প্রাচীর পর্ব-১৫+১৬

0
727

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৫

সুর্বণা মনের ক্লেশ মনে চেপে ছেলের বউকে বরণ করলো। ছেলে তার বউ এনেছে, বরণ না করে উপায় আছে। সে শান্ত মুখে বরণ করলো, মিষ্টি মুখ করালো। গলায় মোটা স্বর্ণের চেইন পরালো। তারপর ভাইয়ের বউদের ইশারা দিলো ভেতরে নিয়ে যেতে।

তারাই নিশাতকে একেবারে ড্রইংরুমে এসে বসালো। তবে সুর্বণার মা আফসানা হক একটু দূরেই রইলেন। না তিনি এগিয়ে গেলেন, না মিষ্টি মুখ করালেন। ওয়াহিদ দেখলো! চুপচাপ হওয়ার কারণে সবার সাথেই তার সখ্যতা কম। তবে নানুর সাথে ভালো। বড় মেয়ের প্রথম নাতি। তার কদর সবার কাছেই বেশি। তবুও সে আজ এগিয়ে গেল না। সব সময় যা করে তাই করল। সোজা নিজের রুমে এলো। সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। চাইলেই ফট করে কিছু ঠিক হয় না। এই বাড়ি, ঐ বাড়ির সবাই একটা অ্যাক্সিডেন্টে আটকে আছে। অথচ দোষ যাদের তারা কেউ’ই আর জীবিত নেই।

সে ফ্রেশ হয়ে কফি নিয়ে দ্বিতীয় ফ্লোরে এসে দাঁড়ালো। ডুপ্লেক্স বাড়ি, এখান থেকে নিচের পুরোটাই দেখা যায়। সে তাঁকিয়ে রইল তার নব্য বধুর দিকে। যে কিনা বসে বসে হাই তুলছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার কোন কিছুতেই কোন আগ্রহ নেই।

নিশাত হাই তুলে আশ পাশ দেখলো। নতুন কিছু নেই। টাকাওয়ালা মানুষের ড্রইংরুম। অভিজাত্যের ছোঁয়া তো থাকবেই। এই আর কি? বরং না থাকলেই অবাক হওয়ার বিষয় হতে।

সে হাই তুলেই আরাম করে বসলো! সারাদিন গেছে দৌড়াদৌড়ি তার মধ্যে আবার বিয়ের ঝামেলা। শরীর এখন বিছানা বিছানা করছে। তবে বেহুদা তাকে এখানে বসিয়ে রেখেছে কেন কে জানে? এমন তো না গ্রাম শুদ্ধ মানুষ এসে দেখে দেখে যাচ্ছে। যে ঢংয়ের বিয়ে তার আবার রিতি নীতি। একগাদা মিষ্টি ঠেলে খাওয়ালো। খাইয়ে হবে টা কি? জন্মের সময় মধুতে কাজ হয়নি আর হবে এই মিষ্টিতে।

তার পাশেই বসা নিতু পেঁচির ছেলে। নিতু পেঁচির ছেলে হলেও কিউটের ডাব্বা। মন ভালো নেই তা না হলে এতক্ষণে গালে দু- তিনটা মোচড় খেয়ে ফেলতো। কিউট বাচ্চাদের গাল হয় কি জন্য। এই মোচড়া মোচড়ি খাওয়ার জন্যই তো। তবে এমন ভদ্র বাচ্চা সে জীবনে কম’ই দেখেছে। সেই বিয়ের পর থেকে এই ছেলে তার আশে পাশে। গাড়িতেও ছিল তার পাশে। এমন না গায়ের উপরে উঠে আসছে বা দুষ্টামি করছে। চুপচাপ তার সাথে সাথে বসে আছে। এই যে বসে আছে সেও বসে আছে। চোখে মুখে ঘুম ঘুম ভাব। তার সাথে সেও হাই তুলছে।

তখনি নিতু এলো! নিতুর মেজাজ খারাপ। তবে সমস্যা হলো এতদিন ঝট করে মেজাজ দেখালোও, আজ কেন জানি দেখাতে পারছে না। এই জন্যই বলে বাপের বাড়ি সেই পর্যন্তই বাপের বাড়ি যেই পর্যন্ত ভাইয়ের বউ না আসে।

নিতু মেজাজ খারাপ করেই চেঁচিয়ে কনা নামের কাউকে ডাকলো। শুকনো কালো মতো এক মেয়ে দৌড়ে আসতেই বললো — বাবু এখনো এখানে বসা কেন? সব নিয়ম ভুলে গেছো না। থাপড়ে দাঁত ফেলে দেব। একটু খেয়াল না করলেই গা ছড়িয়ে বসে থাকা।

মেয়েটে ঝটপট এগিয়ে আস্তে করে বললো, — নিনিত বাবা চলো ঘুমাবে।

নিনিত একবার নিশাতের দিকে তাঁকালো। একটু হেসে বললো, — গুড নাইট মামি।

নিশাত তা বিখ্যাত হাসি হাসলো। নিনিতের জায়গায় সাবা থাকলে উল্টো দৌড় দিতো। তবে নিনিত দিলো না। সে তার মতোই একটু হেসে সেই কনা নামের মেয়ের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে চলে গেলো।

