#তোমার_আমার_প্রেম (কপি নিষিদ্ধ)
#পর্ব_৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
সাজেক থেকে আসার পথে সবার জন্য কিছু না কিছু এনেছে বিবেক ভাই। সবাইকে যার যার জিনিস বুঝিয়ে দিয়ে টুসুকে ডেকে বলল,”এই গাধারাণী এদিকে আয়।”
টুসু এগিয়ে গেল। বিবেক ভাই তার দিকে তাঁতের শাড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”এটা পড়িস ।”
টুসু হেসে বলল,”আমার আপার জন্য কিছু নিয়ে আসোনি?”
বিবেক ভাই সাথে সাথে জানালো,”না।”
জেম্মা বলল,”এ কেমন কথা বিবেক? ওর জন্য কিচ্ছু আনলিনা? বাড়ি এসে যখন জানতে পারবে কিচ্ছু আনিসনি তখন কি তুলকালাম কান্ড ঘটবে তুই জানিস?”
বিবেক ভাই বেশিকিছু বললো না। তবে আপা বাড়ি ফিরে ঠিকই চেঁচামেচি শুরু করে দিল। রাগে দুঃখে অপমানে ওর চোখ ফেটে জল গড়ালো। বিবেক ভাই অবাক হয়ে বলল,
“আশ্চর্য! পকেটে পয়সা ফুরিয়েছে তাই আনতে পারিনি। তোর জন্য এনে টুসুর জন্য না আনলে খারাপ দেখাতো না? তুই বয়সে ওর বড় হয়ে এমন অবুঝের মতো কাঁদছিস কেন?”
আপা রাগে কাঁপছে তখনো। জেম্মা ধরে রেখেছে তাকে। শান্ত করাচ্ছে। বিবেক ভাই আসলে ওর জন্য কিছু না এনে প্রতিশোধ নিয়েছেন। কারণ উনি কিছু বললে আপা তার বিপরীতটাই করে। আপাকে যদি বলে নীল শাড়ি পড়, আপা পড়ে লাল। সারাক্ষণ উনাকে রাগিয়ে দেয়ার তালে থাকে।
বিবেক ভাই আপার সাথে সহজেই রাগেন না যত দ্রুত টুসুর উপর চড়াও হন। তাই শোধটা এভাবেই নিয়েছে সেটা তার ঠোঁটের কোণায় চাপা হাসিটা বুঝিয়ে দিল।
আপা রাতে খাওয়াদাওয়া করলো না। টুসু ভয়ে আপার আশেপাশেও গেল না। রাগলে বিবেক ভাইয়ের মতোই ভয়ংকর লাগে আপাকে। কি যে হবে ভবিষ্যতে। দুটো মিলে বাড়িটাকে তুলে বসাবে। শেষরাতে আপা নিজেই টুসুকে বুকে টেনে নিল। টুসুর খুব খারাপ লাগলো তখন। আপার জন্য কিছু আনলে কি এমন হতো?
দু’দিন পরেই টুসুর অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শুরু তাই বিবেক তাকে ওই কমেন্টগুলোর জন্য বকাঝকা করেনি। তবে পায়েলকে ডেকে বলল,
“ওকে চোখেচোখে রাখতে পারিস না তোরা? সারাক্ষণ ফেসবুকে একটিভ। আজেবাজে কমেন্ট কপিপেস্ট করছে আমার পোস্টের নীচে। আমি এখন ওকে কমেন্ট করা শেখাব?”
পায়েল টুসুকে বকাঝকা করলো। বলল, ওই আইডিতে বেশিক্ষণ একটিভ থাকলে ভাই তোকে মারবে। তুই কি পাগল? উনার আইডিতে গিয়ে কমেন্ট করছিস কেন?”
