গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
505

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪২

স্রোতের বই-পুস্তকের দিকে একপলক তাকায় নায়ীব। কাল থেকে ডিউটি শুরু তার। স্রোতও ক্লাসে যাবে। দুজনার প্রস্থানের সময় যে মিলেনা! নাহলে নায়ীব ওকে দিয়ে যেত। কিংবা নিয়ে আসতো। তবে ওর ক্লাস টাইমের ঠিক-ঠিকানা নেই।
নায়ীব দম ফেলে,
“ এইযে,মিসেস! মন খারাপ করে বসে থাকলে হবে? পড়াশোনা তো লাটে তুলেছেন।” নিতান্তই মজার ছলের বলা কথাটা।
স্রোত বিষন্ন চোখমুখে অবাকতা ভর করে এবার। বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই অসহ্য রকমের বিষন্নতা ঝেঁকে ধরেছিল। নায়ীবের কথায় সে চরম অবাক হলো৷ মুখ কুঁচকে বলল,
“ আমি পড়াশোনা লাটে তুলেছি?”
“ উহুম!”
“ এসব কথা আমি জোহাকে শোনাই। আর আপনি আমাকে শোনাচ্ছেন?”
নায়ীব শব্দ করে হাসে। হাসতে হাসতে বিছানায় বসে। সে জানে স্রোতকে পড়াশোনা নিয়ে চাপ দিতে হয়না।
“ তাহলে মন দিয়ে পড়ুন,মিসেস। আপনি একটা চাকরি ধরবেন আর আমি আমার চাকরি ছেড়ে বাসায় বসে আরামে বাচ্চা-কাচ্চা পালবো।”
নায়ীবের কথায় ভড়কায় স্রোত। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“ বাচ্চা কোথা থেকে আসলো?”
“ আসেনি। আসতে কতক্ষণ?”

স্রোত দ্রুত চোখ সরালো। পুরুষ মানুষ এমন নির্লজ্জ হয়,জানা ছিলনা। কেমন ঠাট্টা করছে! স্রোতের ভারী লজ্জা লাগছে।

..

ওয়াহিদ পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে। বুকে হাত গুঁজে শূণ্যে দৃষ্টি রাখা। পিয়াশ মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করল,
“ কিরে ভাই! কি হয়েছে তোর? আধ ঘন্টা ধরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“ ভাবছি।”
“ কি?”
“ বিয়ে করব ভাবছি। আমাদের ব্যাচের সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।”
পিয়াশ চোখ উলটে বিরক্তি প্রকাশ করে,
“ ফালতু কথাবার্তা ছাড়। সামান্য প্রপোজ করতে যে ভয় পায়, সে নাকি বিয়ে করবে? তাছাড়া এসব ফালতু বুদ্ধি পাস কই? দুইদিন আগে ফার্মের আইডিয়া বের করলি, এখন আবার বিয়ের?”

ওয়াহিদ আগের ন্যায় স্থির। কেবল ভাবুক গলায় বলল,
“ মেয়ে মানুষ বড্ড জটিল,বুঝলি।”
“ আবার কি হলো?” হতাশ গলা পিয়াশের।
“ এই দেখ, এতমাস ধরে পিছু ঘুরছি। ওর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও মা-রামা-রি করেছি। এতকিছু করেও পছন্দের তালিকায় নাম অব্দি উঠাতে পারলাম না।”
বড্ড ভারী শোনালো ওয়াহিদের আওয়াজ। বেচারার হৃদয় আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত। অত্যাধিক কাতর স্বর। বেচারা আর কতদিন এমন থাকবে? পিয়াশ লম্বা দম টানে। বিড়বিড় করে,
“ দাঁড়া, বন্ধু। ব্যবস্থা আমি করছি।”

..

স্যার যেতেই হুড়মুড় করে ক্লাসে ঢুকে পিয়াশ। অন্য স্যার আসার পথে। সে তড়িঘড়ি করে ডাকে,
“ নিশাত! নিশাত কোথায়?”

নিশাত ভড়কায়,হকচকায়। সে ত্বরিত উঠে দাঁড়ায়। বড়বড় চোখে তাকিয়ে বলে,
“ জ-জ্বি?”
“ আসো তো আমার সঙ্গে।”
“ কেনো?”— প্রশ্নটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো পিয়াশ। সে বেরিয়ে গেছে। নিশাত ব্যাগ নিয়ে উঠে। মিষ্টি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে। নিশাত ছোট্ট করে বলে,
“ আসছি, থাক তুই।”

পিয়াশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। নিশাত দৌঁড়ে কিছুটা এগুলো। মধ্যিখানে কম হলেও তিন হাত দূরত্ব। হঠাৎ পিয়াশ থামতেই নিশাতকেও হাঁটায় ব্রেক কষতে হলো। ও থতমত খেয়ে তাকায়,
“ কি কারণে ডেকেছেন,ভাইয়া?”
“ না, এমনি। কথা বলবো বলে।”
“ কি কথা?”
“ মন দিয়ে শুনো নিশাত,ওয়াহিদ তোমাকে ভালোবাসে।”

নিশাত অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। সহসা গলার স্বর অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেল,
“ কিইই?”
বিষ্ময়,উত্তেজনার মিশ্রণ কণ্ঠে। পিয়াশ নির্লিপ্ত গলায় বলে,
“ হ্যাঁ। ও তোমার পিছু পিছু ঘুরে নিজের কি হাল করেছে দেখেছো? ভার্সিটি লাইফের শেষ সময়টায় ও পড়াশোনায় হাল ছেড়ে দিচ্ছে। রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু ও ঘরছাড়া হবে,দেখে নিও।”
নিশাত হতবিহ্বল। মাথায় পিয়াশের কথাগুলো ঘুরলো। অনেক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করল। এরপরই গম্ভীর চোখ তুলে তাকিয়ে,ভারী কণ্ঠে বলল,
“ ওয়াহিদ কোথায়?” ‘ভাইয়া’ সম্বোধনটা আজ গায়েব। এত সিনিয়র একজনকে সোজা নাম ধরে ডেকেছে মেয়েটা। পিয়াশ তাতে বিশেষ পাত্তা দিলনা অবশ্য।
কেবল কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“ ক্যান্টিনে।”