সে যেতেই নিশাতের যাওয়ার হুকুম হলো। সেই হুকুমেই নিশাত ঝট করে উঠল। উঠে সুর্বণার দিকে তাঁকালো। সে বসে আছে তার মা, ভাবিদের মাঝে। সে এক পলক তাঁকিয়েই এগিয়ে গেল।

নিশাতকে ওয়াহিদের রুমে নিয়ে এলো নিতু আর তার মামি। এনে বিরক্ত মুখে বললো, — ভাইয়ার রুমে মতব্বরি কম করবে। এমনিতেও সে কাউকে এলাউ করে না। বউ তো অন্য রুমে রাখা যায় না। তাই সাবধান! মিডিলক্লাস ফ্যামিলির মেয়েদের আবার এক সমস্যা। এসেই আমার বাড়ি, আমার সংসার, আমার স্বামী বলে মরতে থাকে।

নিশাত আবারো হাই তুললো! বিয়ের না করতে করতেই জীবনডা তেনাতেনা। সে হাই তুলেই বললো, — বউ অন্য রুমে রাখা যায় না, তোমাকে কে বললো। রুম তো যেমন তেমন কত মানুষের বাড়িই আলাদা থাকে। তাই এক কাজ করো। আমাকে অন্য রুম দিয়ে দাও। এতবড় ভিলায় রুমের তো অভাব হওয়ার কথা না। তার কমফোর্ট রইল, আমারও।

নিতু চোখ চড়কগাছ করে বললো, — বাড়ি আলাদা মানে কি? আর তুমি আমাকে তুমি করে বলছো কেন?

— বাড়ি আলাদা মানে এই যে আপনার মতো শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি। এখানে দোষ না হলে, আলাদা রুমে থাকলে হবে কেন? আর তাছাড়া তুমি, আমি তো বলতেই পারি। বড় ভাইয়ের বউ। তবে তুমি কোন হিসেবে বলছো বুঝতে পারছি না। যতদূর মনে পড়ে আমি এক বছরের বড়।

— তুমি কি আমাকে খোঁটা দিচ্ছো?

— একদম না। সত্য বললাম। রুমে এলাউ না করলে জোর করে থাকার দরকার কি?

— আমি এটার কথা বলিনি।

— আমিও কোনটার কথা বললাম! শুধু বললাম বয়সে বড়, বড় ভাইয়ের বউ। তুমিতো বলা’ই যায়। তাছাড়া ছোট বেলায় কতো একসাথে পুতুল বউ খেলেছি।

— বড় বড় করছো কেন? বড় হয়েছো তো কি হয়েছে?

— কিছু না। আল্লাহ তালায়া আমাকে এক বছর আগে পাঠিয়েছে। এতো তো তোমার বা আমার হাত নেই। তাই তুমি তুমিতে কাটাকাটি।

নিতু টাসকি খেয়ে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইল। কোন দিকের কথা কোন দিকে গেলো সে ধরতে পারছে না। সারা জীবন চটাং চটাং তো সে বলে এলো। আজ কথা খুঁজে পাচ্ছে না কেন? তাছাড়া এমন চটং চটং কথা তো শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সে নিজেও কখনো বলেনি। অথচ এই মেয়ে কতো অবলীলায় বলছে। কিসের দেমাগ এই মেয়ের। সে আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলো। নিতুর মামি পরিস্থিতি সামলালেন। তিনি মাঝে কথা বলে বললেন। আচ্ছা ঠিক আছে। রাত তো কম হলো না। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও। তাছাড়া ওয়াহিদ রুম থেকে খুব একটা বের হয় না। আমাদের জন্যই হয়তো আসতে পারছে না। নিতু আসো। বলেই তিনি নিতুকে টেনে নিয়ে গেলেন। তার মনে খুশির লাড্ডু ফুটছে। বিয়ে হয়েছে পর থেকে এই ননাসের যন্ত্রনায় ওষ্টাগত। সব কিছুতে মাতব্বরি। আর তাদের শাশুড়ি। মেয়ে যা বলবে সেটাই ঠিক। এর কোন ডান বাম নেই। এখন নিজের বউকে পারলে সামলাও। এই মেয়েকে বাগে আনা চাট্টি খানি কথা হবে না।

নিশাত রুমে এসে অবাক তো মামুলি ব্যাপার স্যাপার। বলতে গেলে ঝটকাই খেলো। না রুম দেখে না। রুম আর এমন কি? টাকাওয়ালা মানুষ। এমন বেড রুম হবে না কেমন হবে। তারা সিম্পল জিনিসও করে লাখ টাকার সিম্পল জিনিস দিয়ে। তাই রুম যেমন খুশি তেমন হোক! তারা মামা বাড়ি নিয়ে যেমন মাথা ব্যথা নেই। তেমন এ বাড়ি নিয়েও নেই। সে তো ঝটকা খেলো, একটা ছবি দেখে।