টুসু চুপ করে আপার কথা শুনলো। কিন্তু কিচ্ছু বললো না। সত্যিই তো। উনার আইডিতে সব উনার বন্ধু-বান্ধব। তারা কি ভাববে তাকে? টুসু সব কমেন্ট রাতারাতি ডিলিট করে দিল। টুসু তার আপাদের সব কথা শোনে। আপারাও তাকে বড্ড ভালোবাসে।
আজেবাজে কমেন্ট করার জন্য মার না খেলেও টুসু সেদিন বিবেকের হাতে মার খেল পরীক্ষার ব্রিফ কুয়েশ্চনের আনসার ভুল করেছিল বলে।
পড়ার টেবিলে বসে টুসু যখন চোখ মুছতে লাগলো
বিবেক তাকে হুমকির স্বরে বলল,”এবার রোল যদি তিন থেকে দুইয়ে না আসতে পারিস তোর কি হাল করবো তুই ভাবতেও পারছিস না। সবার আদরে আদরে বাঁদর হচ্ছিস তুই।”
টুসুর খুব রাগ হলো। কবে যে বাঁদরমুখোটার একটা চাকরি হবে। আর বাড়ি থেকে চলে যাবে। ওর জন্য টুসু ঘোরাঘুরি করেও শান্তি পায় না। খেয়ে শান্তি নেই, কথা বলে শান্তি নেই। সারাক্ষণ দোষ ধরে। হাঁটলে বলে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছিস কেন, দৌড়ালে বলে মাথায় উঠে নাচছিস কেন। টুসু বড্ড বিরক্ত।
___
বিবেক ভাইয়ের ছোট বোন আছে। ওর নাম পায়েল। রাইমার ছমাসের বড় ও। ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে এখন।
কিন্তু টুসুর চোখে পায়েল আপা কেমন যেন। বিয়ে-শাদির বিষয়ে তার কোনো আগ্রহই নেই। রাইমা আপা সবসময় তাকে জোর করে এটাসেটা করানোর চেষ্টা করে। স্কিন কেয়ার থেকে শুরু করে হেয়ার স্টাইল সবকিছু রাইমার নখদর্পনে। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে রাইমাই ওকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেয়।
তারা চার মেয়ে কাজিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজরকাড়া হলো রাইমা আপা। পায়েল আপা দেখতে সুন্দর হলেও স্মার্ট নয়। ও সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
কিন্তু রাইমা আপা যেমন চমৎকার দেখতে, তেমনি আত্মবিশ্বাসী আর বুদ্ধিমতী। ছিপছিপে গড়ন, মিষ্টি চেহারা, আর কোমর অবধি লম্বা ঘন চুল। হাতের আঙুলগুলোও কত লম্বা। আপা মুখে কিছু না মাখলেও সুন্দর। টুসুর সবাইকে বলে বেড়ায় তার আপা সুন্দরী। একদম টিভির পর্দার নায়িকাদের মতো। তার কাকিয়ার মেয়ে রিশাও খুব সুন্দর।
কিন্তু টুসু সুন্দর স্মার্ট কোনোটাই না। মা বলে,”তোর যখন বয়স আঠারো উনিশ বিশ বছর হবে তখন তুই দেখতে সুন্দর হয়ে যাবি। এখন তো বাচ্চা বাচ্চা শরীর।”
বিবেক ভাইও বলেছে, “তুই মোটামুটি আছিস। বিয়ে দিতে কষ্ট হবে না। শুধু তোকে বড় হতে হবে।”
টুসু সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল,
“আপা কত্ত সুন্দর না? ওকে বিয়ে দিতে একদমই কষ্ট হবে না। যে দেখবে তারই পছন্দ হয়ে যাবে। আমার আপার মতো মেয়ে তুমি আর দেখেছ বিবেক ভাই?”
