#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৪৭]
~আফিয়া আফরিন
প্রতিদিনের মত আজও সকাল সকাল ঝিলমিলের ঘুম ভাঙ্গল। যদিও সারারাত ঘুমাতে পারে নাই। য একটু ঘুম আসতো, রোদ্দুর ফোন করে তাও নাই করে দিয়েছে। ওর একটা ফোনকলে ঘুম-টুম কোথায় যে উড়াল দিয়েছে! সারারাত এই ভাবতে ভাবতে কেটেছে যে, ও কী বলতে চেয়েছে? ভোরের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল। কিন্তু ওই যে কেমন একটা চমক খেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তারপর থেকে সে রোদ্দুরের ঘরের সামনে পায়চারি করছে। একবার নিজের ঘরে আসছে আরেকবার যাচ্ছে। বাড়ির কেউ দেখলে যে কী মনে করবে?
রোদ্দুর মনে হয় এখনও ঘুম থেকে উঠে নাই। ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ। ঝিলমিল গভীর দীর্ঘ দম টেনে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। তার কিছু করার নেই, তাই এই দীর্ঘ অপেক্ষা।
এমন সময় হঠাৎ হাতের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। ঝিলমিল দেখল, রোদ্দুর ফোন করেছে। সে রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে রোদ্দুরের ঘুম মিশ্রিত গলার আওয়াজ শোনা গেল।
‘একলা একলা দাঁড়িয়ে কি আমার অপেক্ষা করছিস? আচ্ছা, দুমিনিট সময় নিলাম। ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
এইটুকু বলেই রোদ্দুর ফোন কেটে দিল। ঝিলমিল আশ্চর্য হয়ে পেছন ফিরে তাকাল। ওই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। তবে রোদ্দুর কি করে টের পেল তার উপস্থিতি? ভাবনার মাঝেই রোদ্দুরের উদয় হলো। রোদ্দুর এসে সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘আমাকে মিস করছিলি?’
ঝিলমিল হালকা চালে মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল। তারপর বলল, ‘কীভাবে বুঝলি আমি এখানে?’
‘আমি বোধহয় তোর উপস্থিতি বুঝতে পারছি। ঘুম ভাঙ্গতেই মনে হলো, কেউ আমাকে খুঁজছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। জাস্ট মনে হওয়া থেকে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে কনফার্ম হলাম।’
কল্প দুনিয়া থেকে রোদ্দুরের প্রখর অনুমান শক্তি দেখে ঝিলমিল পরাস্ত মুখে তাকিয়ে রইল। তারপর একসময় সৎ সাহস পুষে শান্ত গলায় বলল, ‘আজকে সকালে মা বলছিল আমাদের কথা। বাড়ির মধ্যে এসব আবার একটা ঝামেলা…. মানে কী আর বলব!’
‘কেনো? পুরো কথা শেষ কর। ঝামেলা কোথায় মনে হচ্ছে?’
‘এই যে এত হৈচৈ, মানুষজনে ভরপুর। আপুর বিয়ের সময় দেখেছি না? আমি তো বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম। এইবার তো আমার তার উপায় নেই।’
‘ইয়েস নেই.. কারণ আপনিই এইবার প্রধান। আর বিয়ে জীবনে একবার’ই হয়। একবার একটু ঝামেলা সহ্য করে নেওয়া যায়।’
ঝিলমিল চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর আর আমার যে দুইবার হচ্ছে।’
‘সেটা তো আগেরবার যেনোতেনো ভাবে হয়েছে বলে। মা তো আমাকে বলেছে, আরোও আগেই। তার দশটা না, পাঁচটা না একটাই মাত্র ছেলে; তার বিয়েটা এভাবে হঠাৎ হয়ে গেল এটা মায়ের ঠিক পছন্দ হয় নাই। হয়ত অনেক ইচ্ছে ছিল, তাই বারবার আমাকে বলত। আর আমার তখন তোর উপর চরম রাগ….’
বাকি কথাটুকু শেষ করতে দিল না ঝিলমিল। বলল, ‘এখন নেই?’
