গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-২২+২৩+২৪

0
676

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২২

জানলার ধারে বসে থাকা স্রোতের টনক নড়ল। পাক্কা এক মিনিট সে হতবিহ্বল বনে বসে ছিল। কলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেই কবেই। স্রোত ত্বরিত বেগে নিচে নেমে এলো। দারোয়ানকে বুঝ দিতে সময় লাগলোনা। এমনিতেও দরকারে সন্ধ্যার পর মাঝেমধ্যে বের হয় স্রোত। তাই আজ আলাদা করে বাহানা দিতে হয়নি। ও গেট পেরিয়ে বেরিয়ে আশপাশে তাকালো।
অমাবস্যার রাত। নীলিমায় চাঁদের দেখা নেই। তাও রাতটা কেমন উজ্জ্বল ঠেকছে স্রোতের নিকট। তার চেয়েও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ওর সুশ্রী মুখাবয়ব! চোখে হাসির ঝলক। অথচ মুখটা স্বাভাবিক। হোস্টেল একদম গলির মাথায়। এরপর বেরোলে দু’টো রাস্তা মিলে। একটা সোজা বাজারে যায়, আরেকটা মেইন রোড। বাজারে নায়ীবের থাকার কথা না। অন্যদিকটা ভীষণ নির্জন। স্রোত একা পা বাড়াতে সাহস পাচ্ছেনা। ভাবনার মধ্যেই হাতে টান পড়তে ছিটকে উঠল স্রোত। আচমকা এমন স্পর্শে ছিটকে উঠাই স্বাভাবিক। মানুষটা হাত ধরে টানাটানি করে খুব! স্রোত মুখ ফুলিয়ে তাকালো। নায়ীব ভ্রু নাঁচালো। বলল,
“ ওদিকে কি দেখছিলেন?”
“ কিছুনা।”
নায়ীব শান্ত চোখে চাইলো। মেয়েটাকে একবার বলায়ই নেমে এসেছে। এতটা বিশ্বাস? নায়ীব বিস্তর হাসলো। সহসা তাকে হাসতে দেখে কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল স্রোতের। জিজ্ঞেস করল,
“ হাসছেন কেনো?”
“ আপনাকে দেখে।”

তৎক্ষনাৎ নিজের ওপর চোখ ঘুরালো স্রোত। গায়ে একটা লং কুর্তি তার। ওপরে আবার শাল চাপানো। জোহাকে পড়িয়ে এসে আর কাপড় পালটানো হয়নি। মাথার চুল বোধহয় এলোমেলো। ওমনি হাতটা চুলে গিয়ে ঠেকল স্রোতের। হাত দিয়ে চুল গোছাতে গোছাতে প্রশ্ন করল,
“ খারাপ দেখাচ্ছে?”

নায়ীব গাঢ় চোখে তাকিয়ে। স্রোতের চুল ঠিক করা দেখেই হাত বাড়াল। স্রোতের হাত চেপে ধরে নিচে নামাল। মুগ্ধতায় বুদ হওয়া স্বরে বলল,
“ সুন্দর দেখাচ্ছে।”

..

চাঁদের আলো বিহীন নিকোষ কালো রাতটাও কেমন ঝলমলে ঠেকল স্রোতের কাছে। উজ্জ্বল চোখে চেয়ে, বড্ড উৎসাহ নিয়ে ও আশপাশে তাকাচ্ছে। রাস্তাটা একদম নির্জন ও নয়। গাড়ির আনাগোনা বেশ আছে। তবে ল্যাম্পপোস্টগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেশ। তাই ক্ষীণ আলোয় কিছুটা ভূতুড়ে দেখাচ্ছে এই পথ। স্রোত-নায়ীব, পাশাপাশি হাঁটছে। পায়ের গতি অতি ধীর। দু’জনের মুখে কথা নেই। নায়ীবের গায়ে পাতলা একটা শার্ট কেবল। উপরে আর কিচ্ছুটি পরা নেই! অথচ বয়ে চলা রিনরিনে হাওয়াটা শরীরে কাঁপুনি ধরানোর মত। স্রোত ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। সহসা জিজ্ঞেস করল,
“ শীত লাগছে?”
“ উহ, না! অল ওকে! আপনার লাগছে?”
চোখ ফট করে তুলে জানতে চাইল সে।
স্রোতের গায়ে ভালোই মোটা একটা উলের শাল। গতবছর পছন্দ হয়েছিল,সাঈম সাহেব কিনে দিয়েছেন। আজ বেরোনোর সময় হাতের কাছে পেয়ে নিয়ে এসেছে। সবার আগে ওরই শীত অনুভূত হয় বোধহয়। আশার সে নিয়ে কি টিটকারি! গ্রাম-গঞ্জে থেকেও তাদের এত শীত লাগেনা।
নায়ীব এখনও উত্তরের আশায় চেয়ে। স্রোত ছোট্ট করে বলল,
“ না! আমার কেন শীত লাগবে? আমার গায়ে তো শাল আছে, আপনার তো নেই!”
কথার মধ্যিখানেই একটা কুকুরের অস্বস্তি টের পেল স্রোত। প্রথমে ছায়া দেখে আন্দাজ করতে পারেনি এটা একটা কুকুর। তাই অকস্মাৎ দেখেই স্রোতের গলা শুকিয়ে এল। কালো রঙের কুকুরটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পূর্বেই স্রোত লাফিয়ে সরে এল। ধাক্কা খেল নায়ীবের প্রশ্বস্ত, শক্ত বক্ষপটে। নায়ীব দক্ষ দুই হাতে আগলে ধরল তাকে। কুকুরটা চলে গেছে। স্রোত কুকুরে ভয় পায়না এত। তবে এই আধাঁরে আচমকা দেখেই প্রাণটা ছলাৎ করে উঠেছে। নায়ীবের পা থেমে গেছে সেই কবেই। স্রোতের সম্বিৎ ফিরতেই সে ছিটকে সরলো। কাঁদো-কাঁদো চেহারায় বলল,
“ সরি! ভয় পেয়ে গেছিলাম। দেখিনি কুকুরটাকে।”
মধ্যভর্তি দূরত্ব তখন একহাতের মতন। নায়ীব সজ্ঞানে তা ঘুচলো। এগুলো দুইপা। গাঢ় তার চোখের দৃষ্টি। স্রোতের চোখের কাছটায় তখন ছোট-ছোট চুলের গোছা। দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সামান্য অস্পষ্ট দেখালেও বড্ড মায়া-মায়া দেখাচ্ছে। চুলগুলো আলতো হাতে গুছিয়ে দিতে দিতে নায়ীব ক্ষীণ আওয়াজে বলল,
“ ইট’স ওকে।”

মুহুর্তেই ফোনটা বেজে উঠল স্রোতের। প্রেমের জোয়ারে ভাসা আর হলোনা আরাম করে! লজ্জারা ঝেঁকে বসলেও বেশিক্ষণ রাজ করতে পারলনা। ফোনের স্ক্রীনে চেয়ে অজানা ভয়েই সিঁটিয়ে গেল স্রোত। সাঈম সাহেবের কল! আলগোছে একবার নায়ীবকে পরখ করে ফোন কানে ঠেকাল ও।
ওপাশ থেকে আসা রমরমা স্বরটা নায়ীব নিজেও শুনতে পেল।

“ কোথায় তুমি?” কেমন রুঢ় শোনালো গলার স্বর।
স্রোত ঢোক গিলে। বলে,
“ দরকারে একটু বেরিয়েছি, আব্বু।”
“ হেমন্ত তোমাকে কল দিয়েছিল, ধরোনি কেন?” উচ্চ অথচ শান্ত গলা। চোরা চোখে একবার তাকালো স্রোত। নায়ীবকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তীক্ষ্ণ, কাটকাট দৃষ্টি এদিকেই। কিছু কি টের পেল?

