প্রাসাদকথন পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0
288

#প্রাসাদকথন
পর্বঃ১৬(শেষ পর্ব)
#সুলতানা_তানি

গোধূলির রঙে রঙিন পুরো অম্বর। অম্বরের সে রঙিন আভা এসেছে প্রণয় নদে। নদের ছলছল জলও করছে ঝিলমিল। বিদায়ী গোধূলি আর অনাগত সাঁঝ রয়েছে এক মধুর সন্ধিক্ষণে। ধরণীর এ মধুর সন্ধিক্ষণে বেদনাবিধুর হয়ে আছে একজনের জীবন। সে তো রয়েছে জীবন-ম’রণের সন্ধিক্ষণে। সে যে আর কেউ নয়, সম্ভার রাজ্যের মুকুট রাজকুমার রাকিন মুনতাসির। বিশালাকার এক কুমির আগ্রাসী ভঙ্গিতে এগিয়ে এসেছে তাকে ভক্ষণের লোভে। শামস কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তরবারিটিও যখন নদের পানিতে হারিয়ে গেলো তখনই বাঁচার সবটুকু আশা ছেড়ে দিয়েছে রাকিন। অসীম হতাশায় বিষণ্ণ বদনে মৃ’ত্যুর প্রহর গুণছে শাহ্জাদা। জলে নেমে কি কুমিরের সাথে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়! স্রোতসংকুল নদের অথৈ জলে নিজের ভারসাম্য রাখাই তো দায়! সেখানে কুমিরের সাথে লড়াই করবে কি করে! তবে বারবার কা’মড় দিতে এসেও কেন যেন দ্বিধান্বিত এ হিংস্র প্রাণীটি। কা’মড় না দিয়েই সরে যাচ্ছে খানিক দূরে। দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে নৌকার পানে। হয়তো কুমিরটি চিনতে পেরেছে এই তিনজনকেই। রাকিনের অতীত উপকারের কথাও স্মরণে আসতে পারে কুমিরটির। হয়তো সেসব ভেবেই ক্ষণিকের জন্য লোভকে সংবরণ করেছে এ হিংস্র প্রাণীটি! তবে কতোক্ষণ নিজের লোভকে সংবরণ করবে কুমির! এ বোকা হিংস্র প্রাণীর তো মায়া বলতে কিছু নেই। কে জানে কখন কা’মড় বসিয়ে দেয়! এরই মাঝে শ’য়তানি হাসিতে বে’ঈমানী ভঙ্গিতে বৈঠা হাতে শামসকে মা’রতে উদ্যত হয়েছে আরশান। একদিকে রাকিন মৃ’ত্যুর মুখোমুখি রয়েছে, অন্যদিকে শামসও মা’র খাবে! তার ভুলের জন্যই তো এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ক্ষণিকের জন্য ভুল করলেও বোকা নয় শামস্। আরশান বৈঠা দিয়ে আঘাতের চেষ্টা করতেই শামস শুয়ে পড়েছে নৌকায়। শুয়েই সমস্ত শক্তি দিয়ে এক লা’থি মে’রেছে আরশানকে। এ বেঈমান ছেলেটি তৎক্ষণাৎ ছিটকে পড়েছে প্রণয় নদে। কুমিরটিও কেন যেন কালবিলম্ব করলো না। সহসাই এসে এক কা’মড় বসিয়েছে আরশানের ঘাড়ে। এ মর্মান্তিক দৃশ্যও আজ এতোটুকু দাগ কা’টতে পারে নি রাকিনের হৃদয়ে। সে ব্যস্ত রয়েছে সাঁতরে নৌকায় ফেরার তাড়নায়। কুমিরের কা’মড়ে র’ক্তের স্রোত বেয়ে নামছে আরশানের শরীর থেকে। কত শত ভাবে বাঁচার আকুতি করছে আরশান! শাহ্জাদা রাকিন নিরুত্তর থেকেই সাঁতরে উঠে এসেছে নৌকায়। ধীরে ধীরে র’ক্তে রঞ্জিত হচ্ছে প্রণয় নদের এই অংশটুকু। এ র’ক্তও হয়তো খানিক বাদেই বিলীন হয়ে যাবে নদের জলে। ধরণীর বুকে থাকবে না আর আরশানের কোনো চিহ্ন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একবার রাকিন তাকিয়েছে পানির সেই র’ক্তিম অংশের দিকে। বাইশটা বছর তো একই প্রাসাদে ছিলো আরশানের সাথে। হয়তো আজ হাজারো স্মৃতি এসে তাড়া করছে রাকিনকে! বিষম ব্যথার অসম সব স্মৃতিকথারা ঘুরপাক খাচ্ছে হৃদয়ে। এই তো সেদিন সিংহাসন অথবা তার মেহবুবা নওরাকে চেয়ে বসেছিলো আরশান। তাদের রাজ পরিবার ধ্বংসেরও গোপন পরিকল্পনা করেছিলো। তাই আজ পেছন ফিরে তাকিয়ে মায়া বাড়ানোর ইচ্ছে নেই রাকিনের। যমজ ভাইকে সঙ্গী করে শাহ্জাদা দাঁড় ধরেছে শক্ত হাতে। নিয়তির এক নির্মম খেলার সাক্ষী হয়ে ওরা ফিরে যাচ্ছে তীরের দিকে।
……….

