ঝিলমিল রোদ্দুরে পর্ব-৪৬

0
321

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৪৬]
~আফিয় আফরিন

ঝিলমিলের কথা শুনে রোদ্দুর এক মুহূর্তের জন্য ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন দিকে ফিরে তাকাল, ঝিলমিল দৃষ্টি সীমানায় আকুতি মিনতি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ও কথাটা মনে থেকে বলেছে নাকি শুধুমাত্র রোদ্দুরকে মানানোর জন্য বলেছে— তা পরিষ্কারভাবে রোদ্দুরের জানা নেই। সে নিজের রাস্তা দেখল। জীবনে কায়রো ভালোবাসার দরকার নাই। ঝিলমিল অবশ্য রোদ্দুরের পথ আটকে দিল। করুণ মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘চলে যাচ্ছিস যে? আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলবি না?’

রোদ্দুর সোজাসুজি উত্তর দিল, ‘না।’

‘আসলেই না? তুই কি এখনও আমার উপর রেগে আছিস? আমি সরি বলেছি তো। দ্যাখ, গতকাল আমি তোকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম। আর আগেই তুই এসে…. মানে তুই আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলি, তারপর কী যে বলেন বসলাম নিজের’ই মনে নেই।’ ঝিলমিলের কথাগুলো জড়িয়ে গেল।

রোদ্দুর বলল, ‘বাহ, গতকালের কথা আজ মনে নেই তাহলে তো আজকে কথা আগামীকাল’ও মনে থাকবে না।’

ঝিলমিল স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘মনের কথা তো মনে থাকবে তাই না!’
রোদ্দুর জবাব দিল না। মুখ ঘুরিয়ে নিল। ঝিলমিল চোস্ত হাতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দরজার সামনে দাঁড়াল। সে রোদ্দুরের মুখ থেকে কথা আদায় না করে কিছুতেই তাকে এ ঘর ছেড়ে যেতে দিবে না। ঝিলমিল একা একাই কিছুক্ষণ বকবক করে গেল।
রোদ্দুর দু’কদম এগিয়ে এসে ঝিলমিলের উদ্দেশ্য যথাসম্ভব শান্তস্বরে বলল, ‘তোর না শরীর খারাপ? এত বকবক করছিস কেনো? আমার এত কথা শোনার ইচ্ছে নেই আর তোকে বিরক্ত করার’ও ইচ্ছে নেই।’

‘আমি তো বিরক্ত হচ্ছি না।’ একঝলক হাসি হেসে বলল ঝিলমিল।

‘কিন্তু আমি তোর কাজে কর্মে ভীষণ বিরক্ত বোধ করছি। তোর যখন যা মন চাইবে, তাই করবি তা তো হতে পারে না। ইচ্ছে হবে একশ হাত দূরে চলে যাবি। আবার ইচ্ছা হবে ভালোবাসার কথা বলবি। এটা কীভাবে হয়? ভালোবাসা কি খেলা? ভালোবাসা মহামূল্যবান রত্নের মত বুকে ধারণ করতে হয়‌।’ গভীর দম টেনে রোদ্দুর লঘুস্বরে বলল।
ঝিলমিল তো এসব কিছু মানবে না। সে নিজেকে জানে, নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সোচ্চার। কিছুদিন যাবত তার মনের মধ্যে কী চলছে, তা তো আর রোদ্দুরের জানার কথা নয়। রোদ্দুরের কথা শুনে নিজের উত্তর সাজাতে চাচ্ছে কিন্তু তার মন মস্তিষ্ক তাকে অন্য খেয়ালে নিয়ে যাচ্ছে। একটা ভয়ঙ্কর কাজ করে ফেলল। তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে ঝড়ের বেগে রোদ্দুরের কাছে ছুটে গেল এবং শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আচমকা ঝিলমিলের এমন পাগলামীতে নিঃশব্দে হেসে দেয় রোদ্দুর।
এতক্ষণ ঝিলমিলের বুকের ভেতর হুহু করা শূণ্যতারা এক মিঠে উষ্ণতা অনুভব করে চুপ হয়ে গেছে। শরীর জুড়ে তেতো অবসাদেরা বিদায় নিয়েছে। ত্রস্ত ব্যাকুল এবং উদ্বেলিত স্বরে বলল, ‘আজ আর আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবি না। তুই অপেক্ষা করেছিস, আমি তোর অপেক্ষার প্রহর শেষ করে দিয়েছি। আর করতে হবে না অপেক্ষা। আরেকবার বল, ভালোবাসিস!’
মুগ্ধতায় অভিভূত হয়ে নিরব থাকে রোদ্দুর। এক অন্যরকম প্রশান্তি খেলে গেল সারা শরীরে। মনে হচ্ছে, সে ঠিক এই জিনিসটাই জীবনভর চেয়ে এসেছিল। জীবন তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় নাই, সবটা দিয়েছে তবে সামান্য একটু দেরীতে।
ঝিলমিল ফের বলল, ‘কিছু তো অন্তত বল।’

