#প্রাচীরপ্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৭
নিশাত সজলের রুমে উঁকি দিলো। তার হাতে গামছা আর টুথব্রাশ। বাথরুমে মামা গিয়ে বসে আছে। তাই ভাবলো একটু হালচালের খবর নেওয়া যাক। গতকাল সে ঘুমিয়েছে অনেক আগে। তাই মামা আসার পরে কি মিটিং হলো সেই আপডেট এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে সকালে সব স্বাভাবিক’ই দেখলো। মা রান্না ঘরে নিজের মতো কাজ করছে, মামি মামাকে দেখানোর জন্য কাজ না করেই চরকির মতো ঘুরছে। সাবা কে দেখলো অনেকদিন পরে বই নিয়ে বসেছে। হয়ত পরীক্ষা টরীক্ষা হবে। পরীক্ষা ছাড়া এই মেয়ে পড়ালেখার ধারের কাছেও নেই। এই নিয়ে এই বাড়িতে কারো মাথা ব্যথাও নেই। যার যার মতো সে চলছে।
সজল এখনো বিছানা ছাড়েনি। নিশাতকে উঁকি দিতে দেখলো। এই মেয়ে জীবনেও ভালো হবে না। সে উঠতে উঠতে বললো, — ভেতরে আয় নিশু।
নিশাত হাসলো! হেসে ভেতরে আসতে আসতে বললো, — জেগে আছো নাকি?
— না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলছি।
নিশাত ভেতরে এলো! চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, — দোকানে বসছো আবার?
— হ্যাঁ। না বসে উপায় কি? লেখাপড়াতো শেষ করিনি। আর করবো টাই বা কি?
— বিয়ে করবে? মেয়ে টেয়ে দেখবো ?
সজল রাগী চোখে নিশাতের দিকে তাঁকালো।
— এভাবে তাঁকাচ্ছো কেন? নাকি আবার দেবদাস হওয়ার প্ল্যান করছো?
— সাত সকালে মাথা খেতে এসেছিস?
— তোমার মাথা খেয়ে আমার লাভ কি?
— তাহলে এসেছিস কেন?
— একটা কাজে।
— কি কাজে?
নিশাত কিছু বলবে তখনি কলিংবেল বাজলো। নিশাত বড় একটা শ্বাস ফেলে বললো। এই কলিংবেল আমার দুশমন সজল ভাই। যখনি ইম্পোর্ট্যান্ট কোন কথা বলতে যাই। তখনি ঘন্টার মতো আমার মাথার উপরে ঢং ঢং করে বাজতে থাকে। আর তোমার ক্যাংগারু বোন লাফাতে লাফাতে দরজা খুলবে। খুলেই দৌড়! পুরো বাড়ির আনাচে কানাচে খবর পার্সেল করবে।
হলোও তাই সাবা দৌড়ে এলো। নিশাত বিরক্ত মুখে বললো, — দেখলে, তো দেখলো। এই মেয়ের পা আমি কোনদিন গলায় ঝুলিয়ে দেই।
সজল হাসলো! সাবা গায়ে মাখলো না। কথা বার্তা যতো কম গায়ে মাখা যায় ততোই ভালো। এই যে নিশাত আপু, সে কি মাখে? মাখে না। দুনিয়া চলে দুনিয়ার মতো, সে চলে তার মতো। তাই সাবাও চলবে সাবার মতো। সে ঠোঁট টিপে হেসে বললো, — দুলাভাই এসেছে আপু।
সজলের মুখটা মলিন হলো। মন সেটা বড়ই আজব জিনিস। জানে তোমার না, তবুও মুখ ফেরাবে না। দোকানে বসে যখন মায়ের ফোন পেলো। নিশাত এসে হাজির। তার টেনশন হওয়ার কথা। হলোটা কি? তা না হয়ে হলো উৎফুল্ল। পাপী মন! তার ধারণা এই মন না থাকলে দুনিয়ায় কোন পাপ কাজ হতো না।
সে আবার কাঁথা টেনে শুতে শুতে বললো, — যাওয়ার সময় দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যাস।
নিশাত যেমন থাকে তেমনি রইল। সাবার দুলাভাই আসার খুশিতে তাকে তেমন বিচলিত দেখা গেল না। সে এগিয়ে সজলের পায়ের কাছে বসলো। বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো — শুলে কেন? ওঠো। আমার কথা আছে।
— তোর জামাই এসেছে।
— এসেছে তো কি হয়েছে। কোলে নিয়ে দরজায় খিল দিয়ে বসে থাকবো। এই সাবা যা দুলাভাইয়ের কাছে যা। শালি আধি ঘরওয়ালি। যা আধা ঘর আপাতত সামলা। আর তুমি উঠো আমার কথা আছে।
সজল আবার উঠল! কোন কাজ আবার তার ঘাড়ে ফেলবে কে জানে? সাবা মুখ বাঁকিয়ে চলে এলো। দুলাভাইয়ের ধারের কাছে ঘেঁষবে কি? দেখলেই কলিজা ফাঁটে। আহারে! সে কি আর একটু লম্বা টম্বা হবে না?