হিম হিম বাতাসে সানাইয়ের সুর ভেসে আসছে। এ মধুর সুর দুটো হৃদয়কে নব বন্ধনে বাঁধার চেষ্টা করছে। আজ বিয়ে হয়েছে শামস্ আর মাহিরার। রাকিনের
আগেই শামসের বিয়ের আয়োজন করা হলো। বাহার রাজ্যের সাথে কিছু বিষয় অমীমাংসিত থাকায় রাকিনের বিয়েতে দেরি হচ্ছে। শামস্-মাহিরার পা’গলামিও ধরা পড়ে গেছে সবার চোখে। তাই আগেভাগে বিয়ে দেয়া হলো এ পা’গলমনা দুজনকে।

হিম হিম হাওয়ার ঝিরি ঝিরি দোলায় সাঁঝ পেরিয়ে রাত এসেছে। সম্ভার রাজপুরীতে ঘুমপরী এসেছে আরো আগেই। নিদ্রিত হয়ে রয়েছে অনেকেই। তবে বিনিদ্র এখনো নববধূ মাহিরাসহ আরো অনেকে। মাহিরা তো চুপটি করে বসে রয়েছে বাসর ঘরে। চঞ্চলা মনে নতুন জীবনের স্বপ্ন এঁকে যাচ্ছে লুকায়িত গোপনে। কত শত বিলাসী ভাবনায় বিভোর তার মন! এরই মাঝে একটি ডিগবাজী দিয়ে বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে একজন যুবক। এহেন কাণ্ডে চমকে গিয়ে থমকে বসেছে মাহিরা। কারণ এতোক্ষণে বেচারী বুঝতে পেরেছে এ ডিগবাজি দেয়া লোকটি যে তারই বরমশাই। ডিগবাজী শেষে বেচারা শামস্ এসে দুষ্ট স্বরে বলছে– “ভয় পেয়েছিস উদ্বেগী?”
“এ্যাই এ্যাই, বাসর ঘরে এসেও আমায় অপমান করা হচ্ছে!”(অভিমানী সুরে,মাহিরা)

“অপমান কখন করলাম উদ্বেগী?”

“তাহলে উদ্বেগী নামে কেন ডাকছেন?”

“তুই যে উদ্বেগের মেয়ে!”

“ভালোই তো! বাসর ঘরে এসে বউয়ের পাশাপাশি শ্বশুরকেও অপমান শুরু করে দিয়েছেন!”

“আরেহ্ পা’গলী, শ্বশুরের একমাত্র মেয়েজামাই আমি। চুপিচুপি কিছু তো বলতেই পারি!”

“চলবে না এসব! আর আমাকেও এমন উল্টা-পাল্টা নামে ডাকা যাবে না!”

“তোকে তো আদর করেই উদ্বেগী ডাকি!”

“বাঁদর মানুষের কোনটা যে আদর আর কোনটা বাঁদরামি সেটা বোঝাও বড় দায়!”–খানিক হেসে জবাব দিয়েছে মাহিরা।

“আমায় বাঁদর বললে আমি কিন্তু বাঁদর নাচ দেখাবো।”

“বাঁদর স্বামীকে মানুষ করতে আমিও একটা বাঁদরলাঠি রাখবো।”

শামস্ দুষ্ট হেসে কাছে এসে জোরে চু’মু খেয়েছে মাহিরার ঠোঁটে। শামসের এমন কাণ্ডে মাহিরার সুখপিয়াসী মনে আচানক এক প্রেমপিয়াসী অনুভূতির উদয় হলো। সে অনুভূতির ঘোরে হঠাৎ লাজে বেচারী মুখ লুকিয়েছে বরের বুকে। এমন অবস্থা দেখে হো হো শব্দে হেসে উঠেছে শামস্। বউকে বুকে জড়িয়ে রেখেই ফি’স’ফিসিয়ে বলছে–“তোর বাঁদর স্বামী কিন্তু আদর শুরু করতেও পারে নি। তার আগেই উদ্বেগে এমন উদ্বেগী হয়ে গেলি!”

আবারো ‘উদ্বেগী’ নামে ডাকায় মাহিরা এক ঘুষি দিয়েছে বরের বুকে। ঘুষির জবাবে শামস্ আবারও চু’মু খেয়েছে মাহিরার ঠোঁটে। এসব পা’গলামোর মাঝেই বাসর কা’টছে এই পা’গলাটে দম্পতির।
………….

চারিদিকে হইচই। সানাইয়ের সুরের মূর্ছনায় মুখরিত বাহার রাজপ্রাসাদ। এ সুর এসে হৃদয় ছুঁয়ে দিয়ে যায় আলতো করে। সে আলতো ছোঁয়ার স্বপ্নদোলায় দুলছে রাকিন আর নওরা। আজ বিয়ে হয়েছে ওদের। খানিক বাদেই নওরাকে নিয়ে সম্ভার রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করবে বরযাত্রীরা। আজই সম্ভার রাজ্যে পদচারণা হবে তাদের ভবিষ্যৎ রাজরানী’র।

