গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
791

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১৬

থমথমে পরিস্থিতি। রোবটের মত এক স্থানে জমে আছে স্রোত। বুকে যেন ধরাম ধরাম শব্দে কেউ হাতু ড়ি পেটা চ্ছে। সুহাদ ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সোজা হয়ে বসল। পেছনে স্রোত দাঁড়ানো। না তাকিয়েই সুহাদ বলল,
“ তুই কি ভেবেছিস শহরে একা একা থাকবি, আর আমরা নিশ্চিন্তে বাড়িতে বসে থাকব। কোনো খবরই নেব না?”

স্রোত ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। সুহাদ বলল,
“ এদিকে এসে বস।”
স্রোত নড়তে ভুলে গেছে। সে আসছেনা দেখে বিরক্ত হয়ে সুহাদ পা তুলে বসে পড়ল বিছানায়। এরপর কিছুটা ঘুরে বসল স্রোতের দিকে। দরজার দিকে তাকাল একবার।
স্রোত নিচের দিকে তাকিয়ে এক ধ্যানে হাতের নখ দেখছে। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে শেষমেশ মুখ খুলল,
“ কি বলছো ভাইয়া! কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। স্পাই লাগিয়েছো পেছনে?”
“ যদি বলি হ্যাঁ?”
স্রোত চুপ হয়ে গেল। এমনটাই বুঝেছিল। ছাত্ররাজনীতিতে থাকতে অনেক ছেলে-পেলে সুহাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ওদের মধ্য থেকেই একজন স্রোতের খবর পাঠায়। আর যাইহোক, বড় শহরে বোনকে সে একা ছাড়বেনা। খবর তো রাখবেই!
স্রোত নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ কিন্তু কেন?”
“ মেয়েদের লাইফে কতটা হেনস্তার শিকার হতে হয় তা একটু হলেও আইডিয়া রাখি। তুই যা মুখচো-রা মানুষ; আম্মুর মত! কিছু হলেও তো মাস পেরোনোর পর আমাকে জানাস। তাই স্পাই লাগিয়েছি।”

স্রোত ঠোঁট উলটে বসে রইল। সুহাদ এবার নিচু গলায় বলল,
“ আব্বু কেমন সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। জোর করে কিছু না চাপালেও নিজের পছন্দের প্রাধান্য আব্বুর কাছে বেশিই থাকে সবসময়। কিছু হওয়ার আগে নিজের মতামত আগে-আগে জানিয়ে রাখাই বেটার। আব্বুকে বলতে না পারলে, আমাকে বল।”

“ কাউকে পছন্দ?” একটু থেমে প্রশ্ন করল সুহাদ। স্রোত সামান্য চোখ তুলে চাইল। সুহাদের দৃষ্টি দেখে আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। সুহাদ উত্তর না পেয়ে ফের জিজ্ঞেস করার পূর্বেই স্রোত চট করে উত্তর দিল,
“ হু!”
সুহাদ চওড়া হাসল উত্তর শুনে।

শুক্রবার। অক্টোবর প্রায় শেষের দিকে। শীতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
রাবেয়া আজ গরুর মাংস রান্না করেছেন। রান্নার জন্যই মূলত তাকে রাখা হয়েছে। তাই রান্নাটুকু তিনি খুব সাবধানে করেন। পুলিশ-টুলিশ তিনি এমনিতেই ভয় পান। আবার শুনেছেন এই ঘরের কর্তা অবসরপ্রাপ্ত মেজর। ছেলেও সিনিয়র ইন্সপেক্টর। ওমনি তার হাওয়া ফুরুত। একে একে খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখতেই নিশাত দৌঁড়ে এল। নাবিদ সাহেব আর নায়ীব কেবলই ফিরেছেন নামাজ শেষে। যার যার রুমে বোধহয়। নিশাত ডাক দিল নাবিদ সাহেবকে। এরপর গেল ভাইয়ের কাছে। বারান্দার দরজাটা দিনেও বন্ধ করে রাখা। আলো বলতে থাই গ্লাস গলিয়ে যা আসছে, তাই। নায়ীব খুব মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কি যেন দেখছে। স্ক্রিনের আলোয় তার চোখ-মুখের চিন্তার ছাপ খেয়ালে আসলো নিশাতের। মৃদু গলায় ডাকল,
“ ভাইয়া! ও ভাইয়া? খাবেনা?”
“ আসছি, যা! ”
গেলনা নিশাত। বলল,
“ জলদি খেয়ে নেই, চলো। আর্জেন্ট কাজ হলেও রেখে আসো। বিকালে কিন্তু দাওয়াত আছে।”
“ হুম? কিসের?” আনমনা কণ্ঠ। ধ্যান সবই স্ক্রিনে স্থির।
“ দুই তালায়, আংকেলের বাসায়। জোহার জন্মদিন আজ।”
শুনেও শুনলোনা নায়ীব। তবে আজকের দিন নিয়ে খুবই এক্সাইটেড নিশাত। সেটা বুঝতে দেয়া যাবেনা।