.
ওয়াহিদ বেহুদা বসে আছে। টেবিলের ওপর রাখা সসের বোতলটা অযথাই নাড়াচ্ছে,শব্দ তুলছে। অকস্মাৎ কেউ টেবিলের ওপর হাত রাখতেই ওর ভাবলেশহীন দৃষ্টি স্থির হয় সেখানেই। ফর্সা হাতের কবজিতে একটা সবুজ রঙের পাথরের ব্রেসলেট। মানিয়েছে দারুণ। সরু চোখ তুলে এবার ওয়াহিদ হাতের মালকিনের মুখের দিকে তাকায়। মনে উথাল-পাতাল ঢেউ উঠে তখনই। নিশাত হাত সরায়না। অন্যহাতে চেয়ার টানে। ভীষণ কঠিন গলায় শুধায়,
“ বসি?”
“ হু..হুম? বসো।”
ওয়াহিদ দ্রুত নজর সরায়। এই মেয়ের প্রতি তার মনের এত উদ্বিগ্নতা ভার্সিটির সবাই দেখে,বুঝে। কিন্তু এই মেয়ে বুঝেনা। মন ব্যাকুল হয়ে উঠে ওয়াহিদের।

“ আপনার বন্ধু আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল।”
“ কি কারণে?”
“ আপনার তো জানার কথা।” রুক্ষ শোনায় নিশাতের কণ্ঠ। ওয়াহিদ অবাক হয়। গলার স্বরের এত বিস্তর তফাৎ দেখে অবাক না হয়ে উপায় আছে?
“ আমাকে বলেনি, তাই জানিনা।” জবাব দেয় ওয়াহিদ।
“ পাঠালেন তো আপনিই, আপনাকে আবার বলবে কেন?”

ওয়াহিদ তীক্ষ্ণ চোখে সরাসরি তাকিয়ে নিজেই ভড়কে যায়। নড়েচড়ে বসে। দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা নিমিষেই উধাও হয়। নিশাতের কঠোর চোখ-মুখ। রাগের আভাস স্পষ্ট। ওয়াহিদ বুঝতে পারছেনা কিছুই।
ওয়াহিদ হালকা কেঁশে গলা ঝাড়ে। পরপরই বলে,
“ এভাবে কথা বলছো কেনো! তুমি জানোনা তুমি আমার কতো জুনিয়র?”
অযথাই মজার ছলে বলা একটা অপ্রয়োজনীয় কথা। নিশাত দাঁতে দাঁত চেপে শুধায়,
“ তা তো জানি। কিন্তু সেই তো বন্ধুকে পাঠিয়ে জুনিয়রের সামনে নিজের ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করলেন। তাতে কিছু যায় আসেনি?”
“ হোয়াট?” সহসা চেঁচিয়ে উঠে ওয়াহিদ। এত চমকপ্রদ খবর শুনে চেঁচানোই স্বাভাবিক নয় কি? ওয়াহিদের হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেছে। মস্তিষ্ক কাজ করছেনা। নিশাত কিয়ৎক্ষণ নিরব রইল। পরমুহূর্তেই মৃদু গলায় বলল,
“ তা আপনি কি বোবা?”
“ তোমার মুখে বুলি ফুটেছে, দেখছি। সেই কখন থেকে আবোলতাবোল বকে যাচ্ছো।” ওয়াহিদের তেজি কণ্ঠস্বর নিশাতকে বিন্দুমাত্রও রুখতে পারলনা। সে জবাবের আশায় রইল তাও। কিন্তু ওয়াহিদ তাকে আরো একবার আশাহত করে নিশ্চুপ,বিমূঢ় রইল। ছেলে-মানুষের এত হেয়ালিপনা নিশাতের পছন্দ নয়। ভালোবেসেছে ঠিকই কিন্তু স্বীকার করতে ইগোতে লাগছে! এ আবার কেমন ভালোবাসা!
নিশাত এবার সরাসরি মোদ্দা কথায় আসে। সে এত হেয়ালি করতে পারেনা। চনমনে গলায় সে বলে উঠে,
“ আপনি আমায় ভালোবাসেন, একথা কেনো আপনার বন্ধুর থেকে শুনতে হলো আমার?”
“ তো কি করবো? ভার্সিটিতে মাইক লাগিয়ে বলে বেড়াবো নাকি?”
“ সেটা করলেও দুঃখ লাগতোনা।”

ওয়াহিদ বোধহয় জ্ঞান হারাবে শীঘ্রই। তার সমস্ত গা একবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। মাথায় ঝিম ধরলো। এতক্ষণ তো মেয়েটা কেমন রুক্ষ গলায় তেজ নিয়ে প্রশ্ন তাক করছিল। এখন কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? যেমন উত্তপ্ত মরুতে বৃষ্টি পড়লে ঠান্ডা হয় সব, তেমনই ওয়াহিদের বক্ষপট আচমকাই ঠান্ডা, শান্ত হলো।
ওয়াহিদকে তার চেয়েও বেশি নাড়িয়ে দিল নিশাতের বলা শেষ বাক্যটা। কি বললো? কি বুঝালো? ওয়াহিদ রোবট বনে বসে রইল। নিশাত অতি সন্তপর্ণে উঠে পড়ল।

..