ওয়াহিদ বসেছে খাটে। এই চেয়ারে বসার সাহস তারও হয়নি। তবে জালাল উদ্দিন আরামছেই বসে আছে। হেনা তার পাশে দাঁড়িয়েই গদগদ করছে। জামাই যখনি আসে হাত ভরে জিনিস পত্র আনে। জামাইয়ের হাত ভালো। টাকা থাকলেও মানুষের কলিজা থাকে না। তবে এর আছে। আর এমন সোনার টুকরো জামাই পেয়েও এই মেয়ে লক্কর ঢক্কর করে। যে জামাই নিয়ে সে সংসার করছে। এমন একটা জুটলে বুঝতি রে ছেরি, কত ধানে কত চাল।
জালাল ধমকে বললো, — এখানে দাঁড়িয়ে গদগদ করছো কেন? যাও জামাইয়ের জন্য নাস্তা লাগাও। সুলতানা কই। সারা জীবন ঘরের ভেতর কচ্ছপের মতো বসে থাকলে হবে। আর নিশাত কই?
ওয়াহিদ ঘড়ির দিকে তাঁকালো। তার হাতে সময় আছে দু- ঘন্টা। সিঙ্গাপুরের নতুন একটা কম্পোনির সাথে তারা যুক্ত হচ্ছে। তার জন্যই আজকে মিটিং আছে। অথচ আধা ঘন্টা এমনিতেই চলে যাচ্ছে। এই মেয়ের খবরও নেই। তাছাড়া এই সপ্তাহের মধ্যে সব কাজ গুছিয়ে ফেলবে। বিয়ের রিসিপশনটা করা দরকার। নেক্সট উইকে প্ল্যান আছে, নিশাত কেউ বলা দরকার। তা না হলে যে মেয়ে, দেখা গেলো নিজের বিয়ের রিসিপশনে নিজেই নেই।
সে ঘড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে বললো, — এসবের প্রয়োজন নেই আঙ্কেল। নিশাতকে একটু আসতে বলুন। একটু কাজ ছিল।
এই ধিঙ্গি মেয়ের কথা আর বলো না। গেলো টা কোথায়? কোন সমস্যা হয় নি তো? অবশ্য এই মেয়ের ভরসা নেই। পুরো দুনিয়াকে অশান্তিতে রেখে শান্তিতে কাজ কারবার করার বহুত নাজির আছে। বড় করলাম তো আমরাই। তাই বাবা সাবধানে থেকো।
— জ্বি না! কোন সমস্যা নেই।
— না থাকলেতো ভালোই। তবে টেনশনে মরি! কপাল পোড়াতো এদের, তার মধ্যে আবার দিতে থাকে ডিগবাজী।
তখনি সাবা এলো! জালাল উদ্দিন ধমকে বললো, — নিশাত কই রে?
সাবা ও নিজের মতো বললো, — আমি জানি না।
— জানি না মানে? দেড় ইঞ্চি ঘর। এই ঘরে এক মানুষ লাপাতা হয় কেমনে?