বেডরুমটা তিন অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে বেডরুম, মাঝে ওয়াশরুম চেঞ্জিংরুম। বাকিটুকু সুন্দর কাচ ঘেরা একটা খোলা জায়গা। যাকে রুমও বলা যায় আবার বিশাল একটা বারান্দাও বলা যায়। কাচগুলোর দেওয়ার ঘেঁষে বড় বড় লম্বা সাদা পর্দা। কোন ফার্নিচার নেই। তবে সুন্দর সুন্দর বসার ফ্লোর কুশন আছে। কাচের দেয়ালের ওপাশে রেলিং ঘেঁষে কুঞ্জলতা ফুটে আছে। আর এই কাচ ঘেরা রুমের ইট, পাথরের দেয়ালে সুন্দর একটা ফ্রেমে বাঁধাই করা একটা ছবি। ছবিটা তাদের ছোট বেলার বিয়ের ছবি। মাথায় জরিওয়ালা বিয়ের ঘোমটা, পুরো চোখ জুড়ে কাজল, ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক। মুখ ফুলিয়ে বসে আছে নিশাত। যেন কোন কিছু নিয়ে খুব রাগ। তার পাশেই ওয়াহিদ। এগারো বারো বছরের ওয়াহিদ। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। পুরো মুখে সে রুমাল চেপে বসে আছে।

নিশাত শান্ত চোখে এই ছবির দিকে তাঁকিয়ে রইলো। তখনি ওয়াহিদ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই নিশাত বললো, — এমন ফাজলামি কারো সাথে না হোক।

— কেন?

— এটা অন্যায়।

— দুনিয়াতে সব ঠিক হতে নেই।

— কি জানি বাপু। যাদের জীবনে সব কিছু ঠিক। তারা ঠিক বেঠিকের বুঝবে কি? বলেই নিশাত চেঞ্জিং রুমের দিকে এগুলো। চেঞ্জ করা দরকার।

ওয়াহিদ পেছন থেকে ডাকলো, — নিশাত।

নিশাত ঘুরে দাঁড়িয়ে গেলো। ওয়াহিদ একটু থামলো। তারপর বললো, — কফি!

নিশাতও তার মতো কিছুক্ষণ থেমে তাঁকিয়ে রইলো। তারপর সোজা বললো, — না।

— কেন?

— কেন আবার কি? না খেলে এখন জোর করে খাওয়াবেন?

— খাওয়াতেও পারি। হক আছে আমার।

— হকগিরি অন্য কোথাও গিয়ে দেখান। তাছাড়া সামনে এলে ঘুষি মেরে নাকের মানচিত্র চেঞ্জ করার কথা ছিল। ভাগ্য ভালো সেটা করছি না।

— করে ফেলো! তোমার উপরে কেন জানি ঠিক ঠাক রাগ করতে উঠতে পারছি না। করলে যদি পারি।

— পেরে কি করবেন?

— রাগ উঠলে ওয়াহিদ সব পারে। বিয়ে করেছি, যা এখন করতে পারছি না, সেটাও করে ফেলতে পারি ।

নিশাত হাসলো! হেসে বললো — চেষ্টা করে দেখতে পারেন। পরে খুন টুন হলে এর দায় নিশাতের না।

— না হলেও হেডলাইন খারাপ হবে না। বাসর রাতে নব বধুর হাতে স্বামী খুন।

নিশাত আর উত্তর দিলো না। সময় নষ্ট! বলেই ব্যাগ থেকে কাপড় বের করলো। করে সোজা চলে গেলো। বেরিয়ে দেখলো ওয়াহিদ বেডরুমের ডিভানে বসা। হাতে কফি! এই রুমেই কফির ব্যবস্থা আছে। বড় লোকদের বড় বড় কারবার। তা না হলে এমন তিতকুটে বিষ কে সখ করে খায়। নিশাত এবারো আর কথা বাড়ালো না। কমফোর্টার জড়িয়ে শুতে গেলো। পুরো দমে এসি ছাড়া। তার শীত শীত করছে।

তখনি ওয়াহিদ বললো, — বিয়েটা কেন করেছো নিশাত?

নিশাত গলা পর্যন্ত কমফোর্টার টেনে শুয়ে বললো, — আমি একটা শান্তির জীবন চাই তাই।

ওয়াহিদ নিশাতের দিকে তাঁকালো । সে পুরো প্যাকেট হয়ে গেছে। এসির রিমোট নিয়ে পাওয়ার কমিয়ে দিলো। দিয়ে বলল, — সেই জীবনটাই কি আমার কোন অংশ আছে?

— না।

— আমি যদি করে নিতে পারি?

— পারবেন না!

— কেন?

— এই প্রাচীর ভেদ করা এতো সোজা না।

ওয়াহিদ আর উত্তর দিলো না। কফিতে চমুক দিলো। নিশাত হাসলো! চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে গাইলো, — আমার বাড়ি আইসো ভোমর, বসতে দেবো পিঁড়ে, জলপানও করিতে দেবো, শালি ধানের চিঁড়ে।

লাইন গুলো কবিতার ! নিশাত এতো সুন্দর করে সুর তুলে গাইলো। ওয়াহিদ মুগ্ধ হয়ে নিশাতের গান শুনলো। তার মনে হলো। এর চেয়ে সুন্দর কোন গান সে আর কখনো শুনেনি।

