প্রিয়জন পর্ব-৭+৮

0
2690

#প্রিয়জন (৭)

থমথমে মুখে ফিরল জাহিন। তার মনটা ইষৎ খারাপ। একই অনুভূতি হুরের মাঝেও বিরাজমান। সে শান্ত দৃষ্টিতে সামনে এগিয়ে চলেছে। জাহিন এসেই নির্দিষ্ট কক্ষে চলে গিয়েছে। হুরকে দেখে লতিফা ডাকলেন।

“এসেছিস, মাত্রই তো গিয়েছিলি।”

“দুপুরের খাবার তো লেট করে খেলাম মা। বিকেল ও হয়ে এসেছে। তাই ফিরে এলাম। বেশি দূর যাই নি।”

ইচ্ছে করেই মিথ্যেটা বলল হুর। সে চায় না মা কোনো ভাবে বিষয় গুলো নিয়ে কষ্ট পাক। ও চায়, মা ভালো থাকুক।

“ভালো কথা মনে করালি। ছেলেটাকে একটু চা করে দে। ভালো লাগবে।”

মেয়ের বাহু স্পর্শ করে বললেন লতিফা। হুর শুকনো একটি ঢোক গিলে। তারপর এগিয়ে যায় রান্না ঘরের দিকে। আধুনিক কোনো কিছুই নেই। ছোট্ট একটা রান্না ঘর। যার চারপাশটা পাটখড়ি দিয়ে তৈরি করা। প্রতি বছর বৃষ্টির সময় পাটখড়ির পচন হয়। তখন আবার বেড়া খুলে, নতুন করে লাগানো হয়। ওপরে অবশ্য টিনচাল করা। না হলে আরেক বিপত্তি হতো। হুর চুলায় চায়ের পানি বসাল। তারপর কিছু শুকনো পাতা এনে মাটির চুলার প্রায় পুরোটাই ভরাট করল। তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পেছন ঘুরতেই একটা লম্বা মূর্তির মতন নজরে পড়ল। হঠাৎ হওয়ায় ভরকাল সে। জাহিন ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে শুধাল,”ভয় পেয়েছ?”

“না।”

“ওভাবে চমকালে যে।”

“আপনি কখন এলেন? ঘরে তো ছিলেন।”

“এসে তো ঘরে যাও নি। আন্টিকে জিজ্ঞাসা করতেই এদিকের কথা বললেন।”

“ও।”

তারপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। জাহিন তখনো দাঁড়িয়ে আছে। হুর শুধাল,”আপনি কি বসবেন?”

“বসলে তোমার সমস্যা হবে?”

মেয়েটির হৃদয়ে একটা ধাক্কা লাগল। জাহিন এ কথা কেন শুধাল? তবে কি তার হৃদয়ে দ্বিধা রয়েছে।

“আমার কেন সমস্যা হবে। আপনি বসুন।”

বলেই কাঠের তৈরি একটি আসন এগিয়ে দিল হুর। জাহিন বসল। পানিতে বলক এসেছে। তাতে পরিমান মতন চিনি আর অল্প একটু লবন দিল হুর। তারপর দিল গুড়ো চাপাতা। কয়েক মিনিট পর চা নামিয়ে ফেলল। এবার চুলায় বসাল দুধ। যা আগে থেকেই ঘন করে রাখা। তবু সেটা গরম করে নিয়ে তাতে লিকার চা মিশিয়ে নিল। পুরোটাই মনোযোগ দিয়ে দেখল জাহিন।

“তুমি কিন্তু ভালো চা বানাও।”

“এখনো তো খেয়ে দেখেন নি।”

“খাওয়া লাগে না, দেখেই বোঝা যায়।”

“খেয়ে ভালো না লাগলে, পরে কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবেন না।”

এ কথার বিপরীতে জাহিন শুধুই হাসল। হুর চায়ের কাপে চা ঢেলে নিয়ে বলল,”জানি না ভালো লাগবে কী না।”

কাপ তুলে নিল জাহিন। জবাব না দিয়ে সে বরং চুমুক বসাল। চায়ের স্বাদ ভালো হয়েছে। কড়া লিকার হওয়াতে খেতে আরাম লাগছে।

“এত ভালো চা বানাও, সেটা আগে জানলে, আবদার করে বসতাম।”

“সত্যিই ভালো লেগেছে?”

