গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-১৯+২০+২১

0
704

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১৯

রাজীব সাহেব মুখোমুখি বসে আছেন। তার নামে অনেক কেস আছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে এসব কেসের ফাইল কোনো পুলিশ খুলেও দেখবেনা। তবে, কিছুদিন আগে একজন নতুন করে কেস করেছে। খু*নের কেস! রাজীব সাহেবের নামে! তাও আবার সাক্ষী সমেত। জায়গা জমির বিবাদ নিয়ে একজনকে লোক লাগিয়ে খু*ন করা হয়েছে। মূলত এসব কেস নিয়েই নায়ীব কিছুদিন যাবত কিছুটা ডিস্টার্বড ছিল।

রাজীব সাহেব তো আর থানায় আসবেন না। তাই বাধ্য হয়ে নায়ীবকে আসতে হয়েছে তার পার্টি অফিসে। এত নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো নায়ীব। ক্ষমতায় তো আর পুরো জীবন থাকবেনা এই লোক। তারপর বুঝবে মজা। তখন নিজেদের লোকই তাকে আস্ত রাখবেনা। নায়ীবের হাতে নীল রঙের ফাইল। সেটা ও টেবিলের ওপর রাখতেই এক প্রকার ছিনিয়ে নিল রাজীব সাহেবের ম্যানেজার। খুলে অবশ্য দেখলনা। হাতে এমনভাবে আঁকড়ে ধরল, যেন এ জিনিস খোয়ালে জান যাবে! নায়ীব শক্ত চোখে একবার তাকে দেখল। রাজীব সাহেব বললেন,
“ এই ফাইলের ব্যাপারে ভুলে যাও। কেউ মিথ্যে কেস ঠুকতে আসবে আর তোমরা কেস ফাইল করবা নাকি? প্রমাণ-ট্রমান ছাড়া একশনও তো নিতে পারবানা।”
“ সাক্ষী আছে।” হিম শীতল স্বর।
“ টাকা খাইয়ে আমিও দশ বারোটা সাক্ষী বানিয়ে তোমাকে ফাঁ-সাতে পারব!” নায়ীব থমকে গেল। পরমুহূর্তেই চোয়ালটা শক্ত হলো। তার কঠিন চোখের দৃষ্টিতে সামান্য বোধহয় ভড়কালেন রাজীব সাহেব। তবে বুঝতে দিলেন না। বললেন,
“ আরে, মজা করছি অফিসার। আমার সঙ্গে শ-ত্রুতা করে লাভ নেই। তাছাড়া এ কেস তোমার থানার আন্ডারেও না।”

নায়ীবকে উঠতে হলো। কেসের ফাইল সরিয়ে ফেললেও তো সত্য চাপা থাকেনা। তবে সঠিক বিচারও বা কয়জন পায়! এলোমেলো কদমে ও অফিস থেকে বেরোলো। চোখের দৃষ্টিও এলোমেলো। জিহাদ বাইরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে এগিয়ে এল। হাত খালি দেখে যা বোঝার বুঝে নিল। এমনিতেও কয়েক ঘন্টা পর একটা কল আসবে। কেসটা স্থানান্তর করতে। কারণ থানাটা ওদের আন্ডারে না।

..

তখন মধ্যরাত। সারাদিনের ক্লান্তি শরীরে নিয়ে বসে আছে শক্তপোক্ত গড়নের মানুষটা। আঙুলের ফাঁকে সিগা রেট। বারান্দায় গা কাঁপানো রিনরিনে, শীতল বাতাসের আনাগোনা। অন্যহাতে ফোন। নায়ীবের চোখ-মুখ অত্যাধিক শান্ত। ফোনের স্ক্রিনে তখন সাদা প্রোফাইল ভাসছে। আশ্চর্য! মেয়েটা কোথায় গায়েব হলো? ম্যাসেজ দেয়ারও উপায় নেই। ভাবনা ঠেলে আবার কল লাগালো সেভ করা নাম্বারটায়। প্রথমে রিং হলেও এরপর সুইচড অফ শোনাল। হতভম্ব হলো নায়ীব। তার মানে মেয়েটা ব্লকই করেছে!

..

মাগরিবের আজান পড়েছে সবে। স্রোত আজ আরেকটু পড়িয়ে বের হলো। দিন ছোট হচ্ছে ক্রমশ। তাই সন্ধ্যার দিকটায় আরেকটু পড়িয়ে যেতে হয় জোহাকে। জোহা মেয়েটা ভীষণ অলস। পরীক্ষার দিন এগোচ্ছে আর তার আলসেমি বাড়ছে। আজ রেগে-মেগে স্রোত ক’টা ধমক দিয়েছে। তাতেই মুখটা ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে ছিল। আসার সময় অবশ্য স্রোত নরম ব্যবহার করে এসেছে।
স্রোত যখন বের হয়েছে তখন বাইরেটা অনেকটাই তমসায় ঘেরা। স্রোত দ্রুত পা চালালো। গলির মুখটায় ইদানীং কিছু ছেলে-পেলে বসে থাকে আড্ডার বাহানায়। সন্ধার পরপরই তাদের উৎপাত শুরু হয়। স্রোত গলির মুখটায় আসতেই দেখতে পেল, দু’টো বেঞ্চ জুড়ে চারজন বসা। টং দোকানটার সামনেই এ বেঞ্চ রাখা। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্রোতের অবয়ব স্পষ্ট হতেই চার জোড়া চোখ তড়াক করে গতিপথ পাল্টালো। স্রোত না তাকিয়েও বুঝতে পারল। হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই, রিকশাও পাচ্ছেনা। অগত্যা কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো। এরপর কি ভেবে পা দু’টো টেনে এগোলো। বেশিদূর যাওয়া হলোনা, এর পূর্বেই বুটের গটগট শব্দ শোনা গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে খাড়া শীতল স্রোত নেমে গেল যেন। ললাটের বিন্দু বিন্দু ঘাম দিয়ে মুছে ও কদম দ্রুত ফেলল। পেছনে তাকানো মানেই তো বিপদ। মাঝরাস্তায় দেখা মিলল একটা রিকশার। স্রোত হাত দিয়ে থামিয়ে দ্রুত চেপে বসল তাতে। তবে রিকশা চলার আগেই একটা গুরুগম্ভীর স্বর শোনা গেল,
“ সরে বসুন একটু।”
ওমনি ছোট্ট জানটা যেন লাফিয়ে উঠল। বুক হাত চেপে পাশে হেলে পড়ল স্রোত। ওমনি কেউ চড়ে বসল রিকশায়। শক্ত কাঁধটায় নিজের কাঁধ ধা-ক্কা খেতেই ধ্যান ফিরল স্রোতের। হতবুদ্ধি হয়ে মুখ খোলার পূর্বেই মানুষটার ইশারায় রিকশা চালক প্যাডেল মা-রলেন। রিকশা চলতে শুরু হলো। পিঠের পেছনে গলিয়ে হুডের একপাশ চেপে ধরল মানুষটা। স্পর্শ না লাগলেও গা শিরশির করে উঠল স্রোতের। মুখ খুলে ফের কিছু বলার পূর্বেই গম্ভীর স্বরটা আটকে দিল,
“ হুশ! কথা বলবেন না, আজ শুধু শুনবেন।”