বিকেলের শুরুতেই বিয়ে বাড়ির সব আয়োজন সারা হয়ে গেলো। নওরাকে নিয়ে রওয়ানা করেছে রাকিনসহ বরযাত্রীরা। রাজতরীতে করে প্রণয় নদ পাড়ি দিচ্ছে ওরা। বিয়েতে অংশগ্রহণ শেষে সম্ভার রাজ্যের হাজার সৈন্যও ফিরে যাচ্ছে আজ। সৈনিকরা রয়েছে রাজতরীর পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট নৌকায়। প্রণয় নদে উত্তাল স্রোত এসেছে আজ। এ স্রোত হয়তো মহব্বতের উন্মাদনাও এনেছে রাকিনের প্রণয় উত্তাল হৃদয়ে। রাজতরীতে আলাদা আলাদা কক্ষে রাখা হয়েছে রাকিন আর নববধূ নওরাকে। কেন যেন শাহ্জাদার মন এখনই হারাতে চায় তার নববধূর মনে। দুর্নিবার এক আকর্ষণে এখনই সব দূরত্বকে দূরে ঠেলে দিতে চায় রাকিন। মধুক্ষণের মধুর বাঁশিতে হৃদয় নাচছে মহব্বতের খুশিতে। সানাইয়ের সুর এসে ধুক ধুক করে হৃদয়ে দোলা দিয়ে সরে যায় খানিক দূরে। আবারও সুর আসে ধীর আবেশে। এ চুপিচুপি হৃদয়জ খেলায় বড্ড বেসামাল আজ রাকিন। তাই তো চুপিসারে এসে কড়া নেড়েছে নওরার দরজায়। পরক্ষণেই সরে দাঁড়িয়েছে খানিক দূরে। নওরার দাসীরা রাকিনকে দেখে কক্ষ ত্যাগ করেছে। ইষৎ হেসে বউয়ের কক্ষে প্রবেশ করেছে শাহ্জাদা। আড়চোখে একবার বরের বদনে তাকিয়ে শাহ্জাদী বসে রয়েছে চুপটি করেই। মধুর মহব্বতের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছে তার বদনে। পাশে বসে আবেগঘন কণ্ঠে রাকিন শুধিয়েছে–” কি অবস্থা বেগম সাহেবা!”

“কথা নেই আপনার সাথে!”(অভিমানী সুরে)

“কেন? কি এমন করলাম আমি? ”

“এই কয়েকদিনে আপনি কিন্তু মহব্বতের একটা চিঠিও পাঠান নি!”

বউকে জবাব দেবার পূর্বেই বুকফা’টা আর্তনাদ ভেসে এলো রাকিনের কর্ণে। তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়েছে শাহ্জাদা। রাজতরীতে কোনো অঘটন ঘটেছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে গেছে বউয়ের কক্ষ থেকে।

আজ বিয়েতে অংশগ্রহণ শেষে হাজার সৈন্য ফিরে যাচ্ছে সম্ভার রাজ্যে। ওদেরই একজন পড়ে গেছে উত্তাল প্রণয় নদে। আচানক একজন সৈনিক নদে পড়ে যাওয়ায় চিৎকার করছিলো অন্য সৈনিকরা। সে আওয়াজেই যেনো কেঁপে উঠেছিলো রাজতরী। সৈনিকদের ঐদিকটায় রাকিন পৌঁছাবার পূর্বেই অন্যরা পানি থেকে তুলে ফেলেছে সে সৈনিককে। সৈনিকদের সাথে আলাপ করতে গিয়ে রাকিনের আর ফিরে আসা হয় নি স্ত্রীর কক্ষে।
………….

গোধূলি পেরিয়ে সাঁঝ এসেছে মহানন্দে। বরযাত্রীও নববধূ নিয়ে ফিরেছে সম্ভার রাজ্যে। রাজ্যের ভবিষ্যৎ রানী নওরার নানজিবার প্রবেশ ঘটেছে রাজপ্রাসাদে।তীব্র প্রদীপশিখার মতো মহব্বতের প্রদীপ জ্বলছে রাকিনের হৃদয়ে। হৃদয় আজ সত্যিই মহব্বতের আলোয় আলোকিত। এসবের মাঝেও রাজকীয় দায়িত্ব ভুলে যায় নি রাকিন। রাজকার্যের ব্যাপারে তিন ভাই আলাপে মগ্ন হয়েছে প্রাসাদের একটি কক্ষে। আচানক সেখান থেকে তাসকিন উঠে এসেছে বউয়ের কাছে। বাহার রাজ্য থেকে ফিরে নাবিহা পাড়ি দিয়েছিলো ঘুমের দেশে। নিদ্রিত বউকে ডেকে তাসকিন জিজ্ঞেস করেছে–“নওরার কাছে গিয়েছো? ওর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করেছো?”

এখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছে নাবিহা। মনভোলা মেয়েটি ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ধ’মকের সুরে স্বামীকে বলছে– “নওরা কে? কোন মহিলার খবর নিয়ে এসেছেন আমার কাছে?”