রোদ্দুর বেশ নরম সুরে বলল, ‘না।’
কেনো কিংবা কী কারণ, তা আর ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল না। বড্ড নাটকীয় শোনাবে। সে জানে তো। ঠোঁট জুড়ে মুচকি হাসি ফুটে উঠল।
রোদ্দুর বলল, ‘ঘরে আয়, একটা জিনিস দেওয়ার ছিল তোকে।’
‘পরে দিস। এখন আমি আসি। মা তখন আমাকে বলেছিল, চা বানাতে। দেখিস পরে আবার আমার সাথে বকবক করবে— আমি এটা করি না, সেটা করি না। কথা বললে পাত্তা দিই না।’
‘ওসব কাজ ওরা করে ফেলেছে। তোর জন্য নিশ্চয়ই ফেলে রাখে নাই। সবাই জানে, তুমি অকর্মা।’
রোদ্দুরের কথা শুনে ঝিলমিল মুখ ভেংচাল। রোদ্দুর পুনরায় বলল, ‘তোর জন্য শুধুমাত্র তোর জন্য, আমি আমার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে এখানে এসে বসে আছি। আর তুই আমাকে দেখাচ্ছিস কাজের ব্যস্ততা? আমার থেকেও এত বেশি ব্যস্ত তুই? তুই ছাড়া আমার আর কী দরকার ছিল এখানে? অবসর কাটাচ্ছি, তার মূল্য দিতে শিখ।’
ঝিলমিল কিছু বলতে চাইছিল তবুও মনের দুয়ারে আগলে পড়িয়ে সোজা বলল, ‘আমার বিয়ের অর্ধেক কাজ আমার উপর অর্পণ করা হয়েছে। এখন আসছি। দরকার পড়লে ডাকিস অথবা ফোন দিস। আর কিছু দেওয়ার ছিল বললি না? পরের জন্য তোলা রাখিস। হাতের কাজ থেকে মুক্তি পেলে কিন্তু সব কড়ায় গন্ডায় উশুল করে নিব।’
ঝিলমিল চলল। রোদ্দুর হাসিমুখেই তাকে বিদায় দিল। এখানে রাগারাগীর আর কোনো প্রয়োজন নেই। সম্পর্কটা সতেজ হতে শুরু করেছে। ঝিলমিল আজ যথাসম্ভব নিজেকে খোলসা করে প্রকাশ করেছে, আগের দিনের মত নিজেকে লুকিয়ে নেওয়ার মনোভাব’টা আজকের দিনে ছিল না।
রোদ্দুরের’ও কাজ ছিল। ছোট চাচ্চুর সাথে বের হবে। তার মুখটা দেখলেই দুর্বিষহ সেসব স্মৃতি মনে পড়ে যায়। বাধ্য হয়েই তাকে চুপ থাকতে হয়। কিছু কিছু সময় নিরব থাকাটাই শ্রেয়। সেইদিনের সেই ঘটনা থেকে রোদ্দুর আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে যে, ভালোবাসা জিনিসটা কী? ছেড়ে দেওয়ার তো হাজারটা থাকে। কিন্তু ধরে রাখার মত একটা কারণ দেখিয়ে সারাজীবন থেকে যাওয়াটাই ভালোবাসা। সেই থেকেই নিজেদের সম্পর্কে আরেকটু বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
ঝিলমিল হোক তার জীবনে জোৎস্নার মায়া, চাঁদের আলো, সূর্যের হাসি, পথের শেষ প্রান্তর, ফিরে আসার অনুভব, জীবনের তাড়না, সময়ের আকাঙ্ক্ষা, অনিচ্ছার জেদ, শত সহস্র জড়তা, এক পৃথিবী সমান ভালোবাসার দাবিদার।
.
অতঃপর তাদের বাড়িতে শুরু হয়ে গেল বিয়ের আয়োজন। রোদ্দুর বলে দিয়েছে, তারাতাড়ি বিয়ে করে সে তার বউকে নিয়ে চলে যাবে। এখানে ওকে রেখে সে নিজে একদন্ড শান্তিতে থাকতে পারছে না।
এর আগেরবার তো কোনোরকম বিয়েটা দেওয়া হয়েছিল। ঝিলমিলের নানাবাড়ি থেকে কেউ উপস্থিত থাকতে পারে নাই। এই নিয়ে শিমুর আফসোসের শেষ নাই। তিনি এইবার আগেভাগেই সবাইকে বলে দিয়েছেন। আনন্দে তাদের সারা বাড়ি জেগে উঠেছে। বাকিদের মনেও আনন্দের শেষ নাই। কারণ একটা অনুষ্ঠান হলেই তাদের সকলের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ মেলে। অন্যসময় কাউকে হারিকেন দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যায় না। সবাই যে যার নিজেদের সংসার জীবন, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ব্যাপক ব্যস্ত। কারোর’ই সময় হয়ে উঠে না দু’দন্ড এসে মন খুলে গল্প করার।
