#তোমার_আমার_প্রেম (কপি নিষিদ্ধ)
#পর্ব_৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দার এক কোণে দাঁড়ালো টুসু। চারদিকে ঘন অন্ধকার, গাঢ় নীরবতা। দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, আর আকাশে মিটমিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলোকে আর আটকালো না। অঝোরে কাঁদলো। তার আপার কষ্টগুলো দূর হয়ে যাক। সে যেন আর কোনোদিন না কাঁদে। তার কষ্টগুলোও দূর হয়ে যাক। কাল ভোরে এক নতুন সূর্য উঠুক। বিবেক ভাই আর অভিনব শারাফ দুজনেই ফিরে আসুক।
কিন্তু কেউ ফিরলো না। না অভিনব শারাফ, না বিবেক ভাই।
পরদিন ভোরে দাদীর অবস্থার আরও অবনতি হলো। দাদী বারবার অস্পষ্ট গলায় একটাই কথা বলছে, “বিবেককে ডেকে আন। আমি ওকে দেখতে চাই।”
টুসু তড়িঘড়ি বিবেক ভাইয়ের ফোনে ডায়াল করলো। বার দুয়েক রিং হওয়ার পর বিবেক ফোনটা ধরলো। খোশমেজাজি গলায় বলল,
“হ্যাঁ বল! কি হয়েছে?”
টুসু কান্নাভেজা গলায় বলল,
“তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি আসো। দাদী কেমন যেন করছে। আর হয়তো খুব বেশি সময় নেই। ও তোমার নাম ধরেই ডাকছে।”
কথাগুলো বলার সময় টুসুর চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরছিল। এক মুহূর্তের জন্য লাইনটা নীরব। তারপর বিবেক ভাই বলল,
“অবস্থা খুব খারাপ? কিন্তু আমি এখন কী করে আসব? কাজের চাপ আছে।”
টুসু স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“তাহলে দাদী মারা গেলেও তুমি আসবে না?”
বিবেক আবার চুপ। টুসুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। গলা ভারি হয়ে গেলেও শক্ত গলায় সে বলল,
“আপার বিয়ে হয়ে গেলেও তুমি আসতে পারবে না?”
বিবেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা আমি দেখছি যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না। তুই আপাতত দাদীর কাছে যা। ভিডিও কল দে।”
টুসু আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না দাদীর ঘরে চলে গেল। ঘরে ঢুকেই দাদীর নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলানোর শেষ চেষ্টা করলো টুসু। কিন্তু কান্না আটকে রাখতে পারলো না। কেঁদে উঠে ভিডিও কলে দাদীমাকে দেখাতে লাগলো। দাদীর ক্লান্ত, অস্পষ্ট চোখগুলো ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কোনো কথা বলতে পারছিল না। এদিকে হঠাৎই জেম্মা ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে রাগে ফেটে পড়লো।
“তুই কেমন ছেলে রে বিবেক? তোর দাদী তোকে দেখতে চাইছে। আর তোকে বলে বলে আনতেও পারছি না! চাকরিটা তোর কাছে এত বড় হয়ে গেল?”
বিবেক ভাই বিরক্ত গলায় বলল,
“মা শোনো দাদীর সামনে এমন কেঁদো না। উনি ভয় পাবে। তোমরা সবাই এমন মরাকান্না করছো কেন? দাদী আরও অনেকদিন বাঁচবে। আশ্চর্য! এই গাধারাণী!”
জেম্মার মুখ রাগে লাল হয়ে উঠলেও সে কিছু বলতে পারলো না। টুসু ফোনটা দ্রুত নিয়ে নিল। ব্যাক ক্যামেরায় দেখা গেল রাইমা দাদীর শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। তার চোখমুখ কান্নায় লাল হয়ে আছে।
টুসু ক্যামেরাটা বন্ধ করলো। কান্নার মধ্যেই বিবেক ভাইকে বলল,”এখন কী করব?”