সাবা উত্তর দিলো না। বেশি উত্তর দিলে জ্বালা আছে। চাপা খুলে হাতে আসতে পারে। নতুন দুলাভাইয়ের সামনে দরকার কি বেইজ্জতির।
— যা জামাইকে নিয়ে ঘরে বসা। আমি দেখছি, কোথায় গেলো। বলেই তিনি তার সাইজের চেয়েও বিশাল এক হুংকার ছাড়লেন। অবশ্য এই হুংকারে কারো কিছুই এলোগেলো না। যে যার মতো যেখানে আছে সেখানেই রইল।
ওয়াহিদ তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে এই বাবা মেয়ের কনভার্সেশন দেখলো। এই বাড়ির প্রত্যেক মানুষের মাথায় গড়বড় আছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে গেলো। যেতে যেতে সাবাকে বললো, — নিশাতকে গিয়ে আসতে বলো সাবা। আমার ইমার্জেন্সি কাজ আছে।
সাবা আবার গেলো। গিয়ে অবশ্য কিছু বললো না। আপু আর সজল ভাইয়ের মাঝে চুপচাপ বসে রইল। নিশাত আপু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে। দেখতে ভালো লাগছে। ইশ! তার আপুটা। এই বদ দুলাভাই না এলে সজল ভাইয়ের সাথে কাহিনী ঠিক হয়ে যেতো।
ওয়াহিদ নিশাতের রুম ঘুরে ঘুরে দেখলো। তেমন কিছু অবশ্য নেই। একটা খাট, আলমারি, আলনা আর একটা ছোট্ট পড়ার টেবিল। সম্ভবতো সাবার! বই টই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সুলতানা নাস্তা নিয়ে এলো। ওয়াহিদ সালাম দিলো। সুলতানা সালাম ফিরিয়ে বললো, — দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো!
ওয়াহিদ বসলো! সুলতানা অবশ্য বসলো না। বসে বলবেই বা কি? তার মাথায় আসে না। ছোট বেলা এই বিয়ের সব কিছু করেছিল কায়সার ভাই আর নাজিম। নাজিমের তেমন হেলদোল না থাকলেও কায়সার ভাই নিশাতকে নেবে মানে নেবেই। তিনিই ঠিক করলেন বিয়ে দেবেন। মুখের কথার নাকি পরে জোর থাকে না।
আসলেই থাকে না। যদি মুখে মুখে কথা হতো। আজ কি এমন কিছু হতো? হতো না! সবাই তিন কুবুলকে শুধু তিনটা শব্দ মনে করে। আসলে এই তিনটা শব্দের মধ্যে আল্লাহর রহমত থাকে, শক্তি থাকে, আল্লাহর ক্ষমতা থাকে। থাকে বলেই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে থাকলেও তারা বেঁধে থাকে। সম্পূর্ণ অচেনা দুটো মানুষকে এক করে ফেলে। আবার চোখের সামনে না থাকলেও এমন এক টান তৈরি করে। মানুষটা থাকা না থাকায় কিছু আসে যায় না। সে তাকে ভেতরে ধারণ করবেই।
সুলতানার মনে হয় এই ছেলেটার ভেতরে আল্লাহ সেই টান তার মেয়ের প্রতি তৈরি করেছে। করেছে বলেই এই ছেলেটা এই বিয়েটা ভুলতেই পারেনি। তা না হলে বিয়ে করেই বিয়ের কথা কেউ মনে রাখে না। আর এই পুতুল বিয়ের মতো বিয়ে কে মনে রাখে। তার মেয়েই রাখেনি। শুধু আধা পাগল বলে। তার তো ধারণা এরকম মাথার তারছেঁড়া টেঁড়া না হলে, তার মতোই প্রেম ট্রেম করে এতদিনে বিয়েও করে ফেলতো। যে বিচ্ছুর বিচ্ছুরে বাবা।
সে এগিয়ে চেয়ার নিয়ে ওয়াহিদের সামনে রাখলো! ঘরে তো আর কিছু নেই। রাখবেই বা কিসে। নাস্তার ট্রে চেয়ারে রাখতে রাখতে বললো, — আমি নিশাতকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি নাস্তা নাও।
— আপনি বসুন আন্টি। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।
সুলতানা হালকা হাসলো! কায়সার ভাইয়ের গুণ পেয়েছে। তিনি ছিলেন মাটির মানুষ। হেসে বললো, — তুমি নাস্তা নাও! আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি বলেই বেরিয়ে গেলো।
ওয়াহিদ চায়ের কাপ হাতে তুলে নিলো। চুমুক দেবে তখনি মহারাণী এসে হাজির। হাতে গামছা, টুথব্রাশ। এসব নিয়ে কোথা থেকে ঘুরে এলো কে জানে। সে না তাঁকিয়েই চায়ে চুমুক দিলো। তার চায়ের অভ্যাস নেই। তবে খেতে ভালো লাগছে।
নিশাত এগিয়ে বললো, — আমিতো সন্ধ্যায় যেতাম’ই। বিয়ে করেছি মামার বাড়ি পরে থাকার জন্য তো না। আবার এসে ঝামেলা তৈরি করছেন কেন? আমি আগেই বলেছি জামাই আদর টাদর এখানে আশা করবেন না ।
— অন্য কিছু আশা করলে পাবো?
