গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
633

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩১

স্রোতের চোখ অশ্রুসিক্ত। মেয়েটা অত্যাধিক বোকা। অন্য সবকিছুতে সে ব্রেইন খাটালেও প্র‍্যাকটিকাল লাইফে সে চূড়ান্ত পর্যায়ের বোকা। এই যে, পুরোটা দিন তার বাড়িতে এত আয়োজন করা হলো, সে বুঝতে পারলো দুপুরের দিকে। এরপর রোবটের মতো বসে ছিল কি না কি ভেবে! টেনশনে ওর হার্টবিট বেড়ে গেছিলো। না দেখা পাত্রপক্ষকে সে কয়েকটা ভয়ংকর গা-লিও দিয়ে বসেছিল। এখন সে পস্তাচ্ছে। না চিনে হবু শশুর বাড়ির লোকদের ওসব গা-লি না দিলেও পারতো!

নায়ীব মাথা নুইয়ে বসে আছে। তার ভেতরে অনেকখানি নার্ভাসনেস জমা হয়েছে। যতটুকু শুনেছে, জয়পুরের চেয়ারম্যান খুবই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কাঠখোট্টা, একরোখা। সুহাদকে দেখে মনেই হয়না সে সাঈম রহমানের ছেলে। তবে নায়ীব এ কারণে মাথা নত করে বসে নেই। সে মাথা নত করে রেখেছে অন্য কারণে। কারণটা স্রোত নিজেই। মাথা তুললেই ওই শাড়ি পরিহিতা মেয়েটার দিকে চোখ যাবে নায়ীবের। সে জানে, একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যাবেনা। নিজের স-র্বনাশ সে আগেই দেখেছে ওই চোখে, কিন্তু এই মুহুর্তে হবু শশুরবাড়িতে বসে নিজের নির্লজ্জতা দেখাতে চাইলোনা ও। ওর নির্লজ্জতা শুধুই বউয়ের জন্য বরাদ্দ।

সাঈম সাহেব নড়েচড়ে বসে হাসার চেষ্টা করলেন। না! ছেলেটা ছবির চেয়েও দেখতে আরো সুন্দর। এক দেখায়ই মনে ধরার মত। কথা বলার ভঙ্গিও সাবলীল, নমনীয়। বড়দের খুব সম্মান করে, বোঝাই যায়। এসেই সোজা সাঈম সাহেবকে সালাম করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেছে। বোঝাই যায়নি, এটা যে ওদের প্রথম সাক্ষাৎ।

স্রোত সাঈম সাহেবের পাশেই বসা। আঁচল পিঠের ওপর দিয়ে নিয়ে অন্যহাতে শক্ত করে মুঠ করে রাখা। চোখের দৃষ্টি তারও নত। তবে সে একটু পরপর চোখ তুলে তাকাচ্ছে। নিশাত যে আর দিকে চেয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে, তা দেখেই ও লজ্জায় আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। নিশাত একটা সিঙ্গেল সোফায় বসা। তার পাশেই ইনান দাঁড়ানো। সে ভ্রু কুঁচকে নিশাতের হাসি দেখছে। পা-গল নাকি? অযথা, একা একা হাসছে কেন?
ও কুঞ্চিত ভ্রু নিয়েই সামনে তাকাল।
সাঈম সাহেবের আলাদা করে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। তিনি সব খবরই জানেন। তাও তিনি ভেতরে হাঁসফাঁস করছেন। ছোটদের সামনে নিজের কথা ব্যক্ত করার যৌক্তিকতা নেই দেখে তিনি বললেন,
“ স্রোত, যাও। নায়ীবকে আমাদের বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে আসো।”

স্রোত উঠলো সময় নিয়ে। সে ভেবেছিল, আলাদা করে কথা বলার সুযোগ দেয়া হবেনা। প্রথমে অবাক হলেও খুশিমনে সরে দরজার কাছটায় গেল।
এতক্ষণে নায়ীব স্বস্তি পেল। তটস্থ পায়ে সে স্রোতের পিছু পিছু দু’তলায় চলে গেল।

এরপর আবার ইনানকে দায়িত্ব দেয়া হলো নিশাতকে বাইরের দিকটা ঘুরিয়ে আনানোর। ইনান খানিকটা বিরক্ত হলো। কিন্তু পরমুহুর্তে বুঝল, এটা একটা উছিলা মাত্র। সে কিছুতেই এখানে থাকার মত বয়সে বড় হয়নি।

ছোটরা যেতেই নাবিদ সাহেব মুখ খুললেন,
“ সোজাসুজি কথা বলি, ভাই-সাহেব। আমার ছেলেরও বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো আছে আর আমাদেরও। তাই ঘুরিয়ে কথা বলে লাভ নেই। স্রোতকে আমি আগে দেখেছি। আপনাদের মেয়ের রুপে-গুণে কোনো কমতি নেই। এমন মিষ্টি মেয়েকেই আমি ঘরে মেয়ে বানিয়ে নিয়ে যাব। আমার স্ত্রী নেই। ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছোট্ট সংসার। সেই সংসারে আরেকটা মেয়ে নিতে চাই। আপনাদের কি কোনো আপত্তি আছে?”