নিজ বোনের নামটা নাবিহা ভুলে যাওয়ায় ভীষণ বিস্মিত কণ্ঠে তাসকিন বলছে–“হায়হায়! এসব কি বলছো নাবিহা!”
“শোনেন, ভুলেও চালাকি করতে আসবেন না আমার সাথে! হতে পারি আমি মনভোলা আর বেখেয়ালি! তবে আপনার ব্যাপারে কিন্তু খুবই খেয়ালি।”

“ঠিক আছে ভাই। আপনি আমার ব্যাপারে খেয়ালি থাকলেই আমি খুশি। আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে হবে না আপনাকে।”

আচানক ঘুম ভেঙেছে বলেই নাবিহা এখন বোনের নামও ভুলে বসে আছে। হয়তো সব মনে পড়বে খানিক বাদেই। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই কক্ষত্যাগ করেছে তাসকিন।
………

অন্তহীন অমানিশাকে সঙ্গী করে নিশি পেরিয়ে যাচ্ছে। সুখের ভাবনাগুলো নিরন্তর ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। মুকুট রাজকুমার রাকিনের বিয়ে উপলক্ষ্যে ফুলে ফুলে সজ্জিত সম্ভার রাজপ্রাসাদ। আরো হাজারো ফুলে শোভিত রাকিনের কক্ষটি। এ কক্ষেই যেনো ফুলের রানী হয়ে বসে রয়েছে নওরা। উদাসী মনের বিলাসী কল্পনারা আজ নতুন সুখের আল্পনা আঁকছে। সেসব আল্পনায় বেখেয়ালি মন বারবার হেয়ালি করছে এখন। আর যে তর সইছে না শাহ্জাদীর! কখন বাসর ঘরে আগমন ঘটবে তার বরমশাইয়ের! উদাসী ভাবনারা অগোছালো হৃদয়টাকে আরও এলোমেলো করে দিচ্ছে বারবার! বর্ণিল চাদরে মোড়া রঙিন স্বপ্নগুলো যেনো দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে। এরই মাঝে এক পদধ্বনির আওয়াজ বুকে ঝড় তুলেছে নওরার। তবে কি রাকিনই আসছে বাসর ঘরে! এমনটা ভেবে বেনারসী শাড়িটি গুছিয়ে পরিপাটী হয়ে বসেছে শাহ্জাদী। এদিকে দরজা ঠেলে ধীর কদমে কক্ষে প্রবেশ করছে রাকিন। নওরার উদাসী মন ভীষণ উচ্ছ্বসিত এখন। এ যেন মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি। খানিক এগিয়ে এসে ফুলেল শয্যায় বউয়ের মুখোমুখি হয়ে বসেছে রাকিন। দূর আকাশের অধরা চাঁদের মতো লাগছে আজ তার বধূয়াকে। এ চাঁদকে ছুঁয়ে দেবার বাসনায় ঘোমটা সরিয়েছে রাকিন। দু’কপোল দু’হাতে স্পর্শ করে শাহ্জাদা দেখছে লাজনম্র বধূর চাঁদ বদনটিকে। তৃপ্ত চোখে বধূয়ার চাঁদমুখ দর্শন শেষে দুষ্ট স্বরে শুধিয়েছে–“কি ব্যাপার বেগম সাহেবা! সালাম-টালাম কিছু দেবেন না?”

“এ্যাই, কিসের সালাম, কিসের সালাম?”–ইষৎ লাজে বরকে প্রশ্ন করেছে নওরা।

“বাসর রাতে স্বামীকে যে সালাম দিতে হয় জানেন না?”

“বুড়ো বয়স পর্যন্ত আপনাকে পর্যবেক্ষণে রাখবো। যদি সে পর্যন্ত ঠিকভাবে স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে পারেন তবেই আপনাকে একটা সালাম দেবো! এখনই আগেভাগে কেন সালাম দেবো!”

“বিশাল হিসাব-নিকাশ তো আমার বউয়ের!”

“হিসেব তো বাকিই রয়ে গেছে। বিয়ের আগেই আপনার বউ পুরনো হয়ে গেলো কিনা! এই কয়েকদিন ধরে আমায় কিন্তু একটাও মহব্বতের চিঠি দেন নি! এই প্রশ্নটাও তো বিকেলে এড়িয়েই গেলেন!”

“মেহবুবার জন্য যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে ভেবেছিলাম– মেহবুবাই আগে একবার আমায় চিঠি দিক না! কিন্তু আগ বাড়িয়ে চিঠি তো আপনি দিলেনই না। উল্টো আমার মহারানী হয়েই জবাবদিহি শুরু করে দিয়েছেন!”

“ওহ্। আমার যে আগে চিঠি দেয়া উচিত ছিলো, এটা তো বুঝতেই পারি নি। আমি সত্যিই দুঃখিত।”

“আর দুঃখ পেতে হবে না বেগম সাহেবা! এই নিন আপনার চিঠি। আমি প্রতিদিনই চিঠি লিখে জমিয়ে রেখেছিলাম।”– বইয়ের ভাঁজ থেকে অনেকগুলো চিঠি এনে নওরার হাতে দিয়েছে রাকিন।
” এতোগুলো চিঠি?”–অবাকের সুরে প্রশ্ন করেছে নওরা।

“হুম,মহব্বতের চিঠি। আরো বেশি মহব্বত হবে আজ আপনার সনে।”

মহব্বতের মধুর ভাবনায় বিভোর রাকিন বসে পড়েছে বউয়ের পাশে। মৃদু লাজে অবনত বদনে বউ বেচারী জবাব দিয়েছে– “মহব্বত হয়তো হবে। কিন্তু আপনি যে এখন আমার আঁচলের উপর বসে পড়েছেন, সেই হুশ কি আছে?”

“আসলেই তো, কোনো হুশই ছিলো না আমার! বউয়ের আঁচলে না বসে বউকে এখন কোলে নিয়ে বসা উচিত আমার!”–দুষ্ট স্বরে কথাটা বলেই বউকে টেনে কোলে নিতে যাচ্ছিলো রাকিন। নওরা এক ধা’ক্কায় দূরে সরিয়ে দিয়ে বলেছে–“পুরনো চিঠিগুলো পড়া শেষ হোক না!”