আগামীকাল তিথির আর তন্বীর আসার কথা। ওরা এলেই সরকার পরিবার এইবার একত্রিত হয়ে পূর্ণ হবে।
বিয়ের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি আছে। রোদ্দুর আগেভাগেই ওর বন্ধুদের ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ের খবর এবং দ্রুত চলে আসতে বলেছে।
এইদিকে তিন্নি পড়েছে ঝিলমিলকে নিয়ে। আরও কিছুদিন আগে থেকেই ওর পরিচর্যায় লেগে পড়েছে। ঝিলমিল যদি জানত, ওরা এইরকম শুরু করবে তবে আরেকবার বিয়ের জন্য মোটেও রাজি হতো না।
আজ সকাল সকাল তিন্নি কি কি যেনো মিক্সড করে এনে মুখে লাগিয়ে দিয়েছে। ঝিলমিলকে স্রেফ বলে দিয়েছে, ‘কথা বলবি না এবং হাসবি না।’
আধঘন্টা পর মুখ থেকে সেই ফেসপ্যাক তুলে ঝিলমিল গা ঝাড়া দিয়ে বলল, ‘আমাকে আর এসব আজেবাজে জিনিস দিবে না। খুব বিরক্ত লাগে।’
‘আরে পাগলি মেয়ে, চেহারার কি অবস্থা করেছিস? আমি ভাবতেছি কপালের কাটা দাগটা কীভাবে এই কয়েকদিনের মধ্যে অপসারণ করা যায়। নিজে তো মাথা ফাটিয়ে বসে আছিস। তোর কোনো চিন্তা নাই। যত চিন্তা সব আমার এবং আমাদের।’
‘এত চিন্তা করতে হবে না। আমি যেমন তেমন’ই ঠিক আছি। এই কয়েকদিন আমার সাথে আর কিচ্ছু করতে পারবা না বলে দিলাম। বিয়ের দিন চুপচাপ আমি সেজেগুজে বিয়ে করে নিব।’ ঝিলমিল সোজাসুজি ঘোষণা দিয়ে দিল। এরইমধ্যে তানিশা আর রিমঝিম’ও চলে এসেছে। ওরা অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল, কী করবে আর কী করবে না! তাই তারা চিন্তামুক্ত। রিমঝিম এসে ঝিলমিলের পাশে বসে বলল, ‘এইবার কিন্তু জনগণ সাক্ষী রেখে তুমি আমার ভাবি হতে চলেছ। আর আপু ডাকব না। ভাইয়াকে এখন থেকে দুলাভাই ডাকব আর আবদার করব। দেখেছ, তোমার বরের শালীর অভাব নেই।’
‘যা ইচ্ছে হয় কর, আমার কোনো আপত্তি নাই।’
তানিশা বলল, ‘আপত্তি কি আমরা শুনছি নাকি? বিয়ের পর দুলাভাইয়ের কাছে আমাদের একমাত্র আবদার হচ্ছে, আমাদের সিনেমা হলে নিয়ে যেতে হবে।’
তানিশার কথা শুনে রিমঝিম দৌড়ে এগিয়ে এলো। সুর করে গাইতে লাগল, ‘দুলাভাই দুলাভাই, ও আমার দুলাভাই! চলো না, সিনেমা দেখিতে আজই যাই। সিনেমার নাম নাকি, তোমাকে চাই দুলাভাই; সিনেমার নাম নাকি তোমাকে চাই।’ ওর গান শুনে ঝিলমিল’সহ সবাই হেসে উঠল।
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল এইভাবেই। একদিন করে যাচ্ছে আর কাঙ্খিত দিনটা নিকটে এগিয়ে আসছে। তিনদিন আগেই আলাদা হয়ে গেছে, অর্থাৎ দু’জনকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।
তিন্নি সাফ সাফ করে জানিয়ে দিয়েছে, রোদ্দুর আর ঝিলমিল বিয়ের আগে কোনোভাবেই দেখা করতে পারবে না। দেখাদেখি, কথাবার্তা যা হওয়ার সব বিয়ের দিন।
ঝিলমিল অবশ্য মেনে নিয়েছে কিন্তু রোদ্দুর কিছুতেই মানতে পারছে না। এই ব্যাপারটা নিয়ে সকাল থেকে মন মেজাজ খারাপ। না পারছে কিছু বলতে, না পারছে কিছু করতে। এইদিকে এমন অবস্থা হয়েছে, ওর সাথে কথা না বললে তার দিন কাটে না। অন্তত সারাদিনে একবার হলেও কথা বলা চাই। ম্যাডামকে তো আবার ফোনেও পাওয়া যায় না। ফোন করলে ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে হৈ হল্লা আর চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসে। ঝিলমিলকে ওরা একেবারে দখল করে ফেলেছে, ছাড়ছেই না একদম।
