প্রাসাদকথন পর্ব-১২

0
76

#প্রাসাদকথন
পর্বঃ১২
#সুলতানা_তানি

সময়ের বহমান ধারায় বয়ে গেছে কয়েকদিন। রাকিন-নওরার গোপন পত্রপ্রেম চলছে সঙ্গোপনেই। এই কয়েকদিনে আরশান বেশ কয়েকটি পত্র প্রেরণ করেছে নওশাদকে। আরশান প্রভাতকালেই পাঠিয়েছে সকল পত্র। এই সময়টায় নওশাদ নিদ্রিত থাকে। তাই সব পত্রই নেহেরিন আর নওরার হস্তগত হয়েছে। প্রতিটি পায়রাই আহত হয়েছে গুলতির মাধ্যমে নিক্ষিপ্ত পাথরে। ভূপাতিত করে চিরকুট তো হস্তগত করা হয়েছেই, আহত পায়রাগুলোও আর ফিরে যেতে পারে নি। তারপরেও আরশান প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাতেই মগ্ন রয়েছে। আজকের এই প্রভাতেও একটি চিরকুট এসেছে গোপনে। নেহেরিন নিজ কক্ষের বারান্দা থেকে গুলতির মাধ্যমে পাথর ছুঁড়েছে। চিরকুট পতিত হচ্ছে নিচে। নেহেরিন দৌড়ে গিয়ে চিরকুট এনে নওরাকে দিয়েছে চুপিসারে। বোনকে বার্তা পৌঁছে দিয়ে নেহেরিন প্রস্থানরত। আলতো হাতে নওরা চিরকুট খুলেছে চিন্তিত ভঙ্গিতে।

শাহ্জাদা নওশাদ,

সশ্রদ্ধ সালাম। কেন জবাব দিচ্ছেন না আমার চিঠির? শাহ্জাদা রাকিন আপনার বাগদত্তার সাথে গোপন সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়েছে। দুশমনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়াই তো উচিত আপনার! আমারও চির দুশমন এই একজনই। আমার নিজস্ব শক্তি খুব কম। এ সম্ভার রাজ্যের সৈন্যরা আমার নির্দেশে কখনোই রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না। আজন্ম মসনদে আরোহনের আকাঙ্ক্ষা আমার! আপনি সৈন্য দিয়ে সহায়তা করলে আমি সম্ভার রাজ সিংহাসন দখল করবো। রাজার সহিত রাজপুত্রদেরকেও নিঃশেষ করে দেবো। আর রাকিন তো আমাদের দুজনেরই দুশমন। আশা করি এই দুশমন দমনে আপনি উদ্যোগী হবেন। আমায় সহায়তা করে নিজের পথের কাঁটা দূর করবেন!
ইতি,
শাহ্জাদা আরশান
সম্ভার রাজ্য

আরশানের পত্র নিয়ে সোজা নেহেরিনের কক্ষে চলে এসেছে নওরা। চরম উৎকণ্ঠিত ভঙ্গিতে মলিন বদনে বড়বোনকে দেখিয়েছে পত্রটি। নেহেরিন পত্রপাঠ শেষ করতেই নওরা চিন্তিত বদনে বলছে–“নেহেরিন আপু, আমার মহব্বতের ঘটনা জানতে পারলে নওশাদ ভাই কিন্তু শাহ্জাদা রাকিনের উপর ক্ষিপ্ত হবে। উনি গোপনে আরশানকে সাহায্যও করতে পারে। আরশান যদি কোনোভাবে সিংহাসনে আরোহণ করে তবে শুধু রাকিনকেই হ’ত্যা করবে না, তাসকিন ভাইকেও তো হ’ত্যা করবে। নাবিহা আপুর জীবনটাও কিন্তু তছনছ করে দেবে!”

নেহেরিন দৃঢ় কণ্ঠে সমঝদারের ভঙ্গিতে বোনকে বলছে–“শোন নওরা, রাজতন্ত্রে আপন ভাইও অনেক সময় সিংহাসনের আশায় মুকুট রাজকুমারকে হ’ত্যা করে। এখানে আরশান তো ওদের সৎ ভাই। যেকোনো ঘটনাই ও ঘটাতে পারে!”