জোহার বাসায় ঢুকতেই হকচকালো স্রোত। গত পরশু সে হোস্টেলে ফিরেছে। কালকের দিনটা রেস্ট নিয়ে আজ পড়াতে এসেছে। কিন্তু এখানে তো ভিন্ন চিত্র। বাসার দরজা খুলেছেন জোহার আব্বু। পরনে খুবই সুন্দর কাপড়-চোপড়। ভেতরে যেতেই আরেক দফা চমকেছে স্রোত। বসার ঘর হয়ে জোহার রুমে যেতে হয়। বসার ঘরে কম হলেও পঞ্চাশটা বেলুন ফুলিয়ে রাখা। কেকও রাখা। সাথে আরো কি কি! হকচকিয়ে তাকাল স্রোত। জোহার আব্বু হেসে বললেন,
“ আসো,আসো! আজ জোহার বার্থডে।”
স্রোত ঠোঁট চেপে কিছু ভাবল। জোহা বলেছিল সামনে তার বার্থডে। কিন্তু ডেট বলেনি। কালও তো বললোনা যে আজকে ছোট-খাটো বার্থডে পার্টির এরেঞ্জ করা হয়েছে! খালি হাতে আসা তো মানায়না। ভাবনার মাঝেই জোহাকে দেখা গেল। সাদা পরীর মত একটা ঝকঝকে লম্বা গাউন পরেছে, দেখতে সে এমনিতেও গোল-গাল গড়নের। মাথায় আবার কিসব লাগানো! মুখে সবসময়কার মত একটা বড় মিষ্টি হাসি। সে কাছে এসে হাত ঝাঁকাল স্রোতের। বলল,
“ আসসালামু আলাইকুম, আপু! কেমন আছেন?”
“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছি। এসব কি জোহা? বার্থডের কথা আগে জানালেনা কেন, হুম?”
কথার মাঝে তাকে রুমে টেনে নিয়ে গেল জোহা।
বিছানায় বসলো স্রোত। কপাল কুঁচকে এই মেয়ের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করল। এর মধ্যে আবার শোরগোল শোনা গেল বসার ঘর থেকে। জোহা বলল,
“ জানালে তো আসতেন না। তাই বলিনি।”
“ তোমার জানানো উচিত ছিল!”
“ ওসব উচিত-ফুচিত দিয়ে কি হবে! এমনিতেও মানুষজন নেই। আনন্দ করবনা একটু? মা কেবল মামাদের দাওয়াত দিয়েছে। আর বিল্ডিং এর মানুষজন। ওরা আসবে কিনা সন্দেহ।”
বলতে বলতে খানিকটা অসন্তোষ হলো সে। স্রোত নরম গলায় বলল,
“ সুন্দর লাগছে তোমাকে। একদম ডলের মত।”
মুহুর্তেই দাঁত কেলিয়ে হাসল জোহা। স্রোত অবাক হতে গিয়েও হলনা। এই মেয়েকে বোঝা বড়ই দায়!

..

নিশাত সিঁড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। যে কেউ দেখলে ‘অসহায়’ তকমা দিয়ে বসবে; এমন অবস্থা। সে আপাতত অপেক্ষা করছে নায়ীবের। এই তো কয়েকটা সিঁড়িই, এগুলো নামতেও কারোর এত সময় লাগে? আলস্য ভঙ্গিতে নায়ীব এসে দাঁড়াল পাশে। বলল,
“ কি? ফকিরের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন এখন?”
“ ফকিরদের সরদারের অপেক্ষা করছিলাম। দয়া করে একটু জোরে হাঁটবেন, সরদার জি?”
নায়ীব প্রতিক্রিয়া দিলনা। বলল,
“ তুই জানিস তুই চূড়ান্ত পর্যায়ের বেয়া দব হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন?”
“ আরো হবো। দু’দিন পর ভাবি আসলে তাকে সঙ্গে নিয়ে বেয়া দবি করব।”
নায়ীব চোখ রাঙালেও লাভ হলোনা। নিশাত ফিরেও চাইলনা। পায়ের গতি তার দ্রুত। এবারও নায়ীবের আগে নেমে গেল ও। নায়ীব তখনও অর্ধেক সিঁড়ি নামেনি। নিশাত কোমরে হাত ঠেকিয়ে বলল,
“ তুমি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো, আসা লাগবেনা।”
“ এমনিতেও যাচ্ছিনা.. এত তাড়াহুড়ো কিসের তোর?”
বিরক্ত ভঙ্গিমায় ঝাঁঝাল স্বরে বলে উঠল নায়ীব। দুপুর থেকে মাথা খেয়ে যাচ্ছে।
নিশাত কাঁধ থেকে চুল সরাতে সরাতে বিড়বিড় করে বলল,
“ তাড়াহুড়ো তোমারও বের হবে, দাঁড়াও।”
সে কলিং বেল চাপল। যদিও দরজাটা ভিড়িয়ে রাখা। ভেতর থেকে ভালোই শোরগোল আসছে। দরজাটা আরেকটু খুলে মুখ বের করল জোহা। নিশাতকে দেখা মাত্রই সে বড় করে হাসল। নিশাত ভেতরে ঢোকার আগে ভাইয়ের দিকে তাকাল। তার ভাবাবেগ নেই। ইশারা দিল ভেতরে ঢোকার জন্য। নিশাত গেলেই সে নিচে যাবে। কিছু কাজ আছে। নিশাত এক পা বাড়িয়েই সামান্য উঁচু স্বরে বলল,
“ আরে স্রোত আপু!”