স্রোত ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে গেছে। পা ঢলছে তার। রিকশা-টিকশার দেখা নেই। আজকে একটা তপ্ত হাওয়া বিরাজ করছে আশেপাশে। স্রোত শাল খুলে হাত নিয়েছে তাই। বাসায় পৌঁছাতে দুপুর পেরোবে।
ও শুণ্য ফুটপাতে ধীর কদমে হাঁটতেই থাকে। কিছুদূর যেতেই কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। ও চকিতে এদিক-ওদিক চায়। রাস্তার ওপাশে দশ-বারো বছরের একটা ছেলে বসে কাঁদছে। গগন কাঁপিয়ে কান্না যাকে বলে। জনমানবহীন এই নিস্তব্ধ রাস্তা বলে কান্নার আওয়াজ একটু বেশিই কানে বাজছে। স্রোত দ্রুত খালি রাস্তা পার হয়ে ওপাশের ফুটপাতে উঠল। বাচ্চাটার কাছে গিয়ে ঝুঁকে, জিজ্ঞেস করল,
“ কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো,বাচ্চা?”

বাচ্চাটার কান্নার বেগ কমলো বটে। তবে উত্তর দিলোনা কোনো।
শালটা ক্রমশ ফসকে যাচ্ছে হাত থেকে। স্রোত সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাগ কাঁধ থেকে নামায়। শালটা ঠিকঠাকভাবে ধরার আগেই হাতে একটা অদৃশ্য টান লাগে। অদৃশ্য বলা ভুল। কারণ সেকেন্ড খানেক গড়াতেই স্রোত দেখতে পেল, কেউ একজন ছুটে যাচ্ছে। তার হাতে স্রোতের সুন্দর কালো নতুন ব্যাগটা। ও দ্রুত নিচে তাকায়। বাচ্চাটা নেই। চোখ রাস্তার দিকে নিতেই দেখে, সে লোকের পিছু পিছু বাচ্চাটাও ছুটছে।

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪৩

এলোমেলো কদমে নিশাত ভার্সিটির ক্যাম্পাস ছেড়েছে সবে। ওয়াহিদ উদগ্রীব চিত্তে পুরো ভার্সিটি সাত চক্কর কাটলেও মেয়েটার দেখা পেলনা। শেষমেশ খবর পেল, মেয়েটা সেই কবেই বেরিয়ে গেছে। ও এক ছুটে বেরোয় ক্যাম্পাস থেকে। দু’দিকের রাস্তা একদম পরিষ্কার, খালি। ওয়াহিদ বাইকে চাবি ঢুকায়। স্টার্ট দিয়েই ঘোড়ার গতিতে বাইকটাকে ছুটায়।

কানে ক্যাটক্যাটে শব্দ বাজে নিশাতের। দুই হাত আপনা-আপনি কান চেপে ধরে। এমন অস-ভ্যের মত বাইক কে চালায়? ও কটমট চোখে পাশ ফিরে তাকায়। ওয়াহিদ বাইকটাকে বড় অবহেলার সহিত ফেলে এলো। অথচ বাইকটা তার কাছে রত্নের চেয়ে কম সমাদর পায়নি এতদিন।
নিশাতের পা জোড়া থেমে গেছে। গাঢ়,স্থির নেত্রজোড়া ওয়াহিদের দিকে। ওয়াহিদ এই প্রথম দূরত্ব ঘুঁচায়। চোখে-চোখ রাখে। মন কখন মন ছুঁয়েছে, জানা নেই। নিশাতের পাংশুটে চেহারা,চোখে কিছু-মিছু অভিমান। সবটাই ওয়াহিদ গভীর চোখে পরখ করে। সে তো মেয়েটার নিরব উত্তর পেয়েই গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করতে মন চাইছেনা। ও শেষমেশ মুখ খুললো,
“ নিশাত! তোমার হাত ধরার অনুভূতি চাইছি, দিবে?”

নিশাত দু’পাশে মাথা নাড়ে,
“ না।”
ওয়াহিদ ভড়কায় না। ঠোঁটের ভাঁজে অল্প হাসির রেখা উদয় হয়। সে অবিচলত গলায় বলে,
“ ভেবে বলেছো?”
“ হ্যাঁ..” দৃঢ় কণ্ঠ নিশাতের।
ওয়াহিদ সময় খরচ করেনা। খপ করে ধরে নিশাতের দুই হাত। বলে,
“ প্রথমবার তো, তাই ফর্মালিটি দেখিয়ে পারমিশন চেয়েছি। ভেবোনা প্রত্যেকবার চাইবো।”