রোদ্দুর প্রসন্ন হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
ঝিলমিলের হাসিমুখটা দপ করে নিভে গেল। সে মোটেও এ কথা শুনতে চায় নাই। কেমন আর যাবে? সে যা শুরু করেছে, তাতে কী আর দিনকাল ভালো কাটে?
সে শুকনো কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আমি জানিনা।’

‘হঠাৎ আমায় ভালোবাসলি যে? তোর মতে আমি তো ভীষণ খারাপ! তবে খারাপ মানুষকে ভালো মানুষের ভালোবাসা কি উচিত হলো? পরে আবার পস্তাবি না তো? যদি মনে হয়, আবেগের বশে ভালোবেসে ভুল করে ফেলেছিস।’ চোয়ালে নিজস্ব ঠাঁট বজায় রেখে বলল রোদ্দুর।

ঝিলমিল অকপটে বলে ফেলল, ‘যদি কখনো আমার এমন মনে হয়, তবে সেদিন থেকে আমিই নিজেকে নিজে শেষ করে দিব। আই প্রমিস।’

রোদ্দুর অস্থির চিত্তে বলল, ‘বাজে বকিস না। সব কথা শুনতে ভালো লাগে না।’

ঝিলমিল রোদ্দুরের বুকে থেকে আলতোভাবে মাথাটা উঠিয়ে বলল, ‘তাহলে আরেকবার বলব?’

‘কী?’

‘ভালোবাসার কথা! বলব? আচ্ছা, তোর অনুমতির কি প্রয়োজন? আমার ভালোবাসা আমি প্রকাশ করছি। আচ্ছা শোন তবে….. তোর জন্য কোনোদিন আমার মন কেমন করবে আমি ভাবতেও পারি নাই। তোকে তো নিজের শত্রু ভেবে এসেছি, সেই কবে থেকে। এইতো বাড়ির সবাই তোকে এত ভালোবাসে, আমার কেনো জানি সহ্য হতো না। তারপর তো আমাদের বিয়ে হলো। দু’চোখে দেখতে পারতাম না। তোকে দেখলেই তোর জায়গায় একটা হনুমান কল্পনা করে ফেলতাম। এরপর হঠাৎ তোকে ছেড়ে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে আমি তোকে অনুভব করা শুরু করি। সব আছে, তবুও কিছু নেই। অতঃপর বুঝি, আমার সেই চরম শত্রু আমার কাছে নেই। এই অনুভবের সাথে নিজের অনুভূতি মিলিয়ে বুঝলাম, আমি তোকে ভালোবাসি। আগেই বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সুযোগ পাই নাই। গতকাল রাতে যখন তুই বলেছিস তারপর তো ওইভাবে আমায় ছুঁয়ে দিয়েছিলি বিশ্বাস কর, আমার ভেতরের সব কথা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে কোথায় যেনো পালিয়েছে। এতকিছুর পরেও বলবি, আবেগে এসব বলছি।’ ঝিলমিলের কথার মাঝে রাগ, অভিমান, অনুরক্তি মিশে ছিল।

রোদ্দুর বলল, ‘ওহ আচ্ছা, তাহলে তো তোকে ধরাছোঁয়া যাবে না। তুই আমাকে চেপে ধরে আছিস কেনো? ছেড়ে দে।’
ঝিলমিল অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না এখন খেয়াল হতেই হৃদপিন্ড দ্বিগুণ হয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল, ‘আমি ধরলে দোষ নাই।’