ব্যস! নায়ীবের পা দু’টো ঘুরে গেল। কাজের কথাও মস্তিষ্কের কোথাও হারিয়ে গেল। নিশাত দরজাটা অর্ধেক আটকে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীব ভেতরের কিছুই দেখতে পেলনা। তবে রিনরিনে একটা মেয়েলি স্বর শুনতে পেল। ওমনি তার ভেতরকার হাঁসফাঁস শুরু হলো। জোহা মাঝ দিয়ে উঁকি দিল,
“ ভাইয়া? ভেতরে আসুন।”
নায়ীব পা বাড়াল। তাকে দেখেই নিশাতের কপালে আপনা আপনি হাত চলে গেল। স্রোত কি জাদু-টাদু করেছে নাকি? মুহুর্তেই এমন ভাবনার জন্য নিজে ধিক্কার জানালো নিশাত। মাথায় দু’টো গাট্টা দিল নিজে নিজেই। ঘরে ওত মানুষ নেই। জোহার মামা আর মামাতো ভাই,নিচ তালার দু’জন মহিলা আর তার মা বাবা। জোহাদের বাসাটা বড় বেশ। ড্রয়িং রুমে আপাতত স্রোত, জোহা, নিশাত আর জোহার মামাতো ভাই। ছেলেটার বিশেষ ভাবাবেগ এদিকে নেই। একমনে সে ফোন দেখতে ব্যস্ত।
ভেতরে ঢুকে তাকে দেখে একবার ভ্রু কুঁচকাল নায়ীব। ভালোই হলো এসে।
সে বসল সোফায়। সামনের সোফা গুলোয় পাশাপাশি বসা স্রোত আর নিশাত। স্রোত মুখ সামান্য নুইয়ে ফেলেছে। লজ্জায় নাকি অন্য কারণে বোঝা যাচ্ছিলনা। তবে তার লাল হওয়া গাল দু’টো পরখ করে চোখ দু’টো শিথিল, শান্ত হলো নায়ীবের। মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে? তাকে দেখে? নায়ীব চোখ ওর পানেই স্থির রেখে অল্প হাসল। আবার হাসি মিইয়েও গেল সেকেন্ডের মাথায়। তবে দৃষ্টি সরলোনা ছিমছাম গড়নের মেয়েটার ওপর থেকে। বুকের ভেতর অনুভূতিদের তীব্রতা বেশ ভালোই উপলব্ধি হচ্ছে তার। সাদা-মাটা খয়েরী কামিজ পরিহিত ছিমছাম গড়নের মেয়েটা একটু একটু করে হৃদয় তার দখলে নিচ্ছে, সেটাও বেশ বুঝতে পারছে নায়ীব।

স্রোত নিশাতের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে বেশ ভালোই বুঝতে পারছে, বাজ পাখির মত একজোড়া নজর তার পানে স্থির। দৃষ্টিটাও প্রগাঢ়। লজ্জায় আড়ষ্টতা বেড়ে যাচ্ছে স্রোতের। চোখ তুলে একবার তাকিয়েই আবার হাঁসফাঁস করে চোখ নামিয়ে নিল। মানুষটার গায়ে ধবধবে সফেদ পাঞ্জাবি। নামাজে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। লম্বাটে দেহের গঠন তার, মুখেও একটা কাঠিন্যতা বিরাজমান থাকে। শ্যামলা মুখে তবুও আজ কোথাও নমনীয়তা দেখতে পেল স্রোত। মেয়েটা বুঝলনা, নমনীয়তা কেবলই তার জন্য বরাদ্দ।

জোহা সবাইকে নিয়ে কেক কাটল খানিক পর। স্রোতকে খাওয়ানোর জন্য হাত বাড়াল। স্রোত একটু খেয়ে আবার তার দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“ হ্যাপি বার্থডে।”
জোহা কেক খেয়ে হুট করে বলল,
“ আমার কিন্তু একটু ইউনিক গিফট লাগবে আপু!”
মেয়েটার গলার স্বরে সামান্য ঘাবড়ে গেল স্রোত। পরমুহূর্তেই জানতে চাইল,
“ কি চাই?”

জোহা ঘরভর্তি মানুষের সামনেই উচ্চস্বরে বলে উঠল,
‘আপনার বিয়েতে সর্বপ্রথম আমাকে দাওয়াত দিতে হবে।’

চলবে..

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১৭

“ ইদানীং বিয়ে নিয়ে খুব ঘ্যানরঘ্যানর শোনা যাচ্ছে। বিয়ের শখ মিটেনি এখনও?”