বিবেক ভাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মৃদুতালে মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“না, তোর আপার মতো অমন ঝগরুটে মেয়ে আমি আর দুটো দেখিনি। বিয়ের পর ওর সংসার দু’দিন টিকবে কিনা সন্দেহ।”
_____
বার্ষিক পরীক্ষার পর টুসু একেবারেই ফ্রি হয়ে গেছে। এখন তার কাজ নেচে-কুঁদে দিন পার করা। পড়ার চাপ নেই। রাত হলে বীজগণিত, পাটিগণিত নিয়ে মাথা খাটানি নেই। তার বড় খালাম্মা সেই ভোরে ফোন দিয়ে জানালো,
“টুসু রে বেড়াতে আসবি না তুই? পরীক্ষা তো শেষ হলো।”
টুসু বলল,”না না আমার পায়েল আপার বিয়ের আয়োজন চলছে। হুট করে বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে।”
খালাম্মা বলল,”তাও আয় সোনা। কতদিন দেখিনা তোকে।”
“আপাকে বলো।”
“তোর আপা তো বড়লোক মানুষ। সে আসবে না। তুই আয়। কাল শীতপিঠা খাওয়ার সময় তোর কথা মনে পড়লো।”
টুসু বলল,”আম্মা তো শীতপিঠা খাইয়েছে আমাকে। আচ্ছা দেখি আপার বিয়ের পর যেতে পারি কিনা।”
টুসুর বড় খালা টুসুকে প্রচন্ড ভালোবাসে। খালাম্মার তিনটে ছেলে। একটা মেয়েও নেই। সেই কারণে খালাম্মা টুসু আর রাইমাকে বড্ড চোখে হারায়। বিশেষ করে টুসু। পারেনা ওকে নিজের কাছে রেখে দিতে। কিন্তু টুসু যে এত্তবড় একটা সংসার সামলায় তা কি আর খালাম্মা জানে?
খালাম্মার সাথে কথা বলা শেষ করতেই জেঠুর ডাক পড়লো। টুসু দৌড়াতে দৌড়াতে বাগানে চলে গেল। জেঠুর পেছনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,”কি হলো?”
জেঠু তার হাতে লাল রঙের ঝাঁকা তুলে দিয়ে বলল,”নে নে সবজি তোল। দেখ কত ধরণের সবজি ধরেছে।”
টুসু কোমরে হাত দিয়ে বলল,”ধুর আমাকে ছাড়া কি কিচ্ছু পারো না তোমরা? তোমার বাগানের সবজি তুমি তোলো।”
জেঠু তাকে বকতে লাগলো। টুসু নেচে-কুঁদে রান্নাঘরে এসে ঢকঢক করে ঠান্ডা পানি খেয়ে মাকে বলল,”মা ও মা একবার তুলিদের বাড়িতে যাই?”
মা রেগে তাকালেন। টুসুর হাতে চায়ের ট্রে তুলে দিয়ে বলল,”তোর বাবা আর কাকাকে চা দিয়ে আয়।”
টুসু বিরক্ত হয়ে বলল,”সবকাজ আমাকে দিয়ে করাও।”
“চুপ। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
টুসু চায়ের ট্রে নিয়ে নীচে যাওয়ার পথে বিবেক ভাইয়ের সামনে পড়লো। বিবেক ভাই বলল,”চা নিয়ে যাচ্ছিস?”
টুসু উপর-নীচ মাথা দুলিয়ে বলল,”হু।”
বিবেক একটা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে বলল,
“আর দুটো চা নিয়ে আয়। বাবাও আছে ওখানে।”
টুসু রেগেমেগে বলল,”বাপরে বাপ আমি মরে যাব তোমাদের জ্বালায়।”
বিবেক ভাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘরে চলে গেল। ও নাকি কোথাও একটা ছোটখাটো চাকরি পেয়েছে। মাস্টার্স কমপ্লিট করার আগ পর্যন্ত ওই চাকরিটা করবে। চাকরিটা কি ওটা কাউকে বলেনি। জেঠুরা সবাই জিজ্ঞেস করলেও কিচ্ছু বলেনি। মাঝেমধ্যে এমন চাপা হয়ে যায় সবাই প্রশ্ন করতেও দ্বিধাবোধ করে। আজই চলে যাবে চাকরির জায়গায়।
টুসু বাপ জেঠাকে চা দিয়ে একপলক তার দাদীমাকে দেখতে গেল। সিঁড়িতে বসে রাইমা তখন পায়েলের হাতে মেহেদী পড়াচ্ছিল। টুসু ওদের সামনে বসে বলল,
“আমাকেও একটু মেহেদী পরিয়ে দেবে আপা?”