“ ফোন কোথায় আপনার? কতবার কল দিয়েছি! এফবিতেও নেই। সমস্যা কি?”
প্রশ্নের পিঠে জবাব না পেলে যে কেউ তেঁতে উঠে। তবে নায়ীব আজ নিজের মেজাজ সংবরণ করল। চোখ উলটে ফোঁস শব্দে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর বলল,
“ কিছু জিজ্ঞেস করেছি!”
“ শুনছি!”
“ উত্তর দিন।”
“ পারবনা।”
ধৈর্যহারা হলো নায়ীব। পিঠের পিছন থেকে হাত সরে এল। কাঁধে কাঁধ বারংবার ধাক্কা খাচ্ছে। মেয়েটা মাথা নুইয়ে ফেলেছে। খানিক পর এই সুনশান রাস্তায় নাক টানার শব্দ শোনা গেল। ওমনি নায়ীব হতভম্ব হলো। নাক টেনে-টেনে মেয়েটা ক্রন্দন আটকানোর চেষ্টায়। এ চেষ্টায় সফলও বটে সে। সেকেন্ড খানেকের মাথায় কান্না গিলে ও শক্ত চোখ-মুখে সামনে তাকিয়ে বলল,
“ রিকশায় উঠেছেন কেন? নামুন!”
“ কান্না করবেন আপনি? কি আশ্চর্য! কি হয়েছে?” প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন! স্রোত মুখ ফেরালো। অভিমান নাকি রাগ, ধরতে বেশ অনেক প্রহরই লাগলো নায়ীবের। নাকের ডগাটা লাল দেখাচ্ছে মেয়েটার। কানের পিঠ থেকে কয়েক গোছা চুলও বেরিয়ে এসেছে। গায়ে আজ পাতলা শালও জড়িয়েছে। জ্বর-টর নাকি? নায়ীব ঠোঁট কাম ড়ে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে চেয়ে রইল। রিকশা চলছে আপন গতিতে। রাস্তাটাও নিস্তব্ধ। পথও ফুরাচ্ছেনা। পাশে বসা মানুষটার হঠাৎ নিরব হয়ে যাওয়ায় স্রোত আড়চোখে তাকাল। চোখাচোখি হতেই আবার চোখ ফেরাল। নায়ীব মৃদু হেসে বিড়বিড় স্বরে বলল,
“ অভিমান করলে কাউকে এত সুন্দর দেখায়, জানতাম না!”

বাক্য শেষ হতেই স্রোত কাটকাট গলায় বলল,
“ কিছু বললেন?”
“না!”
স্রোত আশাহত হলো। এইতো শুনলো এই লোক কি যেন বিড়বিড় করছিল! অস্বীকার করল? নাকি সে-ই ভুল শুনেছে! মনের ভুলই হয়তো! সে সবসময়-ই বেশি বেশি ভেবে ফেলে। এবারও নিশ্চয়ই তা-ই হয়েছে। ওভার থিংকিং না জানি কোন বিপদ বয়ে আনে ওর জন্য। মনটা আবার বিষন্ন হলো ওর। দমে যাওয়া মুখটার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে নায়ীব। মনের কথা মুখে আনা ভীষণ টাফ এন্ড রিস্কি কাজ ওর মতে। তবে এবার উপায়ও নেই!

রিকশা আচমকা থেমে গেল। স্রোতের ধ্যান ছুটে। নায়ীব ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় রিকশা চালকের দিকে। রিকশা চালক বললেন,
“ চলে আইছি!”
স্রোত তড়িৎ গতিতে নেমে গেল। ব্যাগ হাতড়ে টাকা ধরিয়ে দিল রিকশা চালকের হাতে। নায়ীব হতভম্ব বনে দেখে গেল। তার উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে স্রোত হোস্টেলের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। রিকশা চালক ভ্রু কুঁচকে তাকালেন নায়ীবের দিকে। হতভম্ব মুখাবয়ব খানা পরখ করে আচমকাই প্রশ্ন করলেন,
“ কি হয় মামা? প্রেমিকা?”
আরেক দফা হতভম্ব হলো নায়ীব। বিষ ম খেল সামান্য। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বের হলো,
“ হুহ?”
“ রাগ করছে মনে হয়।”

নায়ীব জবাবে চুপ রইল। রিকশা চালক ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“ কোথায় যাইবেন?”
“ যেখান থেকে এসেছি! রিকশা ঘুরান, মামা।” একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল নায়ীব।

..
আজ রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে। ওয়াহিদ মোটামুটি ভালো একটা রেজাল্ট করেছে। সে আশাহতও না আবার খুশিও না। রেজাল্ট হাতে পেয়ে মনে হলো, স্রোতকে জ্বা-লানো যাবেনা এবার। এ নিয়ে অবশ্য খানিকটা হা-হুতাশ করলো সে। মেয়েটা এখন ইনিয়ে-বিনিয়ে খোঁ-চাবে তাকে। ওয়াহিদকে মুখ বন্ধ রাখতে হবে! এসব ভেবেই কেমন একটা নিরাশ হচ্ছিলো সে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে সে ভার্সিটির সামনে। রোজকার নিয়ম হয়ে গেছে এটা। ফার্স্ট ইয়ারের যতদিন ক্লাস থাকে, সে এসে দাঁড়িয়ে রয়। পিয়াশও সঙ্গ দিতে আসে মাঝেমধ্যে। তবে সে আসলে ওয়াহিদকে একটা খোলস ধারণ করতে হয়! শক্ত সাজার খোলস। সে আদতে দিন দিন নিশাতের প্রতি প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়ছে। মেয়েটার ভীতিগ্রস্থ চেহারা তাকে টানে। চোখ দু’টো যেন আস্ত মায়ার বিল। যখন অস্বস্তি নিয়ে তাকায়, তখনও ওয়াহিদের মন আকুবাকু করে উঠে। তবে কোথাও একটা লাগাম টানতেই হয়। মেয়েটার ভাই সম্পর্কে সে খোঁজ নিয়েছে। দাপুটে আছে বলা যায়। ওয়াহিদকে জে-লে ভরা তার বাম হাতের খেলা। দেখা গেল, ভালোবাসা প্রকাশের অপরাধে ওয়াহিদকে জে-লে ভরে রেখেছে আর নিশাত বাইরে টো টো করে ঘুরছে। তাও যদি হয় অন্য কাউকে নিয়ে? যদি একটা প্রেমিক পেয়ে যায়? ওয়াহিদের বুকে চিনচিন ব্যথা হয়। মাথায় ইদানীং আউল-ফাউল চিন্তা ঘুরে।