ওমন রাশভারী গলা কাঁপিয়ে তুলল স্রোতকে। বিয়ের শখ তো সে প্রকাশই করেনি। জোহার সেই কথায় সে হেসেছে কেবল। পাগ ল মেয়ের কথা ধরলে হয় নাকি! কিন্তু সেখানেই নাক ফুলালো একজন। বুক টানটান করে নাকের ডগায় রাগ ঝুলিয়ে দেখল তাকে।

“ কি বলছেন?”
“ বাংলা কথা বুঝতে পারেননি?”
“ জ্বি না, আপনার মুখের ভাষা অনেক কঠিন!” চট করে বলে বেফাঁসে পড়ল স্রোত।

নায়ীব শীতল চোখে চেয়ে। সে খুব স্পষ্ট ভাবেই কথা বলে। অথচ মেয়েটা বলছে তার ভাষা কঠিন? অদ্ভুত!
দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে স্রোত। এক হাতে ব্যাগ চেপে ধরা। চোখ-মুখে ভীতি হলেও মনে ভীষণ লজ্জা। ফোলা-ফোলা গাল দু’টোয় লাল আভা যেন সরছেইনা। এক জোড়া তীর্যক চাহনি তার পুরো মুখশ্রী পরখ করছে। ওমন শীতল অথচ ধারালো চোখের দৃষ্টি গা কাঁপিয়ে দিচ্ছে স্রোতের।
বাবা-ভাইয়ের কড়া নজরদারিতে থেকে প্রেম করা আর হয়ে উঠেনি তার। ভার্সিটিতে এসে সব বুঝতেই তার বছর খানেকের উপর সময় লেগেছে। এরপর পড়াশোনার ব্যস্ততায় সময় কেটেছে। কখনো সেরকম ভাবে কাউকে চোখে লাগেনি। কারোর ব্যক্তিত্ব বোধ, কথার ধরণ, চোখের দৃষ্টি এতটাও টানেনি ওকে। তবে এই তেইশ বছরের মাঝামাঝিতে এসে যেন প্রেমে ধরা দিতেই হল তার। এইযে, এখন সামনে অন্য কেউ হলে তাকে ঠা’টিয়ে দু’টো লাগাতে পিছপা হতোনা স্রোত। অথচ মানুষটা নায়ীব বলেই তার চোখ অব্দি উপরে উঠছে না। হাত তো দূরেই থাক। প্রেম— শব্দটা স্রোতের কাছে একটু অন্যরকম। ভীষণ রকমের লজ্জা আর এক ঝাঁক অনুভূতির। প্রেমে পড়া মানে যদিও বা ভালোবাসা নয়, তবে স্রোতের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টা খুব শীঘ্রই ঘটতে চলেছে। অপর মানুষেরটা স্রোত জানেনা। নিজের অনুভুতিই ব্যক্ত করতে তার জান যায়! অন্যেরটা ভাবতে গেলে আমার মনটা নুইয়ে আসে। যদি সে মানুষটা তাকে নিয়ে একই অনুভূতি অনুভব না করে? যদি সে স্রোতের মতই অনুভূতির জোয়ারে না ভাসে? তবে? এত সব জটিল প্রশ্নের উত্তর জানা ছিলনা স্রোতের। ভাবলেই কেমন দমবন্ধ লাগতো। কিন্তু কাঠখোট্টা মানুষটার দৃষ্টিই যেন সব প্রশ্নের নিরব উত্তর। সব দ্বিধা গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

নায়ীব একহাতের চেয়েও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে। আজ সিঁড়িঘরের বাতিটা নষ্ট হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আলোও ফুরিয়ে এসেছে যেন। স্রোতের মুখ বরাবর ক্ষীণ আলো পড়ছে। নায়ীব যেন অন্ধকারে বিলীন। তবে স্রোত তার উপস্থিতি ঢের টের পাচ্ছে। স্রোত মাথা আরো নুয়ালো। লজ্জায় নাজেহাল অবস্থা যেন যুবতির। নায়ীব চাপা হাসলো। এই বয়সে এসে আবার প্রেমে পড়তে হবে, ভাবেনি কোনোদিন। কাজের প্রেশার আর নিজের কাঠখোট্টা ব্যবহারে বুঝেই গেছিল কপালে কেবল এরেঞ্জ ম্যারেজই আছে। কিন্তু ঘটলো তার বিপরীত।

নায়ীব তখনও ব্যগ্র চোখে চেয়ে। হঠাৎ ধিমে আসা স্বরে কণ্ঠ গলিয়ে শব্দরা বের হল,
“ অকারণে লজ্জা পাচ্ছেন কেন,স্রোতশ্রী?”

স্রোত একবার অবাক পানে চোখ তুলে তাকাল। অন্ধকারে ঝাপসা বোঝা যাচ্ছে মানুষটার চোখ দু’টো। স্রোতের মনে হল, নায়ীব তাকে নিয়ে মজা নিচ্ছে। ওমনি মনটা আকুবাকু করা থামিয়ে দিল। থুতনি ফের ঠেকল গলার নিচে। মুখে নামল ঘোর অমানিশা। তার এমন আচরণে মুখের হাসিটা চওড়া হলো নায়ীবের। সামান্য এগিয়ে এসে বলল,
“ বলুন! লজ্জা কেন পাচ্ছেন? আমাকে দেখে? আমি তো লজ্জা দিইনি।”

ভড়কাল স্রোত। সেকেন্ড খানেক গড়াতেই ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ যেতে হবে আমার।”
“ যান, আটকে কে রেখেছে?”