“জ্বী আপু।”

” রাজা,রাজ্য,রাজনীতিতে আপন বলতে কেউ থাকে না রে! সবাই ক্ষমতার কা’ঙাল হয়, ক্ষমতাই সবচেয়ে আরাধ্য বিষয় এক্ষেত্রে। তুই এখনই ঘটনা জানিয়ে রাকিনকে চিঠি পাঠিয়ে দে।”

“এতো বড় একটা ইস্যু চিরকুটে লিখে পাঠানো উচিত হবে না নেহেরিন আপু!”

“তুই রাকিনকে চিঠি পাঠিয়ে তোর সাথে সাক্ষাতের অনুরোধ কর।”

বোনের পরামর্শ নিয়ে নওরা তৎক্ষণাৎ নিজ কক্ষে ফিরে এসেছে। আজ আর সুখের প্রেমলহরী নেই হৃদয়ে। সীমাহীন বিষণ্ণতায় বিধ্বস্ত তার হৃদয়। দ্রুত হস্তে কালি দিয়ে লিখেছে–

শাহ্জাদা রাকিন,

আজ লিখতে গিয়ে হাত থমকে যাচ্ছে। ভাবতে গিয়ে ভাষারা ছন্দ হারাচ্ছে। কল্পনারাও আজ আমার সঙ্গ ছেড়েছে। আর রঙিন স্বপ্নগুলো তো রঙই হারিয়েছে! তাই আজ আর লিখলাম না রঙিন কিছু। তবে এক আবদার রয়েছে আমার। হোক না আজ আবার মোলাকাত! এ মোলাকাতের যে ভীষণ প্রয়োজন!
ইতি,
আপনার মেহবুবা,
নওরা নানজিবা

…………….
প্রগাঢ় আঁধার নিয়ে নিস্তব্ধ নিশি পেরিয়ে যাচ্ছে। নিশির শিশির টুপটাপ ঝরছে। কুয়াশা যেনো পর্দা হয়ে সম্মুখের সবকিছু আড়াল করে রেখেছে। লোকালয়েও কোনো আওয়াজ নেই। নেই কোনো পাখ-পাখালির কলরবও। পুরো বাহার রাজ্য হয়তো মায়া নিদ্রায় মগ্ন। এ যেনো এক মায়াপুরী। শুধু নিদ নেই নওরার স্বপ্নঘেরা দু’নয়নে। দুজন দাসীকে সঙ্গী করে আজও দাসীর বেশেই বসে রয়েছে শাহ্জাদী। কখন প্রাণপুরুষ রাকিন আসবে! আর কখনই বা মোলাকাত করবে! আরশানের চিরকুট যে রাকিনকে দেখাতেই হবে! যদি সম্ভার রাজ্যে সত্যিই আরশান কোনো ঝামেলা করে! যদি সত্যিই রাজ্য দখল করে রাকিনদেরকে হ’ত্যা করে! দুশ্চিন্তাগুলো তীরের মতো বি’দ্ধ করছে শাহ্জাদীর বক্ষকে। হৃদয়টা ছিঁ’ড়ে যাবার উপক্রম। আচানক এক মধুর বাঁশির সুর ভেসে এলো বাতাসে। প্রিয়তম রাকিনের বাঁশির সুর ছুঁয়ে দিচ্ছে হৃদয়কে। এ বাঁশির সুর তো বৃষ্টির সুরের মতোই ছন্দময়। মনটাও ময়ূরীর মতো নেচে এখনই প্রাসাদ ছাড়তে চায়। বড়বোন নেহেরিনকে সব অবগত করে প্রাসাদ ত্যাগ করছে নওরা। ভীরু ভীরু মনে ধীর কদমে দাসীদের সঙ্গী করে রাজতোরণ পার হচ্ছে। দাসীর বেশেই রয়েছে রাজকুমারী। তবুও আজ যেনো বুক ধড়ফড় করছে অজানা কোনো ভয়ে। রাকিনও অপেক্ষমান রয়েছে সস্থানেই। খানিক হেঁটে নওরা সহজেই চলে এসেছে শাহ্জাদার নিকটে। শাহ্জাদা ফি’সফি’সিয়ে বলছে–“ওঠো..ওঠো, ঘোড়ায় ওঠো।”