ওয়াহিদ আড়মোড়া ভেঙে বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়। গেটের সামনে তখন একজন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কারোর অপেক্ষা করছে। ওয়াহিদকে সে এখনও দেখেনি। দেখলে মুষড়ে যেত সেকেন্ডের মাথায়,রকেটের গতিতে গেট পেরিয়ে ক্যাম্পাসে চলে যেত। ওয়াহিদ ওদিকে চেয়ে হাই তুলে। তক্ষুনি পেছন থেকে এক মেয়েলি স্বর শোনা যায়,
“ ভাইয়া, এভাবে লুকিয়ে আর কত দেখবেন ওকে?”
ওয়াহিদ হতবাক হয়ে পিছু ঘুরে। মিষ্টি দাঁড়িয়ে। চোখ-মুখে কৌতুক খেলা করছে। ওয়াহিদ চট করে ধরে ফেলল তা। এই মেয়েটা ভীষণ চালাক ধাচের। ওয়াহিদের গতিবিধি লক্ষ্য করে বুঝে ফেলেছে সে নিশাতের জন্য কতটা মরিয়া! অথচ তার বল দ বান্ধবী সেটা ধরতে পারেনি। ওয়াহিদের অবাকতা বিদায় নিয়ে হতাশার আগমন হলো। ও উদাসীন গলায় বলল,
“ যতদিন দেখা যায়।”
“ সরাসরি বলে দিলেই তো হয়।”
“ ইম্পসিবল! তুমি এসব আবার তোমার মাথামোটা বান্ধবীকে বলতে যেওনা।”
“ বললে আমি আস্ত থাকবোনা। আপনিও থাকবেন না। ওর ভাই জ্যান্ত পুঁ;তে দিবে। আসি ভাইয়া, থাকেন।”
বলেই মেয়েটা রাস্তা পার হলো। ওয়াহিদ হা করে তাকিয়ে রইল। একবার বলল মনের কথা স্বীকার করতে, আরেকবার মাথায় ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে গেল! মেয়ে মানুষ এমন কেন!
মিষ্টি রাস্তা পার হয়ে নিশাতের কাছে যেতেই নিশাত সর্বপ্রথম প্রশ্ন করল,
“ ওই ছেলের সঙ্গে কি কথা বলছিলি?”
“ হঠাৎ দেখা হলো, তাই সালাম দিয়ে এলাম। সিনিয়র তো, র‍্যাগ-ট্যাগ না দিয়ে বসে সালাম না দেয়ার অপরাধে।” অবলীলায় মিথ্যে বলে মিষ্টি মুখ লুকিয়ে হাসলো। নিশাত ভাইয়ের ভয়েই ওয়াহিদের সামনে পড়েনা। অথচ একদিন গেটের সামনে ওকে না দেখলে কেমন উদ্বিগ্নতা চেহারায় ফুটে উঠে! মিষ্টি সব দেখে, বুঝে।

..

শুভ্রা আর স্রোত দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। জায়গা বলতে একটা রেষ্টুরেন্টের সামনের অংশ। ভীড় দেখে ভিতরে ঢোকার সাহস হয়নি। রেষ্টুরেন্টটা থানার ঠিক বিপরীতে। স্রোতের চোখ-মুখে অস্বস্তি। শুভ্রা নির্বিকার ভঙ্গিতে মুখে ক’টা চিপস গুঁজলো। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। থানা থেকে তো বজ্জা!তটার বেরোনোর কথা! বেরোচ্ছে না কেন? এক পর্যায়ে শুভ্রা বিরক্ত হয়ে চিপসের প্যাকেট ধরিয়ে দিল স্রোতের হাতে। হাত ঝেড়ে বলল,
“ কার প্রেমে পড়লি রে ভাই? এমন আজব মানুষ ইহজীবনে দু’টো দেখিনি।”
স্রোত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজকে এখানে আসার প্ল্যানটা শুভ্রার। যদিও বা ওরা ঘুরতে বেরিয়েছিল। তবে এখানে এসেই ব্রেক কষেছে শুভ্রা। সাইলেন্ট ট্রিটমেন্টের প্ল্যানও শুভ্রার। আর যাইহোক, ইগনোর ব্যাপারটা নায়ীব এড়াতে পারবেনা। মেইল ইগো হার্ট হবে অবশ্যই। সেদিন হোস্টেলের গেটের ভেতর ঢুকে সিঁড়িতে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল স্রোত। এরপর আবার ফিরে এসে ফাঁকা রাস্তায় নজর বুলিয়েছে। মানুষটা দাঁড়িয়ে থাকেনি।
“ এই এই, দেখ দেখ বেরোচ্ছে।”
শুভ্রা আচমকা লাফিয়ে উঠল। এরপর একপ্রকার ছিনিয়ে নিল চিপসের প্যাকেট। স্রোত হতবিহ্বল হয়ে তাকাল সামনে। মানুষটার যেন রাজ্যের তাড়া। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে। গাড়িতে চড়তে এখন আর ভালো লাগেনা তার।
আজ সিভিল ড্রেসে এসেছে। পেটা নো শরীরটায় কালো রঙের শার্ট। সঙ্গে কালো ফর্মাল প্যান্ট। হাতা দু’টো খুবই গুছিয়ে গোটানো কনুইয়ের কাছটায়। হাতে আবার ঘড়িও। চুলগুলো সামান্য লম্বা হয়েছে, গালেও ছোট-ছোট দাঁড়ি গজিয়েছে। কুঁচকানো কপালেও সুন্দর দেখাচ্ছে বেশ!
এত পরিপাটি হওয়ার সময় মেলে, অথচ স্রোতের সঙ্গে দু’দন্ড কথা বলার সময় মেলেনা? স্রোত চোখ ফেরালো। রাস্তার ওপার থেকে মানুষটার নজরে আটকাতে আর বেশিক্ষণ লাগলোনা। প্রথম ক্ষণে নায়ীব নিজের চোখকে অবিশ্বাস করল! কল্পনায় সর্বক্ষণ বিচরণ করা নারীটা এখানে, নাকি সবটাই ভ্রম? সারাক্ষণ ভাবনার ফলে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে নাকি?
তবে পাশে দাঁড়ানো শুভ্রাকে দেখে সে নিশ্চিত হলো। কপালে আরো গাঢ় ভাঁজ পড়ল। দুই বান্ধবীর এখানে কি কাজ?
ও চট করে ফোন বের করল। কল লাগাল রাস্তার ওপাশে থাকা মানু্‌ষটাকে।