সাঈম সাহেব ভদ্রলোকের কথায় মুগ্ধ হলেন। তার চেয়ে বড় কথা, উনার মেয়ে ওখানে মেয়ে হিসেবে থাকবে- এই প্রতিশ্রুতি শুনেই তিনি মুগ্ধ হলেন। যদিও বা এসব বেশিরভাগ মানুষই বলে। তবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে ক’জনই বা?
সাঈম সাহেব সরাসরি জানালেন,
“ আপত্তি করার মত কিছু নেই। সবচেয়ে বড় কথা,ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করেছে। সংসার করার জন্য এর চেয়ে বড় কারণ আর লাগেনা।”
সাঈম সাহেব সহ বাকিরাও সন্তুষ্ট। তবে সঙ্গে আসা নায়মার ভাবভঙ্গি বোঝা দায়। খুবই নির্লিপ্ত হয়ে তিনি বসে আছেন। বসার ঘরটায় যেন তিনি নেই-ই। কেউ-ই আগে পাত্রী সম্পর্কে টু শব্দ বলেনি- সারপ্রাইজ দিবে বলে। এখানে ঢুকে যখন স্রোতকে দেখলেন, তখনই তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। নিশাত বার কয়েক জিজ্ঞেস করেছে যে স্রোতকে নায়ীবের বউ হিসেবে পছন্দ হয়েছে কিনা। কিন্তু প্রতিবারই তিনি কথা ঘুরিয়ে গেছেন।

..

জানলার ধারে চেপে দাঁড়াল স্রোত। আঁচল ছেড়ে দেয়া। খোঁপা করা অবিন্যস্ত চুল। পেছনে তাজা বেলী ফুলের মালা গেঁথে রাখা। কুঁচি অল্প এলোমেলো হয়ে গেছে। মুখে অতি সামান্য প্রসাধনীর ছোঁয়া। ওর মাথা থেকে পা অব্দি সম্পূর্ণটাই গাঢ় চোখে পরখ করছে নায়ীব। চোখের সেই প্রগাঢ় দৃষ্টি বেসামাল। প্রেয়সীকে পরখ করার চেয়ে মা-রাত্মক সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ বোধহয় ধরনীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তবে ওর মনে অন্য বাসনা জাগছে। চোখ যাচ্ছে মেয়েটার খয়েরি লিপস্টিকে ঢাকা ঠোঁটদ্বয়ের কাছে। লিপস্টিকটা ন:ষ্ট করার তীব্র, অস-ভ্য ইচ্ছা ক্রমশ বাসা বাঁধছে মনে। কিন্তু এ ভয়া;নক কাজে স্রোত জ্ঞানও হারাতে পারে ভেবে সংযত রইল।
ওর দিকে দৃষ্টি রেখে, প্রসন্ন হেসে নায়ীব সময়কে থমকে দেয়ার অদ্যম ইচ্ছা জাহির করল। সত্যিই যদি সময় থামিয়ে দেয়া যেত!
তার বেসামাল দৃষ্টিতে বরাবরের মতই লজ্জায় জবুথবু হচ্ছে স্রোত। ছোট-খাটো শরীরটা গুটিয়ে যাচ্ছে বারংবার। অদ্ভুতভাবেই আজ নায়ীবের পাঞ্জাবির সাথে স্রোতের শাড়ির রঙ মিলে গেছে। নায়ীবকে এই দ্বিতীয়বার পাঞ্জাবিতে দেখা ওর। চুলগুলো আবার মাঝারি করে কেটেছে। চোয়াল ভর্তি সামান্য দাঁড়ি,চোখে অগাধ মুগ্ধতা— সব মিলিয়ে এক নতুন নায়ীব লাগছে তাকে।
নায়ীব দৃষ্টি স্থির করল এবার; ঠিক স্রোতের চোখের মণি দু’টোয়। ডুবে গেল অতলে। একটু এগিয়ে হাত বাড়াল।
রুক্ষ হাতটা ছুঁয়ে গেল স্রোতের নরম, রক্তিম গাল। এরপর ঠোঁটের কাছটায় এসে থামল। স্রোতের মস্তক তখন নত। নায়ীব থুতনি ধরে মুখ উঁচাতে চাইল। স্রোত মুখ তুললইনা। বরং নায়ীবের হাতের ওপর হাত চেপে ধরে সরালো। তবে হাত ছাড়লোনা। নায়ীব ওর হাতসহ নিজের হাত উঁচালো। নরম-সরম হাতটার পিঠে কালচে ঠোঁট চেপে ধরল হঠাৎ।

..

নিশাত হাঁটছে। তার চোখে অসীম আগ্রহ। তাদের গ্রামের বাড়িতেও একটা ছোট্ট পুকুর আছে। সেখানে একবার ডুবেই গেছিল নিশাত। এরপর কোনোমতে ঘাটে উঠে এসেছে। সেই ডুব খেয়েই সে সাঁতার শিখেছে। তাদের গ্রামের বাড়িটার এখন ভুতুড়ে বাড়ির মত অবস্থা। বিরাট একটা তালা ঝুলে সদর দরজা আর মেইন গেটে। সুদীর্ঘ প্রাচীর টপকে কেও গেটের ভেতর প্রবেশ করতে পারেনা।
নিশাত হাঁটতে হাঁটতে দেখল, ইনান দাঁড়িয়ে পড়েছে। ও মাথা ফিরাতেই ইনান আবার হাঁটা ধরল। নিশাত জিজ্ঞেস করল,
“ তুমি কিসে পড়ো?”
“ জ্বি,টেনে। আপনি?”
“ আমি অনার্সে। তোমার আপু মানে আমার ভাবীর ইউনিভার্সিটিতেই।” নিশাতের কণ্ঠে খুশির ঝলক। শেষমেশ ‘আপু’ থেকে ‘ভাবী’ ডাক সে কণ্ঠ গলিয়ে বলতে পারছে।