শাহ্জাদী একবার ভীরু নয়নে পশ্চাতে চেয়ে অশ্বারোহী হয়েছে প্রেমিকের সাথে। রাজ অশ্ব এটি, ছুটছেও যেনো দুর্বার ঐশ্বরিক গতিতে। নওশাদকে প্রেরিত আরশানের চিরকুটটি রয়েছে শাহ্জাদীর বোরকার পকেটে। বন,জঙ্গলে ঘেরা মেঠো পথ পেরিয়ে প্রণয় নদের তীরে চলে এসেছে ঘোড়া। আজও একটি ডিঙি নৌকা প্রস্তুত রয়েছে তীরের নিকটে। রাজতরীও রয়েছে রাজকীয় বেশেই। তবে কাছে নয়, খানিক দূরে। ধীর পায়ে নৌকায় উঠে গেছে দুজন সন্তর্পণে। প্রণয় নদ যেনো শীতে শীতার্ত হয়ে রয়েছে। ছলছল করছে না জল, নেই কোনো কুলুকুলু ধ্বনিও। বড় প্রশান্ত আর ভীষণ নিস্তরঙ্গ আজ নদটি। রাকিন বৈঠা চালাচ্ছে নিস্তরঙ্গ নদের জল কে’টে কে’টে। তীর থেকে একটু দূরে গিয়ে বৈঠা তুলে নিয়েছে শাহ্জাদা। নায়ে ভেসে মহব্বতের বার্তা দিতে চায় নীরবে। মৃদু হেসে রাকিন পাশে এসে বসেছে শাহ্জাদীর। আঁধারে মিলিয়ে গেছে সে হাসি। শাহ্জাদীর নয়নগোচরও হয় নি। বোরকার পকেট চিঠি নিয়ে বিনীত হাতে শাহ্জাদাকে দিয়েছে নওরা।প্রেমাসক্ত নয়নে প্রেয়সীর বদনে চেয়ে রাকিন প্রশ্ন করেছে–“কার চিঠি এটা?”

“আপনার সৎ ভাই আরশানের!”

“আরশান আবারও চিঠি পাঠিয়েছে?”–অবাকের সুরে বিরক্তির সাথে প্রশ্ন করেছে রাকিন।

” জ্বী।”

শাহ্জাদার অমলিন বদনে মালিন্য এসেছে নিমিষেই। এই নিশির আঁধারে পত্রপাঠও করা যায় না। নওরা ভারী কণ্ঠে ধীরে ধীরে চিঠির বিষয়গুলো জানিয়েছে শাহ্জাদাকে। সব শুনে ভীষণ ক্ষু’ব্ধ,ক্রু’দ্ধ রাকিন। ভারী কণ্ঠে আফসোসের সুরে নওরাকে জানাচ্ছে–“জানো, সব দোষ আমার আব্বার। তার কারণেই শাসন করা যায় না আরশানকে। কিছু বলতে গেলেই আব্বা প্রতিবাদী হয়। উল্টো আমাদেরকে বলে তোদের একজনই তো সৎ ভাই, বয়সেও ছোট। ওর সাথে মিলেমিশে থাকার দায়িত্বটাও তোদেরই।”

“আরশান কি অনেক ছোট আপনাদের যমজ দু’জনের চেয়ে?”

“না, আমাদের দুজনের চেয়ে বছর দেড়েকেরও কম ছোট আরশান। কিন্তু এটুকু ছোট হওয়ার অজুহাতেই আব্বা বারবার ওকে ক্ষমা করে দিয়েছে!”

“এবার তো আপনার আব্বাকেও বন্দী করতে চায়। এবার যেনো আর ক্ষমা না করে!”

কথা শেষ হবার পূর্বেই বিশাল একটি কুমির মস্তবড় গ্রাস তুলে কা’মড়ে নিতে চেয়েছিলো শাহ্জাদীকে। শাহ্জাদী বসেছিলো নৌকার প্রান্ত ঘেঁষে। প্রেয়সীকে টান দিয়ে নৌকার ভেতরে শুয়ে পড়েছে রাকিন। কুমিরটি আবারও গ্রাস তুলে লাফ দিয়েছিলো। কিন্তু ওরা দুজন নৌকার পাটাতনে শায়িত হওয়ায় কুমির আর নাগাল পায় নি। তবে ফিরেও যায় নি এ হিংস্র প্রাণীটি। ক্ষিপ্রগতিতে ঘোরাফেরা করছে নৌকার ধার ঘেঁষে। ওরা দুজনও পাশাপাশি শায়িত রয়েছে প্রণয় নদের এ প্রণয় তরীতে। রাকিন ধীরে ধীরে ফি’স’ফিসিয়ে বলছে–“এভাবে আমরণ থাকতে চাই পাশাপাশি। ”

“আগে আপনার রাজতরীর লোকদেরকে ডেকে কুমিরটাকে তাড়িয়ে দিন না! তারপর পাশে থাকার কথা চিন্তা করা যাবে! আমার কিন্তু ভীষণ ভয় লাগছে!”–ভীত কণ্ঠে দুর্বিনীত ভঙ্গিতে বলেছে নওরা।

“কোনো ভয় নেই। আমি আছি তো! রাজতরী থেকে লোকজন চলে এলে আমাদের আর মহব্বতের আলাপ হবে না।”
“রাখুন আপনার মহব্বতের আলাপ। আমার যে কি ভয় লাগছে!”