এইতো এখনও একবার ফোন করল আশায় আশায়। জানে যে ঝিলমিলকে ওরা কিছুতেই কথা বলতে দিবে না। তবুও আশায় বাঁচে চাষা।
আজকে ফোন রিসিভ করল তিথি আপু। সে গত পরশু এসেছে। রোদ্দুরের গলা শোনার অপেক্ষায় রইল না। একটা রামধমক দিয়ে বলল, ‘অ্যাই ছেলে! সমস্যা কিরে? আমার বোনটাকে এত বিরক্ত করার প্রয়োজন হচ্ছে কেনো? এত কথা তোর পেটে যে দিনে চৌদ্দবার ফোন করতে হবে? বাপুরে, আমি এত বাঁচাল ছেলে মানুষ দেখি নাই। শোন রোদ্দুর, সব কথা পেটের মধ্যে জমিয়ে রাখ। বাসর রাতে সব উগলে দিস। আর একবার ফোন করলে কিন্তু তোর বাবার কাছে গিয়ে বিচার দিব। আর যদি জরুরী কিছু বলার থাকে তবে আমাকে বলতে পারিস, আমি তোর বউকে বলে দিচ্ছি।’
রোদ্দুর মলিন মুখে বলল, ‘তোমাদের কাউকে কিছু বলার নাই।’
‘ঠিক আছে, তাহলে আর ফোন করবি না। আমাদের অনেক কাজ। আর হ্যাঁ আমরা বড় বোন বলে কিন্তু তোকে ছাড় দিব না। এই যে তোর বউকে পাহারা দিয়ে রাখছি, পঞ্চাশ হাজার টাকা রেডি রাখিস। বিয়ের দিন সব সহ আদায় করব। তুই কিন্তু…..
রোদ্দুর আর কিছু শুনতে চাইল না। মুখের উপর ঠাস করে ফোন কেটে দিল। তার বউয়ের সাথে দেখা করতে দিবে না, আবার চাহিদা নিয়ে আসছে! হুহ। এক টাকাও খসাতে পারবে না।
রোদ্দুর এককাজ করল। ঝিলমিল এক পিচ্চি মামাতো বোনকে ডেকে নিয়ে ইনস্ট্যান্ট একটা চিরকুট লিখে বলল, ‘এটা তোমার আপুকে দিয়ে আসবে। একদম লুকিয়ে কেউ যেনো না দেখে। ওকে?’
মেয়েটা মাথা নেড়ে চিরকুটটা হাতে নিল। রোদ্দুর অবশ্য ওকে একটা চকোলেট কিনে দিল ঘুষ হিসেবে। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল ঝিলমিলের ফোনকলের জন্য। ফোন করতে পারবে কিনা জানে না। তবে যেহেতু রাতে দেখা করতে বলেছে, তখন হয়তো ম্যানেজ করতে পারবে।
ঝিলমিল চিরকুট হাতে পেয়েই বালিশের নিচে চালান করে দিল। এখানে তো ওরা সবাই আছে। চিরকুটটা একদম দেখা যাবে না। সকলের চোখের আড়ালে ঝিলমিল চিরকুটটা ওড়নায় পেঁচিয়ে ওয়াশ রুমে ছুটল। এছাড়া আর উপায় নেই। জীবনে কখনো প্রেম করে নাই, তাই এসব লুকানো ছাপানোর অভ্যাস নেই। কুড়িমুড়ি হয়ে যাওয়া চিরকুটটা পড়ে দেখল, রোদ্দুর তাকে রাতে দেখা করতে বলেছে যখন সবাই ঘুমিয়ে যাবে। রোদ্দুর বাড়ির পেছন দিকে অপেক্ষা করবে। ঝিলমিল চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। বের হয়ে এসে আবার ওদের সাথে যোগদান করল।
বিয়ে বাড়িতে রাতের খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কে কখন খাচ্ছে, যাচ্ছে, আসছে। ঝিলমিল তো অপেক্ষা করতে করতে অস্থির। রোদ্দুর বলেছিল, বারোটার পর অপেক্ষা করবে। অথচ এখন প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। ঝিলমিল তাড়া দিতে লাগল, ওর ঘুম পেয়েছে। তানিশা একবার আসছে, আবার রিমঝিম যাওয়া আসা করছে। ঝিলমিলের হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইশশশ, রোদ্দুর বোধহয় অপেক্ষা করতে করতে চলেই যাবে। তারপর আর দু’দিন দেখা হবে না।
ঝিলমিল ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে বারোটা পার হয় গেছে। তানিশা আর রিমঝিম তার সাথেই থাকছে। ওরা মাত্র ঘরের বাতি নিভিয়ে বিছানায় এলো। এত তাড়াতাড়ি ঘুমাবে বলে তো মনে হয় না। ঝিলমিল একপাশ হয়ে শুয়ে আছে, ওরা দু’জন হাসাহাসি করছে। ঝিলমিলের ফোনটাও দখলে চলে গেছে। কী যে এক বিপত্তি! ওরাও এক অত্যাচার শুরু করেছে, আর রোদ্দুর’ও।
