলের কথাবার্তাকে গুরুত্ব না দিতে। কোনদিন সবাইকে ঠেঙিয়ে সে একাই গ্রামের সবকিছু দখল করে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবে।”

বকুল হেসে বলল, “আরেহ্‌ না, ভাইজান এসব করবেন না।”

“হ্যাঁ তোকে বলেছে। সে আমাকে নৌকা থেকে ফেলে দিবে আর গ্রামের সবাইকে মাথায় তুলে নাচবে। দেখিস, একদিন ঠিকই এই ছেলের কাজকর্মের জন্য তোদের পস্তাতে হবে।”

“আচ্ছা, সময় এলে পস্তাব। এখন আসেন, দেরী হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যে হয়ে গেলে অন্ধকারে নদীর সৌন্দর্য ঠিকঠাক উপলব্ধি হবে না।”

নিজের বাবা ও শ্বশুরকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে মেহমাদ সত্যি সত্যিই নদীরপাড়ে ঘুরতে চলে গেল। ওমায়ের আলী আহাম্মক বনে ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন। জীবনে এত কিপটা মানুষ তিনি কয়টা দেখেছেন, হিসেব করে কুলিয়ে উঠতে পারলেন না। শুধু উপলব্ধি করলেন, মেহমাদকে জামাই বানিয়ে চরম ভুল করেছেন। একে তো বেকার, তারউপর কিপটা, টাকা-পয়সা খরচ করতেই চায় না। কী মুশকিল হলো এটা!

নদীরপাড়ে এসে কাদামাটি ঠেলে কাঠের সিঁড় বেয়ে নৌকায় উঠতে গিয়ে বিপদে পড়ল জেনিফার। এমনিতেই এসবে অভিজ্ঞতা নেই, তারমধ্যে জেদ দেখিয়ে মেহমাদের বাড়িয়ে রাখা হাতটাও ধরল। ছলাৎছলাৎ পানির শব্দে নৌকা দোলে উঠলে, ব্যালেন্স রাখতে দু’হাতে মেহমাদকে খামচে ধরল সে। ভয়ে চিৎকার দিল, “ইয়া আল্লাহ, আমি নদীতে পড়ে যাব বোধহয়। এটা এত নড়ছে কেন?”

মেহমাদ তাকে অভয় দিয়ে আগে দু’হাতে কাঁধ চেপে ধরল, এরপর সাবধানে পাটাতনে বসিয়ে, বৈঠা হাতে নিল। দীর্ঘসময় ধরে শহরে বসবাস বিধায়, কখনওই গ্রামের এই পরিবেশ ও সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় হয়নি তার। আগে যতদিন গ্রামে আসত, বাড়িতেই থাকত। কোথাও ঘুরতে বের হতো না। এজন্য হুট করে নৌকায় উঠে প্রথমে যেমন ভয় লাগছিল, মাঝনদীতে এসে স্বচ্ছ পানির বুকে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য ও নদীরপাড়ের সম্পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে সব ভয়-ডর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। জেনিফার পা ছড়িয়ে পাটাতনেই মাথা হেলিয়ে দিয়ে দূরের ওই নীল আকাশ ও নির্ভয়ে উড়ে বেড়ানো পাখিদের দেখতে দেখতে চোখবুঁজে নিশ্চুপ হয়ে থাকল।

কতক্ষণ নদীর বুকে ভেসে থাকতে থাকতে হঠাৎই চোখ মেলল জেনিফার। নৌকায় বকুলকে না দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ভীতিগ্রস্ত চাহনি থেকে জানতে চাইল, “বকুল কোথায়?”

মেহমাদ বৈঠা টানতে টানতে উত্তর দিল, “পাড়েই আছে।”

“কেন? পাড়ে কেন থাকবে?”

“ও আমাদের স্পেস দিল।”

এ কথা শোনে জেনিফার রেগেমেগে বলল, “কেন? আমরা স্পেস নিয়ে কী করব?”