_______

বিবাহিত জীবনের প্রথম সকাল শুরু হলো নিশাতের মিষ্টি সুবাসে! সুবাসটা কিসের সে ধরতে পারল না। তবে চেনা কোন ফুলের। সে নড়ে চড়ে এ পাশ থেকে ওপাশে ফিরলো। কেউ খুটখাট শব্দ করছে। কে রে ভাই! এতো সাত সকালে কোন কাজের তেল উঠেছে। সে বিরক্ত হলো! বিরক্ত হয়ে চোখ খুলতেই দেখলো ওয়াহিদ তার ঠিক সামনে বসা। পুরো রেডি টেডি হয়ে। ঠকঠক সে জুতো দিয়ে করছে। আর সুবাস তার থেকেই আসছে।

সে উঠে বসলো! বিরক্ত মুখে বললো, — আমার সারাদিনটা খারাপ না করলে হতো না? এই থোবড়াটা তো আমাকে না দেখিয়েই যেতে পারতেন। নাকি টিপক্যাল বউ চান। অফিসে যাওয়ার সময় পিছু পিছু ঘুরবে, টাই বেঁধে দেবে, যাওয়ার পরও রাস্তার দিকে ঘন্টা খানেক তাঁকিয়ে থাকবে।

— এটাকে টিপিক্যাল বউ বলে না, একে বলে ভালোবাসা।

— এতো ভালোবাসার দরকার তো বসে ছিলেন কেন? মেয়ের তো অভাব হওয়ার কথা না।

— মেয়ের অভাব এখনো নেই। তবে বউয়ের অভাব আছে ।

— সেটা সারা জীবন’ই থাকবে। এখন জানতো ঘুমের দফারফা করছেন কেন? আমি আপনাকে জ্বালাচ্ছি? তো আমাকে জ্বালাচ্ছেন কেন? নিজের মতো থাকুন না।

— জ্বালাচ্ছো না?

নিশাত উত্তর দিলো না। ধুর! বলেই আবার শুয়ে পড়ল। ওয়াহিদও উঠল! কালকের অনেক কাজ পেন্ডিংয়ে রয়েছে। তাই সকাল সকাল’ই বেরুতে হবে। সে বেশ কয়েকটা ফাইল নিশাতের সামনে রাখলো। রেখে বললো, — প্রপার্টির দলিল। সিগনেচার করে রেখো। বাকি কাজ আমি কমপ্লিট করে দেবো। ক্যাশ কোথায় ট্রান্সফার করবো, সেই ডকুমেন্ট দিও। আর বলেই একটা চেকবুক নিশাতের সামনে রাখলো। রেখে বললো তোমার কাবিনের টাকা।

নিশাতের তেমন ভাবান্তর হলো না। ওয়াহিদ এগিয়ে নিশাতের সামনে বসলো। নিশাত কিছু বলবে তার আগেই কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। নিশাত কোন রিয়্যাক্ট দেখালো না। তবে তার পুরো মুখে কাঠিন্যতা যে ছেয়ে গেছে ওয়াহিদ তা ঠিক দেখলো। দেখে বললো, — যেভাবেই হোক আমরা একটা সম্পর্কে বেঁধেছি নিশাত। পবিত্র, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক টা রাখার আমার তরফ থেকে কোন কমতি থাকবে না। তবে কোন কিছুই এক তরফ থেকে কিছু হয় না। দু- জনকেই এগুতে হয়। তুমি কি একটু এগুবে নিশাত?

— যদি বলি না ! হাল ছেড়ে দেবেন?

— না।

— তাহলে আর বলে লাভ কি? যা খুশি করুন।

— ভালোবাসা হলো ছোঁয়াচে রোগের মত। এক ঘরে, এক রুমে, এক খাটতে থাকবো। একজনের অনুভূতি আরেকজনে ছোঁবে না। এটা কখনো হবে না। হবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

— দেখা যাক।

— হ্যাঁ অবশ্যই বলেই ওয়াহিদ উঠল। পার্স মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিশাত সেই যাওয়ার দিক থেকে সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। বিয়ে হতে না হতেই ভালোবাসা উপচে পড়ছে। হুহ্!

চলবে…..

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৬

নিশাত বের হলো একেবারে রেডি হয়ে। গায়ে তার মেরুন রঙের থ্রিপিস। মাথায় হালকা ঘোমটা। নাকে হীরের ছোট্ট নাকফুল। সুর্বণা নিশাতকে দেখলো খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ঘোমটা নাকফুল ছাড়া বিয়ের কোন লক্ষণ তিনি দেখতে পেলেন না। সে শান্ত ভাবেই বললেন, — কোথাও যাচ্ছো?

নিশাত একেবারে গলে গেল। যাবে না কেন? শাশুড়ি মা বলে কথা! শ্বশুর বাড়িতে শান্তির প্রধান মন্ত্র হলো শাশুড়ি। শাশুড়ি ঠান্ডা, পুরো দুনিয়া ঠান্ডা। সে ভাই আগেই বলেছে সে শান্তি প্রিয় মানুষ। এখন শান্তির উৎসকে গলার মালা বানাবে না তা হয়? সে তাকে খেয়াল করেনি এমন ভাবে জিভ কাটলো। কেটে সোজা এগিয়ে গেলো সালাম করতে। সুর্বণা কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। হকচকিয়ে বললো, — এসবের কোন প্রয়োজন নেই।

নিশাত হালকা হাসলো! সোজা দাঁড়িয়ে বললো, — স্যরি মা! আসলে ঘুমোতে ঘুমোতে খুব রাত হলো। আপনার ছেলেই বললো, – কফি খাবে? আমরা গরীর মানুষ। কফি টফির অভ্যাস আছে নাকি। খেয়ে ঘুম উধাও। গল্প করতে করতে কখন যে সময় গড়ালো বুঝতেই পারেনি। তাই সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। আপনার ছেলেকেও দেখুন একটু ডেকে যাবে তো নাকি?