মুখটা থমথমে হলো স্রোতের। ভ্রু দু’টো কুঁচকে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। পা বাড়াল দ্রুত। মেইন গেটের কাছটায় আসতেই হাতে টান পড়ল। কবজিতে একটা বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া পেতেই কুঁকড়ে গেল স্রোত। আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে পড়তেই হাতের বাঁধন শক্ত হলো। তার নরম-সরম হাতটা বন্দি হল প্রবল অধিকার বোধ নিয়ে চেপে ধরা হাতটার মুঠোয়। ভ্যাবাচেকা খেয়ে প্রতিক্রিয়া দেয়ারও সময় পেলনা মেয়েটা। তার আগেই দ্রুত পা বাড়িয়েছে নায়ীব। সঙ্গে স্রোতকেও যেতে হচ্ছে।

“ আমি অনেক স্বার্থবাদী মানুষ। আগে-ভাগে নিজেরটা নিজে বুঝে নেই। কারোর অপেক্ষা করিনা। আপনি আমাকে বুঝতে পারেননি এখনও। সমস্যা নেই অবশ্য, বোঝার জন্য অনেকটা সময় সামনে পড়ে আছে।”

হাতের বাঁধনটা আরেকটু দৃঢ় হল। তবে সামান্যতমও ব্যথা পেলনা স্রোত। এই প্রথম বাবা-ভাই বাদে কারোর হাত ছোঁয়া। ভীষণ অন্যরকম অনুভূতি। জড়তা, দ্বিধার বদলে লজ্জারা বেশি জায়গা করে নিয়েছে। শুকনো ঢোক গিলল। এই ভরসন্ধ্যায় সে স্বপ্ন দেখছে নাকি? সর্ব নাশ! হচ্ছেটা কি তার সঙ্গে?

..

“ এই স্রোত, এই পুলিশ ওয়ালাকে আমার সুবিধের লাগেনা।”

শুভ্রা কঠিন মুখে বলে উঠল। স্রোত পানির বোতল থেকে সবেই এক চুমুক পান করেছে। মুখ ফুলিয়ে, চোখ নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ কি?”
“ ওইযে ওই সিনিয়র ইন্সপেক্টর না কি ছাই! নায়ীব? হুহ, ও-ই!”

কাঁশি উঠে গেল স্রোতের। শুভ্রা তড়িৎ গতিতে পিঠ হাতিয়ে দিল। মাথায় হাত রেখে বলল,
“ আরে আস্তে খা রে!”
“ কি বলছিলি তুই? উনি আবার তোর কি বিগড়েছে?”
“ উনি! উনি আবার কে?”

থতমত খেল স্রোত। পানির বোতলের ছিপ আটকাতে আটকাতে বলল,
“ আরে ওই ইন্সপেক্টরের কথা বলছি!”
“ ওহ, তাই বল! হুম? ওর সঙ্গে ফেসবুকে অ্যাড হলি কবে?”
স্রোতের কপালে ঘাম। অদ্ভুত! সে ঘাবড়াচ্ছে কেন?

শুভ্রা আবার বলল,
“ তোর ছবিতে কেয়ার দিয়েছিল, দেখেছি। ভালো কথা, ওর সঙ্গে দেখা-টেখা হয় নাকি?”
“ হয়, ওই মাঝেমধ্যে! ”
“ কীভাবে?”
“ জোহাদের বাসার তিনতলায় থাকে!”
“ আরে বাহ! তাহলে তো সপ্তাহে চার-পাঁচদিন দেখা হয়-ই! কিন্তু সাবধান। দূরে থাকবি..পুলিশ-টুলিশে আমার বিশ্বাস নেই।”

স্রোত ঢোক গিলল। বর্তমানে ওরা একটা ক্যাফেতে বসে আছে। শুভ্রা আর সে বেরিয়েছিল অকারণেই। এই এখানে এসে হঠাৎ শুভ্রা নায়ীবের প্রসঙ্গ কেন তুলল, সে জানেনা। নায়ীবের সঙ্গে সে অ্যাড হয়েছে গতকাল। আইডিতে খুব কম মানুষ তার।
তার ঘাবড়ানো চেহারা বেশ ভালো ভাবেই পরখ করল শুভ্রা। সন্দিহান গলায় শুধাল,
“ এই, তুই কিছু লুকাচ্ছিস না তো?”
“ না না! কি লুকাবো?”
স্রোতের মেকি হাসির দিকে চেয়ে গম্ভীর হয় শুভ্রা। বলল,
“ তোর ভাবভঙ্গি ভালো লাগছেনা। দ্রুত বল কাহিনী কি?”
মাথা তৎক্ষনাৎ ঘুরাল স্রোত। অত্যন্ত নিচু গলায় বলল,
“ কিছু না!”
“ এই এই! তুই আবার ওকে পছন্দ-টছন্দ করিস না তো?”
“ হুহ?” স্রোত হকচকাল। তার চাহনি দেখে শুভ্রাও হকচকাল। মাথায় হাত চেপে বসল। উত্তেজিত গলায় বলল,
“ ওমাইগড! ওমাইগড! কি সব শুনছি!”