ফোনটা বেজে উঠতেই চমকালো স্রোত। শুভ্রা পাশ ফিরে চাইল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“ প্রথমবারেই ধরবিনা, একদম কেটে যাওয়ার একটু আগে ধরবি।”
স্রোত তা-ই করল, কল রিসিভ করল একদম শেষে। নায়ীবের ধৈর্যের সীমা তখন একদম শেষ প্রান্তে। তবে রিসিভ হতেই একবার হাঁফ ছাড়ল। সোজা-সুজি বলল,
“ এখানে কি করছেন?”
“ আপনাকে বলতে হবে?”
“ আমার থানার সামনে যেহেতু দাঁড়িয়ে, সেহেতু বলতে হবে!”
“ আমি কোনো থানার সামনে দাঁড়িয়ে নেই। আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তাটা তো আপনার না..” শীতল স্বর। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো নায়ীব। কি কারণে মেয়েটা অভিমান করেছে ওর জানা নেই। তবে এবার অভিমানের পাহাড় ভাঙ্গতে পারলে ফের আর জমতে দেয়া যাবেনা— সেটা মনেমনে প্রতিজ্ঞাই করল একপ্রকার।

কানে ফোন ঠেকিয়েই নায়ীব রাস্তা পার হলো। শুভ্রা পাশ ঘেষে দাঁড়ালো স্রোতের। ভ্রু মা’রাত্মক কুঁচকে বলল,
“ মিষ্টি-মিষ্টি কথায় গলবিনা একদম। আগেরবার গলেছিস দেখে দুই-তিনদিন খোঁজ নেয়নি। এবার গললে সপ্তাহ গড়াবে, এরপর মাস! সাবধান!”

শুভ্রার কথা কানে এসে ঠেকলো ঠিকই। তবে মনোযোগটা কেবল একজনের পানেই স্থির হলো স্রোতের। নায়ীব রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে এলো ধীরে সুস্থে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভ্রু নাঁচালো আকর্ষণীয় কায়দায়। তাতেই স্রোতের লাজুকতা উপচে পড়ল। তার আমতা-আমতা করা চেহারার দিকে ছোট ছোট চোখে তাকালো নায়ীব। নিচু গলায় জানতে চাইল,
“ আপনার এদিকে কি কাজ,স্রোত? একা একা এসেছেন কেন?”
“ একা একা আসবে কেনো? জলজ্যান্ত আমাকে চোখে দেখছেন না নাকি!”
শুভ্রা বিষ্ময়ে নিয়ে বলে উঠল। নায়ীব এবার তার পানেও তাকাল। সামান্য হেসে বলল,
“ ওহ, দেখিনি।”
মিনিট খানেক বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুভ্রা। এরপর মুখটা ভোঁতা করে ফুঁসে উঠল। স্রোতের হাত টেনে বলল,
“ এই চল, দেরি হচ্ছে।”

টানার কারণে সামান্য হেলে পড়ল ওমন। ডান হাতটা যখন শুভ্রার কাছে বন্দি, বাম হাতটাও তখন বন্দি হলো পুরুষালী হাতের মাঝটায়। দু’দিকে দুজন, বিশাল দোটানায় পড়েছে যেন স্রোত।
স্রোতের বাম হাতের দিকে তাকাতেই অক্ষিযুগল কোটর হতে বেরিয়ে আসতে চাইলো শুভ্রার। চোয়াল সামান্য ঝুলে পড়ল। বিষ্ময়ে ডান হাতটা ছেড়ে দিল। তার এমন চেহারার সুরত দেখে নিজে প্রতিক্রিয়া দিতে ভুলে গেল স্রোত। শুভ্রা হাত ছাড়লেও অপর হাতটা এখনও বন্দিদশায়। মানুষটা আরেকটু কাছে আসলো। মধ্যকার দূরত্ব অত্যন্ত ক্ষীণ, নগণ্য। শুভ্রার দিকে চেয়ে রুক্ষ গলায় বলল,
“ তোমার বান্ধবী আমার সঙ্গে যাক।”

শুভ্রা মাথা দোলালো কেবল। নায়ীবের রাতারাতি পালটে যাওয়া ভাবমূর্তি দেখে আর বাজাতে মন চাইলোনা তাকে। পাছে যদি রেগে গিয়ে এই ফুটপাত ভর্তি মানু্ষের মাঝে ধমক দেয়! শুভ্রা পরপর কয়েকবার মাথা দুলিয়ে বলল,
“সমস্যা নেই, ভাইয়া। আমি যাচ্ছি। এ্যাই,স্রোত..গেলাম আমি, হ্যাঁ? থাক তুই! আল্লাহ হাফজ।” গড়গড় করে বলে ফেলল মেয়েটা। এরপর স্রোতকে একা ফেলে রেখে সুরসুর করে পালালো। একটু আগেও সে নায়ীবের বিপক্ষে ছিল। হঠাৎ তার এমন পরিবর্তন দেখে স্রোত বাকশূন্য হয়ে পড়ল। চোখের পলকেই শুভ্রা রিকশায় চেপে চলে গেল। নায়ীব একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, হাতের মুঠোয় হাত আটকে। স্রোতের হাতটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে যেন। শক্তি নেই। অস্বস্তি নিয়ে নায়ীবের দিকে তাকাতেই সে নরম গলায় শুধাল,
“ এক ঘন্টা সময় চাই, দেয়া যাবে?”

চলবে..