রাইমা তার দিকে তাকালো। বলল,”তোর পেয়ারি বিবেক ভাইকে বল একটা এনে দিতে। তবে পরিয়ে দেব।”
আপার সাথে বিবেক ভাইয়ের কথাবার্তা আপাততঃ বন্ধ। কথাবার্তা চলে টুসুর মাধ্যমে। টুসু তাদের ডাকপিয়ন। টুসু কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেল দাদীমার কাছে। দাদীমা তাকে দেখে বলল,
“টুসুরে আমারে একটু রোদ দেখা রে বোন।”
টুসু বলল,”অন্যদের বলতে পারো না?”
দাদীমা বলল,”ওদের কত কাজ।”
“আমার বিয়ে হয়ে গেলে কি হবে তোমার?”
“তোকে বিয়েই দেব না।”
টুসুর খুব রাগ হলো। তার বিয়ে করার খুব ইচ্ছে। লাল টকটকে শাড়ি পরবে, হাতে পায়ে লাল টকটকে আলতা পরবে। সেদিন তাকে অপূর্ব দেখতে লাগবে। আর দাদী বলে তাকে বিয়ে দেবে না! এই দোয়া করছে তাকে?
সে দাদীকে বারান্দায় নিয়ে এল। বুড়ি ধীরেধীরে হাঁটে লাঠিতে ভর দিয়ে। অন্য হাত টুসুকে ধরে রাখতে হয়। টুসু তার দাদীমাকে আলাদারকম ভালোবাসে যেটা হয়তো বাকিরা বাসেনা।
দাদীমাকে রোদে বসিয়ে দিয়ে টুসু লাফাতে লাফাতে তুলিদের বাড়িতে চলে গেল।
_______
তুলির মা টুসুকে পছন্দ করেনা। সে এলে বিরক্ত হয়। টুসুকে দেখামাত্র তিনি মুখটা শক্ত করে ফেললেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টুসু মলিন হেসে বলল,
“জেঠিমা তুলি বাড়িতে আছে?”
জেঠিমা তাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার ভালো করে দেখে নিয়ে মুখ ফিরিয়ে বললেন,
“আছে। কিন্তু এখন ঘুমাচ্ছে।”
টুসু একটু ইতস্তত করে বলল,
“সোহাম ভাই আছে?”
এবার জেঠিমা চোখ কুঁচকে তাকালেন। বললেন,
“না রে, সোহামকে নাকি বিবেক ডেকেছিল কোথাও। সেখানে গেছে। কেন? তোর সোহামকে আবার কী দরকার?”
টুসু নিজের ওড়নার কিনারা মুঠোয় চেপে হেসে বলল,
“আমার ফোনে না কি একটা সমস্যা হয়েছে। সোহাম ভাই তো ওসব বেশ জানে। বিবেক ভাইকে বললে খুব বকুনি দেবে। তুমি তো জানো আস্ত ত্যাড়া একটা ছেলে হয়েছে আমার জেম্মার। সারাক্ষণ খালি দোষ ধরে।”
জেঠিমার বিরক্তি আরও বাড়লো। তিনি ভেতরের দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে বললেন,
“তুলি! এই তুলি! টুসুনি কী চায় এসে দেখ তো!”
তুলি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। টুসু তাকে দেখে ছুটে গিয়ে বলল,
“কি রে তুই আমাদের বাড়ি যাসনি কেন? শোন না পায়েল আপার বিয়ে হবে কিছুদিন পর। তুই আর আমি হলুদ শাড়ি পরবো। কেমন?”