ইনান হতবিহ্বল হলো। আশ্চর্য স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ আমি তো ভাবলাম আপনি আমার ব্যাচমেট।”
নিশাত দ্বিগুণ আশ্চর্য হলো। তার কপালে গুটি কয়েক ভাঁজও পড়লো। সে দেখতে এতটাও ছোট নয়। ওর তাকানো দেখেই ইনান আমতা আমতা করে উঠল। নিশাত চোখ ফিরিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো। দু’তলা বাড়িটা বিশাল জায়গা জুড়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল জমির ঠিক মাঝখানটায় বাড়ি বানানো হয়েছে। এখান থেকে বাড়ির পেছনের একাংশ দেখা যায় আড়া-আড়িভাবে। ও ডান হাত উঁচালো। তর্জনী তাক করে একটা ঘর চিহ্নিত করল। প্রশ্ন রাখল,
“ ওটা কি ভাবীর রুম?”
“ হু? হ্যাঁ, ওটা আপুরই রুম।”
কথায় কথায় ভাবী বলাটা উদ্ভট লাগছে ইনানের কাছে। তার বোনকে তো পাঠানোই হলোনা ও বাড়িতে। তার পূর্বেই এ মেয়ে ভাবী-ভাবী বলে বলে ফ্যানা তুলছে। কিন্তু হঠাৎ তার খেয়ালে এলো, ওরাও রোজকে ভাবী ডাকে। বিয়ের এখনও ঢের সময় বাকি। ওরাও তো ফ্যানা তুলে ফেলে ভাবী ডেকে। ওর মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে গেল।

নিশাত কৌতুহলী নজর সরিয়ে জ্বিভ কাট:ল। ভাইয়ার পাঞ্জাবি দেখা যাচ্ছে। ভাবির শাড়ির আঁচলও আবছা দেখা যাচ্ছিলো। এত দূর দেখে এমন দৃশ্যতে নজর খোয়ানো মোটেও ভালো কাজ নয়। নিশাত নিজেকে নিজে শাঁ-সালো।

..

বসার ঘরে নিরবতা আর নেই। রান্না-বান্না মূলত দুপুরের খাবারের আয়োজন ভেবেই করা হয়েছে। সব কিছুই ভারী খাবার। নাশতার আইটেম তার চেয়ে কম। তবে নাবিদ সাহেব সেসব ভারী খাবার খেতে নাকচ করলেন বিনয়ের সঙ্গেই। ওনারা খেয়ে এসেছেন দুপুরে। নাশতা খেয়ে পেটে আর জায়গা নেই।

আশা আরো নাশতার আয়োজন করলেন। ইমা তার কাছে গেলেন। প্রথমেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“ বসারঘরের মহিলা যে, উনি ছেলের কি হয়, আপা?”
“ ফুপু।“
“ মহিলাকে তো সুবিধের লাগছেনা।”
“ এই, ইমা! চেহারা দেখে মানুষ বাচবিচার করা কবে থামাবি তুই?”
ইমা কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার মন বলছে, মহিলার মতিগতি সুবিধার না একদমই। তার মনের কথা বিফলে যায়না। তার ভাবনার ব্যাখ্যা আর আশাকে দিলেন না উনি। ভাবলেন, রাতে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করা যাবে। আশা এমনিতেই চিন্তায় জর্জরিত।

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩২

এ দিনটায় আরেকটা শুভ কাজ সম্পন্ন হলো। নায়ীব সঙ্গে করে আংটি নিয়ে এসেছে। অথচ এগুলোর একাংশও সে স্রোতকে আগে জানায়নি। সোজা বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে হাজির। বিয়েতে তার এত উতলা ভাব দেখে স্রোত কুপোকাত। বসারঘরে রমরমে অবস্থা। নাবিদ সাহেব রিং বের করে দিলেন। নায়মা তখনও নির্বিকার। এই রমরমা পরিবেশেও ফুপির এমন ভাবমূর্তি ভালো লাগলোনা নিশাতের কাছে। সে কপাল কুঁচকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“ কি হয়েছে, ফুপ্পি? এরকম মুখ বানিয়ে বসে আছো কেন? ভাইয়া বিয়ে করবে,তোমারই তো সবচেয়ে বেশি খুশি হবার কথা।”
নায়মা মুখ ঝামটা মে:রে ঘুরে বসলেন। নিশাত বিরক্ত হলো। এরপর চোখ রাখলো সামনের চমৎকার সুন্দর দৃশ্যটায়।
নায়ীব, স্রোত; পাশাপাশি সোফায় বসা। নায়ীবের হাতে আংটি। চোখ-মুখ জড়তাহীন। অন্যদিকে, স্রোত তার বিপরীত। চোখ-মুখে অস্বস্তি, লজ্জার প্রগাঢ় চিহ্ন। খুশি তাতে ঢাকা পড়ে গেছে। এ মুহুর্তে সকলেই উপস্থিত বসারঘরে। নায়ীব হাত পাতাতেই সেকেন্ড খানেক সময় নিয়ে হাত বাড়াল স্রোত। একটু আগেই তো হাতের পিঠে চুমু দিয়েছিল লোকটা! লজ্জা রাঙা মুখ নিয়ে নায়ীবের দিকে চুল তুলে তাকাতেই তার ঠোঁটের কার্ণিশে দুষ্টু হাসির দেখা মিলল। ত্বরিত বেগে চোখ নামালো স্রোত। আংটিটা ওর আঙুল গলিয়ে ঢুকতেই ওর সম্পূর্ণ চিত্ত অস্বাভাবিক রকমের শান্ত হলো।
এ সুন্দর মুহুর্তটা ফটাফট ক্যাপচার করলো ইফাদ। সুহাদ ইনানের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। প্রসন্ন হাসির রেখা তার ঠোঁটেও। সাঈম সাহেব আর সাহিদ সাহেবও এক ধ্যানে চেয়ে আছেন। কেবল আশার চোখ ছলছল,টলমলে। টুপটুপ করে এক্ষুনি জল গড়ানোর মত অবস্থা।