বিবেক ভাই দ্রুত বলল,
“সবাইকে ঘর থেকে বের করে দে। দাদীর পাশে শুধু তুই থাক। সবাই মিলে কান্নাকাটি করে দাদীকে আরও অস্থির করে তুলছিস। আমি লাইনে আছি। যা বলছি তাই কর।”
টুসু মাথা নাড়লো। সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
” সবাই একটু বাইরে যাও।”
একটু খাটুনির পর সবাই বেরিয়ে গেল। টুসু ঘরের দরজাটা বন্ধ করে ধীরে ধীরে দাদীর পাশে বসলো। ফোনটা হাতে ধরে বলল,
“বিবেক ভাই তুমি কথা বলো। দাদী শুনছে।”
দাদীমা ঠোঁট নাড়তে লাগলেন, যেন বলতে চাইছেন কিছু। গত রাত থেকেই তিনি ধীরে ধীরে কালেমা পড়ছেন। টুসু চোখের জল মুছতে মুছতে ফিসফিস করে বলল,”এমন করে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”
কান্না থামাতে পারলো না টুসু। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে একের পর এক দাদীর সামনে তার মধুর মুহূর্তগুলো ভেসে উঠতে লাগলো। দাদীর সেই রূপকথার গল্প, ভূতের গল্প, ছড়াগুলো। হঠাৎ মনে হলো এই মুখ, এই কোমল হাত সবকিছু চিরতরে চলে যাবে। মাটির নিচে ঠাঁই হবে তার। কিন্তু দাদী সেখানে কিভাবে থাকবে? অন্ধকার কবরে?
ঠিক তখনই বিবেক ভাই গম্ভীর গলায় হুংকার দিয়ে বললেন,”টুসু কান্না বন্ধ কর। দাদীর সামনে এভাবে কাঁদবি না।”
তার ধমক টুসুর ভিতরে ঝাঁকুনি দিল। সে দ্রুত চোখ মুছলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করলো।
বিবেক ভাই ফোনের ওপার থেকে ধীরে ধীরে দাদীকে ডাকতে শুরু করলেন,
“দাদী আমি বিবেক। শুনতে পাচ্ছো তুমি?”
দাদী অস্পষ্ট কণ্ঠে তাঁর নাম উচ্চারণ করলেন। বিবেকের গলা আরও নরম হয়ে এল।
“তোমাকে আরও অনেকদিন বাঁচতে হবে দাদী। অনেকদিন। এই গাধারাণীর বিয়ে খেতে হবে তো! বুঝেছ?”
কিন্তু দাদীর শীর্ণ মুখে কোনো সাড়া নেই। টুসু জানে দাদী এভাবেই জীবনের শেষ দিনগুলোর হিসেব করছেন।
দাদী হঠাৎ করে টুসুর দিকে তাকালেন। সেই চোখে টুসুর জন্য অনেক মায়া আর অনুচ্চারিত বিদায়ের ভাষা। তারপর দাদী তাঁর কাঁপা হাতটি নাড়ালেন। টুসু দ্রুত সেই হাতটা নিজের মুখে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“দাদী আমায় ছেড়ে যেও না। তুমি ছাড়া আমি কীভাবে থাকব?”
হঠাৎ দাদী ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন। টুসু তা দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে কান্নায় ভেঙে পড়লো। গলা কাঁপিয়ে বলে উঠলো,
“তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছ দাদী। এত ভালো সই আমি কোথায় পাব? তুমি এভাবে চলে গেলে আমার কী হবে? আমার পক্ষ হয়ে কে কথা বলবে? কে আমাকে আগলে রাখবে?”
টুসুর কণ্ঠ দমে এল। দাদীমাও টুসুর সঙ্গে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ওই তো মৃত্যু! আর মাত্র কিছুটা দূরেই। ফোনের ওপার থেকে বিবেক ভাই নাতি-নাতনির এমন করুণ কান্না শুনে নিশ্চুপ।
টুসু দাদীর চোখের জল মুছে দিয়ে কাঁপা গলায় বলল,”হয়েছে দাদী। আর কান্না নয়। বিবেক ভাই তুমি কবে আসছো?”
বিবেক ভাই গম্ভীর সুরে বলল,
“জানিনা। আমি কিছুক্ষণ পরপর ফোন দিয়ে দাদীকে দেখব। আর চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফেরার।”
টুসু একটু থেমে বলল,
“আপার সঙ্গে একটু কথা বললে ভালো হতো।”
বিবেক বিরক্তি চেপে উত্তর দিল,
“হ্যাঁ বলব। কিন্তু এখন আমার সময় নেই।”
টুসু ক্ষোভ চাপতে পারল না। বলল,
“সময় নেই? এটা কেমন কথা বিবেক ভাই?”
বিবেক হঠাৎ অবাক হয়ে বলল,
“তুই এত বড়দের মতো করে কেন কথা বলছিস?”
টুসু তীক্ষ্ণ গলায় উত্তর দিল,
“তোমার মায়া হয় না আপার জন্য?”
বিবেক কুণ্ঠিত হয়ে বলল,
“কেন হবে?”