জেঠিমা বলে উঠলো,”তোকে হলুদ শাড়িতে মানাবে না রে টুসু। হলুদ শাড়ি ফর্সা মেয়েদের মানায়।”
টুসু হেসে বলল,”আপা আমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে জেঠিমা। বিবেক ভাই বলে আমাকে সাজলে ভালো লাগে কিন্তু আপাকে ভূতের মতো লাগে।”
জেঠিমা চলে গেল। তুলিকে বলে গেল,
“ওর সাথে বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই কিন্তু। ও কার সাথে কোথায় কোথায় যায় তার হিসেব নেই।”
তুলি তার মাকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললো। টুসু তা খেয়াল করলো। তুলিকে বলল,”জেঠিমা কি যে বলে। আমি তো এখনো একটা প্রেমিকও জোটাতে পারলাম না।”
তুলি বলল,”পাগল। এসব শুনলে লোকে হাসবে।”
টুসু বলল,”না রে আমি প্রেম করবো। তারপর বিয়ে করবো। ওই যে কমলিনীর কথা ভাব। ও তো অনেক কালো ছিল। কিন্তু ওর প্রেমিক ওকে দেখার পর বিয়ে করে ফেলেছিল। সবাই কত্ত অবাক হলো। আমাকেও যদি ওরকম কেউ পছন্দ করে সোজা চলে যাব। আমার আর ওই বাড়িতে থাকতে ভালো লাগেনা। কাজ আর কাজ। চলে যাব আমি।”
তুলি হেসে বলল,”তুই করবি প্রেম? হা হা।”
টুসুর বেশ অপমান লাগলো। তাই সে টুসুর পিঠে বসিয়ে দিল একচড়।
___
সারাটা বিকেল টুসু তুলিকে নিয়ে কাটিয়ে দিল তাদের বাগানবাড়ির ছায়াঘেরা বারান্দায়। গাছের পাতার ফাঁক গলে আসা আলো ছায়ার খেলা দেখার পাশাপাশি টুসু তুলিকে অভিনব শারাফের প্রোফাইলটা দেখালো।
প্রথম ছবিটা দেখে তুলি একটু ভুরু কুঁচকালো। ছবিতে ছেলেটার আঙুলের ভাঁজে একটা সিগারেট, সিগারেটের ধোঁয়া ঘন কালো অন্ধকারে ভাসছে। পুরো পরিবেশটাই অদ্ভুত।
দ্বিতীয় ছবিতে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে। পেছনের পরিবেশও ভয় ধরানো। তুলি ছবিটা জুম করে দেখলো। তার জিমে গড়া পেশি আর চওড়া কাঁধ ছবিতে আলাদা বোঝা যাচ্ছে করছে।
তুলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“এ নিশ্চয়ই কোনো ক্রিমিনাল হবে। দেখতে লাগছে যেন কোনো গ্যাংস্টার।”
টুসু হাসতে হাসতে বলল,
“আরে না রে! তবে ও একটু সিরিয়াস টাইপের। ওর নাকি মিস্ট্রি টাইপের ছবি তোলার শখ!”
তুলি সন্দিগ্ধ চোখে বলল,
” এদের মতো ছেলেদের থেকে দূরে থাকাই ভালো।”
টুসু কাঁধ ঝাঁকালো,
“এই দেখ আমার কবিতার পোস্টে কমেন্ট করে বলেছে, আমি দারুণ লিখি।
তুলি কবিতাটা পড়লো,
“মানুষ হাসির প্রেমে পড়ে।
আমি প্রেমে পড়লাম তার হাসির কারণটার।
কারণটা ছিল তার “তুমি”।
আর তার তুমিটাই আমি।”
টুসু বলল,”এটা আপার ডায়রি থেকে নিয়েছি। আপা কত সুন্দর কবিতা লিখে জানিস?”