স্রোত সিক্ত নয়নে এদিক-ওদিক তাকায়। কেউ নেই। রাস্তার মাঝখানে সে একা। ছুটে তো ওদের নাগাল পাওয়া দুষ্কর। এতক্ষণে ধরাশায়ীর বাইরে চলে গেছে। স্রোতের নিজের ওপর ভয়া-নক রাগ হলো। মনে চাইলো নিজেকে দু’টো ঠা-টিয়ে চ-ড় মা-রতে। নাহয় মাথার চুল ছিঁড়তে। তার হাতে কেবল একটা শাল। আর কিচ্ছুটি নেই। ব্যাগের ভেতর পার্স ছিলো, ফোন ছিলো। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সব চু-রি হলো। আহারে! ওর নতুন ফোনটা!
কোথায় যাবে এখন ও? বাসা এখনও অনেক দূর। ভাড়া-টাড়া কিচ্ছুটি নেই তার। হতবুদ্ধি সে। মাথায় এতটুকু এলোনা, বাসায় গিয়েও ভাড়া মিটানো যাবে। সটান হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক কতক্ষণ পর, জানে নেই..হঠাৎ একজনের আগমন ঘটলো। এক মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা তাকে এমন খাম্বার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাঁটা থামালেন। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“ এই যে মেয়ে! কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”
স্রোতের সম্বিৎ ফিরে আসে। অস্বাভাবিক মন খারাপ নিয়ে বলে,
“ হুম..”
“ কি হয়েছে?”
“ চো-র আমার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছে।”
ভদ্রমহিলা কেমন করে তাকালেন। ভড়কানো দৃষ্টি। খানিক পরই চঞ্চল গলায় বললেন,
“ তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? থানায় যাও।”
“ ব্যাগের ভেতর পার্সও ছিল,আর পার্সের ভেতর টাকা।”
ভদ্রমহিলা নিগূঢ় চেয়ে স্রোতকে পরখ করলেন। বিশ্বাস করলেন স্রোতের কথা। কিয়ৎক্ষণ ভেবে বলে উঠলেন,
“ আমার সঙ্গে যাবে? আমিও থানায়ই যাচ্ছি।”

স্রোত আনমনে মাথা নাড়ে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে হাঁটা ধরে। কিছুদূর যেতেই ওরা একটা রিকশায় উঠে।

..

নায়ীব মহা বিরক্ত। গম্ভীর চোখে জিহাদকে পরখ করছে। মাথায় সুপ্ত রাগ। এই জিহাদ কোনোকালেই শুধরাবে না। জিহাদ কাচুমাচু মুখে তাকিয়ে। ফাইলের স্তূপ গুলোয় একবার চোখ বুলায়। অনুনয় করে বলে,
“ সরি স্যার। এখানেই রেখেছিলাম ফাইলটা। কই যে মিশে গেছে! স্যার, দুই ঘন্টা সময় দিন,কথা দিচ্ছি..”
নায়ীবের কড়া চোখের শা-সানোতেই দমে যায় জিহাদ। কণ্ঠনালীতেই শব্দ-বাক্য; সবই দলা পাকিয়ে যায়। নায়ীব ধুমধাম কদম ফেলে নিজের আসনে আসে। টেবিলের ওপর দু’হাত রেখে মাথা চেপে বলে,
“ সামনে থেকে যাও, জিহাদ। বাইরে কেউ থাকলে পাঠাও।”

জিহাদ বেরিয়ে গেল। বাইরে তখন মানুষ বসা কয়েকজন। তাদের ভেতরে পাঠিয়ে নিজের চেয়ারে বসলো।

রুমার আচমকা শোরগোলে জিহাদ কপাল কুঁচকে বসে রইল। রুমা মেয়েটা মা-রাত্মক বাকপটু। আসা-মীদের সঙ্গেও তার গল্প থাকে।

“ এইযে, এখানে বসেন আপনারা। স্যার ফ্রি হলে জানানো হবে।”

স্রোত আর সেই ভদ্রমহিলা বসলেন বেঞ্চটায়। স্রোত এদিক-ওদিক চাইলো। আশেপাশে কত মানুষ। জিহাদও ডেস্কে বসে মনোযোগ দিয়ে কি যেন ঘাটছে। নায়ীবও নিশ্চয়ই ব্যস্ত।
পাশে বসা ভদ্রমহিলা এবার তার দিকে ফিরে চাইলেন। বললেন,
“ শুধু ব্যাগ চু-রি হয়েছে তোমার?”
“ জ্বি।”
“ নাম কি তোমার?”
“ স্রোতশ্রী.”
“ ওহ, আমি শর্মিলা। একা একা ওই নির্জন রাস্তায় কি করছিলে?”
“ ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছিলাম, আন্টি।”
“ কিসে পড়ো?”
“মাস্টার্সে।”
স্রোত নির্বিঘ্নে প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিল। শর্মিলা হাঁপিয়ে উঠলেন। শেষমেশ বললেন,
“ শুনো, একা বের হবানা। সঙ্গে অবশ্যই কাউকে নিয়ে বের হবা। দিনকাল ভালোনা। পুরুষ মানুষ সঙ্গে থাকা লাগে এখন।”
স্রোত নিশ্চুপে মাথা নাড়ে।

ভদ্রমহিলা পুনরায় বললেন,
“ একা বেরোনো মোটেও সেফ না। যদি ব্যাগের বদলে তোমায় আটকাতো! ওই নির্জন রাস্তায় তো কেউ ই বাঁচাতে আসতোনা তোমাকে। বাবা ভাই আছে তো?”
“ আছেন, কিন্তু তারা এখানে থাকেন না।”

শর্মিলার কপালে ভাঁজ পড়ে। বিরক্তি নিয়ে বলেন,
“ থাকেন না? এই শহরে মেয়েকে একা ফেলে রেখেছে?”
স্রোত মাথা নাড়ে,
“ আসলে তা না, আমি আমার হাজবেন্ডের সঙ্গে থাকি।”

শর্মিলা কেমন করে যেন তাকালেন। এই মেয়ে এত হেয়ালিপনা করলো কেন!
উনি পুনরায় বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ তো তা-ই বলো। হাজবেন্ড কই?”
“ উনার কাজ থাকে তো। তাই নিয়ে আসতে পারবেনা।”

শর্মিলা পিটপিট করে তাকালেন। কেন যেন মেয়েটার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা। নাকে দুল নেই, হাতে চুড়ি নেই। বিবাহিত কোনো দিক দিয়েই মনে হচ্ছে। উনি সন্দিহান গলায় বললেন,
“ সত্যি বলছো? তুমি বিবাহিত?”

