প্রাচীর পর্ব-০২

0
1081

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০২

বাসায় ফিরতে ফিরতে নিশাতের নয়টা বেজে গেলো। এক্সিডেন্টের কেইস! ঝামেলা তো কম না। তার মধ্যে নাম ঠিকানার কোন আতা পাতা নেই। একটা স্বাভাবিক পুরুষ মানুষ ঘর থেকে বের হলে আর কিছু না থাক, অন্তত ওয়ালেট টা তো সাথে থাকবে। এই বান্দার তাও নেই। খুন টুন করে পালাচ্ছিলো নাকি রে বাবা আল্লাহ’ই জানে? কপাল! সবই কপাল। নিজের নীতির বাইরে গিয়ে কিছু করলো, তাও আবার কিলার টিলার বেরিয়ে যায় কি না দেখো। অবশ্য হসপিটালের লোক পুলিশ ইনফর্ম করেছে। আর এই পুলিশের জন্যই তো যতো দেরি হলো। হসপিটাল কর্তৃপক্ষের পুলিশ আসা না পর্যন্ত এমন ভাব, যা হবার হোক কোন ছাড়াছাড়ি নেই।

আরে বাবা এটা কি বিলেত? এক্সিডেন্ট হবে পুলিশ দৌড়ে চলে আসবে। বাংলা সিনেমায় সব ভুজুং ভাজুং দেখালেও একটা জিনিস একেবারে সঠিক দেখায়। পুলিশ আসে সব কাহিনীর শেষে। তো? তারা তো আর মন্ত্রী- এমপিদের ছেলে মেয়ে না। ফোন দিলেই দৌড়ে চলে আসবে। নিশাতের তখন ইচ্ছে করলো নিজের মাথা নিজেই দেয়ালে ঠুকতে। কোন দুঃখে যে এই নাটকে অংশ নিয়েছিল। এতোক্ষণে টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরে আরামছে এক ঘুম দিতে পারতো। ধুর! ধুর!

আর সেই সমাজ সেবক! মহা আনন্দে সব করলো। এমন স্প্রিঙ্ওয়ালা মানুষতো সে জীবনে দেখেনি। চেনা নেই জানা নেই, দৌড়ে দৌড়ে সব ঔষুধ টষুধ আনলো, রক্তের ব্যবস্থা করলো। নিশাত অবশ্য আর নড়ে চড়ে নি। গেড়ে বসে ছিলো। কি দরকার ভাই? হসপিটালে আনার দরকার এনেছে। এখন যা করার ডাক্তারই করবে। আজরাইলের সাথে ছুরি কাঁচি নিয়ে লড়াই করার ক্ষমতা ডাক্তারের আছে তার তো নেই। তাই বাবা নিরপেক্ষ অভিব্যক্তি নিয়ে নিশাত চেয়ারে চুপচাপ বসে রইল। পুলিশ আসে কখন কে জানে। টাইম পাসের জন্য মনে মনে এক লাইন গুনগুনও করলো, — পিরীতে মোরে করিয়াছে দেওয়ানা, হাছন রাজা পিরীত করিয়ে হইয়াছে ফানা।

হাছন রাজা ফানা হয়েছে কি না নিশাত জানে না। তবে বসে থাকতে থাকতে সে হলো ত্যানাবেনা। তাকে ত্যানাবেনা করে পুলিশ শেষ মেষ পৌঁছালো আট টারও পরে। আসতেই নিশাত কবিতার মতো সব বললো। গাড়ি কোথায় আছে সেই ঠিকানা দিলো। তাদের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার রেখে তবেই রেহাই দিলো। আরে বাবা জীবন বাঁচিয়েছি, খুন করিনি। সময় মতো যদি না আনতাম, এতক্ষণে আজরাইলের সাথে সাক্ষাৎ ঠিক হয়ে যেতো। তাই সে কানে ধরেছে। জীবনে আর কোন নাটকে অংশ নেবে তো ভালোই, ফিরেও তাঁকাবে না । যা হবার হোক। চোখ, কান বন্ধ করে সোজা হেঁটে পগারপার।