“ আননোন নাম্বার দেখে রিসিভ করিনি, আব্বু।”
চাপা স্বর ওর।
“ যাই হোক,কল দিলে রিসিভ করো। দেখা করার হলে আবার করো। ও ফ্রি আছে।”
স্রোত ঠোঁট চেপে কিছুই বললনা। কিছু বলার উপায়ও নেই। সাঈম সাহেবের কণ্ঠই জানান দিচ্ছে, মন মেজাজ উনার খুব একটা ভালো নেই। ও কল কেটে আমতা-আমতা করে তাকাল নায়ীবের দিকে। আস্তে করে বলল,
“ যেতে হবে।”
নায়ীব পা ঘুরালো। সেই সঙ্গে স্রোতের। হোস্টেলের পথে হাঁটা ধরার ক্ষণে নায়ীব জানতে চাইল,
“ কার কল ছিল?”
“ আব্বুর!”
“ জরুরী কিছু?”
“ উম…না!”
ঠোঁট চেপে বলে উঠল স্রোত। গলার স্বরেই অস্বাভাবিকতা টের পেল নায়ীব। তবে জিজ্ঞেস করলোনা বেশি কিছু।

..

হিমি দীর্ঘ আধ ঘন্টা যাবত অপেক্ষা করছে। একজনের অপেক্ষা। শুক্রবারে সে সচরাচর নিজেকে সময় দেয়। পুরো সপ্তাহে সে একটা দিনই পায় নিজের সঙ্গে কাটানোর। মা ঠেলে-ঠুলে তাকে পাঠিয়েছেন পাত্র দেখতে। অথচ সেই পাত্রের খোঁজ নেই আধ ঘন্টা যাবত। টাইম-টেবিল নিয়ে অত্যন্ত সচেতন সে। বিরক্ত ভঙ্গিতে গালে হাত ঠেকাল ও। পাত্রকে দেখা হয়নি। নাম শুনেছে, নায়ীব! নাম শুনে থমকেছে খানিকটা। তবে একই নামের কত মানুষই আছে। তাই অহেতুক ভাবেনি বেশি কিছু। কোত্থেকে মা এই পাত্রের সন্ধান পেয়েছে, তাও সে আন্দাজ করতে পারছেনা। গায়ে তার সাদামাটা শাড়ি। কিন্ডারগার্ডেনে রোজ শাড়ি পরে যেতে হয়। তাই আলমারি হাতড়ালে শুধু শাড়িই বের হয় ওর।

ভাবনার মধ্যেই ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। ওয়েটার আড়চোখে তাকালো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাকে খেয়াল করছে হিমি, কেমন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। তাই ফোন রিসিভ করার পূর্বে এককাপ কফির অর্ডার দিল ও।
আননোন নাম্বার! সেই পাত্রের বোধহয়। কলটা ঝট করে রিসিভ করল ও। হিমিই প্রথম জিজ্ঞেস করল,
“ কে বলছেন?”
“ আমি..আমি নায়ীব। নায়ীব ইয়াকীন।”
ওমনি যেন পুরো পৃথিবীটাই থমকে গেল হিমির। প্রথম নামটা নাহয় কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে, তাই বলে শেষটাও? ইম্পসিবল!
“ আ’ম এক্সট্রিমলি সরি,আমি আসতে পারছিনা।” বিনয়ী স্বরেও কেমন বিরক্তির রেশ মাখানো। হিমি ঢোক গিলে। কিছু বলার পূর্বেই ফোনটা অফ হয়ে যায়। ইশ! সকাল থেকে চার্জ দেয়া হয়নি! ও ফোন কান থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে বসে। সত্যিই সে ঠিক শুনেছে তো? নাকি ভুল? ঠিক কতটা দিন পর মুখোমুখি হতো আজ? এক যুগ! ভাগ্যিস দেখা হয়নি! নাহলে হিমির অপরাধবোধে ছারখার হওয়াটা দেখে সে তাচ্ছিল্য হাসতো নিশ্চয়ই!

.

নায়ীব ওপাশ থেকে রেসপন্স পেলোনা আর। এবার সে কল লাগালো নায়মাকে। রাগী চোখ-মুখের ভাব। ভাইয়ের মেজাজ যে অত্যাধিক বিগড়ে, তা বেশ বুঝতে পারছে নিশাত। সে-ও চায়না তার ভাই কোনো আউল-ফাউল পাত্রী দেখুক। পাত্রী তো আশেপাশেই আছে! সপ্তাহে চার-পাঁচদিন দু’তলা অব্দি উঠে। তাকে কবুল বলিয়ে তিন তলা অব্দি উঠিয়ে নিয়ে আসলেই তো হয়! পাত্রী আর লাগে নাকি?

নায়মা কল ধরলেন রয়েসয়ে। ধরেই চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“ কিরে?মেয়েটাকে পেয়েছিস? ও কিন্তু বসে আছে রেষ্টুরেন্টে!”
“ কি শুরু করলে, ফুপ্পি? মেয়ে দেখতে তো মানা করিনি। তাই বলে সোজা ডেট ফিক্স করবে নাকি? অদ্ভুত!”
“ দিব ধরে একটা। মেয়ে দেখলেই কি বিয়ে হবে নাকি? মেয়েকে তোর চিনতে হবেনা? দু-একমাস কথাবার্তা সেড়ে এরপর বাকিসব। তোরা বাপু ব্যাকডেটেড কেন এত?”
“ আমার এত স্মার্ট হওয়া লাগবেনা, ফুপ্পি। আপাতত রেহাই দাও। এমনিতেই আমি খুব কাজের চাপে আছি। দু’দন্ড শান্তিতে থাকার ফুরসৎ নেই! আর দেখা সাক্ষাৎ? আই কান্ট!” চট করে কল কাটল নায়ীব। কলে থাকলে নায়মা বকাঝকা করতেন। রেগে নির্ঘাত বো/ম্ব হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। নায়ীব মাথা ঝাড়া দিয়ে তাকাল। নিশাত ভ্রু কপালে তুলে তাকিয়ে। অতি আগ্রহ চোখ-মুখে। হঠাৎ প্রশ্ন করল,
“ফ্রি যেহেতু আছো, যেতেই তো পারতে! মেয়েটা যদি সুন্দর হয়? পস্তাতে হবে কিন্তু পরে!”
“ মুখে গ্লু লাগিয়ে দিব তোর,নিশু! তাতেও কাজ না হলে রিকশাওয়ালা ধরে বিয়ে দিয়ে দিব। ভাঙা ঘরে বসে তখন বাসন মাজিস,যত্তসব!”
নায়ীব পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাগে গজগজ করা চেহারা দেখে হাসতে গিয়েও হাসলোনা নিশাত। ভাইয়ের শেষ কথা ভেবে মন খারাপ করে ফেলল। আহহা! বিয়ে তো তাকেও করতে হবে! কাকে করবে? চিন্তার বিষয়!