“আরে ধুর! রাজকন্যারা বুঝি এমন ভীতু হয়!”–কুমিরকে প্রতিহত করতে সাথে থাকা তরবারি খোলস থেকে বের করতে করতে জবাব দিয়েছে শাহ্জাদা।

ভীতু শব্দটা শাহ্জাদীর আত্মসম্মানে যেনো সূচের মতো বিঁধলো। সশস্ত্র রাকিন তো ভরসাই দিচ্ছে। শাহ্জাদীও আর নিরর্থক কথা বাড়ায় নি। রাকিন শীতল কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলছে–“আমাদের শাদী হয়ে গেলে আমরা মাঝে মাঝে প্রণয় নদে রাত কা’টাবো। হয়তো এভাবেই ডিঙি নৌকায় শুয়ে।”

“এমন আঁধার ভালো লাগবে আপনার?”
“কে বললো আঁধার! তুমি তো চাঁদ হয়ে আমার পাশেই রবে। আলোকিত করবে না আমায়!”
“যদি আঁধারে হারিয়ে যাই নদের স্রোতে?”

“জীবনের শুরুতে মা’কে হারিয়েছি। স্নেহ,ভালোবাসা কিছুই পাই নি এ জীবনসফরে। তোমায় পেয়েও হারাতে চাই না। আল্লাহ্ আমার এ ভালোবাসা নিশ্চয়ই কেড়ে নিবেন না!”–ভারী কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিয়েছে শাহ্জাদা।

“তাহলে ওসব দুঃসাহসী চিন্তা বাদ দিন। শাদী করে আপনার এ বেগমকে নিয়ে প্রাসাদেই থাকবেন। প্রণয় নদে এসে রাত কা’টাতে হবে না।”
“কা’টাবো। তবে ডিঙি নৌকায় নয়, রাজতরীতে।”
“সেটা মন্দ হবে না।”
“বধূ নিয়ে মধুচন্দ্রিমার সময়টা কিন্তু সাগরেই কা’টাবো।”

“বেশ!”

এমন মধুর প্রণয়ালাপের প্রহর সাঙ্গ করতে চায় শাহ্জাদা। তড়িঘড়ি করে উঠে আদেশের সুরে শাহ্জাদীকে বলেছে–“এবার ওঠো! কুমিরের আওয়াজ নেই কোথাও। তোমাকে এখন প্রাসাদে পৌঁছে দিয়ে আসবো।”
“এখনই?”
“হুম। সেদিন তো তোমার মা আর দাদীর কাছে ধরা পড়ে গিয়েছো। তোমাকে হয়তো ওনারা নজরদারিতেই রেখেছেন। আজ রাতেও খোঁজ করতে পারে।”

“এতো চিন্তা!”
“হুম। বিশ্বাস করো,তুমি না ডাকলে আজ আমি আসতামই না। একসাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর চিন্তা করেছিলাম।”

আলাপ থেমে গেছে তীরে ফিরে যাবার অভিপ্রায়ে। দাঁড় বেয়ে নৌকা তীরের কাছে নিয়ে এসেছে শাহ্জাদা। নিজে লাফ দিয়ে নেমেছে প্রথমে। শাহ্জাদী নামার পূর্বেই কিছু একটা লাফ দিলো নৌকার ধার ঘেঁষে। আচানক ভয়ে ভীত শাহ্জাদী শুয়ে পড়েছে নৌকায়। রাকিন মৃদু হেসে বলছে–“রাজকন্যার এতো ভয় থাকলে হয়!”

“এটা কুমির ছিলো না তো?”–আতঙ্কিত কণ্ঠে নৌকায় শুয়ে থেকেই প্রশ্ন করেছে নওরা।

“আরেহ্ না। এটা পাঙ্গাস মাছ ছিলো। তুমি চলে এসো তো!”

নওরা উঠে বসেছে জবাব শুনে। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলছে–“কুমিরও তো হতে পারে! আমার না ভয় লাগছে!”