বাসায় ফিরে নিশাত কলিং বেল দিতেই দরজা খুললো তার মামাতো বোন সাবা। তার বয়স চৌদ্দ। এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। বয়স চৌদ্দ হলেও সাবাকে দেখতে লাগে বাচ্চা মেয়েদের মতো। টিংটিঙে শুকনা। ছোট পিপুলু আদুরে একটা মুখ। ফাইভ, সিক্সের মেয়ে বলেও তাকে অনায়াসেই চালিয়ে দেওয়া যাবে। বাবা- মায়ের শেষ বয়সের সন্তান। পুষ্টির অভাবে না গুঁষ্টির দিকে গেছে কে জানে। তার মা, মামারও একই অবস্থা। ছোট খাটো মানুষ এরা। বয়স বাড়ছে না কমছে দেখে বোঝার উপায় নেই। তবে তা নিয়ে এই বেচারি পড়েছে মহা বিপদে। একটু মোটা লম্বা হওয়ার জন্য কি যে কসরত করছে। একমাত্র আল্লাহই জানে।

সাবা তাকে দেখেই নায়িকা ববিতার মতো কান টান ঢেকে দিলো এক চিৎকার । এই মেয়ে নাটক করতে উস্তাদ। অবশ্য নাটক করলেও তার খুব নেওটা। চড়, থাপ্পড় তো কম দেয় না। তাও পিছু ছাড়ে না। পিছু পিছু ক্যাংগারু মতো লাফাবে আর মাথা খাবে। অবশ্য না খেয়ে উপায় কি? বড় হলো তার হাতে পায়ের নিচে। সে চিৎকার দিয়েই বলল, — কি হয়েছে আপু?

তার চিৎকারে মা ঘর থেকে দৌড়ে এলো। তার মায়ের নাম সুলতানা বেগম। বিয়ের আগে ছিল শুধু সুলতানা। আগে পিছে কিছু নেই। নানার নাম ছিল সুলতান, সুলতানের একমাত্র কন্যা সুলতানা। এই শুধু সুলতানা নিয়েতো আর সমাজে টেকা যায় না। তাই বিয়ের আগে যোগ করেছিল আক্তার, বিয়ের পরে সেটাকে চুটকি মেরে উড়িয়ে বসিয়েছে বেগম। এখন আপতত এটা দিয়েই চলছে । মনে হয় বাকি জীবন এটাই চলবে। কেননা মেয়েরা দু- বারই নিজের আর নামের খোলস বদলায়। এক জন্মের সময়, দুই বিয়ের সময়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর বদলা বদলি নেই। বিয়ের পরে যেটা হবে সেটাই পার্মানেন্ট। সেই বিয়ে থাক, না থাক। নামের আর বদলা বদলি নেই।

সুলতানা দৌড়ে এসেই চিন্তিত ভাবে নিশাতের হাত, মুখ, শরীরে হাত বুলালো। সব তো ঠিকিই আছে। জামা ভরা এতো রক্ত কেন? আল্লাহ! হয়েছে টা কি? একা একা কোথায় কোথায় যায় তার তো কোন ঠিক ঠিকানাই নেই। কত করে বলছে, এই ছাইয়ের চাকরি করার দরকার’ই নেই। কতো ভালো ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ আসে। এই মেয়ে তো শুনেও শুনে না। একবার গায়ে দাগ লাগলে, সেই দাগ মোছার ক্ষমতা কি আর তার আছে?