— আমার সাথে ডাবল মিনিংগিরি করতে আসবেন না।
— করলে কি করবে, ঘুষি মেরে নাকের মানচিত্র বাদলাবে?
— করলে করতেও পারি।
— প্লিজ! একদিন করে ফেলো তো।
— কেন?
ওয়াহিদ উত্তর দিলো না। আরেকবার চায়ে চুমুক দিলো। নিশাত দু- হাত বুকে বেঁধে বিরক্ত মুখে বললো, — কথা বলছেন কেন?
ওয়াহিদ চায়ের কাপ রাখলো। রেখে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে দাঁড়ালো নিশাতের সামনে। নিশাতের পেছনে টেবিল। দু- সাইডে হাত রেখে একটু ঝুঁকে বললো, — বললে হজম হবে?
নিশাত আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়েই বললো, — হজম টজমের কথা আমায় বলে লাভ নেই। আমি কচি খুকি না। বরং একটু চোখ ঘুরাই আপনার’ই বদহজম হয়ে যাবে।
— আচ্ছা?
— জ্বি?
— ঘুরাও দেখি?
— আমাকে গাধা মনে হয়?
— একদম না।
— তাহলে সরে দাঁড়ান। পা নিশপিশ করছে আমার। পরে ঊনিশ থেকে বিশ হলে, বংশ রক্ষা করতে কষ্ট হয়ে যাবে।
ওয়াহিদ ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে সময় দেখলো। এই সময় এতো দৌড়ে যাচ্ছে কেন? সে সময় দেখে বললো, — অফিসে যাবে?
— হ্যাঁ!
— আমি বসছি। রেডি হয়ে এসো।
— আপনার সাথে যাবো না।
— কেন?
— লাভ নেই তাই।
— মাহফুজের সাথে আছে বুঝি।
— হ্যাঁ।
— ভালো! কালকে কথা দিয়ে বাসায় ফেরোনি কেন?
— আমাকে এতো ভালো বউ মনে করার কারণ কি?
— কোন কারণ নেই।
— সেটাই! এখন আসুন। সময় মত আমি ঠিক পৌঁছে যাবো। বলেই নিশাত বেরুতে গেলো। তাকে রেডি হতে হবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতো খেজুরের আলাপের দরকার কি? তখনি কিসের মধ্যে পা বাজলো কে জানে। সে উড়ে পড়তে গেলো। এই পড়া পড়লে নাক, মুখ আর আস্ত থাকতো না। তবে ওয়াহিদ ধরে ফেললো! একে অবশ্য শুধু ধরা বলা চলে না। বলতে গেলে ঝাপটে ধরেছে।
নিশাত আবাক হয়ে বললো, — আপনি আমাকে লেং মেরেছেন?
ওয়াহিদ আগের মতোই হাসলো! আরেকটু ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো, — আমাকেও এতো ভালো ভাবার কারণ কি?