“এতো ভয় কেন বলো তো? আমি আছি না!”
“আমি নামবোই না এখন নৌকা থেকে!”

“এ্যাই মেয়ে, এতো ঢং কইরো না তো!”

“আপনার কাছে ঢং মনে হলো!”
“তাহলে নামছেন না কেন আপনি? আমার কোলে চড়ে নামার বাহানা করছেন নাকি?”
“ধুর! কি যে বলেন!”

রাকিন তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গেছে নৌকার কাছে। নওরা উৎকণ্ঠার সহিত চিৎকার করে বলছে–“আরেহ্,আইসেন না! আইসেন না! ঐটা কুমিরও হতে পারে!”

রাকিন কর্ণপাত না করে নি শাহ্জাদীর বারণে। আচানক কোলে তুলে শাহ্জাদীকে নিয়ে এনেছে নৌকা থেকে। এ যেনো এক লাজনম্র ঘোরের সুখপিয়াসী অনুভূতি। মনটা প্রজাপতির মতো হয়ে ঝিলমিল ডানায় উড়ে যেতে চায়। উড়ু উড়ু খুশিতে শাহ্জাদী আঁখি পল্লব বন্ধ করে রেখেছে লাজে। রাকিন ফি’সফিসিয়ে বলছে–“কি ব্যাপার! আজ কিছু বলছেন না যে! আরো কিছুক্ষণ কোলে থাকতে চান নাকি!”

“আপনি না ভীষণ দুষ্ট! নামিয়ে দিন আমায়!”

“বাহানা করেই যখন কোলে উঠেছেন, থাকুন না আরো কিছুক্ষণ!”

“বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!”

“আহ্হা, আমি কোলে করে ঘোড়ায় বসিয়ে দিতে চেয়েছি একসাথে! রাতভর আটার বস্তা কোলে রাখার কোনো শখই নেই আমার!”–কথাটা শেষ করেই শাহ্জদীকে ঘোড়ায় বসিয়ে দিয়েছে রাকিন।
” কি আমি আটার বস্তা?'”

“নাহ্, আপনি একটা চাউলের বস্তা।”

“ধুর!”

হালকা লম্ফ দিয়ে রাকিন নিজেও আরোহণ করেছে ঘোড়ায়। শক্ত হাতে ঘোড়া ছুটিয়েছে সে দুর্বার গতিতে। আঁধার আর কুয়াশার চাদর কে’টে কিছুক্ষণ পরেই ওরা ফিরে এসেছে বাহার রাজপ্রাসাদের নিকটে। দাসীপাড়া আর প্রাসাদের মধ্যবর্তী জায়গা এটা। দাসীরাও হয়তো খানিক দূরেই রয়েছে। প্রগাঢ় আঁধার আর কুয়াশায় দেখা যাচ্ছে না দাসীদেরকে। ওরা দুজনই নেমে গেছে ঘোড়া থেকে। কাছে এসে আলতো করে শাহ্জাদা আলিঙ্গন করেছে প্রেয়সীকে। এমন মধুক্ষণে আচানক ডেকে উঠলো রাজ ঘোড়াটি। সেদিকে কর্ণপাত করে নি রাজপুত্র। প্রেয়সীর কপালে চু’মু খেয়ে ভারী কণ্ঠে বলেছে –“সাবধানে থেকো! আবার কবে দেখা হয় জানি না। ভালো-মন্দ জানিয়ে দিও।”