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২৩

ফোনে ক্রমাগত কল এসেই চলেছে। সাইলেন্ট করা তা-ও স্ক্রিন অন হলেই স্রোতের মেজাজ রাগে সপ্তম আকাশে চড়ে যাচ্ছে। একই নাম্বার থেকে পরপর দশবার কল আসার পর আর এলোনা। স্রোত বিরক্ত মুখে বসল বিছানায়। ফোন হাতে তুলল। এই রাতে কে কল দেয়! কান্ড-জ্ঞান নেই? পরপরই নিজের ভাবনাকে সুধরালো স্রোত। কান্ড জ্ঞান থাকলে তো সে ব্যক্তি বিয়েতেই না করে দিতো! বল-দ একটা!

রাত তখন সাড়ে এগারোটা। খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ। ঘুমানোর সময় স্রোতের। অথচ সে ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করছে। ফোনের স্ক্রিনে আচমকাই একটা ম্যাসেজ ভেসে উঠেছে।

“ কালকে বিকাল ৫টায় দেখা করো, ঠিকানা..”

স্রোতের অস্থিরতা কমছেনা। কেননা সাঈম সাহেব আগেই বলে রেখেছেন দেখা করতে। বাবার এত পরিবর্তন স্রোত মেনে নিতে পারছেনা। মেয়েটার মন চাইছে ভ্যা-ভ্যা করে কাঁদতে। সুহাদের সাথে আলোচনা করে লাভ নেই। সে ওই দূর থেকে কিচ্ছুটি করতে পারবেনা।

সে ভয়ে ভয়ে ম্যাসেজ করল নায়ীবকে। কাঁপা হাতে টাইপ করল,
“ জেগে আছেন?”

মিনিট দুই এক গড়াতেই ফোনে কল ঢুকল। এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল স্রোত।

নায়ীবের চোখে ঘুম। ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিল। রাতের খাবারটাও খাওয়া হয়নি। ও চোখ কচলে উঠে বসল। কানে ফোন শক্ত করে ঠেকিয়ে প্রশ্ন করল,
“ কিছু হয়েছে,স্রোত?”
ওর ঘুমু-ঘুমু স্বর শুনে একপল থমকালো স্রোত। শব্দরা দলা পাঁকিয়ে গেল। কানে বাজল নায়ীবের কণ্ঠ! মুগ্ধতায় মনটা উপচে পড়ল।
খুব কষ্টে, মিহি গলায় বলল,
“ ঘুমাচ্ছিলেন? আমি কি ডিস্টার্ব করলাম?”
নায়ীবের কপাল কুঁচকে এল। গম্ভীর স্বরে বলল,
“ ঘুমাইনি। বলুন কি হয়েছে! গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?”
কণ্ঠস্বরের এমন রাতারাতি পরিবর্তন দেখে স্রোত ঢোক গিলে। তেঁতিয়ে দিল নাকি? এখনও তো আসল কথাই বাকি!
পুরোটা শুনলে সে কি করবে? যতটুকু জানে, নায়ীব অত্যন্ত শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ। আজ অব্দি ওকে ভয়ং কর ভাবে রাগতে দেখেনি স্রোত।
লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে ও বলা শুরু করল,
“আব্বু পাত্র দেখছেন।”
“ হ্যাঁ? কিই!”
অকস্মাৎ গলার আওয়াজ উচ্চ শোনাল। স্রোত ঠোঁট কাম ড়ে অসহায় গলায় বলল,
“ একটা ছেলেকে ওনার খুব পছন্দ! ছেলেটা দেখা করতে চাইছে।” একটু থেমে আবার বলল,
“আমি এখন বিয়ে করবনা।”
শেষের কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই নায়ীবের ভাবমূর্তি পানির মত ঠান্ডা হলো। চট করে কথা ধরল,
“ বিয়ে করবেন না?”
“ না।”
“ কেনো? পাত্র পছন্দ হয়নি?”
স্রোত ঘাবড়ে গেল। হকচকিয়ে উঠল,
“ না।”
“ ছেলে পছন্দ হলে বিয়ে করতেন?”
স্রোত ব্যগ্র গলায় বলল,
“ কি যা-তা বলছেন!”

নায়ীব একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,
“ দেখি! কোন ছেলে! নাম কি?”
“ হেমন্ত। আব্বুর পরিচিত একজনের ছেলে। ইঞ্জিনিয়ার না-কি!”
“ বাহ! এত খবর নেয়া শেষ?”
স্রোত দমে গেল। মিনমিন করে বলল,
“ যা শুনেছি, তাই বলছি! আপনিই তো জানতে চাইলেন।”
মিনিট খানেক নিরবতায় কাটল। সহসা নায়ীব থমথমে গলায় শুধাল,
“ দেখি, ঠিকানাটা দিন। কোথায় দেখা করতে চেয়েছে। চয়েজ কেমন, দেখি আমিও!”

..

হেমন্তকে আজ খুব পরিপাটি দেখাচ্ছে। গায়ে তার একটা শুভ্র রঙের শার্ট। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চুলগুলোও পেছনে ঠেলে রাখা। সে অধীর অপেক্ষায় বসে আছে। আজ মেয়েটা আসুক! বগলদাবা করে পুরো শহর ঘুরাবে। ভালো লাগিয়েই ছাড়বে। ফ্লার্টিং-এ সে ভীষণ ওস্তাদ কিনা! আজই মোক্ষম সুযোগ, হবু বউকে নিজের ফ্লার্টিং স্কিলস শো করার। নিজের ওপর খুশি হলেও সামান্য ঘাবড়াচ্ছে হেমন্ত। মেয়েটা চোখ দিয়ে ভস্ম করতে পারে। সেদিন তো খেয়ে ফেলার মত লুক নিয়ে তাকিয়েছিল। তাই দমে গিয়েছিল হেমন্ত। কিন্তু আজ তা কিছুতেই হতে দেয়া যাবেনা!

সময় গড়াল। সন্ধ্যা নামছে। আজ অফিসেও যায়নি হেমন্ত। পুরোটা দিন মনে মনে ছক কষেছে, কীভাবে মেয়েটার সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট করা যায়। যাতে এবার আর রিজেক্ট না হয়! প্রেমিক-ট্রেমিক থাকলেও কি! ব্রেক-আপ করিয়ে ছাড়বে হেমন্ত। নাহলে হামিদ সাহেব তাকে ঘরছাড়া করতেও দ্বিধা করবেন না।
ঘড়ির কাটায় তখন পাঁচটা বেজে পনেরো। এটা একটা ছোট-খাটো ক্যাফে। স্রোতের হোস্টেলের পাশে বলেই এই জায়গাটা সিলেক্ট করেছে হেমন্ত। হোস্টেলের ঠিকানা জোগাড় করতে অবশ্য কাঠখড় পোহাতে হয়নি। স্রোতের দায়িত্বশীল বাবা-ই এ উপকার করেছেন।

কাঁধে কারোর হাতের ছোঁয়া পেতেই ত্বরিত বেগে ঘাড় ঘুরালো হেমন্ত। ওমনি তার নিঃশ্বাস আটকে এল। চোখ দু’টো বড়-বড় হলো। উঠে দাঁড়াতেই মানুষটা কাঁধে হাতের বল প্রয়োগ করে বসিয়ে দিল। এরপর গটগট বুটের শব্দ তুলে সামনের চেয়ারটায় বসল আয়েশ করে।
হেমন্ত চশমা ঠিক করল। পুলিশি পোশাকে এই লম্বা-চওড়া যুবককে দেখে সহসা যে কেউই ঘাবড়ে যাবে, তার চেহারার ভাবমূর্তি যে এমনই! ঘাবড়ানোর মতন..