কোন কিছুকে গোনায় না ধরা নিশাত রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কেঁপেই যতো শক্তি আছে পা উঁচু করতে গেলো। ওয়াহিদ সেই পা ধরেই তাকে শূণ্যে তুলে ফেললো! কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে বললো, — রোবট থেকে মানুষ বানালাম মাত্র। ধীরে ধীরে নারীও বানিয়ে ফেলবো। আর সেই নারীর একমাত্র অনুভূতি হবে এই আবরার ওয়াহিদ।
চলবে……
#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৮
সুর্বণার সাথে নিশাতের দেখা হলো একেবারে রাতে খাবারের সময়। নিশাত ফিরেছে সন্ধ্যায়! ফিরে রুমে ঢুকেছে যে ঢুকেছে, বের হলো একেবারে এই তো কিছুক্ষণ আগে।
সুর্বণা ভেবেছিল নিশাত বাসায় ফিরেই কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করবে । তবে সেই রকম কিছুই দেখা গেলো না। নিজের মতো আছে। তাকে দেখেই কালকের মতো গদগদ হয়ে একটা সালাম দিলো। দিয়েই শেষ! এখন মাহফুজ নিনিতের সাথে খুব উৎফুল্ল নিয়ে কথা বলছে আর খাবার খাচ্ছে। এতো খুশি সে এখনো না নিনিতকে দেখেছে না মাহফুজকে। কিছুক্ষণ আগে একবার দেখলো নিনিতের গালও মুচড়ে দিলো। নিনিত ব্যথা পেয়েছে বলে মনে হয় না। বরং মিষ্টি করে হাসলো।
তখনি ওয়াহিদ বাসায় ফিরলো। একবার ডাইনিংয়ের দিকে তাঁকালো তারপর যা করে তাই করল। সোজা নিজের রুম। ওয়াহিদ তার দিকে তাঁকায়নি, তাঁকিয়েছে নিশাতের দিকে। আর এটা ভেবেই তার শরীরে আগুন জ্বলে গেলো। সে সেই আগুন নিয়েই তেজের সাথে বললো, — ওয়াহিদের জন্য একটু বসলেই তো পারতে। অতিরিক্ত কাজ না হলে তো দশটার মধ্যেই ফিরে।
নিশাত তখন ভাতে কাঁচামরিচ ডলে নিচ্ছে। এই বাড়ির মানুষেরা ঝাল খায় না। সব কিছু ফেদা ফেদা। সে ডলতে ডলতে বললো, — আমিতো বসতেই চেয়েছি । আপনার ছেলের’ই ঢং বেশি। না পেয়ে বউ পেয়েছে। বলে কোন দরকার নেই। যখন ইচ্ছে খেয়ে নিতে পারো। তারতো ফেরার ঠিক ঠিকানা নেই। তাছাড়া সব সময় নাকি সে একা একাই খাবার খেয়ে অভ্যস্ত।
— সব সময় আর বিয়ের পরে এক হলো? আমি বয়স্ক মানুষ, নিতু নিতুর মতো। এটা কি তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? সারা রাত তো আর বসে থাকার জন্য বলছি না।
নিশাত হাসলো! বড় ভুল হয়ে গেছে এমন ভাবে বললো, — কালকে থেকে আমি অবশ্যই বসে থাকবো মা।
সুর্বণা এই অবশ্যই বসে থাকবো বলায় কোন ভরসা হলো না। এই মেয়ে সত্য মিথ্যা সব এক করে অনায়াসেই বলে। আর তার জন্য কোন মাথা ব্যথাও নেই। তখনি মাহফুজ বললো, — সবারই নিজস্ব ফ্রিডম আছে মা। নিতুর যেমন নিজের মতো থাকতে পছন্দ করে। ভাবিরও এমনটা হওয়া উচিত। তাছাড়া ভাইয়া যেমন কাজ করে ভাবিও তেমন করে। ভাবি যদি নিজের ইচ্ছায় অপেক্ষা করে সেটা ভিন্ন তবে চাপিয়ে দেওয়া টা অন্যায়।
সুর্বণা বিস্ময় নিয়ে তাঁকালেন। মাহফুজ কে তিনি ছেলের মতোই স্নেহ করেন। তার ধারণা ছিল মাহফুজও তাকে মায়ের মতোই সম্মান করে। তবে আজ মনে হলো, করার জন্যই করে। সে তাঁকিয়ে বললেন, — নিতুর সাথে তুমি এর তুলনা করছো কেন? নিতু এ বাড়ির মেয়ে। সে বউ! নিতু তোমাদের বাসায় গিয়ে নিশ্চয়ই তার মতো থাকে না।
মাহফুজ হালকা হাসলো! তার বলতে ইচ্ছে করলো। নিতু থাকলোটাই কবে। তবে সেই কথায় গেলো না। শান্ত ভাবে বললো, — আমার কথায় মনে কোন কষ্ট নেবেন না মা। তবে সন্তানেরা বড় হলে তাদের দিকটা তাদের উপর ছেড়ে দেওয়া ভালো।
নিশাত কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে মাহফুজের দিকে তাঁকালো। যেন ভরা গাঙ্গে ভাসা অবস্থায় একটু কাঠের লাকড়ির সাহায্য পেলো। সুর্বণা রাতে ভাত খায় না। সাদা রুটি আর সবজি। সেই রুটিই হাতে পিষলো। পিষে তেজের সাথে কাজের লোককে বললো, — নিতু কোথায়?