প্রেয়সীকে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে হাত ধরে এগিয়েছে সম্মুখে। দাসীপাড়ার সম্মুখেই তিনজন দাসী চুপিচুপি অপেক্ষা করছিলো। দাসীদেরকে দেখে শাহ্জাদা তৎক্ষণাৎ সরে গেছে পশ্চাতে। দ্রুতগতিতে এসে অশ্বারোহী হয়েছে সে। নওরা মলিন বদনে একবার তাকিয়েছিলো মেহবুবের পানে। অশ্বারোহণ করে চুপটি করে বসে রয়েছে শাহ্জাদা। নওরার প্রাসাদ গমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়। পাছে যদি কোনো বিপদ হয়ে যায় তার প্রেয়সীর! হাত নেড়ে শাহ্জাদী বিদায় জানিয়েছে প্রাণপুরুষকে। তারপরে শুরু হলো প্রাসাদ পানে যাত্রা। আঁধারে মিলিয়ে গেছে শাহ্জাদী, রাকিনের দু’চোখ আর খুঁজে পাচ্ছে না প্রেয়সীকে। হয়তো কোনো বিপদ হয় নি, এমনটা ভেবেই রাকিনও নিশ্চিন্তে ঘোড়া ছুটিয়েছে প্রণয় নদের তীরে ফেরার অভিপ্রায়ে। শাহ্জাদীও দাসীর বেশে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করেছে প্রাসাদে। সিঁড়িতে উঠেই ভয়ে বুক ধক ধক করছে শাহ্জাদীর। কি হলো আজ প্রাসাদে! উপরতলা থেকে ভেসে আসছে অনেকের আলাপচারিতার আওয়াজ। এতো রাতে সবাই সজাগ হলো কি করে! তবে কি আমিই ধরা পড়ে গেছি! ভয়,সংশয় আর উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে মরুভূমির ন্যায় তৃষ্ণার্ত হয়ে যাচ্ছে। পা থমকে গেছে সিঁড়িতে। খানিক ভেবে দাসীদের নিয়ে উপরে উঠছে শাহ্জাদী। পাশের দরজা দিয়ে চুপিচুপি গিয়ে থাকবে আজ দাসীদের কক্ষে। কিন্তু দোতলায় উঠতেই ঝামেলা হলো। নওশাদ ছিলো সিঁড়ির সম্মুখেই। নেকড়ের ন্যায় ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে আসছে সে। অন্য সবাইও নির্ঘুমচিত্তেই উপস্থিত রয়েছে এখানে। নওশাদ এসে দাঁড়িয়েছে দাসীদের সম্মুখে।

“নওরাকে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে যাবার সাহস হলো কিভাবে তোদের? তোরা সঙ্গী না হলে তো নওরা একা যাবার সাহসই পেতো না!”–কথাটা বলেই নওশাদ সাথে থাকা তরবারি উঁচিয়ে কো’প দিতে চেয়েছিলো একজন দাসীর পায়ে। আরও তীব্রবেগে রাজা এসে দাঁড়িয়েছিলো সম্মুখে। উ’ন্মত্ত নওশাদকে দেখে আ’তঙ্কে দিশেহারা হয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরেছে নওরা। রাজার আদেশে সব দাসীরা কক্ষত্যাগ করেছে। নওশাদ তীব্র মেজাজ নিয়ে উগ্র ভঙ্গিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজাকে বলছে–“চাচা, আপনার মেয়ের বিচার আপনিই করুন। আজ সন্ধ্যায় শাহ্জাদা আরশান এসে চুপিচুপি মোলাকাত করে গেছে আমার সাথে। জানিয়ে গেছে রাকিনের সাথে ওর গোপন অভিসারের কথা।”

“আজ সন্ধ্যায় তুমি এসব জেনেছো! তাহলে তুমি এই মধ্যরাতে আমাদেরকে জানিয়েছো কেন? সন্ধ্যায়ই তো তুমি ব্যাপারটা আমাদেরকে জানাতে পারতে! নওরাকেও তুমি তখনই হুশিয়ার করে দিতে পারতে নওশাদ!”–নওশাদের মা ভ্রু কুঁচকে কৌতূহলী সুরে বলেছে ছেলেকে।

“বারণ কিভাবে করবে আপনার ছেলে! সন্ধ্যা থেকেই তো নর্তকী আর সুরা নিয়ে মগ্ন ছিলো। এইমাত্র ঘুম ভেঙেছে আপনার সুপুত্রের। তাই এখন এসেছে আমার মেয়ের খোঁজ নিতে!”–রানী ক্ষু’ব্ধ স্বরে জবাব দিয়েছে নওশাদের মা’কে।

“কই, মেয়ের বিচার করবেন! তা নয়। উল্টো আমার দোষ খুঁজতে এসেছেন। আপনিই নষ্ট করেছেন আপনার মেয়েকে।”–নওশাদ গলা উঁচিয়ে তে’জোদীপ্ত কণ্ঠে বলেছে রানীকে।

” নষ্ট তো তুমিই হয়েছো নওশাদ। নিত্য নষ্টামি করছো প্রাসাদে। আর এখন এসেছো আমার মেয়েকে নষ্ট বলতে!”(রানী)

“আমি সব বুঝি চাচী! আপনার বড় মেয়ে আর আপনি মিলে সাহস জুগিয়েছেন নওরাকে। আপনার দুই মেয়েকেই আমি আজ ব’ন্দী করে রাখবো। শুক্রবার নওরার সাথে আমার শাদী হবে। তারপরেই মুক্ত হবে ওরা।”