স্রোত মুখ গোমড়া করে তাকায়৷ মাথায় ভয়া-নক শয়-তানি চাপে। সে মিথ্যা বলবে কেন? ও ভীষণ সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকায়। ওড়নার নিচ থেকে হাত বের করে অনামিকা আঙুলটা উঁচিয়ে ধরে,
“ এইযে,দেখুন। স্বামীর দেয়া রিং। ঘরে দু’টো ছেলেও আছে।”

শর্মিলা হকচকালেন। ওর বলার ভঙ্গিমা অত্যন্ত সিরিয়াস। এইটুকুন মেয়ে, বিবাহিত মানা যায়। কিন্তু দু’টো ছেলে? শর্মিলা কথা বাড়ালেন না। এসেছেন তিনি একটা বিচার দিতে। বাড়ি ওয়ালা ইদানীং তাকে খুব জ্বা:লায়। বাসা ছাড়তে বলে অকারণে। হুম-কি দিয়েছিলেন পুলিশকে জানানোর। ব্যাটা বিশ্বাস করেনি। তাই আজ সত্যি সত্যি বিচার দিতে এসেছেন তিনি। উনি এবার মুখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। সামনে বসে থাকা লেডি কনস্টেবলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ এইযে, আপনাদের স্যার কখন ফ্রি হবেন?”

রুমা বিরক্তি ভরা নয়নে জিহাদের দিকে চাইলো। ক্যাটক্যাটে আওয়াজে বলল,
“ জিহাদ ভাই! স্যার ফ্রি কবে হবেন?”
“ আমি কি জানি, রুমা! দেখছোনা কাজ করছি? অযথা বিরক্ত করোনা। স্যার এমনিতেই আমার ওপর রেগে আছেন।”

“ কেনো রেগে আছেন?”
প্রশ্নটা রুমার করা না। জিহাদের বোধ হলো তা। ও ত্বরিত মাথা ঘুরালো। ডান পাশের বেঞ্চে দুই মানবী বসা। অদ্ভুত চোখে কতক্ষণ ভ্যাবলার মত তাকিয়ে রইল জিহাদ। পরপরই উঠে দাঁড়াল। বলল,
“ আসসালামু আলাইকুম! দাঁড়ান আমি স্যারকে বলে আসছি, ম্যা…”

“ উহু, লাগবেনা। আপনি বসুন। উনার কাজ শেষ হোক।”
স্রোতের উত্তরে বসে পড়ে জিহাদ। রুমা তার দিকে আচম্বিত প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাকিয়ে। জিহাদ ইশারা দিল। রুমা কিচ্ছুটি বুঝলোনা।
জিহাদ শান্ত থাকতে পারছেনা কোনোমতেই। পা দু’টো অনবরত নড়ছে তার। স্যারের মেজাজ ঠান্ডা করার লোক এসে গেছে। স্যারকে জানাতে হবেনা?
ভেতর থেকে লোকগুলো বেরোতেই জিহাদ ছুটলো। যাওয়ার আগে বলল,
“ ম্যাডাম, বসুন। আমি স্যারকে বলে আসছি।”

নায়ীব মাথা হেলিয়ে বসে আছে। জিহাদ ঠকঠক আওয়াজ তুলে দরজায়। গলা উঁচিয়ে বলে,
“ স্যার,আসবো?”
“ আসো।”
নায়ীবের গম্ভীর গলা। জিহাদ ভেতরে ঢুকে। প্রফুল্ল চিত্তে বলে,
“ স্যার, ম্যাডাম এসেছেন।”
“ কোন ম্যাডাম?”

জিহাদ হকচকালো। কি বলবে? স্যারের বউয়ের নামটা সে কিছুতেই মনে করতে পারছেনা বর্তমানে। ও ঠোঁট কাম-ড়ে ভাবুক চিত্তে বলে,
“ ম্যাডাম! মানে স্যার..”
“ কি এত আমতা আমতা করছো? বিরক্ত লাগছে জিহাদ।”
“ ম্যাডাম মানে, স্যার আপনার ওয়াইফ। নামটা মনে পড়ছেনা।”

নায়ীব সরাসরি ওর দিকে তাকায়। সন্দিহান দৃষ্টি। তেজী গলায় বলে,
“ কি? কে?”
জিহাদ যেন পড়লো বিশাল বিপাকে। জবাব দেয়ার আগেই নায়ীব তড়িঘড়ি করে বলল,
“ একা এসেছে?”
“ না, স্যার। সঙ্গে একজন মহিলা দেখলাম।”
“ কখন এসেছে?”
“ মিনিট পনেরো আগে।”
“ গবেট নাকি? এতক্ষণ বলোনি কেনো?”
জিহাদ কিছু বলতে পারলোনা। নায়ীব ফের বলল,
“ যাও, ভেতরে আসতে বলো।”
জিহাদ যতটা খুশি হয়ে এসেছিল, তার চেয়েও অত্যাধিক দুঃখ নিয়ে বেরোলো। আশ্চর্য! সে তো আগেই জানাতো এসে। ম্যাডাম বাঁধ সেধেছে, তার কি করার?
ও গোমড়া মুখে বেরিয়ে এল। স্রোতদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ ম্যাডাম, যান। স্যার ডাকছেন।”

স্রোত উঠলো রয়ে-সয়ে। পাশে বসে থাকা শর্মিলাও উঠলেন। দুজনে ভেতরে যেতেই জিহাদ রুমার কাছে আসে।
রুমা ভ্রু কপালে তুলে, এতক্ষণ পেটের ভেতর জমিয়ে রাখা প্রশ্ন উগড়ে দেয়,
“ কি ইশারা দিচ্ছিলেন,জিহাদ ভাই? আর ওদের আপনি চেনেন নাকি?”
“ একজনকে চিনি রুমা, স্যারের বউ।”

..