কাজের লোক বলার আগেই মাহফুজ নির্বিকার চিত্তে বললো, — নিতু রাতে খাবে না মা। তার ওজন নাকি বেড়ে যাচ্ছে। তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছে।
নিশাত ঠোঁট টিপে হাসলো। পুরো গুষ্টিকে জ্ঞানদাতার নিজের পরিবারই ফাঁকা ঠনঠনা। সে ঠোঁট টিপে হেসেই বললো, — রাতে এভাবে একেবারে না খেয়ে থাকা একদম ঠিক না মা। এসিডিটি হবে তো। অল্প হলেও কিছু খাওয়া দরকার।
— তুমি নিজের চিন্তা করো।
— সেটাই তো করছি। আপনারা বুঝি আমার নিজের না ? বলেই নিনিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
মাহফুজ দেখে সুন্দর করে হাসলো। সেই হাসি দেখে সুর্বণার রাগে শরীর ফেটে যেতে চাইলো। তখনি ওয়াহিদ এসে বসলো নিশাতের পাশে। সুর্বণা আবারো অবাক হয়ে তাঁকালো! হচ্ছে কি তার বাড়িতে। ওয়াহিদ বাসায় ফিরে কখনো সাথে সাথে নিচে আসবে না। ফ্রেশ হবে, কফি খেয়ে রিল্যাক্স হবে তারপর।
ওয়াহিদ সুর্বণা থমথমে মুখ দেখে বললো, — কোন সমস্যা মা?
— না।
— ঔষুধ নিচ্ছো ঠিকমতো।
— হুম।
তখনি কাজের লোক ওয়াহিদের খাবার আনলো। তার খাওয়া দাওয়া এমনিতেও কম। রাতে আরো কম। সে খাবার নিতেই নিশাত আহ্লাদ করে বললো, চিংড়ির তরকারিটা দেই। এটা খুব ভালো হয়েছে।
ওয়াহিদ চমকালো না! ঠোঁট টিপে একটু হাসলো। সে ধরেই নিয়েছে এই মেয়ের নিত্য নতুন রুপ দেখবে। সারা দিন সে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। সকালের কান্ডের পর আর ফোন’ই ধরে নি। তার হাসির মাঝেই নিশাত এক গাদা তরকারি ওয়াহিদের প্লেটে তুলে দিলো। সুর্বণা তাঁকিয়েই বললো, — গাধার মতো কি করছো?
ওয়াহিদ মাকে থামিয়ে বললো, — সমস্যা নেই মা। আমি খাচ্ছি।
নিশাত আরো দু- চামচ ভাত তুলে দিলো। দিতে দিতে বললো, — আপনিও না মা। ছেলে মেয়েদের কিচ্ছু বলেন না। এতো লম্বা চওড়া মানুষ। এইটুকুতে কি হয় বলেন? বলেই তরকারি উপরে দু- চামচ ডালও তুলে দিলো।
ওয়াহিদ টু শব্দও করল না। তবে সুর্বণা উঠে চলে গেলো। যেতেই নিশাত বললো, — শুনুন, এখন থেকে কখন ফিরবেন না ফিরবেন সব আপডেট আমাকে জানাবেন? এই যে একা একা প্রায় খেয়ে উঠলাম। কেমন দেখায় বলেন? মা খুব রাগ করলেন। ওতো মাহফুজ ভাইয়া আমার হয়ে বললো বলে রক্ষে।
মাহফুজ হালকা হাসলো! নিশাতও হাসি ফেরত দিলো। দিয়ে আবার ওয়াহিদ দিকে ফিরে বললো, — আর কিছু লাগবে আপনার?
ওয়াহিদ শান্ত ভাবেই বললো, — লাগবে।
নিশাত গলেই বললো — কি?
ওয়াহিদ উত্তর দিলো না। নিশাত ওয়াহিদের দিকে তাঁকিয়ে মুখ বাঁকালো। বাঁকিয়ে মাহফুজের দিকে তাঁকিয়ে বললো, — আপনার কিছু লাগবে ভাইয়া?
— না ভাবি, আপনি বসুন তো! আমার শেষ। বলেই মাহফুজ উঠল! সে যেতেই ওয়াহিদ আস্তে করে বললো, — তোমাকে?
— মানে?
— ও যে জিজ্ঞেস করলে কি লাগবে।
— বাবা এক দিনেই এতো উন্নতি?
— বিয়ে করে উন্নতি না হলে পরেতো বদনাম হয়ে যাবে।
— উন্নতি হলেই যে হবে না এটা কে বললো?