ওয়াহিদ ব্যগ্র চোখে তাকিয়ে গেটের দিকে। হাতের ফাঁকে সিগা রেট বরাবরের ন্যায়। তবে আজকেরটা এখনও জ্বালানো হয়নি। লাইটার আনতে গেছে পিয়াশ। মিনিট খানেকের মাথায় চলেও এল। এসে আবার দাঁড়িয়েও রইল। ওয়াহিদের ভাবমূর্তির পরিবর্তন নেই। বাইকের উপর চেপে,আঙুলের ফাঁকে সিগা রেট ঘুরাচ্ছে। চোখ দু’টোর গেটের দিকে স্থির। নিশাত নামের মেয়েটা একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। খুব সম্ভবত ছেলেটা ফার্স্ট ইয়ারের। ওয়াহিদ ওত না চিনলেও পিয়াশ চেনে। দেখেই মুখ বাঁকায়। লাইটার এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ পাখি উড়তে সময় লাগেনা, বুঝলা!”
“ নিজের ফালতু মুখটা অফ রাখ।”
পিয়াশ থমথমে মুখ চাইলো। ভালো কথার দাম নেই! যেদিন সত্যি পাখি উড়ে যাবে, সেদিন এই ছোঁকড়া বুঝবে!
তার ভাবনার মধ্যেই ওয়াহিদ তার দিকে চাইল। বলল,
“ এই ছেলেটা কে?”
“ ফার্স্ট ইয়ারের।”
“ এই বাচ্চা ছেলে-পেলের প্রেমের বয়স হয়েছে? দেখ, দেখ! কেমন হেসে হেসে কথা বলছে। দু’দিন গেলে প্রপোজই না করে বসে!”
“ দামড়া গুলো প্রেম করতে পারেনা বলে ওরাও করতে পারবেনা নাকি?”
মা রাত্মক রাগ নিয়ে তাকাল ওয়াহিদ। পিয়াশ চেয়েও পাত্তা দিলনা ওত।
নিশাত ততক্ষণে ক্যাম্পাসের ভেতর চলে গেছে। ওয়াহিদ একবার চেয়ে আবার চোখ ঘুরালো। তার ভাবভঙ্গিতে জেলাসি খুবই স্পষ্ট। প্রেম না করেও ছ্যাঁ-কার স্বাদ মিলছে! শুনেছে, মেয়েটার বড় ভাই পুলিশ! তাও সিনিয়র গোছের। যা-ও বা আগে সাহস ছিল, তা-ও দমে এসেছে। এরে স্ট হলে তো তার সরকারি কর্মকর্তা বাপও ছুটাতে আসবেনা!

চলবে..

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১৮

নিশাতের বড্ড অস্বস্তি লাগছে। ক্লাস শেষ করে সে এসেছে ক্যান্টিনে। এখানে এসেই তার হাসি-হাসি মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে একজনকে দেখে। সে হলো ওয়াহিদ! নিশাতের জানামতে, ওদের এখন ক্লাস নেই। রেজাল্ট ও বের হয়নি। তাও ভার্সিটিতে এসে ঘুরঘুর করছে। ঘুরঘুর করছে;বললেও ভুল হবে। কারণ সে নিশাতের সামনেই আসছে ঘুরে ফিরে। নিশাতের একদিকে ভয়;অন্যদিকে অস্বস্তি। অথচ ওয়াহিদ শান্ত চিত্তে বসা সামনের টেবিলে। মুখোমুখিই বলা যায়। মিষ্টি নিশাতের সামনা সামনি বসলে মুখ দেখা যেতনা। তবে মিষ্টি বসেছে পাশে। তাই ওই ফর্সাটে মুখটা নিশাতের চোখে বাঁধছে খুব।
মানুষটার চোখ দু’টো যদিও এদিকে নেই, তবুও অজানা সংকোচে বারংবার কুঁকড়ে উঠছে নিশাত।

ওয়াহিদ পিয়াশের দিকে চেয়ে বিরক্ত হলো। বলল,
“ এই মেয়ে এমন অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে কেন? চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে আমাকে# অথচ চোখ-মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমিই ওকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো এক্ষুনি!”
“ তোর এত কিছু খেয়াল করা লাগবেনা। চুপচাপ বসে থাক!”
“ আশ্চর্য! আমি কি দাঁড়িয়ে আছি নাকি!”
ওয়াহিদ বিরক্ত হয়। এখনও মেয়েটা তাকাচ্ছে একটু পরপর! এই ‘পর-পর’ এর ফাঁকে ওয়াহিদও তাকাতে ভুলছেনা। আজ বোধহয় দিনটা ভালোই যাচ্ছে, তাই ধরা পড়ছেনা।

নিশাত খানিক পর মিষ্টিকে বলল,
“ তোর খাওয়া শেষ হলে চল, বাসায় যাব।”
মিষ্টি ভ্রু সামান্য উপরে তুলে একবার ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ওয়াহিদকে চো রা চোখে তাকাতে দেখে মেকি হাসল। ওর হাসি দেখে তড়াক করে ওয়াহিদ চোখ ফেরাল। পিয়াশকে বলল,
“ মেয়ে মানুষের বিশ্বাস নাই ভাই! চল উঠে যাই! দেখা যাবে পুলিশ ভাই এনে কেলা নি দিচ্ছে!”
পিয়াশ শক্ত চোখ-মুখে চাইলো। ওয়াহিদ ভীতু নয়। পুলিশ-ফুলিশও আহামরি ভয় পায়না। তবে সে ভয় পাচ্ছে নিশাতকে। তা-ই আপাতত ঢাকতে চাচ্ছে।

ওয়াহিদ তড়িঘড়ি করে উঠল। ওমনি পিয়াশ হাত টেনে ধরে আবার বসিয়ে দিল। ওকে উঠতে আর বসতে দেখে নিশাত হকচকালো। জানটা লাফিয়ে উঠল। ও ভেবেছিল ওয়াহিদ উঠে এসে ওর সামনে এসে দাঁড়াবে। সেদিনকার মত ভয় দেখিয়ে অদ্ভুত কথা বলবে। তবে তার কোনোটাই হলোনা। নিজের ভাবনায় নিজেরই মেজাজ খারাপ হলো ওর।

..