নায়ীব কতক্ষণ গাঢ় চোখে স্রোতকে পরখ করল। সবুজ রঙের সুতির জামার ওপর শাল, মাথায় জর্জেটের সাদা ওড়না চাপানো। চুলগুলো এলোমেলো, বোঝা যাচ্ছে ওড়নার ভেতর দিয়ে। হাত-টাত খালি। দেখে মনে হচ্ছে বাসা থেকে শুধু কাপড় পালটে এসেছে। ভার্সিটিতে নিশ্চয়ই এভাবে যায়নি। ও অনেক্ষণ চুপ থাকলো। বোঝার চেষ্টা করলো ঘটনা কী। পাশে বসা মহিলা অনর্গল নিজের কাহিনী বলে গেলেন। স্রোত নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে। ভাবভঙ্গি বোঝা দায়। নায়ীবের কানে কিছুই ঢুকছেনা।
শর্মিলা কথা শেষে বললেন,
“ আপনাদের একটা ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। ওই লোকের জন্য বাসায় দু’দন্ড শান্তিতে থাকতে পারিনা।”
“ কোন লোক?” নায়ীব ভ্রু কুঁচকায়।
ভদ্রমহিলা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“ আর কে, আমার বাড়িওয়ালা।”

“ আচ্ছা, আপনার সমস্যা বুঝতে পেরেছি। এখন আসতে পারেন। চেষ্টা করবো ব্যবস্থা নেয়ার।”
ভদ্রমহিলা পাশ ফিরলেন,
“ তুমি চুপচাপ কেনো? বলো সব, একসঙ্গে বেরবো।”
স্রোত এবার মাথা নুয়ালো। দুহাত ঘ-ষতে ঘ-ষতে বলল,
“ আমার ব্যাগ চু-রি হয়েছে।”

নায়ীব পুরো আধ মিনিট ভ্রু কুঁচকে রইল। পরপরই একটা বড় নিঃশ্বাস টেনে বলল,
“ আবার?”
“ জ্বি।”

ভদ্রমহিলা নায়ীবের এমন নির্লিপ্ততা সহ্য করতে পারলেন না বোধহয়। চটপটে গলায় বললেন,
“ আরে, বুঝতে পারছেন চু-রির সমস্যা কত বেড়েছে ইদানীং? আপনারা দ্রুত ব্যবস্থা নিন। রাস্তা-ঘাটে তো এখন চলাই যায়না।”
নায়ীব শান্ত গলায় স্রোতকে জিজ্ঞেস করল,
“ আপনি ওনাকে চিনেন?”
“ জ্বি, না। রাস্তায় পেয়ে সাহায্য করেছেন।”

নায়ীব এমতাবস্থায় কি বলবে ভেবে পেলনা। সেকেন্ড খানেক চুপ থেকে বলল,
“ আন্টি, আপনি আসুন।”

ভদ্রমহিলা উঠলেন,
“ চলো মা।”
স্রোত জবাব দেয়ার পূর্বেই নায়ীব বলল,
“ উনি থাকুক, আমার সঙ্গে যাবে।”
“ আপনার সঙ্গে কেনো যাবে?”

শর্মিলার বিচলিত কণ্ঠ। নায়ীব নিজেও হকচকালো। স্রোত হতচকিত চোখে চেয়ে,সামান্য হাসলো। ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে বলল,
“ জ্বি না মানে.. আন্টি, উনিই আমার হাজবেন্ড।”

শর্মিলা বিস্ফো-রিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষণ। পরপরই নায়ীবের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। এরপর আবার স্রোতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ এ্যা?”
“ জ্বি, আন্টি। থ্যাংকিউ আপনাকে এত সাহায্য করার জন্য।”
“ ওয়েলকাম,ওয়েলকাম। সুখে থাকো মা, বাচ্চা-কাচ্চা-স্বামী-সংসার নিয়ে খুব সুখে থাকো।”
শর্মিলা অপেক্ষা করলেন না। বিব্রত বোধ নিয়েই চপল পায়ে বেরিয়ে গেলেন।

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪৪

স্রোত চায়ে ছোট-ছোট চুমুক বসাচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো জিহাদ অকস্মাৎ প্রশ্ন করল,
“ ম্যাডাম,চো-রের মুখ দেখেছেন এবারও?”
স্রোত চোখ তুলে বলল,
“ জ্বি না। কিন্তু চো-রের সঙ্গে থাকা বাচ্চার দেখেছি।”
“ বাচ্চা? চো-র কি আন্ডার এইটিন?”
জিহাদ প্রশ্নে মাথা নাড়ে স্রোত। এতক্ষণে মেঘের মত গুড়গুড় করে শেষমেশ মুখ খুলে নায়ীব,
“ মূল ঘটনাটা তো বলুন?”
স্রোত সবটা বললো। নায়ীব আশ্চর্য হলো। এই মেয়ের নির্লিপ্ততা দেখে বোঝাই যাচ্ছিলোনা এত কিছু হয়েছে। মাথায় রাগ চাপলো ওর। দাঁড়িয়ে থাকা জিহাদও বেশ বিব্রত,হতচকিত।
নায়ীব বলল,
“ জিহাদ,যাও।”
জিহাদ সুরসুর করে বেরিয়ে গেল।
নায়ীব উঠে এলো। স্রোতের কাছটায়, টেবিলের ওপর হেলে বসে। তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে অল্প-সল্প ভড়কায় স্রোত। বলে,
“ কী?”
“ আপনাকে এখন থেকে একা ছাড়া যাবেনা, দেখছি।”
নায়ীব আরেকটু ঝুঁকে। মেঘস্বরে প্রশ্ন করে,
“ ওই আন্টিকে কি কি বলেছেন নিজের ব্যাপারে? আন্টি বাচ্চাকাচ্চা সহ দোয়া দিয়ে গেল কেনো?”
স্রোত মুখ তুলে। নায়ীবের দিকে এগোয়। মধ্যিখানে ইঞ্চিখানেক দূরত্ব। স্রোত আচমকাই হেসে বলে,
“ মজা করেছি। উনি বিশ্বাস করছিলেন না আমি যে বিবাহিত।”

..