‘তাহলে সব দোষ আমার বেলায়? নাহ, এমন হলে তো আমি মানব না। তোরা মেয়েরা যা বলবি তাই হবে আর আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি নাকি?’ ঝিলমিল ফাঁকা ঢোক গিলল। এতক্ষণ তো রোদ্দুর তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ধরে নাই। নিজের হাত দু’টো দুদিকে ছেড়ে দিয়েছে। ঝিলমিল ওর হাত দু’টো টেনে নিজেকে আবদ্ধ করল। তারপর আরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘এইতো ছুঁয়ে দিলি।’
ঝিলমিলকে মনে হচ্ছে অচিন কোন রাজ্য থেকে ছুটে আসা এক রহস্যময়ী মানবী। যার আপাদমস্তক সম্পূর্ণটাই রহস্যে ঘেরা। নিশি প্রহরে নিজের মন জাগিয়ে তোলা এক তেজস্বী অগ্নিবৎ নারী। হৃদরাজ্যের একমাত্র অধিকারিণী হয়ে নিজের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। ঐন্দ্রজালিক প্রকৃতি আগ্রাসী হয়ে গেছে উদ্ভট কিছুর ইশারা দিয়ে যাচ্ছে।
বিচিত্র অনুভূতি গায়ে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছে। কথা বলার মত মানসিক দৃঢ়তা নেই। ঝিলমিলের নিজেকে বেশ ঝকঝকে লাগছে। শারীরিক সব ব্যথা তাকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। সকালেও তার কৃষ্ণাভ দুটি চক্ষু নির্ঘুম অশান্ত হয়ে গভীর অনুশোচনায় ভুগছিল। এখন আর তার রেশ নেই। আর্দ্র চোখ দুটি বন্ধ করে রাখল। যার বুকে মাথা, তার কাছে শুধু শান্তি আর শান্তি!
ওরা কেউ আর কিছু বলার অবকাশ পেল না। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে দু’জন দুদিকে ছিটকে সরে গেল। ঝিলমিল বলল, ‘আমি দরজা খুলছি।’

ঠিক সেই মুহূর্তে রোদ্দুর’ও এগিয়ে যাচ্ছিল। দু’জন অপ্রতিভভাবে ধাক্কা খেল। ঝিলমিল দাঁড়িয়ে পড়ল আর রোদ্দুর গিয়ে দরজা খুলে দিল। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল তিন্নি, রোদশী। ওরা দু’জন গোয়েন্দার মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দু’জনের দিকে তাকাল। যেনো তারা কঠিন কোনো মামলায় ফেঁসে যাওয়া আসামি।
ওদের মধ্যে রোদ্দুরের থেকে কোনো কাজ নেই। তাই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই তিন্নি আটকিয়ে দিল। ইশশশ, এই ঘর তাকে ছাড়ছে না কেনো? একটু আগে ঝিলমিল এখন আবার এরা।
রোদ্দুর বলল, ‘আমার কাজ আছে। তোমরা কথা বলো, আম আসছি।’

রোদশী সরু চাহনি নিক্ষেপ করে বলল, ‘কি করছিলি? কখন থেকে তোদের খুঁজছি। আমরা তোদের খুঁজে খুঁজে মরব আর তোরা এখানে এসে প্রেম করবি তা তো হতে পারে না।’

রোদ্দুর মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আমি আমার ফোন নিতে এসেছিলাম। ঝিলমিলের কাছে ছিল।’