টুসু ধৈর্য হারিয়ে বলল,
“ওর বিয়ের কথাবার্তা প্রায় ফাইনাল হয়ে যাচ্ছে, আর তুমি? এসব শুনেও তোমার বুক কাঁপে না? তুমি এত আবেগহীন কেন বিবেক ভাই?”
বিবেক ভাই এবার তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“তোর আপার বিয়ে হচ্ছে। আমি কেন কাঁদব? শোন বড় বড় কথা বলবি না। তুই ছোট। ছোট মেয়ের মতো থাক। বেশি পাকনামি করিস না। তোর আপাকে তোর চাইতে আমি ভালো চিনি। বেশি পাকনামি করলে এক চড়ে কান লাল করে দেব। এবার ফোন রাখ।”
টুসু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফোনটা কেটে দিল। ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠে বলল, পাষাণ মানুষ।
____
তুলি আর তুলির মা বিকেলের দিকে দাদীমাকে দেখতে এল। তুলির মা টুসুর দাদীর পাশে বসে মা আর জেম্মার সঙ্গে গল্পে মশগুল। টুসু চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকতেই তুলি বলল,”আমি চা খাব না রে।”
টুসু ট্রেটা টেবিলে রেখে তুলির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,”ছাদে যাবি?”
তুলি প্রথমে মায়ের দিকে তাকালো। মা মাথা নাড়তেই তুলি হেসে টুসুর হাত ধরে ছাদের দিকে রওনা হল।
ছাদে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তুলি টুসুর পিঠে এক চড় বসিয়ে দিল। রাগে বলল,
“বেয়াদব মেয়ে। তুই গেলি না কেন?”
টুসু একটু পিছিয়ে এসে বলল,
“বাড়িতে কী চলছে তুই জানিস? আপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পায়েল আপাকে দেখতে আসা পাত্রপক্ষ আপাকে পছন্দ করে গেছে। এদিকে আপা বিয়েতে রাজি না। কিন্তু বাবার মুখের উপরে কিছু বলার সাহস নেই। কীভাবে বলবে? ওর সাথে তো বিবেক ভাইয়ের…”
তুলি কথা থামিয়ে দিয়ে অধৈর্য গলায় বলল,
“তাহলে বিবেক ভাই কী করছে?”
“ওদের তো ঝগড়া চলছে। কেউ কাউকে বুঝতে চায় না। যদিও আপা একটু বুঝেছে, কিন্তু বিবেক ভাই আর দেখা দিচ্ছে না। এমনকি ফোনেও কথা বলছে না আপার সঙ্গে। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
তুলি এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
“আর অভিনব?”
নামটা শুনে টুসু চমকে উঠলো। বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত কাঁপন ধরলো। যাকে কোনোদিন চোখে দেখেনি, ভালো করে চেনেও না, সেই ছেলের জন্য মনটা এত অস্থির হয় কেন?
অভিনবের সেই মেসেজগুলো মনে পড়ে গেল তার।ছোট ছোট আলাপগুলো টুসুর একঘেয়ে জীবনের মাঝে ঝড় তুলেছিল। তার সরল, আন্তরিক কথাগুলো টুসুর শূন্য জীবনে আলো এনে দিয়েছিল। অথচ সেই মানুষটা হঠাৎ করে হারিয়ে গেল।
তুলি টুসুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” কী ভাবছিস রে?”
টুসু তাড়াতাড়ি নিজের ভাবনায় লাগাম টেনে নিয়ে মৃদু হাসলো।
“কিছু না।আমি ওসব ভুলে গেছি।”
তুলি অবাক হয়ে বলল,”তোর একটুও খারাপ লাগছেনা?”