সযত্নে একটি চিঠির ভাঁজ খুলছে শাহ্জাদী। রাকিন কাছে এসে প্রেমময় দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছে –“ওহ্ হো! চিঠি না হয় অন্য একদিন পড়ে নিও! আজ আমাদের মহব্বতের রাত, শুধু মহব্বতই হোক না আজ!”

“হোক মহব্বত! কিন্তু জানেন, আপনার চিঠিগুলোই ছিলো আমার জীবন!”

পেছন থেকে বউকে টেনে এবার ঠিকই কোলে নিয়েছে রাকিন। কাঁধে মাথা রেখে শুধিয়েছে–“এখন থেকে তো আর চিঠি দেয়া হবে না। আমার বউয়ের জীবনটার কি হবে এখন?”
প্রশ্ন শেষে বউয়ের কপোলে কপোল ঘষে চু’মু খেয়েছে শাহ্জাদা। মধুক্ষণের এ মধুর আলিঙ্গন আচানক ঝিলমিল সুখের দোলায় দোলাচ্ছে নওরাকে। ঝটপট জবাবগুলো সহসাই যেন হারিয়ে গেছে লাজের ভাঁজে। বুক ধক ধক করছে নিরন্তর। শাহ্জাদা নেশালো কণ্ঠে বলছে–“এতো ভয় কেন আজ?”

বরের কোলে চুপটি করে নিজেকে যেন গুটিয়ে নিয়েছে নওরা। নেশালো অনুভূতিরা ঝড় তুলেছে হৃদয় গহীনে। সে ঝড়ে বিলীন হতে চায় তার অবাধ্য মন। শাহ্জাদা রাকিন অনুধাবন করতে পেরেছে বউয়ের হৃদয়জ কথাগুলো। আরও শক্ত করে বউকে বাহুডোরে রেখে রাকিন গম্ভীর স্বরে বলেছে–“ভয় নেই আপনার বেগম সাহেবা! এক অনন্ত যাত্রার সঙ্গী হয়েছি আজ আমরা। এ নিঝুম রাত মহব্বতের মোহর এনে দিক আমাদের হৃদয়ে! আজ থেকে জীবনের সব রাতই হোক মহব্বতের!”

জবাব নেই শাহ্জাদার লাজরাঙা বউয়ের কণ্ঠে। ফুলশয্যায় এসে সব যেন হারিয়েছে প্রেমরাঙা ভাবনার মনরাঙা খুশিতে। সে খুশির দোলায় নওরার হৃদয় বাকহারা হয়ে নাচছে ময়ূরীর ছন্দে। চুপটি করে থাকা বউকে শাহ্জাদা আবেগঘন কণ্ঠে বলছে–“কথা তো বলছো না কিছুই! আজকের এ নিশা কিন্তু ঊষায় হারাতে যাচ্ছে! তুমিও আজ হারাবে নাকি মহব্বতের মায়ায়?”

ইষৎ হেসে মাথা নিচু করে রেখেছে নওরা। শাহ্জাদা আবারও চু’মু এঁকে দিয়ে বলেছে–“তাহলে শয়নের প্রস্তুতি নাও!”

কথাটা বলেই পোশাক বদলাতে পর্দার আড়ালে চলে গেছে শাহ্জাদা। নওরার পাশেই ছিলো চিঠিগুলো। শাহ্জাদী চুপিচুপি ভাঁজ খুলে নিয়েছে একটি চিঠির। সেথায় লেখা রয়েছে–

মেহবুবা নওরা,

সুদূর অম্বরের তারকারাও একদিন ম’রে যায়, অদূর পাহাড়ের ঝর্ণাধারাও আচানক নিজেকে গুটিয়ে নেয়, অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎপাতও কোনো একদিন থেমে যায়। নশ্বর এ পৃথিবীতে কত কিছুই তো আসে যায়! এসব আসা-যাওয়ার খেলায় মহব্বতের এক বাঁধনে বাঁধা পড়েছি তোমার সনে। আমরণ তোমায় জড়িয়ে রাখতে চাই এ মহব্বতের বাঁধনে! একসাথে পথ চলে অমর করতে চাই আমাদের এ মধুর মহব্বতকে! এ পথচলার মাঝে যদি মধুক্ষণ হয় বিষণ্ণ, যদি মধুময় সংসারেও আসে বিষাদ, তবু্ও হাতে রেখো হাত। সেইসব দুঃসময়ে হাতে হাত রেখে দুজন খুঁজে নেবো নতুন সুখের স্বাদ। আমি যে হৃদয়ের কালি দিয়ে বুকে লিখেছি তোমারই নাম। থেকো তুমি আমারই হয়ে এ জনম।
ইতি,
তোমার আশিক
রাকিন মুনতাসীর