— না খেয়ে মরার চেয়ে খেয়ে মরা ভালো।
— তা ঠিক! নাচতে যখন নেমেছি আর ঘোমটা তুলে লাভ কি? বলুন পতিদেব আপনার সেবায় কখন বিলীন হবো?
ওয়াহিদ হেসে ফেললো! তার হাসি দেখে নিনিতও হাসলো। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ওয়াহিদ বললো — নেক্সট ফ্রাইডে রিসিপশন টা রাখবো। তুমি কাকে কাকে ইনভাইট করতে চাও, জানিয়ে দিও।
— আমি কাওকেই চাইনা।
— ভালো। হানিমুনের জন্য কোন স্পেশাল চয়েজ আছে?
— আছে।
— কি?
— জাহান্নাম।
— গুড।
নিশাত বিরক্ত চেপে উঠে চলে গেলো। এতো মেন্দা মার্কা বেটা জীবনে দেখেনি। রাগ উঠেনা কেন? ওয়াহিদ নিশাতের যাওয়া দেখে আগের মতোই হাসলো। হেসে বললো, — অল ওকে নিনিত বাবা?
— ইয়াহ!
— মামি পছন্দ হয়েছে?
— অনেক।
ওয়াহিদ হাসলো! হেসে বললো, — আমারও।
____
নিশাত আজকে ঘুম থেকে উঠল খুব ভোরে। নিজে থেকেই উঠেছে। এক দু- বছর অন্তর অন্তর তাদের অভ্যন্তরীন প্রশিক্ষণে যেতে হয়। দু থেকে তিন দিনের কোর্স। এই কোর্সের’ই ডেট পড়েছে। সেখানেই রওনা দেবে । সে অবশ্য এখনো কাওকে বলেনি। বলার কোন ইচ্ছাও নেই। সে উঠেই কাচের রুমটায় উঁকি দিলো। খালি গায়ে শুভ্র একটা চাদরে কুশন জাপটে ওয়াহিদ ঘুমিয়ে আছে। পাশেই ল্যাপটপ!
কাজ করতে করতে সেখানেই ঘুমিয়েছে না ইচ্ছে করে ঘুমিয়েছে নিশাত জানে না। তবে গতকালও সে লাইট টাইট অফ করে আগেই ঘুমিয়েছে। ওয়াহিদ নিচে থেকে এসে আর লাইট অন করেনি। ল্যাপটপ আর কফি নিয়ে সোজা এই রুমে চলে এসেছে।
সে ফিরে এলো! এসে নিজের মতোই রেডি হলো। হালকা কিছু গোছগাছ করে বেরুবে তখনি দেখলো দরজা লক।
নিশাত বড় একটা শ্বাস ফেললো। এই বেটা তলে তলে মিচকা শয়তান। ঠিক জেনে গেছে। সে শ্বাস ফেলেই একগ্লাস পানি নিয়ে সোজা গেলো ওয়াহিদের সামনে। একবার ভাবলো পুরো গ্লাস ঢেলে দেই তবে নিজেকে সামলে হাত দিয়েই ছিটালো। সাত সকালে এতো রং ভালো লাগছে না।
ওয়াহিদ চোখ খুললো না! আরাম করে শুতে শুতে বললো, — লাভ নেই।
নিশাত বিরক্ত মুখে বললো, — দেরি হচ্ছে আমার।
— হোক।
— আমি পুরো গ্লাস ঢেলে দেবো।
— দাও! আমার বাথরুমে বাথটাব দেখেছো তো। দু- জনের জন্য একদম পার্ফেক্ট। নিতে আমার দু- সেকেন্ড লাগবে।
— এতো কাহিনী করছেন কেন?
— তোমার সাথে তো আমার কাহিনীর’ই সম্পর্ক।
নিশাত রাগে দাঁতে দাঁত পিষলো! পিষে বললো, — কি চাচ্ছেন বলুন তো ? আমি আপনার কোন কাজে ডিসটার্ব করছি? তো আমার কাজে বেগরা বাজাচ্ছেন কেন?