সুর্বণা শান্ত চোখেই নিশাতের দিকে তাঁকিয়ে রইল। মেয়েটাকে সে বুঝতে পারছে না। তবে এইটুকু ঠিকিই বুঝেছে সুলতানার মতো সহজও না। তবুও ভেতরে কোথাও যেন জ্বলে উঠল। তার ছেলে, এই মেয়ের সাথে একই রুমে একই খাটে। সে নিজেকে শান্ত রেখে আগের মতোই বললো, — কোথায় যাচ্ছো?

— অফিসে! হঠাৎ বিয়ে। ছুটি ছাটা তো নেওয়ার সুযোগ পেলাম না। তবে আজকে গিয়েই সপ্তাহ খানের নিয়ে আসবো। নতুন বউ এমন ডিং ডিং করতে করতে অফিসে যাবে ভালো দেখায় বলেন?

সুর্বণা কিছুক্ষণ আগের মতোই তাঁকিয়ে রইলো। তারপর বললো, — দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো।

নিশাত এগিয়ে সুর্বণার পাশে বসলো। সুর্বণা আগের মতোই বললো, — আমি জানি আমাদের সম্পর্কটা আর দশটা মানুষদের মতো না। অনেক তিক্ততা আছে। তবে যা গেছে তা আর মনে রেখে লাভ কি? আমি একা মানুষ! ওয়াহিদ বলতে গেলে সারাদিন বাইরে বাইরে। নিতু নিতুর মতো! আমি এমন একটা বউ চেয়েছিলাম যে সংসারটা আলো করবে। আমার ছেলেকে ঘর মুখো করবে। পছন্দও ছিল! আমার বোনের মেয়ে। যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি ভদ্র মেয়ে। ওয়াহিদ আবার তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। এখন সব আশা ভরসাতো তোমার কাছেই রাখবো, তাই না?

— অবশ্যই! আপনি বলুন আমাকে কি করতে হবে।

— কিন্তু তুমি তো অফিসে যাচ্ছো।

— আমার আরামের চাকরি মা । মানছি এখন অনেকটা দূর হয়ে গেছে। তবে আমি ম্যানেজ করে নেবো।

— আসলে ওয়াহিদ এখনো অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কিছু বলেনি। হয়ত সব ম্যানেজ করে বলবে। তবে আমি তো আত্মীয়- স্বজন নিয়ে থাকি। দুপুরে তো সম্ভব না। তাদের যদি রাতে ডিনারের ইনভাইট করি। তুমি সব ম্যানেজ করতে পারবে? আসলে খারার টাবার তো সবাই সবার বাসাই খায়। আমার বাসায়ও কাজের লোক আছে। তবে নতুন বউদের কাছে সবাই একটু আশা রাখে।

— অবশ্যই ! আপনি কোন টেনশন করবেন না। আমি দুপুরের কিছুটা পরপর’ই এসে হাজির হবো। বুঝতেই পারছেন, কালকেও হাফ ডে করেছি। আমার তো আর আপনার ছেলের মতো বাপের অফিস না। বসে বসে বসগিরি করবো।

সুর্বণা ভ্রু কুঁচকে তাঁকালো। মেয়েটা অতি স্বাভাবিক ভাবে যে কোন কথা বলতে পারে। এতোটাই স্বাভাবিক যে কোনটা খোঁটা, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ কিছুই ধরা যায় না। তখনি মাহফুজ নামলো। নিতু এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। সেই মহারাণী নিজের মতো চলে। এমন চলে দেখেই শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতে চায় না। নিশাত হেসে বললো — আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

মাহফুজও হকচকিয়ে গেলো। সে ভাবে নি এভাবে কথা বলবে। কালকে যে মুখ করে বসে ছিল। সে ভেবেছে নিতুর টাইপ’ই মনে হয়। বিয়ে নিয়ে তো কোন মাথা ব্যথা দেখলো না। নিজের মতো ঘুরছে ফিরছে। সে হকচকিয়ে সালাম নিলো।

— নাস্তা করেছেন ভাইয়া?