ওরা দুজন’ই প্রায় আশ্চর্য হয়ে একসাথে বলে উঠল, ‘ওমা এতক্ষণ লাগে ফোন নিতে? দরজা বন্ধ করে ফোন নিতে হবে?’ ওরা দু’জন হেসে উঠল। রোদ্দুর চোরা দৃষ্টিতে ঝিলমিলের দিকে তাকাল। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয়বার রোদ্দুরের চোখে চোখ রাখার সাহস এখনও সঞ্চয় করে উঠতে পারে নাই।
হাসা উচিত নয়, তবে ঝিলমিলের এইরকম করুণ মুখচ্ছবি দেখে রোদ্দুরের সত্যি হাসি পেল এবং সে হেসেও ফেলল। ওরা সবাই সহজ ঝিলমিলও মাথা তুলে তাকাল।
রোদ্দুর বলল, ‘তোমাদের যে আজব টাইপের কথাবার্তা। না হেসে আর পারি? তোমরা থাকো। আমার একটু বাইরে যাওয়ার দরকার। আমি আসছি।’ এই বলে সে আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়াল না। ওদেরকে কথা বলার সুযোগ দিলেই, ওরা আটকে দিবে। তবে ঝিলমিলকে পেয়েছে না? ওকে এত সহজে ছাড়বে না।
রোদ্দুর যা ভেবেছিল তাই হলো। সে চলে যাওয়ার পর ওরা দুইজন দু’দিক থেকে ঝিলমিলকে জেঁকে ধরল। নানান প্রশ্ন করে ওকে প্রায় পাগল করে ছাড়ল।
ওইদিকে বাড়ির বড়রা রোদ্দুরের সাথে আলাপ করে নিয়েছে। তারা এইবার ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চায়। রোদ্দুর তৎক্ষণাৎ মতামত দেয় নাই কারণ ঝিলমিলের দিক থেকে কতটা সাড়া পাওয়া যাবে তার জানা ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে আর কোনো দ্বিধা রইল না। বাবার কাছে এসে জানিয়ে দিল, এই কয়েকদিনের মধ্যে নির্দ্বিধায় তারা বিয়ের আয়োজন করতে পারে। সে রাতটা তাদের আলাপ-আলোচনায় কেটে গেল। এরইমধ্যে রোদ্দুর ঝিলমিলকে হাতেগোনা মাত্র দু’বার দেখতে পেয়েছে। কোথায় কোথায় গিয়ে যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে কে জানে?
রাতে খাওয়া-দাওয়ার সময়’ও ঝিলমিল উপস্থিত ছিল না। রোদ্দুর তানিশাকে জিজ্ঞেস করল, ঝিলমিলের কথা। তানিশা বলল, সে রান্নাঘরে সবার সাথে বসে আছে। রোদ্দুর একবার গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে এলো। ঝিলমিল অবশ্য ওকে খেয়াল’ই করল না।
রাতে রোদ্দুর ঘরে এসে কতক্ষণ যে বসে বসে অপেক্ষা করল, তার ইয়ত্তা নেই। ঝিলমিলের সাথে কথা ছিল। কিন্তু সে যে ওই ভালোবাসার কথা বলে গা ঢাকা দিল, আর খবর’ই নেই। রোদ্দুর ফোন করল। দু’বার ফোন করার পর ঝিলমিল ফোন রিসিভ করল।
রোদ্দুর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘কোথায় তুই?’

ঝিলমিল বলে ফেলল, ‘ঘুমাচ্ছি তো।’

‘ওহ আচ্ছা। ঘুমের মধ্যে কথা বলছে কে?’

ঝিলমিল থতমত খেয়ে বলল, ‘না মানে, ঘুম ভেঙ্গে গেল তো।’

‘ওহ আচ্ছা। ঘরে এলি না যে?’

‘এমনিতেই। দাদি বলল, আজ আমার সাথে থাক। তাই আমি দাদির সাথেই আছি। তুই এখনও ঘুমাসনি কেন? কত রাত হয়েছে সে খেয়াল আছে?’

রোদ্দুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অপেক্ষা করছিলাম। আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ’ই হচ্ছে না।’

‘ইয়ে মানে….’ ঝিলমিল চুপ করে গেল। ওরা এমনভাবে দু’জন কথা বলছে যেন মনে হচ্ছে, অষ্টাদশী কিশোর-কিশোরী পরিবারের সবাইকে লুকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে।
ঝিলমিল চুপ করেই আছে। রোদ্দুর বলল, ‘কথা ছিল। আচ্ছা সকালে আসিস, বলবনি।’

‘আচ্ছা আসব, ঠিক আছে।’ ঝিলমিল ফোন রেখে দিল। রোদ্দুর একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে আপনমনে বলল, ‘শুধু কথা শোনার জন্য’ই আসবে, আশ্চর্য! মুখ দিয়ে কি শুধু কথাই বলা যায়। চুমু খাওয়া যায় না?’
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫০০