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২০

অহ্নের অন্তিম প্রহর। দ্যুলোক তখন কমলা-লালের মিশ্র রঙ ধারণ করেছে। অস্ত যাওয়া সূর্যের বিপরীতে তখন এক ফালি চন্দ্র নজরে আসছে। পাখিরা ঝাঁক বেঁধে নীড়ে ফিরছে। আশেপাশে মৃদু কোলাহল থাকলেও তা যেন কানের ভেতর প্রবেশই করছেনা। মনোরম দৃশ্য দেখেই বোধহয় কান বন্ধ রেখেছে স্রোত। মুগ্ধ চোখে গগনে পানে চেয়ে, ঘাসের ওপর বসে আছে ও। ঠিক এক ইঞ্চি দূরেই আরেকজন বসা; নায়ীব। তার চোখেও মুগ্ধতা। তবে আকাশ পানে চেয়ে নয়, একটা মিষ্টি, সুশ্রী মুখের আদলে চেয়ে। এই মুগ্ধতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। স্রোত কি সেসব টের পাচ্ছে? হয়তো না! টের পেলে হয়তো অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যেত। নাহলে লজ্জা পেয়ে নায়ীবের কাঁধেই মুখ লুকাতো। দ্বিতীয়টা এই ক্ষণে একপ্রকার অসম্ভব। দিবা স্বপ্ন যাকে বলে।

মিনিট দশ এক নিরবতারাই রাজ করলো। এরপর স্রোতের ধ্যান ছুটল আশেপাশের কোলাহল শুনে। আমতা-আমতা করে উঠল ওমনি। আশেপাশে অসংখ্য কপোত-কপোতী। কারো সঙ্গে বাচ্চা, কেউ বা নতুন যুগল। ফুল বিক্রির আশায় ঘুরঘুর করছে এক ছোট্ট বাচ্চা। বয়স দশ-বারো হবে হয়তো। হাতে বালতি ভর্তি গোলাপ,বেলী।

জায়গাটা নায়ীব কিংবা স্রোত; কারোরই চেনা নয়। বিশাল বড় ওয়াকওয়ে বলা যায়। নামটাই শুধু জানা ছিল নায়ীবের, বাকিটা রিকশাওয়ালা সাহায্য করেছেন। সামনে একটা দীঘি। তার ঘাটেও মানুষজন বসা। চেয়ার-টেবিলের সুব্যবস্থা পেতে হলে রেঁস্তোরা গুলোর ভেতরে ঢুকতে হবে। সেখানেও অনেকটাই ভীড়। তাই এদিকটায়ই স্বচ্ছ, পরিষ্কার ঘাস দেখে তার ওপরই বসে পড়েছে স্রোত। নায়ীব কিছু বলেনি অবশ্য; সে তো বসতে বাধ্য। স্রোতের চেহারা-সুরুতে মনে হচ্ছে মুড-টুড আহামরি খারাপ নয়। মনের কথা ব্যক্ত করার মোক্ষম সময়। তবুও নায়ীব অনেক্ষণ ঠোঁট চেপে বসে রইল।
স্রোত সহসা ঘাড় ফেরাল। নায়ীবের শ্যামবর্ণের চেহারায় চোখ ঘুরিয়ে আবার চোখ রাখল দীঘির জলে; বলল,
“ কি বলতে নিয়ে এসেছেন?”
নায়ীবের দৃষ্টি তখনও অটল। এক চুলও নড়েনি। বরং দৃষ্টিটা আরো প্রগাঢ় হলো। ক্ষীণ আওয়াজে বলল,
“ জায়গাটা সুন্দর লাগছে?”
“ হু!”
স্রোতের আনমনা স্বর। ঘাসের বুকে আঙুল ঘোরালো কতক্ষণ।
নায়ীব একটা শান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলতে চাইল। অথচ সেকেন্ড খানেকের মাথায়ই অস্থিরতা ঝেঁকে বসল। অতঃপর বলেই ফেলল,
“ আপনার কিছু অজানা নয়, স্রোত।”
আঙুল থেমে গেল স্রোতের। মাথাও কিঞ্চিৎ নত হলো। হাত দু’টো গুটিয়ে নিয়ে বলল,
“ সবটা আমার কাছে স্পষ্টও নয়।”
ওমনি বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল নায়ীবের। চাপা স্বভাবের সে যে ঠিকঠাক অনুভূতি ব্যক্ত করার কলাকৌশল জানেনা!

“ আমার জীবনে এর আগেও একবার প্রেম এসেছে, স্রোত। মিথ্যা বলবনা, মিথ্যা বলাটা আমার দিয়ে ঠিকঠাক হয়না। সেই প্রেমটা ছিল প্রকাশ্যে। আমার বন্ধুবান্ধব;সবাই অবগত ছিল। তখন আমার বয়স ষোলো, আমার ধ্যান-জ্ঞান, সবই ওই একজনকে ঘিরে ছিল। অথচ সে আমাকে টাইমপাস হিসেবে দেখেছে। কখনো সিরিয়াস হওয়ার কথা ভাবেনি। ওটাই আমার মেজর হার্টব্রেক ছিল বলা যায়। এরপর আব্বুর ট্রান্সফার হলো, হিমি নামের মেয়েটাকেও আমি ভুলার চেষ্টা করলাম। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে জড়তায় আর যোগাযোগ করতে পারিনি। নতুন শহরে এসে আমিও ব্যস্ত হলাম পড়াশোনা নিয়ে এরপর এই চাকরি! প্রেম-ভালোবাসায় আর জড়াইনি এরপর। জড়াতে চাইনি। মনেও ধরেনি কাউকে। কিন্তু জীবনের এই আটাশতম বছরে এসে আমার মন অবচেতন ভাবেই আপনার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আমি জানিনা, কীভাবে। বলা যায়, এই প্রেমে আমি অবচেতন মনে,গোপনেই পড়েছি। আমি রূপ দেখে গলার মতো পুরুষ না,স্রোত। তবুও আপনার চোখে তাকালে নশ্বর এই পৃথিবীর সবকিছুই ফিকে লাগে।
বাবার প্রতি সম্মান আর নিশাতের জন্য আপনার করা কেয়ারটুকুও আমার মনে গেঁথেছে। আমাদের মা অনেক আগে মা-রা গেছেন। আমার বুঝ থাকলেও নিশাতের ওত ছিলনা। ও মা ছাড়াই বড় হয়েছে বলতে গেলে ফুপ্পি যদিও খেয়াল রেখেছেন। তারপরেও, উনি আর ক’দিনই বা থাকবেন নিজের সংসার ফেলে। মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই আব্বু দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। তবে নিজেও কোনো কমতি রাখেননি আমাদের মানুষ করতে। বিশেষ করে নিশাতকে।”
ক্ষীণ গলার স্বর থেমে গেল। শেষ দিকটায় গলা কিঞ্চিৎ নড়বড়ে শোনাল। মাথা নুইয়ে, স্থির চিত্তে কথাগুলো শুনছিল স্রোত। এবার নায়ীব একটা নিঃশ্বাস টেনে চোখ অদূরের গগনে রেখে ফের বলা শুরু করল,
“ আপনাকে আমার আগে থেকেই ভালো লাগে স্রোত।”
একটু থামে সে। সেকেন্ড খানেক বিরতি নিয়ে ফের বলে,
“ ভালোবাসি। ভালোবাসার তীব্রতা হয়তো এখন টের পাচ্ছেন না। আমি কেসের কাজে ক’দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। ঠিকঠাক যোগাযোগ করতে পারিনি, আ’ম সরি। অভিমানটুকু সরিয়ে এই অধমের ওপর একটু দয়া করা যাবে? প্রথম প্রেম না হলেও শেষ প্রেম হওয়া যাবে?”