তুলি চ্যাটগুলো দেখতে দেখতে বলল,”বাবাহ কত কথা বলেছিস তুই।”
টুসু বলল,”কথা না ঝগড়া করেছি। ছেলেটা খুব ঝগরুটে জানিস? আমাকে বলে কিনা মেয়েমানুষ কি চায় সে নিজেই জানেনা। অসহ্য।”
আমি উত্তরে বলেছি, “কয়টা মেয়েমানুষের মন পড়েছে সে। উত্তরে বললো, পড়ার দরকার নেই। আমি লিখলাম, মেয়েমানুষকে ভয় পান সেটা স্বীকার করুন। সে বলল, মেয়েমানুষ অবশ্য আফ্রিকার জঙ্গলে হিংস্র প্রাণীদের চাইতেও বেশি ভয়ংকর। ভয় পাই বললে খুব বেশি মিথ্যে বলবো না।
তুলি মেসেজগুলো পড়তে পড়তে হাসলো। বলল,
“তুই এত ঝগড়া করতে জানিস আগে তো জানতাম না।”
টুসু বলল,”ওকে আমি বলেছি সাহস থাকলে আমাদের জেলায় আসতে। চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে রাখবো। বলে কিনা চট্টগ্রামের মেয়েরা ঝগড়ুটে? আমি তো বলেই দিয়েছি, আপনি একটা বইঙ্গা। আমাকে বলল, চাটগাঁইয়ারা তাহলে বইঙ্গা বিয়ে করে কেন? আমি বললাম, হে হে চাটগাঁইয়ারা বইঙ্গা খায় না। তারপর মেসেজ সিন করে চুপ। মোক্ষম জায়গায় ঢিল ছুঁড়েছি। বল?”
তুলি বলল,”খায় না বলেছিস ওটাতে নিশ্চয়ই মাইন্ড করেছে।”
টুসু বলল,”করুক গে আমার তাতে কি?”
তুলি তার কান্ড দেখে হেসে কূল পেল না। এত্ত ঝগড়া টুসু পারে সেটা তার কাছে অবিশ্বাস্য! টুসু বলল সে ঝগড়া শিখেছে আপা আর বিবেক ভাইয়ের কাছ থেকে।
__
সন্ধ্যা নামতেই টুসু বাড়ি চলে গেল। বিবেক ভাইয়ের সাথে আপার রাতে আবারও ঝগড়া বাঁধলো। ঝগড়াটা বাঁধিয়েছে আপা নিজেই। বিবেক ভাই পুরোটা সময় চুপ। যেন আপার কথা সে কানেই তুলছেনা।
বিবেক ভাই রাতে তার কাজের জায়গায় চলে গেল। যাওয়ার আগে বাড়ির সবাইকে বলল, ও বাড়ি আসার আগে পায়েলকে নয় রাইমাকে যেন বিয়ে দেয়া হয়। এরকম মেয়ে বাড়িতে থাকলে ও থাকবে না। আপা সেই কথাটা শুনে আরও রেগে গেল। চেঁচিয়ে বলল,”
“দিয়ে দাও বিয়ে। আমিও একপায়ে খাঁড়া। এই বাড়িতে থেকে তোমার নাটক দেখতে মোটেও ভালো লাগেনা আমার।”
টুসু পরে জানতে পারলো ঝগড়ার মূল কারণটা ছিল বিবেক ভাই। উনি আপাকে তার সব সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ব্লক করেছে। টুসুর খুব খারাপ লাগলো। রাতে আপা টুসুকে বলল,
“আমার ওভাবে রাগ করা ঠিক হয়নি না? এখন পৌঁছেছে কিনা সেই খবরটাও পেলাম না।”
পরক্ষনেই নিজে নিজেই বলল,”বেশ করেছি। উনার ইগো কি করে ভাঙতে হয় আমার জানা আছে। আমিও কম নাকি? এত ইগো কেন দেখায় আমার সামনে? বারবার কেন আমাকে সব বুঝে নিতে হবে? নিজে কিছু পারেনা। সব আমার উপর চাপিয়ে দেয়। ব্লক করার মজা বুঝিয়ে দেব আমি। আমাকে এখনো চেনেনা।”
টুসু আপাকে সান্ত্বনা দিয়ে শুইয়ে দিল। আপার চোখে ঘুম নামতেই টুসু ফোনটা হাতে নিল। অভিনব শারাফের মেসেজ। টুসুর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটলো। সে চ্যাট করতে করতে প্রোফাইলটা আরও একবার ঘুরলো। অভিনব শারাফ একটা ছবি পোস্ট করেছে। ক্যাপশনে লেখা,
“বিশুদ্ধ তুমি, আমার জন্য নিষিদ্ধ।”
_______
দুদিন পর টুসু আবার হাজির তুলিদের বাড়িতে। তুলি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই টুসু চওড়া হাসি দিয়ে বলল,”এই জানিস কাল কি হলো?”