“না। আমার মনে হচ্ছে ও বুঝে গেছে আমাকে ওর পছন্দ হবে না। তাই সরে পড়া ভালো।”
কথাগুলো বলার সময় টুসুর চেহারাটা মলিন হয়ে এল। ছোট থেকেই সে শুনে এসেছে বাড়ির সব মেয়েরা সুন্দর হওয়ায় বিয়ে দিতে কষ্ট না হলেও টুসুকে বিয়ে দিতে কষ্ট হবে। কারণ তার গায়ের রঙ সবার চাইতে কালো। তাদের বাড়ির ছেলেমেয়ে সবাই সুন্দর শুধু টুসু ব্যতিক্রম। ছোটবেলায় সে হেসে উড়িয়ে দিলেও এখন সে বুঝতে পারে সবাই কথাগুলো এমনি এমনি বলতো না। অভিনব শারাফ নিশ্চয়ই বুঝে গেছে সুন্দর মেয়েরা কোনোদিন গায়ে পড়ে কথা বলেনা। অসুন্দর মেয়ে বলেই সে গায়েপড়ে কথা বলছে। তাই হয়তো আইডিটাতে একটিভ হচ্ছে না।
কতকিছু যে মনে এল টুসুর। মনের ভেতর যে তোলপাড় চলছিল সেটা সে তুলিকেও দেখালো না। অথচ আড়ালে ঠিকই চোখের জল পড়েছে এটা ভেবে সবাই যা বলতো সবকথা সত্যি। সে অসুন্দর বলে কারো ভালোবাসা পাওয়াও তার জন্য নিষিদ্ধ। সত্যিই তো আয়নার সামনে দাঁড়ালে আপা, পায়েল আপা আর রিশাকে কত সুন্দর লাগে। আর সে? সেলফি তোলার সময় ওদের মাঝখানে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে। ছোট্ট রিশা শিশুসুলভ কন্ঠে সত্যি কথাটা বলে ফেলে এই বলে,”টুসু আপুকে বাজে লাগছে।”
আপা আর পায়েল আপা ওকে ধমকে টুসুকে সান্ত্বনা দিলেও টুসুর খারাপ লাগাটা ঠিকই থেকে যায়। কোথাও বেড়াতে গেলে সবাই অবাক হয়ে বলে রাইমার বোন ও? বোঝায় যায় না। দুই বোনের একটুও মিল নেই।
বিবেক ভাই যে মাঝেমধ্যে মজা করে বলতো তোকে কাকা কুড়িয়ে পেয়েছে ওটা সত্যি হলে কতই না ভালো হতো। অন্তত নিজেকে সে সান্ত্বনা দিতে পারতো এই বলে, সে এদের কেউ না।
টুসুর বয়ঃসন্ধির সময় পার করছে। মনে কত উতালপাতাল ভাবনা আসে তার। ওর কষ্ট লাগে খুব। কিন্তু সেসব কথা শুনে যদি কেউ হাসে তাই সে বলেনা। শুধু তুলিকে বলে। কিন্তু তুলিকেও বলতে ইচ্ছে হয় না আজকাল। টুসুর সব কথা শোনার মানুষ যদি অভিনব শারাফ হতো? কি এমন ক্ষতি হতো? কথা শোনার মানুষের বড্ড অভাব এই পৃথিবীতে। মা বাবা সবসময় সান্ত্বনা দিয়েই যায়। কিন্তু ওসব টুসুর শুনতে ইচ্ছে করেনা। আপন মানুষেরা তিক্ত সত্যিটা বলে কষ্ট দিতে চায় না সেটা টুসু বুঝে গেছে এই কয়েকদিনে। দাদী একমাত্র তাকে বুঝতো। কিন্তু সেও চলে যাবে যাবে করছে।
দিনগুলো এভাবেই চলে যাচ্ছিল। দাদীমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। বিবেক ভাই হাসপাতালে আসবে বলেছে। আব্বা ছোট করে আপার বিয়ের বন্দোবস্ত করার জন্য ছোটাছুটিতে আছেন। দাদীমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে চান। যেকোনো একটা নাতনির বিয়ে তিনি দেখে যেতে চান। অবশ্য এসব দাদীমার মুখের কথা নয়। জেঠু আর আব্বারা নিজেদের কথা দাদীমার হয়ে চালিয়ে দিয়েছেন।
_____
আরও এক সপ্তাহ চলে গেলেও দাদীমার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরঞ্চ অবনতি হচ্ছে দিনদিন। হাসপাতালের খাটুনিতে ক্লান্ত, অবসন্ন, টুসুর মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে এই এক সপ্তাহে। তার সব ছেড়েছুড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেদিনই ঘটলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি।
অভিনব শারাফের নামের পাশে সবুজ বাতিটা জ্বলে উঠেছে হঠাৎ আর নিউজফিডে একটি পোস্ট। ছবিতে বুকের ক্ষত, ব্যান্ডেজ, সেলাই আরও রক্তাক্ত কিছু ভয়ানক দৃশ্য। এত আঘাত, এত ক্ষত! ক্যাপশনে লেখা,”এইতো মৃত্যু দেখলাম।”
টুসুর বুকটা এক লহমায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেল সব কিছু। কি করবে কিছুই বুঝতে পারলো না। চোখে জল জমে উঠলো। চোখ ঝাপসা। গলা শুকিয়ে এসেছে। হৃদপিণ্ডটা শব্দ করছে। সাথে সাথে তার মেসেঞ্জারে নোটিফিকেশন। টুসু চোখ বুঁজে নিল। আবার চোখ মেলে মেসেজটা পড়লো,
“এইতো আমি এখানে। বেঁচে আছি। ফিরে এসেছি হয়তো তোমারি জন্য।”
বলেই একটা ইমুজি দিল যেটা দেখে টুসুর রেগে যাওয়াটা স্বাভাবিক।
টুসুর চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। কাঁপা কাঁপা হাতে সে মেসেজের রিপ্লাই দিল,”আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।”
অভিনব শারাফ মেসেজটি সিন করলো। লাভ রিয়েক্ট দিয়ে লিখলো,
“আমিও তোমাকে মিস করেছি। কাল স্বপ্নে কি দেখলাম জানো?”