কথা শেষে চিৎকার করে দাসীদের ডেকেছে নওশাদ। নওরা আর নেহেরিনকে কক্ষে বন্দী করে রাখার আদেশ দিয়েছে। রাজা নির্বিকারই রয়েছেন। তার মেয়ে ভুল করেছে। ঠিক ভুলও নয়। একজনের বাগদত্তা হয়ে মধ্যরাতে অন্যের সাথে প্রাসাদ ত্যাগ করার ব্যাপারটা অন্যায়ের মতোই। রাজার দৃষ্টিতে এটা অপরাধও। রাজা নিজেও বিয়ে দেবার আগ পর্যন্ত বন্দী করেই রাখতেন কন্যাকে। মেয়ের হয়ে রানী প্রতিবাদ করেছে নওশাদকে। রাজা আর ঝামেলায় জড়াতে চান না। তাছাড়া বিয়ে তো নওশাদের সাথেই হবে। দু’দিন শাহ্জাদীদের নিজ কক্ষে বন্দী থাকা নিয়ে রাজা বাড়াবাড়ি করেন নি। দাসীরা ধরে নিয়ে ব’ন্দী করেছে দুই শাহ্জাদীকে।
………..

ভোরের আলো ফোটার পূর্বেই রাকিন সগৌরবে ফিরে গেছে সম্ভার রাজপ্রাসাদে। আযানের মধুর সুর হয়তো ভেসে আসবে খানিক বাদেই। সৎ ভাইয়ের অসৎ কর্মকাণ্ডে ভীষণ চিন্তিত রাকিন। প্রভাতেই পিতার সম্মুখে সৎ ভাইকে সবার মুখোমুখি করতে চায় শাহ্জাদা। একটু বিশ্রামের আশায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে এখন। ক্লান্ত শরীরে নয়নের পর্দা নেমেছে ক্ষণিকেই। স্বপ্নেরা দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছে নিদে। ভেঙেছে সে দুঃস্বপ্নও। নিদ আর হয় নি আজ। ধীর কদমে শাহ্জাদার আগমন ঘটেছে পিতার কক্ষে। হাতে তার আরশানের সেই চিঠি। হাত বাড়িয়ে বিনয়ের সাথে পিতাকে হস্তান্তর করেছে চিঠিটি। রাজা তারিক পত্রপাঠ শেষে বাকি পুত্রদেরও ডেকেছে নিজ কক্ষে। তাসকিন,শামস্ও এসে চিঠিটি পড়েছে। বিব্রত ওরাও। আরশানের বদনে নয়নবাণ ছু’ড়ে মনে মনে বলছে- এতোটা অবিশ্বাসী কি করে হয়ে গেলি তুই?

রাজা মলিন বদনে অমলিন সুরে প্রশ্ন করেছে আরশানকে–“শাহ্জাদা আরশান, এমন চিঠি কেন অন্য রাজ্যে প্রেরণ করেছো? আমায় ব’ন্দী করে সিংহাসন দখল করতে চাও? মুকুট রাজকুমার রাকিনকেও হ’ত্যা করতে চাও তুমি?”

“চাই, এসবই চাই। কি দিয়েছেন আপনি আমায় মহারাজ? আপনার প্রথম পক্ষের পুত্র রাকিনকে মুকুট রাজকুমার ঘোষণা করে রেখেছেন। শামসকে রাজ্যের ভবিষ্যৎ সেনাপতি বানাবেন। অসুস্থ পুত্র তাসকিনকে রাজ্যের ভবিষ্যৎ অভিভাবক ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। আর মন্ত্রীত্ব! আপনার ভাইয়ের পরিবার থেকে সর্বদা মন্ত্রী নিয়োগের ব্যাপারে আইন করে রেখেছেন। আর আমার জন্য! কি করেছেন আপনি আমার জন্য?”

গম্ভীর বদনে শীতল কণ্ঠে জবাব দিচ্ছেন মহারাজ তারিক–“তোমার ভাইয়েরা তোমার অগ্রজ। রাজকীয় ক্ষমতায় ওরাই এগিয়ে থাকবে। ওদের জন্মও আমার মহারানী রেহনুমার গর্ভে। পিতৃ এবং মাতৃ দু’দিক থেকেই রাজ র’ক্ত বহন করছে ওরা। ওদেরকেই তো এগিয়ে রাখতে হবে। তোমাকেও বঞ্চিত করতে চাই নি আমি। কিন্তু তুমি তো তোমার মায়ের মতোই কু’চক্রী আর ব্যভিচারী। তোমাকে রাজকীয় পদে কি করে রাখি বলো?”