“তুমিই খেয়ে দেখো।”

এই বলে কাপটি এগিয়ে দিল জাহিন। হুর দ্বিধায় পড়ল। তবে জাহিন এগিয়ে ধরায় মানা করতে পারল না। ও চা কাপে চুমুক বসাল। যেখানে জাহিনের ঠোঁট স্পর্শ করেছিল, ওখান থেকেই চুমুক দিল ও। জাহিন সেটা লক্ষ্য করল। ওর ভালো লাগল। ভালো লাগল এটা ভেবে, মেয়েটি তার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি না রাখলেও, ভালো লাগার অনুভূতি ঠিক ই রাখে।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় লতিফার সাথে বেশ কথাবার্তা হলো জাহিনের। শ্রদ্ধা, সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে, ছেলেটা অতুলনীয় বটে। ওর প্রতিটা কাজ, চলন, বলনে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে হুর। আকাশের বুক থেকে মেঘের দল একটু একটু করে সরতে শুরু করেছে। মেয়েটি তখনো এক ধ্যানে চেয়ে। লতিফা এবার বাহু টেনে ধরলেন।

“কী হয়েছে তোর?”

“কিছু হয় নি তো মা।”

“কতবার ডাকছি, উত্তর করছিস না যে।”

“ডেকেছ!?”

অবাক হয়ে বলল হুর। লতিফা শান্ত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বল‍লেন,”সব ঠিক আছে তো?”

“হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। তুমি চিন্তা কোরো না।”

“জানি, দুলের জন্য তোর মনটা ভালো নেই।”

“যা যাবার, তা চলে গিয়েছে মা।”

“সেটাই রে। তুই যা। ঘুমিয়ে পড়। লেট করিস না।”

মাথা নাড়িয়ে চলে যায় হুর। লতিফা সে পথে চেয়ে থাকেন। বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এই সময়টায় স্বামীর কথা বড়ো স্মরণ হয়। লোকটার চলে যাওয়ার পর, মেয়েকে ধরে বেঁচে ছিলেন। তবে মেয়েরা যে অন্যের ঘরের জন্য বড়ো হয়। আর নিজের ঘরে দিয়ে যায় শূন্যতা।

জাহিনের ঘরটা বিশাল। সেই সাথে রয়েছে নানান ধরনের জিনিসপত্র। সেই তুলনায় ছোট্ট একটা কক্ষ হুরের। তা ও দামি কোনো জিনিসপত্র নেই। লজ্জা না হলেও, মানুষটার কথা ভেবে খারাপ লাগছে। খাটের এক কোণে বসে থাকা সুপুরুষ’কে এই কক্ষে বেমান ঠেকছে। তার জায়গা যে, রাজমহলে। এই ছোট্ট নীড়, তার জন্য জেল খানার মতন। ও বুক ভরে সমীরণ টেনে নিল। এদিক সেদিক করতে লাগল। সেটা দেখে জাহিন বলল,”এখন ঘুমাবে?”

“আপনি ঘুমাবেন?”