নায়ীবের হার্টবিট অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে তখন। হয়তো স্রোতও শুনতে পাচ্ছে।
নায়ীবের দৃষ্টি যুগল স্রোতের দিকে ফিরছেইনা অস্থিরতায়। অথচ স্রোত এবার তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে। মুখে চমকিত, হতবিহ্বল ভাব। এগুলো শোনার জন্যই তো মরিয়া হয়ে ছিল এতদিন, তাহলে কেন এখন সবকিছুই স্বপ্নের মত ঠেকছে? নায়ীব উত্তরের আশায় অনেক্ষণ নিশ্চুপ রইল। পাক্কা দুই মিনিট পর স্রোত অকস্মাৎ থমথমে গলায় বলল,
“ আপনি আসলেই একজন স্বার্থবাদী মানুষ।”

নায়ীব বিচলিত নেত্রে তাকাল। কি ভুল করল আবার? স্রোত তাকে অবাক করে দিয়ে আরেকটু কাছ ঘেষে বসল। অবলীলায় নায়ীবের বাহু সামন্য আঁকড়ে ধরল। মুখে তখন অঢেল লজ্জার ছড়াছড়ি। তবুও নিজেকে আটকালোনা স্রোত। কাঁধে আলতো করে মাথা ঠেকিয়ে বলে উঠল,
“ আমি কারো শেষ প্রেম হতে পারবনা। চাই ও না। আমি আপনার শেষ ভালোবাসা হতে চাই।”

সিগা-রেট পোঁ ড়া সামান্য কালচে ওষ্ঠদ্বয়ের ফাঁক তখন একটা বিশাল হাসি দখল করেছে। চওড়া সেই হাসি তার ভেতরকার প্রশান্তি,উৎফুল্ল ভাবটাকে যথেষ্ট প্রকাশ করছেনা যদিও। তবুও ঠোঁট অত্যাধিক প্রসার করা হাসিটা সরলোইনা নায়ীবের। মাথা নুইয়ে ফেলা স্রোত তখন ইহ জগতে নেই যেন। কোন এক স্বর্গীয় সুখানুভূতিতে সে আসমানে ভাসছে তখন। তন্মধ্যে এলোমেলো হওয়া চুলের ফাঁকে হঠাৎই ওষ্ঠের স্পর্শ টের পেল স্রোত। একবার নয়, দুইবার নয়, পরপর অনেকবার। স্পর্শ থামতেই বিচলিত নেত্রে মুখ তুলে এপাশ-ওপাশ দেখল স্রোত। সূর্য তখন সম্পূর্ণ অস্ত গেছে। রেঁস্তোরা গুলোর রঙ বেরঙের লাইটগুলো ওতোটাও আলো ছড়াচ্ছেনা। তাই এদিকটা স্পষ্টও নয়। নায়ীব ওর আচমকা বিচলিত হওয়া দেখে হাসল। বলল,
“ হাত ধরলেন যখন, তখন কেউ দেখেনি! আমি সামান্য ঠোঁট ছোঁয়াতেই সবাই দেখে ফেলবে,হু?”

কান গরম হলো স্রোতের। অবিশ্বাস্য চোখে নায়ীবের দিকে তাকাতেই দেখল, সে মিটমিটিয়ে হাসছে। ভীষণ মজার কিছু ঘটেছে যেন! স্রোত দম ফেলল। এর মধ্যেই নায়ীব হাত উঁচিয়ে ফুল বিক্রি করা ছেলেটাকে ইশারা দিল। সে আসলো ধীরে-সুস্থে। হাতের বালতিটায় অবশিষ্ট ছয়টা গোলাপ। তাজা ভাবটাও নেই ওত। পানি ছিটানো কেবল। নায়ীব সব কটাই কিনলো। পাশে বসা প্রেম সাগরে ভাসা স্রোত ভাবল, নায়ীব এরপরই তার হাতে ধরিয়ে দিবে গোলাপ গুলো। ভাবনাটা কিঞ্চিৎ ভুল হলো যদিও। নায়ীব আচমকাই দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসল। স্রোত ঘাসের ওপর বসা, ঠোঁট বিষ্ময়ে সামান্য ফাঁক হয়েছে। নায়ীব গোলাপ সমেত হাত বাড়াল, অন্যহাতে মাথা চুলকে হাসল হঠাৎ।
চোখে একরাশ মুগ্ধতা আর কন্ঠে অঢেল মায়া মিশিয়ে বলল,
“ রিং তো নেই। আজ নাহয় গোলাপই গ্রহণ করুন, প্লিজ?”
মানুষদের দৃষ্টি ওদের পানে স্থির হতে বেশিক্ষণ লাগলোনা। নায়ীব এক বুক আশা নিয়ে চেয়ে। উত্তর যদিও বা আগে পেয়ে গেছে। স্রোত ঢোক গিলে, গোলাপ গুলোর দিকে তাকায়। তন্মধ্যে নায়ীব বেশ উচ্চস্বরে আবার জিজ্ঞেস করে,
“ ডু ইউ লাভ মি, মিস.স্রোতশ্রী?”
স্রোত ফাঁকা ঢোক গিলে এবারও। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে গোলাপগুলো ছুঁয়ে দেখে। এরপরই চোখে চোখ রাখে। জড়তা,লজ্জাদের পা পি’ষে ঠোঁট এলিয়ে লাজুক হেসে বলে,
“ ইয়েস, অফিসার। আই ডু।”

সেকেন্ড খানেক গড়াতেই করতালিতে চারপাশ মুখোরিত হলো। তবে একজনের শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গেছে যেন। সামনের এই সদ্য প্রেমের রঙে রাঙা কপোত-কপোতীর প্রেম নিবেদন দেখে তার অন্তর ক্রোধে ফুঁসে উঠে..