— না, এখনো করা হয়নি।

— আসুন না একসাথে করি। আমারও করা হয়নি।

— না ঠিক আছে। আপনার দেরি হতে পারে ।

— একদম না, আসুন তো। আমার হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের চাকরি। একটা টিউশনিও করতাম। আর যাওয়া হবে না মনে হয়। আহারে সায়ান বাবাটা! যাক সায়ানের দুঃখ নিনিতকে দিয়ে ভুলবো বলেই নিশাত এগিয়ে গেলো। নিজেই সব কিছু মাহফুজকে এগিয়ে দিলো। মাহফুজ অবাক হয়ে বললো, — ভাবি আপনি বসুন। কাজের লোক আছে তো, তারা দেখবে।

— কি যে বলেন না ভাইয়া। হাজার কাজের লোক থাক। যত্ন, ভালোবাসা এগুলো কি কাজের লোকের কাছে পাওয়া যায়। এই যে দেখুন আপনার ভাইয়া, বিয়ের প্রথম সকালেই গায়েব। এক সাথে নাস্তা করবো তা না। আর আসবে এই রকম সকাল বলেন?

মাহফুজ নিশাতের দিকে তাঁকালো। নিশাত আগের মতোই হাসলো। হেসে সুন্দর করে গুছিয়ে মাহফুজকে সব এগিয়ে দিলো।

সুর্বণা ড্রইংরুম থেকেই শান্ত চোখে তাঁকিয়ে রইল। তখন তার মা তার পাশে বসলেন। বসতে বসতে বললেন, — নিজের সন্তান নিজের সন্তান’ই হয়। এই যে আমার মেয়ে সারমিন। কতোটা দুঃখে নিজের জীবন দিয়েছে। সে যদি তোর সন্তান হতো এতো সহজে মেনে নিতে পারতি?

সুর্বণা উত্তর দিলো না। সে নিশাতের দিকে আবার তাঁকালো! সে খুব হেসে হেসে মাহফুজের সাথে কথা বলছে। নাস্তার প্রতিটা সময় সুর্বণা খুব নিঁখুত ভাবে খেয়াল করলেন। খেয়াল করলো মাহফুজকেও। এই বাড়িতে এলে তার মুখে হাসি দেখা যায় না। শুধু যেন দায়িত্বের জন্য আসা।

নাস্তা করে সুর্বণার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা এক সাথেই বেরুলো। মাহফুজ যখন আসে বেশ কিছুদিন এখানেই থাকে। এখান থেকে অফিস করে। তারা বেরুতেই সুর্বণা বললো, — মমতা হাত বেঁধে ফেলেছে মা। নাজিম আমার কেউ ছিল না, সুলতানাও কেউ না। তারা থাকুক, মরুক, বাঁচুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তবে এবার আমার সন্তান মা। চলে গেলে আমি যে মরে’ই যাবো।

আফসানা হক বিরক্ত মুখে অন্য পাশে তাঁকালেন। সুর্বণা চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা রাখলেন! রেখে বললেন, — আমার ছেলে তাকে এনেছে, ছেলেই ধাক্কা দিয়ে বের করবে। সুর্বণা চুল পাকতে পারে বুদ্ধি না।

মাহফুজ বাইরে এসে বললো, — চলুন না ভাবি আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

নিশাত কিছু বলবে তার আগেই এক লোক এসে বললো, — স্যার আপনার জন্য আলাদা গাড়ি রেখেছে ম্যাডাম। নিশাত শুনেও শুনলো না। মাহফুজকে বললো, — আপনার সমস্যা হবে নাতো?

— কি যে বলেন ভাবি। কিসের সমস্যা আসেন তো?

নিশাত এগিয়ে গেলো। যেতে যেতে হাত দিয়ে নিজের দু’ চাপা একটু মালিশ করলো। মাহফুজ দেখে বললো, — কোন সমস্যা?

— একদম না ভাইয়া!

— আমি কিন্তু আপনাকে অন্যরকম ভেবেছিলাম।
ভেবেছিলাম খুবই কঠিন টাইপ কেউ।

নিশাত হাসলো! হেসে বললো, — আসলে ভাইয়া সব সময় আমরা যা দেখি তা সত্যি হয় না।

— একদম ঠিক বলেছেন। প্রমাণতো আমার সামনেই। ভাইয়া খুব লাকি।

নিশাত আগের মতোই ঠোঁট ভ্যাটকালো। ভেটকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। বসতে বসতে বললো, — আপনিও খুব লাকি। নিতুর মতো জীবন সঙ্গি পেয়েছেন।

মাহফুজ হাসলো! এ হাসি অবশ্য আগের মতো প্রাণবন্ত না। নিশাত দেখলো, দেখে রাস্তার দিকে তাঁকালো। তার ঠোঁটের কোণে আগের মতোই হাসি।

নিশাত অফিসে এসে দেখে একটা মেয়ে চুপচুাপ বসে আছে। মেয়েটাকে তার চেনা চেনা লাগলো। এতো মানুষ এখানে আসে বিশেষ ভাবে কারো চেহেরা মনে রাখা সম্ভব হয় না। নিশাত চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো — তোমার নামটা যেন কি?