ওদের ঘুমাতে ঘুমাতে একটা পার হয়ে গেল। ঝিলমিল চুপিচুপি উঠে বসল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। রোদ্দুর আছে না চলে গেছে কে জানে? সে দ্রুত পায়ে নিচে নামল তবে খুব সাবধানে। মাথায় ওড়না জড়িয়ে বাসা থেকে বের হলো। মনের মধ্যে এক আতঙ্ক কাজ করছে। কিছুদূর এগোতেই রোদ্দুরকে দেখতে পেল, এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
পায়ের আওয়াজে রোদ্দুর পেছন ফিরে তাকাল। ঝিলমিলকে দেখতে পেল, ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে আসতে। রোদ্দুর বলল, ‘তুই ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আমিই আসছি।’
বলে রোদ্দুর এগিয়ে গেল। ঝিলমিল চোখ তুলে তাকাল রোদ্দুরের দিকে এক পলক। মাথাভর্তি এলোমেলো চুল, কুঁচকানো ভুরু, কপালে পরপর কয়েকটা ভাঁজ পড়া, ধূসর রঙের টি-শার্ট পড়নের এই ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত এবং ভদ্র ছেলে। ওকে এই অবস্থায় দেখে কে বলবে ওর মাথাভর্তি রাগ সর্বক্ষণ গিজগিজ করছে। ঝিলমিলের মনে হলো, রোদ্দুরকে সে বহু যুগ পর দেখছে। ওই মুহূর্তে হিসেব করে দেখল, রোদ্দুরের সাথে তার দেখা হয় না আটদিন হচ্ছে। উফফফ, অনেক দীর্ঘ সময়।
রোদ্দুর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে ঝিলমিলের হাত ধরল এবং এই ঝোপঝাড় থেকে বের হলো। সেই বারোটা থেকে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। একবারের জন্যও ফিরে যায় নাই, যদি ঝিলমিল এসে খোঁজ না পেয়ে ফিরে চলে যায়? রোদ্দুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ঝিলমিল যতক্ষণ না আসবে ততক্ষণ সে এভাবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকবে। এতক্ষণ যে কতকগুলো মশার কামড় খেয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ঝিলমিল বলল, ‘এতদূর নিয়ে এসেছিস কেনো? তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে তো।’
‘রাখ তোর বাড়ি ফেরা। এক্ষুনি আমি যদি তোকে নিয়ে পালিয়ে যাই, তবে কার সাধ্যি আছে আমাকে আটকাবে?’
‘কেনো ডেকেছিস সেটা বল? বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না। বাড়ির সবাই জেনে গেলে একটু লজ্জাজনক কাহিনী হবে।’
‘চুপ কোনো কথা হবে না। তোর চৌদ্দ গুষ্টি আমি ভয় পাই না। আমার সাথে চল। আপাতত এই বাড়ি থেকে বের হতে পারলে শান্তি পাব।’
ঝিলমিল চোখ বড় বড় করে তাকাল। এ যেনো তার মরণ ফাঁদ। রোদ্দুর এইভাবে ডাকছে, মানা করতে পারছে না। আবার যাওয়ার সাহস’ও পাচ্ছে না। এতবড় রিস্ক নেওয়া এই রাতের বেলায় সম্ভব না। তাই ঝিলমিল না বলে দিল। রোদ্দুর’ও তা মেনে নিল। এইতো দেখা হলোই। আর কীছু করার নেই তো। ফিরে যেতে হবে তো এইবার! ঝিলমিল ফিরে যাওয়ার আগে একবারে জন্য শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আগামী দুদিন ওকে ছেড়ে থাকার শক্তি সঞ্চয় করা আর কী! রোদ্দুর’ও ধরল। ফিসফিস করে বলল, ‘ওদেরকে আমি পরে দেখে নিব। আসবে না আবার ভাই ভাই করতে! জাস্ট কালকের দিনটা যেতে দে। তারপর আমার বোন নামক শত্রুদের সাথে আমার একটা ভালো রকম বোঝাপড়া হবে।’
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ২০৮২