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২১

হামিদ সাহেব বিরক্তিভরা চোখে তাকালেন একবার হেমন্তের দিকে। তার চেহারার রঙ আপাতত বিলীন। চোখের চশমা খুলে রাখা। বিরক্তির ছাপ তারও পুরো মুখে স্পষ্ট। হামিদ সাহেব কল লাগালেন সাঈম রহমানকে। দেরীতে রিসিভ হলো। কল ধরতেই হামিদ সাহেব চাপা স্বরে বললেন,
“ সাঈম,জরুরী কথা ছিল।”
“ বলেন, ভাইজান!” সাঈম সাহেবের স্বাভাবিক কণ্ঠ। হামিদ একবার হেমন্তের দিকে তাকালেন। এরপর ফটাফট চোখ সরিয়েও নিলেন।
“ তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা করার খুব ইচ্ছে ছিল, তবে মনে হয়না তোমার মেয়ের কারণে তা সম্ভব হবে।”

কিছুক্ষণ নিরব রইলেন সাঈম সাহেব। কথার ধাচ ওতোটাও ভালো ঠেকছেনা হামিদ সাহেবের। কি বুঝাতে চাইছেন তাও বুঝতে সক্ষম হলেন না সাঈম রহমান। গম্ভীর নিরস স্বরে জানতে চাইলেন,
“ মানে বুঝিনি, ভাইজান?”
“হেমন্ত স্রোতকে পছন্দ করেছে। ও এতদিন জানতো যে ওর জন্য স্রোতকে ঠিক করে রাখা। এমনটাই তুমি বছর খানেক আগে আমায় কথা দিয়েছিলে। ও বড় আশা নিয়ে সেদিন দেখা করতে গেছিল। ফিরে এসেছে নিরাশা নিয়ে। তারপরও ও আমার পছন্দের ওপর সন্দেহ করেনি। কিন্তু তোমার মেয়ে আমার ছেলেকে রিজেক্ট করলো!”

“ রিজেক্ট কখন করলো,ভাইজান? আমার মেয়ে তো কিছু জানায়নি। নাকচ করলেও আপনাকে আমি বলতাম। আমার মেয়েটা একটু ব্যস্ত থাকে তো..”

হামিদ সাহেব শব্দ করে হাসলেন এবার। তার হাসির দিকে এক ধ্যানে চেয়ে রইল হেমন্ত। রাগে মস্তিষ্ক তোলপাড় তখন।

ওপাশে থাকা সাঈম সাহেবের ললাটে গাঢ় ভাঁজ। স্রোত কিছুই জানায়নি। সময় নিচ্ছে, নিক! আপত্তি তো নেই।

“ একটু ভালো করে খোঁজ খবর নাও,সাঈম। তুমি খুব বিচক্ষণ মানুষ। নাহলে পরপর এতবার চেয়ারম্যানের আসন পেতে না। এত বড় শহরে মেয়েকে একা ছেড়েছ, সে তো আর ছোট্ট খুঁকি নেই। বড় হয়েছে। ভালো করে খোঁজ নাও, বুঝলে। রাখি,পরে কথা হবে।”
হামিদ সাহেব খট করে মুখের ওপর কল কাটলেন।

সাঈম সাহেব অত্যন্ত সম্মানিত একজন ব্যক্তি। জয়পুর ছাড়াও আশেপাশের গ্রামের মানুষজনও তাকে যথেষ্ট সম্মান করে চলেন। ব্যক্তিত্ব এতই প্রখর তার। আজ; এই প্রথম বোধহয় কেউ এত কথা শোনাল! মুখের ওপর কল কাটলো! তবে তা বিশেষভাবে সাঈম সাহেবের আত্মসম্মানে লাগলোনা। ব্যাপারটা তার মনে ধামাচাপা পড়ে গেল। মস্তিষ্কে তখন অন্য ভাবনা ঘুরছে। হামিদ সাহেবের কথার ধরণ মোটেও ঠিকঠাক ছিলনা। নেতিবাচক ইঙ্গিতে বলা কথাগুলো ভালো করেই বুঝতে পারলেন সাঈম সাহেব। চোয়াল শক্ত হলো তার। সন্তান মানুষ করতে এক চুলও ছাড় দেননি তিনি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও বাচ্চাগুলোকে সময় দিয়েছেন। হয়তো একটু কড়া ছিলেন। তবে ভালোবাসা তো কম দেননি। সুপ্ত রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। স্রোতের ওপরই গিয়ে পড়বে সে রাগ!

.

হেমন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। টি-শার্টের কলার টেনে ঠিক করতে করতে বলল,
“ এত ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বলার কি দরকার ছিল? বলতেই পারতে উনার গুণধর মেয়ে পার্কে প্রেমিক নিয়ে..”
“ আহ! চুপ! স্রোত হচ্ছে সোনার হরিণের মত। ওকে পেলে তোমার আর চাকরি করা লাগবেনা। কতই বা পাও চাকরি করে?”
অপমানে থমথমে হলো হেমন্তের চেহারা। গটগট পায়ে সে চলে এল। রুমে। ফোনে তখন আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। হেমন্তের রাগ চড়াও হলো। কল ধরে কতক্ষণ গা-লা-গা-লি করল। বিশেষ লাভ হলোনা। ওপাশ থেকে শুধু ফুঁপানোর আওয়াজ শোনা গেল। আর একটা শব্দও মেয়েটি বললোনা। হেমন্ত-ই কল কেটে ব্লক লিষ্টে ফেলল নাম্বারটা। গত মাসে মেয়েটার সঙ্গে ব্রেক-আপ করেছে বাবার কথায়। মেয়েটা ওর এক বছরের জুনিয়র। ভার্সিটির শেষের দিকে প্রণয়, এরপর গত মাসে বিচ্ছেদ। মেয়েটা সইতে পারছেনা। হেমন্ত যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে।

..