শক্ত চোয়ালে হাসি ফুটে উঠল আচমকা। নায়ীব সামান্য শব্দে হাসলোও। হঠাৎ প্রশ্ন করল,
“ ওয়েটার হয়ে টেবিল দখল করে বসে আছো কেন?”
হেমন্ত নিজেকে পরখ করল একবার। ফের চশমা ঠেলে রাগী গলায় বলল,
“ আমি ওয়েটার না। আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। আপনি কে? আমার সঙ্গে কি দরকার?”
“ আওয়াজ নিচে!” শান্ত স্বরের ধমক।
দরদর করে ঘাম ছুটল হেমন্তের।
দুর্ভাগ্যবশত, সেদিন সে কেবল স্রোতকেই লক্ষ্য করেছে। আবছা, অস্পষ্ট আলোয় নায়ীবকে সে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেনি। চেহারাটাও তাই ঘোলাটে লেগেছে।

হেমন্তের মাথায় অন্য ভাবনার আগমন হলো। ওর প্রাক্তন কি তবে পুলিশের কাছে সব ফাঁ/স করে দিয়েছে? ব্রেক-আপ নিয়ে তো কোনো ল নেই! তাহলে কিসের কমপ্লেইন করল? মানহানির?— ভাবতেই ফের কপাল বেয়ে সরু ঘামের রেখার উদয় হলো। ওর প্রাক্তন তো সাংঘা-তিক!
এসির নিচে বসেও সে ঘামছে!
নায়ীব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ কি হলো? টেনশনে পড়ে গেলে নাকি?”
হেমন্ত নিজেকে ধাতস্থ করল বহু কষ্টে। বলল,
“ কি দরকার আপনার? আমি তো আপনাকে চিনি না। কোনো আসা-মীও নই আমি।”

নায়ীবের রাগ এক মুহুর্তের জন্য উধাও হয়ে গেল। তার না হওয়া শশুর এই হাবা-গোবা, চার চোখের, বল দ গোছের ছেলেকে নিজের সুশ্রী মেয়ের জন্য পছন্দ করেছেন? জাস্ট ইম্পসিবল!

পরমুহূর্তেই ফের রাগী চোখে তাকাল ও। হিসহিস করে বলল,
“ এখানে কি কারণে আসা আজ?”
“ আমি দেখা করতে এসেছি। হবু বউয়ের সাথে। আপনার কি..ওয়েট! ইউ..”
দৃষ্টি শিথিল হলো হেমন্তের। চোয়াল ঝুলে পড়ল। চমকিত গলায় শুধাল,
“ আপনি-ই সে?”
“ কোন সে?”
“ না মানে, স্রোতশ্রী নামের মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড! কি সাংঘা/তিক! মেয়েটা সোজা তার বয়ফ্রেন্ডকে পাঠিয়ে দিয়েছে! তাও আবার আমাকে শাসানোর জন্য?”
হেমন্ত বিস্ময় ভুলে রেগে গেল। উঠে দাঁড়ালো অবিলম্বে।

“ বোস!” অতি শান্ত স্বর শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো হেমন্ত। না বুঝার মতন মুখ করে বলল,
“ সরি?”
“ বসতে বলেছি!” কণ্ঠস্বর শুনেই এবার হেমন্ত’র গলা শুকিয়ে এল। কার পাল্লায় পড়লো ও! চটপট চিত্তে ও চেয়ারে বসল আবার। আশেপাশে গুটি কয়েক মানুষজন। ওরাও আড়চোখে তাকাচ্ছে। হেমন্ত তাদের সামনে ইজ্জত খোয়াতে চায়না।
নায়ীব কঠোর চোখে তাকিয়ে বলল,
“ ফোন বের কর।”
“ হ্যাঁ?”
“ ফোন বের করে স্রোতের বাবাকে কল দিবি, দিয়ে বলবি উনার মেয়েকে তুই বিয়ে করবিনা। তোর আরেকজনকে পছন্দ। গট ইট?”
“ অ..অসম্ভব! আই কান্ট ডু দিস!”

এবার চট করে নায়ীব নিজের ফোন বের করল। দ্রুত গতিতে কল লাগালো জিহাদকে। রাশভারি গলায় বলল,
“ জিহাদ, গাড়ি নিয়ে আসো। ঠিকানা পাঠাচ্ছি। আর হ্যাঁ! স্পেশাল হ্যান্ডকাফটা অবশ্যই সঙ্গে আনবে। লকাপ যেন একদম ফাঁকা থাকে।”

হেমন্ত’র শ্বাস রোধ হলো যেন। তড়িঘড়ি করে ফোন বের করল। কল দিয়ে স্পিকার অন করল। নায়ীব কান থেকে ফোন সরিয়ে একবার ওর ফোনে চোখ ঘুরাল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“Saim Uncle”

নিজের ফোনটা কান থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে বসল নায়ীব।
রিং হয়ে যাচ্ছে, রিসিভ হচ্ছেনা। হেমন্ত অস্থির চোখে ক্রমশ ফোন আর নায়ীবের কাঠিন্যতায় ঘেরা মুখ পরখ করছে।
কল রিসিভ হলো। সালাম-টালাম রেখে হেমন্ত গড়গড় করে বলল,
“ আংকেল, আমি বিয়েটা করতে পারবনা, সরি।”

আকস্মিক এমন কথা শুনে ওপাশে থাকা ব্যক্তি বোধহয় শব্দ খুঁজে পেলেন না। খুব সময় নিয়ে হঠাৎ বললেন,
“ কি বলছো, হেমন্ত? বুঝতে পারছিনা!”
“ বাবার কারণে স্রোতশ্রীকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম আংকেল। কিন্তু আমি আরেকজনকে পছন্দ করি। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।”

সাঈম সাহেব বোধহয় কড়া ভাষায় কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন, তার পূর্বেই নায়ীব হাত থেকে টেনে ফোন নিয়ে নিল। এরপর কল কেটেও দিল। হেমন্ত জিজ্ঞাসুক নজরে তাকিয়ে। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। কবে বের হবে এই রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি থেকে,তারই প্রহর গুনছে। নায়ীব উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“ চল..”
হেমন্তকে নিয়ে সে ক্যাফের বাইরের দিকটায় এলো। জিহাদ ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে হাজির। পুলিশের গাড়ি দেখেই হেমন্ত’র কাঁদো কাঁদো মুখে তাকাল। সামান্য ঝুঁকে নায়ীবের পা ধরতে চাইলো বোধহয়। তার আগেই নায়ীব সরে গেল। কপালে তার গাঢ় ভাঁজ। এই বল/দের এহেন কাজ দেখে তার হাসি পেল। কিন্তু সে হাসলোনা। বলল,
“ আয়, লকাপের হাওয়া খাইয়ে আনি। তাহলে বিয়ের শখ মিটবে।”

কথাটা নিত্যান্তই মজার ছলে বলা। কাজ তো হয়েই গেছে নায়ীবের।
অথচ কথাখানা শুনেই হেমন্ত তার হাত ধরল। মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,
“ না, স্যার। এই সর্ব নাশ করবেন না, প্লিজ! স্রোতশ্রীর সামনে আমি ভুলেও যাবনা, ওর বাবার সামনেও না। কসম খেয়ে বলছি! আমাকে ছেড়ে দিন, আমার বস জানলে অফিস থেকে বের করে দিবে।”
নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। হাত ছাড়িয়ে নিল। স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“ এক মিনিটের ভেতর চোখের সামনে থেকে ফুট!”