চুপিসারে একটি পত্রপাঠ শেষ করেই শয়নের প্রস্তুতি নিতে মগ্ন নওরা। আড়াল থেকে যেকোনো সময় বেরিয়ে আসতে পারে বরমশাই। তাই তড়িঘড়ি করে ভারী গয়নাগুলো ছেড়ে দিয়েছে শাহ্জাদী। গোপন সুখের স্বপ্নগুলো বুকে নিয়েই আবারও চলে গেছে ফুলশয্যায়। রাকিনও বসে নেই। পোশাক বদলে সাধারণ পোশাক পরিধান করেছে সে। ইষৎ হেসে শাহ্জাদা এগিয়ে এসেছে ফুলেল শয্যাপার্শ্বে। এসেই ফুল শয্যায় শয়ন করেছে ধপ করে। বুকভরা স্বপ্নের মখমলি অনুভূতি নিয়ে শাহ্জাদী এখনো বসেই রয়েছে পাশে। শয্যাশায়ী স্বামীকে দেখে আচানক গভীর লাজ ধরা দিয়েছে তার বদনে। এ লাজনম্র বদনও যেন ইশারায় বলে দিয়ে যায় অনেক কিছু। সেই সব জানার অভিপ্রায়ে রাকিন হ্যাঁচকা টানে বউকে শুইয়ে নিয়েছে নিজের বুকে। বাহুডোরে বেঁধে ফি’স’ফিসিয়ে বলছে–“এতো লাজুক কেন এখন তুমি?”

শাহ্জাদীর আরো লাজ এসেছে নিজেরই অজান্তে। লাজের ঘোরে আচানক ভালোবাসার ঘোরও এসেছে হৃদয় জুড়ে। তবু কেনো যেনো এখন নির্বাকই থাকতে চায় মন। ইষৎ লাজে শাহ্জাদী হারিয়েছে হৃদয়জ সব কথন। বউকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রাকিন আবারও ফি’সফিসিয়ে বলছে–“এ্যাই, কি হয়েছে গো? কিছু বলছো না যে! আজ কি আর কিছুই বলবে না?”

এখনও নির্বাক তার বউ। সে যে হারিয়েছে নিজেকে এক মধুময় অনুভূতিতে! রংধনুর সব রঙে এখন রঙিন হচ্ছে তার মন। আরো রঙিন হতে চায় এ মধুক্ষণ। এ মধুক্ষণে রাকিনও হারাতে চায় হৃদয় ছোঁয়া মধুর ভালেবাসার পরশে। এমন ক্ষণে বউকে বুকে রেখেই শাহ্জাদা স্বভাবসুলভ খোঁচা মে’রে বলছে–“এ্যাই, কোনো কথা বলছো না কেন? এভাবে চুপটি করে সারা রাত আমার বুকে থাকার বাহানা ধরেছো নাকি?”

নওরা কালবিলম্ব না করে জবাব দিয়েছে–“সারা রাত কেন! আমি তো সারাজীবনই আপনার বুকে থাকতে চাই।”

“এ বুক পিঞ্জিরায় প্রাণ পাখি করে রাখবো তোমায়!”–আবেগঘন কণ্ঠে কথাটা বলেই রাকিন পাশে শুইয়ে দিয়েছে বধূয়াকে। শয্যাশায়ী বধূয়াকে আলিঙ্গন করে মহব্বতের তৃষ্ণায় চু’মু এঁকেছে ললাটে। হৃদয়জ খুশিরা আচানক বাঁধনহারা ছন্দ তুলছে নওরার বুকে। এ যেনো এক সুখহিল্লোলের প্রেমময় ছন্দ। এ ছন্দের মাঝেই শাহ্জাদা ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়েছে বউয়ের দু’কপোলে। এ ক্ষণ যে তৃষ্ণার পথে হারাবার ক্ষণ। সে পথে যেতে যেতে শাহ্জাদা নিরন্তর চুমু খাচ্ছে বউকে। খানিক বাদেই হয়তো আসবে চির আকাঙ্ক্ষিত সেই হারাবার ক্ষণ। মধুর বাসরে মহব্বতের চাদরে জড়িয়েই হবে মধুমিলন।
………
সময়ের বাধাহীন স্রোতে কে’টে গেছে দু’ দুটো বছর। একমাস আগে পুত্র সন্তানের জনক হয়েছে রাকিন-নওরা দম্পতি। ভীষণ ব্যস্ততা ওদের। এসবের মাঝেই নওশাদের সাথে বিশেষ আলোচনা করতে চায় রাকিন। বাহার রাজ্যের এ রাজপুত্রের মানসিক অবস্থাও পর্যবেক্ষণ করতে ইচ্ছুক রাকিন। তাই আজ শিশুপুত্রকে নিয়ে সস্ত্রীক সাক্ষাৎ করতে এসেছে ব’ন্দী নওশাদের সাথে। বেচারাকে আগেই বের করে আনা হয়েছে বন্দীশালার প্রথম ফটকের বাইরে। হাস্যোজ্জ্বল বদনে নওশাদের পানে চেয়ে নওরা বলছে–“আপনি তো মামা হয়েছেন নওশাদ ভাই!”

নওশাদ মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়েছিলো। এই দু’বছরে বেশ পরিবর্তন এসেছে তার স্বভাবে। নওরা আবদারের সুরে চাচাতো ভাইকে বলেছে–“ভাগ্নেকে একটু কোলে নেবেন না নওশাদ ভাই?”