মেয়েটা একটু মলিন ভাবে হাসলো! হেসে বললো, — আফিয়া।

নাম শুনেই নিশাতের ঝট করে মনে পড়ে গেলো। আরে হ্যাঁ! সেই মেয়েটা। নিশাত ভালো করে মেয়েটার দিকে তাঁকালো, আগের চেয়ে অনেকটা শুকিয়ে গেছে,চোখের নিচে কালি জমেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঘুম, আরাম তো ভালোই। ঠিক মতো খাবারও খেতে পেয়েছে কি না সন্দেহ।

সে একটা দীর্ঘ ছেড়ে বললো — দেখো কিছু দিনতো সময় লাগে’ই। কে কে পাবে এই লিস্টটা আমাদের হাতে এলেই আমরা সবাইকে জানিয়ে দেই।তোমার কষ্ট করে এখানে আসার প্রয়োজন নেই। যদি তোমার নাম আসে আমরা ফোন করে জানিয়ে দেব।

আফিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল। চোখটা ছলছল করছে। নিশাত কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইল। তারপর এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো –তোমার হাসবেন্ড কি করে।

আফিয়া হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা নিলো। নিয়ে অবশ্য মুখে তুললো না। হাতে নিয়ে মাথাটা নিচু করে চুপচুাপ বসে রইল।

— বলতে সমস্যা থাকলে বলতে হবে না।

আফিয়া আস্তে করে বললো– নেই!

— নেই মানে?

— ফেলে চলে গেছে! গার্মেন্টসে কাজ করতো। সেখানের এক মেয়ের সাথে। বাবা কাজ করে এক খাবার হোটেলে। তাঁর অল্প আয়ে সংসার চালানোই মুশকিল। এই সন্তানের দায়িত্ব নেবে কিভাবে। ফেলে দিতে বলে। ফেলতো দিতে পারি না আপা। কলিজায় টান লাগে। তার কি দোষ?

নিশাত হাসলো! হেসে বললো, — তার দোষ সে তোমার হাসবেন্ডের সন্তান। রক্তের দোষের চেয়ে এই পৃথিবীতে আর বড় কোন দোষ নেই। বলেই মোবাইল তুলে নিলো। নিয়ে ফোন দিতে দিতে বললো, — যেই নাম্বার দিয়েছো, সেটায় বিকাশ নাম্বার আছে?

আফিয়া মাথা নাড়লো। সে ফোন করেছে ওয়াহিদকে ধরলো আসিফ। তার স্বভাব মতো অতি ভদ্র ভাবে বললো, — আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম।

— ওয়া আলাইকুমুস সালাম আসিফ সাহেব। যতদূর মনে পড়ে এটা আপনার স্যারের নাম্বার।

— জ্বি ম্যাডাম! তবে স্যার মিটিংয়ে আছেন।

— এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় মিটিং হলো বউয়ের সাথে। বউয়ের সাথে মিটিং বন্ধ এই দুনিয়ার সব কার্যক্রম বন্ধ। এখন আপনার স্যারকে দিন। পাঁচ সেকেন্ড সময় দিলাম। তা না হলে আপনাদের সব কার্যক্রম বন্ধের ব্যবস্থা আমি করবো।

আসিফ দৌড়ে গেলো! এই মেয়ের ভরসা নেই। দৌড়েই কনফারেন্স রুমে সোজা ঢুকে গেলো। ওয়াহিদ বিরক্ত চোখে তাঁকালো। আসিফ অসহায় ভাবে বললো, — স্যার নিশাত ম্যাডাম লাইনে আছেন?

সবার দৃষ্টি ওয়াহিদের উপরে। সে খুক খুক করে কাশলো! এমন ঘটনা এই অফিসে প্রথম। সে কেশে একটু হেসে বললো, — মাই ওয়াইফ! হয়তো ইমারজেন্সি। বলেই ওয়াহিদ উঠল। টান দিয়ে আসিফের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে গটগট করে নিজের কেবিনে চলে এলো।

কনফারেন্সের সবাই অবাক হয়ে তাঁকালো! স্যার বিয়ে করেছে নাকি? আসিফ হেসে বললো, — এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্যারের বিয়ের বয়স এই কোম্পানির সমান সমান। তাই কষ্ট করে দু- মিনিট ওয়েইট করুক।

ওয়াহিদ এসে হ্যালো বলতেই নিশাত বললো, — একটা একাউন্ট নাম্বার সেন্ড করছি। আমার সব ক্যাশ সেখানে ট্রান্সফার করুন।

— করছি।

— ধন্যবাদ বলেই নিশাত ফোন রাখতে গেলো ওয়াহিদ বললো, — শুধু এই কারণেই ফোন দিয়েছিলে?

— হ্যাঁ!

— এটা আসিফের কাছেও বলা যেত।

— আসিফের কাছে আমি কেন বলবো? কে সে? আসিফ আপনার চেলা আমার তো না। আমি যা বলার আমার হাসবেন্ডকেই বলবো। ছয় কবুল বলে বিয়ে করেছি এমনি এমনিতো ছেড়ে দিতে পারি না।

— নয়।

— কি নয়?

ওয়াহিদ হেসে ফেললো! রেগে যাওয়ার মতো কাজ তবে কোন কারণে এই মেয়ে উপরে রাগতে পারছে না। কারণ কি? সে হেসেই বললো, — আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি।

— অসংখ্য ধন্যবাদ! রাখছি।

— নিশাত

— কি?

— সময় হবে?