ওয়াহিদ চোখ খুললো! নিশাতে গায়ে সাদা একটা কামিজ। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। মেয়েটা চোখে কখনো কাজল পরেনা কেন? সে উঠে বসতে বসতে বললো, — রাতে তো বললাম’ই শক্রবারে রিসিপশন।
— তো! আজ কি বার? মঙ্গলবার। সময় মতো থাকলেই তো হলো।
— বিয়ে শুধু একটা অনুষ্ঠান হয় না নিশাত। সেখানে অনুভূতি থাকতে হয়।
— আপনার জন্য আমার কখনোও কোন অনুভূতি হবে না। এটাই সত্য, এক সত্য, দুই সত্য, তিন সত্য।
— কাছে আসো দেখি অনুভূতি কি না করে হয়।
নিশাত ওয়াহিদের ঠিক সামনে বসলো। বসে বললো, — নিন আসলাম! দেখি কত অনুভূতি হয়।
ওয়াহিদ হাসলো! হেসে চোখে চোখ রেখে বললো, — তোমার হ্নদয় কোথায় মেয়ে?
— অনেক বছর আগে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
— আমার এই শরীর না হ্নদয় চাই।
— সেটা খোঁজ আপনি কখনো পাবেন না।
— কেন? সুর্বণার ছেলে বলে।
— হ্যাঁ!
— তাহলে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছো কেন? সোজা’ই তো বলা হয়েছিল। রাখতে চাও কি না?
— তো? রাখতে চাও কি না জিজ্ঞেস করেছেন? এখানে আবার হ্নদয় কি? অযথা যতো ঢং। বউ লাগবে সোজা বলুন।
ওয়াহিদ বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে কুশনের নিচ থেকে চাবি বের করে দিলো। দিতে দিতে বললো, — শক্রবারে সকালে আমার বউ আমি ফেরত চাই। যদি না পাই তোমার খবর আছে মেয়ে।
নিশাত মুখ বাঁকালো! বাঁকিয়ে চাবি নিয়েই বেরিয়ে এলো। ড্রইংরুমে এসে সোফার নিচে, সাইডে একটু উঁকি ঝুঁকি মারলো। কনা এসে বললো, — কি হয়েছে ভাবি?
— আর বলোনা কালকে অনেক রাত প্রর্যন্ত মাহফুজ ভাইয়া সাথে বসে বসে আড্ডা দিলাম। রুমে গিয়ে দেখি কানের দুলটা নেই। এখানে পড়ল কি না। এদিকে আবার আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
— আপনি যান ভাবি, আমি দেখছি।
— সমস্যা হবে নাতো তোমার?
— কি যে বলেন না ভাবি। কিসের সমস্যা।
— অসংখ্য ধন্যবাদ কনা। আর মাকে একটু কষ্ট করে বলে দিয়ো তো। আমি বেরিয়ে গেছি।
— আচ্ছা ভাবি! সমস্যা নেই।
নিশাত হেসেই বেরিয়ে গেলো। নামাজ পড়ে সুর্বণা কখনো ঘুমায় না। বাগানে হাঁটাহাঁটি করে। তজবিহ পড়ে। আজকেও তেমনি বেরিয়ে দেখে কনা আর আরেক কাজের লোক সোফার নিচ তো ভালোই পুরো ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে। সে আবাক হয়ে বললো, — কি হয়েছে?
— ভাবির নাকি দুল হারিয়েছে।
— কখন?
— কাল রাতে। দুলাভাই আর নাকি ভাবি এখানেই বসে গল্প করেছে। রুমে গিয়ে দেখে দুল নেই। তাই ভাবলো এখানে পড়েছে কি না।
সুর্বণা ভ্রু কুঁচকে বললো, — কে কে গল্প করেছে?
— দুলাভাই আর ভাবি।
— কখন?
— রাতে।
সুর্বণা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার মন বললো কিছু একটা ঠিক নেই। কি নেই ধরতে পারলো না। সে চিন্তা করতে করতেই রুমের দিকে এগুলো। তখনি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, অনেক অনেক দিন আগের কিছু স্মৃতি। এভাবেই হেসে হেসে গড়িয়ে পড়া, এভাবেই বসে বসে কতো আড্ডা দেওয়া। সব কিছুতে নাজিম ভাই, নাজিম ভাই করে গলে যাওয়া। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় দৌড়ে নাজিমের বাইকের পেছনে বসে আহ্লাদ করে বলা, — একটু পৌঁছে দিন না নাজিম ভাই প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। সুর্বণার শরীর কাঁপতে লাগলো। কাঁপতে কাঁপতেই সিঁড়িতে পা রাখতেই ফসকে গেলো। কনা শব্দ পেয়ে পেছনে তাঁকাতেই এক চিৎকার দিলো।
চলবে…..