“কিছু কাজ আছে।”

“ও।”

“তুমি শুয়ে পড়তে পারো।”

“অপেক্ষা করি।”

হুর অপেক্ষা করতে লাগল। তবে দুজনের দূরত্ব অনেকটাই রইল। এমন একটা দূরত্ব মনের মধ্যেও রয়েছে। জাহিন মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু করছে। শহরে তার ব্যবসা রয়েছে। সেসব ই দেখে নিচ্ছে। হুর অনেকটা সময় অপেক্ষা করল। তবে জাহিনের কাজ শেষ হয় না। সে ফোনের মধ্যে ডুবে আছে। এটা সেটা করতে থাকে। আর হুর চেয়ে থাকে। এক দৃষ্টিতে। কেটে যায় অনেকটা সময়। মানুষটার দিকে চেয়ে থাকতে, থাকতে হুরের দুটো চোখ বন্ধ হয়। তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।

চলবে…..
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি

#প্রিয়জন (৮)

সমস্ত রাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছে জাহিন। এমন না এই পরিবেশে একেবারেই সে মানাতে পারছে না। তার খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। তবে কেন যেন ভেতরটা ভয়ানক য ন্ত্র ণাতে বুদ হয়ে আছে। সকাল হতেই এক কাপ চা হাতে ঘরে প্রবেশ করল হুর। গতরাতে টানা ঘুমিয়েছে সে। নিজের প্রিয় রুমটা পেয়ে বেশ ভালোই ঘুম হয়েছে। যার দরুণ চোখ মুখ ফুলে ওঠেছে।

“আমি আজ ফিরে যাচ্ছি।”

চায়ের কাপটি তুলে নিয়ে বলল জাহিন। হুর একটু চমকাল, থমকাল। কয়েক সেকেন্ড বাদে বলল,”কেন?”

এই প্রশ্নে জাহিনের ভেতর একটুখানি সমীরণ এসে স্পর্শ করে গিয়েছিল। তবে পরের কথাটি শুনেই শীতল সমীরণ তপ্ত হয়ে বুক স্পর্শ করে গেল।

“তার মানে তো আমাকেও যেতে হবে। আমি না গেলে হয় না?”

পুরুষটি ঠোঁট কামড়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল,”তোমাকে যেতে হবে না।”

“আচ্ছা, মা কে বলে আসি। কখন যাবেন?”

শেষ প্রশ্নের দ্বারা মেয়েটি কী বুঝাল? সে চলে গেলেই ওর স্বস্তি। পুরুষটি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও, হুর সেটি দেখল না। “দুপুরে” বলতেই সে এক ছোটে মায়ের কাছে এল। লতিফা দুপুরের খাবারের আয়োজন এখন থেকেই শুরু করে দিয়েছেন।

“এভাবে ছুটে এলি কেন?”

“ওনি আজ ই চলে যেতে চাচ্ছেন।”

“সেকি। আজ ই কেন?”

“হয়তো কোনো কাজ আছে।”

“এর কোনো মানে হয়? আমি কথা বলি।”

লতিফা আঁচল টেনে ওঠে দাঁড়াতেই বাঁধ সাধল হুর। মায়ের বাহু চেপে ধরে বলল,”কী দরকার?”

“দরকার নেই বলছিস? পাগল কোথাকার। ছেলেটা কাল এসেছে, আজই চলে যাবে।”

মেয়েকে ঠেলে তিনি কক্ষে পৌঁছালেন। জাহিন তখন চায়ের কাপটি রেখে নিজের ব্যাগ পত্রে হাত দিয়েছে।

“বাবা, তোমরা নাকি আজ চলে যাবে।”

জাহিন কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার পূর্বেই পেছন থেকে হুর বলল‍,”আমি যাব না তো।”

লতিফা মেয়ের দিকে দৃষ্টি ফেললেন। তারপর আবার জাহিনের দিকে তাকিয়ের বললেন,”এটা হয় বাবা? তুমি চলে যাবে। কাল ই তো আসলে।”

“আমাকে শহরে যেতে হবে আন্টি। কিছু কাজ পড়ে গেল।”

“তাহলে হুর ও ফিরে যাক। তুমি আসলে তখন আবার দুজন এসে থেকো।”

“না আন্টি। ও থাক। আমি এসে নিয়ে যাব।”

“কোনো ভাবেই কি থাকা যায় না?”