এক মিনিটের কম সময়েই জলজ্যান্ত মানুষটা উধাও হয়ে গেল। মেইন রোড পেরিয়ে ততক্ষণে হেমন্ত ছুটে রিকশায় চড়ে বসেছে।
নায়ীব ধীরে সুস্থে রাস্তা পার হলো। গাড়িতে উঠে বসতেই জিহাদ জিজ্ঞেস করল,
“ স্যার, হ্যান্ডকাফটা কার জন্য?”
“ একটা উটকো ঝামেলার জন্য। লাগবেনা এখন। গাড়ি স্টার্ট দাও।”

ঘড়িতে তখন ছয়টার উপর বাজে। সূর্য সেই কবে অস্ত গেছে। আজ বহুদিন পর ডিউটি শেষে ক্লান্ত লাগছেনা নায়ীবের। কপালে হাত ঠেকিয়ে ফোন অন করল ও। স্ক্রিনে ভাসলো সাতটা ম্যাসেজের নোটিফিকেশন। লাস্ট ম্যাসেজটা দশ মিনিট আগের। ভয়ে হয়তো কল দেয়নি মেয়েটা।
নায়ীব নিজেই কল দিল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।
রিসিভ হলো সেকেন্ডের মাথায়। স্রোত ব্যাকুল গলায় জানতে চাইল,
“ কোথায় আপনি?”
“ রাস্তায়।”
“ বাসায় ফিরছেন?”
“হুম! কিছু বলার ছিল?”

স্রোত ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছু ভাবলো। যতই নায়ীব শান্ত মেজাজের হোক। শান্ত মেজাজের মানুষ জন রাগলে ভীষণ ভয়াবহ ভাবে রাগে। সে ক্যাফের ঠিকানা দেয়ার কিছুক্ষণ পরই আফসোস করেছে। না দিলেই তো পারতো! এই লোক যদি আবার কিছু করে?
ভাবনার মধ্যে ফোনে আরেকটা কল ঢুকলো। নায়ীবকে তাই বলল,
“ আব্বু কল দিচ্ছে। পরে কথা বলি?”
নায়ীব বিস্তর হাসলো। বলল,
“ শিওর।”
খট করে কল রেখে ফোনটা সামনের ফাঁকা জায়গায় ছুঁড়লো। জিহাদ পাশ ফিরে তাকালো একবার। নায়ীবের হাসি হাসি মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ স্যার, হাসছেন কেন?”
“ এমনি।”

এরপর মিনিট খানেক পর নায়ীবই ঘাড় ঘুরালো। ভীষণ স্বাভাবিক স্বরে একটা অস্বাভাবিক কথা বলে বসল,
“ বিয়ে করবো আমি, জিহাদ। সবার আগে তোমার দাওয়াত রইল।”

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২৪

সাত সকালে সুহাদকে ডেকে পাঠালেন সাঈম রহমান। সুহাদ তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে গেল। সেখানে আগে থেকেই আশা উপস্থিত ছিলেন। হাতে তার নাশতার ট্রে। বের হওয়ার ক্ষণেই সাঈম সাহেব আটকে দিয়েছেন,জরুরী কথা আছে নাকি। সুহাদ আসতেই সাঈম সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। বলা শুরু করলেন,
“ আমাকে অনেক আগেই হামিদ ভাই স্রোতের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, তা তো তোমাদের বলেছি-ই।”

আশার কপাল কুঁচকে গেল। তার জানামতে, প্রস্তাবটা বছর খানেক আগে পাওয়া মাত্রই নাকচ করে দিয়েছিলেন সাঈম সাহেব। বাড়িসুদ্ধ লোক তা-ই জানে, স্রোত বাদে।
তার কুঁচকানো কপাল দেখে সাঈম সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
“ তোমরা হয়তো ভাবছো প্রস্তাব নাকচ করার পরও কী করে উনি আশা নিয়ে বসে থাকেন! আসলে উনাকে কারণ হিসাবে স্রোতের বয়স দেখিয়েছিলাম। তবে উনি মানেননি। ওর তো মাস্টার্সও শেষ হয়ে যাবে। তা-ই এবার আর মানা করতে পারিনি। তাছাড়া উনার ছেলেকে দেখে ভালো মনে হয়েছিল।”
শেষের কথায় নাক-মুখ মা রাত্মক কুঁচকে এলো তার। সুহাদ ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো তা দেখে। সাঈম সাহেব এবার গম্ভীর গলায় বলতে লাগলেন,
“ কিন্তু ছেলেটা আস্ত এক বেয়া-দব! আদব-কায়দার বালাই নেই। তার উপর ও চাপে পড়ে রাজি হয়েছিল। তাই হামিদ ভাইকে আমি কড়া ভাষায় মানা করে দিয়েছি। আর এ কথা আমি কালই স্রোতকে জানিয়ে দিয়েছি। ওর হয়তো সাময়িক খারাপ লাগতে পারে!”
সুহাদ এবার মুখ খুলল,
“ ওর এমনিতেও এই প্রস্তাবে রাজি ছিলনা, আব্বু!”
সামান্য চমকালেন সাঈম সাহেব,
“ তাহলে আগে জানালো না কেন?”