সাঈম সাহেব আজ শহরে এসেছেন। সামনে আবার ইলেকশন। গ্রামে-গঞ্জে দারুণ উন্মাদনা। সাঈম সাহেবের প্রবল আত্মবিশ্বাস; তারই জয় হবে। সে অনুযায়ীই প্রস্তুতি চলছে। তিনি আজ এসেছেন মূলত একটা নিমন্ত্রণে। শহরে তার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন। বহুদিন দেখা হয়নি। তার বাসায়ই আসা। লোকটার নাম মীর হামিদ। পেশায় তিনি একজন সাংবাদিক। সাঈম সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের বলা যায়না। কারণ মীর হামিদ সাঈম সাহেবের সিনিয়র।

সাঈম সাহেবকে দেখে হামিদ বুকে টেনে নিলেন। এরপর বসতেই সাঈম রহমানের ফোনে কল এলো। স্রোতের নামটা স্ক্রিনে আলগোছে দেখে নিলেন হামিদ সাহেব। ওমনি জিজ্ঞেস করলেন,
“ তোমার মেয়ে?”
“ জ্বি!”
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি গলায় সালাম জানালো স্রোত। এরপর বলল,
“ আব্বু! কখন আসবে? আমার টিউশনি আছে আজ।”
“ আসতে বিকাল হবে।”
“ আচ্ছা, আমি ঠিকানা পাঠিয়ে দিব।”

পাশে বসা হামিদ সাহেবও তাদের কথা শুনলেন। সাঈম সাহেব কল কাটতেই বলে উঠলেন,
“ তোমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে, তাইনা?”
সাঈম সাহেব চাপা হাসলেন,
“ ওতো বড়ও হয়নি। বাবার কাছে মেয়েরা কখনো বড় হয়না।”
হামিদ সাহেব হাসলেন ফের।

..

স্রোত চঞ্চল পায়ে সিঁড়ি নামছে। মনটা আজ বেশ খারাপ। দু’দিন ধরে একজনের দেখা নেই। হুটহাট কোথাও দেখাও হচ্ছেনা। যোগাযোগ করতেও কেমন লজ্জা বোধ হচ্ছে ওর। এদিকে আবার মনও অশান্ত। সাঈম সাহেবকে আগেই এখানের ঠিকানা পাঠিয়েছে স্রোত। হোস্টেলে বসে তো আর কথা বলা যাবেনা। পুরুষ মানুষ এলাউড না। তার উপর স্পেসও নেই। বাবা ছোট্ট রুমটা দেখলে নাক সিটকাবেন নিশ্চিত।

মেইন রোডের কাছে আসতেই গাড়িটা নজরে এলো। ড্রাইভার দাঁড়িয়ে পাশেই। স্রোত এগোতেই দরজা খুলে দিল। পেছনে উঠে বসল স্রোত। সাঈম সাহেব কলে কথা বলছিলেন। আড়চোখে মেয়েকে দেখলেন। চোখ দু’টো আনন্দে চকচকে তার। এদিকে ঘুরে বসে আছে। সাঈম সাহেব হাত বাড়িয়ে মাথায় বুলিয়ে দিলেন। ফোন রেখে বললেন,
“ ড্রাইভার! গাড়ি ঘুরাও..”
এরপরই মেয়েকে এক হাতে আগলে ধরে বললেন,
“ তোমার জন্য সুন্দর একটা সারপ্রাইজ আছে, আম্মু।”

..

নাম তার হেমন্ত। দেখতে-শুনতে মোটামুটি। সুদর্শন হলেও হতে পারে। তবে তাকে আপাতত নিজের চোখে এভারেজই লাগছে স্রোতের। আবার চোখের বি;ষও লাগছে। পেশায় সে একজন ইঞ্জিনিয়ার। নম্র-ভদ্র চাল-চলন। ভীষণ লাজুকই বোধহয়। লাজুক ছেলে স্রোতের পছন্দ নয়। লজ্জা নারীদের ভূষণ। আর এখানে কিনা এই ছেলে নিজেই লজ্জায় লাল-নীল হচ্ছে? তবে স্রোতের ধারণা ভুল।

রেষ্টুরেন্টে উপচে পড়া ভীড়। তবুও কীভাবে কর্ণারের একটা টেবিল ম্যানেজ করেছে এই লোক, কে জানে। হয়তো আগেই রিজার্ভ করেছে। তার মানে সব প্ল্যানড ছিল! ভাবতেই নাকের পাটা ফুলে উঠল স্রোতের।
অন্যদিকে; দুজনকার মধ্যবর্তী নিরবতায়, ঠিক কি কারণে স্রোতের নাকের পাটা ফুলে উঠছে, হেমন্ত বুঝতে পারছেনা। নিজের নাকের ডগায় আসা চশমা একপ্রকার ঠেলে উপরে তুলল। তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“ হ্যালো, মিস?”