“তার জন্য আপনি আমায় সমস্ত ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করবেন!”(ক্ষু’ব্ধ স্বরে)

মহারাজ কৌতূহলী ভঙ্গিতে সম্মোহনী সুরে প্রশ্ন করেছে–“বলো, কি চাও তুমি? তোমার জন্য প্রয়োজনে রাজকীয় পদ তৈরি করে দেবো!”

“আমি যা চাই তা আপনি দিতে পারবেন?”

“আশা করি পারবো। তবে চিঠিতে তো আমার নিজের এবং আমার অন্যান্য পুত্রদের জীবন নিতে চেয়েছো! এমন কিছু চাইতে যেয়ো না!”

“না, জীবন চাইবো না।”

“তবে কি চাও তুমি?”

“সময় হোক! আমি আমার পাওনা চেয়ে নেবো।”

“তাহলে এই কথাই রইলো। এরমধ্যে কোনো ঝামেলা করবে না তুমি!”

“ঠিক আছে।”

অন্যান্য শাহ্জাদারা রাজ্যের প্রয়োজনে আরশানকে বন্দী রাখার অনুরোধ করেছে। কিন্তু রাজা অনুরোধ রাখেন নি। তিনি মুক্তই রেখেছেন আরশানকে। রাকিনের প্রেমিকা নওরা যে শাহ্জাদা নওশাদের বাগদত্তা, এ ব্যাপারটি আজই জেনেছেন রাজা। এমন কাউকে পছন্দ করায় তিরস্কার করেছেন পুত্রকে। এসব তিরস্কারে কিছুই আসে-যায় না রাকিনের। বেচারা তো মহব্বতের ইন্দ্রজালেই বন্দী রয়েছে।

…………..

হিম হিম হাওয়া বইছে। দখিনের জানালা দিয়ে হিমেল হাওয়া এসে হিমশীতল করতে চায় রাকিনকে। হাতে তার একটি কাগজ। কালি রয়েছে সম্মুখেই। মেহবুবা নওরাকে প্রেমপত্র লিখবে সে। শুভ্র হাতে কালি নিয়েছে আলতো করে। কিন্তু বাতায়নের পাশে সহসাই একটি পায়রা পাখা ঝাপটিয়ে এসে বসে পড়লো। শাহ্জাদী নওরার চিরকুট ভেবে রাকিন এগিয়ে এসেছে বারান্দায়। শাহ্জাদাকে দেখে বারান্দায় চিরকুট রেখে দূর অম্বরে উড়ে গেছে পায়রা। আজ আর জবাবের অপেক্ষা করে নি এ বার্তাবাহক পাখিটি। দ্রুত হস্তে চিন্তিত বদনে চিরকুট খুলেছে রাকিন—

শাহ্জাদা রাকিন,

প্রভাতী শুভেচ্ছা নিও। আমি জানি এক জটিল মহব্বতের মায়ায় জড়িয়েছো তুমি। এ মহব্বতের পথ ভীষণ দুর্গম,বড়ই বন্ধুর এ যাত্রা। দুর্গম,বন্ধুর হলেও এ পথ কিন্তু অজেয় নয়। এ পথ যে পাড়ি দিতে পারে সেই তো অমর হয়। জানি না কেমন তোমার মহব্বতের হিম্মত! শুধু জানি তোমার মেহবুবাকে নওশাদ বন্দী করেছে মহব্বতের অপরাধে। শুক্রবারই বিয়ে হবে নওশাদের সাথে। এ নরপিশাচের হাত থেকে তুমি ওকে মুক্ত করতে পারো। তবে ভুল করেও রাজকন্যার সাথে বাহার রাজ্য জয় করতে এসো না। এখানে আমাদের রাজ বংশেরই রাজত্ব চলবে। আমাদের রাজ্য এবং রাজত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে তোমার মহব্বতের হিম্মত দেখাও।

ইতি,
সেই নানী,
তোমার মায়ের ফুফু

আচানক যেনো মেঘের ছায়া নেমে এলো রাকিনের হৃদয় অম্বরে। নানীর এ চিঠি তীরের মতো বি’দ্ধ হলো সেথায়। আজ বুধবার। শুক্রবারই নওরার বিয়ে! কি করবে এখন শাহ্জাদা!

চলবে