সুহাদ দম নিল। একবার চাইল মায়ের দিকে। এরপর বলল,
“ হয়তো তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে,তা-ই। তাছাড়া ও তোমাকে ভয়ও পায়।” সুহাদ থেমে আবার বলল,
“সবাই-ই পায়।”

আশ্চর্য হলেন সাঈম সাহেব। স্ত্রীর দিকে অবাক নয়নে তাকালেন। অবুঝ শিশুর মত প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“ অ্যাই আশা! বলোতো, আমি কখনো আমার মেয়েকে ধম-ক দিয়েছি? নাকি গায়ে হাত তুলেছি?”
আশা মুখ নুয়ালেন সামান্য,
“ আপনার চেহারা দেখলেই তো সবাই ভয় পায়..”
সাঈম সাহেব আরো আশ্চর্য হলেন। তার মন চাইল আয়নার সামনে বসে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে। এই বয়সে পেটে সামান্য ভুঁড়ি বেড়েছে, এই যা! আহামরি ও বাড়েনি। চুলগুলো মেহেদীর দেয়ার কারণে লাল। মুখের চামড়া ঝুলেনি ওতো। এখনও কাঠখোট্টা, শক্ত আছেন। দেখতে তিনি এতটাও ভয়া-নক নন! আশার কথায় তিনি প্রচন্ড ব্যথিত হলেন বোধহয়। তার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়া চেহারার আদল দেখে মুখ চেপে হাসলেন আশা। বললেন,
“ আমি আপনাকে অসুন্দর বলিনি।”
সুহাদ উঠে দাঁড়ালো এর মাঝে। মা-বাবার এই অল্প-সল্প মান-অভিমানে সে থাকতে চাইলোনা। তবে যেতেও পারলনা। হঠাৎ মুখ খুলল,
“ আব্বু! আরো কিছু কথা ছিল আমার।”
“ বলো..”
“ স্রোত তো এখন আর ছোট নেই।”
“ হুম, তো?” কিঞ্চিৎ ভাবুক হলেন সাঈম সাহেব।

“ বিয়ে সারাজীবনের ব্যাপার। এই ব্যাপারে ওর নিজস্ব মতামত বা পছন্দ থাকা অস্বাভাবিক নয়।”

নিচু স্বরে বলল সুহাদ। এবার তৃতীয় আশ্চর্য কথা শুনে বাকরুদ্ধ বনে গেলেন সাঈম সাহেব। আশা সুহাদকে ইশারায় চলে যেতে বললেন। সুহাদ বেরিয়ে গেল। আশা পাশে এসে বসলেন। সাঈম সাহেব হতবিহ্বল চোখে তাকাতেই আশা বললেন,
“ মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন।”

..

নিশাত চিন্তিত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। নাবিদ সাহেব গেছেন ফার্মেসিতে, জ্বরের ওষুধ ঘরে নেই। কবে শেষ হয়েছে, জানা নেই। নিশাত হাত বাড়িয়ে নায়ীবের কপাল ছুঁয়ে দেখল। সেকেন্ড খানেকের মাথায় হাঁচি দিয়ে উঠল নায়ীব। পরপরই নাক টানল। চোখ দু’টো নিভু-নিভু। রাতে সে বরফ গলা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছে। তার এই দুঃসাহসিক কাজের কথা শুনে নাবিদ সাহেব একচোট বকেছেন। নিশাত তো বিশ্বাসই করতে পারছিলনা। সে শীত আসার আগেই গরম পানি দিয়ে গোসল করে। আর তার ভাই কিনা রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছে! নায়ীবের শরীর নাজুক নয়। তাও জ্বর তাকে ভালোই কাবু করেছে। সকালে তাই থানায়ও যেতে পারেনি। নিশাত ভ্রু কুঁচকালো। ভীষণ বিরক্ত হয়ে সহসা ঝা-ড়ি দিয়ে উঠল,
“ এই বয়সে এটা কেমন কান্ড-জ্ঞানহীন কাজ, ভাইয়া! এই জ্বর এখন কয়দিনে বিদায় হয়, দেখবা!”
নায়ীব চোখ বুজল। অসন্তোষ গলায় বলল,
“ জ্ঞান দিসনা তো, বের হ রুম থেকে।”
নিশাতের মন খারাপ হলো। জলপট্টি দিতে দিতে বলল,
“ বিয়ে-শাদি করার আগেই এমন দূরছাই করছো! ভাবি আসলে তো ঘর থেকেই বের করে দিতে পারো,মতিগতি সুবিধের লাগছেনা।”
নায়ীব চোখ খুলল ফট করে। কপট রাগ প্রকাশ করে বলল,
“ মুখটা বন্ধ রাখবি? নাহলে বউ আনার আগেই তোকে বিদায় করব।”

.

জোহাকে পড়ানো শেষ করে প্রচন্ড দ্বিধায় ভুগতে লাগলো স্রোত। হাঁস-ফাঁস করতে করতে আরেকবার নায়ীবের ফোনে কলও দিয়ে বসল। না! এখনও অন হয়নি ফোন। রাত থেকে ফোনটা সুইচড অফ। সে বাসায় কীনা, তাও আন্দাজ করতে পারছেনা ও। জোহা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে। ঠোঁটের কোণে অল্প দুষ্টু হাসি। স্রোত যদিও সেসব খেয়াল করছেনা। মিনিট দশ এক পেরোতেই ও ব্যাগ নিয়ে উঠল। বিষন্ন মুখে একপল চেয়ে বলল,
“ আসি, জোহা। পড়াগুলো শেষ করে রেখো।”
জোহা মাথা নাড়ায়। দরজা অব্দি পিছু পিছু যাওয়ার কথা তার। তবে সে দরজা না লাগিয়ে মুখ বের করে বাইরে তাকিয়ে রইল।
উপরে উঠবে কিনা তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল স্রোত, এর মধ্যে জোহার এসব অদ্ভুত কান্ডে সে ভীষণ ভ্যাবাচেকা খেল। এই বিচ্ছুর সামনে দিয়ে উপরে যাবে সে? অসম্ভব! কি না কি ভেবে বসে আবার! ও ঠোঁট চেপে নিচের দিকে পা বাড়াল। দরজা লাগানোর শব্দ হতেই আবার পা ঘুরালো। সেকেন্ড ত্রিশের মধ্যেই সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরের তলায় উঠে গেল। মেয়েটা বুঝলোই না, দরজার দূরবীন দিয়ে তার কাজ দেখে তখন খিলখিল করে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে জোহা!

স্রোত বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে কলিং চাপলো। মিনিট দু’এক এর মাথায় দরজা খুলে গেল। নিশাত হা হয়ে চেয়ে খুশি হয়ে বলল,
“ আপু! তুমি?”
স্রোত ইতস্তত হাসলো। কানের পিঠে চুল গুঁজে নিচু স্বরে বলল,
“ তোমার সঙ্গে অনেকদিন কথা হয়নি, তা-ই ভাবলাম একটু দেখে যাই।”

নিশাত সরে দাঁড়ালো। স্রোত ভেতরে প্রবেশ করল ভীষণ ছোট ছোট কদমে। কৌতুহলী গলায় জানতে চাইল,
“ বাসায় কি তুমি একা?”
“ উহুম! সবাই আছে তবে আব্বু মসজিদে।”
“ সবাই?” অবাক স্বর স্রোতের। যাক! আসা তবে বৃথা হয়নি। মাথা নাড়িয়ে নিশাত উত্তর দেয়,
“ আসলে,ভাইয়া অসুস্থ তো! তা-ই আজ কাজে যায়নি। আব্বু তো বাসায়ই থাকে। আসো, রুমে আসো।”

নিশাতের দৃষ্টি তখন স্রোতের দিকে স্থির। কথা শেষ হওয়ার মিলিসেকেন্ডের মাথায়ই পালটা প্রশ্ন আসলো,
“ অসুস্থ? হঠাৎ কি হলো উনার?”