স্রোতের রাগ আরো টগবগিয়ে উঠল। পিঠ সোজা করে বসে সামনা সামনি তাকালো। তার ওই আগু ন চোখে চেয়ে সামান্য কেঁশে উঠল হেমন্ত। মেয়ে দেখতে এই প্রথম আসা। তাও একা! বাবার ভীষণ পছন্দের নাকি এই মেয়ে।

“ তুমি কি রেগে যাচ্ছো? সরি ফর সেয়িং তুমি! আসলে তুমি আমার অনেক ছোট তো!” বলে হেমন্ত মেকি হাসল। স্রোত শান্ত হলো। একটা তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিঁড়ে। ভদ্রতার খাতিরে হলেও একজন অপরিচিতকে ‘আপনি’ বলতে হয়। ছোট হোক নাহয় বড়! কই! নায়ীব তো প্রথম দিন তাকে তুমি বলেনি। এ কেন বলবে? আবারও রাগটা তরতরিয়ে উঠল। সাঈম সাহেবের সারপ্রাইজটা অত্যন্ত চমকপ্রদ কিন্তু বাজে ছিল। একবার স্রোতের মতটা নিতে পারতেন। তা না! কোন ক্যাবলাকান্তের সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছেন সোজা!

“ কথা বলছো না কেন? আমি কিন্তু টকেটিভ না, আমি গুড লিসেনার। আমার পার্টনারকে তাই অবশ্যই টকেটিভ হতে হবে।” এক নিঃশ্বাসে বলে থামল সে। স্রোত চট করে উঠে পড়ল। রাগের বশে না কখন কাঁচের গ্লাস এর মাথায় ভাঙে। চোখ রাঙিয়েও বিশেষ লাভ হলোনা। চশমা ব্যবহার করেও বোধহয় এ কিছুই দেখেনা। পাওয়ার কম। হেমন্ত হা করে চাইল। বলল,
“ উঠলে কেন? মাত্রই তো এলে।”
“ আমার আর্জেন্ট কাজ আছে। ভালো থাকবেন, আসি।”

হেমন্ত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা গটগট পায়ে বেরিয়ে গেল। আশ্চর্য! কিছু অর্ডারও করলনা! খেলোও না..নিজের ব্যাপারে কিছু বললোওনা।

..

সুহাদ স্ক্রিনে তাকাতেই ভড়কালো। ওপাশে ফ্যাকাশে,নিরস চিত্তে বসা স্রোত। চোখ দু’টো টলমলে। যেকোনো মুহুর্তে কেঁদে ফেলবে, এমন অবস্থা। সুহাদ বেরিয়ে এল ফ্যাক্টরি থেকে। খোলা আসমানের নিচে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“ কি হয়েছে, পাখি? এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
নাক টেনে উঠল স্রোত। তার ভীষণ দুঃখ হচ্ছে। সাঈম সাহেব জানিয়েছেন, হেমন্তের নাকি তাকে পছন্দ হয়েছে। এখন তার মতামত জানার পালা। এরপর বাকিসব। স্রোত কিছু বলতে পারেনি। বোবা বনে কল কেটে দিয়েছিল। বাড়ির সকলেই এ ব্যাপারে অবগত। মীর হামিদের একমাত্র সুপুত্র হেমন্ত। আলাদা করে দেখা সাক্ষাৎ করার কিছু নেই। সাঈম সাহেব লোক লাগিয়ে খবর ঘন্টার মাঝেই বের করে ফেলেছেন। তার উপর হামিদ সাহেব তার পূর্বপরিচিত। নিরেট ভদ্রলোক তিনি।

“ বিয়ে করবনা আমি।” চোখ টলমলে, অথচ কাঠিন্যতায় ঘেরা মুখের আদল। সুহাদ ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে হাসল অগোচরে। এরপর আবার গম্ভীর চোখ-মুখে তাকিয়ে বলল,
“ কেন? আব্বু বলেছে, ছেলেটা অনেক ভালো। চাচ্চুও খবর নিয়েছেন। যথেষ্ট ওয়েল ম্যানারড। চাকরিও ভালো মানের করে, দেখতে শুনতেও…”

স্রোত চট করে কল রেখে দিল। ভাইকে সে কীভাবে বলবে, ওয়েল ম্যানারড মানুষটাকে তার মনে ধরেনি? ধরেছে আরেক বজ্জাতকে? যে তার খোঁজই নেয়না ঠিকমত! ফুঁসে উঠে ও। চট করে আবার ম্যাসেজ লিখে সুহাদকে পাঠায়।
“ আমি এখন বিয়ে করবনা, আব্বুকে বলে দিও। উনার পছন্দের পাত্রকে আমার পছন্দ হয়নি।”

সুহাদ মিটমিট করে কতক্ষণ হাসলো ম্যাসেজ পড়ে। এরপর টাইপ করল,
“ আব্বু আমার কথা শুনবে কেন? বিয়ে তো আমি করছিনা! আমার বিয়ে তো সেট-ই! তোর অপিনিয়ন, তুই আব্বুকে জানা।”

চলবে..