স্রোতের মনে তখন অনুভূতিদের হর:তাল চলছে বোধহয়। অদ্ভুত ভালোলাগার মিশ্রণে সে ভাবতেই পারছেনা অন্য কিছু। যেন জাগতিক সবকিছু থেকেই সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নায়ীব হাত ছাড়লো আরেকটু পর। ইমা যখন তার মুখের সামনে মিষ্টি ধরলেন, তখন।
নায়ীব মিষ্টি খাওয়ার আগে অতি সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস! গত দুই রাত তার শান্তিতে এক প্রহর ঘুম হয়নি। কেবল ছটফট করেছে বিছানায়। চোখে বিন্দু পরিমাণ নিদ্রা ছিলনা। ছিল শুধু কিছু হারানোর ভয়। নিজের ভাগ্যর ওপর নায়ীব সন্তুষ্ট সর্বদাই। তবে সম্পূর্ণ ভরসা করতে সে পারেনা।
ও মুখ হা করে সামান্য মিষ্টি খেল। বাকি মিষ্টিটা ইমা এগিয়ে দিলেন স্রোতের দিকে। স্রোত খেল অল্প।

আশা এর ফাঁকে টেবিল ভরিয়ে ফেললেন খাবারে। আজকের দিনটা তাদের মেয়ের জীবনের অত্যন্ত স্মরণীয় দিন। আংটি পরানোর কথা কেউ-ই আন্দাজ করতে পারেননি। একদম শেষ মুহুর্তে নাবিদ সাহেব এ আর্জি করেন। স্রোত এখন একজনের বাগদত্তাও। তার শশুরবাড়ির লোকদের তো না খাইয়ে ছাড়া যায়না।
যাওয়ার আগেই তাদের জোর করে বসানো হলো টেবিলে। স্রোতকে তখন উপরে পাঠানো হয়েছে। নিপা সঙ্গে।
স্রোত উঠতে উঠতে আঙুলে চোখ বুলালো। অনামিকায় একটা দারুণ কারুকার্য খচিত স্বর্ণের আংটি। হাতের পুরো নকশাই যেন পালটে দিয়েছে। স্রোত চিনতেই পারছেনা নিজের হাত। দেখতেই আকর্ষণীয় লাগছে। ও হাত দেখতে দেখতেই একটা হোঁচট খেল। নিপা দ্রুত ওর হাত ধরে সামলালো। মৃদু হেসে বলল,
“ আপা, ঘরে গিয়ে হাত দেইখেন।”
স্রোত ত্রস্ত পায়ে রুমে ছুটল। এরপর বসলো বিছানায়। নিপা জিজ্ঞেস করল,
“ কিছু খাবেন, আপা? নিয়ে আসি? সকাল থেকে তো খান নাই।”
“ শরবত আন।”
নিপা চলে গেল নিচে। এই ফাঁকে হন্যে হয়ে ফোন খুঁজলো স্রোত। কোথায় যে রেগে ছুঁড়ে মে-রেছিলো নিচে যাওয়ার আগে! এক সময় সেটা পেয়ে ও ম্যাসেজ বক্সে ঢুকলো। এরপর ফটাফট টাইপ করল,
“ সন্ধ্যার আগেই কি চলে যাবেন?”