মায়ের চিন্তা নিয়ে নিশাতের তেমন ভাবান্তর হলো না। তার মায়ের চিন্তার এক বিশাল ডাব্বা আছে। সেই ডাব্বা ভর্তি চিন্তা আর চিন্তা। আজকে রান্না করবে কি, সেই নিয়ে চিন্তা। তেল এক মাস যাবে কি না, সেই নিয়ে চিন্তা। আজকে কি কি কাজ করতে হবে তা নিয়ে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই বিশাল চিন্তা। সাবা স্কুলে যাওয়া, তার ভাইয়ের শরীর, ভাইয়ের বউর মেজাজ। তার মধ্যে এক্সট্রা সাবজেক্ট হলো, তার মেয়ে দামড়ি হচ্ছে, বেহায়া হচ্ছে, লাজ লজ্জা দিনকে দিন নাই হচ্ছে। সেটা নিয়ে এক সাগর চিন্তা।

তাই সে জুতো খুলতে খুলতে স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — কিছু হয়নি মা।

— কিসের কিছু হয়নি! জামা ভরা এসব কি?

নিশাত নিজের দিকে তাঁকালো। সিএনজিতে দু-জনে ধরাধরি করে বসেছিলো। মাথায় চেপে ধরে ছিলো ওড়না। ধরলেও কি? তার গায়ের রক্তে পুরো মাখামাখি হয়েছে। ধুর! কোথাকার কে না কে? তার রক্তে মাখামাখি হয়ে বসে আছে।

সে বিরক্ত মুখেই বললো,– একজন এক্সিডেন্ট করেছিল, সাহায্য করেছি। চিন্তার কিছু নেই। বলেই ভেতরে চলে এলো। গোসল করা দরকার।

সুলতানা হাঁফ ছাড়লো। তার কলিজায় পানি নেই। এমনিতেই এই মেয়েকে নিয়ে থাকে সে দুনিয়ার চিন্তায়। পেটে রাখলে কি হবে? কোন পদের যে হয়েছে সে তো ঠাওর’ই করতে পারে না।

নিশাত কাপড় টাপড় নিয়ে সোজা বাথরুমের সামনে এসে দাঁড়ালো! দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো!

এই বাড়িতে কোন অ্যাটাচ বাথরুম নেই। ছোট্ট ফ্ল্যাট! একটা ছোট্ট ড্রইংরুম আর তিনটা রুমই তার মামা অতি বুদ্ধি নাড়িয়ে চাড়িয়ে কোন রকম করেছে। খাট, আর একটা আলমারি ছাড়া কিছু রাখতে গেলে দশবার চিন্তা ভাবনা করেও কূল কিনারা মেলে না। সেই বাড়িতে একের অধিক বাথরুম থাকা বিলাসিতাই বটে। তাই পুরো বাড়িতে একটাই কমন বাথরুম। কেননা দেড়- কাঠার জমিতে তার মামা, অবশ্য মামির ভাষ্য মতে এক বেলা কোনরকম খেয়ে, ছেঁড়া শার্ট – স্যান্ডেল পরে, ঈদে কাপড় টাপড় না নিয়ে, সখ – আহ্লাদ ইত্যাদি ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে এই জায়গা নাকি কিনেছে, কিনে রাতের ঘুম হারাম করে দু- তলা বাড়িটা করেছে। নিচের টুকু আপাতত ভাড়া। এই ভাড়া বাড়ির দ্বিতীয় তলায় উঠতে হয় খুবই চিকন সরু সিঁড়ি দিয়ে। এমন না আরেকটু চওড়া হতো না। মামা জায়গা বাঁচানোর কোন রাস্তাই ছাড়ে নি। যদি সিঁড়ি ছাড়া দোতলায় উঠার গায়েবী কোন ব্যবস্থা থাকতো তার মামা জান প্রাণ দিয়ে সেটাও করে ফেলতো।

নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেলেই মাথা নাড়লো। নেড়ে চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এলো। সে, সাবা, আর মা থাকে এক রুমে, বাকি দুটোর একটাতে মামা, মামি আরেকটায় সজল ভাই । সজল ভাই তার মামাতো ভাই। তারা দু- বছরের ছোট বড়। সে লেখাপড়া করলেও সজল ভাই অর্ধেক গিয়েই শেষ। তার নাকি ভালো লাগে না। মামা – মামিরও কোন মাথা ব্যথা নেই। বর্তমানে মামার সাথে দোকানে বসে। সেই দোকান থেকেই মনে হয় ফিরেছে। রুমের দরজা তো হাট করে খোলা। হয়ত এসেই ফ্রেশ হতে বাথরুমে গেছে। এই বান্দার এক মুদ্রা দোষ। দুনিয়া উল্টে যাবে, তবে বাথরুমের ভেতর থেকে কথা বলবে না।