সব ক্ষো’ভ,সব রাগ ভুলে নওশাদ কোলে তুলে নিয়েছে ভাগ্নেকে। রাজ র’ক্ত বহমান এ বাহার রাজপুত্রের শরীরে। রাজাধিরাজ পিতার মৃ’ত্যুর পরে নওশাদ বখে গিয়েছিলো জীবনপথে। তবে এই ছোট্ট শিশুর বদনে চেয়ে আজ আবার হাসি ফুটে উঠেছে তার অধরে। ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে ইষৎ হেসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাকিনকে বলছে–“আমার ভাগ্নে তো একদম তোমার মতোই হয়েছে রাকিন! ভালোই ভাগ্য তোমার! অল্পবয়সেই বাবা হয়ে গেছো!”

এমন কথাই যেন শুনতে চেয়েছিলো রাকিন। দুষ্ট হেসে নওশাদকে জবাব দিয়েছে–“প্রথম মেহবুবা নেহেরিনকে বিয়ে করলে এতোদিনে আপনারও এমন কয়েকজন সন্তান থাকতো! জীবনটাও স্থিতিশীল হতো নওশাদ ভাই!”

রাকিনের কথা শুনে ক্ষণিকের তরে কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছে নওশাদ। খানিক বাদেই মলিন বদনে আফসোসের সুরে জবাব দিয়েছে–“সেটা ঠিকই বলেছো রাকিন! আমারও হয়তো সন্তান থাকতো! তবে নেহেরিন আমার প্রথম মেহবুবা নয়। জীবনে আমার একমাত্র মেহবুবা ছিলো নেহেরিন!”

“আর বাকি যাদের সাথে মহব্বত করেছেন, তাদেরকে কি বলবেন নওশাদ ভাই?”

“মহব্বত শুধু নেহেরিনের সাথেই করেছিলাম! বাকিরা ছিলো মোহ! বোঝোই তো, বাহার রাজ বংশের একমাত্র রাজকুমার আমি।আমার কথাতেই চলতো অনেক কিছু! অল্পবয়সে অধিক ক্ষমতা পেয়ে সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান করেছি আমি। অহংকার আর নারীর মোহে জীবনটা শেষ হয়ে গেছে আমার!”–অনুতাপের সুরে বলছে নওশাদ।

“আপনার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নেহেরিন আপুর অন্যত্র বিয়ে হলো। সে সুখের জীবনের শুরুতেই উনি বিধবা হয়েছেন! বোঝেন, কি কষ্ট উনার! আপনি তো সুখেই ছিলেন। আপনাকেও দু’বছর কারাবন্দী রেখে কষ্ট দিলাম! কোনো সুরা,কোনো নারী আপনাকে দেয়া হয় নি এ বন্দী জীবনে। কষ্ট যে কি জিনিস কিছুটা হলেও আপনি উপলব্ধি করেছেন। ”

মেঘমলিন বদনে আফসোসের সুরে নওশাদ বলছে–” জানো রাকিন, নেহেরিনকে প্রত্যাখান করার পরে আমিও গোপন ব্যথায় জর্জরিত হয়েছিলাম। ওর বিয়ের পরেই আমার কেন জানি ভীষণ অস্থির লাগতো, ভীষণ কষ্ট হতো বুকের মাঝে! সবসময় মনে হতো কি যেন হারিয়ে ফেলেছি। সব ভুলতে গিয়ে হঠাৎ করেই আমি বহুনারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এক পশুসুলভ হিংস্রতা এসেছিলো আমার মাঝে। এ দু’বছরের ব’ন্দী জীবনে নেহেরিনের বদনটাই বারবার আমার নয়নে ভেসে উঠেছে। আমি বুঝতে পেরেছি জীবনে মহব্বত শুধু নেহেরিনকেই করেছিলাম! আর কারো ছবি তো কখনো ভেসে আসে নি আমার অক্ষিপটে! যদি কখনো মুক্ত হই তবে বাহার রাজপ্রাসাদ থেকে দরবার নৃত্য চিরতরে বন্ধ করে দেবো। শুধু শুধু নারীর মোহে আর নিজেকে নিঃশেষ করতে চাই না। আর কোনোদিন সুরাও চাই না আমার এ জীবনে। ”

রাকিন উচ্ছ্বাসের সাথে জবাব দিয়েছে–“এটাই শুনতে চেয়েছিলাম নওশাদ ভাই, এটাই শুনতে চেয়েছিলাম। তবে এক শর্তে আপনাকে মুক্ত করে দেবো।”

“কি শর্ত?”

“পুরনো মেহবুবা নেহেরিনকে বিয়ে করতে হবে আপনাকে।”

“আমি তো বাকি জীবনে নেহেরিনকেই চাই। কিন্তু ভীষণ অভিমানী মেয়েটি! কিছুতেই হয়তো আমায় বিয়ে করতে রাজি হবে না !”

“বিধবা নেহেরিন আপুও বড্ড একা। নারীর লোভ থেকে আপনি মুক্ত হওয়ার ওয়াদা দিন। ইনশাআল্লাহ্ বাহার রাজই নেহেরিনকে আপনার সাথে বিয়েতে রাজি করাতে পারবে।”