নায়ীব খুব অল্প খায়। সেই জায়গায় ইমা, আশা মিলে প্লেট ভরিয়ে ফেলেছেন হরেক রকম তরকারিতে। জামাই হওয়ার আগেই এমন সমাদর দেখে নায়ীবের নিজের কাছেই অসহায় লাগলো। যতবার শশুরবাড়ি আসবে, ততবারই তো এরকম করা হবে। তবে ও খাবার নষ্ট করলনা। একে একে শেষ করল সবই। তন্মধ্যে ফোনটা পকেটে একবার ভাইব্রেট করে উঠল। চট করে সেটা বের করল নায়ীব। না! অফিসিয়াল কিছুনা! বরং ভীষণ পার্সোনাল ম্যাসেজ। ব্যক্তিগত মানুষের ম্যাসেজ! নায়ীবের ভ্রুদ্বয়ের মধ্যে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পড়ল। মাথা নুইয়ে সে ম্যাসেজ চ্যাক করল। চক্ষু শিথিল হলো পরপরই। আনাড়ি বাম হাতে, অনেক্ষণ সময় নিয়ে টাইপ করল,
“ আপনি বললে থাকতেও পারি।”
এরপর ম্যাসেজ সেন্ড করল। পাশের চেয়ারে বসা নিশাত হঠাৎ উঁকি দিতেই ও চটপটে হাতে ফোন পকেটে পুড়লো। নিশাত দাঁত কেলিয়ে হেসে ফিসফিস করে বলল,
“ সমস্যা হলে বলো, আমি টাইপ করে দেই।”
নায়ীব চোখ বড় বড় করে তাকালো। শা-সালো চোখের দৃষ্টিতেই। তন্মধ্যে ইমা বেশ জোরে বললেন,
“ খাচ্ছোনা কেন, বাবা?”
নায়ীব হকচকালো। অল্প হেসে বলল,
“ খাচ্ছি।”

..

সন্ধ্যার সাঁঝ গ্রাম-বাংলায় একটু অন্যরকম সুন্দর। তবে জয়পুর গ্রাম-শহরের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। মিশ্র এক দৃশ্যের দেখা মিলে এখানে। মেইন রোড কাছেই। অহরহ গাড়ি চলাচল করে। গাড়ির শব্দের সাথে শেয়ালের ডাক মিশে যায়।
নায়ীবরা বেরোলো। তাদের সঙ্গে বেরোলো সবাই-ই। তবে দোতলার ওই কার্ণিশের রুমটায় বসে রইল একজন। সে পারছেনা ছুটে নিচে নামতে। দেখতেও পারছেনা। ও বিছানায় বসে ছিল। চোখ-মুখে কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব। গায়ের শাড়িটা সে খুলে ফেলেছে একটু আগে। পরণে নরমাল জামা-কাপড়। নিচে যাওয়ার জন্য কেউ ডাকেনি ওকে। ওর ভাবনায় মধ্যেই দরজার টোকা দিলো কেউ। স্রোত চোখ তুলে তাকাতেই নিশাত মিষ্টি হাসলো। বলল,
“ আসবো? ভা বী?” ভাবী ডাকটা সে টেনে টেনে ডাকলো। স্রোতের কানে বাজলো খুব। মাথা উপর নিচ ঝাঁকিয়ে বলল,
“ আসো।”
“ চলে যাচ্ছি। তুমিও চলে এসো খুব জলদি।” নিশাত এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। বিদায় নিয়ে ফের বলল,
“ আমাদের বাসায় কোনদিন যে আসবে তুমি!”
স্রোত হতবুদ্ধি হলো। ভাইয়ের চেয়েও বোন বেশি ডেস্পারেট! ও ফিক করে হেসে ওকে বিদায় দিলো।

..

রাত তখন নয়টার কাছাকাছি। খাবার টেবিলে সবাই বসা; স্রোত বাদে। ও নামতে চাইছিলোনা। জোর গলায় বারবার নিপাকে বলছিল, ওর ক্ষিদে নেই। শেষে আশা এলেন। খুবই গম্ভীর গলায় খেতে ডাকলেন। সে ডাক শুনেই গায়ে গরম কাপড় চাপিয়ে সুরসুর পায়ে খেতে চলে এলো স্রোত। চেয়ারে বসলো গুটিসুটি হয়ে। ইমা ওর প্লেটে বড় মাছের পিস তুলে দিতেই ও বলল,
“ এটায় কাঁটা বেশি, খেতে পারবনা।”

“ বেছে খেতে শিখো। ছোটমা তো তোমার সঙ্গে থাকবেনা সবসময়।” আশার অত্যন্ত ঠান্ডা স্বর শুনে প্রত্যেকেই একবার চোখ তুলে তাকালো। পরপরই আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। তবে আশার কথা মনে দাগ কাটলো স্রোতের। সে মাছের পিসটা তুলে রাখতেই যাচ্ছিল,আশার কথা শুনে আর রাখলোনা। সত্যিই তো! ওখানে কি ওকে মাছ বেছে দিবে কেউ? ওখানের কেউই তো জানেনা, কাঁটাযুক্ত মাছ খেতে ও পছন্দ করেনা। ও তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কাঁটা বাছায় মন দিল। ইমা ব্যথিত নজরে তাকালেন আশার দিকে। আশা চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললেন উনাকে।
খাওয়া শেষে যে যার মত নিজ নিজ রুমে চলে এল। স্রোত উঠলো সবার শেষে। মাছ বাছার জন্য তার ভাতই ঠান্ডা হয়ে গেছিল। তবে ও ব্যর্থ হয়নি। দু’একটা গুতা খেয়েও সফল হয়েছে। ও উঠে হাত না ধুঁয়েই উপরে উঠে গেল।