দিন কয়েক পরের কথা।
দেয়ালঘড়িটা টিকটিক শব্দ তুলছে। ঘড়ির কাটাগুলো ক্রমশ সন্ধ্যা ‘সাত’ এর ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে। স্রোত ম্লানমুখে টিভির সামনে বসে আছে। পাশেই নিশাত বসে আছে, তারও মেজাজ খুব একটা ভালো নেই।
নাবিদ সাহেব ঘর হতে হাঁক ছাড়লেন,
“ নায়ীব কি এসেছে?”
“ আসেনি, আব্বু।” স্রোত জবাব দেয়। পরপরই ঘরটা পুরোদমে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। টিভির আওয়াজ বাদে বাড়তি কিছুর শব্দ নেই। থুতনিতে ঠেকানো রিমোটটা এবার থুতনি থেকে সরিয়ে চ্যানেল পাল্টালো স্রোত। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলল,
“ নিশাত তোমার ভাইকে একটা কল দাও। মাথা ধরে যাচ্ছে আমার। লেট হলে আগে বলতো। আমরা আরো দেরীতে রেডি হতাম। সং সেজে বসে থাকতে কার ভালো লাগে?”
নিশাত হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ে। দৃষ্টি তার টিভিতে,
“ কল ধরছেনা তো ভাইয়া। আবার দিলে যদি ধমক দেয়? ভাবী, তুমি দাও কল।”
স্রোত আড়চোখে তাকালো। ধমক তো শুধু নিশাতকে দেয়, এমন না। স্রোতকেও ধমকায়। স্রোত দৃষ্টি সরিয়ে টিভিতে রাখল। গায়ে তার ঝকঝকে একখানা শাড়ি। শাড়িটা ওর শাশুড়ির। আলমারি ভর্তি শাড়ির একাংশ শাড়িই তার শাশুড়ির। বড় যত্ন করতেন শাড়িগুলোর;তাকালেই বোঝা যায়। স্রোতও যত্ন করে পরেছে। আজ তাদের নায়মার বাসায় দাওয়াত। রাতে ওখানে খাবে। নায়ীব যেতে পারবেনা বলে দুপুরে রাখা হয়নি দাওয়াতটা। সে তারপরও দেরী করছে।

চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে একটা নিউজ চ্যানেলের হেডলাইনে চোখ আটকালো স্রোতের। গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা, ‘এম.পি রাজীব হোসেন পলাতক।’
স্রোত বড়বড় চোখে তাকিয়ে নিশাতকে বলল,
“ এই নিশাত, নিউজটা দেখোতো।”
নিশাত বড্ড ভাবলেশহীনভাবে নিউজটা দেখল। পরমুহূর্তেই স্বাভাবিক গলায় বলল,
“ দেখলাম। কি হয়েছে?”
স্রোত হা হয়ে চেয়ে পুরো নিউজ শুনলো। চটপটে হাতে ফোন তুলে কল দেয় নায়ীব। অথচ মানুষটা রিসিভই করলোনা কল। স্রোত উঠে ঘরজুড়ে পায়চারি শুরু করে দেয়। আচমকা কলিং বেল বেজে উঠতেই ছুট লাগায়।
অবসন্ন নায়ীবের চেহারাটা ম্লান। তাও সে দরজা খোলা স্রোতের দিকে চেয়ে হাসলো। জুতা-জুড়ো খুলে রাখতে রাখতে বলল,
“ সবাই রেডি নাকি?”
নিশাত জবাব দেয়,
“ ভাইয়া, দয়া করে জলদি রেডি হও। আর পারবোনা বসে থাকতে।”
স্রোত একপল নিশাতের দিকে তাকায়। বিরক্তি তার মুখেই প্রকাশ পাচ্ছে। স্রোত লহু কণ্ঠে বলে,
“ রুমে আসুন তো জলদি।”

বলে সে ছুটলো রান্নাঘরে। শরবত বানিয়ে রেখেছিল। সেটা নিয়ে আবার রুমে গেল। নায়ীব শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ওর দিকে তাকালো। শরবতের গ্লাস নিয়ে এক ঢোকে পুরোটা শেষ করে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিলো। তবুও এক পা নড়লোনা স্রোত। হাঁসফাঁস,ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“ বেশি ব্যস্ত ছিলেন নাকি আজ?”
“ হুম।”
শার্টটা খুলে ফেলে নায়ীব। উদাম শরীরের দিকে চেয়ে ঢোক গিলে স্রোত। তার নিজেরই লজ্জা লাগছে। অথচ মানুষটা কি নির্বিকার! ওর চাহনি দেখে আচমকাই হাসলো নায়ীব। বিব্রতবোধে জর্জরিত স্রোত চোখ সরাল। আমতা-আমতা করে বলল,
“ আচ্ছা, নিউজ দেখলাম। এম.পি রাজীবের আবার কি হলো?”

নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। ছোট বাচ্চাটার বিচার হয়েছে। খু*নি শা-স্তি পেয়েছে। একা ভোগেনি অবশ্য। চাচার ওপর ক্ষেপে তার প্রায় সব কু-কীর্তিই ফাঁ-স করে দিয়েছে।
স্রোত পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
“ বলুন না কি হয়েছে!”
নায়ীব সবটা বললো শেষমেশ। সব শুনে স্রোতের মন খারাপ হলো। বাচ্চাটার মা বাবার কি অবস্থা, কে জানে। ও আচমকা প্রশ্ন করল,
“ ওই মেয়েটা কোথায়?”
“ কোন মেয়ে?”
“ ওইযে, এম.পির মেয়ে!” স্রোতের এমন উদ্ভট প্রশ্নে চোখ ছোট ছোট হয়ে আসে নায়ীবের। ওয়াশরুমে যেতে যেতে ভীষণ হতাশার স্বরে ধমকায়,
“ স্রোত! মা-র খাবেন?”
“ কি সাংঘা-তিক! পুলিশ হয়ে নারী নির্যা-তন? দাঁড়ান,আমি আজই কেস দায়ের করব।”
“ ইন্সপেক্টর নায়ীব ইয়াকীন তা সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করতে প্রস্তুত।”
স্রোত মুখ বাঁকাল। নায়ীব মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এল। স্রোত ততক্ষণে বিছানার ওপর শার্ট, জ্যাকেট বের করে রেখেছে। নায়ীব উদাম শরীরেই ঘরজুড়ে পায়চারি শুরু করল। বিছানায় পা দুলিয়ে বসে থাকা স্রোতের বেসামাল দৃষ্টি ঘুরপাক খায় ওই পেটানো শরীরের প্রতিটা ভাঁজে। অদ্ভুত! এমন উদাম হয়ে ঘুরঘুর করছে কেনো সামনে? স্রোতের অস্বস্তি লাগবেনা?
নায়ীব এবার এসে দাঁড়ালো তার সামনে। দু পাশে হাত রেখে ঝুঁকতেই স্রোত মাথা সরালো পেছনে। দরজাটা পুরোপুরি খোলা। যেকোনো সময় কেউ এসে পড়বে। রেড জোনে আছে বলা যায়। ও মৃদু গলায় বলে,
“ কেউ আসবে,সরুন। এসব কি?”
“ এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো,স্রোত? আমাকে আর শার্টলেস দেখেননি কখনো?”
স্রোত বেজায় বিব্রত। হতচকিত চোখ-মুখ তার। আড়ষ্টতা চেহারায় বিদ্যমান। লাল হওয়া গালদু’টোয় সশব্দে ঠোঁট ছুঁয়ালো নায়ীব। স্রোত সঙ্গে সঙ্গেই তেঁতে উঠে,
“ এই,সরুন। আমি অনেক কষ্টে,সময় নিয়ে সেঁজেছি।”
নায়ীব সরার আগে ঠোঁটেও শক্ত চুমু বসালো। এরপর বিছানার ওপর রাখা সি গ্রিন রঙের শার্টটা শরীরে জড়াতে জড়াতে ডাকে,
“ স্রোত!”
“ কি?”
স্রোত উঠে দাঁড়ায় চট করে।
নায়ীব শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে একবার চোখ তুলে তাকায়। শুভ্র বদনে গোলাপি জামদানি শাড়ি,মুখে হালকা প্রসাধনী। গলায়,হাতে গয়না; এখন লাগছে পুরো নতুন বউ। নায়ীব কিয়ৎক্ষণ থম মেরে পর্যবেক্ষণ করে তাকে। আচানক মুখ খুলে,
“ আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা।”
স্রোত বিরক্তিতে চোখ উল্টায়,
“ তো কি করতে ইচ্ছে করছে?”
নায়ীব চোখে চোখ রাখে। ঠোঁটের ভাঁজে মিশে যায় বিস্তর হাসির রেখা,
“ আপনার সাঁজ নষ্ট করতে।”

..

নিশাতের আজ প্রথম পরীক্ষা। ও কোনোমতে পরীক্ষা দিয়ে চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে এসে বসলো ক্যান্টিনে। মিষ্টি বেরোয়নি। পুরো ক্যান্টিনে শুধু নিশাত আর সিনিয়র কয়েকজন ছেলে-মেয়ে। নিশাতের ব্যাচের কেউ নেই। নিশাত গালে হাত ঠেকিয়ে বসলো। পরীক্ষার হল তার কাছে একটা জে-লখানার মত। আর সে আ-সামী। সে সেই জে-লখানা থেকে বেরিয়ে আপাতত ভীষণ শান্তি পাচ্ছে। নেক্সট পরীক্ষার আগে বিশাল এক গ্যাপ আছে। তাতে বিদেশ-টিদেশ চক্করও দেয়া যাবে; ভাবতে ভাবতেই হেসে ফেলে নিশাত। ওমনি কেউ টেবিলে থা-বা দেয়। হাসি মুখটা নিভে যায় অচিরেই। চোখ তুলে তাকানোর পূর্বেই ওয়াহিদ ধপ করে চেয়ারে বসে। নিশাত ভীষণ রাগীকণ্ঠে বলে,
“ এগুলো কি ধরণের অসভ্যতামি? হুটহাট ভূতের মত আচরণ করেন কেনো? দেখে লাগছে র‍্যাগ দিতে এসেছেন!”

ওয়াহিদ বিচলিত হলো বটে। এক নিঃশ্বাসে যে কথাগুলো বলেছে মেয়েটা; তার কিচ্ছুটিই ওয়াহিদ আন্দাজ করতে পারেনি। সে শুধু মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইলো। ও আচানকই কুটিল হাসে। সে হাসি বজায় রেখে বলে,
“ তো কি প্রেম করতে এসেছি নাকি? র‍্যাগ দিতেই এসেছি।”

চলবে.