“শোনো রাকিন, ছোটবেলা থেকেই নেহেরিনের সাথে মহব্বত ছিলো আমার। যতোদিন ওর সাথে মহব্বত ছিলো ততোদিন অন্য নারীর বদনে ফিরেও তাকাই নি। হঠাৎ করেই কিছু শ’য়তান বন্ধুর চ’ক্রান্তে পড়ে নেহেরিনকে প্রত্যাখান করলাম! ওদের কু’মন্ত্রণায় অধিকতর সুন্দরী নওরাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণের লোভ করেছিলাম। মাঝখান থেকে আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেলো! এখন আর নারীর মোহ নেই আমার! যদি নেহেরিন আমার জীবনে আসে তবে ওকে নিয়েই বাকি জীবন কা’টাবো। নেহেরিন আমার জীবনে আসতে না চাইলে ওকে জোর করো না। আমি এক ঘৃণ্য মানুষ। আমায় ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দেবার অধিকার ওর রয়েছে।”
…………….
সুদূর অম্বরে শত-সহস্র তারকাদের মিলন মেলা বসেছে। মিটমিটে আলোয় মিলন-বিরহের গানই হয়তো তারা গাইছে। একখানি চাঁদও হেসেখেলে জোছনা বিলিয়ে দিতে মগ্ন। এই ভরা জোছনায় আজ বিয়ে হয়েছে নেহেরিন আর নওশাদের। নেহেরিনেরও সুপ্ত মহব্বত ছিলো নওশাদের জন্য। কারাবাস থেকে ফিরেই নওশাদ বাহার রাজপ্রাসাদের দরবার নৃত্য বন্ধ করে দিয়েছে। রাজ্যের ক্রান্তিকালে দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রজাদের কাছে বারবার ক্ষমা চেয়েছে। সুরার আমদানিও বন্ধ করে দিয়েছে বাহার রাজ্যে। সব শেষে নেহেরিনও বিয়ে করতে রাজি হয়েছে নওশাদকে। আজকের বিয়ের অনুষ্ঠানে মহানন্দে অংশগ্রহণ করেছে সবাই। রাকিন,নওরাও এসেছে ওদের শিশুপুত্রকে নিয়ে। শামস্-মাহিরা,তাসকিন-নাবিহাও সন্তানসহ উপস্থিত হয়েছে। এ বাহার রাজ্যের একমাত্র রাজকুমারের বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। কত শত সুখের বাজনা বাজছে! পাশাপাশি আসনে বসে রয়েছে নওশাদ আর নেহেরিন। রাকিন-নওরা এসে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করেছে নওশাদকে –“আপনার ভবিষ্যৎ রাজকীয় জীবন কিভাবে কা’টাতে চান নওশাদ ভাই?”

নেহেরিনকে খুশি রাখতে ওদেরকে একটু খোঁচা দিয়েই জবাব দিয়েছে নওশাদ–“এই প্রণয় নদ তীরবর্তী রাজ্যগুলোর রানীদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমতী হবে আমার নেহেরিন। এমন বুদ্ধিমতী বউ সাথে থাকলে আমিই সবচেয়ে সুখী রাজকীয় জীবন কা’টাবো।”

“আবার ভুল পথে পা বাড়িয়ে দিয়েন না যেনো!” –সাবধানী আওয়াজ ভেসে এলো রাকিনের কণ্ঠ থেকে।

“দু’বছর বন্দী রেখে তুমি সংশোধনের পথে এনে দিয়েছো, কি করে ভুল করি আবার! তাছাড়া এমন লক্ষী বউ পাশে থাকলে ভুল করার উপায় আছে!”–আবারও নেহেরিনকে খুশি করার অভিপ্রায়েই কৌশলী জবাব দিয়েছে নওশাদ। পুরনো প্রেমিকাকে বউ করে হাসিখুশি জীবন কা’টাতে চায় নওশাদ। তাই বারবার নেহেরিনকে খুশি করার বাহানায় মগ্ন সে। এমনটা দেখে রাকিন,নওরাও আজ ভীষণ খুশি। এই ভরা জোছনায় আজ যেনো মহব্বতের বাঁশি বেজেছে সবার মনে। থাকুক না এ মহব্বতের বাঁশির সুর চিরন্তন হয়ে!
………..
সুখের স্বপ্নগুলো পূর্ণ হওয়ায় বাহার রাজ মুনাওয়ারও আজ ভীষণ খুশি। রাজ্য,রাজত্ব সবই তো টিকে আছে সগৌরবে! তার হারানো স্বপ্নেরা পূর্ণতার ডানা মেলেছে। নিজ কন্যা নেহেরিনই তো হচ্ছে বাহার রাজ্যের ভবিষ্যৎ রানী। কনিষ্ঠা কন্যা নওরাও পার্শ্ববর্তী সম্ভার রাজ্যের রানী হবে। একজন রাজপুত্রের জনক হতে না পারার গোপন ব্যথা আজ আর তাড়িত করছে না তাকে। এ ভরা চাঁদোয়ায় চাঁদের হাসি যেন লেগে রয়েছে তার বদনে। সম্ভার রাজ্য এখনো পরিচালিত হয়ে আসছে রাজা তারিকের দক্ষ রাজত্বে। পুত্রগণ তাকে সাহায্য করছে রাজকার্যে। দু’রাজ পরিবারের মধ্যকার সম্পর্কও এখন বয়ে চলছে বহমান গতিতেই। মাঝখানে হয়েছিলো অনেক ভাঙা-গড়ার খেলা। সে খেলা সাঙ্গ হয়েছে আগেই। দুটো রাজপ্রাসাদের অন্দরেও ছিলো সুখ-দুঃখের অনেক গোপন কথা। এসব কথায় কথায় শেষ হয়ে গেলো এই #প্রাসাদকথন।

সমাপ্ত।

(আমায় ক্ষমা করবেন।)