সব গোছগাছ করে আশা এরপর গেলেন ওর কাছে। রুমটায় কৃত্রিম আলো নেই। জানলা গলিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে। সেই সঙ্গে শীতল বাতাসও হুরমুড় করে প্রবেশ করছে। ঘরটা অত্যাধিক শীতল হয়ে আছে তাই। আশা লাইট অন করলেন। চটজলদি জানলাও বন্ধ করলেন। এরপর বিছানার কার্ণিশে বসলেন। স্রোত উঠে বসেছে ততক্ষণে। আশা মুখ খুললেন,
“ সর্দি এমনিতেই পিছু ছাড়ছেনা। আরো অসুখ বাঁধাবি?”
একটু থেমে আবার বললেন, “খামখেয়ালিপনা এখন ছাড়তে হবে। নিজের ভালোটা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে।”
স্রোত বিপরীতে চুপ রইল। হঠাৎই আশার কোলে মাথা রাখল। কোলে মুখ লুকিয়ে ফেলল এরপর। আশার হাত তখন মেয়ের মাথায়। ধরা গলায় তিনি বলা শুরু করলেন,
“ নতুন জায়গায় তোমার মানাতে কষ্ট হলেও থাকতে হবে। নিজের ভালো-মন্দ তোমাকেই দেখতে হবে সবার আগে। সবার দিকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি নিজেরটারও খেয়াল রাখতে হবে। তুমি এসবে খুব উদাসীন। সুধরে নাও।”

“ তোর বাবা কেমন সেটা আমার চেয়ে তোরাই বেশি জানিস। সেই মানুষটা একদিনের দেখায় বিয়েতে মত দিয়েছে। কারণ পছন্দটা তাঁর মেয়ে নিজে করেছে। এত মানুষদের মধ্যে ওই একজনকে বেছে নেয়ার পেছনে নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, এটা তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। এক দেখায় যতটুকু মনে ধরা সম্ভব, ততটুকু থেকেই বলছি ছেলেটা ভালো। আল্লাহ আমার মেয়েকে হাত ভরে সুখ দিক, আমিন।”

স্রোত আরেকটু মুখ গুঁজলো। ফুঁপিয়ে উঠার আগ-মুহুর্তে বিড়বিড় করে বলল,
“ নায়ীব সত্যিই অনেক ভালো।”
আশা কান খাড়া করে শুনলেন। মেয়ে মানুষ চিনতে ভুল না করলেই হয়! সম্পূর্ণ জীবন একসঙ্গে পার করে দেয়ার জন্য মনের মিলন আর একে অপরের প্রতি এমন আত্মবিশ্বাসই যথেষ্ট।

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩৩

বাসায় এসে যে যার মত ফ্রেশ হতে চলে গেল সবাই। নায়মা ঢুকলেন গেস্ট রুমটায়। কথা ছিল, পাত্রীর বাড়ি থেকে এসেই নিজ বাসায় চলে যাবেন। কিন্তু নাবিদ সাহেব বাঁধ সাধলেন। বাইরে ঘোর তমসা। বোনকে তো একা ছাড়া যায়না। তার ওপর তাদের কারোরই বিন্দুমাত্র এনার্জি নেই যে মাত্র ত্রিশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করবেন আবার। উনি নিজেও অবসন্ন। নায়ীবও তা-ই। ছেলেটা থানায় গেছিলো খুব সকালে। জরুরী কাজ সেড়ে জলদি এসে আবার রেডি হয়েছে। মিষ্টি-টিষ্টি কিনেছে সে-ই। আংটিটা অবশ্য দু’একদিন আগে কিনেছে।

নায়মা সোফায় বসলেন। ভ্রু কপালে তোলা। মনোযোগ টিভিতে। চোখ-মুখেও বিরক্তি-ক্লান্তির মিশ্রণ। নাবিদ সাহেব বেরোলেন রুম থেকে। নায়মাকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন বসার ঘরে। ড্রয়িং-ডাইনিং এর স্পেসটা অনেক লম্বা। তবে একসঙ্গেই লাগানো। মাঝখানে কেমন পাতলা সাদা পর্দা টানানো। নাবিদ সাহেব সোফায় এসে বসলেন। নায়মার মন-মেজাজ ঠিক লাগছেনা, সেই সকাল থেকেই। উনি এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ কি হয়েছে? সকাল থেকে মুখ এমন কালো বানিয়ে রেখেছিস কেন?”
“ কিছুনা। মেয়ে তো তোমরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলে। তাহলে আমাকে শুধু শুধু কসরত করালে কেনো,বাপু!”
কিঞ্চিৎ বিরক্তি এবং ক্রোধের রেশ বোঝা গেল কণ্ঠে। নাবিদ সাহেব ধরতে পারলেন না তার কথার মনে। তন্ময় হয়ে জানতে চাইলেন,
“ মানে?”
“ তুমি জানো আমি কত মেয়ে খুঁজেছি? বেস্ট একজনকে তোমার ছেলের সঙ্গে দেখা করাতে পাঠিয়েছিলাম। তোমার ছেলে দেখাই করলোনা। নামও শুনলোনা, কথা তো দূর। মুখের ওপর মানা করায় মেয়েটার মা আমাকে যাচ্ছে-তাই শুনিয়েছে! আমি কি জানতাম নাকি তোমার ছেলে মেয়ে ঠিক করে বসে আছে? জানলে তো আমি কথা শোনা থেকে বেঁচে যেতাম।”
নাবিদ সাহেব কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে মুখ খুলতেই যাচ্ছিলেন, সেই ক্ষণে নায়ীব বেরোলো। দানবের মত লম্বা লম্বা পা ফেলে এলো ড্রয়িং রুমে। চোখ-জোড়া অতিমাত্রায় শান্ত। নাবিদ সাহেব পরিস্থিতি বুঝলেন। নায়মাকে বুঝাতে চাইলেন,
“ স্রোতের ব্যাপারটা হুট করে জানিয়েছে ও। জেনে বুঝে তোকে সমস্যায় তো আমার ছেলে ফেলতে চায়নি।”
“ হয়েছে, বলতে হবেনা কিছু। আমি কাল সকালেই চলে যাব। আর শুধু বিয়ের দিন আসবো। বিয়েতে যাবনা কিন্তু এখানে আসবো।”
নায়ীব বিরস মুখে তাকালো। কিছু কথা বলতে চেয়েও গলা অব্দি আটকে রাখতে হলো। নাবিদ সাহেব তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললেন।

তন্মধ্যে নিশাত বের হলো ফ্রেশ হয়ে। তার উৎফুল্ল চেহারা দেখে এ ব্যাপারে আর কেউ কিছু ঘাটলোনা বেশি। নিশাত ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে বলল,
“ আমি আসছি, আব্বু।”
“ কোথায় যাচ্ছিস?”
“ জোহাদের কাছে। চলে আসবো।”
জবাব দিয়েই একপ্রকার ছুটে গেল নিশাত।

জোহা তখন ঘুমাচ্ছিলো। দরজা খুললেন ওর মা। নিশাত বিস্তর হেসে বলল,
“ মিষ্টি খান, আন্টি।”
ভদ্রমহিলা হকচকালেন বেশ। দরজার সামনেই মিষ্টি খাবেন নাকি? উনি সরে দাঁড়ালেন। বললেন,
“ ভেতরে আসো। কিসের মিষ্টি?”
“ আমার ভাইয়ার বিয়ের।”
“ সেকি! ওর বিয়ে হয়ে গেছে?” জোহার মা তাজ্জব বনে গেলেন। নিশাত তড়িঘড়ি করে সুধরে দিল,
“ হয়নি, আন্টি। হয়ে যাবে। জোহা কোথায়?”
“ ও তো ঘুমাচ্ছে। ওর সঙ্গে কোনো দরকার আছে?”
নিশাত উপর নিচ মাথা ঝাঁকাতেই জোহার মা জোহার রুমে গেলে। পাক্কা তিন মিনিট লাগিয়ে মেয়েটাকে গাঢ় ঘুম থেকে টেনে তুললেন। জোহার মা আবার ওকে রেখে বেরোলেন। নিশাতকে বললেন,
“ ও উঠেছে, যাও।”
নিশাত মিষ্টির বাক্স রেখে ধীর কদমে এগোলো। তাকে দেখে বিছানায় বসে থাকা জোহা অবাক হলো। চোখ কচলে বলল,
“ তুমি?“
“ জোহা, একটা হ্যাপি নিউজ শুনবে?”
“ শোনান, আপু। অনেকদিন ধরে হ্যাপি কিছু শুনিনা। স্যাড লাইফ।”
“ ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে আজ।”

এক মিলিসেকেন্ড গড়ালো বোধহয়। এরপরই জোহা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিছানার ওপর। মাথায় দুই হাত চেপে খেঁকিয়ে উঠল,
“ আল্লাহ! এটা হ্যাপি নিউজ? স্রোত আপুর কি হবে? আপুর সামনে আমি মুখ দেখাবো কি করে? না জানি কি অবস্থা হবে আপুর এসব শুনে! আপনারা তো আপুকে ঠকিয়েছেন! কেউ কাউকে ঠকিয়ে জীবনে কখনো সুখি হতে পারেনা,কক্ষনো না!”
ওর চিৎকার বোধহয় পুরো বিল্ডিংই শুনতে পেত। ভাগ্যিস জানলা বন্ধ আর দরজাটাও চাপিয়ে ঢুকেছিল নিশাত! নিশাত কানে হাত চেপে ধরল। চোখ-মুখ ভয়া-নক কুঁচকে গেল ওর বিরক্তিতে।
লহু গলায় বলল,
“ব্রেইনটাকে একটু খাটাও না কেন,জোহা! আল্লাহ তো ব্রেইন এমনি এমনি দেননি!”

জোহা অপমানিত বোধ করলো। আবার হাঁক ছাড়ল,
“ কি বলছেন?”
“ বসো, জোহা। লাফিয়ো না। পুরো খবর তো শুনবে? তার আগেই আমার ভাইকে ঠকবাজ বানিয়ে দিলে!”
জোহা ধপ করে বসলো। নিশাত বলল,
“ তোমার স্রোত আপুর সঙ্গেই বিয়ে ঠিক। স্রোত আপুকেই বিয়ে করবে ভাইয়া। আর কাউকে না।”
“ আল্লাহ! এটা আগে বললেন না কেন? আমি শুধু শুধু প্যানিকড হলাম। আমার হার্ট লাফাচ্ছে এখনও।”
“ তোমার চিৎকারে আমি হার্ট ফেল করতাম জোহা! তুমি তো শুধু প্যানিকড হয়েছ!”

..

নায়ীবের চোখে ঘুম নেই। একদিকে কিছু পাওয়ার সুপ্ত অভিলাষ, অন্যদিকে কেমন একটা বিপদের আভাস। তার জীবনটা কেমন অনিশ্চয়তার দিকে এগুচ্ছে প্রতিনিয়ত। সে ঢের বুঝতে পারছে, পালানোর কিংবা পেছানোর পথ আর খোলা নেই। এতটা দিন পর কথা ছিল, একটু প্রশান্তির নিদ্রায় ডুব দিবে। পুরো প্রশান্তি অবশ্য সেদিনই মিলবে, যেদিন প্রেয়শীকে বুকে জড়িয়ে সুখনিদ্রায় পাড়ি জমাবে। তবে আপাতত পাঁচ-ছয় ঘন্টার গাঢ় ঘুমের প্রয়োজন ওর। চোখ-মুখে এখন ক্লান্তির ছাপ অল্পতেই ভেসে উঠে। মাথা অসহ্য ব্যথায় তিরতির করে উঠে। সকালে সে একটা কেস ফাইল করেছে। নায়ীবের বুঝে আসেনা, রাজীবের কেস কেন ঘুরে ফিরে ওর কাছেই আসে! তবে আজকের এক্সি-ডেন্টের কেস সে ফিরাতে পারেনি। এক্সি-ডেন্টটা হয়েছে রাজীবের ভাতিজার সঙ্গে এক ছয় বছরের ছোট বাচ্চার। বাচ্চাটার বাঁচার সম্ভবনা শূন্যের কোঠায়। তার বাবাও বেশ নামকরা ডাক্তার। ছেলের এ দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা মানলেও কেস তিনি ফাইল করেছেন। রাজীব সাহেবের ভাতিজার বিরুদ্ধে তাই কেস দায়ের করতেই হয়েছে। কিন্তু আসা-মী আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে।
নায়ীব এবার যতটুকু সম্ভব, চেষ্টা করবে অপরা-ধীকে শাস্তি দেয়ানোর। বাকিটা উপরওয়ালার ওপর। তবে ওর মন বলছে,এ কেসও বেশিদূর আগাবে না। ডাক্তার হয়তো দু’দিনের ভেতর নিজেই কেস তুলে নিবেন। নাহয় রাজীবের ম্যানেজার হাজির হবে।

..
স্রোত মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত তখন গভীর। স্ত্রীকে রুমে আসতে না দেখে বিছানা থেকে নেমে জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে নিঃশব্দে হাঁটা ধরলেন সাঈম সাহেব। দু’তলার শেষের রুমটায় এসে থামলেন। বাকি রুমগুলোর দরজা আটকানো। সবাই গভীর ঘুমে। উনি ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা আলতো হাতে ঠেললেন। অল্প শব্দ হলো। পরপরই সেই শব্দ চাপা পড়ল সাঈম সাহেব রাশভারি স্বরের কারণে।
“ আশা?”
“ ভেতরে আসুন..”
রিনরিনে স্বরটা বাতাসের মত ধাক্কা খেল সাঈম সাহেবের কর্ণকুহরে। ধীর,শব্দহীন পায়ে তিনি ভেতরে ঢুকলেন। লাইট জ্বালানো। স্রোত মায়ের কোলে ঘুমিয়ে, মুখের ওপর শাড়ির আঁচল রাখা বলে উজ্জ্বল আলোর ঝলকও তার ঘুমকে বিরক্ত করতে পারছেনা। পা তুলে বসা আশা। স্রোতের গায়ে চড়ানো কম্বলের একাংশ তার পায়ের ওপরও। তবে উপরের অংশে কেবল একটা পাতলা শাড়ি। জানলা বন্ধ হলেও একটা ঠান্ডা ভাব বিদ্যমান রুমটায়। সাঈম রহমান মেয়ের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। পরপরই গায়ে শালটার প্যাঁচ খুললেন ত্বরিত বেগে। তার শক্ত হাত দু’টো এগিয়ে গিয়ে আশার শরীরে শালটা প্যাঁচিয়ে দিল। আশা হকচকালেন। নিচু অথচ উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,
“ আরে! একি করলেন! আপনার ঠান্ডা লাগবে তো!”
“ আর তোমার ঠান্ডা লাগবেনা, আশা?” সাঈম সাহেবের শান্ত গলা।

“ না, লাগবেনা। আমার পায়ের ওপর কম্বল আছে। আপনার গায়ে পাতলা ফতুয়া শুধু।”
ভ্রু কিঞ্চিৎ বেঁকে গেল আশার। হাত বাড়িয়ে শালটা শরীর থেকে সরাতেই যাচ্ছিলেন, ওমনি সাঈম সাহেবের হাত আটকে দিল তাকে। সাঈম সাহেব আরো ভালো ভাবে শালখানা তার শরীরে প্যাঁচিয়ে দিলেন। চিবুক ধরে মুখ উঁচিয়ে বললেন,
“ শুধু পায়ে ঠান্ডা থাকেনা, আশা। ঠান্ডায় তোমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। রুগ্ন লাগছে। আমি চিনতে পারছিনা। আমার সুন্দর আশাকে খুঁজে পাচ্ছিনা এ চেহারায়।”

চলবে.