“হানিমুনে কেন আসে মানুষ? কেন স্পেস লাগে? এগুলো এখন আমি আপনাকে হাতেকলমে শেখাব?”

মেহমাদের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জা ও রাগ দু’য়ে মিলে জেনিফার ক্ষুব্ধ মেজাজে বলল, “আপনি একটা অসভ্য পুরুষ।”

মেহমাদ ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রেখে বলল, “অসভ্যতামির কী দেখলেন? এখন পর্যন্ত আমি আমার কথার নড়চড় করিনি। আপনিই সুযোগ নিচ্ছেন। আমার সেবা করার অজুহাতে একদম কাছে এসে যাচ্ছেন।”

জেনিফার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, “কী? আমি সুযোগ নিচ্ছি? এটা বলতে পারলেন আপনি? কোথায়, উপকারের বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবেন, তা না করে আপনি আমাকে সুযোগসন্ধানী বানিয়ে ছাড়লেন! ইয়া আল্লাহ, আমি কার পিছনে এত শ্রম দিলাম! আমার তো ভাবতেই খারাপ লাগছে। আপনার চিন্তাভাবনা এত নীচ! এত জঘন্য।”

অপমানটা ঠিক সহ্য হলো না জেনিফারের। একাধারে বকাঝকা করে ঠোঁটে একটা বিদ্রুপ হাসি ঝুলিয়ে বলল, “নৌকা পাড়ে ভিড়ান। আমি ঘরে যাব।”

“কেন? হানিমুন কি মনমতো হয়নি?”

জেনিফার আগুনগরম চোখে তাকিয়ে বলল, “যা বলছি, তা করুন। নয়তো আমি এক্ষুণি পানিতে ঝাঁপ দিব।”

হঠাৎ করে জেনিফারের এই রাগ ঠিক বুঝে এলো না মেহমাদের। তবে এইটুকু নিশ্চিত হয়ে গেল যে, তার সামনে বসে থাকা রমণী খেপে গেছে। সে তড়িঘড়ি নৌকা পাড়ে ভিড়াতেই জেনিফার একলাফে নৌকা থেকে নেমে, কাদামাটিতে ভরপুর রাস্তায় এলোমেলো পা ফেলে বাড়ির দিকে রওনা দিল। মেহমাদ নৌকাটা ঘাটে বেঁধে রেখে, মাঝিকে কিছু টিপস্‌ দিয়ে পায়জামার পকেটে হাত গুঁজে জেনিফারের পিছন পিছন এগোলো। ঠোঁটের কোণে চোরা হাসি লুকিয়ে রেখে বিড়বিড়াল, “আশ্চর্য! শ্বশুর আব্বার মেয়ে হুট করে এত অভিমানী হয়ে গেল কেন?”

***

চলবে…

রুয়েল হাতে-পায়ে ধরে মাফ চেয়ে বলল, “তোকে ছুঁয়ে বলছি ভাই। ছেড়ে দে।”

ইয়াশ রাগ সামলাতে না পেরে বলল, “স্কুল জীবনে অনেক মারামারি করেছি। মার খেয়ে নয়, মেরে অর্ধমৃত বানিয়ে ফেরার একশোটা রেকর্ড আছে আমার। মনে আছে, ভার্সিটিতে একবার এক ছেলে সখীর সাথে টিজ করেছিল দেখে ওই ছেলেটার হাত আমি ভেঙে দিয়েছিলাম, আজও চাইলেই সেই একই কাজটা করতে পারতাম। কিন্তু আফসোস আমি পারছি না। কারণ, অনেকগুলো দিন একসাথে পথ চলেছি বলে সম্পর্কের প্রতি সম্মানটাকে আমি এখনও বাঁচিয়ে রেখেছি। আমাকে রাগানোর ফল কিন্তু মোটেও ভালো হবে না। নেক্সট টাইম এমন করলে, সোজা স্বর্গের টিকিট হাতে ধরিয়ে দিব। বাবা-চাচা-খালু কোনোদিকই দেখব না।”

***

* পড়ুন ই-বই ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়’
https://link.boitoi.com.bd/CWHp

***