টুসু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি?”
অভিনব লিখলো,
“দেখলাম তুমি আর আমি রাতের চাঁদের আলোয় সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছি। হঠাৎ তুমি দৌড়ে দৌড়ে সমুদ্রের মধ্যে হারিয়ে গেলে। আমি তোমাকে ডাকলাম। তুমি শুনলে না। আমি তোমাকে আবারও ডাকলাম। সমুদ্রের গর্জনের সাথে সাথে তোমার হাসির শব্দ ভেসে এল, কিন্তু তুমি এলে না।”
টুসু একটু থামলো। লিখলো,”তারপর?”
অভিনব লিখলো,
“তারপর স্বপ্নটা থেমে গেল।”
টুসু কল্পনায় হারিয়ে গিয়ে বলল,
“যদি বাস্তবে এমনটা হয়?”
অভিনব শারাফ চুপ হয়ে গেল। কেন চুপ টুসু জানেনা। অথচ টুসু আর অনেককিছু শুনতে চাচ্ছিল। কিন্তু বুকের ভেতর অনবরত চলতে থাকা ধুকপুকানি, অস্থিরতা তাকে শান্ত হতে দিল না। মনে হলো তার ভেতরে যেটা চলছে সেটা বলেই ফেলি।
সে চোখের জল মুছতে মুছতে অনুভূতিগুলো শব্দে বন্দি করে সজোরে শ্বাস নিয়ে, আস্তে আস্তে লিখলো,
“তোমাকে একটা কথা বলি?”
অভিনব শারাফ মেসেজ সেকেন্ডের মধ্যে পড়ে উত্তর দিল, “একটায় হবে না।”
টুসু ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস নিল। বলবে নাকি বলবে না? ও কি মনে করবে? গায়েপড়া বেহায়া? টুসু তারপরও লিখলো,
“তোমার খোঁজ না পেয়ে আমার খারাপ লাগছিল খুব। মানে কেমন লাগছিল আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আমার এরকম কখনো লাগেনি। আমি নিজেকে সামলাতে চাইলাম কিন্তু তারপরও কষ্টটা কমলো না। কেন এমন হলো?”
অভিনব কিছুক্ষণ চুপ থেকে লিখলো, “এটাই তো স্বাভাবিক।”
টুসু অবাক হয়ে লিখলো, “কেন স্বাভাবিক?”
অভিনব সোজা উত্তর দিল, “এটা প্রেমে পড়ার লক্ষ্মণ। তুমি আমাকে তোমার প্রেমিক সেজে তোমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছ। তো তোমাকে প্রেমিকা হতে হবে, তাই না? আর প্রেমিকার মধ্যে প্রেমের লক্ষ্মণ তো থাকবেই।”
টুসু লিখলো, “মানে?”
তারপর অভিনব যা বললো টুসু কল্পনাও করেনি সে এভাবে বলে দেবে। অভিনব সোজাসাপটা কোনো জড়তা ছাড়াই লিখলো, “মানে ইউ লাভ মি, রাগিনী। আই থিংক, মি অলসৌ।”
টুসু সাথে সাথে ফোনটা চেপে বন্ধ করে দিল। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়লো যা থামার নয়। কি যেন ভেবে অজস্র কাঁদলো বসে বসে। দাদী তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। ওই চোখদুটো যেন তাকে বলছে, আমার পর ওই তোকে ভালো বুঝবে। টুসু কান্না থামালো। আবারও কাঁদলো। চোখ মুছলো ভালো করে। চোখদুটো তারপরও ভিজে আসতে লাগলো। সে দ্রুত ফোনটা অন করলো। তারপর বুকের ভার কমিয়ে লিখলো,
“আমিও আমিও। আই লাভ ইউ অভিনব শারাফ।”
চলমান….