নিশাত এসে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো। হেসে সুন্দর করে দরজায় একটা টোকা দিলো।

সজল ভাই ভেতর থেকেই গলা খাঁকারি দিলো। এটা সংকেত! মানে সে ভেতরে আছে। নিশাত আবারো টোকা দিলো। এবার অবশ্য কোন শব্দ নেই। জানা কথা, করবেও না। তার ধৈর্য্য ওই গলা খাঁকারি দেওয়া পর্যন্তই। তবে নিশাত জানে, এখন আস্তে আস্তে সজল ভাইয়ের মেজাজের পারদ আকাশ ছুঁবে।

নিশাত আবার টোকা দিলো। এবার অবশ্য একটা না। পরপর কয়েকটা, যেন খুব প্রয়োজন। তখনি কল ছাড়ার শব্দ হলো। মানে এখন বের হবে। নিশাত টুক টুক করে আরো দুটো দিলো, দিয়েই এক দৌড়।

সজল ফট করে দরজা খুলেই এক হুংকার ছাড়লো। বাথরুমের দরজা লক, তবুও কে এমন দরজা ভাঙলো?

ছেলের হুংকার শুনে হেনা বেগম উঁকি দিলো। এমনিতেই আপতত সে আছে মহা টেনশনে। সজলের বাবা শেষ বাজার থেকে এক কাতলা মাছ পাঠিয়েছে। কাতলা মাছের অবস্থা বড়ই শোচনীয়। ধরতেই গলে যাচ্ছে। সুলতানা বুহু কষ্টে আষ্টে টাষ্টে ছাড়িয়ে কেটে নিয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে পঁচা দেখে কম দামে দিয়ে বেঁচেছে।

বেচুক! সমস্যা সেটা না। তার এতো বছরের সংসারে এমন পঁচা দঁচা দেখে খেয়ে তারা সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত। সমস্যা হলো, ফোন দিয়ে বলেছে মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট করতে। অথচ বাড়িতে মুগ ডালের এক দানাও নেই। মুড়িঘন্ট টা করবে কি দিয়ে। মুড়ি দিয়ে? বাড়িতে এসেই পুরো বাড়ি মাথায় নেবে।

সে বিরক্ত মুখেই বললো, — ষাঁড়ের মতো এমন চেঁচাচ্ছিস কেন?

— চেঁচাবো না! হাজার বার বলেছি বাথরুমে গেলে টুকাটুকি করবে না ।

— কে টুকাটুকি করলো?

— আমি কিভাবে বলবো? চোখের মধ্যে তো এক্সট্রা পাওয়ার নেই। ভেতর থেকে বসে বসে দেখবো বাইরে কে?

হেনা আর কথা বাড়ালেন না। রান্না ঘর থেকে বের হলেন। রান্না সুলতানাই করুক। এমনিতেও কাজ টাজ তার ভালো লাগে না। তবে কপালগুণে জামাই পেয়েছে যমেরগুরু। বসা দেখতেই পারে না। ভাগ্যিস সংসার ভেঙে সুলতানা এসেছিলো। তা না হলে গায়ের হাড্ডি একটাও আর আস্ত থাকতো না। তাই এই কাতলা মাছের কালবৈশাখী, যা যাওয়ার সুলতানার উপর দিয়েই যাক। অবশ্য গেলেও সমস্যা নেই। সুলতানা ঠান্ডা প্রকৃতির বোকা মহিলা। বোকা হলেও কঠিন। সব কিছু খুব স্বাভাবিক ভাবে হজম করে, শান্ত ভাবে চুপচাপ বসে থাকে।

চলবে…….