— না।

— পাঁচ মিনিট।

— না।

— চার

— না।

— তিন

নিশাত ফোন কেটে দিলো। দিয়ে আফিয়ার দিকে তাঁকিয়ে বললো, — তোমার বাবার নাম্বারে কিছু টাকা যাবে। সেগুলো দিয়ে চলো। আমি নিজে তোমার কথা বলবো। ইন শা আল্লাহ সামনের মাস থেকে ভাতাটা তুমি পাবে ।

আফিয়া কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাঁকালো। নিশাত তাদের কাজের খাতা টেনে নিতে নিতে বললো, — মেয়েদের জন্য এই পৃথিবীটা রণক্ষেত্র। এই রণক্ষেত্রে মেয়েদের সব সময় যুদ্ধ করে যেতে হয়। সেটা মেয়ে হিসেবে হোক, কারো স্ত্রী হিসেবে হোক আর মা হিসেবেই হোক। তাই সাহসী হও। যুদ্ধ তো সবে মাত্র শুরু।

কলিং বেলের শব্দ শুনে সুলতানা চমকে উঠল। এই সময় মেয়েটা বাসায় ফিরতো। ফিরে টুকটুক করে তার হাতে হাতে কাজ করতো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই জানালার দিকে তাঁকালো। তখনি সাবা দৌড়ে এলো। সুলতানা বিরক্ত মুখে বলল,– অযথা দৌড়াদৌড়ি করিস কেন?

— অযথা করবো কেন? তোমার মেয়ে এসেছে।

সুলতানা অবাক চোখে তাঁকালো। তার অবাকের মাঝেই নিশাত রুমে ঢুকে হাত পা ছড়িয়ে ধরাম করে খাটে শুয়ে পড়লো। শুয়ে বললো, — এতো অবাক হওয়ার কি আছে। হলুদ দিয়ে, মেন্দি দিয়ে বিদায় করেছো। পরের দিন ফিরতি আসবো না?

সুলতানা কি বলবে ভেবে পায় না। এই মেয়ের রং দেখতে দেখতে সে দিশেহারা। হেনা এগিয়ে এসে বললো, — আমি আগেই বলেছি এই মেয়ে দু’দিনও টিকতে পারবে না। এলাকায় আর নাক রাখা যাবে না । এক ননদ ঘাড়ে এখন আবার ননদের মেয়েও ঘাড়ে।

নিশাত তার বালিশ টেনে আরাম করে শুতে শুতে বললো, — এতো সহজে আসছি না মামি। কষ্ট করে আরো কয়েকটা দিন থাকো। তারপরে ঠিক ঘাড়ে চেপে যাবো ।

হেনা ছুটলো তার স্বামীকে কল দিতে। কি করে এসেছে কে জানে? সুলতানা অসহায় ভাবে মেয়ের দিকে তাঁকালো।

আর এদিকে ওয়াহিদ বাসায় ফিরলো রাতে। সুর্বণা থমথমে মুখে ড্রইংরুমে বসে আছে। কেন সে বুঝতে পারলো না। কেনানা নিশাত ঐ বাসায় গিয়েছে সে জানে। তার পেছনে লোক লাগানো আছে। সে কি করে না করে সব কিছুই তার কাছে আপডেট আসে।। ওয়াহিদ পাশে বসে বললো, — কি হয়েছে মা?

সুর্বণা উত্তর দিলো না। তবে নিতুর বুলেট ট্রেনের গতিতে মুখ ছুঁটলো। তার বউয়ের জন্য মায়ের আজ কত বড় অপমান হলো। থাকবে না তো কথা রাখলো কেন? অপেক্ষা করতে করতে সবাই কতো কিছু বলে বিদায় নিলো। মা মনের কষ্ট মনে চেপে তোমার বউকে মানতে চেষ্টা করছে। তোমার বউ কি করলো?

ওয়াহিদ শান্ত ভাবেই সব শুনলো। শুনে মায়ের দিকে তাঁকিয়ে বললো, — আমি দেখছি মা। হয়ত কাজ পড়ে গেছে।

সুর্বণা রাগে দাঁতে দাঁত পিষলো। সে ভেবেছিল আত্মীয় – স্বজন আসলেই একেক জন একেক কথা তুলবে। তুললেই তো নাটক শুরু। কিন্তু তার চাল তার উপরেই পড়েছে। উল্টো সবাই তাকেই খোঁচা মেরে গেলো। বউতো তাকে গোনায়’ই ধরছে না। এত বছরের জীবনে কখনও তাকে নিয়ে উপহাস করার সুযোগ পায়নি। এখন হয়ত বাসায় গিয়ে তাই করছে, ঠোঁট টিপে হেসে মরছে। আর বলছে, “কোথায় গেলো তার সব কিছু হাতে রাখার যোগ্যতা। ”

ওয়াহিদ রুমে ফিরে নিশাত কে কল দিলো। নিশাত ঘুম ঘুম কন্ঠে হ্যালো বললো। ওয়াহিদ নিশাতের ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনে কিছুই বলতে পারলো না। তবে ফোনও রাখলো না। নিশাত ঘুমিয়ে গেছে। তার ভারী নিশ্বাসের শব্দ ওয়াহিদ কান পেতে শুনতে শুনতেই খাটে গা এলিয়ে দিলো। অনেক দিন পর তার রুটিনে হেরফের হলো। না চেঞ্জ করলো না তার অতি প্রিয় কফি খেলো।

চলবে…..