তুলি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কি হলো?”
টুসু হেসে ফেলে বলল,”ওর সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে। রাতের কম্বলের নীচে শুয়ে শুয়ে চ্যাটিং করেছি।”
তুলি গম্ভীর মুখে বলল,”সাবধান কিন্তু। বইঙ্গার প্রেমে পড়ে যাস না।”
টুসু রাগ করে বলল,
“বইঙ্গা আবার কি? বলবি বঙ্গদেশী।”
তুলি হেসে লুটিয়ে পড়ে বলল,
“বাপরে এত্ত চেঞ্জ! তুই তো পুরো পাল্টে হয়ে যাচ্ছিস এখন থেকে।”
টুসু একটু লাজুক হেসে ঘাড় নীচু করে বলল,
“জানিস কাল সে কি জানতে চাইলো?”
তুলি কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না। বলল,”কি?”
টুসু ফিসফিস করে বলল,”জিজ্ঞেস করলো আমি কাউকে পছন্দ টছন্দ করি কিনা।”
তুলি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো,”মার ছক্কা! কাজ তো প্রায় হয়ে গেছে। তুই কি বললি?”
টুসু মুচকি হেসে বলল,”আমি বলেছি, হ্যাঁ করি।”
তুলির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে বলল,
“মিথ্যে বললি কেন?”
“আরেহ যাচাই করে দেখতে হবে না?”
তুলি চোখ সরু করে তাকালো,
“জেলাস করানোর চেষ্টা করছিস তাই তো?”
টুসু হেসে ফেলে বলল,
“যা! ছেলেরা এসব বুঝতে দেয় নাকি? আমি ওকে আরও নাচাবো বুঝলি? কাল তো বিবেক ভাইয়ের ঘড়ির একটা ছবি তুলে দিয়ে বলেছি এই ঘড়িটা আমার খুব পছন্দ। তারপর চুপ!”
তুলি চোখ বড় করে বলল,”কষ্ট পেয়েছে?”
টুসু ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”এক কথা কেন বারবার বলছিস? ও বিশ্বাসই করতে চায়নি যে আমি কাউকে পছন্দ করি। তাই বিশ্বাস করানোর জন্য ঘড়ির ছবি দিয়েছি।”
তুলি বলল,”দেখ কি বলে। আমাকে জানাস কিন্তু।”
টুসু অনেক গল্পগুজব করে সেদিন চলে গেল। তবে তার পরের দিন আবারও হাজির। তুলিকে দেখেই বলল,
“কাল তো তুমুল ঝগড়া করলাম! ও আমাকে বললো আমার আইডির সাথে নামটা নাকি একদম পারফেক্ট ম্যাচ করে। রাগিনী!”
তুলির কপাল কুঁচকে গেল। ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলো,”এই নামটা কেন দিয়েছে তোর আপা?”
টুসু চারপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হলো কেউ শুনছে না। তারপর মুখটা তুলির কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,”কথা দে। কাউকে বলবি না।”
তুলি সোজা হয়ে বসে বলল,
“বলবো না।”
টুসু তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,”রাগী রাণীর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে রাগিনী। আপা আর বিবেক ভাইয়ের মধ্যে কিছু-মিছু চলে জানিস? সারাক্ষণ ঝগড়া হয় দেখিস না?”
তুলি তার হাতে চিমটি মেরে বলল,
“তাহলে তুই আর তোর অভিনব শারাফের মধ্যে কিছু-মিছু হবে নাকি?”
টুসুর গাল লজ্জায় লাল হয়ে এল। সে বলল,
“আমি তো ওকে দেখিইনি। কিন্তু কি জানিস আমার ওর সাথে ঝগড়া করতে খুব ভালো লাগে।”
তুলি বলল,”ভাই, তুই তো ফেঁসে যাচ্ছিস। সাবধান। খুব সাবধান।”
চলবে..