নিশাত চোখ ফিরিয়ে হাসলো। জোহা তবে ভুল খবর দেয়নি তাকে। ও হাসি লুকালো বহু চেষ্টার পর। পরপরই দুঃখী মুখ বানিয়ে বলল,
“ আর বোলো না! কাল রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছে। তা-ই জ্বর এসেছে। কিছুই খাচ্ছেনা। আমি আর আব্বু এত জোর করলাম! আব্বু একটু আগেই মসজিদে গেছে।”
একটু থেমে ও পা বাড়াল নায়ীবের রুমের দিকে। দরজার কাছটায় গিয়ে বলল,
“ আসো, সমস্যা নেই। ভাইয়া ঘুমাচ্ছে।”

ইতস্তত চিত্তে স্রোত এক কদম, দু কদম করে এগোলো। কেমন জড়ানো তার ভাব-ভঙ্গি! মানুষটার জ্বর! অথচ সে জানালোও না একবার?
দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে আঁধারে তলিয়ে যাওয়া রুমের কিচ্ছুটি দেখা গেলনা। সুইচ বোর্ড হাতড়ে লাইট অন করল নিশাত। বেডে কাত হয়ে শুয়ে আছে নায়ীব। গায়ে মোটা কম্বল। মাথার কাছে ভেজা রুমাল। নিশাত ছুটে গিয়ে সেটা সরালো। বালিশটা কিঞ্চিৎ ভিজে গেছে। ও টুল টেনে বেডের পাশে রাখল। স্রোতকে ইশারা দিয়ে বলল,
“ বসো। আমি আসছি।”
মেয়েটা স্রোতের প্রতিক্রিয়া কিংবা প্রত্যুত্তর, কোনোটারই অপেক্ষা করলনা। অস্বস্তির অতল সাগরে স্রোতকে ধা-ক্কা দিয়ে সে ছুটল রান্নাঘরে।
স্রোত বসল টুলে। নায়ীব ওদিকে ফেরা। কপাল ঘুমের মধ্যেও কুঁচকানো। স্রোত মৃদু স্বরে ডাকল,
“ এই যে,শুনছেন?” আওয়াজ অত্যন্ত ক্ষীণ। নিজের আওয়াজ নিজের কানেও বাড়ি খেলনা স্রোতের। ও অসহায়ের মত বসে রইল। মিনিট খানেক গড়াতেই হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল ফ্যাকাশে ললাটটা। জ্বর তখন কমেছে সামান্য। স্পর্শটা আরো গাঢ় হলো। স্রোত আনমনা হয়ে হাতটা চুলেও ছুঁয়ালো। পাতলা চুলের ফাঁকে তার আঙুল চালানোর পূর্বেই অকস্মাৎ হাতখানা ব-ন্দি হলো।

নায়ীব চোখ মেলল অনেক কষ্ট করে। তবে চোখ খুলে আর মন চাইলনা চোখ দু’টো বুজতে। ও কি সত্যি দেখছে? নাকি সবটাই জ্বরের ভ্রম?
স্রোত বাকহারা! মুখ সামান্য ফাঁক। চার চোখ তখন একই দৃষ্টিতে বন্দি। সময়টা বোধহয় থমকে গেছে। তবে সেকেন্ড খানেকের মাথায় নায়ীব তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। স্রোতের হাতটা ছেড়ে ও হেলান দিয়ে বসল বালিশে। লজ্জায় জবুথবু অবস্থা স্রোতের। নায়ীব নিভু চোখে চাইল। গাঢ় স্বরে জানতে চাইল,
“ এখানে কি?”

“ আপনার ফোন কোথায়? রাত থেকে বন্ধ!”

“ চব্বিশ ঘন্টাও তো হয়নি! তাতেই এই অবস্থা? প্রেমে তো বেশ ভালোই হাবুডুবু খাচ্ছেন। বাসায় না পেলে নিশ্চয়ই মিসিং ডায়রি করতে যেতেন!” জড়ানো গলায় এক নিঃশ্বাসে কথা বলে অল্প হাসলো নায়ীব। জ্বরে চেহারা পুরোপুরি ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে! তার উপর আবার স্রোতের মজা উড়াচ্ছে। স্রোত নিজের রাগ দমিয়ে রাখল। ভাবল, এই লোকের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে তাই।
ও নিশ্চুপে চেয়ে রইল। নায়ীব তা দেখে ভ্রু নাঁচালো এবার। মুখ খুলল ফের,
“ কখন এসেছেন?”
“ আপনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন।”
“ একা এসেছেন?”
“ আর কে আসবে সাথে?”
পালটা প্রশ্ন শুনে চোখ ফিরালো নায়ীব। ঘড়িতে চোখ ঘুরালো একবার। ছয়টা বাজতে চলেছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল একটা। মেয়েটার সাহস আছে, বলতে হয়। এখন একটুতেই সন্ধ্যা নামে। বাইরেটা একদম সুনশান হয়ে যায়। এতক্ষণে হয়তো হোস্টেলে পৌঁছে যেত! এখন ফিরবে একা একা! নায়ীবের মনে একটু একটু করে অশান্তি বাড়ল। ও গা ঝাড়া দিল। স্রোত নিশ্চুপে চেয়ে আছে এখনও। আশপাশ হাতড়ে ফোন খুঁজল নায়ীব। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা সেটা। রাতে অফ হয়ে গেছিলো বোধহয়। এরপর আর দুনিয়াদারির খবর রাখেনি নায়ীব। গা কাঁপিয়ে জ্বর তার বহুদিন পর এসেছে। আগে মা জলপট্টি দিত। এখন নিশাত দিয়ে দেয়। ক’দিন পর হয়তো আরেকজনও দিবে। নায়ীব ঠোঁট চেপে কিঞ্চিৎ হাসলো।
স্রোত ভ্রু কুঁচকালো তাতে,
“ আপনার জ্বর নেমেছে?”
নায়ীব গাঢ় চোখে তাকাল। বলল,
“ একটু আগে না কপাল ছুঁয়ে দেখলেন? কি মনে হয়, নেমেছে?”
অস্বস্থিতে নাস্তানাবুদ হলো স্রোত। দৃষ্টি লুকাতে চাইলো। ওর চো রা চাহনি নায়ীবের নজর কাড়ল। মেয়েটাকে আজ অন্যদিনের তুলনায় অগোছালো লাগছে। চোখ মুখে কত দ্বিধা! নায়ীবের সঙ্গে বোধহয় ওত ফ্রি হতে পারেনি! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার পূর্বেই স্রোত ত্যাড়া গলায় বলল,
“ দেখতে দিলেন আর কই!”