“খুব ই আর্জেন্ট হয়ে গেল। না হলে এভাবে চলে যেতাম না। আমি কথা দিচ্ছি, আবার আসব।”

“ঠিক আছে বাবা। যেভাবে ভালো হয়। আমি রান্না বসাই।”

লতিফা ছুটলেন রান্না ঘরের দিকে। মেয়ে জামাইকে সবটুকু দিয়ে আপ্যায়ন করছেন তিনি।

“আপনি ব্যাগ ও নামিয়ে ফেলেছেন?”

খাটের ওপরে থাকা ব্যাগটা দেখে শুধাল হুর। জাহিন উত্তর দিল না। কঠিন মুখে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল,”এক সপ্তাহ পর আসব।”

“আচ্ছা।”

এইটুকু? আর কিছু কি মেয়েটার বলার নেই। জাহিন সবটা বুঝে, জানে। তবু ওর হতাশ লাগল। গতকাল বিকেলের ঘটনাটি স্মরণ হলো। সে উষ্ণ একটু চুম্বনের আশায় মেয়েটির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অথচ কৌশলে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল মেয়েটা। একজন স্বামীর কাছে, বিষয়টি কষ্টের।

দুপুরের খাবার খেয়ে মাত্র কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল জাহিন। তারপরই ব্যাগপত্র নিয়ে বের হয়ে গেল। লতিফা আরো একবার অনুনয় করল। তবে অনুনয়টি রাখতে পারল না ছেলেটা। তাকে যেতেই হলো। হুরের আহামরি কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। মানুষটি ওর স্বামী, একটা ভালো লাগা কাজ করে ঠিক ই, তবে সংকোচের দরুন দূরত্বটা রয়েই গিয়েছে। ও এটা ভেবে স্বস্তি পেল, মানুষটিকে অন্তত এই পরিবেশে আর কষ্ট পেতে হবে না। তাছাড়া কিছুটা সময় ওর ও প্রয়োজন। আজকাল হৃদয় বড়ো প্র হা র করে চলেছে। জাহিনের কাছাকাছি হওয়া মাত্রই তাহিরের কথা স্মরণ হয়। তীব্র অস্বস্তিতে ভালো লাগা পরিণত হয় বিভ্রমে। ভয় এসে চেপে ধরে গলা। আর তারপর বাড়ে দূরত্ব। আশ্চর্য হলেও সত্য জাহিনের ফোন নাম্বারটি তার কাছে নেই। সন্ধ্যার নামাজ শেষ করে এসে মা বললেন,”জাহিনের সাথে কথা বলেছিস?”

এ কথায় চমকায় মেয়েটি। কথা বলতে পারে না। লতিফা মাত্রই নামাজ শেষ করে এসেছেন। মেয়ের পাশে বসেন।

“সব ঠিক আছে?”

“হ্যাঁ মা। সব ঠিক আছে। তুমি ভেবো না।”

“ভাবতে চাই না রে মা। তবু ভাবনায় এসে যায়। ও বাড়ির সবাই কেমন?”

হুর শান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চায়। এ নারীটির জীবনে কী আছে? কিছুই তো নেই। শুধু সে আছে। তার জন্যই তো নিজের সবটুকু শেষ করে চলেছেন। হুরের ভেতরটা তীব্র খারাপ লাগায় বুদ হয়ে গেল। ও মায়ের কাধে মাথাটা এলিয়ে দিল।

“সবাই ভালো মানুষ মা। সবাই খুব ভালো। তুমি চিন্তা কোরো না।”

মুখে এ কথা বললেও ওর ভেতরে যে প্র হা র চলে। তাহির নামক ব্য থাটা পুনরায় বুকে এসে আন্দোলন করে। ও মনে মনে প্রার্থনা করে তাহির যেন ফিরে না আসে। সে ফিরলে, হুরের জীবনটা বানের জলে ভেসে যাবে। একটা সুন্দর সংসার হওয়ার পূর্বেই তাতে ভা ঙচু র হবে। যা শেষ করে দিবে একাধিক জীবন। তখন বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে কি?

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি