গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
576

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩৬

টেনশনে মাথা ধরা স্রোতকে আরেকটু টেনশন দিতে নায়ীব রাশভারি গলায় বলল,
“ স্রোত!”
“ ভাইয়া..হ্যালো! ক..কে?”
মেয়েটা হকচকালো। সুহাদের কণ্ঠ তো নয়। তবে সেকেন্ড খানেক গড়াতেই মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করল। বলল,
“ আপনি?”
“ এতক্ষণ লাগে গলা চিনতে?” গম্ভীর গলা নায়ীবের।
স্রোত লম্বা দম টেনে বলে,
“ আমি জানতাম বুঝি ভাইয়ার বদলে আপনি ওপাশে আছেন?”

নায়ীব ততক্ষণে সরে গেছে বাকিদের থেকে। গম্ভীরতা বজায় রাখল সে। ঘন-ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে স্রোত বলে,
“ কি হয়েছে? সব ঠিক-ঠাক? আব্বু,আম্মু কই?”
“ আছেন।”
“ আপনার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? কিছু কি হয়েছে?”
“ হয়নি। হবেন। আমার বউ হবেন আপনি। তৈরি থাকুন।”

..

দিন ক্রমশ পেরোচ্ছে। সময় তো আর থেমে থাকেনা। ঘোরের মধ্যেই বিগত ক’টা দিন কাটলো স্রোতের। চোখের পলকেই কেমন দিন চলে যাচ্ছে। আজ নাকি তাদের শপিং এ যেতে হবে। কার্ড-টার্ড ছাপানোর কাজও আছে। সবাই আসবে আজ। কদিন পর হোস্টেল ছেড়ে দিবে ও। বদ্ধ এই রুমটা ছিল স্রোতের আলাদা এক জগত। খুব একটা স্মৃতি যদিও বা নেই। তবে নিজের ঘরের পর এখানটায় ঢুকলেই স্বস্তি মিলতো তার। এখন এটা ছাড়তে হবে, দুদিন পর নিজের ঘর ছাড়তে হবে;ভাবতেই দুঃখ লাগে ওর। এই দুঃখের বহিঃপ্রকাশ করাও সম্ভব না। যার সঙ্গে বলবে, সে যে ভয়াবহ রেগে যাবে।

স্রোত আস্তে-ধীরে সব গোছানো শুরু করল। সামনের সপ্তাহে হোস্টেল ছেড়ে দিবে। সব বলাই আছে। বিয়ে-টিয়ের দাওয়াতও হোস্টেল মালিককে সে দিয়েছে। কি এক লজ্জার বিষয়। যেচে বলতে হচ্ছে,“ আমার বিয়ে..”
জোহার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে এর আগে। জোহার কথা স্রোত ফেলেনি। বিয়ের দাওয়াতটা সে জোহাকেই প্রথমে দিয়েছে। তবে আকারে-ইঙ্গিতে। সরাসরি বলতে হাঁসফাঁস করছিল স্রোত। কোনোমতে বুঝিয়ে কল রেখে দিয়েছে। কার্ড ছাপানোর পর সর্বপ্রথম তাদেরই দিয়ে আসবে নাহয়।

শুভ্রারও যাওয়ার কথা আজ। সে যেতে রাজি হচ্ছিলোনা। তবে স্রোতের জেদের কারণে রাজি হয়েছে। বিকাল তিনটায় বেরোনোর কথা। স্রোত শুভ্রাকে নিয়েই চলে যাবে। বাকিরা মলের সামনে অপেক্ষা করবেন।

যথারীতি ওরা পৌঁছালো সাড়ে তিনটার দিকে। মলের সামনে ওরা দাঁড়িয়ে। সাঈম সাহেব এবং সাহিদ সাহেব; দুইভাই আসেননি।
সুহাদ পার্কিং প্লেসে। ইফাদ এগিয়ে এল। সবাই জড়ো হয়ে ঢুকলো মলের ভেতর। বিশাল মলের সেকেন্ড ফ্লোরে ব্রাইডাল শপগুলো। গুনে-গুনে সাতটা দোকান ঘুরে ওরা থামলো।

স্রোত ক্লান্ত হয়ে বসলো একটা চেয়ারে। এত এত কাপড়চোপড় কেনা হয়েছে! বিয়ের শাড়িটা বাকি এখনও। শুভ্রা বিরক্ত হল। সেও বসে বলল,
“ এত ভেজালের কাজ এই বিয়ের শপিং! একারণেই বিয়ের শখ মিটে যায়।”

“ এভাবে বলে বান্ধবীকে নিরুৎসাহিত করোনা,শুভ্রা।” চাপা স্বরের কথা শুনে শুভ্রা তড়াক করে মোড়ল। সঙ্গে স্রোতও। দুজনের চেহারায়ই চমকিত ভাব।

নায়ীব এগিয়ে গিয়ে আশা,ইমাকে সালাম করল। সেই সঙ্গে তিন সম্বন্ধি-শালার সঙ্গে কোলাকুলি করল। এরপর এলো পূর্বের স্থানে। শুভ্রা ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“ তর সইছেনা নাকি? বিয়ের আগেই পিছু পিছু ঘুরছেন, বিয়ের পর পল্টি খেলে কিন্তু খবর আছে।”
নায়ীব এ কথার পিঠে কেবল মুচকি হাসল। সে একা আসেনি, সঙ্গে নিশাত,নায়মা। স্রোত ঘাড় ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসা। কান দু’টো লজ্জায় গরম হচ্ছে অকারণেই। মানুষটার উপস্থিতিই এখন তাকে লজ্জা দিতে। স্রোতের অন্যপাশের চেয়ারটা থেকে ইনান আলগোছ উঠে গেল। নায়ীবকে বলল,
“ বসুন, দুলাভাই। পায়ে ব্যথা করবে।”

নায়ীব বসলো সময় নিয়ে।
নায়মা গেলেন আশাদের কাছটায়। রাগ-অভিমান পুষে লাভ নেই। বিয়েটা তো শেষমেশ করছে, নায়ীব। সেই ঢের। চমৎকারভাবেই কুশল বিনিময় করে বসলেন তিনি। ইমা ভ্রান্ত ধারণা ভাঙ্গল তাতে।
নিশাত শুভ্রার পাশটায় বসে গালে হাত দিল। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,
“ কি সুন্দর শাড়িগুলো!”
শুভ্রা ঘাড় ঘুরালো। দুষ্টুমি করে বলল,
“ শাড়ি দেখে বিয়ের শখ জাগছে?”
“ ধ্যাৎ! কি যে বলেন আপু!” নিশাত লজ্জা পেল বেশ। তবে মনে মনে অস্বীকার করতে পারলনা কথাটা। শাড়িগুলো গায়ে জড়িয়ে পুতুলের মতন সাজার তীব্র ইচ্ছা সব মেয়ের মত তারও আছে। তাকে কেমন দেখাবে লাল টুকটুকে শাড়িতে, সে দেখতে চায়।

সকলে তখন কাপড় দেখতে ব্যস্ত। নায়ীব ঝুঁকে বসল। ঘাড় হালকা কাত করল। স্রোত ঠোঁট চেপে শক্ত হয়ে বসা। তার এ ভাবমূর্তি পছন্দ হলোনা নায়ীবের। ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হলো মুহুর্তেই। ফিসফিস করল,
“ শাড়ি পছন্দ হচ্ছেনা?”
“ না।”
নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। ইনান দূর থেকে কোমরে হাত রেখে বলে,
“ শেষ না তোমাদের? তোমাদের শেষ হলে তো আমরা পাঞ্জাবি কিনব। দুলাভাইর শেরওয়ানি পছন্দ করাও বাকি।”
ইমা বিরক্ত হয়ে বললেন,
“ তোরা যা না। আমাদের সময় লাগবে।”
“ এই নিয়ে সাত দোকান, আম্মু। আর কত?”
ইমা ভয়ানক রেগে তাকাতেই দমে গেল ইনান। ইফাদ,সুহাদ দুজনেই তাকে আটকালো। বলল,
“ মহিলা মানুষ, জানিসই তো। আমরা যাই জেন্টস সেকশনে চল।”

“ নায়ীব, চলো।” সুহাদ ডাকে। নায়ীব তাকিয়ে বলে,
“ আসছি,ভাইয়া। আপনারা যান। পাঁচ মিনিট।”

ওরা তিনভাই গেল ধীরে-সুস্থে। তন্মধ্যে আরো শাড়ি বের করলেন দোকানদার। নায়ীবের চোখ আটকালো গাঢ় লাল-খয়েরীর মিশ্রণের একটা বেনারসিতে। খয়েরীও না, লালও না। চমৎকার, আকর্ষণীয় একটা রঙ। পাড়ে চকচকে সোনালী রঙের দারুণ কারুকাজ।
সে চট করে শাড়িটা হাতে তুলে। সবার অগোচরে স্রোতের কাঁধে রেখে হাত সরাল। মাথা পেছনে নিয়ে পরখ করে ভালোভাবে। অনেক্ষণ পর লহু স্বরে বলে,
“ এটা সুন্দর,স্রোত। এত সুন্দর লাগছে, আপনাকে! আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। ”
অল্প গলার স্বর। স্রোত বাদে কেউ শুনতে পেলনা। চুপচাপ বসে থাকা স্রোত এবার নড়েচড়ে বসলো। নায়ীব যাওয়ার আগে ফের বলল,
“ আমার চোখে আর কিছুই ধরছেনা। আপনি দেখুন, আমি আসছি।”

স্রোত শাড়িটা কাঁধের ওপরই চেপে রাখল। আশাকে ডেকে বলল,
“ আম্মু, কেমন এটা?”
আশা মুগ্ধ হয়ে তাকালেন। ইমা ফটাফট বললেন,
“ মাশা-আল্লাহ, আম্মা! পরীর বাচ্চা লাগছে।”
“ তুই কার প্রশংসা করছিস, ইমা?” আশার প্রশ্ন শুনে নিশাত শব্দ করে হেসে ফেলল। সঙ্গে বাকিরাও।
শেষমেশ এ শাড়িটাই নেয়া হলো।

..

শপিং-টপিং শেষ করে ওরা বেরোলো। কার্ড ছাপানোর অর্ডার এক ফাঁকে দিয়ে এসেছে সুহাদ। তন্মধ্যে হঠাৎ রোজের কল এল। মেয়েটাকে সঙ্গে আনার কথা ছিল। তবে তার নাকি কিসব কাজ-টাজ আছে। সুহাদ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করে। রোজ উৎফুল্ল স্বরে শুধায়,
“ কোথায় এখন?”
“ মল থেকে বেরিয়েছি। আপাতত পার্কিং স্পেসে আছি।”
“ ব্যস্ত?”
“ উহুম,বাকিরা ব্যস্ত বর-কনেকে নিয়ে। আমি ফ্রি।”
“ কি কিনলেন মশাই?”
“ একটা শাড়ি কিনেছি, রোজ। কালো রঙ না তোমার পছন্দের?”
ওপরপ্রান্তের রোজ বিষম খেল। কথায় কথায় একদিন বলেছিল তার কালো রঙের প্রতি একটা ফ্যাসিনেশন আছে। সেটাও মনে রেখেছে এই লোক? রোজ পুরু গলায় বলল,
“ পছন্দ তো। কিন্তু নিজের জন্য কি কিনলে,সেটা জানতে চেয়েছি।”
“ একটা পাঞ্জাবি কিনেছি। আমার শেরওয়ানি কিনার অপেক্ষা কবে যে শেষ হবে, কে জানে।” সুহাদের গলায় ক্ষীণ আক্ষেপ। রোজ লজ্জায় মিইয়ে গেল তা শুনে। তড়িঘড়ি করে বলল,
“ ধ্যাৎ! রাখছি, বাড়ি গিয়ে কল দিও।”

..

দু’দিন পরের কথা। নিশাতের হাতে বিয়ের কার্ড। ও বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছে কয়েকখানা কার্ড। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। বর-কনের নাম সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। ঠিকানাও দেয়া। তার দাওয়াত দেয়ার কেউ নেই। মিষ্টি ওতদূর যাবেনা। রিসিপশনে আসবে। আর কে-ই বা আছে। তাদের চাচা ইউকের বাসিন্দা। ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেখানেই থাকেন। বিয়েতেও বোধহয় আসতে পারবেন না। মামার বাড়ির আওলাদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা আছে বেশ। তবে তারা আসবেন বিয়ের একদিন আগে। ওতদূরেও তারা থাকেন না। নিশাত তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। কি ভেবে কার্ডটা ব্যাগে ঢুকায়। এরপর বেরিয়ে পড়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

ওয়াহিদ রোজ ক্লাস করতে আসতোনা। এখনও আসেনা। তবে সপ্তাহের কয়েকটা বিশেষ দিনে আসে। ওয়াহিদ হাই তুলে। খুব সকালে ঘুম বিসর্জন দিয়ে উঠা তার স্বভাববিরোধি। তবে সকাল-সকাল ভার্সিটিতে হাজির হলে যদি একখানা মিষ্টি মুখ পরখ করা যায়,তাতে ক্ষতি কি?

নিশাত তখন রিকশা থেকে নামছে। গায়ে সাদা-মাটা একটা ঢিলেঢালা কামিজ। গলায় ওড়না, গায়ে শাল। দারুণ শীতে তার মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। গুটিয়ে আছে কেমন। মেয়েটা বরাবরই গুটিয়ে থাকে, ওয়াহিদের থেকে। ওয়াহিদ দেখেও না দেখার ভাণ করে। নিশাত একপল তাকে দেখে চোখ ফেরায়। গেট পেরিয়ে যায়। তক্ষুনি ওয়াহিদ ওদিকে নজর ফেলে। সরু চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখে, মেয়েটা ফিরে আসছে। এদিকেই আসছে,তার কাছে। খুব কাছে।
মেয়েটা একদম সামনা-সামনি এসে থামলো। চোখ-মুখে ইতস্তত ভাবটা জহুরি চোখে তাকিয়ে থাকা ওয়াহিদের নজর এড়ালোনা। অথচ সে আগের মতই ভাবলেশহীন বসা। কোনো নড়চড় নেই। নিশাত শালের নিচ থেকে হাত বের করল। একটা ঝকঝকে, নেভি ব্লু কার্ড এগিয়ে দিল। ওয়াহিদ অতি আগ্রহ দেখালনা। স্বাভাবিক গলায় বলল,
“ কি এটা?”
“ কার্ড..বিয়ের কার্ড।”
“ কার? তোমার? বাল্যবিবাহ দিচ্ছে নাকি তোমার পরিবার?”
ওয়াহিদের কণ্ঠে কৌতুক নেই। অথচ সে কৌতুকই করছে। এই মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে সে পাত্রের নাক-মুখ ভেঙে দিয়ে আসবে, তাতে সন্দেহ নেই।
নিশাত হকচকালো না। তবে ক্ষীণ বিচলিত আওয়াজে বলল,
“ জ্বি? আমি এইটিন প্লাস। বিয়ে দিলেও বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য হবেনা। এটা আমার ভাইয়া আর স্রোত আপুর বিয়ের কার্ড।”
“ ওহ, তা আমাকে দিচ্ছো কেন? আমি বিয়েতে গেলে দেখা যাবে, ওই মহিলা বিয়ের আসর থেকেই উঠে যাবে।”
এবার হকচকালো নিশাত। বলল,
“ কোন মহিলা?”
“ আরে, তোমার ভাবী।”
“ আশ্চর্য!আপনি আমার ভাবীকে মহিলা বলছেন কেন?”
“ তো সে কি পুরুষ? পুরুষ বলব? ”
নিশাত রেগে গেল অকস্মাৎ। ভাবীর ব্যাপারে এসব আলাপ সে মোটেও বরদাস্ত করবেনা। সে ভয়ানক রেগে বলল,
“ আশ্চর্য তো! পুরুষ কেন বলবেন?”

ওয়াহিদ সোজা হয়ে দাঁড়াল এবার। এইটুকুন মেয়ে, রেগে ফায়ার হচ্ছে। তার ওপর চেঁচাচ্ছে। দারুণ সাংঘা-তিক ব্যাপার-স্যাপার! মেয়েটাকে সরল-সোজা ভেবেছিল, এ তো স্রোতের আরেক কপি। যে স্রোতের ব্যাপারে ভালো-মন্দ কিছু শুনলেই ছ্যাঁত করে উঠে। ওয়াহিদ বিরাট গম্ভীর গলায় শুধাল,
“ তুমি শুধু শুধু ঝগড়া করছো।”
“ আমি কোথায় ঝগড়া করলাম?” অবিলম্বে নিশাতের নাকমুখ কুঁচকে গেল।

“ এখন করছো। রাগলে তোমাকে সুন্দর দেখায়। খবরদার, আর রাগবেনা। নিষিদ্ধ অনুভূতি বেড়ে গেলে তখন তুমিই বিপদে পড়বে,মেয়ে।”

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩৭

ওয়াহিদ কার্ডটা পরখ করে আবার ফিরিয়ে দিল। তার পকেট এত বড় নয় যে কার্ডটা জায়গা হবে। নিশাতকে ফিরিয়ে দিয়ে সে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ক্লাসে। আজ তার ক্লাস করতে যদিও মন চাইছেনা। তবে না করেও উপায় নেই। ক্যাম্পাসে বেকার বসে থাকলে সমস্যা আছে। নিশাত সামনে পড়লেই তার মন আকুবাকু করবে। এর চেয়ে বাংলা শিখা ভালো।

শুভ্রা একা বসা। স্রোত কখনো দেরীতে আসেনা। তবে আজ সে এলো একদম প্রথম ক্লাস শেষ হওয়ার পর। স্রোত দ্রুত বেগে ঢুকলো ক্লাসে। শুভ্রার পাশটায় চেপে বসে ব্যাগ হাতড়ে কার্ড বের করল। শুভ্রাকে একটা দিয়ে আশপাশে তাকালো। আশ্চর্য! তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। তবে না দিয়েও তো উপায় নেই। খুঁজে খুঁজে কয়জনকে দিয়ে আবার ডিপার্টমেন্টের টিচার কয়েকজনকেও দিতে হবে। যদিও বা কেউ ওতদূর যাবেনা। তবুও, সৌজন্যতা দেখিয়ে দেয়া উচিত। সে উঠল আবার। টিচারদের দিয়ে বেরোতেই আবার মুখোমুখি হলো ওয়াহিদের। তার মুখে ললিপপ। স্রোতকে দেখেই সে দাঁত কেলিয়ে হাসল। অতিমাত্রায় ভদ্র সেঁজে বলল,
“ কি খবর?”
“ ভালো।” তীক্ষ্ণ নজর স্রোতের। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পূর্বে কি মনে করে ঘাড় ফিরালো ও। হাতে শেষ একটা কার্ড। দেয়া কি উচিত? দোটনায় ভোগার ক্ষণে ওয়াহিদের চোখ গেল সেদিকে। অল্প হেসে বলল,
“ বিয়ে-টিয়ে করে ফেলছিস নাকি?”
“ হু..হুম..” কার্ডটা এগিয়ে দিল স্রোত। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল ওয়াহিদ। সকালেও একই কার্ড দেখেছে। তবে সেটা গ্রহণ করেনি। এটাও করবেনা করবেনা করেও স্রোতের মুখের দিকে চাইল। হবু সম্বন্ধির বউ। মুখের ওপর রিজেক্ট করলে ভবিষ্যৎ-এ যদি পস্তাবে হয়? সে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কার্ডটা রেখে দিল। ললিপপ মুখ থেকে বের করে, অন্য হাত বাড়াল। স্রোতের মাথার একহাত উপরে,শুণ্যে হাত রেখে বলল,
“ বড় হ। পড়াশোনা বাদ দিয়ে স্বামীর ঘর কর মন দিয়ে। দোয়া করে দিলাম, যা। তোর স্বামীভাগ্য ভালো হবে,দেখে নিস।”
স্রোত অদ্ভুত চোখে তাকাল। ক্ষণকালের ব্যবধানে সে ফিক করে হেসে ফেলল। এরপর চলে গেল ক্লাসের উদ্দেশ্যে।

..

ঘড়ির কাটায় রাত দু’টো বাজে। স্রোতের চোখ নিদ্রাহীন। কাল সকালে তার জলদি উঠার কথা। কাল হোস্টেল ছাড়ার দিন। অদ্ভুত! তার যেতে মন চাইছেনা। সে আস্তে-ধীরে উঠে বসলো।।অন্ধকার রুমটায় চোখ বুলাল। এরপর ফোন হাতে নিল। রাত দু’টো। মানুষটা নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে? তবুও কি ভেবে কল লাগালো স্রোত। সেকেন্ড খানেকের মাথায় রিসিভ হলো। ওপর প্রান্ত থেকে চিন্তিত গলা ভেসে এল,
“ কি হয়েছে? এত রাতে ঘুমাননি?”
“ ঘুম আসছেনা।”
“ আমার কাছে চলে আসুন, ঘুম পাড়িয়ে দেই।” নায়ীবের কণ্ঠ ঘুমু-ঘুমু। সে আদতে ঘুমেই ছিল। সবে চোখটা লেগেছিল।
“ আপনি এত নির্লজ্জ কথাবার্তা বলতে পারেন,নায়ীব! আমি তো কল্পনাই করিনি।”
স্রোত বিচলিত স্বর। নায়ীব নিঃশব্দে হেসে বলল,
“ আমি আরো নির্লজ্জ, স্রোত। বিয়ে হোক, বুঝবেন। তখন যা হবে, তা-ও আপনি কল্পনা করতে পারবেন না।”

স্রোত মৌন রইল ক্ষণকাল। প্রসঙ্গ ঘুরাতে আচমকাই বলে উঠল,
“ আচ্ছা। নায়ীব,আপনার ওই প্রেমিকার কাহিনিটা বলুন না।”

নায়ীবের চোখ বন্ধ ছিল। সে বিছানার মাঝখানটায় পড়ে আছে নিস্তেজ শরীর নিয়ে। মাঝরাতে এমন অদ্ভুত কথা কেউ বলে? সে চট করে চোখ খুলল। অথচ অন্ধকার হাতড়ে কিছুই দেখতে পেলনা। নাক-মুখ কুঁচকে গেল অবিলম্বে। গাঢ় স্বরে বলল,
“ কোন প্রেমিকা?”
“ প্রেমিকা না, প্রাক্তন। প্রাক্তন বলে। নামটা যেন কি? উ..উম..হিমি। এম আই রাইট?”
স্রোত অনেক ভেবে নামটা মনে করেছে। কণ্ঠে কৌতুহল।

নায়ীব ত্বরিত উঠে বসল। হকচকিয়ে বলল,
“ আপনি ওর নাম জানলেন কি করে?”
“ আপনিই তো বললেন। আশ্চর্য!এমন ভাণ করার কি?”
“ আল্লাহ! সেই কবে বলেছি!”
“ আমার ব্রেইন খুব শার্প।”
নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। বিড়বিড় করে,
“ আল্লাহ আপনাকে এত শার্প ব্রেইন না দিলেও পারতেন।”

..

বাড়িভর্তি মানুষ দেখে হকচকালো স্রোত। নানুবাড়ির সকলে উপস্থিত। স্রোতের তিন মামা-খালার কম হলেও আট-নয় জন ছেলেমেয়ে। বেশিরভাগই স্রোতের ছোট। তাদের হৈ-হুল্লোড়ে বাড়ি মেতে আছে। তার ওপর গ্রামের মানুষজনের চলাচল তো আছেই। স্রোত বাড়িতে প্রবেশ করতেই সবার নজর তার দিকে পড়ল। ওমনি অস্বস্তিতে গুটিয়ে গেল স্রোত। একে একে সবাইকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করল। এর ফাঁকেই ইমা এসে তাকে উপরে নিয়ে গেলেন।
স্রোত রুমে ঢুকলো। ব্যাগ-ট্যাগ রেখে ফ্রেশ হতে গেল। বেরিয়েই দেখল বিছানার ওপর আয়েশ করে বসা চারজন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। স্রোতের ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে অল্প ভাঁজ পড়ল। সামান্য ঠোঁট এলিয়ে জানতে চাইল,
“ কি কথা হচ্ছে?”
চারজোড়া চোখের গতিপথ পাল্টাল। স্রোত তোয়ালে মেলে আসতেই তাকে ধরে বসিয়ে দেয়া হলো বিছানার মাঝবরাবর। সাবিলা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ আর বলিস না তো আপু! সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছি তোর আসার।”
“ কেন? আমার অপেক্ষা করার কি আছে?” স্রোত ভ্রু নাঁচায়।
সাবিলা জবাব দেয়ার পূর্বেই তিন্নি বড্ড উৎফুল্ল গলায় বলে,
“ দুলাভাইয়ের ছবি দেখিনি আমরা। সুহাদ ভাইকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।”
স্রোত মিহি গলায় বলে,
“ ছবি দেখে কি হবে? আর ক’টা দিনই তো। সামনা সামনি দেখিস।”
“ কি সাংঘাতিক! শালি হয়ে এটুকু অধিকার নেই আমাদের?” সমস্বরে বলে উঠে আইরিন, পিয়া। দুজনেই স্রোতের বড় মামার মেয়ে। বাকি দুজনে ছোট মামার মেয়ে। স্রোতের সাথে তারা খুব কমই সময় কাটিয়েছে। তা-ই এই বিয়েতে ওরা অতিরিক্ত উৎফুল্ল।

স্রোত আলগোছে ফোন বের করে। গ্যালারিতে সেভ করা অসংখ্য ছবি। সবগুলোই ফেসবুক থেকে সেভ করা,পুরোনো ছবি। নায়ীবের ইদানীং কালের ছবি নেই। খুব একটা তফাৎ নেই যদিও। ও ফোন বাড়িয়ে দিল। চারজোড়া হাতই তেড়ে আসলো। কাড়াকাড়ি শেষে ফোনটা টিকলো আইরিনের হাতে। এরপর একে একে বাকিরাও দেখল।

..

বাড়ির সামনের খালি জায়গাটা দারুণভাবে সাজানো হয়েছে আজ। ছোট-খাটো একটা স্টেজ বসানো হয়েছে। সেই স্টেজে আগামীকাল বিয়েও সম্পন্ন হবে। তবে তা আপাতত ব্যবহার করা হবে গায়ে হলুদের জন্য।

স্রোত ভাবুক হয়ে বসে আছে। সদ্য গায়ে জড়ানো সবুজ রঙের শাড়িটার দিকে তার দৃষ্টি স্থির। চোখের পাতা নড়ছেইনা। রুমটায় আপাতত কেউ নেই। একটু পরই সবাই আসবে। তাকে সাজানো হবে। তার আচানক সবকিছু অদ্ভুত লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে। এ অনুভূতি সে কার সঙ্গে শেয়ার করবে? নায়ীবের সঙ্গে কথা হয়নি আজ। তবে তাদের বাসায়ও আয়োজন করা হচ্ছে গায়ে হলুদের। স্রোত জানে, নায়ীব এসবে নেই। নিশাত আর বাকিদের চাপে পড়ে রাজি হয়েছে নিশ্চয়ই।
ভাবনার সুঁতো ছিঁড়ে হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজে। মুখ তুলে একবার চেয়ে দেখল,তিন্নি বিশাল এক বাক্স নিয়ে ঢুকছে। সে মেক-আপ আর্টিস্ট। স্রোতকে সে-ই সাজাবে। তিন্নির সঙ্গে আরো মানুষও আছে। বেশিরভাগই গ্রামের মহিলা। বিয়ে উপলক্ষে আনাগোনা তাদেরই বেশি। তিন্নি ক্ষণকাল গড়াতেই বাড়তি মানুষদের সরালো। দরজাটা চাপিয়ে রাখলো। মেক-আপ বাক্সে হাত দিতে দিতে শুধাল,
“ কেমন সাজবি? মানে..ভাইয়ার ইচ্ছে কেমন?”
বলেই সে একা একা খ্যাট খ্যাট করে হাসলো। স্রোত বড়-বড় চোখে তাকাল,
“ ফাজিল!”
“ মজা করছি রে। এখানে তো কেউ নেই, অযথা লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”

স্রোত মুখ ঘুরাল। তিন্নি কাজ শুরু করল। পাক্কা ঘন্টাখানেক খরচ করে দারুণ এক সাঁজ আনলো স্রোতের মুখশ্রীতে। স্রোত চোখ বন্ধ করে বসা। তার ঘুম পাচ্ছে এত আরামে। আস্তে-ধীরে চোখ খুলে সে আয়নায় তাকাল। গায়ের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে সাঁজ। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা কাঁচা ফুলের গয়না,গাঁজরা। স্তব্ধ চোখে নিজেকে পরখ করল স্রোত। এমন সাজে নিজেকে প্রথমবার দেখা। নিজের কাছে নিজেকে অদ্ভুত লাগছে তাই। অস্পষ্ট স্বরে তাও সে আওড়ালো,
“ সুন্দর হয়েছে।”
তিন্নি তেজী গলায় বলল,
“ হয়েছে। আপনাকে বলতে হবেনা। সাঁজ সুন্দর হয়েছে কিনা, দুলাভাই-ই বলবে।”
স্রোত চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তন্মধ্যে তিন্নি তাকে গয়নাগুলো ঠিকঠাকমত পরিয়ে দিল। মাথার ওপর একটা গাঢ় সবুজ পাতলা ওড়নাও আটকে দিল।
এরপর সে ছুটে বেরিয়ে গেল দরজা আটকে। স্রোত তার মতিগতি বুঝলোনা। দশ মিনিট পর সে হাজির এল। তবে একা নয়। সঙ্গে ইনানও। ইনানের হাতে ফোন, ঠোঁটে দুষ্টুমিষ্টি হাসি। ফোনের স্ক্রিনটা সে ঘুরাতেই চোখ ছানাবড়া হলো স্রোতের। গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত এক শ্যাম পুরুষ তাকিয়ে আছে। তার দিকেই, থমকানো দৃষ্টি নিয়ে। স্রোতের চোখ আটকে তার দিকে, তার চোখ স্রোতের দিকে। এই সুন্দর দৃশ্যখানার সাক্ষী হলো তিন্নি আর ইনান।
স্রোতের হঠাৎ ধ্যান ছুটতেই সে ফোনটা নিজের হাতে নিল। ইনান,তিন্নির দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলল,
“ যা,বাইরে যা। কেউ আসলে খবর দিস।”
“ তাড়িয়ে দিচ্ছিস কেন? আমরা এমনিতেও থাকতাম না,হুহ।”
তিন্নি ইনানের কাঁধ চাপড়ে বেরিয়ে গেল। দরজাটা চাপানো কিনা, তা একবার পরখ করল স্রোত। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে সে তাকালো স্ক্রিনের দিকে। আশ্চর্য! মানুষটার পলক পড়ছেনা। স্থির তাকিয়ে। স্রোত বারকয়েক নেত্রপল্লব ঝাপটালো। বোকা-বোকা স্বরে বলল,
“ হ্যালো? শুনতে পাচ্ছেন? নাকি নেট প্রবলেম হলো?”

ওপর প্রান্তের মানুষটা আচমকা মুখ খুলল,
“ নেট ঠিক আছে।” সে তখনও একইভাবে চেয়ে।
“ আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“ আয়নায় দেখেছেন নিজেকে? দেখলে তো এই প্রশ্ন করতেন না।”
স্রোত চোখ তুলে আয়নায় চাইলো একবার। নায়ীবের গলার স্বরটা অন্যরকম। সে চোখ রাখল এবার স্ক্রিনে। বলল,
“ এতটা খারাপও লাগছেনা, সুন্দরও লাগছেনা।”
“ মেয়ে মানুষ নিজেকে নিয়ে কখনই বা স্যাটিসফাইড হয়?” সে অল্প থামল। পুনরায় বলা শুরু করল,
“ এইযে, হুরের মতন রুপ নিয়েও নিজেকে অসুন্দর বলছেন আপনি। ইজ দ্যাট ফেয়ার,হুহ?”

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩৮

হই-হট্টগোলের আওয়াজে কানে পোঁকা ধরার মতন অবস্থা। দো’তলার ঐ কোণার রুমটায় কনেকে রেখে সবাই নিচে নেমে এসেছে। গেটে পাত্রপক্ষকে আটকানো হলো। সাবিলা বড় মুখ করে হাজার পঞ্চাশ’এক টাকা দাবি করল। তর্কা-তর্কি করতে করতে শেষমেশ পনেরো হাজারে থামলো ওরা। নায়ীব কোনো শব্দই খরচা করেনি। তর্ক করেছে তার মামাতো ভাই। সে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে এসব দেখছে। কেবল টাকা দেয়ার সময় তাকে দরকার পড়ল। চকচকে টাকার বান্ডিল পূর্বপ্রস্তুতি স্বরুপ সঙ্গে আনা হয়েছে। জানা কথা, গেটে এমন লুটপাটের শিকার তাদের হতেই হবে। টাকার ঝামেলা মিটাতেই তার শালা-শালিরা মিষ্টির বাটি উঁচাল। শুভ্রা চামচে মিষ্টি গেঁথে তা এগিয়ে দিল। সহাস্যে বলল,
“ দেখিতো দুলাভাই, হা করেন।”
নায়ীব সন্দিহান চোখে তাকাল। অকস্মাৎ তীরের মত প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ কিছু মিশিয়েছেন, শালি সাহেবা?”

শুভ্রা এসেছে গতকাল রাতে। তার বাবার সঙ্গে একপ্রকার যু*দ্ধ করে। এতদূরে কিছুতেই আসার জন্য মানানো যাচ্ছিলোনা। শেষমেশ কাল রাতে তার বাবা-ই এসে দিয়ে গেছেন। একটুর জন্য গায়ে হলুদ মিস করেনি।
আচানক নায়ীবের এমন প্রশ্নে শুভ্রার বদলে আইরিন ঘাবড়ে গেল। সে পুরো এক চামচ ভর্তি লবণ মিষ্টির ওপর ঢেলেছে। কিছুটা গায়েও লেগে আছে, দেখতে চিনির মত লাগছে। সে তড়িঘড়ি করে বলল,
“ এতটাও বাজে নই আমরা, দুলাভাই। পাওনা মিটিয়েছেন, সেই খুশিতে মিষ্টি সাধছি। দ্রুত খান, আমাদের বোন অপেক্ষা করছে।”
তার এমন ধুরন্ধর বাজি চট করে ধরে ফেলল নায়ীব। তবে হতাশ করতে চাইলনা তাদের। শুভ্রার উঁচিয়ে ধরা চামচটা হালকা টেনে, ছোট্ট কামড় বসালো মিষ্টিতে। চোখ-মুখ কুঁচকে এল সঙ্গে সঙ্গেই। সেকেন্ড খানেকের মাথায় আবার কুঁচকানো মুখ ঠিকঠাক করে দুর্বোধ্য হাসলো সে। বলল,
“ তোমাদের চালাকি তো আগেই ধরে ফেলেছি।”

পিয়া ভ্রু কপালে তুলে বলে,
“ পুলিশ তো এমনি এমনি হোন নি, দুলাভাই। আসুন, আসুন। সুঁতো কেটে উদ্বোধন করুন বিয়ে বাড়ির।”

নায়ীবের পাশে দাঁড়ানো, শিহাব। সে সম্পর্কে নায়ীবের মামাতো ভাই। পনেরো হাজারটা টাকার জন্যে তার বড্ড মায়া লাগছে। সে কখনোই নিজের বিয়েতে এত টাকা খোঁয়াতো না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এদের কাজকারবার দেখছিল। এ পর্যায়ে ফট করে আওয়াজ তুলল,
“ সুঁতোতেও ভেজাল আছে, নিশ্চয়ই।”

কথা শেষ হতে না হতেই হাসির হিড়িক পরল। পিয়া রক্তিম চোখে একবার শিহাবকে পরখ করে। ওমন দৃষ্টি যদিও শিহাব পাত্তা দেয়নি। তবুও হাত দু’টো হালকা তুলে, ধরা পড়ার ভঙ্গিমায় কাঁধ উঁচাল।

..

কাজী সাহেব চশমার ফাঁকে এদিক-ওদিক চাইলেন। স্টেজে মুখোমুখি করে দু’টো সোফা পাতানো। একটা সোফায় বর বসা। সামনের সোফা খালি, মাঝখানে পাতলা ওড়নার মত কি যেন টানানো। পর্দা বোধহয়।
বরের অস্থির চেহারা পরখ করে ক্ষীণ হাসলেন কাজী সাহেব। মুহুর্তের মধ্যে কানে ভেসে এল শোরগোল। কনেকে নিয়ে আসা হচ্ছে। মুখোমুখি থাকা সোফাটায় তাকে বসিয়ে দিতেই কাজী সাহেব নিজের বড়-সড় খাতাটা খুললেন।

নিশাত একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, আগ্রহটা তারই বেশি এখন। কাজী সাহেব মুখ খুললেন। বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। মিনিট দু’এক এর মাথায় আচমকা কথা ছুড়লেন স্রোতের দিকে,
“ বলো মা, কবুল?”

কথাটা তীরের মত গেঁথে গেল যেন। স্রোত থমকানো দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চাইলো। কাছেপিঠে কোথাও সাঈম সাহেব, আশা নেই। তার হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে। ধক ধক আওয়াজ নিজেরই কর্ণে আসছে। সেকেন্ড খানেকের মাথায় ভীর-টীর ঠেলে এগিয়ে এলেন সাঈম সাহেব। হাতের মুঠোয় তার আরেক হাত বন্দি। নায়ীব চেয়ে চেয়ে দেখল। বুঝল, শশুর আর সে একই ধাচের এক্ষেত্রে। আশার হাতটা সযত্নে হাতের ভাঁজে আটকে তিনি এগিয়ে গেলেন। ক্রন্দনরত আশার চোখমুখ লাল। সাঈম সাহেব চোখ মুছিয়ে দিলেন। মৃদু আওয়াজে, আদুরে গলায় শুধালেন,
“ কাঁদে না, আশা। মেয়ের সামনে শক্ত থাকতে হয় মা-বাবাদের। কান্না থামাও।”
আশা কান্না থামালেন। তবে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল স্রোত। ততক্ষণে তার তিন ভাইও সামনে চলে এসেছে।
সুহাদ,ইফাদ দু’পাশে দাঁড়ালো। পাতলা,লম্বা ঘোমটার ওপর হাত বুলালো। চাপা গলায় সুহাদ বলে উঠল,
“ পাখি? কান্নার কিছু হয়নি। আমরা আছিনা? কাজী সাহেব যা বলতে বলছেন, বলো।”
ক্ষণকাল গড়াতেই ভাঙা গলার ক্ষীণ আওয়াজ শোনা গেল,
“ কবুল..”
আরো দু’বার বলতে বলা হলে,সে কান্না আটকেই বলে ফেলল। এরপর কাজী সাহেব স্বস্তি নিয়ে নায়ীবের দিকে ফিরলেন। যতটা বিয়ে পড়িয়েছেন, সবকটায় কনের কবুল বলার সময় ধৈর্য ধরে বসে থাকতে হয়। বরের বেলায় তার ব্যতিক্রম। তিনি এবার বললেন,
“ বলো বাবা, কবুল।”
থমকালো এবার নায়ীবও। নিশাত ঠোঁট কামড়ে তার দিকে চেয়ে। চোখ-মুখে উপচে পড়া খুশি। চোখ সামনে রাখল নায়ীব। পাতলা কাপড়ের পর্দা ভেদ করে ওপাশে নীরবে চোখের জল খসানো মেয়েটার দিকে চেয়ে চেয়েই সে আওড়াল,
“ কবুল,কবুল,কবুল।”

সমস্বরে সকলে শুকরিয়া আদায় করল। পর্দাটা সরানো হলো এবার। নায়ীব উঠল। লম্বা ঘোমটাটা সে আস্তে ধীরে তুলল। শুভ্র ললাটে এক গভীর চুম্বন বসিয়ে দিল। মুখ ফুটে অচিরেই বেরোলো,
“ মাশা-আল্লাহ।”

ওমনি হাসির আওয়াজ শোনা গেল। স্রোতের কান্না আপনা-আপনি থেমে গেল। আশাও লাল চোখ-মুখ নিয়ে অল্প হাসলেন। সাঈম সাহেবকে টেনে সরিয়ে নিলেন ছোটদের মাঝখান থেকে।
ইমা,সাহিদ সাহেব একটু দূরেই দাঁড়িয়ে। ইমার হুহু করে কান্না পাচ্ছে। আশাকে দেখে কাঁদছেন না।

তিন্নি ঠেস মে রে বলল,
“ শুধু মাশা-আল্লাহ? আমরা তো ভাবলাম জ্ঞান-ট্যান হারাবেন আপনি, দুলাভাই।”

নায়ীব কিঞ্চিৎ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। ঠাট্টা-মজা চলমান থাকার ক্ষণেই সে বসল স্রোতের পাশে। একদম গা ঘেষে। চোখ গেল তার এবার নরম হাত দু’টোর দিকে।
স্বামীর বেশি ভালোবাসা আর মেহেদীর রঙ গাঢ় হওয়ার সঙ্গে নাকি বিশেষ কানেকশান আছে, শুনেছে নায়ীব। স্রোতের ডান হাতটায় মাঝেই তার নাম লেখা। গাঢ় মেহেদী রঙা হাতে নজর বুলিয়ে চমৎকার হাসলো সে।
স্রোত চুপটি করে বসা। কণ্ঠনালি গলিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছেনা, শব্দ ভান্ডারও খালি। সবাই তখন ব্যস্ত ছবি তুলবে বলে। নিশাত হুট করে কাছে এল। থুতনি ছুঁয়ে বলল,
“ ভাবী! এত সুন্দর লাগছে কেন তোমাকে? আমার চোখ সরছেইনা।”
নায়ীব তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। এ কথা বলা উচিত তার, বলছে তার বোন! সাং ঘাতিক! ওর চাহনি দেখে ভ্রু কুঁচকালো নিশাত। জিজ্ঞাসু নজরে তাকিয়ে ভ্রু নাঁচাল। হঠাৎ বলল,
“ ভাবীর দিকে তাকানোর আগে সাবধান থাকবে। তোমার নজর লাগতে পারে।”
“ নজর? আমার বউয়ের ওপর আমার নজর লাগবে? আশ্চর্য কথা বলছিস!”

শ্লেষাত্মক প্রত্যুত্তরটি কান দিয়ে ঢুকতেই স্রোত হাত দিয়ে ঠ্যালা দিল। নায়ীব তাকাল তার দিকে, চোখে প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো বিলীন হলো অচিরেই। চোখ তার আটকে গেছে চাঁদের মত মুখটার ওপর।

..

শিহাব আইঢাই করছে সেই কখন থেকে। দরজার নবটা আরেকবার ঘুরিয়ে পরিক্ষা করল,ঠিকঠাক লক হয়েছে কিনা। শেষমেশ শিওর হয়ে সে থামল। নিশাত কাছে দাঁড়িয়ে। চোখ-মুখে অশেষ প্রশ্ন। শিহাব পায়চারি করতে করতে শুধাল,
“ কিরে, তোর ভাই আসছেনা কেন?”
“ তার আগে বলো, দরজা আটকালে? ভাবীর কিছু দরকার হলে বেরোবে না? আমাকেও ঢুকতে দিচ্ছোনা!”
শিহাব বিরক্ত চোখে তাকাল। খানিকটা রাগী গলায় বলল,
“ বলদ তুই? যা তো বাকিদের নিয়ে আয়,নায়ীব ভাই আসার আগে। টাকা হাতাতে হবেনা?”
তব্দা খায় নিশাত,
“ সাংঘা!তিক! এই চাল চালছিলে তুমি?
গেটে ওরা টাকা চাওয়ায় কেমন বাকবিতন্ডায় জড়ালে,আর এখন নিজেই? ছিহ, লজ্জা! দাঁড়াও বাকিদের ডেকে আসছি।”
নিশাত ছুটল চঞ্চল পায়ে। শিহাব আহাম্মকের মত দাঁড়িয়ে রইল। বল:দ উপাধিটাই শ্রেয় নিশাতের ক্ষেত্রে। ছিহ-ছিহ করে আবার তাল মেলালো? আচ্ছা ধুরন্ধর তো!
মিনিট খানেকের মাথায়ই সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে হাজির হলো নিশাত।
নায়ীব নাবিদ সাহেবের রুমে। কিসব উপদেশ বাণী নিচ্ছে, কে জানে!
নিশাত শিহাবের পানে সহসা প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“ কত চাইবে?”
“ হাজার দশ এক তো চাওয়াই যায়, কি বলিস? নাকি তার চেয়েও বেশি চাওয়া উচিত?”
নিশাত অবাক হলোনা। শিহাবের দিকে কেবল মুখ কুঁচকে তাকাল,
“ তোমার মনে হয় ভাইয়া এত টাকা পকেট থেকে খসাবে?”
“ শালিদের এর চেয়ে প্রায় ডাবল টাকা দিয়েছে। আমাদের অর্ধেক দিতে সমস্যা কোথায়?”
নিশাত এবার মাথা নেড়ে বলে,
“ সহমত,ভাই। পাশে আছি।”

এবার আগমন ঘটলো নায়ীবের। গায়ে শুভ্র পাঞ্জাবি। শেরওয়ানির নিচেই পরা ছিল। অফ হোয়াইট শেরওয়ানিটা সে খুলে ফেলেছে অতিরিক্ত গরম লাগার কারণে। সেটা হাতে নিয়ে সে দরজার সামনে দাঁড়ালো। দরজায় তালা মারলেও অবাক হতোনা নায়ীব।
ও অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“ কি চাই?”
“ মানি..”
“ কত?”
“ দশ।”
“ ভাংতি নেই,বাকির খাতায় তোলা থাক। কাল ভাংতি এনে দিব।”
হকচকালো শিহাব। নিশাত দরজার দুপাশে হাত মেলে দাঁড়িয়ে। শাওন; শিহাবের ছোটভাই, অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। তেজি গলায় বলে,
“ দশ টাকা না ভাইয়া.. দশ হা..”
“ ওই অব্দি থেমে যা, আর বলা লাগবেনা।”
“ তাহলে টাকা বের কর?” শিহাবের প্রশ্ন শুনে এবার কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পড়ে নায়ীবের। পকেট হাতড়ে কেবল বেরোয় হাজার টাকার পুরনো তিনটে নোট। সেগুলো ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“ আর নেই।”
নিশাত হতাশ হলো। সে জানতো ভাইয়া এমন চালাকিই করবে। নতুন নোটগুলো কোথায় রেখেছে, তার হদিসও পাওয়া দুরসাধ্য।
শিহাব বড়বড় চোখে তাকাল। বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ মশকরা হচ্ছে নাকি? শালিদের বেলা পনেরো হাজার, আমাদের বেলা কেবল তিন? পাঁচ দিলেও মানতাম। বাসর ঘর সাজিয়েছি, সেজন্য তো পারিশ্রমিক বানতা হ্যা..”

এবার আরো দু’টো হাজার টাকার খসখসে নোট বের করল নায়ীব। এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ এবার ঢুকতে দে?”
নিশাত দরজা থেকে সরলো। হামলে পড়লো নায়ীবের পাঞ্জাবির পকেটের ওপর। অথচ মিনিট খানেক চিরুনী তল্লাশি করেও আর একটা সিঁকি অব্দি পেলনা সে। নায়ীবের হাত থেকে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে এরপর সরে গেলো। শিহাব চাপা স্বরে আওড়ালো,
“ কি ঠকা ঠকেছি রে,নিশাত। আয়, দু’টো থা-প্পড় দে আমাকে।”
থা-প্পড় পিঠে পড়লো বটে। তবে নিশাত এ দুঃসাহস দেখায়নি। শাওন শিহাবের কথা মেনে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ থ্যাংক মি লেটার, ভাইয়া।”

..

দরজার নব ঘুরলো ধীর গতিতে। সঙ্গে সঙ্গেই জড়সড় হয়ে বসলো স্রোত। গায়ের ভারী গয়নাগুলো সে ড্রেসিং টেবিলের ওপর খুলে বিছানায় বসেছে সবেই। হাঁসফাঁস লাগছিল প্রচন্ড। পরনের বেনারসিটাও কিঞ্চিৎ ভারী। মাথার ওড়নাটার অবস্থাও বেহাল। কোন সময় যে সে এসব থেকে মুক্তি পাবে, কে জানে।
দরজা আচমকা খুলল। পরপরই আবছা অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তির আগমন ঘটলো। লাইটটা একটু আগেই নিভিয়েছে স্রোত। ভেবেছিল নায়ীব আসলেই অন করবে। তবে নায়ীব সে সুযোগই দিলনা। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই সে দরজা আটকে সিঁটকিনি অব্দি আটকে ফেলল। এরপরই আবছা আলো ডিঙিয়ে ধুপধাপ কদমে এগিয়ে এল বিছানার কাছটায়। একপাশে শেরওয়ানি, পাগড়ি রেখে বুক টানটান করে দাঁড়াল।
তন্মধ্যে ত্বরিত বেগে নেমে টুপ করে সালাম সাড়ল স্রোত। এরপরই জড়সড় ভঙ্গিমায় দাঁড়ালো। নায়ীব হাত বাড়িয়ে অল্প আলোর বাতিটা জ্বালালো। সামান্য অন্ধকার দূর হলো বটে, তবে আবছা ভাবটা থেকেই গেল। স্রোত তখন জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে। ভিন্ন এক অনুভূতির নদীতে খেই হারিয়েছে সে। নতজানু মুখটা পরখ করল নায়ীব। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“ শাড়িটা খুলে ফেলুন।”

কথার মানে চট করে ধরতে পারলনা স্রোত। হকচকালো অনেকখানি। অপ্রস্তুত স্বরে মুখ ফুটে বেরোলো,
“ হ.. হ্যাঁ?”

ওর হকচকানোর ভঙ্গিমায় আচমকাই হাসি পেল নায়ীবের। বিছানায় পা দুলিয়ে বসার আগ মুহুর্তে কেবল বলল,
“ শাড়ি পালটে আসুন।”

স্রোত লাগেজ থেকে সুতি শাড়ি বের করল। সব কিছুই আশার গুছিয়ে দেয়া। কখন কোন শাড়ি পরলে স্বস্তি লাগবে, সেটাও বলে দিয়েছেন উনি। স্রোত ওয়াশরুমে ঢুকে গেল শাড়ি হাতে। কাপড়-চোপড় পালটে বেরোতে তার সময় লাগলো গুনে গুনে ছাব্বিশ মিনিট। নায়ীব স্থির বসা। ও বেরোলো যখন, তখনও সে গাঢ় চোখে তাকিয়ে। বিয়ের সাজটা তুলে ফেলেছে মেয়েটা। অথচ আসার পথে নায়ীব তার লাল টুকটুক বউয়ের সেই চেহারা থেকে নজর ফেরাতে পারেনি। যদিও বর্তমানেও তার ব্যতিক্রম নয়। ভেজা, স্নিগ্ধ মুখটায় সে অপলক, নির্নিমেষ চেয়ে। মেয়েটা এখন শুধুমাত্র তার প্রেমিকা নয়, বউও। ওর গাঢ় দৃষ্টি ছুটলো মেয়েটার সর্বাঙ্গে। নীল রঙের শাড়ির এলোমেলো কুঁচিগুলোর দিকে চেয়ে হাসলো অল্প। মেয়েটা শাড়ি পরতে আনাড়ি। এ দায়িত্ব নাহয় নায়ীবই কাঁধে নিবে।
স্রোত চোখ নামিয়ে, আলগোছে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে সব মেলে আসলো। যাওয়ার সময় নায়ীবের শেরওয়ানিটাও সঙ্গে নিলো। ও বারান্দা থেকে আসতেই নায়ীব বলল,
“ দরজা আটকে দিন। ঠান্ডা বাতাস আসছে।”

স্রোত হাত উঁচিয়ে দরজা আটকালো। এরপর এত শ্লথ গতিতে হেঁটে এলো, সময়টা খুবই আগ্রহ নিয়ে গুনলো নায়ীব। চোখের দৃষ্টি সহসাই পালটে গেল তার। ব্যগ্র ভঙ্গিতে মেয়েটাকে কাছে টেনে নিলো। হাত দু’টো আচমকাই নরম, মসৃণ কোমরটা পেঁচিয়ে ধরলো। স্রোত থমকালো, হকচকালো। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ব্যাকুল হলো সম্পূর্ণ চিত্ত।
ভর রাখতে হাত দু’টো স্থান খুঁজে নিল নায়ীবের কাঁধে। এর বাদে করার আর কিচ্ছুটি নেই তার। নায়ীবের চোখ-মুখে সম্মোহন,মুগ্ধতা। উন্মুক্ত কোমরের ফাঁকে ফাঁকে তার হাতের বিচরণ চললো অনেকক্ষণ। একটা সময় থেমে গেল। স্রোতের কুঁকড়ানোও থেমে গেল। স্তব্ধ, বিমুঢ় চোখে তাকাতেই নায়ীব দুর্বোধ্য হাসলো। মুখ উঁচিয়ে টুপ করে এক চুমু বসালো থুতনিতে। প্রশান্তিতে বুদ হওয়া গলায় আওড়ালো,
“ আরেকটু নির্লজ্জ হই এবার?”

স্রোত কথার মানে বোঝার সময়টুকুও পেলনা। শক্ত এক চুম্বনের দাপটে তার ঠোঁটজোড়া বন্ধ হলো। কণ্ঠনালী গলিয়ে কোনো শব্দ বেরোনোর সুযোগই পেলোনা। দীর্ঘক্ষণ শেষে থামলো নায়ীব। ব্যগ্র হাত দু’টো মেয়েটাকে টেনে ফেলল বিছানায়। এলোমেলো কুঁচিতে আবার নজর গেল নায়ীবের। স্রোতের দিকে অনেকটা ঝুঁকে, অকস্মাৎ এক অদ্ভুত প্রশ্ন রাখল,
“ শাড়ি পরতে কষ্ট হয়েছে?”
স্রোতের চোখ-মুখে চমকিত ভাব। আড়ষ্টতায় জর্জরিত হয়ে কোনোমতে সে জবাব ছিল,
“ হ.. হ্যাঁ..”
জড়তাহীন পুরুষালী গলার স্বরটা মাঘ মাসের শীতল, গা শিরশির করা বাতাসের মতোন কানে ধাক্কা খেল,
“ এডভান্স সরি। সকালে আবার আমি পরিয়ে দিব নাহয়..”

চলবে.