নায়ীব থমকালো বোধহয়। তবে আবার ঠোঁট এলিয়ে বিস্তর হাসলো। মাথা এগিয়ে বলল,
“ আচ্ছা, দেখুন আবার।”
স্রোত জড়তা নিয়েই হাত বাড়ালো। চোখে চোখ পড়লনা এবার। নায়ীব তার দিকে চেয়ে থাকলেও সে লজ্জায় তাকাচ্ছেনা। সেকেন্ড কয়েকের মাথায় ললাটে স্পর্শরত হাতটা সরিয়েও নিল। ছোট্ট করে বলল,
“ কমেছে। থার্মোমিটার থাকলে ভালো হত।”

“ ড্রয়ারে দেখো, আপু। থার্মোমিটার ওখানেই রাখা।”
নিশাতের হাতে নাশতার ট্রে। সঙ্গে নায়ীবের ভীষণ প্রিয় ভেজিটেবল স্যুপ! তবে নায়ীব নাক সিটকালো খাবার দেখে। পুরোটা গলা তেঁতো হয়ে আছে। পানিটুকু গিলতেই তার আপত্তি হয়। তবে নিশাত এবার মাথায় বুদ্ধি এঁটেই এসেছে। স্রোত সামনে থাকলে, ভাই খেতে আপত্তি করবেনা, সে জানে।
স্রোত প্রথমে নিশাতের গলা পেয়ে আঁতকে উঠেছিল। মেয়েটা কি তবে দেখেই ফেলল তাদের ওই অবস্থায়? তবে নিশাতের স্বাভাবিক মুখভঙ্গি দেখে সে আর ঘাটলোনা। ব্যাপারটা ঘুরাতে ও ড্রয়ার খুলল। ড্রয়ার খুলতেই একরাশ কৌতুহল ঝেঁকে ধরল তাকে। এত এত প্রিন্টেড ছবি! স্রোত হাতে নিল কয়েকটা। এত মেয়েদের ছবি! থার্মোমিটার একহাতে নিয়ে মুখ ঘুরালো নিশাতের দিকে। হাত বাড়িয়ে সহসা প্রশ্ন করল,
“ এই নাও। কিন্তু এগুলো কে, নিশাত?”

নিশাত পা বাড়িয়ে উঁকি দিল। পরপরই তাকালো ভাইয়ের দিকে। ছবিগুলো সেই পাত্রীদের। নায়ীব ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ‘শি!ট’ বলে কপাল চাপড়ালো। এগুলো এখনও সরানো হয়নি! সে তো ভুলেই বসেছিল এগুলোর কথা!
নিশাত সরে এসে বিছানার কোণায় বসল। বেশ হাসি-হাসি মুখ বানিয়ে বলল,
“ এগুলো আসলে ফুপ্পি রেখে গেছে। ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখেছেন উনি। তুমি দেখতে চাইলে দেখো। ছবির পেছনে ডিটেইলসও দেয়া আছে।”

স্রোত ছবিগুলো পূর্বের স্থানে রেখে আস্তে করে ড্রয়ার বন্ধ করল। হাত গুটিয়ে নিল আবার। অতিরিক্ত কৌতুহল ভালো নয়। এইযে, এতগুলো কথা তো তার না জানলেও হতো! ও সামান্য হাসার চেষ্টা করল। বলল,
“ দেরী হচ্ছে আমার। যেতে হবে।”
“ নাশতা খাও। তোমার জন্য বানিয়েছি তো। ভাইয়া এগুলো খায়না। আমার একা একা খেতে ভালো লাগেনা, আপু।”
একটা বাটি এগিয়ে দিল নিশাত। এরপর স্যুপের বাটিটা নায়ীবের দিকে এগিয়ে দিতেই নায়ীব রাগী চোখে তাকিয়ে তা হাতে নিল। তার রাগী দৃষ্টির মানে বুঝেও পাত্তা দিলনা নিশাত। একবার পরখ করে নিল স্রোতের নিরস মুখখানা।
স্রোত অল্প খেয়ে উঠে দাঁড়ালো। সাইড ব্যাগটা হাতে তুলে নিশাতের দিকে চেয়ে বলল,
“ আসি, নিশাত। ভালো থেকো।”
নিশাত নিজেও উঠল। স্রোতকে দরজা অব্দি বিদায় দিয়ে পা ঘুরতে না ঘুরতেই আশ্চর্য বনে গেল। নায়ীব তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসছে। সে না সারাদিন শরীর দুর্বল বলে বিছানা ছেড়ে উঠে এক দন্ড দাঁড়াতে পারেনি? এখন সোজা দৌঁড়ানোর অবস্থা? নিশাত অবাক হয়ে বলল,
“ কি হলো, ভাইয়া! কোথায় যাচ্ছো!”
নায়ীব জবাব না দিয়ে বেরোতে চাইল বাসা থেকে। নিশাত আটকে দিল। বলল,
“ এই শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? আব্বু কিন্তু বকবে!”
নায়ীব দম নিল। নিশাতের মাথায় দু’টো গাট্টা মে রে বলল,
“ সবসময় দুই চামচ বেশি বকিস কেন? ওকে ওই ফুপ্পির আনা পাত্রীদের কথা বলার কি দরকার ছিল?”
চেঁচিয়ে আর্তনাদ করে নিশাত।
নায়ীব মুখ চেপে ধরে রাগী চোখে তাকায়। বলে,
“ এসে বুঝাচ্ছি মজা,দাঁড়া।”

এরপর সে জুতো পরে এলোমেলো পায়ে দরজা খুলে ছুটলো।

স্রোত তখন দ্রুত কদমে এগোচ্ছে। গেট পেরিয়ে সবেই কিঞ্চিৎ অন্ধকার নিস্তব্ধ গলির রাস্তায় পা দিয়েছে, তক্ষুনি কেউ বাহু টেনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় স্রোত ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অজানা আশংকায় ও যখন চেঁচাতে যাবে, তখনি আবার একটা শক্তপোক্ত বৃদ্ধাঙ্গুল ঠোঁটের ওপর দৃঢ় ভাবে চেপে ধরল কেউ। এরপরই তার মুখটা এগিয়ে আনতেই তা স্পষ্ট হলো স্রোতের নিকট। সেই ছোট ছোট দু’টো চোখ, ধারালো নাক, সামান্য কালচে হওয়া ঠোঁট আর লম্বাটে মসৃণ অথচ ফ্যাকাশে চেহারাটায় ওর দৃষ্টি আটকে গেল।
মানুষটা তখন গম্ভীর গলায় বলল,
“ এত ভয় কিসের? আমি ছাড়া আর কে ছুঁবে আপনাকে? এত সাহস কার?”
বৃদ্ধাঙ্গুলটা তখন স্রোতের গালের কাছটায়। স্রোতের কাছে এ ব্যাপার গুলো নতুন। মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়লেও হৃদয়ে কেবলই ভালোলাগার জোয়ার। সেই জোয়ারে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে স্রোত। একটু আগের রাগটাও কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
নায়ীবের চোখে হাসলো। আঙুলের সাহায্য ফোলা গালটায় চাপ দিল অল্প। ওমনি লজ্জায় কাবু হলো স্রোত। হাঁসফাঁস করে সরতে চাইলে, নায়ীব দু’হাত দেয়ালে রেখে আটকে দিল। স্রোত অস্থির গলায় বলল,
“ সরুন!”
“ উহু! এত রাগ?”
ফোঁস করে উঠে স্রোত,
“ আমি বিয়ে ভাঙ্গছি আর এখানে মেয়ে দেখা হচ্ছে!”
“ এইযে, এখন দেখছি মেয়ে। ”

নায়ীবের স্বাভাবিক গলা। মাথা অল্প পেছনে সরালো সে। স্রোতের ভ্যাবাচেকা খাওয়া চেহারাটা দেখে সে মজা পেল বেশ। স্রোত তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সরতে চাইলেই পুনরায় দূরত্ব কমায় নায়ীব। জ্বরও তাকে এত কাবু করতে পারেনি,যতখানি এই মেয়ে করেছে!

চলবে.