জোহা হাই তোলার ক্ষণে তাকায়। খাতাটা স্রোতের সামনে রাখা। প্রায় দশ মিনিট হলো লেখা শেষ করেছে সে। অথচ স্রোত এক ধ্যানে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে।
জোহা দুইবার ডেকেছে। সাড়া পায়নি। এবার আরেকটা ফন্দি আঁটল সে। আস্তে করে উঠে পড়ল। স্রোতের পেছনে দাঁড়াল। ধরা পড়লে বলবে, পানি খেতে গেছিল। তবে স্রোত তাকে ধরতে পারলোইনা। কারণ তার সম্পূর্ণ মনোযোগ, ধ্যান স্ক্রিনে। যেখানে ভাসছে একটা ছবি! হাস্যোজ্জ্বল মুখের নায়ীবের ছবি। চোখে রোদ-চশমা। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে। শ্যামবর্ণ মুখটা চকচক করছে। ভীষণ সুন্দর, আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। জোহা মিটমিট করে হেসে উঠল। নিশাতের সঙ্গে অনেকদিন এই দুই অঘোষিত প্রেমিক-প্রেমিকার ব্যাপার নিয়ে আলাপ হয়নি! এবার হবে! জোহার ভাবনার মধ্যেই স্রোত নড়েচড়ে বসল। সামনের চেয়ার খালি দেখে চমকালো। ঘাড় ফিরাতেই জোহাকে দেখে সামান্য চেঁচিয়ে উঠল। ভূত দেখার মত চমকে বলল,
“ এই, জোহা! করছোটা কি?”
“ পানি খেতে উঠেছিলাম। আপনাকে এতবার ডাকলাম, শুনলেনই না। এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছিলেন, আপু? এত মনোযোগ যদি আমি ব্যাকরণে দেই, তাহলে নির্ঘাত বোর্ড স্ট্যান্ড করতাম।”
বলতে বলতে হা হুতাশ করে উঠল জোহা।

স্রোত থতমত খেল। ওর চেহারা আড়চোখে খেয়াল করল জোহা। মিটমিটিয়ে হাসতেই স্রোত ধমকে কথা ঘুরালো। বলল,
“ এক সাবজেক্ট পড়লেই বোর্ড স্ট্যান্ড করতে পারবেনা। সব পড়া লাগবে। পড়ো!”

..

রিটায়ার্ড হওয়ার পর নাবিদ সাহেবের বিশেষ একটা কাজ থাকেনা। দিনের অধিকাংশ সময়ই তিনি একা কাটান। রাবেয়া নামের ভদ্র মহিলা এসে রান্না করে দিয়ে যান শুধু। তার রান্না করা খাবারের স্বাদ যদিও খারাপ না তবুও রোজ একটা তরকারি নাবিদ সাহেব নিজেই রান্না করেন। সময় কাটানোর উছিলা বলা যায়। নিশাত ভার্সিটি চলে গেলে তার সময়টা কাটেইনা। বারান্দায় গিয়ে বসে কখনো কখনো স্ত্রীর ছবি সামনে নিয়ে একা একা কথা বলেন। নাহলে পুরোনো ছবির অ্যালবাম খুলে বসে থাকেন। বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বাদে কিছুই বের হয়না তার। নায়ীবের মা অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। সেই সাথে রাগীও ছিলেন। নাবিদ সাহেব নিজেও রাগী মানুষ ছিলেন। কিন্তু বিয়ে হওয়ার পর তিনি এক নতুন ‘নাবিদ খান’ কে আবিষ্কার করলেন। তিনি বনে গেলেন প্রচন্ড বউপ্রেমি, শান্ত মানুষ। তার সেই শান্ত স্বভাব পেয়েছে নায়ীব। একদম সমুদ্রের ঠান্ডা জলের মতন তাদের মেজাজ।

আজ বিকেলে নাবিদ সাহেব গাছে পানি ঢালছিলেন। এই কাজটা তিনি আধ ঘন্টা খানেক লাগিয়ে করেন। মোট সাতটা ছোট্ট চারা লাগানো। নিশাত গাছের মাটি শুকনো পেলেই খেঁকিয়ে উঠে। তন্মধ্যে ফোন উচ্চশব্দে বেজে উঠল। নায়মা কল করেছেন। নাবিদ সাহেব রিসিভ করতেই ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে বললেন,
“ নায়ীব কোথায়? থানায়?”
“ হু, থানায়ই তো।”
“ ও আসলে আমাকে কল দিতে বলো। ভালো একটা মেয়ে পেয়েছি। এমন মেয়ে হাতছাড়া করলে তোমার ছেলের সন্যাস গ্রহণ ছাড়া গতি নেই।”
নাবিদ সাহেব হাসলেন। এ আর নতুন কি! সপ্তাহে দুই তিনটা মেয়ে খুঁজে ফেলেন নায়মা। ঘটক বনলে নিশ্চয়ই ভালো রোজকার হতো তার বোনের।

..

স্রোত ব্যগ্র চোখে চেয়ে স্ক্রিনে। পুরোটা দিন গেল, মানুষটার কল এলো না। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার কথা। বাড়ি ফিরে একটা কল দেয়া যায়না?
সন্ধ্যা বাজে সাতটা। পড়াশোনার চাপ আপাতত কম স্রোতের। তবে ক্লাস হয়তো শুরু হয়ে যাবে শীঘ্রই। সেসব নিয়েও সে ভাবছেনা। ভাবছে অন্য একজনকে নিয়ে। সে হচ্ছে; নায়ীব ইয়াকীন। তার ভাবনার অত্যন্ত বজ্জা-ত সুপুরুষ।
ফোনে এখনও সে উৎকণ্ঠা বনে চেয়ে আছে। মিনিট খানেকের মাথায় কল এল। ঠোঁটের কোণে ধেয়ে আসা হাসিটা আবার মিলিয়ে গেল মিলি সেকেন্ডের মাথায়। কল একদম কেটেই যাচ্ছিল, তখন রিসিভ করল স্রোত।

ওপাশ থেকে শান্ত স্বর শোনা গেল,
“ কল কাটার সময় রিসিভ করার কি মানে?” সামান্য রাগ বোধহয় কণ্ঠে। টের পেল স্রোত। মুখ বাঁকাল সে। ত্যাড়া গলায় জানাল,
“ ফোনের কাছে ছিলাম না। কি বলবেন বলুন!”
“ কাউকে মিস করলে কল দেয়া উচিত। নিজে থেকে কল দিলে ইগো হার্ট হয়না, যদি মানুষটা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত হয়।” বক্ষে উত্তাল তোলার মত স্বর। স্রোতের সম্পূর্ণ চিত্ত শান্ত বনে গেল। জানলার ধারে মাথা ঠেকাল। গাল দু’টো অকারণেই রক্তিম।
ওপাশে থাকা নায়ীব কি হাসলো? বোধহয়। অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি। সে নিত্যান্তই একদম ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত। তবে প্রেমিক হিসাবে সে কেমন, তা কেবল স্রোত দেখবে।

“ নিচে নামবেন, স্রোত?”
“ হ… হ্যাঁ? ”
ভ্রু ত্বরিত গতিতে কুঁচকে গেল স্রোতের। অবুঝ গলার স্বর। নায়ীব ঠোঁট কাম ড়ে বলল,
“ নেমে আসুন। হোস্টেল তো বন্ধ হতে অনেক দেরি। পারলে সাথে কয়েল নিয়ে আসবেন, অনেক মশা এখানে।”

চলবে.